পরিশিষ্ট

আমি এ গ্রন্থ প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত ইতিহাসগুলো থেকে তাত্ত্বিক সহায়তা গ্রহণ করেছি –

(১) তারীখে যাহাবী – এতে ৭০০ হিজরী পর্যন্ত সংঘটিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ রয়েছে।

(২) তারীখে ইবনে কাসীর – ৭৩৮ হিজরীর ইতিহাস পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।

(৩) মাসালিক – ৭৭৩ হিজরীর ইতিহাস সন্নিহিত।

(৪) ইবনে হাজার আসকালীনী রচিত ইবনাউল উমার – এতে তিনি ৮৫০ হিজরী পর্যন্ত ইতিহাস লিখেছেন।

এছাড়াও নিম্নবর্ণিত ইতিহাসগুলো থেকে সংকলন ও উদ্ধৃতি দিয়েছি –

(৫) তারীখে বাগদাদ – খতীব (১০ খণ্ড)।

(৬) তারীখে দামেশক – ইবনে আসাকির (৫৭ খণ্ড)।

(৭) আওরাক – সূলী (৭ খণ্ড)।

(৮) তওরীয়াত (৩ খণ্ড)।

(৯) হিলয়াহ – আবু নাঈম (৭ খণ্ড)।

(১০) মাজালিসাহ – দিনুরী।

(১১) কামিল – মুবাররদ (২ খণ্ড)।

(১২) আমালী,সালাবা। এছাড়াও ইতিহাসের অন্যান্য গ্রন্থাদি।

 

স্পেনের উমাইয়্যা রাজত্ব

স্পেনের প্রথম বাদশাহ আব্দুর রহমান বিন মুআবিয়া বিন হিশাম বিন আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান। ১৪৮ হিজরীতে স্পেনে পালিয়ে গেলে তার কাছে খিলাফতের বাইআত করা হয়। তিনি আলেম আর ন্যায়পরায়ণ। ১৭০ হিজরীর রবিউল আখির তার মৃত্যু হলে তার স্থানে তার পুত্র হিশাম আবু ওয়ালীদ তখতে আরোহণ করেন। ১৮০ হিজরীর সফর মাসে তার মৃত্যুর পর তার ছেলে আল-হাকাম আবুল মুযাফফর মুর্তজা উপাধি নিয়ে মসনদে বসেন। ২০৬ হিজরীর যিলহজ মাসে তিনি মারা যান।

তার ছেলে আব্দুর রহমান পিতার শূন্য তখত অলংকৃত করেন। তিনি সর্বপ্রথম স্পেনের মাটিতে উমাইয়্যাদের শাসন ব্যবস্থা পরিপক্ব ও মজবুত করেন। তিনি স্পেনে খিলাফতের মহত্ত্ব ও আভিজাত্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার যুগে পোশাক অলংকৃত করা হয় এবং দিরহাম তৈরি করা হয়, এর আগে এখানে মুদ্রা তৈরি হতো না। পূর্বাঞ্চলীয় লোকেরা যে দিরহাম নিয়ে আসতো, সেটাই এখানে চলতো। তিনি মুদ্রা তৈরির কারখানা নির্মাণ করেছিলেন। তিনি শান-শওকত ও প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক থেকে ওয়ালীদ বিন আব্দুল মালিকের মতো এবং দর্শনশাস্ত্র প্রবর্তনের ক্ষেত্রে বনূ আব্বাসের খলীফা মামুনের অনুরূপ ছিলেন। তিনি স্পেনে সর্বপ্রথম দর্শন নিয়ে আসেন।

২৩৯ হিজরীতে তার ইন্তেকালের পর তার ছেলে মুহাম্মাদ তখত নসীন হোন। ২৭৩ হিজরীর সফর মাসে তার অন্তর্ধানে তার ছেলে আল মুনযির বাদশাহ হোন। ২৭৫ হিজরীর সফর মাসে তার মৃত্যুর পর তার ভাই আব্দুল্লাহ মসনদে উপবেশন করেন। তিনি স্পেনের খলীফাদের মধ্যে ইলম ও শরীয়তের দিক দিয়ে সর্বোত্তম। ৩০০ হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে তার ইন্তেকালের পর তার স্থানে তার পৌত্র আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মাদ আন নাসর উপাধি নিয়ে তখতে উপবেশন করেন। তিনি সর্বপ্রথম স্পেনকে খিলাফতের উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সর্বপ্রথম তাকে আমিরুল মুমিনীন হিসেবে সম্বোধন করা হয়। খলীফা মুকতাদরের শাসনকালে বনূ আব্বাসের খিলাফত দুর্বল হয়ে পড়ায় তিনি স্পেনের মাটিতে খিলাফত দাবী করেন এবং আমিরুল মুমিনীন উপাধি ধারণ করেন। তার পূর্বের সকল বাদশাহকে আমীর হিসেবে স্মরণ করা হতো।

