আল মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আল মুতাযদ সর্বশেষ খলীফাদের পিতা। তিনি প্রথমে উত্তরাধিকার মনোনীত হয়েছিলেন। তার পিতার মৃত্যুর পর ৭৬৩ হিজরির জমাদিউল উলা মাসে তিনি খিলাফতের তখতে আরোহণ করেন। তিনি পঁয়তাল্লিশ বছর খিলাফত পরিচালনা করেন। এর মধ্যে সেই সময়টুকুও অন্তর্ভুক্ত, যে সময়ে তিনি অন্তরীন ছিলেন। এর বিবরণ আমরা সামনে পেশ করবো।
তিনি অনেক আওলাদ রেখে যান। কথিত আছে, তিনি ছিলেন একশো সন্তানের জনক। এদের মধ্যে কেউ গর্ভে, প্রসবের সময় আর শৈশবে মারা গেছে। আর অধিকাংশরা পরিণত বয়সে পরলোক গমন করে। এদের থেকে পাঁচজন খিলাফতপ্রাপ্ত হোন, যার নজির অন্য খলীফাদের মধ্যে বিরল। তারা হলেন – আল মুসতাইন আল আব্বাস, আল মুতাযদ দাউদ, আল মুসতাকফী সুলায়মান, আল কায়িম হামযা, আল মুসতানজিদ ইউসুফ।
খলীফা মুতাওয়াক্কিলের জীবিত আওলাদের মধ্যে একমাত্র মুসা-ই বাকি থাকে, যে চারিত্রিক দিক থেকে ইব্রাহীম বিন মুসতাকফীর অনুরূপ ছিল। সে সময় বনু আব্বাসের যতগুলো লোক ছিল, মুতাওয়াক্কিলের আওলাদই ছিল ততগুলো।
৭৬৪ হিজরিতে আল মানসুর মুহাম্মাদ অপসারিত হলে শাবান বিন হুসাইন বিন নসর বিন মুহাম্মাদ বিন কালাদুন ‘আশরাফ’ উপাধি নিয়ে সুলতান মনোনীত হয়।
৭৭৩ হিজরিতে অভিজাতবর্গকে সহজে নির্ণয়ের জন্য সুলতান তাদেরকে সবুজ পাগড়ী বাধার নির্দেশ দেয়। এটা ছিল একটি অভিনব কাজের আদেশ।
এ বছর উদ্ধত তাইমুর লং আক্রমণ চালিয়ে শহরগুলো ধ্বংস করে ফেলে, অনেক বনি আদমকে হত্যা করে আর আল্লাহ’র যমিনে ফিতনা ছড়িয়ে দেয়। আল্লাহ এই অভিশপ্তকে ৮৭৩ হিজরিতে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেন। তাইমুর লং দিহকানের বাসিন্দা ছিল। সে চুরি রাহাজানির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর খায়ল শহরের সুলতানের কাছে চলে যায়। সুলতানের মৃত্যু হলে সে তার স্থানে বসে। আস্তে আস্তে সে এমন বেড়ে যায় যে, কিয়ামত পর্যন্ত ইতিহাসে তার নাম রয়ে যায়। এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হয় যে, তাইমুর লং সর্বপ্রথম কতো সালে হামলা করে ? সে জবাব দেয়, শাস্তির বছর। কারন আরবী বর্ণমালার মান-নির্ণয় অক্ষরের বিন্যাস প্রণালীর দৃষ্টিকোণ থেকে শাস্তি (عذاب ) এর সংখ্যাগত মান ৭৭৩।
৭৭৫ হিজরির রমযান মাসে সুলতানের সামনে কেল্লার মধ্যে বুখারী শরীফের ক্লাস শুরু হয়। প্রথমে হাফেজ যাইনুদ্দিন ইরাকি, পরবর্তীতে শিহাবুদ্দিন ইরয়ানী ক্বারি নিযুক্ত হোন।
৭৭৮ হিজরিতে আশরাফ শাবান নিহত হলে তার ছেলে আলী আল মানসুর উপাধি নিয়ে তখত নসীন হয়। এ বছর শাবান মাসের ১৪ তারিখে চন্দ্রগ্রহণ আর ২৮ তারিখে সূর্যগ্রহণ হয়।
৭৭৯ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের ৪ তারিখে আতা বেগ আল আসাকির যাকারীয়া বিন ইব্রাহীম বিন আল মুসতামসিক বিন খলীফা হাকিমকে খিলআত প্রদান করে আর খলীফা বানিয়ে দেয়। অথচ কেউ তার কাছে বাইয়াত করেনি আর কেউ তার বিষয়ে ইজমাও করেনি। যাকারিয়া বিন ইব্রাহীম আল মুসতাযদ উপাধি ধারণ করে খলীফা মুতাওয়াক্কিলকে কুস শহরে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। আশরাফ নিহত হওয়ার সময় আতাবেগের অন্তরে খলীফার প্রতি জিঘাংসার সৃষ্টি হয়। মুতাওয়াক্কিল কুসে গেলে রবিউল আউয়ালের বিশ তারিখে মুসতাযদ পনেরো দিনের জন্য খলীফা হয়ে সেও অপসারিত হয়।
