মহাপ্রলয়ের লক্ষণ
আজকের বিষয়বস্তুর নাম দেয়া হয়েছে ‘মহাপ্রলয়ের লক্ষণ’। নামটি মূলত আরবি পরিভাষা ‘আশরাত আস-সা’আহ’ বা ‘আলামাত আস-সা’আহ’র অনুবাদ। এই ‘আলামাত আস-সা’আহ’ মহাপ্রলয় বা কিয়ামত নির্দেশ করে। এগুলোকে বলা যায় কিয়ামতের দিকে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে এক একটি নির্দেশক বা মাইলফলক। এখানে ব্যবহৃত ‘আস-সা’আহ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ‘সময়’, প্রায়োগিক অর্থ ‘কিয়ামত শুরু হওয়ার সময়’। এ সময়টা আসলে কখন, তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ছাড়া অন্য কেউ জানে না, এমনকি কোন নবী কিংবা ফেরেশতাও না। এটা ‘ইলমুল গাইব। একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলাই জানেন কখন কিয়ামত হবে। এজন্যেই একটি মশহুর হাদীসে জিবরীলে পাওয়া যায়, জিবরাঈল (আ) আকাশ থেকে নেমে এসে যখন রাসূলুল্লাহকে (স) জিজ্ঞেস করেছেন, “কিয়ামত কখন?” রাসূলুল্লাহ (স) উত্তর দিয়েছেন, “যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে সে প্রশ্নকর্তার চেয়ে ভাল জানে না।”
খেয়াল করুন জিবরাঈল (আ) রাসূলুল্লাহকে (স) জিজ্ঞেস করলেন যে কিয়ামতের সময়টা কখন আর রাসূলুল্লাহ (স) উত্তর দিলেন যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে সে প্রশ্নকর্তার চেয়ে ভাল জানে না অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন আমাদের দুজনের কারোরই জানা নেই যে কখন কিয়ামত হবে, এটা আল্লাহর ইলমুল গাইবে আছে। তবে রাসূলুল্লাহ (স) আমাদেরকে এর বেশ কিছু আলামত বলে গিয়েছেন। কিন্তু আসল ব্যাপার হচ্ছে এ ধরণের আলামত বা লক্ষণ এর বর্ণনা আছে অনেক- কোনটা আছে বেশ নির্ভরযোগ্য হাদীসে আর কোনটা নিতান্তই দুর্বল হাদীসে। পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ অংশটুকু ছেঁকে নিয়ে আসতে হলে হাজারো বই আর হাদীস ঘাঁটতে হবে- বুঝতেই পারছেন বেশ কঠিন এবং শ্রমসাধ্য কাজ।
তবে আলহামদুলিল্লাহ ইবনে কাসীর সহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ইতিমধ্যে কিয়ামতের আলামতগুলোর তালিকা প্রণয়ন করে বেশ কিছু বই লিখেছেন। আমার ধারণা, আল্লাহু আ’লাম, কিয়ামতের আলামত নিয়ে তাঁরা রীতিমত মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি স্তরের কাজ করেছেন। এ বিষয়ে যে বিশুদ্ধ হাদীসগুলো আছে সেগুলোকে বলা হয় আস–সহীহ মিন আশরাত আস–সা’আহ কিংবা আস-সহীহ মিন আলামাত আস-সা’আহ। শুধু এই বিশুদ্ধ হাদীসগুলো সংগ্রহ করে ইউসুফ নামের জনৈক বিশেষজ্ঞ একটি বই লিখেছেন। এটাকেই আমি মূল তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছি। তিনি নির্ভরযোগ্য হাদীসগ্রন্থ থেকে এ হাদিসগুলো নিয়েছেন এবং পঞ্চাশটিরও বেশি আলামত তাঁর তালিকাভুক্ত করেছেন। অন্যান্য অনেক বইতে এ সংখ্যা প্রায় একশ’তে পৌঁছেছে, তবে সেগুলোতে কিছু দুর্বল হাদীস থাকার সম্ভাবনা আছে।
এবার কিয়ামতের আলামতগুলো বর্ণনা করার আগে কিছু বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া যাক। যেমন কিছু আলামত আসলে এমন কিছু ঘটনা যেগুলো একবারই ঘটতে পারে এবং ঘটলে আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন যে ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, হিজাযে একটি আগুন লাগবে যার আলো শামদেশ পর্যন্ত পৌঁছবে এবং রাতের বেলাতেও তুমি উটের ঘাড় পর্যন্ত দেখতে পাবে। এটা আসলেই একটা ঘটনা যা ঘটলে আপনি জানতে পারবেন যে এটা ঘটেছে কিনা এবং কখন ঘটেছে।
আবার কিছু আলামত আছে যেগুলো বারবার ঘটতে পারে কিংবা না ঘটলেও মনে হবে ঘটেছে। যেমন একটি আলামত আছে এরকম যে অনেক গণহত্যা এবং খুনোখুনি হবে। এটা এমন একটা আলামত যে বর্তমানে উম্মাহর মধ্যে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড দেখে বলতেই পারেন ওয়াল্লাহি এটা বোধহয় ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। কিন্তু আপনি হয়ত জানেন না- এটা আরও খারাপভাবেও ঘটতে পারে। তাছাড়া কিছু আলামত আছে যেগুলো কোন এক সময় অল্প পরিসরে ঘটলেও এখনো হয়ত পূর্ণ আয়তনে ঘটেনি, আবার কিছু আছে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কিছু সম্পূর্ণ বিপরীত আলামতও পাওয়া যায় যেমন একটা আলামত আছে যে শান্তি আসবে আবার অন্য একটা আলামত বলে যে যুদ্ধ ও নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে পড়বে। দেখতেই পাচ্ছেন একটা আরেকটার সম্পূর্ণ বিপরীত- দুটো একই সাথে ঘটতে পারে না। কাজেই এগুলো অবশ্যই কালের পরিক্রমায় ভিন্ন ভিন্ন যুগে ঘটবে।
আসলে রাসূলুল্লাহর (স) আগমনই কিয়ামতের প্রথম আলামত। কারণ রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, “আমাকে কিয়ামতের এতটা কাছাকাছি পাঠানো হয়েছে যতটা কাছাকাছি এই আঙুল দুটো”। এখানে রাসূলুল্লাহ (স) আমাদেরকে বলছেন যে, পৃথিবীর বুকে মানবজাতির যে বয়স সে তুলনায় তিনি কিয়ামতের এতটাই কাছাকাছি এসেছেন যতটা কাছাকাছি তাঁর আঙুল দুটো। তিনি বলছেন যে তিনি এসেছেন শেষ সময়ে। এ পৃথিবীর বুকে মানুষের বিচরণকালকে যদি একটি দিন ধরা হয় তবে রাসূলুল্লাহর (স) আগমন যেন পড়ন্ত বিকেলে- সূর্য যেন অস্ত যাই যাই করছে। এটা আল-বুখারীর হাদীস।
দ্বিতীয় আলামতটি হচ্ছে রাসূলুল্লাহর (স) মৃত্যু। আল-বুখারীর একটি হাদীসে আছে, আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (স) আমাকে কিয়ামতের আগে ছয়টি আলামত হিসেব করতে বলেছেনঃ ১ নাম্বারে তিনি বলেছেন- “আমার মৃত্যু”। কাজেই প্রথমে আমরা এ আলামতটি নিয়ে আলোচনা করবো তারপর পর্যায়ক্রমে বাকি পাঁচটি আলোচিত হবে। রাসূলুল্লাহর (স) মৃত্যু শুধু কিয়ামতের একটা আলামতই নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর জন্যে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ও ছিল বটে। এ ব্যাপারে একটা হাদিসই আছে যেখানে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘তোমরা যখনই কোন সমস্যায় ভুগবে, তখনই আমায় হারিয়ে ফেলার মাধ্যমে যে সমস্যায় পড়েছ সেটার কথা ভাববে,তোমাদের সমস্যাটা তখন তুচ্ছ মনে হবে’। যদি আপনার জীবনে কখনো কোন সমস্যা, দুর্ঘটনা কিংবা বিপর্যয় আসে তবে ভেবে নেবেন আপনি বেশি কিছু হারাচ্ছেন না । কারণ সবচেয়ে বড় হারানোটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি- রাসূলুল্লাহকে (স) হারিয়েছি; দেখবেন আপনার সমস্যাটা ছোট , তুচ্ছ সামান্য হয়ে যাবে। সুনান আত-তিরমিযীতে আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (স) যখন মদীনায় এসেছিলেন পুরো মদীনা যেন আলোয় ভরে গিয়েছিল, যখনই তিনি চলে গেলেন মদীনা যেন আঁধার হয়ে এল। যখন রাসূলুল্লাহকে (স) আমরা দাফন করলাম, তাঁর কবরের মাটি হাতে লেগে থাকতেই হৃদয়ে যেন কী একটা পরিবর্তন অনুভব করলাম। খেয়াল করুন তিনি বলছেন, আমরা হৃদয়ে কী যেন একটা পরিবর্তন অনুভব করলাম তার মানে রাসূলুল্লাহর (স) শুধু উপস্থিতিই তাঁদের কাছে ছিল কিছু একটা। এবং রাসূলুল্লাহ (স) মারা যাওয়ার সাথে সাথে তাঁরা অনুভব করলেন মদীনায় কি যেন নেই। সাহাবী আনাস ইবন মালিক (রা) বলে চলেছেন, আমরা আমাদের নিজেদের মনকেই যেন চিনতে পারছিলাম না, এ যেন অন্য হৃদয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (স) আশেপাশে থাকলেই মনে একটা প্রশান্তি পাওয়া যেত। এমনকি তিনি যদি তাঁদের চোখের সামনে নাও থাকতেন- তিনি হয়ত আছেন তাঁর বাসায়- তবু তাঁরা শুধু তাঁর উপস্থিতির কারণেই কিছু একটা অনুভব করতেন; যখনই তিনি চলে গেলেন তখনই তাঁদের মনে হল কী যেন হারিয়ে গেছে।