৩৫০ হিজরীতে তার মৃত্যুতে তার ছেলে আল হাকিম আল মুসতানসির বাদশাহ হোন,যিনি ৩৬৬ হিজরীর সফর মাসে পরলোক গমন করেন। তার পর তার ছেলে হিশাম আল মুঈদ তখতে আরোহণ করেন। ৩৯৯ হিজরীতে তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে বন্দী করা হয়। তার স্থানে মুহাম্মদ হিশাম বিন আব্দুল জাববার বিন নাসের আব্দুর রহমান ‘আল মাহদী’ উপাধি নিয়ে তখতে আসীন হন। ছয় মাস পর তার ভাতিজা হিশাম বিন সুলায়মান বিন নাসর আব্দুর রহমান হামলা চালিয়ে বাদশাহ হোন। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে অপসারণ করে। তিনি আত্মগোপন করেন। অবশেষে খুজে বের করে তাকে হত্যা করা হয়।

স্পেনের জনতা হিশামের হত্যাকারীর ভাতিজা সুলায়মান বিন হাকাম আল মুসতানসিরকে ‘আল-মুসতাইন’ উপাধি দিয়ে তার কাছে বাইআত করে। এরপর প্রজাবৃন্দ তার সাথে লড়াই করে ৪০৬ হিজরীতে তাকে বন্দী করে এবং আব্দুর রহমান বিন আব্দুল মালিক বিন নাসরকে মুর্তজা লকব দিয়ে তার কাছে বাইআত করে নেয়। বছরের শেষে তাকেও হত্যা করা হয়। তার অন্তর্ধানে উমাইয়্যা শাসনের পতন হয়। তদস্থলে গড়ে উঠে ফাতেমী শাসনের সৌধ।

৪০৭ হিজরীর মুহাররম মাসে আন নাসর আলী বিন হামুদ ফাতেমী রাজত্বের তখতে সমাসীন হোন। ৪০৮ হিজরীর যিলকদ মাসে তাকে হত্যা করে তদস্থলে তার ভাই আল মামুন আল কাসিম বাদশাহ হোন। ৪১১ হিজরীতে তাকে অপসারণের পর তার ভাতিজা ইয়াহইয়া বিন নাসর আলী বিন হামুদ ‘আল মুসতাআলা’ উপাধি নিয়ে বাদশাহ হোন। এক বছর সাত মাস পর তাকে হত্যার মাধ্যমে আবার উমাইয়্যা রাজত্ব ফিরে আসে। আল মুসতাযহার আব্দুর রহমান বিন হিশাম বিন আব্দুল জাব্বার (উমাইয়্যা বংশীয়) বাদশাহ হোন। পঞ্চাশ দিন পর তাকে হত্যা করা হলে মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান বিন উবায়দুল্লাহ বিন নাসর আব্দুর রহমান আল মুকতাফী উপাধি নিয়ে ক্ষমতারোহণ করেন। এক বছর চার মাস পর তাকে অপসারণ করা হয়। তদস্থলে হিশাম বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল মালিক বিন নাসর আব্দুর রহমান আল মুতামাদ বাদশাহ হোন। কিছুদিন পর তাকেও অপসারণ ও বন্দী করা হয়। ৪০০ হিজরীর সফর মাসে অথবা এর চেয়ে কয়েক হিজরী পড়ে তিনি বন্দী অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুর সাথে সাথে স্পেনের মাটিতে উমাইয়্যা শাসনেরও মৃত্যু হয়।

 

