আল মুযতাযহার বিল্লাহ আবুল আব্বাস আহমাদ বিন মুকতাদী বিল্লাহ ৪৭০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন।
তার পিতার মৃত্যুর পর ষোলো বছর বয়সে তিনি তখতে আরোহণ করেন।
ইবনে আসির বলেছেন, “তিনি খুবই কোমলমতি, উন্নত চরিত্র, নেককার আর সদা লাস্যমান। অনেক বিষয়ে তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন, যা তার ব্যাপক জ্ঞান ভাণ্ডারের অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি দানশীল, উদার আর ওলামা প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
এ খলীফার খিলাফতে অসুন্দরের কোন নমুনা পাওয়া যাবে না। খিলাফতের দিনগুলো তার যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে সর্বদা উদ্বিগ্ন অবস্থায় কেটেছে। খিলাফত লাভে প্রথম বছর মিসরের শাসনকর্তা মুসতানসির উবায়দীর মৃত্যুর পর তার ছেলে তখত নসীন হয়। এ বছর রোমানরা বলনসীয়াহ শহর দখল করে নেয়।
৪৮৮ হিজরিতে সমরকন্দের বাদশাহ আহমদ খা নিহত হয়। লোকটি বদদ্বীন ছিল। উমারাগন তাকে বন্দী করে আর মুফতিগণ তাকে হত্যার ফতোয়া দেন। তার স্থানে উমারাগন তার চাচাতো ভাইকে উপবেশন করায়।
৪৮৯ হিজরিতে একমাত্র শনিগ্রহ ছাড়া সকল গ্রহপুঞ্জ আর নক্ষত্ররাজি বুরজে হুতে মীন রাশি জমা হলে জ্যোতিষীরা ঐক্যমত্য হতে ভবিষৎবাণী করলো – অচিরেই নূহ (আঃ) এর যুগের মতো তুফান হবে। কিন্তু একটি প্লাবন ছাড়া আর কিছুই হয়নি। হাজীগন বাইতুল্লাহ শরীফে সমবেত হলে অধিকাংশ হাজী এ প্লাবনে ভেসে যায়।
৪৯০ হিজরিতে খুরাসানের শাসনকর্তা সুলতান আরসালান আরগোয়ান বিন আলব আরসালান সারজুকী নিহত হয়। সুলতান বুরকীয়ারুক তার রাজ্যগুলো পদানত করে আর শহরের লোকেরা এসে তার সাথে মিলিত হয়। এ বছর হলব, ইনতাকিয়া, মুরাহ আর শিরাজ শহরে এক মাস পর্যন্ত উবায়দীদের নামে খুৎবা পড়া হয়। এরপর আবার আব্বাসিয়দের নামে খুৎবা পাঠ শুরু হয়। এ বছর ফিরিঙ্গীরা এসে সর্বপ্রথম তায়কীয়া শহর দখল করে তাদের মর্জি মোওয়াফেক শহরে কুফর জারি করে। তারা পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে লুটতরাজ করে। ফিরিঙ্গীরা প্রথমে সিরিয়ায় অবস্থান করেছিলো। কুসতুনতুনিয়া পানিপথে ফৌজি বাহিনী নিয়ে আসে। বাদশাহ আর প্রজাবৃন্দের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ তারা গ্রহণ করে। কথিত আছে, সালজুকীদের শক্তি আর প্রতিপত্তি দেখে মিসরের বাদশাহ’র চিঠি কর্তৃক আবেদনের প্রেক্ষিতে তারা সিরিয়ায় হামলা চালায়। লোকেরাও তাদের প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
৪৯২ হিজরিতে ইস্পাহানে বতনিয়ূরা শক্তিশালী হয়ে উঠে। এ বছর ফিরিঙ্গীরা দেড় মাস দুর্গে আবদ্ধ থাকার পর বাইতুল মুকাদ্দীস দখল করে আর আলেম-ওলামা, ইবাদাতকারী ও দানশীলদের এক বড় জামাতাকে হত্যা করে। নিহতদের সংখ্যা আনুমানিক সত্তর সহস্রাধিক, সত্যবাদীদের ধ্বংস করে। ইহুদীদেরকে গির্জায় একত্রিত করে পুড়ে ফেলে, বাকিরা বাগদাদে পালিয়ে যায়। এ অত্যাচারের বিবরণ শুনে যে কোন চক্ষু অশ্রু ঝরাবে। কবিরা কবিতার তুলিতে এ পৈশাচিকতার করুন কাহিনী তুলে ধরেছেন। সুলতানগণ অপারক হয়ে সম্মিলিতভাবে ফিরিঙ্গীদের উপর হামলা চালিয়ে বাইতুল মুকাদ্দিস ছিনিয়ে নেয়।