তৃতীয় আলামতটি হচ্ছে জেরুযালেম অধিকার – ফাতহু বাইতিল মুকাদ্দাস। এই ঘটনাটি ঘটেছিল উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) আমলে। তখন মুসলিম বাহিনীর প্রধান ছিলেন আবু উবাইদাহ আমর ইবনু জাররাহ এবং তিনি জেরুযালেম ঘিরে রেখেছিলেন। জেরুযালেম আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়, কারণ মুসলিম বাহিনীর সাথে তাদের যুদ্ধের কোন সুযোগই ছিল না। অতএব তারা আবু উবাইদাহকে খবর পাঠাল যে, আমরা জেরুযালেমের চাবি হস্তান্তর করে আত্মসমর্পণ করতে রাজি আছি। তবে শর্ত দিল এই যে, চাবি তারা মুসলিমদের খলীফাহর হাতে দেবে। এ খবর শুনে উমার ইবনুল খাত্তাব শূরা ডাকলেন- যাব কি যাব না? কোন কোন সাহাবা বললেন, আপনি মদীনাতেই থাকুন, গেলে আপনার বিপদ হতে পারে। আবার কেউ কেউ বললেন আপনি যান, ইনশা আল্লাহ নিরাপদেই থাকবেন। উমার ইবনুল খাত্তাব শেষ পর্যন্ত গেলেন।
এবারকার ঘটনা আমরা আগেও আলোচনা করেছি; সংক্ষেপে বলি- তিনি বেরোলেন তাঁর খাদেমকে সঙ্গে নিয়ে অর্থাৎ চাকর বা ভৃত্যকে সাথে করে নিয়ে তিনি বের হলেন। তাঁরা একেকবার একেকজন উটের পিঠে চড়েন- একবার উমার, একবার তাঁর ভৃত্য, তারপর আবার কিছুক্ষণ উটকে বিশ্রাম দেন। এভাবে উমার ইবনুল খাত্তাব যখন জেরুযালেমের কাছাকাছি পৌঁছলেন, তখন তাঁর উট টেনে নেয়ার পালা আর তাঁর ভৃত্যের উটে চড়ার পালা। এদিকে তাঁরা এসে পৌঁছেছেন এক কাদাভরা ডোবার সামনে- ঐ ডোবার ওপর দিয়েই যেতে হবে, তাই উমার তাঁর কাপড় উঠিয়ে নিয়ে ডোবা পেরোনো শুরু করলেন। পায়ে ও কাপড়ে কাদা লেপে তিনি ডোবার মধ্য দিয়ে উট টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আর এই ঘটনাটা ঘটছে জেরুযালেমের বাসিন্দাদের চোখের সামনে। আবু উবাইদাহ, যিনি ছিলেন আল-আশারাতুল মুবাশশারাতু বিল জান্নাহর একজন, ভাবলেন এটা ঠিক হচ্ছে না- এজন্যে নয় যে কোন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির বিনয়ী হতে পারবে না ,তা নয়। কিন্তু রোমান সংস্কৃতির ছায়ায় বেড়ে ওঠা এই লোকগুলো সবসময় দেখে আসছে যে রাজা-বাদশাহ আর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের চারপাশে থাকে প্রহরী, একটা আলাদা ঢঙে তারা নিজেদেরকে উপস্থাপন করে থাকে। তাই তিনি ভাবলেন উমার ইবনুল খাত্তাবের এভাবে আসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি কারণ জেরুযালেমের বাসিন্দারা তাঁকে এই বেশে যথার্থ সম্মান নাও দিতে পারে যেখানে ঐ সময়ে দুনিয়ার যেকোনো মানুষের চেয়ে বেশি সম্মান প্রাপ্য উমার ইবনুল খাত্তাবের। এই ভেবে তিনি আমীরুল মুমিনীনের কাছে গেলেন এ ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিতে। উমার ইবনুল খাত্তাব সে পরামর্শ শুনে তাঁর বুকে আঘাত করে বললেন, “আমি তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি”। তিনি আরও বললেন, “আমরা এমন জাতি যারা নিতান্ত তুচ্ছ, নীচু জাত ছিলাম, আল্লাহ আমাদের মর্যাদা উঁচু করে দিয়েছেন ইসলামের মাধ্যমে। আমরা যদি অন্য কোন উপায়ে সম্মান কামনা করি, তবে আল্লাহ আবারো আমাদের নীচু করে দেবেন”। এর অর্থ আমাদের সম্মান মোটর শোভাযাত্রা কিংবা দেহরক্ষী বাহিনীর মাঝে নেই, নেই আমাদের পোশাকে, কিংবা বিলাসবহুল সিটে বসে সুরক্ষিত সফরে। পোশাকি জৌলুস নয়, আমাদের সম্মান দেয় ইসলাম- তিনি আবু উবাইদাহকে এই শিক্ষা দিচ্ছিলেন ১৪টি তালি দেয়া এক পোশাক পরে। তিনি তাঁকে এ কথাই বলতে চেয়েছেন যে তারা কী ভাবল না ভাবল ভুলে যাও। কারণ তাদের প্রত্যাশিত বেশে আমরা নিজেদেরকে উপস্থাপন না করলেও আল্লাহ তাদের হৃদয়ে আমাদের মর্যাদার স্থান করে দেবেন। তিনি আবু উবাইদাহকে এ কথাও পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন যে বাইরের কোন জৌলুসে সম্মান খোঁজার চেষ্টা করলে আল্লাহ আমাদের সম্মান ছিনিয়ে নেবেন। কারণ আমাদের সম্মান ইসলামেই নিহিত, অন্য কোথাও নয়। কেতাদুরস্ত আনুষ্ঠানিকতা আমাদের দরকার নেই, আমরা সাদামাটা মানুষ। আল্লাহ আমাদেরকে দীনের মাধ্যমেই আমাদের সম্মান দেবেন। সুবহানাল্লাহ উমার ইবনুল খাত্তাব ঠিকই বলেছেন, জেরুযালেমের লোকেরা যখন তাঁকে এ অবস্থায় দেখল,তারা কেঁদে দিল। বলা হয়ে থাকে যে লোকে তাঁকে দেখার জন্যে বাড়ীর ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে ছিল কারণ তারা প্রবল প্রতাপশালী উমার ইবনুল খাত্তাবের নাম শুনেছিল মাত্র,দেখেনি কখনো। তবে তারা যা আশা করেছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রটিই দেখতে পেল। ইসলামের এই সাদামাটা নমুনা দেখে তারা নিজের চোখকে পর্যন্ত বিশ্বাস করতে পারল না,আবেগে কাঁদতে শুরু করল। জেরুযালেমের চাবি তারা শেষ পর্যন্ত আল-খলীফাহ উমার ইবনুল খাত্তাবকেই দিয়েছিল। আল্লাহু আ’লাম, ইবনু কাসীর উল্লেখ করেছেন, যে এই চাবি হস্তগত করবে তাঁর কিছু বৈশিষ্ট্য নাকি তাদের বইয়ে লিখা ছিল এবং একটা বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে তাঁর জামায় ১৪টা তালি থাকবে। যাহোক, বাইতুল মাকদিসের এই আলামতটি বুখারীর হাদীসে উল্লিখিত ছয়টি আলামতের একটি।
চার নাম্বার আলামতটি হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, মৃত্যু তোমাদের গ্রাস করবে এমন এক রোগের রূপে যা ছাগলের হয়ে থাকে। এখানে প্লেগের কথা বলা হচ্ছে আর এই প্লেগ হয়েছিল জেরুযালেম অধিকারের পর হিজরি ১৮ সনে আশ-শাম নামক জায়গায়। এটা মুসলিমদের জন্যে বড় একটা বিপর্যয় ছিল- পুরো উম্মাহ বেশ বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। কারণ ২৫,০০০ এরও বেশি মুসলিম এই প্লেগে মারা গিয়েছিলেন এবং এঁদের মধ্যে আবু উবাইদাহ ও মুয়ায ইবনু জাবালের মত ব্যক্তিরা সহ আরও বহু সাহাবা ছিলেন। তাঁদের জন্যে এটা ছিল একটা রহমত কারণ তাওয়াউন এক ধরণের শাহাদাহ,(check) কিন্তু উম্মাহর জন্যে তাঁদের মত ২৫,০০০ জনকে হারানোটা ছিল বিশাল এক লোকসান।