পাশ্চাত্যের উবায়দিয়া রাজত্ব

পাশ্চাত্যে (তথা আরবের পশ্চিমাঞ্চলে – অনুবাদক) ২৯২ হিজরীতে আল মাহদী উবায়দুল্লাহ সর্বপ্রথম উবায়দিয়া শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন। তিনি ৩২২ হিজরীতে মারা গেলে তার ছেলে আল কায়িমবি আমরিল্লাহ মুহাম্মাদ তদস্থলে উপবেশন করেন। ৩৩৩ হিজরীতে তিনিও মারা যান। কায়িমের পর তার ছেলে আল মানসুর ইসমাঈল তখতে সমাসীন হোন। তিনি ৩৪১ হিজরীতে মারা যান। এরপর তার পুত্র আল মুয়ায লিদ্দীনিল্লাহ সাদ বাদশাহ হোন। যিনি ৩৬২ হিজরীতে কায়রো প্রবেশ করেন আর ৩৬৫ হিজরীতে মারা যান। তার স্থানে তার ছেলে আল আযীয বাযযার আসীন হোন। তিনি ৩৮৬ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। তারপর তার ছেলে হাকিম বিন আমরিল্লাহ মানসুর তখতে আরোহণ করেন। ৪১১ হিজরীতে তাকে হত্যা করা হলে পুত্র আয যাহির লা আযাযুদ্দীনিল্লাহ সালতানাতে প্রতিষ্ঠা পান। তিনি ৪২৮ হিজরীতে মারা যাওয়ায় পুত্র আল মুনতাসির মুহাম্মাদ সালতানাতের তখত অধিকার করেন। তিনি ৪৮৭ হিজরীতে পরলোক গমন করেন। তিনি ষাট বছর চার মাস রাজত্ব করেন।

যাহাবী বলেছেনঃ আমার মতে মুসলিম জাহানের কোনো খলীফা বা বাদশাহ এত দীর্ঘ সময় রাজ্য শাসন করেননি।

এরপর তার ছেলে আল মুসতাআলা বিল্লাহ আহমাদ মসনদে আরোহণের পর ৪৯৫ হিজরীতে মারা যান। এরপর তার ছেলে আল আমর বি আহকামিল্লাহ মানসুর পাঁচ বছর বয়সে বাদশাহ হোন। ৫২৪ হিজরীতে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হলে চাচাতো ভাই আল হাফিজ লিদ্দীনিল্লাহ আব্দুল মজিদ ইবন মুহাম্মাদ বিন আল মুসতানসির তখত নসীন হোন,যিনি ৫৪৪ হিজরীতে মারা যান। তদস্থলে পুত্র জাফর বিল্লাহ ইসমাঈল উপবেশন করে ৫৪৯ হিজরীতে নিহত হলে ফায়েয বি নাসরিল্লাহ ঈসা তখতে আসীন হোন। যিনি ৫৫৫ হিজরীতে মারা যান। তারপর আল আযদ লিদ্দীনিল্লাহ আব্দুল্লাহ বিন ইউসুফ বিন হাফিয লিদ্দীনিল্লাহ তখত নসীন হন। তিনি ৫৬৭ হিজরীতে অপসারিত হোন আর এ বছরই মারা যান। বর্তমানে মিসরে আব্বাসীয় শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান এবং সেখানে উবায়দিয়া রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

যাহাবী বলেনঃ উবায়দিয়া রাজত্বের চতুর্দশ বাদশাহ নিজেকে খলীফা দাবী করলেও কেউ তার খিলাফত মেনে নেয়নি।

বনূ তাবাতাবাদের শাসন ব্যবস্থা

১৯৯ হিজরীর জামাদিউল উলা মাসে সর্বপ্রথম যিনি এ শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন তিন হলেন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহীম তাবাতাবা। তার যুগে আল-হাদী ইয়াহইয়া বিন আল-হুসাইন বিন কাসিম বিন তাবাতাবা ইয়ামানে শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন এবং আমিরুল মুমিনীন উপাধি ধারণ করেন।

