আল কাদের বিল্লাহ আবুল আব্বাস আহমাদ বিন ইসহাক বিন মুকতাদার ‘মওসুমা তামান্না’ বা ‘দিমনা’ নামক বাঁদির গর্ভে ৩৩৬ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন।
তয়ে অপসারিত হওয়ার পর তিনি তখতে আরোহণ করেন। তয়ে অপসারিত হওয়ার সময় তিনি বাগদাদে ছিলেন না। ১০ই রমযানে তাকে ডেকে আনা হয়। ১১ ই রমযানে সাধারণ পরিষদের সামনে তিনি মসনদে উপবেশন করেন। কবিগণ তার শানে কবিতা আবৃত্তি করেন। কবি শরীফ রেযা বলেন, “হে বনু আব্বাস, আজ আবার খিলাফতের মর্যাদাকে আবুল আব্বাস পুনর্জীবন দান করলেন। ঐক্যের মাধ্যমে এ শক্তিকে যুগ যুগ ধরে কায়েম রাখতে হবে।”
খতীব বলেছেনঃ কাদের বিল্লাহ খুবই সাধু, সুবিবেচক, ঝানু রাজনীতিবিদ, তাহাজ্জুদগুজার ও সদকা-খয়রাতকারী ছিলেন, তিনি সুপথপ্রাপ্ত হিসেবে প্রসিদ্ধ। তিনি আল্লামা আবু বশর হারবী শাফীর কাছে ফিকহ অর্জন করেন
فضائل صحابه تكفير معتزله قائلين خلق القرآن
একটি কিতাব লিখেন, যা প্রতি জুমআয় মুহাদ্দিসদের সামনে মাহদী জামে মসজিদে পাঠ করা হতো। (ইবনুস সালাহ, তবকাতুস শাফীয়াহ)
যাহাবী বলেছেনঃ খিলাফত লাভের প্রথম বর্ষের শাওয়াল মাসে একটি আড়ম্বরপূর্ণ সভার আহবান করা হয়। এতে কাদের বিল্লাহ আর বাহাউদ্দৌলা প্রতিজ্ঞা রক্ষার শপথ করে এবং কাদের বিল্লাহ নিজের প্রাসাদ ছাড়া গোটা সাম্রাজ্য তার উপর সোপর্দ করেন।
এ বছর মক্কা শরীফের শাসনকর্তা আবুল ফুতুহ আল হাসান বিন জাফর উলুবী লোকদের থেকে নিজের বাইয়াত নিয়ে রাশেদবিল্লাহ লকব ধারণ করে। খিলাফত তার হস্তগত হয়। মিসরশাহীর শাসন মকায় পরাভূত হয়। কিছুদিন পর আবুল ফুতুহ দুর্বল হয়ে পড়লে মিশরের বাদশাহ আযীয উবায়দীর বশতা মেনে নেয়।
৩৮২ হিজরিতে উযীর আবু নসর করখ অঞ্চলে একটি ভবন নির্মাণ করেন। এর নাম রাখা হয় দারুল ইলম। এতে একটি সমৃদ্ধ কুতুবখানা কায়েম করা হয়। বিপুল পরিমাণে ক্রয়কৃত গ্রন্থাদি এতে ছিল। ওলামাদের বিদ্যা অর্জনের জন্য এটি ওয়াকফ করা হয়।
৩৮৪ হিজরি ইরাক, সিরিয়া আর ইয়েমেনের লোকেরা হাজ্জ করতে গিয়ে রাস্তা থেকে ফিরে আসে, কারন এ বছর ত্যাক্স ছাড়া হাজ্জ করতে যেতে বাধা দেওয়া হয়। এ বছর শুধু মিসরবাসীরাই হাজ্জ করতে পারে।
৩৮৭ হিজরিতে সুলতান ফখরুদ্দৌলার তিরোধানে তার চার বছরের শিশু তদস্থলে নিয়োগ হয়। কাদের বিল্লাহ তাকে মাজদুদ্দৌলা উপাধি দেন।
যাহাবি বলেছেনঃ ৩৮৭/৩৮৮ হিজরিতে নয়জন বাদশাহ পরলোক গমন করেন। এদের মধ্যে মা-ওরাউন নহরের বাদশাহ মানসুর বিন নূহ, রায় এবং জাবালের শাসক ফখরুদ্দৌলা আর মিসরের আযীয উবায়দী অন্তর্ভুক্ত। কবি আবু মানসুর আবদুল মালিক এই নয়জনকে নিয়ে একটি শোকগাঁথা রচনা করেছেন।
