আল মুসতাযা বি আমরিল্লাহ আল হাসান বিন আল মুসতানজিদ বিল্লাহ ৫৩৬ হিজরিতে আর্মেনীয় গোযযা নামক বাঁদির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার ইন্তেকালের পর তিনি তখতে আরোহণ করেন।
ইবনে জাওযী বলেছেনঃ তিনি সরকার প্রধান হওয়ার পর সকল শুল্ক মওকুফ করে দেন, এতে করে জুলুমের গতিরুদ্ধ হয়, চারদিকে ইনসাফের শীতল বাতাস ছড়িয়ে পড়ে। আমি নিজের জীবনে কখনোই এমনটা দেখিনি। হাশেমী, উলুববী, ওলামায়ে মুদাররিসীন আর ইমামদের পিছনে তিনি অনেক অর্থ ব্যয় করেন, তিনি সর্বদা অর্থ ব্যয় করতেন। তার দৃষ্টিতে অর্থের কোন মূল্য ছিল না। তিনি খুবই নম্র আর দয়ার্দ্র ছিলেন। তিনি খলীফা হওয়ার সময় সকল সুলতানদের খিলাআত প্রদান করেন। মাখযিন ওয়ারযী বলেন, সে সময় তিনি লোকদের মাঝে এক হাজার তিনশো রেশমের কাবা (আলখেল্লা) বণ্টন করেন। বাগদাদে তার নামে খুৎবা পাঠ করা হলে তিনি অনেক দিনার সদকা করে দেন। রূহ বিন হাদিসিকে কাযিউল কুযযাত মনোনীত করে তাকে সতেরোটি গোলাম দান করেন।
ইবনে জাওযী বলেছেনঃ তিনি অধিকাংশ লোক থেকে পর্দা করতেন। খাদেম ছাড়া তিনি সওয়ার হতেন না আর সেবকগণ ছাড়া তার কাছে কেউ যেতে পারতো না।
কবি হায়েস বায়েস তার শানে দীর্ঘ কবিতা রচয়া করেছেন। তার খিলাফতকালে উমাইয়া বংশীয় শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। মিসরে তার নামে খুৎবা দেওয়া আর মুদ্রায় তার নাম খোদাই করা হয়। লোক মারফত এ সংবাদ বাগদাদে পৌঁছুলে একাধিক বাতির সমাহারে তীব্র আলোর ঝলকানিতে বাজার ঝলমল করে উঠে। ইবনে জাওযী বলেন, আমি এ ঘটনাকে নিয়ে ‘আল নসর আলাল মিসর’ নামে পৃথক একটি বই লিখেছি।
যাহাবি বলেছেনঃ ৫৬৭ হিজরিতে বাগদাদে রাফেযিদের প্রভাব একেবারেই নিঃশেষিত হয়। লোকদের নিরাপত্তা নসীব হয় আর সৌভাগ্য অর্জিত হয়। ইয়ামান, বুরকা, তুরিয, মিসর আর উসওয়ান পর্যন্ত তার নামে খুৎবা পাঠ হতে থাকে। অধিকাংশ বাদশা তার ফরমানগত হয়ে পড়ে।
উবাদ কাতেব বলেছেনঃ ৫৬৭ হিজরিতে সুলতান সালাহুদ্দীন বিন আইয়ুব মিসরের জামে মসজিদে আনুগত্যের উপর বয়ান করেন। প্রথম জুমআয় মিসরে তিনি বনু আব্বাসের নামে খুৎবা পাঠ করেন, এতে বিদআত নাস্তানাবুদ হয় আর শরীয়ত হয় স্পষ্ট। দ্বিতীয় জুমআয় তিনি বনু আব্বাসের নামে কাহেরায় খুৎবা দেন। এরপর আশুরার দিন মিসরের শাসনকর্তা আল আযদ বিল্লাহ মারা যায়। সালাহুদ্দীন তার সকল পরিত্যক্ত সৌখিন আসবাবপত্র হস্তগত করেন, এর মধ্যে মূল্যবান ও পছন্দনীয় জিনিশগুলো রেখে তিনি সবগুলো বিক্রি করে দেন। এগুলো বিক্রি করতে লেগেছিল দশ বছর। সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি এ সুসংবাদ দিয়ে শিহাবুদ্দিন আল মুযাফফর বিন আল আল্লামা বিন আবি উসরুনকে বাগদাদে পাঠান আর আমাকে (উবাদ কাতেব) খোশখবরীনামা লিখার নির্দেশ দেন। আমি লিখলাম –আল্লাহ তাআলা সত্যকে জয়যুক্তকারী, তিনি সত্যকে প্রকাশ আর ভ্রস্টতাকে ধ্বংস করেছেন। তার করুনায় আমরা কৃতজ্ঞ। শহর নগর জনপদের এমন কোন মিম্বর নেই, যেখানে আমাদের ইমাম মুসতাযা বি আমরিল্লাহ আমিরুল মুমিনীনের নামে খুৎবা পড়া হয়নি। সকল মসজিদ ইবাদতারী আর দানশীলদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বিদআতের মারকাযগুলো ভেঙে পড়েছে। আল্লাহ আমাদের হুকুমত প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমাদের জন্য যমীনকে বিস্তৃত করেছেন। আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী আমাদেরকে আল হাদ আর রাফেযদের উৎখাত করার তাওফিক দিয়েছেন। আমরা তদের ধ্বংস করতে পেরেছি। (হে আল্লাহ,) আব্বাসীয় রাজত্ব সত্যের উপর সুপ্রতিস্থিত করার তৌফিক আমাদের দিন।