পঞ্চম আলামতটি হচ্ছে সম্পদের প্রাচুর্য। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, “সম্পদ এত অঢেল হবে যে কোন মানুষের হাতে একশ দিনার [দিনার হচ্ছেছোট ওজনের স্বর্ণমুদ্রা] ধরিয়ে দিলেও সে সন্তুষ্ট হবে না”। ভাবখানা এমন যে, মাত্র একশ দিনার! কী এটা!- এতটাই প্রাচুর্য হবে। এটা কিছুটা হয়েছিল উমার বিন আব্দিল আজীজের আমলে, উমার বিন আল-খাত্তাবের আমলেও কিছুটা হয়েছিল বলা যায়। উমার বিন আব্দিল আজীজের সময়কার কিছু কাহিনী প্রচলিত আছে, তার মধ্যে একটা হচ্ছে আফ্রিকার এক রাষ্ট্রের কাহিনী- সে সময়ে ছিল উত্তর আফ্রিকা- বর্তমান লিবিয়া বলা যেতে পারে। তারা মদীনার খলীফাহর কাছে কিছু অর্থসম্পদ পাঠাল। উমার বিন আব্দিল আজীজ বললেন তোমরা কেন আমাকে এই টাকাটা পাঠাচ্ছ? তাঁর প্রশ্ন ছিল কেন আফ্রিকার এই রাষ্ট্র আমাকে টাকা পাঠাচ্ছে? এটা ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে একই এলাকার গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার কথা। অন্যভাবে বললে, এই টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আসার কথা নয়, বরং স্থানীয় সরকার তার নিজস্ব এলাকায় ব্যয় করার কথা। এর উত্তরে তারা বলল যে, আমরা টাকাটা দেয়ার মত কোন গরীব লোক খুঁজে পাচ্ছি না। উমার বিন আব্দিল আজীজ তখন নির্দেশ দিলেন, আফ্রিকার ঐ রাষ্ট্রে এটা ফেরত পাঠিয়ে দাও এবং রাস্তাঘাট নির্মাণ কিংবা দাসমুক্তির কাজে ব্যবহার করতে বল। একইভাবে উমার বিন আব্দিল আজীজের আমলেই ইয়েমেনের যাকাহও কেন্দ্রীয় সরকারকে পাঠানো হয় এবং তিনি সেটা ফেরত পাঠাতে বলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমত ও বরকতের কারণে সে সময় সম্পদের প্রাচুর্য ছিল। তবে এই সম্পদের প্রাচুর্যই যখন পুরো বিশ্ব জুড়ে থাকবে তখন সেটা কিয়ামতের ইঙ্গিত হয়ে দেখা দেবে। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন যে, “একটা সময় আসবে যখন কেউ সাদাকাহ হিসেবে সোনা নিয়ে বেরোবে কিন্তু সেটা নেয়ার মত কাউকে খুঁজে পাবে না” (মুসলিম)। কল্পনা করুন তো, আপনি লোকজনকে সোনা সেধে বেড়াচ্ছেন কিন্তু কেউ নিতে চাচ্ছে না! কারণ সবারই এত বেশি আছে যে অন্যের কাছ থেকে নিতে আঁতে ঘা লাগে- সবাই তুষ্ট এবং তৃপ্ত। তবে আমার কথা হচ্ছে,কিছু লোক কি এমন পাওয়া যাবে না যাদের টাকা থাকলেও সোনা দেখলে না নিয়ে পারবে না? আসলে এই হাদিসটা আমাদের দুটি কথা বলছে। প্রথম কথা লোকজন তৃপ্ত, তুষ্ট থাকবে, তাদের যথেষ্ট টাকাপয়সা থাকবে।
দ্বিতীয় কথাটি হচ্ছে তারা লোভ করবে না- কারণ ধনী লোকেও সোনা পেলে নেয়ার কথা। মুসলিমেরই আরেকটা হাদীসে আছে যে, পৃথিবী সোনারূপার স্তুপ উগরে দেবে। তখন খুনী এসে বলবে, অতীতে আমি এর জন্যে মানুষ খুন করতাম; চোর বলবে আমি এর জন্যে চুরি করতাম; পরিবার-পরিজন ছেড়ে দিয়েছে এমন লোক এসে বলবে, আমি এর জন্যে আমার পরিবারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, তাদের সাথে লড়েছি; কিন্তু কেউ এগুলো নেবে না। চিন্তা করে দেখুন, তারা বলবে অতীতে এর জন্যে মানুষ খুন করেছি কিংবা চুরি করেছি কিংবা নিজের পরিবারের সাথে লড়েছি, কিন্তু তারপরও কেউ কিছু নেবে না। মনে তারা এতটাই তৃপ্ত থাকবে যে সোনাদানা না নিয়ে ফেলে রাখবে। আল্লাহু আ’লাম, কারণটা সম্পদ নিয়ে তাদের ভোগান্তিও হতে পারে। কারণ কিয়ামতের আরেকটা আলামতেই বলা আছে যে, ফোরাত নদী সোনার এক পাহাড় উন্মুক্ত করে দেবে, তারপর রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন যে, তুমি সেটা দেখলেও ছেড়ে দিয়ো কারণ সেখানে যারা যাবে তাদের প্রতি একশ জনে নিরানব্বই জনই খুন হবে। সম্পদ নিয়ে তখন হয়ত এত বেশি রক্তপাত হবে যে শেষে লোকজন একদম হাল ছেড়ে দেবে, বলবে- আমরা আর এসব চাই না, এগুলো আমাদের এত ভুগিয়েছে- আমি এর জন্যে মানুষ খুন করেছি কিংবা চুরি করেছি কিংবা নিজের পরিবারের সাথে লড়েছি, এখন আর এসব চাই না। অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (স) আমাদের সাবধান করেছেন এই বলে যে, আমাকে স্বর্গের সঞ্চিত ভাণ্ডারের চাবি দেয়া হয়েছে, আমি দারিদ্র্য নিয়ে মাথা ঘামাই না, তোমরা গরীব হয়ে যেতে পার সে উদ্বেগও আমার নেই। আমার আশঙ্কা এই যে, তোমরা দুনিয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে আর সে প্রতিযোগিতা তোমাদের ধ্বংস করে দেবে। অর্থাৎ পার্থিব অর্জনের প্রতিযোগিতাই আমাদের ধ্বংস ডেকে আনবে। রাসূলুল্লাহ (স) বলছেন যে তিনি দারিদ্র্য নিয়ে ভীত নন। আসলেও বর্তমানে আমরা দেখতে পাই, উম্মাহর মধ্যে যে দারিদ্র্য বিদ্যমান সেটা সম্পদের অভাবে নয় কারণ সবচেয়ে দামী সম্পদগুলোই আছে মুসলিম বিশ্বে- কোন দামী ধাতুই হোক বা তেলই হোক বা উর্বর কৃষিজমি যেটাই বলেন না কেন। সমস্যাটা হচ্ছে অসম বণ্টন, শোষণ, মানুষ যাকাহ দিচ্ছে না- যাকাহ দিচ্ছে না! তাহলে আমাদের দারিদ্র্য সম্পদের অভাবে নয়। সুবহানাল্লাহ আপনি যদি আজকের দুনিয়ার দিকে তাকান তবে দেখতে পাবেন সম্পদের ওপর খুব বেশি কিছু নির্ভর করে না- মানুষই সবচেয়ে বড় সম্পদ। উদাহরণ হিসেবে সিলিকন ভ্যালির কথা ধরা যাক- এই ভ্যালিতে আছে কিছু ধুলাবালি অর্থাৎ আসলেই খালি সিলিকনই আছে, আর কিছুই নেই। এক সময় সেখানে চাষাবাদ হত, এখন আর তাও হয় না। তবু এটা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী এলাকা। ঐ এলাকায় শুধু টাকা আর টাকা, কিন্তু মাটির নিচে কোন তেল নেই, খুব একটা চাষাবাদও হয় না, কোন সোনারূপাও নেই। তাহলে আছেটা কী? সেখানে যা আছে সেটা হচ্ছে মানবসম্পদ, মস্তিষ্ক- সবচেয়ে বড় সম্পদ যেটা। দুর্ভাগ্য মুসলিম বিশ্বের যে, সম্পদ আমাদের অনেক আছে কিন্তু সেগুলো কাজে লাগানোর মত সামর্থ্য নেই। আর যতদিন আমরা ব্যাবসা-বাণিজ্যে শরীয়াহ মেনে না চলব, ততদিন আল্লাহও আমাদের রিযকে বরকত দেবেন না। যদি আমরা প্রতারণার পথ অবলম্বন করি তবে আল্লাহ আমাদের রিযকে বরকত দেবেন না- যদি কেউ সম্পদশালী হয়েও থাকে তবু আল্লাহ তার সম্পদে কোন মঙ্গল রাখবেন না। একটা মানুষের টাকা-পয়সা থাকতেই পারে, কিন্তু তাতে যদি আসল নির্যাসটুকুই না থাকে তাহলে সে টাকাপয়সা দিয়ে তো কোন লাভ হবে না।
কিয়ামতের ষষ্ঠ আলামতটা হচ্ছে- ফিতনার সময়, আল-ফিতান(اَلْفِتَنُ- ‘আল-ফিতনাহ’ শব্দের বহুবচন)। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, ফিতনার সময় আসার আগেই ভাল কাজ করে রাখ; সে সময়টা হবে রাতের অন্ধকারের মত। তখন সকাল বেলা যে মুমিন রাতের বেলাতেই সে কাফির হয়ে যাবে, রাতের বেলায় যে মুমিন সে সকাল বেলাতেই কাফির হয়ে যাবে। কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন যে, তারা পার্থিব লাভের জন্যে ধর্ম বিক্রি করবে। অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তি কিছু টাকাপয়সার জন্যে তার ধর্ম বিক্রি করে দেবে- পার্থিব লাভের আশায় নিজের ধর্ম ত্যাগ করবে! আল-হাসান আল-বাসরী এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, আল্লাহর নামে বলছি, আমি এ লোকগুলোকে দেখেছি- শুধু আকৃতি আছে, হৃদয় বলতে কিছু নেই, শুধু দেহটাই আছে, কোন চেতনা নেই- দেয়ালি পোকার মত আগুনে আকৃষ্ট হয়, আবার মাছির মত সবুজে আকৃষ্ট হয়। এরা দুই দিরহামের বিনিময়ে চলে যায় আবার দুই দিরহামের জন্যে ফিরে আসে, সামান্য ছাগলের মূল্যেও বোধহয় ধর্মকে বিক্রি করে দেয়। তিনি