২০৮ হিজরীর যিলহাজ্জ মাসে তার ইন্তেকালের পর পুত্র মুর্তজা মুহাম্মাদ তখতে আরোহণ করেন,যিনি ৩২০ হিজরীতে মারা যান। এরপর তার ভাই নাসর আহমদ তখত নসীন হোন। তিনি ৩২৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তার পর পুত্র আল মুনতাখিব আল হুসাইন ক্ষমতায় আসেন এবং ৩২৯ হিজরীতে মারা যান। অতঃপর তার ভাই মুখতার আল-কাসিম মসনদে বসেন। ৩৪৪ হিজরীর শাওয়াল মাসে তিনি নিহত হোন। এরপর তার ভাই হাদী মুহাম্মাদ,অতঃপর তার ছেলে রশীদ আব্বাস তখতে উপবেশন করেন। এরপর তাদের শাসন ব্যবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটে।

 

তবরিস্তানের রাজত্বের বিবরণ

ছয়জন পর্যন্ত এ রাজত্বের শাসন ব্যবস্থা কায়েম ছিল। এদের মধ্যে প্রথম তিনজন হাসান (রাঃ) এর আওলাদ এবং পরের তিনজন হুসাইন (রাঃ) এর বংশধর।

২৫০ হিজরীতে রায় এবং দিলম অঞ্চলে সর্বপ্রথম হিশাম আল দায়ী ইলাল্লাহ হাসান বিন সায়েদ বিন মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল বিন হুসাইন বিন যায়েদ বিন জাওয়াদ বিন হাসান বিন হুসাইন বিন আলী বিন আবু তালিব এ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর তার ভাই কায়িম বিলহক মুহাম্মাদ তখত নসীন হোন এবং ২৮৮ হিজরীতে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর তার পৌত্র আল মাহদী আল হাসান বিন যায়েদ আল কায়িম বিলহক ক্ষমতায় আসেন। অতঃপর —!! (গ্রন্থকার এরপর আর কিছুই লিখেননি – অনুবাদক)।

 

ফায়দা

ইবনে হাতিম স্বরচিত তাফসীর গ্রন্থে আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রাঃ) বর্ণনা করেন,আবহমান কাল থেকে আজ অবধি পৃথিবীতে প্রত্যেক শতাব্দীর শুরুতে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়ে আসছে।

আমার মতে, হিজরীর প্রথম শতাব্দীতে হাজ্জাজের ফিতনা প্রকাশ পায়।

হিজরীর দ্বিতীয় শতাব্দীতে খলীফা মামুনের ফিতনা দেখা দেয়। তিনি তার ভাইকে হত্যা এবং লোকদের খলকে কুরআনের প্রতি আহবান জানান। এটা ছিল এ উম্মতের জন্য বড় ফিতনা আর সর্বপ্রথম বিদআত। এর পূর্বে কোনো খলীফা লোকদের বিদআতের প্রতি আহবান করেননি।

তৃতীয় হিজরীতে কারমতীর পর খলীফা মুকতাদারের ফিতনা প্রকাশ পায়। তাকে অপসারণ করে তার ভাইয়ের হাতে সকলে বাইআত করলে তিনি পুনরায় দ্বিতীয় দিন খলীফা হোন। বিচারপতিগণ আর অনেক ওলামায়ে কেরাম নিহত হোন, ইতোপূর্বে কোনো বিচারককে হত্যা করা হয়নি।

চতুর্থ শতাব্দীতে হাকিমের ফিতনা, যা শয়তানের ইশারায় সংঘটিত হয়।

পঞ্চম শতাব্দীতে সিরিয়া আর বাইতুল মুকাদ্দিস ফিরিঙ্গীদের কাছে চলে যায়।

ষষ্ঠ শতাব্দীতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যা ইউসুফ (আঃ) এর যুগের পর থেকে এত তীব্র দুর্ভিক্ষ আর কখনই হয়নি। এ শতাব্দীতে তাতারীদের উত্থান হয়।

সপ্তম শতাব্দীতে তাতারীদের উপমাহীন হত্যাযজ্ঞে মুসলমানদের রক্তের বন্যা বয়ে যায়।

অষ্টম শতাব্দীতে তাইমুর লং এর ফিতনা প্রকাশ পায়, যার তুলনায় তাতারীদের ফিতনা কিছুই না।

আমি মহান আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা করছি,তিনি যেনো নবম শতাব্দীর ফিতনা আমাদের না দেখান। আর আল্লাহ’র হাবীব আমাদের নেতা মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বদৌলতে রহমতের বারিধারায় আমাদের সিক্ত করুন। আমীন! আমীন! ইয়া রাব্বাল আলামীন!!