এ চিঠিসহ বাগদাদে দূত পৌঁছালে খলীফা সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি আর সালাহুদ্দীনকে খিলআত ও মর্যাদাবান বস্তু আর উম্মাদ কাতেবের জন্য খিলআত ও একশো দিনার পাঠিয়ে দেন।
ইবনে আসির বলেছেনঃ সুলতান সালাহুদ্দীন মিসরের শাসনক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে নিলে আযিদ দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি সুলতান সালাহুদ্দীনকে খুলাফায়ে বনু আব্বাসের নামে খুৎবা পাঠ করতে বললেন। কিন্তু তিনি মিসরবাসীর অবাধ্যতার আশংকায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নুরুদ্দিন জঙ্গি খুৎবা পড়ার জন্য আবার তাকীদ দিলেন। ফলে তিনি আমীর উমারাদের নিয়ে পরামর্শে বসলেন। কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে মতামত তুলে ধরলো। এমন সময় আমিরুল আলিম নামের মিসরের এক আজমী লোক এসে বললো, আমি সর্বপ্রথম এ কাজ শুরু করবো। অতএব মুহাররম মাসের প্রথম জুমআয় সে ইমামের পূর্বে মিম্বরে দাঁড়িয়ে খলীফার জন্য দুয়া করে। লোকেরা বাধা দিলো না। দ্বিতীয় জুমআয় সালাহুদ্দীন আযীদের নামীয় খুৎবা বর্জনের নির্দেশ দেন। হুকুম তামিল করা হলো। লোকেরা কোনই কথা বলল না। সে সময় আযীদের অসুস্থতা দিন দিন বেড়েই চলেছিলো। অবশেষে সে আশুরার দিন মারা যায়।
৫৬৯ হিজরিতে সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি উপহারস্বরূপ খলীফার কাছে একটি গাধা পাঠান। এর শরীরে অক্ষরিক দাগ ছিল, একে উতাবী গাধা বলা হতো। এ বছর দজলা ও ফোরাতের পানিতে বাগদাদ প্লাবিত হয়। এ বছর দামেশকের শাসনকর্তা সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গির ইন্তেকালে তার ছেলে মুলকুস সালেহ ইসমাইল তখতে নসীন হয়। এ বছর ফিরিঙ্গীরা হামলা করতে এলে অনেক ধনদৌলত দিয়ে তাদের সাথে সন্ধি করা হয়। এ বছর উমাইয়া বংশীয় হিতাকাঙ্ক্ষীরা বনু উমাইয়ার সালতানাত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। সুলতান সালাহুদ্দীনের আমীরগণও এ চক্রান্তে যোগ দেয়। সংবাদ পেয়ে সুলতান সালাহুদ্দীন তাদের সকলকে বন্দী করে শূলে চড়ান।
৫৭২ হিজরিতে সুলতান সালাহুদ্দীন মিসর আর কাহেবার পাশে প্রাচীর নির্মাণের নির্দেশ দেন। এ কাজ বাহাউদ্দিনের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইবনে আসির বলেছেন, এ প্রাচীর ছিল উনত্রিশ হাজার তিনশো হাত। এ বছর তিনি জাবালে মুকতমে একটি দুর্গ নির্মাণের আদেশ দেন। কিন্তু তিনি এর শেষ দেখে যেতে পারেননি। এ বছর তার ইন্তেকাল হয়। তার ভাতিজা সুলতান মুলকুল কামেল এ কাজটি সমাপ্ত করেন। এ বছর সুলতান সালাহুদ্দীন ইমাম শাফির কবরে মাযার তৈরি করেন।
৫৭৪ হিজরিতে বাগদাদে অন্ধকার নেমে আসে আর আকাশে আগুনের মিনার দেখা দেয়।
৫৭৫ হিজরির শাওয়াল মাসের শেষে মুসতাযা ইন্তেকাল করেন।
তার খিলাফতকালে যে সকল ওলামায়ে কেরাম ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – নাহুবিদ ইবনে খুশাব, মুলকুল নাজ্জাত আবু নাজ্জার আল হাসান বিন সাফী, হাফেজ আবুল আল্লামা হামদানী, নাহুবিদ নাসিহুদ্দিন বিন দিহান, ইমাম শাফির আওলাদ হাফেজ আল কাবির আবুল কাসিম বিন আসাকির, কবি কায়েস বায়েস, হাফেজ আবু বকর বিন খায়রু প্রমুখ।