বলছেন যে, তাদের আকৃতি বা দেহটাই আছে, কোন হৃদয় বা চেতনা নেই এবং তারা সামান্য মূল্যে তাদের ধর্ম পর্যন্ত বেচে দেয়। দুই টাকায় ধর্ম ছেড়ে দেবে আবার দুই টাকার বিনিময়েই ফিরে আসবে। ভাবুন তো, আল-হাসান আল-বাসরী এটা বলছেন তাবিঈনের যুগে। আমি চিন্তা করি, আজ বেঁচে থাকলে তিনি কী বলতেন! আরেকটা হাদীস আছে যেখানে একটু অন্য রকম বলা আছে। ইমাম আহমাদ এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। এর শুরুটা আগের হাদীসের মতই, শুধু শেষে গিয়ে বলা হয়েছে, যে বসে থাকবে সে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির চেয়ে ভাল, যে দাঁড়িয়ে থাকবে, সে হেঁটে যাওয়া ব্যক্তির চেয়ে ভাল, যে হাঁটবে সে দৌড়নো ব্যক্তির চেয়ে ভাল। কাজেই দরকার হলে তোমার হাড়-হাড্ডি ভেঙে ঘরে বসে থাক। যদি কেউ তোমার ঘরে ঢুকতে চায়, তবে আদমের (আ) দুই ছেলের মাঝে যে ভাল তার মত হও। এর মানে কী বলুন তো? এর মানে আসলে এই যে, ঐ সময়ে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এমন এক সময় সামনে আসবে যখন সত্য-মিথ্যা সবকিছু গুলিয়ে যাবে, আর আলাদা করতে পারবেন না। রাসূলুল্লাহ (স) বলছেন যে, তখন ফিতনায় যত কম জড়ানো যায় ততই ভাল, পারলে ঘরে বসে থাক। এ হাদীসে বলা হচ্ছে, বসে থাকা দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে ভাল, ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে আপনি বসে আছেন তার মানে যে দাঁড়িয়ে আছে তার চেয়ে আপনি ফিতনায় কম জড়িয়েছেন। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা হাঁটার চেয়ে ভাল আর হাঁটা দৌড়ানর চেয়ে ভাল অর্থাৎ যত কম জড়ানো যায়। তারপর বলা হচ্ছে, আদমের (আ) ছেলেদের মাঝে যে ভাল তার মত হও। এর মানে কী? এর মানে হচ্ছে হাবিলের মত। হাবিল যখন কাবিলের হাতে খুন হয় তখন সে বলেছিল যে, তুমি আমায় মেরে ফেলার জন্যে হাত বাড়ালেও আমি তোমার সাথে লড়ব না। তবে এ হাদীসে ফিতনা থেকে দূরে থাকতে বলা হলেও সেটা ভবিষ্যতের কোন এক সময়ের জন্যে নির্দিষ্ট। আপনি এখন নিষ্ক্রিয় ঘরে বসে থাকবেন আর বলবেন যে হাদীস অনুসরণ করছেন সেটা হবে না। এখানে এমন সময়ের কথা বলা হচ্ছে যখন সবকিছু থাকবে অস্পষ্ট- সত্য-মিথ্যা আলাদা করা যাবে না। ফিতানের কথা বলতে গেলে, কিছু ফিতান ইতিমধ্যে ঘটে গেছে আবার কিছু এখনো ঘটেনি। রাসূলুল্লাহ (স) একবার পূর্ব দিকে ইশারা করে বললেন, ফিতান এদিক থেকে আসবে। তিনি তখন ছিলেন মদিনায়। কাজেই মদিনার পূর্ব দিককে তিনি ফিতানের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এরপর তিনি বলেছেন, এদিকেই শয়তানের বাড়ি। আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাই বেশ কিছু বড় বড় ফিতনা এসেছে মদিনার পূর্ব দিক থেকে। তবে মদিনার পূর্ব দিক ফিতানের একটি প্রধান উৎসস্থল মাত্র, তার মানে এই নয় যে সব ফিতান ওখান থেকেই আসতে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (স) এও বলেছেন যে, তোমাদের সাথে রোমানদের যুদ্ধ হবে এবং যুদ্ধ হবে বিশ্বের অন্যান্য এলাকারও। তবে সবচেয়ে বড় বড় কিছু ফিতানের শুরু মদিনার পূর্ব দিকে, যেগুলো উম্মাহকে সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় ফেলেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক রকম ফিরকার উৎপত্তি এই পূর্ব দিকে। এছাড়া এটা হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতার মূল উৎসস্থল। আরও বলা যায় মঙ্গোলীয়দের কথা- তাতাররা যে কী ফিতনার জন্ম দিয়েছিল তা তো সবারই জানা। রাসূলুল্লাহ (স) এও বলেছেন যে, আদ-দাজ্জাল এবং ইয়াজুজ-মাজুজ আসবে পূর্ব দিক থেকে।
যেসব ফিতনা ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছেঃ
১। আততায়ীর হাতে উসমান (রা) এর খুন হওয়া ছিল উম্মাহর জীবনে সর্বপ্রথম ফিতনাহ এবং এই ফিতনাই অন্য সবকয়টা ফিতনার দরজা খুলে দিয়েছিল। আল বুখারিতে উমর (রাঃ) এবং হুজাইফা (রাঃ) এর একটি সংলাপ/কথোপকথন বর্ণিত আছে। ঘটনাটা অনেকটা এমন যে, উমর (রাঃ) একটা মিটিং এ ছিলেন, সেখানে তিনি সকলের উদ্দেশ্যে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “কে ফিতনার হাদীসটি বর্ণণা করতে পারবে?”। হুজাইফা (রাঃ) বললেন, “আমি পারব”, এই বলে তিনি হাদীসটি বর্ণণা করলেন। উমর (রাঃ) আসলে সেই হাদিসটি শুনতে চাননি, তাই তিনি এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার করার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, “আমি তোমাদেরকে কাছে সেই ফিতনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি যেটা হবে সাগরের ঢেউয়ের মত প্রবল ফিতনা। হুজাইফা এবার জবাব দিলেন, “দুশ্চিন্তার কিছু নেই, কারণ সেই ফিতনা আর আমাদের মাঝে একটা দরজা আছে”। এবারে উমর জিজ্ঞেস করলেন, “দরজাটা কি খোলা নাকি বন্ধ”? হুজাইফা বললেন, “বন্ধ আছে”। উমর বললেন, “যদি দরজাটা একবার ভেঙ্গে যায়, তাহলে এটা আর কখনই বন্ধ করা যাবে না”। তো, পরবর্তীতে হুজাইফা যখন এই হাদিসটি কিছু তাবিয়্যিনদের কাছে যখন বর্ণণা করছিলেন, তখন তারা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “উমর কি জানতেন এই দরজাটা বলতে আসলে কাকে বোঝানো হয়েছে?”, হুজাইফা বললেন, “হুম, তিনি জানতেন, কারণ আমি তাকে বলছিলাম দরজায় আসলে কে ছিল”। এটা বলে হুজাইফা চলে গেলেন। তখন তারা কাউকে পাঠিয়ে জানতে চাইল কে ছিল এই দরজা। হুজাইফা উত্তর দিলেন, “উমর ছিলেন সেই দরজা”। উমর (রাঃ) ছিলেন উম্মাহ এবং ফিতনার মাঝের সেই দরজা। উমর (রাঃ) এর সময় আমরা দেখি, তখন শান্তি ছিল, নিরাপত্তা ছিল, স্থিতি ছিল। উমরের মৃত্যুর পরই নানা রকম ঝামেলা শুরু হয়।, কিন্তু যতদিন তিনি ছিলেন ততদিন মুসলিম উম্মাহ নিরাপদ ছিল।
তো আমরা যা বলছিলাম, উমরের মৃত্যুর পরপরই সমস্যার শুরু। এরপর খলিফা হলে উসমান বিন আফফান। উসমান বিন আফফান ও আততায়ীর হাতে খুন হয়েছিলেন। এই দুইজনই গুপ্তহত্যার শিকার, তবে পার্থক্য হচ্ছে, উমর (রাঃ) কে হত্যা করেছিল একটা কাফির,কিন্তু উসমানকে যারা হত্যা করেছিল তারা ছিল মুসলিম নামধারী লোক, তাই এই মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে উম্মাহর মধ্যকার বিভক্তির দরজা খুলে যায়। কারণ, উমরকে যে হত্যা করেছিল সে ছিল ইসলামের পরিষ্কার শত্রু, কিন্তু উসমানের ক্ষেত্রে এটা মুসলিমদের নিজেদের মধ্যকার সমস্যা। উসমানের খিলাফতের সময় কিছু সমস্যা হয়েছিল, কিছু মুসলিম এসে তার বাড়ি ঘেরাও করল, এবং তার পদত্যাগের দাবি জানাল। তাকে বলল, খিলাফতের দায়িত্ব থেকে নেমে যেতে।
