আল মুসতাকফী বিল্লাহ আবু রাবীআ সুলায়মান বিন হাকিম বি আমরিল্লাহ ৬৮৪ হিজরির মুহাররম মাসের মাঝামাঝিতে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতার খিলাফতকালে তিনি উত্তরাধিকার মনোনীত হওয়ায় পরবর্তীতে খলীফা হোন।
৭০১ হিজরির জামাদিউল আউয়াল মাসে মিসর আর সিরিয়ার মিম্বরগুলোতে তার নামে খুৎবা পাঠ করা হয়। এর সুসংবাদ মুসলিম সাম্রাজ্যের চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। খিলাফতের খান্দানরা আস্তাবলে থাকতেন। সুলতান তাদের দুর্গে ডেকে এনে তাদের পৃথক পৃথক করে দেয়।
৭০২ হিজরিতে তাতাররা সিরিয়ার উপর হামলা চালায়। খলীফা আর সুলতান যৌথভাবে মোকাবিলা করলে তারা পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে অনেক তাতার সৈন্য নিহত হয়। এ বছর মিসর আর শামে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়, ফলে বিধ্বস্ত বাড়ির নিচে অনেক মানুষ চাপা পড়ে মারা যায়।
৭০৪ হিজরিতে আমীর বিবরস জামে মসজিদে হাকিম-এ দরস তদরীস (শিক্ষা দিক্ষা) শুরু করেন। তিনি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো পুনঃনির্মাণ করেন। তিনি চারজন কাযী নিয়োগ করেন। ফিকহের দুজন শিক্ষক, সাউদুদ্দিন হারেসী হাদিসের জন্য আর আবু হায়ানকে আরবি ব্যাকরণের উস্তাদ পদে নিয়োগ দেন।
৭০৮ হিজরির রমযান মাসে সুলতান আল মুলকুন নসর মুহাম্মাদ বিন কারাদুন হজব্রত পালনের জন্য মিসর থেকে এক জামাআত আমীর-উমারাসহ যাত্রা করে। পথিমধ্যে এ সড়ক দুর্ঘটনায় মর্মাহত হয়ে সে মিসরে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার সংবাদ পাঠালে ৭০৮ হিজরির শাওয়াল মাসের ২৩ তারিখে রুকুনদ্দৌলা বিবরস তার স্থানে অধিষ্ঠিত হয়। সে মুলকুল মুযাফফর উপাধি ধারণ করে। খলীফা তাকে খিলআত আর পাগড়ি প্রদান করেন। এরপর খলীফার একটি ফরমান নিয়ে সে সিরিয়া যায়। শাহী ফরমানে লিখা ছিল –
إِنَّهُ مِن سُلَيْمَانَ وَإِنَّهُ بِسْمِ اللَّـهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ
৭০৯ হিজরিতে আল মূলকুন নাসর আবার সালতানাতের দাবী করলে আমীর উমারাদের একটি জামাআত তাকে সমর্থন জানায়। শাবান মাসে দামেশকে আসে আর ঈদুল ফিতরের দিন সে মিসরের দুর্গে প্রবেশ করে। মুলকুল মুযাফফর পালিয়ে যায় আর পরবর্তীতে তাকে হত্যা করা হয়।
এ বছর তাতারিদের বাদশাহ ফুবন্দ তার রাজ্যে রাফেযিদের অনুরূপ খতীবদের আলি (রাঃ), আহলে বাইত আর তার আওলাদ ছাড়া খুৎবায় কারো নাম উল্লেখ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে। তার মৃত্যু পর্যন্ত, অর্থাৎ ৭১৬ হিজরি পর্যন্ত এ নির্দেশ বহাল ছিল।
তারপর তার ছেলে আবু সাইদ ক্ষমতায় আরোহণ করলে চারদিকে ইনসাফ ছড়িয়ে পড়ে। তিনি সুন্নতকে কায়েম করেন। খুৎবায় যথাক্রমে আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ), উমর ফারুক (রাঃ), উসমান গনী (রাঃ) আর আলি মুর্তজা (রাঃ) এর নাম জারি করেন। তার প্রশাসনিক নীতি সকল (তাতারি) বাদশাহদের নীতি অপেক্ষা শ্রেয়, বলিষ্ঠ ও উত্তম ছিল। তিনি সুন্নতের অনুসারী ছিলেন। মৃত্যু অবধি তিনি এই অভিন্ন তরিকার উপর অটুট ছিলেন। ৭৩৬ হিজরিতে তার মৃত্যুর পর তাতারিদের সালতানাত দুর্বল হয়ে পড়ে।
