আল মুসতারশিদ বিল্লাহ আবু মনসুর আল ফজল বিন আল মুসতাযহার বিল্লাহ ৪৮৫ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতার মৃত্যুর পর ৫১২ হিজরির রবিউল আখির মাসে তিনি তখতে সমাসীন হোন। তিনি বীর, সাহসী, বিজ্ঞ আর বিচক্ষণ। খিলাফতের কাজ সুচারুরূপে সম্পাদন করতেন। খিলাফতের দেহে পুনর্জীবন দান করেন। খিলাফতকে সুসংহত ও সুদৃঢ়করণে বিস্তর অবদান রাখেন। শরীয়তের আরকানগুলো মজবুত করেন। তিনি স্বশরীরে যুদ্ধ করতেন। কয়েকবার হালা, মৌসুল আর খুরাসান যুদ্ধেও যান। শেষে হামদানের নিকটবর্তী রনাঙ্গনে তার ফৌজরা পরাজিত হয় আর তাকে বন্দী করে আযারবাইজানে পাঠানো হয়।
তিনি আবুল কাসেম বিন বয়ান আর আবদুল ওহাব বিন হাবতীল্লাহ আস সুবতীর কাছে হাদিস শ্রবণ করেন। মুহাম্মাদ ইবনে উমার বিন মক্কী আল আহওয়াযী, তার উযীর আলি বিন তারাদ, ইসমাইল বিন তাহের আল মৌসুলী তার থেকে রেওয়ায়েত করেন। (এটি সাআনীর বর্ণনা)
তার ইলম ও মর্যাদার ব্যাপারে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ইবনে সাল্লাহ তার স্বরচিত তবকাতে শাফিয়াহ গ্রন্থে লিখেছেন, আবু বকর আশ শাশী তার নামানুসারে একটি ফিকহ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, তিনি ‘উমদাতুত দুনিয়া ওয়াল আখিরা’ খেতাবে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
ইবনে সুবকী তবকাতে শাফিয়া গ্রন্থে লিখেছেনঃ মুসতারশিদ বিল্লাহ আবেদ আর দানশীল ছিলেন, পশমের পোশাক পড়তেন। ইবাদত করার জন্য নিজ আলয়ের একটি স্থান নির্ধারণ করেছিলেন।
পিতার খিলাফতকালে তার বাবা তাকে উত্তরাধিকার মনোনীত করে তার নাম খোদিত পয়সা চালু করেন। সুন্দর হস্তাক্ষরের ক্ষেত্রে বনু আব্বাসের সকল খলীফার মধ্য থেকে তিনি অগ্রজ। অধিকাংশ লেখক তার কাছে ভুল সংশোধন করতো। তার সাহসিকতা, প্রতিপত্তি, বীরত্ব, অগ্রগামিতা ছিল দিবাকরের মতো ভাস্বর, তবে তার সাশনামল ছিল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। বিরোধীরা তার উদয়াচলকে বিষণ্ণ করে তুলেছিলো। এ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও বিপন্ন অবস্থাকে কাটিয়ে উঠার জন্য তিনি নিজেই রণাঙ্গনে যান। সর্বশেষ তিনি ইরাকে গিয়ে পরাজিত হয়ে বন্দী হোন আর শাহাদাতের শরাব পান করেন।
যাহাবী বলেছেনঃ ৫২৫ হিজরিতে সুলতান মাহমুদ বিন মূলক শাহ নিহত হোন। তার ছেলে দাউদ সুলতান হয়। কিছুদিন পর তার চাচাতো ভাই মাসউদ বিন মুহাম্মাদ দাউদের উপর হামলা করে। উভয়ের মাঝে তুমুল লড়াই হয়। অবশেষে সালতানাতের অংশীদারিত্বের উপর সন্ধি হয়। বাগদাদে খুৎবায় মাসউদের নাম পাঠ করা হতে থাকে। কয়েক দিন পর মাসউদ আর খলীফার মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। মাসউদ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়, খলীফাও তার ফৌজ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু খলীফার সৈন্যরা বিশ্বাসঘাতকতা করে। অধিকাংশ সিপাহী খলীফার সঙ্গ বর্জন করে। ফলে মাসউদ জয়লাভ করে। খলীফা একদল অভিজাত লোকসহ বন্দী হোন। হামদানের নিকটবর্তী এক দুর্গে তাদের কয়েদ করে রাখা হয়।
এ খবর জানার পর বাগদাদের আবালবৃদ্ধবণিতা গভীর শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। সেদিন মানুষ এতোটাই স্তব্ধ হয়ে যায় যে, সেদিন নামায আর খুৎবা বন্ধ ছিল। ইবনে জাওজি বলেন, সেদিন বাগদাদে ভূমিকম্প হয়েছিলো, যা পাঁচ দিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। প্রতিদিন পাঁচ ছয়বার করে ভুকম্পন হতো। এতে লোকেরা ভীষণ ভয় পেয়ে খুবই বিনয়ের সাথে দুয়া করে।
