আল মুকতাদার বিল্লাহ

২৮২ হিজরির রমযান মাসে গারীব নামের রোমান বা তুর্কি বাঁদির গর্ভে আল মুকতাদার বিল্লাহ আবুল ফজল জাফর বিন মুতাযদ জন্মগ্রহণ করেন।

অন্তিম শয্যায় মুকতাফীকে পরবর্তী খলীফা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে মুকতাদার সে সময় বালেগ হওয়ায় তিনি তাকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। মুকতাদার তের বছর বয়সে খিলাফতের তখতে সমাসীন। তিনিই বয়সের দিক দিয়ে সর্বকনিষ্ঠ খলীফা। উযীর আব্বাস বিন হাসান তাকে বাচ্চা ভেবে তার বাইয়াত থেকে সরে দাঁড়ানোর মতামত ব্যক্ত করলে লোকেরা সমর্থন জানিয়ে আবদুল্লাহ বিন মুতায – এর প্রস্তাব করে। জানোতে পেয়ে আবদুল্লাহ বিন মুতায বলল, রক্ত ঝরার আশংকা না থাকার শর্তে আমি খিলাফত গ্রহণ করবো। সংবাদ পেয়ে মুতাকাদ বিপুল পরিমাণ সম্পদের বিনিময়ে আব্দুল্লাহকে সন্তুষ্ট করায় আবদুল্লাহ খিলাফত প্রত্যাখ্যান করেন।

জনগন এ প্রক্রিয়া মেনে না নেওয়ায় ২৯২ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের বিশ তারিখে ফুটবল খেলারত অবস্থায় জনতা মুকতাদারের উপর আক্রমণ করে বসলে তিনি ঘরের মধ্যে গিয়ে আত্মগোপন করেন। লোকেরা আবদুল্লাহ বিন মুতাযাদকে ডেকে আনলে সামরিক অফিসারগণ, বিচারকমন্ডলী, রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ আর শহরের অভিজাত শ্রেণীর নাগরিকেরা তার হাতে বাইয়াত করেন আর তাকে ‘গালিব বিল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপর মুহাম্মাদ বিন দাউদ বিন জাররাহকে উযীর আর আবুল মুসনা আহমাদ বিন ইয়াকুবকে কাযি পদে নিয়োগ দিয়ে নতুন খলীফার নামে আহকাম জারি হতে থাকে।

মাআফী বিন যাকারিয়া জারীরী বলেছেন, মুকতাদারকে অপসারন করে ইবনে মুতাযের বাইয়াত গ্রহণের পর লোকেরা মুহাম্মাদ বিন জারীর তাবারীর কাছে এলে তিনি নতুন উযীর আর কাযীর নাম জানোতে চাইলেন। তারা বললো, “মুহাম্মাদ বিন দাউদ বিন জারররাহ হলে উযীর, আর আবুল মুসনা আহমাদ বিন ইয়াকুব হলেন কাযী।” তিনি বললেন, “এ কাজ পূর্ণতা পায়নি।” তার বললো, “আপনি কি এদের যোগ্য মনে করছেন না ?”

বাইয়াতের পর ইবনে মুতায মুকতাদারকে দারুল খুলাফা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে পাঠালে মুকতাদার বললেন, “বিনা চেষ্টায় কেন তা ছেড়ে দিবো ?” মুকতাদার তার পক্ষের কিছু লোককে অস্ত্রসজ্জিত করলেন। আল্লাহ তাআলা ইবনে মুতাযের বাহিনীতে ভীতি ছড়িয়ে দিলেন। ইবনে মুতায তার উযীর আর কাযীকে নিয়ে পালিয়ে গেলো। বাগদাদে কতলে আম (গণহত্যা) শুরু হলো। সেসব ফকীহ আর আমীরগণ মুকতাদারকে অপসারন করেছিলো, তাদের বন্দী করে ইউসুফের কাছে সোপর্দ করা হলে তিনি তাদের মধ্য থেকে চারজন বাদে যাদের মধ্যে কাযী আবু উমর ছিলো, সকলকে হত্যা করেন। ইবনে মুতাযকে বন্দী করে জিন্দানখানায় পাঠানো হয়। কয়েক দিন পর সে লাশ হয়ে বেরিয়ে আসে।

