ইমাম আহমেদের পুত্র, আবদুল্লাহ ইবন ইমাম আহমেদ বলেন, তার পিতা যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তিনি তার পাশেই ছিলেন। আর তার পিতা ‘সাক্বারা’-র মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। ‘সাক্বারা’ হল এক ধরনের অচেতন অবস্থা। আমরা যখন দুনিয়া থেকে আখিরাতে যাই, সেটা বেশ জটিল একটা পরিবর্তন। ধরুন, আপনি ৬০-৭০ বছর এই দুনিয়াতে ছিলেন, আর সেখান থেকে এখন আপনি একেবারেই ভিন্ন একটা জগতে পদার্পণ করতে যাচ্ছেন। এই পরিবর্তনটা এতোই কষ্টকর ব্যাপার যে অনেক সময়ই তা চট করে হয়ে যায় না। মানুষ তখন ‘সাকারা’-র এদিক-ওদিক করতে থাকে। ব্যাপারটার সাথে ঘুমের বেশ মিল রয়েছে। আল্লাহ বলেন,
“… আল্লাহ মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়, আর যে মরে না, তার নিদ্রাকালে”(সূরাহ জুমার ৩৯:৪২)
ঘুমকে বলা হয় গৌণ মৃত্যু (মাইনর ডেথ) বা (আল ওয়াফাতুস সুঘরা) আপনার জাগ্রত অবস্থা আর নিদ্রাকালীন বিভিন্ন ধাপের মাঝে চলাকালীন অবস্থা -এ দু’টি অবস্থার মাঝামাঝিতে ‘মধ্যবর্তী’ একটা সময় রয়েছে (interphase), যখন আপনি না জাগ্রত, না ঘুমন্ত। এই অবস্থাটা পার করার পরই আপনি নিদ্রার ঘোরে প্রবেশ করেন। মৃত্যুর পূর্বেও একই ঘটনা ঘটে, যখন আপনাকে জীবন আর মৃত্যুর মধ্যবর্তী একটা অর্ধচেতন বা অবচেতন পর্যায় অতিবাহিত করতে হয়। সেখানে কিছু মুহূর্তে যেন আপনার অবস্থান দুনিয়ার এই পাশে, আবার কিছু মুহূর্তে দুনিয়ার অন্য পাশে। আবদুল্লাহ ইবন ইমাম আহমেদ বলেন, তার পিতা যখন এই রকম অবচেতন পর্যায়ে পৌঁছে যান আর বলতে থাকেন, ‘লা বা’আদ, লা বা’আদ’ – ‘না এখনও নয়, না এখনও নয়’। একথা শুনে আবদুল্লাহ প্রচন্ড চিন্তিত বোধ করলেন! চিন্তা করে দেখুন, আপনি যদি আপনার বাবাকে তার মৃত্যুকালীন সময়ে বলতে শুনেন, ‘না এখনও না, না এখনও না’, আপনি কিভাবে এটাকে ব্যাখ্যা করবেন? এটার অর্থ কী বলে আপনার কাছে মনে হবে? ‘না এখনও না, আমি এখনও মরতে চাইনা’ এমনই মনে হওয়ার কথা, তাইনা?
তো ইমাম আহমেদ জেগে উঠলে, আবদুল্লাহ উদ্বিগ্ন হয়ে পিতাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আমার পিতা, কেন আপনি বলছিলেন – “এখনও না, এখনও না” ?’ ইমাম আহমেদ বললেন, “শয়তান আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, সে তার অঙ্গুলি কামড়ে বলছিল, “হে আহমেদ, তুমি তো আমার হাত ফসকে বের হয়ে গেলে, হে আহমেদ, তুমি তো আমার হাত ফসকে বের হয়ে গেলে” !’ তাই আমি তাকে বলছিলাম, ‘না, এখনও না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি মারা যাচ্ছি। তোমার আর আমার যুদ্ধ এখনও চলছে, যখন আমি মারা যাব, একমাত্র তখনই আমি তোমার হাত থেকে রক্ষা পাব।”
শয়তান রাগে-দুঃখে তার আঙ্গুল কামড়াচ্ছিল কারণ সে ইমাম আহমদকে হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছিল, আর ইমাম আহমেদ তার হাত থেকে পার পেয়ে যাচ্ছিলেন! তাই ইমাম আহমেদ বলছিলেন, ‘না এখনও না, যতক্ষণ না আমি মারা যাচ্ছি।’
দেখুন, এই ঈমানদার বান্দাকে! কীভাবে তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করতে থাকে, কখনোই নিরস্ত হননি। আমরা যদি গর্ব বোধ করি, আমরা বলেই ফেলি, “এইতো, আমি তোমার বিরুদ্ধে জিতে গেছি”, কিন্তু ইমাম আহমেদ বলছেন, না, যতক্ষণ না আমি মারা যাই ততক্ষণ পর্যন্ত আমি জিতব না। ইমাম আহমদ যখন এভাবে বলছেন যে ‘মৃত্যু হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি শয়তানের কবল থেকে নিরাপদ নন’, তাহলে অবশ্যই এরকম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যে শেষ মুহূর্তে এসেও আমাদেরকে শয়তানের কাছে হেরে যেতে হতে পারে, আর তাহলে বিষয়টা হবে অত্যন্ত ভয়ংকর।
ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন, ‘এরকম হওয়ার কারণটা হলো এই যে, শয়তান বুঝতে পারে আপনার সাথে এটাই তার শেষ সুযোগ, যদি এবার আপনি তার হাত থেকে ছুটে যান তো আপনি চিরকালের জন্যই তার কাছ থেকে পার পেয়ে গেলেন। শেষ সময়ে আপনাকে পথভ্রষ্ট করতে না পারার অর্থ সে আপনাকে আর ধরতে পারল না। এজন্যই শয়তান আপনার জীবনের শেষ সময়ের দিকে বিশেষ নজর দেয় আর আপনার বিরুদ্ধে তার কাজকে আরো জোরদার করে তুলে।’
সুতরাং এবার একটু তুলনা করে দেখুন তো, আপনি যদি এখনই শয়তানের কাছে হেরে যান, যখন লড়াইটা তুলনামূলক সহজ, তাহলে তখন আপনার কি অবস্থা হবে, যখন অন্তিম মুহূর্তে এই লড়াই আরো কঠিন আকার ধারণ করবে? যখন শয়তান আপনার উপর কেবল অর্ধেক মনোযোগ দিচ্ছে তখনই যদি আপনি তার কাছে হার মানেন, তাহলে সে যখন একাগ্রভাবে তার পূর্ণ মনোযোগ আপনার উপর দিবে, তখন আপনার অবস্থাটা কি হবে? এগুলো হলো মৃত্যুকালীন ফিতনা, এজন্যই আমরা সালাতে বলি, ‘আমরা তোমার কাছে জীবন ও মৃত্যুর ফিতনাহ্র থেকে আশ্রয় চাই’।
আসুন মানুষের জীবনের মন্দ সমাপ্তির কারণগুলো নিয়ে কিছু কথা বলি, কেননা আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জীবনের অন্তিম মুহূর্ত। একজন ব্যক্তি যেভাবে মারা যাবে, ঠিক সেভাবেই পুনরুত্থিত হবে। যদি হাজ্জের ইহরামকৃত অবস্থায় তালবিয়া করার সময় কেউ মারা যায়, তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সেই ব্যক্তি পুনরুত্থিত হবে, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা – আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলতে বলতে। আর যদি কেউ মারা যায় শহীদ হিসেবে তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে বলেন, সে কিয়ামতের দিনে কবর থেকে যখন বের হয়ে আসবে তখন তার ক্ষতস্থান থেকে এমনিভাবে রক্তক্ষরণ হতে থাকবে যেমনটা যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুর সময় হয়েছিল। এজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময় বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার জীবনের শেষ কাজকে সবচেয়ে ভাল কাজ হওয়ার তওফিক দান করো’। আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘…তোমাদের মধ্যে একজন জান্নাতের কাজ করতে করতে এমন অবস্থায় পৌঁছে যাবে যে জান্নাত থেকে তার দূরত্ব থাকবে আর মাত্র এক ফুট, এরপর শেষে এসে তুমি জাহান্নামবাসীদের মত কাজ করে মারা যাবে আর তাই তোমার বাসস্থান হবে জাহান্নাম’।
