আল কাহির বিল্লাহ আবু মানসুর মুহাম্মাদ বিন মুতাযদ বিন তালহা বিন মুতাওয়াক্কিল ‘ফিতনাহ’ নামক বাঁদির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
মুকতাদার নিহত হওয়ার সময় লোকেরা তাকে আর মুহাম্মাদ বিন মুকতাফীকে নির্বাচন করে। তারা খিলাফত গ্রহণের অনুরোধ নিয়ে ইবনে মুকতাফীর কাছে গেলে তিনি তা গ্রহনে অসম্মতি জানিয়ে বলেন, “খিলাফতে আমার প্রয়োজন নেই, কারন আমার চাচা কাহির খিলাফতের বেশী হকদার।” কাহির খিলাফত গ্রহণ করলে বাইয়াত হয়ে যায়। ৩১৭ হিজরিতে তাকে আল-কাহির উপাধি দেওয়া হয়।
তিনি খিলাফতে আসীন হয়ে সর্বপ্রথম মুকতাদারের আওলাদদের উপর জরিমানা আরোপ করেন আর এতে তারা অনেক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পরিস্থিতি এমন হয় যে, মুকতাদারের মা ধুকেধুকে ইন্তেকাল করেন।
৩২১ হিজরিতে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে মুনিস আর ইবনে মুকালাহসহ কিছু লোক কাহিরকে খিলাফতচ্যুত করে ইবনে মুকতাফীকে তখতে বসানোর চেষ্টা চালায়। জানোতে পেয়ে কাহির একটি ফাঁদ পাতেন। তিনি তার বিরোধী সকলকে বন্দী করে হত্যা করেন আর ফৌজদের উপহার-উপঢৌকন দিয়ে হাত করে নেন। এভাবে তিনি প্রজাদের অন্তরে মর্যাদার আসন করে নেন। তিনি তার লকবের সাথে ‘আল মুনতাকিম মিন আদায়াদ্বীনিল্লাহ’ – এতটুকু বৃদ্ধি করেন।
এ বছর তিনি গায়িকা বাঁদিদের রাখা নিষিদ্ধ করেন। মদ দূরে ফেলে দেন, গায়কদের বন্দী করেন, হিজড়াদের নির্বাসনে পাঠান, খেলাধুলার সামগ্রী ভেঙে ফেলেন। যারা উত্তেজনাকর গান গাইতো আর যারা ঠাণ্ডা সঙ্গীত পরিবেশন করতো না, তাদের বিক্রি করে দেওয়ার নির্দেশ দেন, অথচ তিনি নিজেই অসম্ভব রকম জ্ঞান শুনতেন আর মদ পান করে বুদ হতে থাকতেন।
৩২২ হিজরিতে দায়লম আলী বিন বূয়ার সহযোগিতায় ইস্পাহানের উপর আক্রমণ চালায়। সে সম্পদের পাহাড় গড়েছিলো। খলীফার নায়েবের সাথে মিলে মুহাম্মাদ বিন ইয়াকুবকে পরাজিত করে আর ইবনে বূয়া পারস্যের দিকে দৃষ্টি দেয়। তার পিতামাতা ছিল হতদরিদ্র, তারা মাছ শিকার করতো। একদিন সে স্বপ্নে দেখলো, তার পেশাবের রাস্তা দিয়ে এক খণ্ড অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হয়ে পৃথিবী আলোকিত করে ফেলেছে। সে নিজেই এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলো এভাবে যে, তার আওলাদ বাদশাহ হবে, আর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ যতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছে ততদূর পর্যন্ত তার রাজ্যের সীমানা যুদ্ধের মাধ্যমে সম্প্রসারিত হবে।
ইবনে বূয়া অনেক মাল জমা করে আর অধিকাংশ শহর তার পদানত হয়। খুরাসান আর পারস্য খিলাফত থেকে বেরিয়ে ইবনে বূয়ার অধীনে চলে যায়। এ বছর ইসহাক বিন ইসমাইলকে কাহির কুপের মধ্যে লটকিয়ে হত্যা করে। তার অপরাধ ছিল – সে খিলাফত লাভের আগে কাহিরের এক বাদিকে কাহিরেরে চেয়ে বেশী মূল্য দিয়ে কিনেছিলো।
এ বছর ইবনে মুকালা আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এসে সেনাবাহিনীতে এ অপপ্রচার চালায় যে, সৈন্যদের বন্দী করে রাখার জন্য কাহির ভুগর্ভস্থ কক্ষ নির্মাণ করেছেন। এ কথা শুনে তারা কোষমুক্ত তলোয়ার নিয়ে কাহিরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে সে পালিয়ে যায় আর ৩২২ হিজরির হামাদিউল আখির মাসের ছয় তারিখে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের হাতে বন্দী হোন।