এরপর মুকতাদার আবুল হাসান আলী বিন মুহামাদ বিন ফরাতকে উযির নিয়োগ করেন। তিনি মাজলুমদের পাশে দাঁড়ান, ইনসাফের প্রসার ঘটান আর মুকতাদারকে ইনসাফ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। অল্প বয়স্ক হওয়ার কারনে মুকতাদার সাম্রাজ্যের যাবতীয় কার্যাদি সম্পাদনের দায়িত্ব আবুল হাসানের উপর অর্পণ করে তিনি খেলাধুলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

এ বছর তিনি ইহুদী আর খ্রিস্টানদের সেবা গ্রহণ না করার ফরমান জারি করেন। এ বছর পশ্চিমাঞ্চলে মাহদী নামক এক প্রতারকের আবির্ভাব ঘটে। সে ইমামত দখল করে আর খিলাফতের দাবী তোলে, লোকেরা তার সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করে আর দূর-দুরান্ত থেকে জনতার ঢল এসে তার পতাকাতলে সমবেত হয়। ধীরে ধীরে পশ্চিমাঞ্চলীয় জনপদগুলো তার কব্জায় আসতে থাকে আর তার ভুখন্ডের পরিধি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। সে ইমাম মাহদী হওয়ার ব্যাপারে দাবী করে। অবশেষে আফ্রিকার গভর্নর যিয়াদাতুল্লাহ বিন আগলিব পালিয়ে মিসর হয়ে ইরাক পাড়ি জমান। এরপর মুসলিম বিশ্বের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রশাসন বনু আব্বাসের হাত থেকে মাহদীর দখলে চলে যায়।

ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে এ ঘটনাটি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আর বনু আব্বাসের জন্য একটি মর্মান্তিক ও দুঃখজনক ক্লান্তিকাল। এ হিসাব মোতাবেক বনু আব্বাসের সাম্রাজ্য মুসলিম বিশ্ব হিসেবে ১৬০ বছরের চেয়ে কিছু বেশী সময় তাদের হাতে পরিচালিত হয়ে আসে। এরপর মুসলিম জাহানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো তাদের হাতছাড়া হতে থাকে।

যাহাবী বলেছেন, “বয়সে ছোট হওয়ার কারনে মুকতাদার রাস্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় অনেক ভুল ভ্রান্তির জন্ম দেন।”

৩০০ হিজরিতে দায়নুর শহরে একটি পাহাড় ধ্বসে পড়ে আর এর নীচ থেকে এতো পানি বের হয়, যা দ্বারা কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়। এ বছর মাদী খচ্চর পুরুষ খচ্চরে পরিণত হয়। আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।

৩০১ হিজরিতে আলী বিন ঈসাকে উযীর নিযুক্ত করা হয়। তিনি খুবই ঈমানদারী, ইনসাফ ও তাকওয়ার সাথে কাজ করতেন। তিনি মদপান নিষেধ করে আহকাম জারি করেন। তিনি শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক বাজার গড়ে তোলেন। এ বছর আবু উমরকে দ্বিতীয় বার কাযী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ বছর মুকতাদার সর্বপ্রথম ঘোড়ায় চড়ে নিজের প্রাসাদ থেকে শামাসীয়া শহরে যান আর জনতার সামনে নিজের আত্তপ্রকাশ ঘটান। এ বছর হুসাইন হাল্লাজ মারুফ মানসুর (মানসুর হাল্লাজ – অনুবাদক) উটের পিঠে চড়ে বাগদাদ আসে। সে ‘আনাল্লাহ’ (আমি আল্লাহ) বলে দাবী করতো। বাগদাদে এর প্রসার ঘটে। তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিতর্ক করে জানা যায় – কুরআন, হাদিস আর ফিকহ সম্পর্কে তার কোন ধারনাই নেই। এ আকিদা বহনের জন্য তাকে বন্দী করা হয়। অবশেষে ৩০৯ হিজরিতে কাযী আবু উমরের ফতোয়া মোতাবেক তাকে শূলে চড়ানো হয়।

