আল মুসতানসির বিল্লাহ আবু জাফর মানসুর বিন আয যাহের বি আমরিল্লাহ ৫৭৭ হিজরির সফর মাসে এক তুর্কি বাঁদির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতার পর ৬২৩ হিজরির রজব মাসে তিনি তখতে আরোহণ করেন।
তিনি প্রজাগণের মধ্যে ন্যায়বিচার ছড়িয়ে দেন, বিচার ব্যবস্থায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন। ওলামা আর দ্বীনদারদের উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। মসজিদ, মাদরাসা ও হাসপাতাল নির্মাণ করেন। দ্বীনকে শক্তিশালী করেন, শত্রুদের ধ্বংস করে দেন, সুন্নতের প্রসার ঘটান, ফিতনা দমন করেন, সুন্নতের উপর চলার তাকীদ দেন। জিহাদের সুন্দর ব্যবস্থাপনা তৈরি করেন, ইসলামের সাহায্যার্থে ফৌজি সমাবেশ ঘটান, অধিকাংশ দুর্গ দখল করেন।
মুফিক আবদুল লতিফ বলেছেন, “তিনি সুন্দর আখলাক গ্রহণের মাধ্যমে মসনদে আরোহণ করেন। তিনি বিদআত বন্ধ করেন। দ্বীনদার সভাসদ নিয়োগ, ইসলামকে শক্তিশালী, বিলুপ্তপ্রায় দ্বীনের কাজ পুনঃপ্রবর্তন আর লোকদের অন্তরে সে কাজগুলোর প্রতি ভালোবাসার সৃষ্টি করেন। মুখে মুখে তার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে। তার ত্রুটিগুলো দৃষ্টির আড়ালে পড়ে থাকে।
হাফেজ যাকীউদ্দীন আবদুল আযিম মুনযেরি বলেছেন, “মুসতানসির নেককার আর নেক কাজের প্রতি খুবই নিষ্ঠাবান। তিনি মাদরাসা আল মুনতাসিরীয়া নামক একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এখানে মোটা অংকের ভাতা প্রদান সাপেক্ষে আহলে ইলমদের আহবান জানানো হয়।
ইবনে ওয়াসেল বলেন, মুনতাসির দজলা নদীর তীরে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ধরণের উন্নত প্রতিষ্ঠান পৃথিবীতে আর একটিও ছিল না। তৎকালীন যুগে এহেন ছাত্রসমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান ছিল দুনিয়াতে বিরল। এ প্রতিষ্ঠানে চার মাযহাবের চার শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এতে একটি হাসপাতালও ছিল। ফকিহদের জন্য ছিল একটি বাবুর্চিখানা। পর্যাপ্ত ঠাণ্ডা পানির ব্যবস্থা ছিল। ফকিহদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা, যানবাহন, তেল, প্রদীপ, কাগজ ইত্যাদির সরবরাহ ছিল অফুরন্ত। এরপরও ফকিহদের এক দিনার করে মাসিক ভাতা দেওয়া হতো। তাদের জন্য হাম্মামখানাও নির্মাণ করা হয়। পূর্ববর্তী যুগে যার কোনই দৃষ্টান্ত ছিল না। খলীফার সেবায় নিয়োজিত থাকা বিশাল সেনাবাহিনী, তার পিতা ও দাদারও এতো সুবিশাল বাহিনী ছিল না। তিনি নিজেও একজন সাহসী, নির্ভীক, বীর-বাহাদুর লোক ছিলেন। তাতাররা তার রাজ্যগুলোতে আক্রমণ করলে তার বাহিনী রুখে দাঁড়ায়। ফলে তাতাররা লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়। খিফাজী নামক খলীফার এক ভাই ছিলেন, তিনি একজন নির্ভীক যোদ্ধা। তিনি বলতেন, “আমি খলীফা হলে জীবনসাগর পাড়ি দিয়ে তাতারদের সাথে এক বিশাল ফৌজবাহিনী নিয়ে লড়াই করে তাদের মূলোৎপাটন করতাম। কেড়ে নিতাম তাদের সকল ভূখণ্ড।” মুনতাসিরের মৃত্যুর পর তার দুর্ভাগ্য তাকে নিদারুনভাবে জড়িয়ে ধরে। আত্মম্ভরিতা, মদ্যপান আর কর্কশ স্বভাবের কারণে লোকেরা তার বাইয়াত গ্রহণ না করে মুসতানসিরের ছেলে আবু আহমাদের হাতে বাইয়াত করে। আবু আহমাদ ছিলেন শান্ত প্রকৃতির খলীফা।