সুলতান সিনজর তার ভাতিজা মাসউদের কাছে দূত পাঠিয়ে বললো, “তুমি খলীফার কাছে যাও। নিজেকে পাপী বলে ক্ষমা প্রার্থনা করো। অন্ধকার, বিদ্যুৎ আর ভূমিকম্পে সৈন্যদের মধ্যে হতাশা ও বিষণ্ণতার সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো আসমান আর যমীনের ভয়ংকর আলামত, যা দেখার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই। ফলে মসজিদগুলোতে নামায আর খুৎবা না হওয়া কতোই না গজব আর বিপজ্জনক কথা। তুমি অবিলম্বে আমিরুল মুমিনীনের কাছে হাজির হও। তাকে খুবই মর্যাদার সাথে দারুল খুলাফায় পৌঁছে দাও, যা আমাদের পূর্ব পুরুষেরা করতো। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণে তুমি সেবার চাদর শরীরে জোড়াও।”
মাসউদ সুলতান সিনজরের কথা মান্য করে। সে যমীনে খিদমত চুম্বন করে আর ক্ষমা প্রার্থনা করে। এরপর সুলতান সিনজর খলীফাকে সসম্মানে নিয়ে আসার জন্য মাসউদের কাছে দূতসহ একদল সৈন্য পাঠায়। এ সৈন্য দলের মধ্যে সতের জন বাতেনী (সম্প্রদায়ের লোক, যারা খিলাফত বিরোধী) ঢুকে পড়ে, যা সুলতান আর মাসউদ কেউই জানোতো না। কেউ কেউ বলেন, মাসউদ নিজেই তাদের লেলিয়ে দিয়েছিলো। অবশেষে তারা খলীফার তাঁবুতে ঢুকে অভিজাত লোকগুলোসহ খলীফাকে হত্যা করে। বাকি ফৌজরা যখন এ কথা জানোতে পারলো, তখন সব শেষ হয়ে গেছে। পরিশেষে তাদের বন্দী করে হত্যা করা হয়। আল্লাহ তাদের উপর অভশাপ বর্ষণ করুন।
প্রজাবৃন্দ এ কথা জানোতে পেরে কিয়ামত দিবসের মতো শোরগোল শুরু করে। এ খবর বাগদাদ পৌঁছলে হাশরের দৃশ্য নেমে আসে। জনতা উলঙ্গ শরীরে কাপড় পড়তে পড়তে ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে, নারীরা খোলা চুলে শোকগাঁথা গাইতে থাকে। কারন মুসতারশিদ বীরত্ব, ইবাদত আর নমনিয় মেজাজের কারণে সকলের কাছে প্রিয় ছিলেন। ৫২৯ হিজরির যিলকদ মাসের ষোলো তারিখ সোমবারে তিনি শহীদ হোন।
মুসতারশিদের কবিতাগুলর মধ্যে একটি হলো এটি, যা বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি আবৃত্তি করেন – “এটা বিস্ময়ের কোন কারন নয়, যদিও কুকুর বাঘের উপর বিজয় অর্জন করে। কারন ওয়াহশী তো হামযা (রাঃ) আর ইবনে মূলজেম তো আলী (রাঃ) কে শহীদ করেছিলো।”
পরাজিত হওয়ার মুহূর্তে লোকেরা মুসতারশিদকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে একটি কবিতা আবৃত্তি করেন। যাহাবি বলেছেন, মুসতারশিদ তার বাবার শান অনুযায়ী ঈদুল আযহায় সুন্দর একটি খুৎবা পাঠ করেন। উযির জালালুদ্দীন আল হাসান বিন আলী সদকাহ খলীফা মুসতারশিদের প্রশংসায় একটি কবিতা রচনা করেন।
৫২৪ হিজরিতে মুসতারশিদের যুগে মৌসুলে আকাশ থেকে আগুন বর্ষিত হয়। এ বছর মিসরের শাসনকর্তা আল আমর বি আহকামিল্লাহ মানসুর নিহত হলে তার চাচাতো ভাই হাফেয আবদুল মজিদ বিন মুহাম্মাদ বিন মুনতাসির ওলী হয়।
মুসতারশিদের শাসনামলে যে সকল ওলামায়ে কেরামগন ইন্তিকাল করেন তারা হলেন – শামসুল আইম্মা আবুল ফজল ইমামে হানাফিয়া, আবুল ওফা বিন আকিল হাম্বলী, কাযিউল কুযযাত আবুল হাসান আল দামগানী বিন বিলমাতুল মাকরী, আইম্মাতুল আজালের লেখক তগরায়ী, আবু আলী সিদফী হাফেজ, আবু নসর কুশায়রী বিন কাতা আল লগবী, মহিউসসুন্নাহ আল বাগবী, ইবনুল হায আল মাকরী, মাকামাতের লেখক হারীরী, আমসালের লেখক ময়দানী, আবুল ওলীদ বিন রুশদ আল মালিকী, ইমাম আবু বকর তরতুসী, আবুল হুজ্জাজ সয়কতী ইবনে সায়্যেদ যাতলুসী সী, আবু আলী আল ফারুকী শাফি বিন খাত তুরুত, ইবনে বাযশ, কবি জাফর, আবদুল্লাহ গাফফার প্রমুখ।