আপনারা যারা সবাই এখন জান্নাতবাসীদের ন্যায় কার্যকলাপ করছেন, শেষ মুহূর্তে যেয়ে আপনি কিছু গড়বড় করে ফেললেন, আর আপনার গন্তব্য নির্ধারিত হয়ে গেল জাহান্নাম। আবার এর বিপরীতও হতে পারে, আপনি জাহান্নামের বাসিন্দাদের মত কাজকর্ম করছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে ভাল কিছু করলেন, তাই মৃত্যুর পর আপনার বাসস্থান হলো জান্নাত। তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হল এই শেষ সময়টা। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কাছে ভাল, পবিত্র ও বরকতপূর্ণ মৃত্যুর দু’আ করি।
একজন মানুষের জীবন খারাপভাবে সমাপ্তির কারণঃ
এক নম্বর কারণ, ঈমানে (বিশ্বাসে) ত্রুটি বা অপরিপূর্ণতা থাকা এবং দূষণযুক্ত হওয়াঃ
একটা উপমার কথা চিন্তা করুন। ধরুন, আপনি একটা কম্পিউটার কিনে সেখানে কাজ শুরু করলেন। প্রথম মাস সেটা খুব ভালভাবে চলল। দ্বিতীয় মাসেও ঠিকঠাক কাজ করল। কিন্তু আপনি যখনই ভারি কোন অ্যাপ্লিকেশন রান করতে শুরু করলেন, ওমনি কম্পিউটারে সমস্যা দেখা দিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেল। তো আপনি দেখতে যেয়ে জানতে পারলেন, সেখানে আসলে প্রথম দিন থেকেই খুঁত ছিল, কিন্তু ব্যাপারটা প্রকাশ পায়নি যেহেতু আপনি এটাকে হালকাভাবে ব্যবহার করছিলেন, সহজ-সরল অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে। কঠিন কোন প্রোগ্র্যাম, অ্যাপ্লিকেশন বা কার্যক্রম পরিচালনা করার সাথে সাথে কম্পিউটারটা খারাপ হয়ে যায়। কেন? কারণ প্রথম দিন থেকেই সেখানে একটা সুপ্ত ত্রুটি (defect) ছিল, সেটা প্রথম দিন বা দ্বিতীয় দিন দেখা না গেলেও, এমনকি দুই মাসের জন্য এটা ভালভাবেই কাজ করার পরেও জটিল কিছু করার সাথে সাথে সেটা খারাপ হয়ে যায়। আর যেহেতু সমস্যাটা প্রথম থেকে অপ্রকাশিত/গুপ্ত অবস্থায় ছিল যেটা আপনি দেখতে পাননি, আপনি ভেবে বসেছিলেন কম্পিউটারে কোন সমস্যা নাই কেননা জিনিসটা হচ্ছে ‘ব্র্যান্ড নিউ’।
প্রকৃতপক্ষে আপনি এখন বেঁচে আছেন, ভাবছেন আপনার ‘ঈমান’ একেবারে নিখুঁত, আপনার মনটা পরিষ্কার। কিন্তু এমন হতে পারে যে এই মুহূর্তে আপনার অন্তরের কোন এক গহীনে কোন বিদ’আত আছে, অথবা কুরআন, নবী-রাসূল (আম্বিয়া) বা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কোন নিয়ম নিয়ে কিছু সন্দেহ লুকিয়ে আছে, এমন সময় মৃত্যু এসে হাজির হলো। আর শয়তান তার পূর্ণ প্রচেষ্টা চালাবে যেন সে আপনাকে পরীক্ষায় ফেলাতে পারে। অর্থাৎ শেষ মুহূর্তে আসলে ব্যাপারটা কঠিন হয়ে যাবে আর আপনি তখন আবিষ্কার করবেন যে আপনার বিশ্বাসে অপূর্ণতা ছিল। যখন আপনি আপনার ঈমানে কোনরকম খুঁত খুঁজে পাবেন তখন কি করবেন? তখন আপনি পুরো জিনিসটাই পরিত্যাগ করে ফেলবেন! যেহেতু আপনি আবিষ্কার করলেন যেই বিষয়গুলোতে ঈমান এনেছিলেন তাতে সমস্যা আছে, আপনি ভাবতে শুরু করেন যে পুরো ইসলামেই কিছু সমস্যা আছে। এভাবে আপনি সবকিছু পরিত্যাগ করে দিয়ে সবই হারালেন। অনেকটা যেন সেই কম্পিউটারের মত, যেন একজন কোন খুঁত পেয়ে আস্ত কম্পিউটারটাই ফেলে দিল। মূলত আপনি এভাবে সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে দিলে আসলে গোটা জীবন যুদ্ধেই হেরে যাবেন।
এই কারণেই ইবন কায়্যিম বলেন,
‘আমরা এটা কখনোই আশা করতে পারিনা যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সরল পথে চলছে এমন কোন ব্যক্তিকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করবেন, যদি না সেই ব্যাক্তির বিশ্বাসে কোন গোপন সমস্যা থেকে না থাকে। আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার রহমত ও দয়ার কারণে, যে ব্যাক্তি প্রকৃত সৎকর্মশীল তাকে কখনোই পথভ্রষ্ট করবেন না’।
সুতরাং এর মানে এমন একটা খুঁত আপনার মধ্যে ছিলই যা হয়ত কোন না কোন এক সময়ে প্রকাশ পেয়েছিল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
“বলুনঃ আমি কি তোমাদেরকে সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। এরাই তো এই দুনিয়ার জীবনে তাদের প্রচেষ্টা পন্ড করছে, অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করেছে।” (সূরা কাহফ ১৮:১০৩–১০৪)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এখানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কথা বলছেন, যারা ভাবে তারা ভালকাজ করছে কিন্তু আসলে তারা ভুল করছিল, কাজের কাজ কিছুই করছে না। আপনারা আরো দেখতে পাবেন, কিছু মানুষ আছে যারা খুবই সৎকর্মশীল, এ ধরনের মানুষ মনে করে তারা সৎ কর্ম করছে, কিন্তু তারা মূলত এসব কাজ করে ভ্রান্ত পথে, ভুল তরীক্বায়, তারা রাসূলের পথ অনুসরণ না করায় তাদের কাজ (আল্লাহর নিকটে) সৎকর্ম হিসেবে স্বীকৃত/ গৃহীত হবে না।
দুই নম্বর কারণ হল বিপথগামী হওয়া বা সরল পথ থেকে সরে যাওয়াঃ