যাহাবি বলেন, মাদরাসা মুসতানসারীয়ার বাজেট ছিল সত্তর মিসকাল। মাদরাসার ভিত্তি দেওয়া হয় ৬২৫ হিজরিতে, আর এ কাজ শেষ হয় ৬৩১ হিজরিতে। এতে একটি গ্রন্থাগার ছিল। ১৬০ উট বহনযোগ্য গ্রন্থাদি সমৃদ্ধ এ পাঠাগারে চার মাযহাবের ২৪৮ জন ছাত্র জ্ঞান চর্চা করতো। এতে হাদিস, নাহু (আরবি ব্যাকরণ), চিকিৎসা বিদ্যা ও দর্শনের পৃথক অনুষদ ছিল। তাদের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক খাওয়ার সুব্যবস্থা ছিল। এ ছাড়াও এ মাদরাসায় তিনশো এতিম ছাত্র জ্ঞান অর্জন করতো। যাহাবি এ প্রতিষ্ঠানের জন্য ওকফকৃত গ্রাম আর ভূখণ্ডের বিশদ বিবরণ পেশ করেছেন। এ মাদরাসার শিক্ষাবর্ষ শুরু হতো রযব মাসে। বর্ষ শুরু সময় বিচারপতিগণ, শিক্ষকমন্ডলি, মন্ত্রী পরিষদ আর সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ অফিসারদের নিয়ে একটি সভার আয়োজন করা হতো।
৬২৮ হিজরিতে দামেশকের শাসনকর্তা মূলক আশরাফ দারুল হাদিস আশরাফিয়া নামক এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি দেয়, যা ৬৩২ হিজরিতে শেষ হয়।
৬৩২ হিজরিতে প্রচলিত স্বর্ণের ক্ষুদ্রাংশে নির্মিত মুদ্রার পরিবর্তে মুসতানসির চাদীর মুদ্রা তৈরি করেন।
৬৩৫ হিজরিতে কাযী শামসুদ্দিন আহ্মাদ আল জুফী দামেশকের বিচারক মনোনীত হোন। তিনি সাক্ষ্য প্রদানের জন্য সর্বপ্রথম একটি ঘর নির্মাণ করেন। আর আগে সাক্ষ্যদানের জন্য আদালতে হাজির হতে হতো। এ বছর দামেশকের শাসনকর্তা আশরাফ মারা যায়। এর দুই মাস পর মিসরের শাসনকর্তা কামেলও মারা যায়। এরপর মিসরে কামেলের ছেলে তখতে উপবেশন করে, তার উপাধি ছিল আদেল সুলতান। কিছুদিন পর তাকে অপসারণ করে তার জায়গায় তার ভাই আস সালিহ আইয়ুব নাজমুদ্দীনকে বসানো হয়।
৬৩৭ হিজরিতে শায়খ আযুদ্দীন বিন আব্দুস সালাম দামেশকের খতীব মনোনীত হোন। এ বছর ইয়ামানের শাসনকর্তা নুরুদ্দীন উমর বিন আলী বিন রসূল আল তুর্কমানীর দূত খিলাফতের দরবারে এসে মিসরের সালতানাত প্রার্থনা করে।
৬৩৯ হিজরিতে মিসর শাসনকর্তা আস সালিহ প্রাসাদে একটি মাদরাসা আর প্রাসাদ সংলগ্ন বাগানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। কিন্তু ৬৫১ হিজরিতে তার গোলাম সেগুলো নষ্ট করে ফেলে।
৬৪০ হিজরির জামাদিউল আখির মাসের শুক্রবারে মুসতানসির ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুতে কবিগণ শোকগাঁথা রচনা করেন।
মুসতানসিরের শাসনামলে যেসব ওলামা ইন্তেকাল করেছেন তারা হলেন – ইমাম আবুল কাসিম আর রাফী, জামালুল মিসরী, ইবনে মাযুর আন নাহবী, ইয়াকুব আল হুমুবী, আল মিফতা গ্রন্থকার সিকাকী, হাফেজ আবুল হাসান বিন কিতান, মুফিক আবদুল লতিফ বাগদাদী, হাফেজ আবু বকর ইবনে নুকতা, আযুদ্দীন আলি বিন আসির – যিনি তারিখ, ইনসাব আর আসবুল গাবা’র গ্রন্থকার, কবি ইবনে গানাবী, সাইফুল আমাদী, ইবনে ফুযলান, তায়িয়ার লেখক উমর বিন আল ফারিয, আওয়ারিফুল মাআরিফ গ্রন্থের লেখক শিহাবুদ্দীন সহরওয়ারদি, আল মাওলুদুন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর লেখক বাহামা বিন শাদ্দাদ আবুল আব্বাস উফী, আল্লামা আবুল খাত্তাব বিন ওহয়া, ইকতেফা ফিল মাগাযী গ্রন্থকার হাফেজ আবু রবী বিন মুসলিম, কবি ইবনে শুরা, জামালুল হাযরামী শায়খে হানাফী যিয়া বিন আসির প্রমুখ।