আল মুতামাদ আলাল্লাহ

আল মুতামাদ আলাল্লাহ আবুল আব্বাস (আবু জাফর) আহমাদ বিন মুতাওয়াক্কিল বিন মুতাসিম বিন রশীদ ২২৯ হিজরিতে ফিতয়ান নামের রোমান বাঁদির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।

মুতামাদ নিহত হওয়ার সময় তিনি জুসিকে বন্দী ছিলেন। তাকে বের করে লোকেরা তার হাতে বাইয়াত করে। তিনি তার ভাই মোফিক তালহাকে পূর্বাঞ্চলীয় গভর্নর নিয়োগ করেন। পুত্র জাফরকে উত্তরাধিকার মনোনীত করে মিসর ও পশ্চিমাঞ্চলীয় গভর্নর পদে নিয়োগ দেন। তার লকব ‘মফুয ইলাল্লাহ’ রাখা হয়। তিনি আরাম আয়েশ, খেলাধুলা আর মুসলিম উম্মাহ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়লে জনসাধারণ অসন্তুষ্ট হয়ে তার ভাই তালহার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

মুহতামাদের খিলাফতকালে বসরা আর তার পার্শ্ববর্তী জনপদগুলো দস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হয়। দস্যুরা শহরে নারকীয় তান্ডব চালায়, লুণ্ঠন করে শহরময় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। মুসলিম বাহিনীর সাথে তাদের লড়াই হয়। এরপর ইরাকে মহামারী ছড়িয়ে পড়ে, এতে সহস্রাধিক মাখলুকের প্রাণহানি ঘটে। মহামারির পর ভুমিকম্পেও সহস্রাধিক পশু-প্রাণীর জীবন সাঙ্গ ঘটে।

এদিকে ২৭০ হিজরি পর্যন্ত দস্যুদের সাথে লড়াই চলতে থাকে। এ বছর দস্যু সর্দার বাহবুদ (আল্লাহ তার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করুন) নিহত হয়। সে রিসালাতের দাবী করে বলতো, আমি আলিমুল গায়েব। সে ১৫ লাখ মুসলমানকে হত্যা করেছিলো। সে একদিনে বসরায় ৩ লাখ মুসলমান হত্যা করে। সে মিম্বরে দাঁড়িয়ে উসমান, আলী, মুআবিয়া, তালহা, যুবায়ের আর আয়েশা (রাঃ) কে গালি দিতো। এক এক উলুবিয়া নারীকে ২/৩ দিরহামে নিলামে বিক্রি করতো। একেক দস্যুর কাছে দশজন উলুবিয়া নারী বাঁদি হিসেবে ছিল। এ অসৎ লোকটি নিহত হলে তার কাটা মাথা বর্শায় গেঁথে বাগদাদের পথে ঘোরানো হয়। এতে করে লোকেরা আনন্দ করে আর দস্যুদের সাথে লড়াইরত মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক তালহাকে ধন্যবাদ জানায় আর কবিগণ তার প্রশংসায় কাব্য রচনা করেন।

সূলী বলেনঃ এ যুদ্ধে আনুমানিক এক কোটি লোক জড়িয়ে পড়ে।

২৬০ হিজরিতে ইরাকে ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, ফলে এক বস্তা গমের দাম একশো দিনারে গিয়ে পৌঁছে। এ বছর রোমানরা লুলু শহর দখল করে নেয়।

২৬১ হিজরিতে পুত্র জাফরকে উত্তরাধিকার আর তারপর ভাই তালহাকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। জাফরকে শাম, জাযিরা আর আর্মেনিয়ার গভর্নর পদে নিয়োগ দেন। আর তালহাকে ইরাক, বাগদাদ, হিজায, ফারিস, ইস্পাহান, রায়, খুরাসান, তবরিস্তান, সিজিস্তান ও সনদের গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনি দুজনের জন্য পৃথক দুটো পতাকা নির্বাচন করেন। সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারপতিকে ডেকে উভয়ের মাঝে লিখিত চুক্তি সম্পাদন করেন যে, জাফরের অবর্তমানে তালহার রায় চূড়ান্ত। এ চুক্তিপত্র প্রধান বিচারপতি ইবনে আবু শাওয়ায়িব খানায়ে কাবার দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেন।

২৬৬ হিজরিতে রক্ত ঝরিয়ে দেয়ারে বকর জনপদটি দখল করে নেয়। ফলে জাযিরাবাসী আর মৌসুলবাসী সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এ বছর গ্রাম্য লোকেরা কাবা শরীফের গেলাফ চুরি করে নিয়ে যায়।

২৬৭ হিজরিতে আহমাদ বিন আবদুল্লাহ আল হিজাবী খুরাসান, সিজিস্তান আর কারমান দখল করার পর ইরাক দখলের পাঁয়তারা করলে তার গোলামরা তাকে হত্যা করে।