একজন ব্যক্তি সোজা পথ ধরে চলা শুরু করে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিল সে পথ থেকে কিছুটা সরে যাবে অথবা একটা হালকা মোড় নিবে। এই শাখা পথ প্রথমে নিতান্তই খুব সূক্ষ কোণে শুরু হলেও, সে যতই দূরে যেতে থাকে, মূল পথ থেকে তার দূরত্ব ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই মোড়টা প্রথমের দিকে ছোট মনে হলেও, আপনি এভাবে বাঁক নিয়ে আসলে যত পথ চলবেন, তত বেশি সোজা রাস্তা থেকে দূরে যেতে থাকবেন।
বিতাড়িত ইবলিস ছিল প্রথমে সৎ কর্মশীলদের অন্তর্গত। যে একটা ছোট্ট ভুল করে ‘কিবর’ বা অহংকারের বশে। অহংকার একটা মারাত্মক সমস্যা। আর এভাবে সে পরিণত হয় সবচেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টিতে (বাল’আম)।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
“আর তাদের কাছে পাঠ করো ওর বৃত্তান্ত যাকে আমরা আমাদের নির্দেশাবলী প্রদান করেছিলাম, কিন্তু সে সেসব থেকে গুটিয়ে নেয়, সেজন্য শয়তান তার পিছু নেয়, কাজেই সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর যদি আমরা ইচ্ছা করতাম তবে নিশ্চয়ই এর দ্বারা তাকে আমরা উন্নীত করতাম, কিন্তু সে মাটি আকঁড়ে ধরলো, আর সে তার হীন কামনার অনুসরণ করে চললো।” (আ’রাফ ৭:১৭৫–১৭৬)
এই আয়াতে এমন ব্যক্তির বিবরণ দেয়া হচ্ছে যে আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে অবহিত হয়েছে, দ্বীনের ‘ইলম প্রাপ্ত, কিন্তু এরপরেও জেনে শুনে নিজের ইচ্ছা-আকাংক্ষার অনুসরণ করেছে। তাই শয়তান তার পিছনে লেগেছে আর তাকে করেছে পথভ্রষ্ট। কেন? কারণ হল সে মাটি আকঁড়ে ধরল, দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ল। দেখুন, এই পার্থিব জীবন কী না করতে পারে! সেই ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট করে দিল যার কাছে ‘ইলম ছিল, আল্লাহর আয়াত ছিল, আর সে এই সবকিছু হারিয়ে ভ্রান্ত পথে চালিত হল শুধুমাত্র নিজের দুনিয়াসক্তির কারণে আর নিজের কামনার অনুসরণ করার ফলে।
এজন্য নিজের আকাঙ্ক্ষা-কামনা-বাসনার অনুসরন করা থেকে বিরত থাকুন। এই দুনিয়ার পিছে চলা থেকে বিরত থাকুন। কেননা এটা ইসলাম শব্দের পরিপন্থী।
চলুন, আমরা একেবারে মৌলিক বিষয়টাতে ফিরে যাই। ‘ইসলাম’ কথাটার অর্থ কি? আল্লাহর প্রতি পূর্ণাঙ্গভাবে সমর্পণ। অর্থাৎ আপনি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করবেন যদিও বা আপনাকে সেজন্য আপনাকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে হয়, নিজের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যেতে হয়, আপনি আল্লাহ সুনহানাহু ওয়াতা’আলার সন্তুষ্টির জন্য নিজে যা চান, শখ-আহ্লাদ সব ত্যাগ করবেন।
আমরা দ্বীন মানতে চাই আমাদের ‘যার-যার বুঝ’ অনুযায়ী, নিজেদের সুবিধা মত, আমাদের অবসর সময়ে! না, আমরা ইসলামকে বদলে দিয়ে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করতে পারিনা, বরং আমাদের উচিত আমরা নিজেরা বদলে গিয়ে ইসলামের সাথে মানানসই হই। কারণ এটাই হল ‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ, এটা পরিপূর্ণভাবে সমর্পণ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলার কাছে সম্পূর্ণ রূপে আত্মসমর্পণ। এই লোকের কাছে জ্ঞান এবং আল্লাহ তা’আলার নিদর্শনাবলী থাকা সত্ত্বেও সেগুলো তার কোনই উপকারে আসে নি কারণ সে তার নিজের ইচ্ছার অনুসরণ করেছে, আর তাই সে বিপথগামী হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি তোমাদের উপর যে জন্য সবচেয়ে বেশি ভয় করি তা হল এমন এক ব্যক্তি যে কুরআন মুখস্থ করে সে পর্যন্ত যখন তার চেহারায় কুরআনের আলো আবির্ভূত হয়, এরপর সে নিজেকে আল্লাহর আয়াত থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। সে তার প্রতিবেশীর উপর তরবারি চালায় আর তাকে শিরক করার দোষে অভিযুক্ত করে।’ সে তাকে মুশরিক বলে অভিযুক্ত করে। হুযাইফা বিন ইয়ামান জিজ্ঞেস করেন, ‘তাদের মধ্যে কে মুশরিক, অভিযোগকারী নাকি অভিযুক্ত ব্যক্তি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘অভিযোগকারী’। ইবন কাসীর বলেন হাদীসটির সনদ ‘জায়্যিদ’ অর্থাৎ ভাল।
আরেকটা কাহিনী বলি, আর এই কাহিনী দিয়েই আমরা এই আলোচনা শেষ করব, আর তা হল বারসিসার কাহিনী। বারসিসা ছিল বনী ঈসরাইলের একজন সুখ্যাত উপাসক, ধর্মযাজক,‘আবিদ’। তার নিজের মন্দির ছিল আর সেখানে সে একাগ্রভাবে নিজেকে উপাসনায় নিয়োগ করত। বনী ঈসরাইলের তিনজন পুরুষ জিহাদে যেতে চাচ্ছিল, তাদের একমাত্র বোনকে কোথায় রেখে যাবে বুঝতে পারছিল না। তারা সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘কোথায় আমরা আমাদের বোনকে রেখে যেতে পারি? তাকে তো আমরা একা ফেলে যেতে পারিনা। কোথায় তাকে রেখে যাওয়া যায়?’ তখন তারা তাদেরকে বলল, ‘তাকে রেখে যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হবে তাকে ঐ উপাসকের কাছে রেখে যাওয়া, সেই-ই সবচেয়ে ধার্মিক ব্যক্তি, আর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। তোমাদের বোনকে তার কাছে রেখে যাও, সে তার খেয়াল রাখবে’। তারা আবিদের নিকট গেল। তাকে সব বর্ণনা করে বলল, ‘এই হল অবস্থা – আমরা জিহাদে যেতে চাই, আপনি কি কষ্ট করে আমাদের বোনকে দেখে রাখতে পারবেন?’ সে বলল, ‘আমি তোমাদের থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আমার কাছ থেকে চলে যাও’। তখন শয়তান তাকে প্রলুব্ধ করল, ‘তুমি তাকে কার কাছে রেখে আসবে? তুমি যদি তার খেয়াল না রাখো তাহলে হয়ত কোন দুষ্ট লোক তার খেয়াল রাখবে, আর তারপর তো তুমি জানোই কী ঘটবে! তুমি কি করে এই ভাল কাজটা তোমার হাতছাড়া করে দিতে পার?’