উসমান তখন স্মরণ করলেন রাসূলূল্লাহ(সাঃ) তাকে আগেই কি বলে গিয়েছিলেন এই পরিস্থিতির ব্যাপারে। রাসূলূল্লাহ (সাঃ) উসমানকে বলেছিলেন, “আল্লাহ তোমাকে একটা চাদর দেবেন, যদি মানুষ তোমাকে সেই চাদর খুলে ফেলতে বলে, তাহলে সেটা করবে না।” উসমানকে যখন এটা রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, তিনি এটা বুঝতে পারেননি, তখন তার কোন আইডিয়া ছিল না যে, এই কথা বলে রাসূল (সাঃ) আসলে কি বোঝাচ্ছেন। পরে তিনি বুঝলেন, রাসূল (সাঃ) ইঙ্গিত করেছিলেন এই ফিতনার দিকে, যখন কিছু লোক খলিফার পদ থেকে তার পদত্যাগ দাবি করল। এখানে চাদর বলতে উসমানের কাধেঁ অর্পিত খিলাফতের গুরু দায়িত্বের দিকে রাসূল (সাঃ) ইঙ্গিত করেছেন। যেহেতু রাসূল (সাঃ) তাকে বলেছিলেন, লোকেদের কথামত চাদর খুলে না দিতে, তাই তিনি সেসব লোকদের অন্যায্য দাবি মেনে নিতে অস্বীকৃত জানালেন।
কিন্তু উসমান (রাঃ) তাদের সাথে যুদ্ধ করতেও অস্বীকৃতি জানালেন। পরিস্থিতিটা তখন খুব ঘোলাটে ছিল। আলী (রাঃ) এবং তার ছেলেরা উসমানের নিরাপত্তায় ছিলেন। তিনি উসমানকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আমাকে আদেশ দিন আমরা এই দুর্বৃত্তগুলোর সাথে যুদ্ধ করি। উসমান ইবন আফফান বললেন, “আমি চাই না আমার জন্য কারো শরীর থেকে এক ফোটাঁ রক্ত ঝরুক, আমি চাই না আমাকে বাচাঁবার জন্য কোন খুনাখুনি হোক”। আলীকে তিনি তার পক্ষে যুদ্ধ করতে অনুমতি দিলেন না। আলী তার দুই ছেলে হাসান এবং হোসাইনকে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু উসমান কাউকেই তার পক্ষে যুদ্ধ করতে দিতে চাইলেন না। তো, এরপর সেই লোকগুলো, তারা সংখ্যায় ছিল হাজারের উপর। তারা জড়ো হল, উসমানের বাড়ি ঘেরাও করল, এবং তারা তাকে হত্যা করল এবং ফিতনার জন্ম দিল। আর রাসূলূল্লাহ (সাঃ) এটা বলেই গিয়েছিলেন, উসমান শহীদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করবেন। এটা বলেছিলেন তখন, যখন তিনি একবার আবু বকর, উমর এবং উসমান তিন জনের সাথে উহুদ পাহাড়ের উপর অবস্থান করছিলেন। ভূমিকম্পে উহুদ পাহাড় কেঁপে উঠেছিল, রাসূলূল্লাহ (সাঃ) বললেন, “পাহাড় তুমি থেমে যাও, তোমার উপর আছে একজন নবী, একজন সিদিক্ব এবং আল্লাহর রাস্তায় দুই শহীদ”। এই দুই শহীদ হচ্ছেন উমর এবং উসমান।
২। উম্মাহর জীবনের এর পরে যে ফিতনাটি হল তা হচ্ছে আল-জামালের যুদ্ধ। উসমান খুন হবার পর কিছু মুসলিম আলী ইবনে আবি তালিবের কাছে আসলো এবং তারা বলল, “আমরা আপনার খলিফা হবার জন্য আপনার হাতে বায়াত করতে চাই”। আলী বললেন, “না, তোমরা আমাকে এখন বায়াত দিও না। মুসলিমরা মিলে শূরাহ কাউন্সিল গঠন করুক, তারপর তারা কে খলিফা হবে সে ব্যাপারটা ঠিক করবে। তারা বলল, “দেখেন উসমানের হত্যার পর আমরা একটা বড় ফিতনার মধ্যে আছি, উসমানের হত্যাকারীরা চারপাশে ছড়িয়ে আছে, সমস্যা আরো বড় আকার ধারণ করতে পারে, মুসলিম উম্মাহ মিলে শুরা গঠন করে খলিফা নির্ধারণ করতে করতে অনেক সময় লেগে যাবে। সুতরাং, আপনারই এখন খলিফা হওয়া উচিত”। তারা আলীকে চাপ দিল, কিন্তু তিনি তাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলেন এবং বললেন আগে শুরাহ গঠন করা হোক। তারা আলীকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকল এবং তারা বলল, আমরা এখন নেতৃত্ব সংকটে ভুগছি, আমাদের একজন নেতা দরকার যিনি মুসলিমদেরকে এই সংকটময় মূহূর্তে একতাবদ্ধ করতে পারবেন। শেষ পর্যন্ত আলী রাজি হলেন। তারা আলী (রাঃ) এর হাতে বায়াত করল, জুবায়ের এবং তালহা (রাঃ) ও আলীর হাতে বায়াত করলেন।
তো যেটা সমস্যা হয়েছিল সেটা হচ্ছে উসমানের হত্যাকারীরা আলী (রাঃ) এর সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। আর তারা সংখ্যায় ছিল হাজার হাজার। তালহা, জুবায়ের এবং আয়েশা, এরা উসমানের হত্যাকারীর বিচার দাবি করলেন। তারা এই বিচারকাজের জন্য আলী (রাঃ) এর কাছে গিয়ে দাবি জানালেন যে, আমাদের অপরাধীকে সনাক্ত করতে একটা কোর্ট বসানো দরকার। কিন্তু আলী (রাঃ) এই দাবি মানতে অস্বীকৃতি দিলেন, তিনি বললেন, এই বিচারের দাবিদার হচ্ছে উসমানের নিকটাত্মীয়রা, তারা এসে এই হত্যার বিচারের জন্য দাবি জানাবে। কারণ, ইসলামিক শরীয়াহ মতে, যদি কেউ মারা যায় তাহলে কেবল তার নিকটাত্মীয়রাই এই হত্যার প্রতিশোধের দাবি তুলতে পারে, অন্য কেউ নয়। আল-আওলিয়া বা মৃত ব্যাক্তির নিকটাত্মীয়দের দাবিই এখানে মূখ্য। কাউকে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হয় তাহলে হত্যাকারীর ব্যাপারে দুটো সুযোগ থাকে, হয় হত্যাকারীকে খুন করা হবে, অথবা তার কাছ থেকে রক্তমূল্য গ্রহণ করা হবে, কোনটি নেয়া হবে এই সিদ্ধান্ত দেবে মৃত ব্যাক্তির নিকটাত্মীয়রা।
আলী ইবনে আবি তালিব তাই বললেন, “আমি উসমান এর নিকটাত্মীয় ব্যাক্তিদের এসে বিচারের দাবির জন্য অপেক্ষা করব”। জুবায়ের, তালহা এবং আইশা, আলীর সাথে একমত হলেন, তখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু এক রাতে উসমান ইবনে আফফান এর হত্যাকারীরা যারা ছিল আলীর সেনাবাহিনীতে, তারা আক্রমণ করল তালহা, জুবায়ের এবং আইশার সেনাবাহিনীকে। এ আক্রমণের জবাবে তারাও বিশাল সেনাবাহিনী পাঠালেন, তবে সেটা যুদ্ধের খাতিরে নয়, বরং ন্যায়ের খাতিরে। যেহেতু এই আক্রমণ তারা রাতে করেছিল, তাই তালহা, জুবায়ের বা আইশা কেউই বুঝতে পারেননি, এটা আলী (রাঃ) এর কাজ নয়, বরং এটা উসমানের হত্যাকারীদের ফিতনা সৃষ্টির অপচেষ্টা। তাই তারাও প্রতিরোধের জন্য যুদ্ধ করলেন তবে যুদ্ধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। শেষ পর্যন্ত আলী তাদেরকে বোঝাতে সমর্থ হলেন যে, এই অতর্কিত আক্রমণ তিনি করেন নি, বরং তার মতটাই সঠিক।
এমন একটা ভুল বোঝাবুঝি যে হবে সেটা আলীকে রাসূল (সাঃ) আগেই বলে গিয়েছেন। ইমাম আহমদ বর্ণণা করেন, রাসূলূল্লাহ (সাঃ) একবার আলীকে বলেন, “তোমার আর আইশার মধ্যে কিছু একটা সমস্যা হবে”। আলী জিজ্ঞেস করলেন, “আমার আর আইশার মধ্যে?”, রাসূল (সাঃ) উত্তর দিলেন, “হ্যা”। আলী তখন বললেন, “আমি নিশ্চয়ই সবচেয়ে দুর্ভাগাদের একজন, আমার সাথে উম্মুল মু’মিনীন আইশার ভুল বোঝাবুঝি হবে, নিশ্চয়ই আমি খুবই দুর্ভাগা”। রাসূলূল্লাহ সাঃ বললেন, “না, যখন এমন হবে, তখন তুমি আইশাকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনবে। পরবর্তীতে এমনটাই হয়েছিল, আলী আইশার কাছে তার সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে তাকে নিরাপদ স্থানে ফিরিয়ে আনেন। আর এর মাধ্যমে রাসূল (সাঃ) এর একটি ভবিষ্যৎবাণী সত্য প্রমাণিত হয়।
৩। আল জামালের যুদ্ধের অবসানের পর মুসলিম উম্মাহর জীবনে পরবর্তী যে ফিতনা নেমে আসে তা হল সিফফীনের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ছিল একটা বড় ফিতনা এবং এই ফিতনা কথা রাসূল (সাঃ) ভবিষৎবাণী করে গিয়েছিলেন, যেটা আছে সহীহ বুখারী এবং মুসলিমে। রাসূলূল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, মুসলিমদের দুটি বড় বড় দল যুদ্ধে লিপ্ত হবে, দুটো দলই একই উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করবে। এখানেই বৈপরীত্য ! সাধারণত এমন হয় যে দুটো দল তাদের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের জন্য যুদ্ধ করছে, কিন্তু এখানে দুটো দলের স্বার্থ এক ও অভিন্ন, তবুও তারা যুদ্ধ করছে!