৩০১ হিজরিতে মাহদী চল্লিশ হাজার বারবার সৈন্য নিয়ে মিসর আক্রমণের জন্য যাত্রা করে। পথিমধ্যে নীল নদে প্রবল উত্তাল থাকার কারনে তারা ইসকান্দারিয়ায় ফিরে গিয়ে সেখানে ফিতনা ফাসাদের জন্ম দেয়। তাদের প্রতিহত করার জন্য শাহী ফৌজ পাঠানো হয়। বরকা অঞ্চলে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ হলে শাহী বাহিনী পরাজিত হয় আর মাহদী ইসকান্দারিয়া ও ফিউম পদানত করে।

৩০২ হিজরিতে মুকতাদার তার পাঁচ পুত্রের খতনা করেন। এ বাবদ তিনি ছয় লাখ দিনার খরচ করেন। পুত্রদের সাথে তিনি অগণন ইয়াতিম শিশুর খতনা করার আর তাদের প্রতি অনেক করুণা করেন। এ বছর মুকতাদার সর্বপ্রথম মিসরের জামে মসজিদে জামায পড়ান।

৩০৪ হিজরিতে বাগদাদে যাবযাব নামক এক ভয়ংকর প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে, সে রাতে দুই তলায় উঠে বাচ্চাদের খেয়ে ফেলতো আর নারীদের নিতম্বে আঘাত করতো। লোকেরা তার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য থালাবাসন বাজাতো। এ ঘটনা অনেক দিন পর্যন্ত চলে।

৩০৫ হিজরিতে রোমান সাম্রাজ্য মুকতাদারের প্রতি বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে আর সন্ধি করার জন্য উপঢৌকনসহ কিছু লোক তার কাছে পাঠানো হয়। মুকতাদার রোমানদেরকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের জন্য শামসীয়া তোরণ থেকে দারুল খুলাফা পর্যন্ত এক লাখ ষাট হাজার বর্ম পরিহিত সৈন্য দাড় করিয়ে দেন। তাদের পিছে ষাট হাজার সেবক আর সাতশো প্রহরী নিয়োগ করেন। দারুল খুলাফায় দেওয়ালগুলোতে গৌরচন্দ্রিকা খাতে আটচল্লিশ হাজার যবনিকা দিয়ে সুসজ্জিত করেন, বাইশ হাজার কার্পেট বিছিয়ে দেন, একশ শিকারী পাখি শিকলে বেঁধে নিজের সামনে রাখেন। এ বছর ওমানের বাদশাহ মুকতাদারের কাছে উপঢৌকন পাঠায়, এর মধ্যে ছিল কালো বর্ণের একটি পাখি – যে তোতা পাখি বিশুদ্ধ ও স্পষ্টভাবে পার্সি ও হিন্দি ভাষায় কথা বলতো।

৩০৬ হিজরিতে মুকতাদারের মা একটি চিকিৎসালয় গড়ে তুলেন, যার বার্ষিক খরচের পরিমাণ চার হাজার দিনার। এ বছর মুকতাদারের অবহেলার কারণে সাম্রাজ্যের সকল বন্দোবস্ত শাহী হারামের হাতে চলে যায়। মুকতাদারের মা প্রতি জুমআয় ইজলাসের আহবান করতে থাকেন। এতে কাযীগন আর রাস্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিত হওয়ার ফরমান জারি করেন। এ বছর কাসিম মুহাম্মাদ বিন মাহদি মিসরের অধিকাংশ জনপদ দখল করে নেয়।

৩০৮ হিজরিতে বাগদাদে খাদ্যশস্যর দারুন সংকট দেখা দেয়। ফলে প্রজাবৃন্দ অভাব অনটনে নিপতিত হয়। কথিত আছে, বাগদাদে প্রশাসক হামিদ বিন আব্বাসের অত্যাচারে জনগন অস্থির হয়ে লুটপাট শুরু করলে লড়াই বেঁধে যায়। ক্ষিপ্ত জনতা জেলখানায় আগুন ধরিয়ে দিলে কয়েদীরা পালিয়ে যায়। সাম্রাজ্যের উযীরকে প্রস্তারাঘাতে হত্যা করা হয়। আব্বাসীয় সাম্রাজ্য গোলযোগ পূর্ণ হয়ে উঠলে বাগদাদ পর্যন্ত কোন শস্য পৌঁছাতো না। এ বছর আল কাসিম জাযীরা কাসসাত শহর দখল করে নিলে মিসরবাসী বিচলিত হয়ে উঠে। তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।