৭১৭ আর ৭২৭ হিজরিতে নীল নদের পানিতে পার্শ্ববর্তী জনপদগুলো প্লাবিত হয়।
৭২৮ হিজরিতে পবিত্র মক্কা শরীফের মসজিদে হারাম আর তার দরজা নির্মাণ করা হয়, আর দরজার একটি অংশ বাবে বনু শায়বা পর্যন্ত প্রলম্বিত ছিল।
৭৩০ হিজরিতে মাদরাসা সাহিলিয়ায় জুমআর নামায কায়েম করা হয়। এ বছর কুসুন একটি জামে মসজিদ নির্মাণ করেন। সেখানে সুলতান আর পদস্থ অফিসারগণ একত্রিত হয়ে প্রধান বিচারপতি জালালুদ্দীনকে খতীব নিয়োগ করা হয়। এরপর ফখরুদ্দীন বিন শুকর স্থায়ী খতীব হিসেবে নিয়োগ পান।
৭৩৩ হিজরিতে সুলতান আবনুস গাছের কাঠ দিয়ে কাবা শরীফের দরজা তৈরি করে। এর উপর একটি রৌপ্য লাগানো হয়, যার অর্জন পঁয়ত্রিশ হাজার তিনশো পঁয়তাল্লিশ মিসকাল। পুরানো দরজায় ইয়ামনের শাসনকর্তার খোদিত নামটি তুলে ফেলা হয় আর এর কাঠগুলো বনু শায়বার লোকেরা চেয়ে নেয়।
৭৩৬ হিজরিতে সুলতান খলীফাকে কেল্লার এক শীর্ষ প্রকোষ্ঠে নজরবন্দি করে। লোকদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
৭৩৭ হিজরির যিলহাজ্জ মাসে আত্মীয়-স্বজনসহ খলীফাকে কুসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাকে নিয়মিত ভাতা দেওয়া হতো। অবশেষে খলীফা ৫০ বছর বয়সে ৭৪০ হিজরির শাবান মাসে ইন্তেকাল করেন। তাকে সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
ইবনে হাযার ‘আদ-দর’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ খলীফা মুসতাকফি জ্ঞানী, উদার আর বীর বাহাদুর ব্যক্তি ছিলেন। তার হস্তাক্ষর ছিল অপূর্ব। বন্দুকের গুলি ছোঁড়া আর পোলো খেলার ক্ষেত্রে তাকে উস্তাদ মনে করা হতো। তিনি ওলামা আর সাহিত্যিকদের সহচরত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আদের খুবই শ্রদ্ধা আর সমাদর করতেন। তার শাসনামলে, নজরবন্দী থাকাকালীন, এমনকি কুসে অবস্থান করার সময় সর্বদা তার নামে খুৎবা পাঠ করা হতো। প্রথমে খলীফার সাথে সুলতানের মধুর ও নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তারা একসাথে ভ্রমনে বের হতেন, পোলো খেলতেন আর উভয়ের মাঝে ভাত্রিত্বের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। একদিন খলীফার একটি চিঠি পড়ে সুলতান তার উপর অসম্ভব রাগ করে। এ চিঠিটি খলীফা এক লোকের কাছে লিখেছিলেন। এতে লেখা ছিল – মজলিশের প্রারম্ভে আমি সুলতানকে অমুক লেনদেনের কারণে পেশ করতে চাই। এরপর সুলতান তাকে কুসে পাঠিয়ে দেয় আর তার জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দেয়। খলীফার সম্মান মিসরের চেয়েও কুসে বেশী ছিল।
ইবনে ফাযলুল্লাহ ‘আল মাসলিক’ গ্রন্থের অনুবাদ করতে গিয়ে লিখেছেনঃ খলীফা মুসতাকফী খুবই নম্র হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
তার যুগে যেসব ওলামা ইন্তেকাল করেন তারা হলেন – কাযি উল কুযযাত তাকিউদ্দিন বিন দাকিকুল ঈদ, শায়খ যীনুদ্দিন আল ফারুকি, হাফেজ শরফুদ্দীন, যিয়াউত তুসী, হানাফি ইমাম আর হিদায়ার ব্যাখ্যাকার শামসুস সুরুজী, শাফি ইমাম নজমুদ্দীন বিন রিফা, মক্কার মুহাদ্দিস ফখরুস সুরী, শাইখুল হাদিস সদরুদ্দীন বিন ওকীল, মক্কার ইমাম রেযা আবারী, শায়খ তাকিউদ্দিন বিন তাইমিয়া প্রমুখ।