দেখুন ! শয়তান তাকে ভাল কাজে উৎসাহিত করছে! তো সে তাদেরকে আবার ডেকে এনে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তার খেয়াল রাখব, কিন্তু সে আমার সাথে আমার মন্দিরে থাকতে পারবে না, আমার আরেকটা বাড়ি আছে সে সেই ঘরে থাকবে’। সে মেয়েটিকে বলল, ‘তুমি ওখানে থাক, আমি আমার মন্দিরে থাকব’। তো মেয়েটা সেই বাড়িতে একটা ঘরে থাকত, আর সেই ধর্মযাজক তার জন্য প্রতিদিন খাবার নিয়ে এসে তার নিজের দরজার বাইরে রেখে দিত। সে মেয়েটির বাড়িতে পর্যন্ত যেত না, নিজের দরজার বাইরেই খাবার রেখে দিত আর মেয়েটিকে ঘর থেকে বের হয়ে এসে খাবার নিয়ে যেতে হত; সে মেয়েটির দিতে তাকিয়ে দেখতে পর্যন্ত ও চাইত না। তখন শয়তান আবার তার কাছে এসে বলল, ‘তুমি করছটা কি? তুমি কি জানো না মেয়েটা যখন তার ঘর থেকে বের হবে আর তোমার মন্দির পর্যন্ত আসবে লোকে তাকে দেখতে পাবে? তোমার উচিত তার দরজায় যেয়ে খাবারটা রেখে আসা।’ সে বলল, ‘হ্যাঁ, আসলেই’।
শয়তান কিন্তু তার সাথে সামনা-সামনি কথা বলছেনা, তাকে ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। ধর্মযাজক ‘আবিদ তাই এবার খাবার নিয়ে মেয়েটির দরজা পর্যন্ত রেখে আসতে শুরু করল। এভাবে কিছুদিন চলল, এরপর শয়তান তাকে বলল, ‘মেয়েটা এখনও তার দরজা খুলছে আর বাইরে বের হয়ে আসছে প্লেট নেয়ার জন্য, কেউ তাকে দেখে ফেলতে পারে, তোমার উচিত প্লেটটা তার ঘরে গিয়ে দিয়ে আসা’। শয়তান কিনা তাকে বলছে আরো ভাল কাজ করতে! তাই সে খাবারের প্লেটটা ঘরে রাখা আরম্ভ করল, সেখানে রেখেই সে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসত। এভাবে আরো কিছুদিন পার হলো। আর ওদিকে জিহাদ চলতে থাকায় ভাইদের ফিরে আসতে বিলম্ব হচ্ছিল। শয়তান আবারো তার কাছে আসল, বলল, ‘আচ্ছা, তুমি তাকে এভাবে একা ছেড়ে দিবে, কেউ তো নেই যে তার দিকে একটু খেয়াল রাখবে, একটু কথা বলবে। সে যেন জেলখানায় আবদ্ধ হয়ে আছে, কথা বলার কেউ নেই। তুমি কেন ওর দায়িত্ব নিচ্ছ না? ওর সাথে একটু সামাজিকতা বজায় রেখে তো চলতে পার, যেয়ে একটু কথা বলো যাতে করে তুমি তার খোঁজখবর রাখতে পারো। তা নাহলে দেখা যাবে সে বাইরে যেয়ে কোন পরপুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বে’। তাই সে মেয়েটির সাথে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করল, মেয়েটা ঘরের মধ্য থেকেই কথা বলত; দুজনকে প্রায় চিৎকার করে কথা বলতে হতো যেন তারা একজন অন্য জনকে শুনতে পায়।
শয়তান এবার তাকে বলল, ‘তুমি এরকম দূর থেকে একজন আরেকজনের উপর চিৎকার না করে কেন ব্যাপারটাকে নিজের জন্য আরেকটু সুবিধাজনক করে নিচ্ছ না? কেন তার সাথে একই ঘরে বসে কথা বলছ না?’ তো এবার সে মেয়েটার সাথে একই ঘরে বসে কিছু সময় ব্যয় করতে শুরু করল। তারপর ধীরে ধীরে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসাথে কাটাতে লাগল, আর আস্তে আস্তে তারা পরস্পরের আরো কাছাকাছি আসতে লাগল। এক সময় এমন হল যখন সেই আবিদ, ধর্মযাজক,উপাসক সেই মেয়ের সাথে যিনায় (ব্যাভিচার) লিপ্ত হল। ফলে মেয়েটা অন্তসত্ত্বা হয়ে পড়ল।
কাহিনী এখানেই শেষ নয়। মেয়েটি একটি সন্তানের জন্ম দিল। শয়তান ধর্মযাজকের কাছে এসে বলল, ‘একি করেছ তুমি! তুমি কি জানো যখন ওর ভাইরা ফিরে আসবে তখন কি হবে? তারা তোমাকে মেরে ফেলবে, এমনকি তুমি যদি এটাও বলো যে – “এটা আমার বাচ্চা না”, তারা তোমাকে বলবে যে “তোমার বাচ্চা না হলেও তুমি তার দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলে, তাই এটা এখন তোমারই দায়ভার। বাচ্চার বাবা কে আমরা তার পরোয়া করি না, তুমিই এর জন্য দায়ী”। সুতরাং এখন একটাই উপায়, তুমি বাচ্চাটাকে মেরে তাকে পুঁতে ফেল’। বারসিসা বলল, ‘এটা কি গোপন থাকবে আমি তার ছেলেকে মেরে ফেলার পরে?’ শয়তান বলল, ‘তোমার কি মনে হয় ও এটাকে গোপনে রাখবে? তুমি যদি এরকম ভাব, তাহলে তুমি মস্ত বড় বোকা’। সে জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে আমি কি করব?’। শয়তান জবাব দিল, ‘তোমার ঐ মেয়েটাকেও মেরে ফেলা উচিত’। তাই সে মেয়েটাকে আর বাচ্চাকে মেরে ফেলল, এরপর দুজনকে একই ঘরের নিচে কবর দিয়ে দিল।
ভাইয়েরা একসময় ফিরে আসল, তারপর জানতে চাইল, ‘আমাদের বোন কোথায়?’, সে উত্তরে বলল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এরপর মারা যায়, তাকে ওখানে কবর দেয়া হয়েছে’ এই বলে সে মনগড়া একটা কবর দেখিয়ে দিল তাদেরকে। তারা বলে উঠল, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজি’উন’, তারা বোনের জন্য দু’আ করল, আর নিজেদের বাসায় ফিরে গেল।
রাতের বেলা, তিনজনের মাঝে এক ভাই একটা স্বপ্ন দেখল, কে তার সেই স্বপ্নে এসেছিল? শয়তান, সে তাকে বলল, ‘তুমি বারসিসা কে বিশ্বাস করো? তুমি কি তাকে বিশ্বাস করো? সে মিথ্যা বলেছে। সে তোমার বোনের সাথে ব্যাভিচার করেছে, তারপর তাকে আর তার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আর এই কথার প্রমাণ হল সে তোমাদেরকে যেখানে সে কবর দেখিয়েছে তোমাদের বোন সেখানে নেই, আছে তার ঘরের পাথরের নিচে’। তার ঘুম ভেঙ্গে গেল আর সে তার বাকি ভাইদেরকে স্বপ্নের কথা জানাল। তারা বলল, ‘আমরাও তো একই স্বপ্নই দেখেছি, তাহলে এটা নিশ্চয়ই সত্যি’। পরদিন তারা সেই মিথ্যা কবরটা খুড়ল কিন্তু কিছুই পেল না, এরপর তারা তাদের বোনের ঘরে যেয়ে মাটি সরাল তখন দেখতে পেল তার বোনের মৃতদেহ সাথে একটা শিশু। তারা যেয়ে বারসিসাকে ধরল, ‘মিথ্যুক! এইসব করেছ তুমি?’ তারা তাকে ধরে টেনে হিঁচড়ে রাজার কাছে নিয়ে গেল। এমন সময় শয়তান আসল বারসিসার কাছে, এবারে কিন্তু সে মনের ওয়াসওয়াসা হিসেবে আসেনি, সে আসল মানুষের রূপ ধরে। তাকে বলল, ‘বারসিসা, তুমি কি জানো আমি কে? আমি শয়তান, আমিই সে, যে তোমাকে এতো ঝামেলার মধ্যে ফেলেছি। আর আমিই সে একজন, যে তোমাকে এখন এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারব। আমিই এসব ঘটনা ঘটিয়েছি আর আমার কাছেই আছে এসবের সমাধান। এখন তোমার উপর নির্ভর করে, তুমি যদি মরতে চাও তো ঠিক আছে। তুমি যদি চাও আমি তোমাকে রক্ষা করি, তাহলে আমি করতে পারি’। বারসিসা বলল, ‘দয়া করে আমাকে বাঁচাও’। শয়তান বলল, “আমাকে সিজদাহ করো’। বারসিসা শয়তানের প্রতি সিজদাহ করল। কিন্তু শয়তান কি বলল? সে বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, তোমার সাথে দেখা হয়ে ভাল লাগল’ এরপর সে তাকে আর কোনদিন দেখতে পেল না। বারসিসা শয়তানের উদ্দেশ্যে সিজদাহ করল, আর এটাই ছিল তার জীবনে করা শেষ কাজ, কারণ এর কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। সুতরাং তার জীবনের শেষ কাজটা তাহলে ছিল- শয়তানকে সিজদাহ করা, সে ছিল সেই উপাসক যে কিনা ছিল সরল পথের উপর, কিন্তু যেহেতু সে সেপথ থেকে বাঁক নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যদিও খুব খুব ছোট্ট একটা বাঁক, প্রথমদিকে যেটাকে একেবারেই তুচ্ছ মনে হচ্ছিল, একটু সুবিধার নামে, দ্বীনের মাসলাহার নামেই সে এগুলো করেছিল। সরলপথ থেকে তার বিচ্যুতির পরিমাপটা ছিল একদমই নগণ্য কিন্তু দেখুন তার শেষ পরিণতি! নিজের ইচ্ছাকে অনুসরণ করার বিপত্তিটা এখানেই; আমরা আমাদের জ্ঞান, কুরআনের যতখানি জানি, আমাদের ইবাদত ইত্যাদি নিয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে যাই। সুবহান আল্লাহ! আমাদের তো সব সময় উচিত নিজেদের নিয়ে শঙ্কায় থাকা, আমরা কখনই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হব না বরং আমাদের সব সময় উদ্বিগ্ন থাকতে হবে, আর এটাই হল আল্লাহ-ভীতি, এটাই সত্যিকার অর্থে ‘জ্ঞান’। আল্লাহ বলেন,
“আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে জ্ঞানীরাই কেবল তাঁকে ভয় করে” (ফাতির ৩৫:২৮)।
যদি আপনি একজন আলেম হন তাহলে আপনার মধ্যে আল্লাহর প্রতি ভয় থাকতে হবে, তা বাদে এটা হবে শুধুই কিছু আয়াতের মুখস্থ চর্চা, বাস্তবজীবনের যার কোনই অর্থ নেই।
এই গল্পের আর একটা দিক- শয়তান বারসিসার সাথে কোন নীতি গ্রহণ করেছিল? যদি শয়তান বারসিসার কাছে এসে সরাসরি বলত, ‘আমাকে সিজদাহ করো’ বারসিসা কি কখনো তা করত? না, করত না। শয়তান step by step ‘ধাপে ধাপে’ মানুষকে দীন থেকে বিমুখ করার নীতি গ্রহণ করেছিল।
ইবন আল জাওযি বলেন, ‘একদা এক ব্যক্তি ছিল, তার নাম আবদু ইবন আবদুর রহীম।এটা ২৮০/ ২৭০ হিজরির কথা। সে ছিল মুসলিম সেনার একজন মুজাহিদ। তারা রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। সে অনেকদিন ধরে জিহাদ করে আসছিল। এসবের মাঝে একটা যুদ্ধ ছিল যখন তারা একটা রোমান দুর্গকে ঘিরে ফেলছিল, এই মুহূর্তে তার নজর পড়ল একজন নারীর প্রতি। তার জন্য এটা ছিল একটা ‘ফিতনা’ (পরীক্ষা, প্রলোভন)। সে তার সাথে পত্র বিনিময় করতে শুরু করল। স্ত্রী লোকটি ছিল সেই শহরের নারী যেখানে মুসলিমরা তাদেরকে ঘিরে ধরেছিল। মুসলিম ব্যক্তিটি তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিভাবে আমি ভিতরে ঢুকতে পারি?’ সে তাকে বলল, ‘খ্রিস্টান হয়ে যাও, আমি তোমাকে ঢুকতে দিব’। তাই, সে খ্রিস্টান হয়ে গেল। পরদিন মুসলিমরা অবাক হয়ে দেখল, এই লোক এতোদিন ধরে তাদের সাথে ছিল, এখন সে রোমানদের মধ্যে! তো এই ব্যাপারটায় সবাই খুব ভেঙ্গে পড়ল কারণ এই ব্যক্তি বহুদিন ধরে জিহাদে অংশ নিয়ে আসছে আর সে কুরআনের অনেক কিছু জানে, তার অনেক জ্ঞান আর হঠাৎ করেই সে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে গেল এক সুন্দরী নারীর পাল্লায় পড়ে। বছরের পর বছর কেটে গেল, কিছু মুসলিম, যারা লোকটিকে চিনত, একদিন সেই রোমান দুর্গের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা তাকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘আমাদের সাথে আসো’। সে বলল, ‘না, আমি তোমাদের সাথে আসতে পারব না, আমি এখানেই স্থায়ী বসতি গেড়েছি। আমি বিবাহিত আর আমার সন্তান-সন্ততি, ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। আমি এখান থেকে নড়ব না’। সে তার দ্বীন বিসর্জন দিয়ে ফেলল, খ্রিস্টান বনে গেল, এখন গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে চলে। তারা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার জিহাদ করা কোথায় গেল? তোমার জ্ঞানের কি হল? কি হল তোমার সেই কুরআনের?’ সে বলল, ‘ওহ, আমি সব ভুলে গেছি শুধু একটা মাত্র আয়াত বাদে যেখানে আল্লাহ বলেছেন,
“কোনো সময় কাফেররা আকাঙ্ক্ষা করবে যে, কি চমৎকার হত, যদি তারা মুসলমান হত। আপনি ছেড়ে দিন তাদেরকে, খেয়ে নিক এবং ভোগ করে নিক এবং আশায় ব্যাপৃত থাকুক। অতি সত্বর তারা জেনে নেবে।”’ (হিজর ১৫:২–৩)
অর্থাৎ সে কুরআনের সব আয়াত ভুলে গিয়েছিল শুধু এই আয়াতটা বাদে যেখানে বলা হচ্ছে একদিন অবিশ্বাসীগণ আকাঙ্ক্ষা করবে আর চাইবে যেন তারা মুসলিম হতে পারত। আর আল্লাহ বলছেন, ছেড়ে দিন তাদেরকে খাওয়া-দাওয়া করতে ও আমোদ-আহ্লাদ করতে, কামনা-বাসনা দ্বারা তাদেরকে বোকা বনে যেতে দিন। শীঘ্রই তারা বুঝতে পারবে। তারা জানতে পারবে সত্যি কি। যখন আপনি সত্য পথ থেকে সরে যাবেন, এটাই হবে। এই ব্যক্তিটি ছিল একজন মুজাহিদ, সে কুরআন জানত, আর বহু আয়াত মুখস্থ করেছিল,সে প্রচুর জ্ঞানের অধিকারী ছিল। কিন্তু সরল পথে লেগে থাকেনি।
আল্লাহ তা’আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, (ফাসতাক্বিম) “সত্য জানার পরে আপনি সরল পথের অনুসরণ করুন।” একজন সাহাবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তাকে বলল, ‘আমাকে একটা উপদেশ দিন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমাকে এমন এক উপদেশ দিন যেন আমাকে আর কারো কাছে কোন উপদেশ চাওয়া না লাগে, যেন আপনার এই একটা উপদেশই আমার জন্য যথেষ্ট হয়’। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘বলো, আমি আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি আর তারপর সরল পথের উপর দৃঢ় থাকো’। কারণ আমরা মুখে বলে পারি আমরা মুসলিম, কিন্তু জরুরি বিষয় হল সরল পথের উপর থাকা,এটাই তো আমাদের আসল পরীক্ষা, আর এখানে এসেই অনেক মানুষ বিফল হয়। তারা কিছু সময়ের জন্য সত্য পথে চলে তারপর পরিবর্তনের হাওয়া তাদেরকে ডান থেকে বামে নিয়ে যায়। এটাই হয় শেষ পর্যন্ত তার সাথে। কেন? কারণ সে সত্য পথে চলা থেকে বিরত হয়েছিল। তো আপনার পা ফসকে যায়, আর আপনি জানেন পর্যন্ত না যে কতো উঁচু পাহাড় থেকে আপনি পড়তে যাচ্ছেন। আল্লাহর ভয় হলো এরকম, আপনি জানেন সত্য কী, আর আপনি এতো চিন্তিত/উদ্বিগ্ন যে সালাতে ১৭বার আল্লাহকে ডাকেন, “হে আল্লাহ, আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি। আমাদেরকে সরল পথ দেখাও।” (সূরাহ ফাতিহা ১:৫–৬)
আমরা আমাদের ফরয নামাজের সময় ১৭ বার আল্লাহর কাছে এই দুআ করতে থাকি যেন আমাদেরকে তিনি সরল পথে পরিচালিত করেন। আর তারপর সুন্নাহ এবং নফল সালাহ গুলিতেও সূরাহ ফাতিহা পড়ি। কেন আমরা একই আয়াত বার বার করে পড়ছি? কারণ এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় – সরল পথের উপর থাকতে পারা।
তৃতীয় কারণ হল, গুনাহ্র কাজে অব্যাহত থাকা।
একজন ব্যক্তি খুব ছোট কোন গুনাহ করতে পারে, কিন্তু উলেমাগণ বলে থাকেন, ছোট গুনাহ-ও অনবরত করতে থাকলে তা বড় গুনাহতে পরিণত হয়। অতএব যখন আপনি একটা ছোট গুনাহ বারে বারে করতে থাকবেন, এটাকে ধরা হবে গুরুতর গুনাহ হিসেবে। আল-যাহাবী (Al-dhahabi) তাঁর ‘আল-কাবাইর’ গ্রন্থে মানুষের জীবনের মন্দ সমাপ্তি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, এক ব্যক্তির নেশা ছিল দাবা খেলা, মৃত্যুর সময় যখন তাকে বলা হল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে, সে, তা বলতে পারল না। আর মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সে বলতে থাকল, ‘চেক দোস্ত, চেক দোস্ত, চেক দোস্ত’, কারণ সে ভাবছিল তার দাবার কথা, আর এভাবেই সে মারা গেল। আল-যাহাবী আরেক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন যাকে মৃত্যুর সময় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে বলা হলে সে বলতে থাকে, ‘আমাকে একটা বোতল দাও, একটা গ্লাস দাও, আমি মদ খাব’। যেহেতু সে ছিল মাদকাসক্ত, শেষ মুহূর্তে এসেও তার মাথায় মদের কথা ঘুরছিল। আর-রাবী বিন সাবুরা বলেন, তিনি একজন লোকের মৃত্যুর সময় উপস্থিত ছিলেন, এই লোক একজন অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে চাকরি করত। তাকে সবসময় হিসাব-নিকাশ আর গণনার কাজ করতে হতো। মৃত্যুর সময় সবাই বলল, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে, সে বলতে শুরু করল ১০, ১১, ১২ এরপর মৃত্যু পর্যন্ত সে এভাবেই নম্বর গুনতে থাকল। ইবন আল কায়্যিম একটা কাহিনী বর্ণনা করেন যেখানে এক ব্যক্তিকে মারা যাওয়ার সময় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে বলা হলে সে বলল, ‘আমি পারছি না’ অথচ তার জিহ্বায় কোন প্রকার সমস্যা ছিল না। সে প্রাঞ্জলভাবে কথা বলতে পারত, কিন্তু সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে পারল না। আল্লাহ তা’আলা তাকে এটা বলার তওফিক দিলেন না কেননা তার জীবনে এটা বলার মত কোন রেকর্ড ছিল না।
মৃত্যুর সময় আপনার জন্য ‘সাকারা’ কেমন হবে তা বুঝার জন্য চিন্তা করে দেখুন, যখন আপনি ঘুমিয়ে পড়েন, কি ধরনের জিনিস নিয়ে স্বপ্ন দেখেন? খুব সম্ভবত তা হবে সারাদিনে আপনি যা ভাবেন বা করেন সেগুলোই। যখন আপনি একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকেন, সাধারণত সেটাই রাতে আপনার স্বপ্নের মধ্যেও উঠে আসে। আপনার মাথায় কি চলছে তা বুঝার আর একটা উপায় হল, যখন আপনি ঘুম থেকে সকালে জেগে ওঠেন, তৎক্ষণাৎ আপনার মাথায় প্রথম কোন জিনিসটা আসে। যেহেতু মৃত্যু অনেকটা ঘুমের মতই, ঘুমকে বলা হয়ে থাকে ‘গৌণ মৃত্যু’, তাই যখন আপনি ঘুম থেকে জাগ্রত হতে যাচ্ছেন, ঐ মুহূর্তটা অনেকটাই ‘সাকারাতুল মাউত’ অবস্থাটার সাথে মিলে। একজনের মাথায় যেসব চিন্তা-ভাবনা আছে, জীবনের শেষ সময়ে এসে ঐ চিন্তাগুলোই এসে হাজির হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। আমরা সবসময় ভাবছি আমি কি করব, আমি কি চাই। আমি সারাজীবন আমার মনমত গুনাহ করে যাব আর মৃত্যুর ঠিক ৫ মিনিট আগে আমি বলব ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ – না, এটা এতো সহজ না। এভাবে আপনি পরিকল্পনা করছেন, আল্লাহর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। আপনি যখন এসব কথা বলেন তখন আপনি আসলে আল্লাহর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন। কিভাবে? কারণ আপনি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে বলছেন, ‘আমি তোমার ইবাদত করব না’। আপনি এটা নিয়্যত করছেন যে আপনি জীবনের শেষ মুহূর্ত টা আসার আগ পর্যন্ত আল্লাহর ইবাদত করবেন না! এটা কি? এটা কি আল্লাহর বিরুদ্ধেই ফন্দী আঁটা নয় কি? আমি যা চাইব তাই করব, আমি এখনও অল্পবয়সী, বুড়ো হবার পর তওবার কথা চিন্তা করব। আল্লাহ আপনাকে বলছে- ‘তোমার জীবনের প্রতি দিন প্রতি রাতে আমারই ইবাদত করো’, আর আপনি বলছেন, ‘না, আমি এখান থেকে কোনোভাবে পালিয়ে থাকি, শুধু শেষে যেয়ে তওবা করে ফেলব, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কে আমি বোকা বানাবো’। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর তারা চক্রান্ত করেছিল, আর আল্লাহ্ও পরিকল্পনা করেছিলেন। আর আল্লাহ্ পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে সর্বোত্তম।” (সূরাহ আলে ইমরান ৩:৫৪)
একজন শায়খ (স্কলার) কয়েক সপ্তাহ আগে একটা বাস্তব ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। তারা একজন বৃদ্ধ লোকের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল যে জীবনের অন্তিমশয্যায় চলে এসেছিল, তারা ঐ বাড়িতে পৌঁছে দেখলেন সারা বাড়ি উম্মে কুলসুমের (একজন আরব সঙ্গীতশিল্পী) গানে গমগম করছে। এই লোকটা তার জীবনের শেষ মুহূর্ত কাটাচ্ছে আর টেপ রেকর্ডারে ফুল ভলিউমে গান চলছে। শায়খ তাদের কাছে যেয়ে বললেন, ‘আল্লাহকে ভয় করুন, একজন মানুষ মারা যাচ্ছে আর আপনারা গান শুনছেন’। তাই তারা গান বন্ধ করে কুরআন ছেড়ে দিল। যখন সে বৃদ্ধ ব্যক্তি কুরআন শুনতে পেল সে বলল, ‘বন্ধ করো এটা, আর উম্মে কুলসুমের গান আবার লাগাও, কারণ ওটা শুনলে আমার মন জুড়িয়ে যায়’, এরপর সে মারা গেল। যখন আপনি জীবনে একটা জিনিস নিয়ে চলতে থাকবেন, আপনি মারাও যাবেন সেটা নিয়েই। আপনি যেসব কাজ করে অভ্যস্ত সেসব কাজ করতেই করতেই আপনার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কখনোই ভাববেন না আপনি আল্লাহ কে বোকা বানাবেন। আপনার মনে আল্লাহর ভয় থাকা উচিত। যে ব্যক্তি আল্লাহর আযাব থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। ‘খাশিয়া’ (আল্লাহ ভীতি) মুসলিমদের জন্য খুবই মৌলিক একটা ব্যাপার। একজন মুসলিম হওয়ার জন্য, ঈমানদার হওয়ার জন্য অবশ্যই অন্তরে খাশিয়া (আল্লাহর ভয়) থাকতে হবে।
জীবনের শেষ মুহূর্ত খারাপ হওয়ার চতুর্থ কারণ হল, দুর্বল ঈমান বা দুর্বল বিশ্বাস। সুলায়মান আবদুল মালিক, আল-আওয়ামির খলিফা (মুসলিম বিশ্বের খলিফা), মক্কা আর মদীনায় সফর করে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘এমন কেউ কি এখানে আছে যে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দেখেছেন?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ, আবু হাযিম’। তিনি বললেন, ‘তাকে ডাকো’। তাই তারা আবু হাযিম মালিক কে নিয়ে আসল। খলিফা সুলায়মান ইবন আবদিল তাকে একটা প্রশ্ন করলেন, ‘এমন কেন যে আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই? কেন আমরা মারা যেতে চাইনা?’ আবু হাযিম বলেন, ‘কারণ আপনি এই দুনিয়াকে গড়েছেন আর আখিরাতকে ধ্বংস করেছেন। তাই আপনি যা তৈরি করেছেন সেটা ছেড়ে, যা নষ্ট করেছেন সেখানে যেতে ঘৃণা করেন’। প্রভাবটা খুবই স্বাভাবিক, আপনি যদি আখিরাতের জন্য নিজেকে তৈরি না করেন তাহলে কেন সেখানে আপনি যেতে চাইবেন? আপনি যেতে চাইবেন না -এর কারণ হল দুর্বল ঈমান, আর দুর্বল ঈমান হওয়ার কারণ কি? এই দুনিয়ার জন্য ভালবাসা। যখন আমরা এই দুনিয়াকে ভালবাসতে শুরু করি, তখন আখিরাতে যেতে চাইনা। আর এই দুনিয়ার মোহের কারণে আপনার জীবনের শেষটা হতে পারে অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক, মারাত্মক। উলেমাগণ বলেছেন, ‘যদি কারো হৃদয়ে এই পৃথিবীর জন্য ভালবাসা থাকে, তাহলে ঠিক মৃত্যুর পূর্বে যখন সে বুঝতে পারে সে তার এই প্রিয় দুনিয়া চিরতরে ছেড়ে দিয়ে আখিরাতে যাচ্ছে, সে যেটা পছন্দ করে তার প্রতিই আসক্ত হয়ে যাবে অর্থাৎ সে দুনিয়ার সাথে আবদ্ধ হয়ে যাবে, আর আল্লাহকে ঘৃণা করা শুরু করবে কারণ আল্লাহ তাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উলামাগণ বলেন একজন মানুষের মৃত্যুর একদম পূর্ব মুহূর্তে এরকম হতে পারে, আর যদি তা হয় তাহলে তার চিরস্থায়ী শাস্তি হবে জাহান্নাম। কেননা আপনি যদি আল্লাহর সাথে দেখা করতে ঘৃণা করেন, অপছন্দ করেন, তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাও আপনার সাথে দেখা করতে অপছন্দ করবেন।
মুআয ইবন জাবাল তাঁর মৃত্যুর সময় কি বলেছেন? সে বলেন, ‘মৃত্যু তোমায় স্বাগতম। আমি তোমার জন্য কতোদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি, আমাকে দেয়া আল্লাহর ওয়াদার জন্য অপেক্ষা করে আছি। মৃত্যু তোমায় স্বাগতম!’ অর্থাৎ তিনি খুশি। এরপর তিনি বললেন, ‘হে মৃত্যু, মনে করো না, আমি এই দুনিয়াতে থাকতে চেয়েছি এর প্রতি ভালবাসার জন্য, আমি এখানে থাকতে চেয়েছি যেন দীর্ঘ গরমের দিনগুলোতে রোজা রাখতে পারি, যেন শীতের লম্বা রাত্রিতে নামাজ পড়তে পারি, তাই এখন যখন আমার যাওয়ার সময় এসেছে, আমি তোমাকে স্বাগত জানাই। নাও আমার আত্মাকে’। তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সাথে সাক্ষাত করতে চাইতেন, তাই আল্লাহ তা’আলাও তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে চান।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘প্রত্যেক নবী-রাসূলকে মৃত্যুর পূর্বে জান্নাতে তাঁর স্থান দেখানো হয়, এরপর তাকে যেকোন একটা নেয়ার ইচ্ছা প্রদান করা হয় – সে এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে পারবে অথবা মৃত্যুবরণ করতে পারবে। অর্থাৎ আম্বিয়াদেরকে চয়েস দেয়া হয়, এই হাদীসটি আইশা (রা) বর্ণনা করেছেন আর তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন যে প্রত্যেক নবী এবং রাসূলকেই মৃত্যুর পূর্বে জান্নাতে তাঁর বাসস্থান দেখানো হয়, এরপর তাকে জীবিত থাকা বা মৃত্যুবরণ যেকোন একটার সুযোগ দেয়া হয়। আর যখন রাসূলুল্লাহ (সা) মারা যাচ্ছিলেন তাঁর মস্তক আমার কোলের উপর ছিল, এরপর তিনি অচেতন হয়ে যান, আবার জেগে ওঠেন, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকেন, ‘হে আল্লাহ, সর্বোৎকৃষ্ট সঙ্গী, হে আল্লাহ, সর্বোৎকৃষ্ট সঙ্গী!’, (অর্থাৎ আমি সর্বোৎকৃষ্ট সঙ্গীর সাথে থাকতে চাই, আল্লাহর সাথে থাকতে চাই), আইশা (রা) বলেন, আমি জানতাম ঐ মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যেকোন একটা বেছে নেয়ার ইচ্ছা প্রদান করা হয়েছিল আর তিনি তখন আমাদেরকে পছন্দ করেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর ফেরেশতা দ্বারা এই ইচ্ছা প্রদান করা হয়- ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি কি এখানে বেঁচে থাকতে চান নাকি চলে যেতে চান?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার সাথে থাকতে চাই, ‘ওহ আল্লাহ, সর্বোৎকৃষ্ট সঙ্গী!’ আর এটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ কথা।
সাল্লাল্লাহু আলা সাইয়িদিনা মুহাম্মদ ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাহবিহী ওয়া সাল্লাম তাসলীমান কাসীরাহ