যাহাবী বলেছেনঃ ৩৮৬ হিজরিতে মিসরশাহী আযীয মৃত্যুবরণ করে। সে তার বাবার থেকে প্রাপ্ত রাজ্যের সাথে হামস, হামাত আর হলব – এই তিনটি শহর জয় করে অন্তর্ভুক্ত করে। মৌসুল আর ইয়েমেনে তার নামে খুৎবা পড়া হতো। তার রাজ্যে তার নামে পয়সা চালু করা হয়েছিলো। পতাকায় তার নাম লিখা থাকতো, মার মৃত্যুর পর তদস্থলে তার পুত্র মানসুর আল হাকিম বিআমরিল্লাহ উপাধি দিয়ে সমাসীন হয়।
৩৯০ হিজরিতে সিজিস্তানে স্বর্ণের খনি বের হলে লোকেরা মাটি খনন করে স্বর্ণ উত্তোলন করে।
৩৯৩ হিজরিতে দামেশকের নায়েব আসওয়াদ পশ্চিমাঞ্চলীয় এক লোককে ধরে গাধার পিঠের উপর তুলে ঘুরানো হয়। সে সময় ঘোষক বলতে থাকে – এ হল সে ব্যক্তি, যে আবু বকর (রাঃ) আর উমর (রাঃ) কে ভালোবাসে। এরপর তাকে হত্যা করা হয়। আল্লাহ তার উপর রহমত বর্ষণ করুন আর তাকে হত্যাকারী ও এই বাদশাহকে কিয়ামতের দিন অপমান করুন।
৩৯৪ হিজরিতে বাহাউদ্দৌলা শরীফ আবু আহমাদ হুসাইন বিন মুসাকে কাযি-উল-কুযযাতের সাথে হাজ্জ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বসহ শিরাজ নগরী পর্যন্ত তার এলাকা বৃদ্ধি করে দেয়। কিন্তু কাদের বিল্লাহ এতে অনুমোদন না দেওয়ায় সে কোন দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।
৩৯৫ হিজরিতে হাকিম মিসরে একদল ওলামাকে হত্যা করে। মসজিদের দেওয়ালে দেওয়ালে এবং পথ-প্রান্তরে সে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) দের কুৎসা লেখে। সে হুকুম জারি করে – সাহাবীদের গালি দাও। কুকুর লালনপালন কারীদের হত্যা করো। ফাকাআ (নিশামুক্ত শরতে) আর মালুখীয়া (এক প্রকার ঔষধ) নিষিদ্ধ করে। চামড়াহীন মাছ খেতে নিষেধ করা হয়। এছাড়াও কেউ তা বিক্রি করলে তাকে হত্যা করো।
৩৯৬ হিজরিতে হাকিম মিশর আর হারামাইন শরিফাইনে (মক্কা শরীফ আর মদিনা শরীফ) এ ফরমান জারি করে, যে কোনো স্থানে বা মজলিসে আমার নাম উচ্চারিত হলে শ্রবণকারী আমার সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাবে আর সিজদা করবে।
৩৯৮ হিজরিতে শিয়া সুন্নি দ্বন্দ্ব হয়। দীর্ঘদিন এ লড়াই চলতে থাকে। এতে শায়খ আবু হামিদ আসফারানী নিহত হোন। রাফেযীরা বাগদাদে হে হাকিম, হে মানসুর বলে চিৎকার করতে থাকে। এতে কাদের বিল্লাহ রেগে যান। তিনি এ বিশৃঙ্খলা দমন করেন। তিনি একদল অশ্বারোহী ফৌজ সুন্নতের অনুসারীদের সাহায্যার্থে পাঠান, যারা খুবই নির্মমভাবে শিয়াদের গর্দান উড়িয়ে দেয়।
এ বছর হাকিম বাইতুল মুকাদ্দাসের মধ্যে নির্মিত কামামার গির্জা ভেঙে ফেলে। মিসরের সকল গির্জা ধ্বংস করে। খ্রিস্টানদের গলায় এক হাত লম্বা আর পাঁচ রিতিল ওজনের ক্রিশ পড়ার নির্দেশ দেয়। ইহুদীদের গলায় লাল বর্ণের একই ওজনের ক্রুশ পড়ার আর কালো পাগড়ী বাধার হুকুম দেয়। এ কারণে অনেক ইহুদী ও খ্রিস্টান মুসলমান হয়। কিছুদিন পর সে আবার এই আইন বাতিল করে গির্জা পুনর্নির্মাণ এবং যারা অপারক হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো তাদেরকে স্বধর্মে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