আব্বাস মুহাম্মাদ বিন মুকতাদারের কাছে জনগন বাইয়াত করে এবং ‘আর রাযী বিল্লাহ’ উপাধি দিয়ে তার উপর খিলাফত চাপিয়ে দেয়। এরপর লোকেরা উযীর, আবুল হাসান বিন কাযী আবু উমর, হাসান বিন আবদুল্লাহ বিন আবুল শাওয়ারিব, আবু তালিব বিন বহলুলকে কাহিরের কাছে পাঠায়। তারা তাকে বললো, “এখন আপনি কি করতে চান ?” তিনি বললেন, “তোমরা আমার কাছে বাইয়াত করেছো, আমি তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট নই। তোমরা আমার আনুগত্য করবে আর অন্যদেরকেও আনুগত্য করতে উদ্বুদ্ধ করবে।” এর জবাবে উযীর কাহিরকে অপসারণের অভিমত ব্যক্তি করে চলে যায়।
কাযী আবুল হাসান বলেছেনঃ আমি রাযীর কাছে গিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে বললাম, “আমার দৃষ্টিতে তার আমানত ফরয।” রাযী বললেন, “তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হলো।” আমি সেখান থেকে চলে আসার পর কাহিরের চোখে সীসা ঢেলে দেওয়া হয়, ফলে তিনি চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যান।
মাহমুদ ইস্পাহানী বলেছেনঃ দুশ্চরিত্র আর রক্ত ঝরানোর প্রতি অসম্ভব নেশার কারণে কাহিরকে অপসারন করা হয়। তিনি পদচ্যুত হতে অসম্মতি জানালে তার চোখ দুটো খুলে নেওয়া হয়।
সূলী বলেছেনঃ কাহির ছিল রক্ত পিপাসু, দুশ্চরিত্র, স্বতন্ত্র মেজাজের আর মদ্যপায়ী। প্রহরী পছন্দ না হলে তিনি তার বংশের পর বংশ হত্যা করতেন। তিনি বর্শা হাতে নিলে কাউকে না কাউকে হত্যা না করা পর্যন্ত ক্ষান্ত হতেন না।
আলী বিন মুহাম্মাদ খুরাসানী বলেছেনঃ একদিন আমি কাহিরের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে একান্তে ডেকে নিলেন। সে সময় তার সামনে বর্শা রাখা ছিল। তিনি আমাকে বনু আব্বাসের খলীফাদের বৈশিষ্ট্যাবলী বর্ণনা করতে বললেন।
আমি বলতে লাগলাম – “সাফফাহ রক্ত পিপাসু ছিলেন। তার দেখাদেখি তার প্রশাসকবৃন্দও তার অনুসরণ করে। তবুও তিনি ছিলেন দানশীল।
মানসুর সর্বপ্রথম আব্বাস আর আবু তালিব উভয় বংশে অনৈক্যের জন্ম দেন, যা আগে ছিল না। তিনি কবিদের সভাসদের পদে অধিষ্ঠিত করেন। তিনি সর্বপ্রথম সুরিয়ানী আর অনারব ভাষায় লিখিত গ্রন্থাদি, যেমন – কালীলাহ, দিমনাহ, উকলীদস, গ্রীক দর্শনের বিপুল বই পুস্তক ইত্যাদি অনুবাদ করান। সেগুলোর প্রতি লোকদের আকর্ষণ প্রবল হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা প্রকৃত জ্ঞানচর্চা ছেড়ে দেয়। ফলে সে সময় মুসলিম উম্মাহ’র বুদ্ধিবৃত্তিক এ নাজুক মুহূর্তে মুহাম্মাদ বিন ইসহাক মাগাযী আর সিরাতের গ্রন্থাদি প্রণয়ন করেন। মানসুর প্রথম খলীফা, যিনি আরবে গোলামদের বিচারকদের পদে নিয়োগ করেন।
মাহদি খুবই ন্যায়পরায়ণ, দানশীল ও ইনসাফগার ছিলেন। তার বাবা যেটুকু আত্মসাদ করেছিলেন, তিনি তা লোকদের ফিরিয়ে দেন। হত্যাযজ্ঞ ঠেকাতে তিনি জীবনভর অসম্ভব রকম চেষ্টা করেছেন। তিনি মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী আর মসজিদে আকসার উন্নয়নমূলক কাজ করেন।
হাদী জালেম আর অহংকারী। তার কর্মকর্তারা তার দৃষ্টিভঙ্গির উপর কাজ করতো।