২৬৪ হিজরিতে মুতামাদের ভাই মুফিক (তালহা) সেনাবাহিনীসহ মুতামাদের উপর আক্রমণ করে। এতে মুতামাদ মর্মাহত ও হতাশ হোন। অবশেষে ২৬৯ হিজরিতে মিসরের ডেপুটি প্রশাসক ইবনে তুলুনের সাথে মুতামাদের পত্রাদি বিনিময়ের মাধ্যমে যে কথা হয়, তার ভিত্তিতে ইবনে তুলুন সসৈন্যে আর মুতামাদ সামরাহ থেকে দামেশকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। এ সংবাদ পেয়ে মুফিক লিখিতভাবে ইসহাক বিন কান্দাজকে জানালো, যে কোনভাবে মুতামাদকে ফিরিয়ে আনতে হবে। ইসহাক নাসিবীন শহর থেকে মুতামাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। মৌসুল আর হাদীসার মধ্যবর্তী স্থানে উভয়ের সাক্ষাৎ হলে ইসহাক বললো, “আমিরুল মুমিনীন, আপনার ভাই আপনার দুশমনদের সাথে লড়াই করছে, আর আপনি খিলাফতের রাজধানী ছেড়ে কোথায় চলেছেন ? শত্রুরা জানোতে পেলে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ করে আপনার বাপ-দাদার সাম্রাজ্য দখল করে নিবে, আর সে সময় আপনার কিছুই করার থাকবে না।”

মুতামাদের গতিবিধির উপর ইসহাক সবসময় নজর রাখার জন্য বিশ্বস্ত কিছু লোক নিযুক্ত করেছিলো। সে মুতামাদকে জানালো, “এ স্থান আপনার জন্য নিরাপদ না, এখান থেকে ফিরে যেতে হবে।” মুতামাদ বললেন, “আমার কাছে শপথ করো যে, তোমরা আমাকে কষ্ট দিবে না আর আমাকে শত্রুর হাতে তুলে দিবে না।” ইসহাক শপথ করলো, এরপর তিনি সামরাহ’র দিকে রওয়ানা করেন। পথিমধ্যে মুফিকের কেরানি সাদ বিন মুখাল্লাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। মুতামাদকে সাদের কাছে ইসহাক হস্তান্তর করে। সে অন্যত্র চলে যায়। সাদ তাকে রাজধানিতে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। সে তাকে আহমাদ বিন খাসীবের বাড়িতে নিয়ে যায় আর পাঁচশো অশ্বারোহী মুতামাদকে রাজধানীতে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্য নিযুক্ত রাখে। সংবাদ পেয়ে মুফিক ইসহাককে বৃত্তি ও জায়গীর প্রদান করে আর ‘যুল সানাদাইন’ উপাধি দেয়। আর সাদকে ‘যুল ওয়াযারাতাইন’ উপাধি দেয়।

মুতামাদ সাদের হাতে গৃহবন্দী ছিলেন। তার কোন কাজ করার ইখতিয়ার ছিল না। তিনি নিজের এ অপারগতা ও অসহায়ত্বকে উপজীব্য করে একটি কবিতা রচনা করেন – “আশ্চর্য! আমি বাদশাহ, অথচ আমার ইখতিয়ারে কোন জিনিস নেই! আমি বাদশাহ হয়েও আমার লোকবল কম।”

তিনি প্রথম খলীফা – যিনি নিপতিত হোন, তার উপর লোকের পাহারা বসানো হয় আর তার অপবাদ ছড়ানো হয়। এরপর মুতামাদ মধ্যস্থতায় আসেন। এ খবর পেয়ে ইবনে তুলুন বিচারক আর আমীর উমরাহদের ডেকে বললো, মুফিক আমিরুল মুমিনীনকে বন্দী করে রেখেছেন, তাই তার বাইয়াত থেকে পৃথক হওয়া উচিত। কাযী বাকার বিন কীতীয়াহ ছাড়া সকলেই সমর্থন জানালো। কাযী বাকার বললেন, “তোমরাই প্রথমে আমার সামনে মুতামাদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ফরমান পেশ করেছো, যার কারনে তাকে উত্তরাধিকার বানানো হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা স্বয়ং মুতামাদের কাছ থেকে তার পৃথকীকরণের হুকুমনামা না দেখাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি অনুমতি দিবো না।” এর জবাব ইবনে তুলুন বললো, “এ মুহূর্তে মুতামাদ বন্দী আর গযবে নিপতিত, এজন্য তিনি ফরমান লিখতে পারবেন না।” কাযী বাকার বললেন, “আমি এ অবস্থায় কোন হুকুম দিতে পারি না।” ইবনে তুলুন বললো, “পৃথিবীব্যাপী প্রসিদ্ধ যে, কাযী বাকার এতো অনন্য ও অদ্বিতীয় বিচারক, এজন্য তোমার অহংকার হয়েছে। আসলে তোমার বিবেক বৃদ্ধতার দংশনে ক্ষত-বিক্ষত।” এ কথা বলে ইবনে তুলুন কাযী বাকারকে বন্দী করলো আর যতগুলো উপহার সামগ্রী তাকে দেওয়া হয়েছিলো, সবগুলো জব্দ করা হলো। এর আনুমানিক মূল্য ছিল দশ হাজার দিনার। কথিত আছে, এ কথা জানোতে পেরে মুফিক বললো, “তোমরা মিম্বরে আরোহণ করে ইবনে তুলুনকে অভিশাপ দাও।”