৩১১ হিজরিতে তিনি এ আদেশ দেন যে, মুতাযদ এর ফরমান মোতাবেক গর্ভস্থ বাচ্চাকে অবশ্যই সন্তানের ভাগ দিতে হবে।

৩১২ হিজরিতে খোরাসানের আমীরের হাতে ফারগানা বিজিত হয়।

৩১৪ হিজরিতে রোম সাম্রাজ্যের মালতীয়া অঞ্চল তলোয়ার দ্বারা জয় হয়। এ বছর দজলা নদীর পানিতে মৌসুল শহর প্লাবিত হয়।

৩১৫ হিজরিতে রোমানরা দিময়াত শহরে লুটপাট করে আর জামে মসজিদে বাঁশি বাজায়। এ বছর দিলাম গোত্রের লোকেরা রায় ও জাবাল শহরে হামলা করে গভর্নরকে হত্যা আর বাচ্চাদেরকে যবেহ করে।

৩১৬ হিজরিতে কারমাতী দারুল হিজরত নামে একটি ভবন তৈরি করায় বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মুসলমানদের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে সে অনেক জনপদ দখল করে। তার সহচরের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তার সৈন্যরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। খিলাফতের ভিত্তি কেঁপে উঠে। মুকতাদার তার সাথে যুদ্ধ করার জন্য কয়েবার সেনাবাহিনী পাঠান, কিন্তু তারা পরাজিত হয়ে ফিরে আসে। তাদের ভয়ে হাজ্জ বন্ধ হয়ে যায়, মক্কাবাসী মক্কা শরীফ ছেড়ে পালিয়ে যায়। রোমানরা খাল্লাত আক্রমণ করে সেখনাকার জামে মসজিদের মিম্বর বের করে সে স্থানে ক্রুশদণ্ড স্থাপন করে।

৩১৭ হিজরিতে মুনিস ভেবেছিলো, “মুকতাদার আমাকে বাদ দিয়ে হারুন বিন গারীবকে আমিরুল উমারা বানাতে চান”, এ জন্য সে বিদ্রোহ করে। মুহাররম মাসে শুক্লা পক্ষে এশার পর সকল সৈন্য ও আমীরকে নিয়ে দারুল খুলাফা আক্রমণ করে। এ দৃশ্য দেখে মুকতাদারের প্রাণ উড়ে যায়। সে সময় তিনি নিজের মা, খালা আর স্ত্রীকে নিয়ে সরে পড়েন। তার ঘর থেকে ছয় লাখ দিনার লুট করে নেয়। লোকেরা তার অপসারণের উপর সাক্ষ্য দেয়। মুনিস আর আমীরগণ মুহাম্মাদ বিন মুতাযদকে ‘আল কাহির বিল্লাহ’ লকব দিয়ে তাকে বাইয়াত দেন। আবু আলী বিন মুকালার উপর উযীরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এটা ছিল জুমআর দিন। রবিবারে আল কাহির বিল্লাহ ইজলাস করেন। সোমবারে উযীর এ সংবাদ সকল রাজ্য প্রশাসকদের কাছে সরবরাহ করে। সেদিন সৈন্যরা তাদের বেতন-ভাতাদি প্রার্থনা করে। সে সময় মুনিস উপস্থিত ছিল না। ফলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সৈন্যরা দিরহানকে হত্যা করে, মুনিসের ভবনে হামলা চালায় আর মুকতাদারের অনুসন্ধান করে। অবশেষে তারা মুকতাদারকে কাঁধে করে দারুল খুলাফায় নিয়ে আসে আর আল কাহির বিল্লাহকে ধরে এনে তার সামনে পেশ করে। সে সময় আল কাহির কাঁদছিলেন, অন্তর আল্লাহ আল্লাহ করছিলো। মুকতাদার তাকে বললেন, “ভাই, ভয় পেয়ো না। তোমার কোন অপরাধ নেই। তুমি আমার কোন অসম্মান করোনি। আল্লাহ’র কসম, আমি আপনাদের কিছুই বলবো না।” এ ঘটনা দেখে লোকেরা নীরব নিস্তব্ধ হয়। আগের উযীরকেই আবার নিয়োগ করেন। রাজ্যগুলোতে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়। মুকতাদার খলীফার আসনেই অধিষ্ঠিত থাকেন। তিনি সৈন্যদের পুরস্কৃত করেন।