হারুন রশীদ জীবনের অধিকাংশ সময় হাজ্জ আর জিহাদের ময়দানে কাটিয়েছেন। তিনি মক্কা যাবার পথে বিশ্রামাগার আর পানির বড় বড় হাউজ নির্মাণ করেন। আযনা, তারতুস, মাসীসা, মারআশ প্রভৃতি জনপদ আবাদ করেন। তিনি জনসাধারণের প্রতি অনেক ইহসান করেন। তার যুগে মক্কাবাসী উরুজ করতো। তিনি প্রথম খলীফা, যিনি বনু আব্বাসের খলীফাদের মধ্যে সর্বপ্রথম দাবা ও তাস খেলেন।
আমীন বড়ই উদার ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। তবে তিনি স্বাদে-গন্ধে লিপ্ত হওয়ায় ফিতনা ফাসাদে জড়িয়ে পড়েন।
মামুন জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত দর্শনে প্রভাবিত হোন। তিনি ছিলেন দয়ার্দ্র, উদার ও ধৈর্যশীল। মুতাসিম মামুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলতেন। তবে অনারব বাদশাহদের প্রতি তার প্রবল ঝোঁক ছিল। তিনি অনেক যুদ্ধ করেন আর অনেক বিজয় ছিনিয়ে আনেন।
ওয়াসেক বাবার অনুসরণে চলেন।
মুতাওয়াক্কিল ছিলেন মামুন আর মুতাসিমের বিপরীত, এমনকি আকিদাগত দিক থেকেও। তিনি মুনাযারা (বিতর্ক) বন্ধ করে দেন, অপরাধীদের শাস্তি নির্ধারণ করেন। হাদিস পঠন আর শ্রবণের নির্দেশ দেন। খলকে কুরআনের বিরোধীতা করেন।”
এরপর আমি অবশিষ্ট খলীফাদের বিবরণ পেশ করলাম। তিনি বললেন, “তুমি বাস্তব ও স্বচ্ছ বর্ণনা বিধৃত করেছো।”
মাসউদী বলেছেনঃ মুনিসের অনেক সম্পদ কাহির ছিনিয়ে নিয়েছিলো। খিলাফত থেকে অপসারিত হওয়ার পর অন্ধ হয়ে গেলে জনগন তাদের হারানো সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার চাপ দিলে তিনি তাদের দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে তারা বিভিন্নভাবে তাকে কষ্ট দিতে থাকে। অবশেষে রাযী বিল্লাহ তাকে ডেকে এনে বলেন, “আজ আমজনতা নিজেদের অর্থ-সম্পদ ফিরে পেতে চায়। আমার কাছে এমন কোন ভাণ্ডার নেই, যা দিয়ে তাদের দাবী মেটাতে পারবো। ভালো হবে যদি তুমি বলে দাও যে, সেই ধনরাজ কোথায় গোপন করে রেখেছো।” কাহির বললেন, “বাগানে পুঁতে রেখেছি, (কাহির শখ করে বাগানটি লাগিয়েছিলেন। এতে ছিল বারোটি নদী আর প্রাসাদসমূহ) বাগান খনন করলে পাবে।” রাযী এ বাগানের সৌন্দর্যে বিমোহিত ছিলেন। তিনি বাগান খনন করতে চাইছিলেন না। ফলে রাযী বললেন, “একটি নির্দিষ্ট স্থানের কথা বলো।” কাহির বললেন, “আমি অন্ধ, নির্দিষ্ট স্থান দেখিয়ে দিতে পারবো না। তবে কয়েক জায়গায় খনন করো, ধনরাজির সন্ধান পাবে।” রাযী বাধ্য হয়ে খনন কাজ শুরু করে। প্রাসাদের ভিত্তিমূলে খনন করা হয়, বৃক্ষ নিধন হয়, কিন্তু ধন-সম্পদের কোন হদিস মিললো না। আবার কাহিরকে বলা হলো, “সর্বশেষ সম্পদ তুমি কোথায় রেখেছো?” কাহির বললেন, “আমার কাছে মূলত কোন সম্পদই নেই। এ বাগানে তুমি সুখের জীবন অতিবাহিত করবে, আর আমি দেখবো, তা যেন না হয় সে জন্য বাহানা করে বাগানের লাবণ্য বিনষ্ট করেছি।” এ কথা শুনে রাযী ভীষণ লজ্জা পেয়ে চলে যান আর ৩৩৩ হিজরিতে তাকে বন্দী করা হয়। এরপর তাকে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়।
কাহির ৩৩৯ হিজরির জামাদিউল আউয়াল মাসের শেষের দিকে ৫৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি আব্দুস সামাদ, আবুল কাসিম, আবুল ফজল আর আবদুল আযীয নামের চার পুত্রের জনক।
হানাফী মাযহাবের শায়খ ইমাম তহাবী, ইবনে দরীদ, আবু হাশিম বিন হায়া প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম তার যুগে ইন্তেকাল করেন।