এ বছর মিসরে এতোই অন্ধকার নেমে আসে যে, নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যেতো না। আকাশ থেকে অবিরাম বালু বর্ষিত হয়। এ অবস্থা দেখে লোকেরা ভাবে, ধ্বংসের সময় সমাগত প্রায়। এরপর কিছুটা আলোর কণা দেখা দেয়। এরপর পূর্ণ উজ্জ্বলতা বিকশিত হয়। আসর থেকে মাগরিবের পর পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজমান ছিল।
এ বছর ফিরিঙ্গী আর স্পেন শাসনকর্তা ইবনে নাশিকীনের মধ্যে লড়াই হয়। মুসলমানরা জয়লাভ করে। অনেক ফিরিঙ্গী নিহত ও বন্দী হয়। বিপুল পরিমাণে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ মুসলমানদের হস্তগত হয়। অনেক বড় বড় বীর বাহাদুর ফিরিঙ্গীরা পরপারের যাত্রী হয়।
৫০৭ হিজরিতে মৌসুলের বাদশাহ মওদুদ ফিরিঙ্গীদের বাদশাহ’র সাথে যুদ্ধ করার জন্য বাইতুল মুকাদ্দীস যান। সেখানে তুমুল যুদ্ধ হয়। এরপর মওদুদ দামেশকে এসে জামে মসজিদে জুমার নামায পড়ে বের হওয়ার সময় এক বাতনীর অতর্কিত আক্রমনে আহত হোন আর সে দিনেই তিনি মারা যান। ফিরিঙ্গীদের বাদশাহ দামেশকের শাসনকর্তার কাছে এ মর্মে পত্র লিখলো – তোমাদের এক আদনা গোলাম তোমাদের ঈদের দিন তোমাদের বাদশাহকে আল্লাহ’র ঘরে হত্যা করেছে। লজ্জার কথা যে, তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য।
৫১১ হিজরিতে প্রাকৃতিক প্লাবনে বুখার আর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো ডুবে যায়। এতে অনেক জানোমালের ক্ষতি হয়। এ বছর সুলতান মুহাম্মাদের মৃত্যু হয়। তার সাথে তার ছেলে মাহমুদ চৌদ্দ বছর বয়সে সুলতান হয়।
৫১২ হিজরিতে খলীফা মুসতাযহার বিল্লাহ ১৩ই রবিউল আউয়াল মঙ্গলবারে পঁচিশ বছর খিলাফত পরিচালনার পর জগতের মায়া কাটিয়ে পরপারে পাড়ি জমান। ইবনে আকীল শায়খে হানাবালা তাকে গোসল করান আর তার ছেলে আল মুসতারশিদ জানাযায় নামায পড়ান। এর অল্প কিছুদিন পর জাওয়ান নামক খলীফার দাদী ইন্তেকাল করেন। যাহাবি বলেন, আমার জানা মতে একমাত্র মুকতাদীর দাদী ছাড়া কেউ নাতির খিলাফতকাল দেখে যেতে পারেনি। মুকতাদীর দাদী, নাতি আর নাতির ছেলের যুগেও জীবিত ছিলেন।
মুসতাযহার কবিতা জানোতেন। তার অনেক কবিতা প্রসিদ্ধতা অর্জন করেছে।
সালাফি বলেছেন, আবুল খাত্তাব বিন জাররাহ আমার কাছে বর্ণনা করেছেনঃ আমি রমযান মাসের একদিন নামাযের ইমামতি করলাম। মুসতাযহারের রেওয়ায়েত অনুযায়ী কেরাতে সূরাহ ইউসুফের মধ্যে –
‘اِنَّ اِبْنُكَ سَرَ قَه
– (১২ – ৮১) আয়াতটি তিলাওয়াত করলাম। সালাম ফিরিয়ে মুসতাযহার বললেন, এটিই অধিকতর সঠিক কিরাত, কারন এর মাধ্যমে পয়গম্বরগণ ভ্রম থেকে দূরে বুঝায়।
তার যুগে যেসব ওলামায়ে কেরাম ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – আবুল মুতফার সামআনী, নাসরুল মুকাদ্দাসী, আবুল ফরজ, রুয়ানী, খতীব তিবরিযী , কিয়ার হারায়ী, ইমাম গাযালী, মুসতাযহারের প্রশংসা মূলক জীবনী লেখক শাশী, আয়বরদী আল লগবী প্রমুখ।