৭৮২ হিজরিতে নামাজের সময় এক লোক চিল্লাচিল্লি করলে নামায শেষে তাকে শুকরের সুরতে দেখা গেলো।
৭৮৫ হিজরির সফর মাসে মানসুর নিহত হলে তার ভাই হাজী বিন আশরাফ সালিহ উপাধি নিয়ে সুলতান মনোনীত হয়। ৭৮৪ হিজরির রমযান মাসে সালিহ অপসারিত হয় এবং যাহির উপাধি নিয়ে বরকুক বাদশাহ হয়।
৭৮৫ হিজরির রজব মাসে বরকুক খলীফা মুতাওয়াক্কিলকে জাবাল দুর্গে বন্দী আল ওয়াসিক বিল্লাহ উপাধি দিয়ে মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম আল মুসতামসিক বিন হাকিমের হাতে বাইয়াত করে নেয়। মুহাম্মাদ ৭৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করলে লোকেরা মুতাওয়াক্কিলকে পুনরায় খলীফা মনোনীত করার জন্য অনুরোধ জানালে বরকুক তা প্রত্যাখ্যান করে। সে তার ভাই মুহাম্মাদ যাকারিয়াকে ডেকে এনে খলীফা বানায়। সে ৭৯১ হিজরি পর্যন্ত খলীফা ছিল। অবশেষে বরকুক লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে মুতাওয়াক্কিলকে মুক্তি দেয় আর তাকে আবার খলীফা মনোনীত করে, আর যাকারিয়াকে অপসারণ করা হয়। সে স্বেচ্ছায় গৃহজীবন বেছে নেয় আর সেখানেই তার মৃত্যু হয়। আর মুতাওয়াক্কিল মৃত্যু অবধি খলিফাই থাকেন।
এ বছর জামাদিউল আখির মাসে সালিহ হাজী নিজের উপাধি পরিবর্তন করে আল মানসুর উপাধি ধারণ করে বরকুককে করগ শহরে বন্দী করে। এ বছর মুয়াযযিনরা আযানের মধ্যে একটি নতুন শব্দ – الصلوة والتسليم علي النبي صلي الله عليه وسلم বৃদ্ধি করে, যা স্পষ্ট বিদআত।
৭৯২ হিজরির সফর মাসে আল মানসুর সুলতান হয়। মৃত্যু অবধি ৮০১ হিজরি পর্যন্ত সে এ পদেই বহাল থাকে। তারপর তার ছেলে ফরজ নাসর উপাধি নিয়ে সুলতান হয়। ৮০৮ হিজরির রবিউল আউয়াল মাসের ছয় তারিখে তাকে অপসারণ করে তার ভাই আবদুল আযিযকে আল মানসুর উপাধি দিয়ে তখতে বসিয়ে দেওয়া হয়। এ বছর জমাদিউল আখের মাসের ৪ তারিখে তাকে অপসারণ করা হয় আর নাসর দ্বিতীয়বার সুলতান মনোনীত হয়।
৮০৮ হিজরির রজব মাসের ১৮ তারিখ সোমবার রাতে খলীফা মুতাওয়াক্কিল ইন্তেকাল করেন।
তার যুগে যেসব ওলামা ইন্তেকাল করেছেন তারা হলেন – শামস বিন মুফলী, সালাহুস সফদী, শিহাব বিন নাকিব, মুহিব নাযিরু জায়েশ, হাফেজ শরিফুল হুসাইনী, কুতুব তাহতানী, বিচারপতি আযুদ্দীন বিন জামাত, তাজ বিন সুবকী, বাহাউদ্দিন বিন সুবকী, জামাল আসতুবী, ইবনে সানিহ হানাফি, জামাল বিন বানাত, আফীফ ইয়াফগী, জামাল শুরায়শী, শরফ বিন কাযি জাবাল, সিরাজ আল হিন্দি, ইবনে আবি হাজালা, হাফেজ তকীউদ্দিন বিন রাফে, হাফেজ উমামুদ্দিন বিন কাসির, নাহুবিদ আতাবী, বাহা আবুল বাকা সুবকী, শামস বিন খতীব বৈরুত, উম্মাদ হিসবাতী, বদর বিন হাবিব, যিয়াউল কারমী, শায়খ আকমালুদ্দীন, শায়খ সাআদুদ্দীন, বদর, সিরাজ ইবনে মানকিন, সিরাজ বালকিনী, হাফেজ যাইনুদ্দীন ইরাকী প্রমুখ।