আগেই বলা হয়েছে, উসমানের হত্যাকারীরা ছিল আলীর সেনাবাহিনীর লোক এবং তারা সংখ্যায় একজন দুইজন নয়, অনেকজন। আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে মু’আবিয়া (রাঃ) ছিলেন উসমান (রাঃ) এর ওয়ালী বা অভিভাবক। তাই একমাত্র তারই অধিকার ছিল উসমান হত্যার বিচারের দাবি জানানোর। তিনি আলী(রাঃ) কে বললেন, “যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে তাদেরকে আমার হাতে তুলে দাও”। আলী বললেন, “আমি সেটা করব, কিন্তু তার আগে আমার কর্তৃত্ব স্থাপন করা অধিকতর জরুরি। তারা সংখ্যায় অনেক। আমি এভাবে তাদেরকে তোমার হাতে তুলে দেয়া সম্ভব নয়। এমনটা করলে একটা গৃহযুদ্ধ বেধেঁ যেতে পারে। তাই আগে তুমি আমাকে খলিফা হিসেবে বায়াত কর। আমি যখন খলিফা হব তখন আমার হাতে কর্তৃত্ব আসবে এরপর আমি আমি তাদের ব্যবস্থা নেব। কিন্তু এখন এটা করা সম্ভব নয়, কারণ আমার হাতে এখন ক্ষমতা নেই, যেহেতু তুমি এখনও আমাকে বায়াত দাও নি।” মু’আবিয়া বললেন, “না, আমি তোমার কাছে বায়াত করব না যতক্ষণ না তুমি আমার হাতে সেই হত্যাকারীদের হস্তান্তর করবে”।
তো, মু’আবিয়া চাচ্ছিলেন উসমানের রক্তের বদলা নেয়া হোক, এবং আলী ও তাই করতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল এ নিয়ে যে, মু’আবিয়া চেয়েছিলেন আগে হত্যাকারীদের বিচার হোক, তারপর খলিফা নির্বাচন, আর আলী চাচ্ছিলেন উল্টোটা। এইখানে আলীর অবস্থান ছিল সঠিক। মু’আবিয়া একটি মত দিয়েছিলেন বা ইজতিহাদ করেছেন কিন্তু সেটা ভুল ছিল, কিন্তু এই ভুলের মানে এই নয় যে তিনি রাসূল (সাঃ) এর সাহাবী নন। তিনি ছিলেন সেই সাহাবীদের একজন যিনি কুর’আন লিখে সংরক্ষণ করতেন। কিন্তু আমরা দেখি এই ব্যাপারটিতে সঠিক অবস্থান ছিল আলীর। আর এটা ছাড়াও, রাসূল(সাঃ) আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে বলে দিয়েছিলেন যে, এই যুদ্ধে তুমি মারা যাবে যারা সীমা লঙ্ঘনকারী দলের হাতে। এবং তিনি মু’আবিয়ার সেনাবাহিনীর হাতেই মারা পড়েন। কিন্তু আমরা মু’আবিয়াকে এই কারণে কাফির বলতে পারি না, কারণ রাসূল (সাঃ) বলেছেন, মুসলিমদের দুটো দল যুদ্ধে লিপ্ত হবে। তাই পরস্পর যুদ্ধ করলেও উভয় দলই ছিল মুসলিম, এবং এই হাদীসটি আছে সহীহ বুখারি এবং মুসলিমে।
৪। সিফফীনের যুদ্ধের পর আসে আল-খাওয়ারিজদের ফিতনা। আলী এবং মু’আবিয়ার যুদ্ধে আলী যুদ্ধে এগিয়েছিলেন এবং মু’আবিয়া তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন। মু’আবিয়ার সেনাবাহিনী তাদের তরবারির উপর মুসহাফ অর্থাৎ, কুর’আনের কপি রেখে আত্মসমর্পণ করেন। আলী যখন এ দৃশ্য দেখলেন তখন তিনি যুদ্ধ করা বন্ধ করলেন। কিন্তু যুদ্ধবাজ কিছু লোক ছিল যারা এই যুদ্ধ থেকে উপকৃত হচ্ছিল, তারা চাইছিল না এ যুদ্ধের অবসান হোক। তারা চাইল আলীর সাথে জুবায়ের এবং তালহা এবং জুবায়ের যেমন অকারণে ভুল বোঝাবুঝির কারণে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন তেমনি আলীর সাথে মু’আবিয়ার যুদ্ধও চলতে থাকুক। এরা ছিল কিছু গোত্রের প্রধান যারা এই রক্তপাত থেকে নিজেরা সুবিধাভোগ করছিল এবং এরা ছিল তারা যারা একের পর এক সমস্যা সৃষ্টি করছিল। তারা পুরো ব্যাপারটিকে অতিরঞ্জিত করছিল এবং তারা উভয়পক্ষেই বিদ্যমান ছিল। তারা বলল, “কিভাবে আলী যুদ্ধ থেকে বিরত হতে পারলেন ?” “মু’আবিয়ার সাথে যুদ্ধ করা হচ্ছে আল্লাহর হুকুম, আর আলী এখানে নিজের মতকে আল্লাহর আইনের উপরে প্রাধান্য দিচ্ছেন”। প্রথমে তারা বলল আলী ভুল করছেন এবং পরবর্তীতে তারা বলল কুফরে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করল ! এর আগেই তারা মু’আবিয়া এবং আমর ইবনে আল আসকে কুফরে লিপ্ত হওয়ার জন্য দায়ী করেছিল। তারা এরপর আলীর সেনাবাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং এজন্যই তাদের বলা হয় খাওয়ারিজ। খাওয়ারিজ হচ্ছে তারা যারা ইসলামিক জামা’আ থেকে আলাদা হয়ে যায়, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আলী (রাঃ) এদেরকে ফিরিয়ে আনতে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে পাঠালেন। ইবনে আব্বাসের সাথে সংলাপের পর তিনি তাদের মধ্য থেকে চার হাজার জনকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেন। বাকিরা রয়ে গেল তাদের পূর্ব অবস্থানে, এভাবেই খাওয়ারিজ ফিরকার জন্ম। তাদের বংশানুক্রম তাদের উৎসের আলামত আমরা পাই রাসূলূল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে। তাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দ্বীনের ব্যাপারে এরা চরমপন্থা অনুসরণ করে।
সহীহ বুখারিতে তাদের ব্যাপারে একটা হাদীস বর্ণিত আছে, আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) বর্ণণা করেন, রাসূলূল্লাহ (সাঃ) যুদ্ধে প্রাপ্ত গণিমতের মাল যখন বণ্টন করছিলেন তখন বনু তামীম গোত্রের জুলখা ইসরা নামে এক ব্যক্তি খুব বীরদর্পে এসে ঔদ্ধত্যের সাথে রাসূল (সাঃ) কে বলল, “আপনি ন্যায়বান হোন!”। লক্ষ করুন তার চরম অমার্জিত আচরণের দিকে ! সে আল্লাহর রাসূল(সাঃ) কে আদেশ করছে ন্যায়বিচার করার জন্য ! আল্লাহর রাসূল (সাঃ) উত্তরে বললেন, “দূর্ভোগ তোমার জন্য! আমি যদি ন্যায়বিচার না করি তবে কে করবে ? আমি যদি ন্যায়বিচার না করি তাহলে আমি নিশ্চিতভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাব। তুমি আমাকে ন্যায়বিচার করতে বলছ !”। উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বললেন, এই লোকের মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হোক। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, “তাকে ছেড়ে দাও, তার অনেক অনুসারী হবে, তুমি দেখবে তারা এমন একাগ্রতার সাথে সালাত আদায় করবে যে তোমাদের সালাত তাদের সালাতের তুলনায় কিছুই হবে না। তাদের সাওমের তুলনায় তোমাদের সাওমের কোন তুলনাই হবে না। অর্থাৎ, এই লোকগুলো ইবাদাতের একনিষ্ঠতার কারণে বাইরে থেকে দেখলে তাদের এতটাই ধর্মপরায়ণ এবং তাক্বওয়াসম্পন্ন মনে হবে যে তাদের তুলনায় সাহাবাদের আমল কিছুই না। রাসূল (সাঃ) বলছেন, তারা কুর’আন পড়বে কিন্তু এই পড়া তাদের গলার ভেতরে প্রবেশ করবে না, অর্থাৎ এই কুর’আন তাদের জীবনে প্রয়োগ হবে না। রাসূল (সাঃ) আরো বলছেন, তারা এমন ভাবে দ্বীন থেকে বেড়িয়ে যাবে যেমন করে তীর লক্ষ্যবস্তু ভেদ করে বেড়িয়ে যায়। অর্থাৎ তারা দ্বীন থেকে এত সহজে এবং দ্রুত বের হয়ে যাবে যে কেউ তেমন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তা হয়ে যাবে। তারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে পড়বে তাদের চরমপন্থী মনোভাবের কারণে।
বাহির থেকে দেখলে তারা খুবই ধার্মিক, কিন্তু তাদের মনের ভেতরটা অত্যন্ত কঠোর, পাথরের মতো শক্ত। রাসূলূল্লাহ (সাঃ) উমর ইবনে খাত্তাবকে বলেছিলেন আল খুয়াইসরা এর মতো মানুষদের থেকে খারেজিদের জন্ম। আপনারা দেখবেন তার আচরণের মধ্যে প্রবল ঔদ্ধত্য আর অহংকার আছে, তার আচরণ খুবই রুঢ়। এরাই হল তারা যারা উসমানকে হত্যা করেছিল, যদিও তখন তাদেরকে খারেজি হিসেবে ডাকা হত না। এরাই তারা যারা আলী (রাঃ) এর জুবায়ের এবং তালহার সাথে যুদ্ধ বাধিয়েছিল। আর এরাই তারা যারা আলী আর মু’আবিয়ার মধ্যে শান্তি স্থাপিত হলেও যুদ্ধ চালিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে। যখনই তারা রক্তপাত দেখেছে তখনই তারা সেখানে যোগ দিয়েছে, যখন তারা মুসলিমদের মধ্যে শান্তি দেখেছে সেটা তাদের সহ্য হয় নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কিভাবে বুঝব রাসূল (সাঃ) যে লোকগুলোর কথা বলেছিলেন যে তারা দ্বীন থেকে বের হয়ে যাবে, সে হাদীসটি আলী(রাঃ) এর সেনা থেকে বের হয়ে যাওয়া লোকগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ? রাসূলূল্লাহ (সাঃ) এর হাদীসে এই ব্যাপারে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আল বুখারিতে বর্ণিত আছে, আবু