এ বছর মুকতাদার হাজীদের সাথে মানসুর দালমীকে পাঠান। যিনি হাজীদের নিরাপদে মক্কা শরীফে পৌঁছে দেন। ৮ই জিলহাজ্জ তারিখে আল্লাহ’র দুশমন আবু তাহির কায়মতী মক্কায় গিয়ে মসজিদে হারামের হাজীদের হত্যা করে আর লাশগুলো জমজম কূপে ফেলে দেয়। লৌহদণ্ডের আঘাতে হাজরে আসওয়াদ ভেঙে গুরিয়ে দেয় আর খানায়ে কাবার দেওয়াল থেকে তা পৃথক করে ফেলে। এগারো দিন পর্যন্ত হাজরে আসওয়াদ এভাবেই পড়ে ছিল। এরপর সে তা নিয়ে চলে যায়। বিশ বছরের বেশী সময় পর্যন্ত সেটি তার কব্জায় ছিল। পঞ্চাশ হাজার দিনারের বিনিময়ে তা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা হলেও পরবর্তীতে সে তা ফিরিয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে মতির খিলাফতকালে হাজরে আসওয়াদটি আনা হয়।

কথিত আছে, হাজরে আসওয়াদটি মক্কা শরীফ থেকে দারুল হিজরাতে নিয়ে যাওয়ার সময় যে উট একে বহন করেছে সে উটই মারা গেছে। এভাবে পথিমধ্যে চল্লিশটি উট মারা যায়। আর ফিরিয়ে আনার সময় হাজরে আসওয়াদ বহনকারী দুর্বল উটটি মোটাতাজা হয়ে যায়।

মুহাম্মাদ বিন রবী বিন সুলায়মান বলেছেন, কারামতের এ বছরে আমি মক্কা শরীফে ছিলাম। এক ব্যক্তি কাবা শরীফের সাদের নালা খুলে ফেলার জন্য সাদে উঠলে আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। আমি দুয়া করলাম, “হে আল্লাহ, আপনি বড়ই সহনশীল। কিন্তু এ জুলুম আমার মোটেও সহ্য হয় না।” লোকটি সাথে সাথে সাদ থেকে পড়ে মারা গেলো।

কারমতী কাবার দরজায় উঠে এ কবিতাটি পাঠ করে –“আমি আল্লাহ’র সাথে রয়েছি। আল্লাহ’র কসম, আমিই সৃজনশীলতাকে সৃষ্টি করি আর ধ্বংস করি।” এরপর এ জালিম লোকটি বেশী দিন অবকাশ পায়নি, সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এ বছর বাগদাদে একটি বড় ফিতনা সৃষ্টি হয় এ আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে –

عَسَىٰ أَن يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُودًا

“অচিরেই তোমার রব তোমাকে মাকামে মাহমুদে পৌঁছে দিবেন।” (সূরাহ আল-ইসরা, ১৭ : ৭৯)

হানাবিলা সম্প্রদায়ের দাবী, এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামকে আরশে পাকে সমাসীন করবেন। আর অপর পক্ষের বক্তব্য হলো, এর অর্থ এটা নয়। এ থেকে রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শাফাআত উদ্দেশ্য। এ ফিতনায় অনেক লোক প্রাণ হারায়।

৩১৯ হিজরিতে কারমতী কুফায় এসে ধমক দিলে বাগদাদবাসী বাগদাদ দখলের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। লোকেরা এ থেকে পরিত্রাণের জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে অত্যন্ত বিনয় জড়িত কান্নার সাথে প্রার্থনা করে। এ বছর দীলাম গোত্রের লোকেরা দিনুর অঞ্চল দখল করে সেখানকার অনেক লোককে বন্দী আর হত্যা করে।