৩৯৯ হিজরিতে বসরার কাযী আবু আমরকে অপসারন করে আবুল হাসান বিন শাওয়ারিবকে কাযী পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ বছর স্পেনের উমাইয়া বংশীয় সুলতান দুর্বল হয়ে পড়ায় রাষ্ট্র শক্তিহীন হয়ে পড়ে আর তার ব্যবস্থাপনা হাতছাড়া হয়ে যায়।
৪০০ হিজরিতে দজলা নদীর পানি এতোটাই কমে যায়, যা এর আগে আর কখনোই হয়নি। ফলে দজলার চর ভারা দেওয়া হয়।
৪০২ হিজরিতে হাকিম খেজুর ও আঙ্গুর বিক্রি করে দেয় এবং অনেক আঙ্গুরের গাছ ধ্বংস করে।
৪০৪ হিজরিতে রাত-দিন যে কোন মুহূর্তে মেয়েদের রাস্তায় বের হতে মানা করে। এ ফরমান তার মৃত্যু অবধি অব্যাহত ছিল।
৪১১ হিজরিতে হাকিম মিসরের হাল ওয়ান নামক গ্রামে নিহত হয়। আল্লাহ তার উপর অভিশাপ বর্ষণ করুন, তার স্থানে তার পুত্র আল যাহের লা আযাযুদ্বীনিল্লাহ উপাধি ধারণ করে সমাসীন হয়।
৪২২ হিজরির যিলহাজ্জ মাসের ১১ তারিখ সোমবার রাতে কাদের বিল্লাহ ইন্তেকাল করেন।
তার শাসনামলে যে সকল ওলামায়ে কেরাম ইন্তেকাল করেন, তারা হলেন – আবু আহমাদ আসকারী আদীব, রুমানী নাহুবিদ, আবুল হাসান, মাসরজসী, আবু আবদুল্লাহ মরযুবানী, মুঈদুদ্দৌলার উযীর সাহেব বিন উবাদা, হাফেজ দারা কুতনি, ইবনে শাহীন, আবু বকর আওদী ইমামুশ শাফিয়া, ইউসুফ, ইবনে সিরানী, ইবনে রুলাক আল মিসরি, ইবনে আবি যায়েদ আল মালিকী, কওতুল কুবের লেখক আবু তালিব আল মালী, ইবনে বাততা আল হাম্বলী, ইবনে শামউন খাতায়ী, খাতেমিল লগবী, আওফু আবু বকর, ইবনে গালবুন আল মাকরী, কাশমিহনা, মাআনী বিন যাকারিয়া আন নাহরুয়ানী, ইবনে খুওয়ায মিন্দাদ, ইবনে জনা, সহীদ এর লেখক জওহরী, আল জামালের লেখক ইবনে ফারেস, ইবনে মান্দাত আল হাফেজ ইসমাইল শায়খে শাফিয়াহ, আসবানা বিনিল ফারাজ শায়খে মালিকীয়া, বদিউযযামান (যিনি সবপ্রথম মাকামাত লিখেছেন), ইবনে লাল, ইবনে আবী যাযনীন, আবু হায়ান আত তাওহিদী, কবি আলওয়াদ, আল ফারিবিনের লেখক আল হারবী, কবি আবুল ফাতাহ আল বাসনী, হালিমী শায়খে শাফিয়াহ, ইবনুল ফারিয, আবুল হাসান আল কালবেসী, কাযী আবু বকর বাকলানী, আবু তবীব সালুকী, ইবনে আকফানী, আল খুতব এর লেখক ইবনে নাযাতাহ, সামিরী শায়খে শাফিয়াহ, মুসতাদরাকের লেখক হাকিম ইবনে কুজ, শায়খ আবু হামেদ, ইবনে ফুরাক, শরীফ রেযা, আবু বকর আর রাযী, হাফেয আবদুল গেনা বিন সাঈদ, ইবনে মারদুয়া, হাফতুল্লাহ বিন সালামা, ইবনুল বাওয়াব, আব্দুর রহমান, মুহামেলী, আবু বকর আল কাফাল, ইবনুল ফুখার, আলী বিন ঈসা প্রমুখ।
যাহাবি এছাড়াও অসংখ্য মনীষীর নাম উল্লেখ করেছেন।