২৭০ হিজরিতে মুতামাদ সামরাহতে ফিরে আসেন। এ সময় তার সাথে সবসময় একদল সৈন্য থাকতো, যা দ্বারা মনে হতো তিনি পূর্ণ স্বাধীন। এ বছর ইবনে তুলুনের ইন্তেকাল হয়। মুফিক তদস্থলে নিজের ছেলে আবুল আব্বাসকে মিসরের গভর্নর নিয়োগ করে। আবুল আব্বাস একদল সৈন্যসহ মিসরে যায়। এদিকে খামারিয়া বিন আহমদ বিন তুলুন আগেই বাবার আসনে অধিষ্ঠিত হয়। উভয়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এতে মিসরবাসীর ললাটে বিজয় চুম্বন করে। এ বছর বাগদাদে দজলা নদীর বাঁধ ফেটে যাওয়া বাগদাদ নগরী প্লাবিত হয়। এতে করে সাত হাজার ঘরবাড়ি ধ্বসে পড়ে। এ বছর রোমানরা এক লাখ সৈন্য নিয়ে তরতুস আক্রমণ করে। এতে মুসলমানেরা জয়লাভ করে, এ যুদ্ধে প্রচুর গনিমত মুসলমানদের হস্তগত হয়।

এ বছর আবদুল্লাহ বিন উবায়েদ নিজেকে ইমাম মাহদি বলে দাবী করে। সে এ আকিদার উপর অটল থেকে ২৭৮ হিজরিতে হাজ্জ পালন করতে গেলে কেনানা গোত্রের লোকেরা তার অনুসরণ করে।

সূলী বলেছেন, ২৭১ হিজরিতে হারুন বিন ইব্রাহীম আল হাশেমির নির্দেশে বাগদাদে শুধু পয়সার প্রচলন ঘটে। এ ব্যবস্থা কিছুদিন চালু থাকে।

২৭৮ হিজরিতে নীলনদ শুকিয়ে যাওয়ায় মিসরে দুর্ভিক্ষ হয়। এ বছর মুফিকের পরলোক গমনে মুতামাদের স্বস্তির নিঃশ্বাস নসীব হয়। এ বছর কুফায় কারমাহ নামক একটি দলের আবির্ভাব ঘটে, এরা ছিল পথভ্রষ্ট ও ফাসিক। তারা ফরয গোসলকে নাজায়েয আর মদ পানকে জায়েয বলতো। তারা আযানের শব্দের মধ্যে এ শব্দটি বৃদ্ধি করেছিলো – ان محمد بن الحنفية رسول الله তারা বছরে দুদিনকে ফরয সাব্যস্ত করতো, বাইতুল মুকাদ্দিসে হাজ্জ করতো, আর তাকেই কেবলা বানিয়েছিলো। এভাবে তারা শরীয়তে অনেক জিনিসের কম-বেশী করে। তাদের মতবাদটি জাহেল, বর্বর ও অসভ্য লোকেরা গ্রহণ করে।

২৭৯ হিজরিতে আবু ফজল বিন মুফিকের প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্য আর নিজের দুর্বলতা ও অপারগতার কারন মুতামাদ নিজের ছেলেকে উত্তরাধিকার থেকে অপসারন করে আবুল ফজল বিন মুফিককে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন আর তাকে ‘মুতাযাদ’ উপাধি দেন। এ বছর মুতাযাদ মিথ্যা গল্প, নোবেল নাটক, দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত গ্রন্থাদি কেনার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর কয়েক মাস পর ২৭৯ হিজরির রযব মাসের ১৯ তারিখ সোমবারে ২৩ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার পর ইন্তেকাল করেন। কেউ কেউ বলেন, তাকে বিশ খাওয়ানো হয়। কারো মতে, রাতের আঁধারে তাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে।

মুতামাদের যুগে যে সকল ওলামায়ে কেরাম এ নশ্বর জগত ত্যাগ করেন তারা হলেন – ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, ইবনে মাজা, রাবীহুল জায়যী, রাবীহুল মুরাদী, ইউসুফ বিন আবদুল আলী, যাবের বিন বাকার, আবুল ফজল আর রিয়াশী, মুহাম্মাদ বিন ইয়াহইয়া যাহলী, হাজ্জাজ বিন শায়ের আজালী আল হাফেজ, কাযীউল কুযযাত ইবনে আবু শাওয়ায়িব সূসী আল মাকরী, উমর বিন শায়বা, আবু যরআ আর রাযী, মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল হাকাম, কাযী বাকার, দাউদ যাহেরী, ইবনে দারাহ, বাঁকা বিন মুখাল্লাদ, ইবনে কুতায়বা, আবু হাতিম আর রাযী প্রমুখ।