৩২০ হিজরিতে মুনিস বারবার জাতি নিয়ে গঠিত এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মুকতাদারকে আক্রমণ করতে এলে তিনিও সসৈন্যে ময়দানে আসেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে এক বারবার ফৌজের বর্শার আধাতে মুক্তাদার যমিনে পড়ে গেলে সে তার তলোয়ার দিয়ে খলীফার মাথা কেটে ফেলে। তার কাঁটা মাথা বর্শার আগায় গেঁথে তার উপর কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় আর তার লাশটি উলঙ্গ করে দূরে ফেলে দেয়। লোকেরা খড়কুটো আর বর্জ্য দিয়ে তার লজ্জাস্থান ঢেকে দেয় আর সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। এটা ৩২০ হিজরির শাওয়াল মাসের ২৭ তারিখ সোমবারের ঘটনা।

মুকতাদার বিশুদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি শাহওয়াত আর শরাব থেকে অপারগ ছিলেন। তার সাথে অপচয় পূর্ণমাত্রায় বিরাজ করতো। নারীরা তার উপর পেরেশান ছিল। তিনি তাদের মাঝে খিলাফতের সকল জওহর বিলিয়ে দেন। তিনি এতিমদের তিনগুন বেশী দান করতেন। অনন্য ও অদ্বিতীয় একটি জওহরের তাসবিহ তিনি এক দারোগাকে দান করেন। তার কাছে রোমান, সাকালাবী আর হাবশি গোলাম ছাড়াও এগারো হাজার হিজড়া গোলাম ছিল।

মুকতাদারের বারো পুত্রের মধ্যে রেজা, মুত্তাকী আর মতি – এই তিনজন খলীফা হোন। আবদুল মালিকের চার পুত্র খলীফা হয়েছিলেন, যার দৃষ্টান্ত বিরল। এটা যাহাবির অভিমত। তবে আমার (গ্রন্থকারের) মতে, আমার যুগ পর্যন্ত মুতাওয়াক্কিলের পাঁচ জন আওলাদ আল মুসতাইন আব্বাস, আল মুতাযদ দাউদ, মুসতাকফী সুলায়মান, আল কায়িম হামযা আর আল মুসতানজিদ ইউসুফ খলীফা হোন, যার উপমা নেই।

লতীফাহ লাতাইফুল মাআরিফ সাআলাবীর মধ্যে রয়েছে, মুতাওয়াক্কিল আর মুকতাদার ছাড়া কারো নাম জাফর ছিল না। উভয়ে নিহত হোন। মুতাওয়াক্কিল সোমবার আরতে আর মুকাতাদার সোমবার দিনে মারা যান।

তার শাসনামলে যে সকল ওলামায়ে কেরামগণ ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – মুহাম্মাদ বিন আবু দাউদ যাহির, কাযী ইউসুফ বিন ইয়াকুব, শাফেয়ী মাযহাবের শায়খ ইবনে শারীহ, যিনদ, দানশীল আবু উসমান জিরী, আবু বকর দাইযী, জাফর কারয়ানী, কবি ইবনে বাসাস, সুনানের লেখক নাসাঈ, সুনানের লেখক হাসান বিন সুফিয়ান, মুতাযালাদের শায়খ জায়া জায়ায়ী, নাহুদবি ইয়ামুত বিন মারযা, ইবনে জাল্লা, মুসনাদের লেখক আবুল আলী মৌসুলী, মিশরের সম্মানিত ক্বারি ইশনানীল মাকরী বিন ইউসুফ, মিসরের প্রখ্যাত ক্বারি ইবনে ইউসুফ, মুসনাদের লেখক আবু বকর রুয়ানী, ইমাম ইবনে মুনযির, ইবনে জারীর তাবারী, নাহুবিদ যিজাজ, ইবনে খুযাইমা, ইমাম যাকারিয়া তৈয়ব, বিনানুল জামাল, আবু বকর বিন আবু দাউদ সিজিস্তানি, নাহুবিদ ইবনে সারাজ, আবু আওয়ানা, মুসনাদের লেখক আবুল কাসিম বাগবী, আবু উবাইদা বিন হারবূয়া, মুতাযালাদের শায়খ কাবী, কাযী আবু উমর, কাদামা প্রমুখ।