সাঈদ আল খুদরী বলেন যে, রাসূলূল্লাহ (সাঃ) খাওয়ারিজদের মধ্যের এক ব্যাক্তির বর্ণণা করেন,যে, সে হবে কালোবর্ণের, তার একটা হাত থাকবে তা হবে মহিলাদের স্তনের মত, এর মানে হচ্ছে তার হাতে যেন কোন হাড় থাকবে না, তাই সেটাকে মেয়েদের স্তনের মত দেখাবে। আবু সাঈদ বলেন, আমি আলীর পক্ষে খাওয়ারিজদের বিপক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আলী খারেজিদের কাছে গিয়ে তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে তারা ভুল করছে, কিন্তু তারা তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাল। তারা বলল, “আলী, তুমি আল্লাহর আদেশের অবাধ্য হয়েছে”। আলী কথা না বাড়িয়ে বললেন, আমি তোমাদেরকে তিনটা জিনিষ দেব। প্রথমত, আমি তোমাদেরকে মসজিদে সালাহ আদায় করতে বাধা দেব না, তোমরা আমাদের সাথেই সালাত আদায় করতে পার, দ্বিতীয়ত, আমি তোমাদেরকে যুদ্ধে লব্ধ মালামালের একটা অংশ দিয়ে দেব, এবং তৃতীয়ত, তোমরা যদি মুসলিমদেরকে ছেড়ে দাও, তাহলে আমিও তোমাদের ছেড়ে দেব, তোমরা নিরাপদ থাকবে। আলীর ক্ষমাশীলতার এমন নিদর্শনের পরেও খারেজিরা তাদের কথা রাখে নি। তারা মুসলিমদের ছেড়ে দেয় নি। আল্লাহর রাসূল এর সাহাবী খাব্বাব বিন আরাত, এর পুত্র, তার স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে যখন ইরাকে যাচ্ছিলেন তখন পথিমধ্যে খারেজিরা তার পথরোধ করে, তারা জায়গায় জায়গায় চেকপয়েন্ট রেখেছিল, তারা তাকে বলল, “তুমি কে?”। তিনি নিজের পরিচয় দেয়ার পর তারা বলল, তুমি কার পক্ষে যুদ্ধ করছ? তুমি কি আমাদের পক্ষে নাকি বিপক্ষে যুদ্ধ করছ ? তিনি বললেন, “আমি তোমাদের বিপক্ষে নই, তবে আমি সত্যের পক্ষে”। একথা বলার পর তারা তাকে হত্যা করল, তার স্ত্রী ছিলেন গর্ভবতী, তারা তার পেট কেটে ভ্রূণ বের করে ফেলে তাকেও হত্যা করল।
এরপরেই আলী(রাঃ) তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। কারণ তাদের সাথে এই বোঝাপড়া হয়েছিল যে, তারা মুসলিমদেরকে তাদের মত ছেড়ে দেবে তাহলে তাদেরকেও কিছু করা হবে না। কিন্তু আল্লাহর রাসূল(সাঃ) এর সাহাবীর পুত্র এবং তার স্ত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর আলী ইবনে আবি তালিব তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। আন নাহরুওয়ান এর যুদ্ধে আলী তাদেরকে পরাজিত করেন এবং তাদের অনেককে হত্যা করেন। আবু সাঈদ আল খুদরী বলেন, আমি ছিলাম আলীর পক্ষে। তিনি আমাদেরকে আদেশ দেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যে লোকটির বর্ণণা দিয়েছেন তাকে খুঁজে বের কর। আমি নিজের চোখে একটা লোককে দেখলাম, যে রাসূল(সাঃ) এর বর্ণণার সাথে হুবহু মিলে যায়। এভাবেই আমরা বুঝতে পারি খারেজি বলতে তিনি কাদেরকে বুঝিয়েছেন। আলী ইবনে আবি তালিব বলেন যারা এই লোকগুলোকে হত্যা করবে তাদের জন্য অনেক পুরষ্কার আছে। রাসূল(সাঃ) বলেন, আমি যদি সে সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকি থাকি তাহলে আমি তাদেরকে সেভাবে হত্যা করব যেভাবে আদ জাতিকে হত্যা করা হয়েছিল। অর্থাৎ, তাদেরকে সবাইকে হত্যা করে একদম শেষ করে ফেলতে হবে, যেমনটা করা হয়েছিল আদ জাতির ক্ষেত্রে। কেন? কারণ এই ধরণের মানসিকতার লোকদের সাথে একমাত্র এভাবেই সমঝোতা হওয়া সম্ভব, অন্য কোন উপায়ে নয়।
এই ধরণের চরমপন্থাসম্পন্ন লোকদের সাথে যুক্তি দিয়ে বোঝাপড়া সম্ভব নয়। তারা রক্ত চায়, তাদের সাথে কি করে বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করা সম্ভব ? রাসূলূল্লাহ (সাঃ) তাই বলেছেন যারা এদের হত্যা করবে তাদের জন্য অনেক পুরষ্কার আছে, কারণ তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হলেও তারা কখনই মুসলিমদেরকে ছেড়ে দেয় না। তাই তাদেরকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায়ে তাদের থামানো সম্ভব নয়। আল-খাওয়ারিজ ছিল মুসলিমদের জীবনে সবচেয়ে বড় ফিতনার একটি।
সুবহানআল্লাহ, এখানে আমরা একটা অসঙ্গতিপূর্ণ ব্যাপার দেখতে পাই তাদের মধ্যে, মুহাদ্দিসরা বলেন যে, আমরা কখনও কোন খারেজিকে দেখি নি যে রাসূল (সাঃ) এর সম্পর্কে মিথ্যা বলেছে। তারা কখনই কোন হাদীস জাল করে নি, অথচ আহলে সুন্নাহর অনেকেই হাদীস জাল করেছে ! কিন্তু খারেজিরা কখনও মিথ্যা কথা বলে নি। তাদের মধ্যে আন্তরিকতা, ইখলাস এবং সত্যবাদিতা ছিল, কিন্তু তারা ছিল ভারি একগুঁয়ে, এবং তারা খুন-খারাপিকে কিছু মনেই করত না। আর, খাওয়ারিজদের এই ফিতনা যে শুধু রাসূল(সাঃ) এর যুগে ছিল তা নয়। রাসূল (সাঃ) ভবিষ্যৎবাণী করেছেন তাদের ফিতনা যুগে যুগে আসবে। তাদের ফিতনা কোন একটা প্রজন্মে আসবে এবং সেই প্রজন্মেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এক যুগের ফিতনা বংশানুক্রমে পরের যুগ পর্যন্ত স্থায়ী হবে না। পরবর্তী প্রজন্মে আবার নতুন করে ফিতনা শুরু হবে এবং দাজ্জালের আগমন পর্যন্ত এরুপ হতে থাকবে।
এর কারণ হল, তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি করে শেষ হয়ে যাবে, নিজেরাই নিজেদের মেরে ফেলবে অথবা বাইরের কেউ এসে তাদের মূলোৎপাটন করবে, কিন্তু তাদের যে চরমপন্থা মানসিকতা, তা ভিন্ন স্থান-কাল-পাত্রের মানুষের মধ্যে জন্ম নেবে এবং নতুনভাবে এই ফিতনা আরম্ভ হবে। আর তারা তখন আবার যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবে, রক্তপাত ঘটাবে, যতক্ষণ না তাদের ধংস করা হয়, এরপর তারা আবার অন্যকোন স্থানে তাদের জন্ম হবে। তারা নিজেদের মধ্যে কোনরুপ মতানৈক্যে পৌছতে পারে না, তাই তাদের পরিণতি হয় যুদ্ধ-বিগ্রহে গিয়ে থামে।
তাদের মানসিকতাটা এমনই। তারা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে এবং যুদ্ধ করে। ইবনে মাজাহতে বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ ইবনে উমার বলেন, আমি শুনেছি রাসূল (সাঃ) বলছেন, তাদের এক প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটবে এবং তারা সম্পূর্ণরুপে বিলুপ্ত হবে, তারপর আরেকটি নতুন প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটবে এবং তাদের ও বিলোপ হবে। আবদুল্লাহ ইবনে উমর বলেন, রাসুলূল্লাহ (সাঃ) এই কথাটি প্রায় ২০ বারের বেশি পুনরাবৃত্তি করেন। সবশেষে তিনি বলেন, “যতক্ষণ না দাজ্জালের আগমন ঘটে”। অর্থাৎ, খারেজিদের প্রত্যেকটি প্রজন্ম নিজেরা মারামারি করে শেষ হয়ে যাবে, অথবা বাইরে থেকে কেউ এসে তাদের ধংস করবে। আবদুল্লাহ ইবনে উমার বলেন, এই লোকগুলো ছিল সবচেয়ে খারাপ লোক। তিনি বলেন, তারা কুর’আনের যেসব আয়াত কাফিরদের কথা বলছে সেগুলো উদ্ধৃত করে মুসলিমদের উপরে প্রয়োগ করত। তারা প্রায়শই মুসলিমদেরকে কুফরের অভিযোগে সাব্যস্ত করত এবং নিয়মিত ভিত্তিতে মুসলিমদেরকে কাফের ঘোষণা করত। এটাই তাদের চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
৫। এর পরবর্তী ফিতনা হচ্ছে, আল হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবু তালিবের মৃত্যু। রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর সামনে একবার জিবরাঈল (আঃ) কিছু লাল মাটি এনেছিলেন, এবং বলেছিলেন, তোমার নাতী হুসাইনকে হত্যা করে হবে আর এই হল সেই মাটি যে মাটিতে তাকে হত্যা করা হবে। হুসাইন ইবনে আলী নিহত হন কারবালার যুদ্ধে। তার পিতা আলীর মৃত্যুর পর তার ভাই হাসান ইবনে আবি তালিবকে বায়াত করা হয় এবং তিনি ছয়মাস পর শাসনভারের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর হুসাইনকে ইরাকের কয়েকটি গোত্র এবং আহলুল বাইতের পক্ষ থেকে বায়াত করা হয় এবং তাকে সামরিক এবং রাজনৈতিক সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। তাদের সাথে বনী উমাইয়া গোত্রের যুদ্ধ হয় কিন্তু ইরাকের গোত্রগুলো এবার তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, তাই শেষ পর্যন্ত হুসাইন ইবনে আবি তালিবের সাথে আহলুল বাইতে তার আত্মীয়-স্বজনেরা তার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান শেষ মানুষটি নিহত হবার আগ পর্যন্ত। তাদের সকলেই এ যুদ্ধে নিহত হন, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর পরিবার রক্তাক্ত হয়। মুসলিমদের ইতিহাস এটি একটি কালো অধ্যায় যে, মুসলিম উম্মাহর হাত রাসূল (সাঃ) এর পরিবারের রক্তে রঞ্জিত হয়। এই ঘটনা ঘটেছিল ইয়াজিদ ইবনে মু’আবিয়া এর সময়ে। ইয়াজিদ পরবর্তীতে আরো একবার মদীনায় এরকম হত্যাযজ্ঞ চালায়, সেটাকে বলা হয়, “মারেফাতুল হাররাহ”, সেখানে তিনি মদীনা আক্রমণ করেছিলেন এবং দিনের পর দিন রক্তপাত সংঘটিত করেছিলেন। তিনি অনেক আনসার এবং তাদের সন্তানদের হত্যা করেন। রাসূলূল্লাহ (সাঃ) বলেন, তিনি মদীনার ঘরে ঘরে দূর্যোগ আর বিপর্যয়ের বৃষ্টি পতিত হতে দেখেছেন। আর এটা হল সেই দূর্যোগবৃষ্টি যা মদীনাবাসীর উপর নেমে এসেছিল হত্যাযজ্ঞ আর রক্তপাত হয়ে, যা হয়েছিল ইয়াজিদ খিলাফতের সময়।
ক্বিয়ামাতের সাত নম্বর আলামত হচ্ছে মিথ্যা নবীর আবির্ভাব। আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ (সাঃ) বলেন, শেষ বিচারের দিনের আগমন হবে না, যতদিন না পর্যন্ত ৩০ জন মিথ্যানবীর আবির্ভাব ঘটে, এবং তাদের প্রত্যেকে দাবি করবে সে একজন নবী। আমরা যদি আজ অবধি যত লোক নিজেকে নবী দাবি করেছে তা হিসাব করি তা এই সংখ্যাটি ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু রাসূলূল্লাহ (সাঃ) এখানে সবার কথা বলছেন না। আর এই হাদীসের ব্যাখ্যাকারীরা বলছেন যে, এইখানে সেইসব মিথ্যানবীদের ব্যাপারে ইঙ্গিত করা হয়েছে যাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুসারী থাকবে, তারা বিখ্যাত হবে এবং অনেকের কাছে পরিচিতি পাবে। আমরা আজ দেখি যে যেখানে সেখানে অমুক তমুক পাগল ব্যাক্তি নিজেকে নবী দাবি করে বসে আছে, এই হাদীসটি তাদের কথা বলছে না। এটি বলছে তাদের কথা যাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক অনুসরণ করবে এবং তারা একটা ফেরকা বা দল তৈরি করবে। মুসলিমদের মাঝে দুইজন ছিল যারা রাসূলূল্লাহ (সাঃ) বেঁচে থাকতেই নিজেদের নবী হিসেবে দাবি করেছিল, এরা হচ্ছে ইয়ামামার বনু হানিফা গোত্রের মুসায়ালাম আল কাযযাব এবং ইয়েমেনের সানার আল আসওয়াদ আল আনসি।
মিথ্যা নব্যুয়তের দাবিদারদের মধ্যে এরা ছিল প্রথম, আর এদের উদ্ভব রাসূলূল্লাহ (সাঃ) এর জীবনের শেষের দিকে। মুসায়লামা আল কাযযাব ছিল বনু হানিফা গোত্রের বেদুইন, যেটা অনেক বড় একটা গোত্র ছিল, তারা আরবের ইয়ামামা অঞ্চলে বসবাস করত। সে লোকদেরকে গোত্রবাদের উপরে উত্তেজিত করত। সে বলে বেড়াত, “রাসূলূল্লাহ (সাঃ) কুরাইশ বংশের, আর আমি বনু হানিফার … তারা শহুরে এলাকায় থাকে, তারা শহরবাসী, আর আমরা গ্রামের”। তো সে এভাবে জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে বেড়াত। আপনারা দেখবেন যে, এই ধরণের মিথ্যা নবীরা সবসময় প্রতারণাপূর্ণ উপায়ে লোকদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করে। মুসায়লামা কাযযাব জানত যে, মুসলিম হলেও এখনো লোকদের মনে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদের বিষ রয়ে গেছে, তাই সে এটাকে ব্যবহার করে লোকদের মধ্যে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিত। তার এক অনুসারী ছিল, তার ডানহাত, সে খুব পরিষ্কারভাবেই বলত, কাযযাব বানু হানিফা খায়রুম মিন সাদিক্ব ক্বুরাইশ, অর্থাৎ, “বনু হানিফা গোত্রের মিথ্যাবাদী লোকটিও কুরাইশের সত্যবাদী লোক থেকে ভাল”।
অনেকেই জানত সে মিথ্যা বলছে, কারণ সে যে কুর’আনটি রচনা করেছিল তা খুবই হাস্যকর। সুবহান আল্লাহ, এটা একটা অলৌকিক ব্যাপার যে, আপনি দেখবেন খুব বুদ্ধিমান ব্যাক্তি, হতে পারে কবিতা এবং পদ্য রচনায় পারদর্শী, যখনই সে কুর’আনকে নকল করে কিছু একটা রচনা করতে চায়, তাহলে তার অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে পড়ে, সে খুব হাস্যকর কিছু রচনা করে নিয়ে আসে। আবুল আলা আল মা’আররি, সে ছিল খুব বিখ্যাত এবং সুপরিচিত এক কবি, সে ছিল অন্ধ, আল্লাহ তাকে ভাষাজ্ঞানে বাগ্মী হওয়ার গুণে গুণান্বিত করেছিলেন। লোকেরা বলত, তার মধ্যে এতটাই অহংবোধ আর ঔদ্ধত্য কাজ করেছিল যে সে একবার কুর’আনের মত কিছু একটা রচনা করে আল্লাহর কালামের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল। তাই সে কুর’আনের মত কিছু একটা লিখতে বসল কিন্তু লোকেরা দেখল সে ব্যর্থ হচ্ছে, তাই তাকে জিজ্ঞেস করা হল, “কি ব্যাপার কোথায় তোমার সে কুর’আন যার প্রতিশ্রুতি তুমি করেছিলে?” সে উত্তর দিল, ভুলে যাও আমি এটা করতে পারি নি।
মুসায়লামা আল কাযযাব যে কুর’আনটি রচনা করেছিল তা খুব হাস্যকর হওয়ার পরেও তার হাজার হাজার অনুসারী ছিল। এটা ছিল একটা ফিতনা, আর এই ফিতনার আগুন নিভেছে যখন আবু বকরের নেতৃত্বে মুসলিমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করে। সেই যুদ্ধে অনেক মুসলিম নিহত হয়, অনেক কুর’আনে হাফেয এই যুদ্ধে নিহত হন। এভাবেই কুর’আন সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের কার্যক্রম শুরু হয়। আবু বকর (রাঃ) কুর’আনের বিভিন্ন অংশ এক করতে শুরু করেন, আর এই পুরো কার্যক্রম শেষ হয় উসমান (রা) এর সময়ে। আল হাদীক্বা এর যুদ্ধে মুসায়লামা মারা যায়। রাসূলূল্লাহ (সাঃ) একটি স্বপ্নে দেখেছিলেন যে তিনি দুটো স্বর্ণের বালা পরিহিত আছেন। তিনি বলেন, আমি এটা দেখে খুব বিচলিত হয়ে পড়ি এবং আল্লাহ তা’আলা আমাকে বললেন এই দুটোকে ফু দাও ! আমি সেই সোনার বালা দুটোতে ফুক দিলাম আর সেগুলো উড়ে চলে গেল । সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা কি ? তিনি বললেন, এর মানে হচ্ছে আমার উম্মতের মধ্যে থেকে দুই মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব ঘটবে। এখানে বলা হচ্ছে মুসায়ালামা আল কাযযাব এবং আল আসওয়াদ আনসি এর কথা। মুসায়লামাকে হত্যা করা হয়েছিল। সে সাজাহ নামের এক মহিলা বিয়ে করে, সে মহিলাও নিজেকে নবী হিসেবে দাবি করে। তাদের দুইজনেরই বেশি কিছু অনুসারী ছিল, তাই তারা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির আশায় পরস্পরকে বিয়ে করে। মুসায়ালামা যখন মারা গেল, তখন সে মহিলা আবিষ্কার করল, এই নব্যুয়ত দিয়ে এখন আর কোন লাভ নেই, তা সে আবার মুসলিম হয়ে গেল।
আল আসওয়াদ ওয়াল আনসি, তাকে ইয়েমেনের ফায়রুজ নামের এক লোক তার প্রাসাদে গিয়ে তাকে গোপনে হত্যা করে, আর এভাবেই আল আসওয়াদের জীবনের সমাপ্তি ঘটে। এই তালিকায় আরো আছে তুলাইহা আল আজদি, সেও মিথ্যা নবী হবার দাবি করেছিল, তবে পরবর্তীতে সে মুসলিম হয়ে যায় এবং সে পরবর্তীতে ঠিকঠাকভাবে ইসলাম পালন করত। আল্লাহু আলম, মুসায়লামা কিংবা তুলাইহা- এদের মধ্যে একজন ছিল যাকে কুর’আনের কোন আয়াত জিজ্ঞেস করা হলে সে সেইসব আয়াত বেশি করে উদ্ধৃত করত যেসব আয়াতে খাবার দাবারের কথা বলা হয়েছে। তো লোকেরা বলত, ফেরেশতারা কি তোমার হৃদয়ে নাযিল হয় নাকি তোমার পেটে – আমরা বুঝতে পারছি না। এরপর আরো আছে, মুকতার আল উবায়েদ আস সাকাফি, সেও এদের মতই একজন। আর অধুনা সময়ে এমন একজন ব্যাক্তি হচ্ছে মির্জা গোলাম আহমদ। সে কাদিয়ানি ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। তাকে সেই ত্রিশ জনের ভেতরে একজন ধরা যেতে পারে, কারণ তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুসারী ছিল। তার আন্দোলন খুব সিরিয়াস ছিল, তারা খুব ফিতনা সৃষ্টি করে। তারা যে আক্বীদা পোষণ করে সেগুলো ইসলামী শরীয়াহ মতেই যে কেবল কুফর তা নয়, পাকিস্তানে, আলহামদুলিল্লাহ, আইনগতভাবে কাদিয়ানি ধর্মকে ইসলামের কোন রুপ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না।
সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়া আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লা আনতা আসতাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইক