পরকালের পথে যাত্রা – পর্ব ০৬ – কিয়ামতের ছোট লক্ষণ ১৯-৩৮


১৯ নং আলামত – রক্তপাতের ব্যাপক বিস্তারঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বুখারির এই হাদীসে বলেছেন, ‘একটা সময় আসবে যখন হারাজের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাবে। সাহাবারা তখন রাসূল (সা) কে জিজ্ঞেস করলেন, হারাজ অর্থ কি, (কারণ এটা আরবি শব্দ নয়। এটা হাবশীয় শব্দ।) রাসূলুল্লাহ সা বললেন, এটা আবিসিনিয়ান শব্দ। এর অর্থ হত্যাযজ্ঞ।’ 

এখন, আল্লাহু আলীম, এই শব্দটি এখনো প্রচলিত কিনা জানা নেই। এটি ইথিওপিয়ায় জন্মানো একটি ভাষা ছিলো। কোন কোন ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সা অনারব শব্দ ব্যবহার করেছেন। অথবা, তিনি এমন একটি বাচনভঙ্গি ব্যবহার করেছেন যা কোরায়েশদের থেকে ভিন্ন ছিলো। 

উদাহরণ স্বরূপ, আবু মূসা আল আশারীর আশারা গোত্রের লোকজন রাসূলুল্লাহ সা এঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য আসলো, যেটি ইয়েমেনের একটি গোত্র এবং তাদের আরবি বাচনভঙ্গি কিছুটা ভিন্নতর ছিলো, তারা আরবি ‘আল’ কে ‘আন’ উচ্চারণ করতো। তো, তারা রাসূলুল্লাহ সা কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভ্রমনরত অবস্থায় রোজা রাখার কোন ফজিলত আছে কি?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরই বাচনভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, ‘ভ্রমনরত অবস্থায় রোজা রাখার কোন ফজিলত নেই।’ এর অর্থ তোমরা ভ্রমনরত অবস্থায় রোজা না রাখলেও সমস্যা নেই।

 

তো এটা একটা উদাহরণ যেখানে আমরা দেখতে পাই, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনারব শব্দ ব্যবহার করেছেন।

 এখন, আমরা সেই আগের হাদীসে ফিরে যাই। তো, রাসূলুল্লাহ সা এখানে হারাজ শব্দ ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ হত্যা বা হত্যাযজ্ঞ। রাসুলুল্লাহ সা বলেছেন হত্যার ব্যাপক বিস্তার হবে। মানুষের জীবনের মূল্য কমে যাবে। কিন্তু এর অর্থ কি? কাদের সাথে কাদের হত্যাকাণ্ড ঘটবে? 

এর অর্থ এই নয় যে মুসলিমরা অমুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করবে, যদিও প্রথমত সাহাবারা সেটাই মনে করেছিলেন।

আহমদ থেকে বর্ণিত, যা এই বুখারির হাদীসের মতোই, রাসুলুল্লাহ সা বলেছেন, কেয়ামতের নিকটবর্তি সময়ে হারাজ হবে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হারাজ কি? রাসুলুল্লাহ সা বললেন হত্যাযজ্ঞ। সাহাবারা বললেন, তখন বর্তমান সময়ের থেকেও বেশি হত্যাযজ্ঞ হবে? রাসুলুল্লাহ সা বললেন, ব্যাপারটি এমন হবে না যে, তোমরা অবিশ্বাসীদের হত্যা করবে, এটা হবে তোমাদের নিজেদের মধ্যে হত্যাযজ্ঞ। মুসলমানরা মুসলমানদের হত্যা করবে’। 

এবং লক্ষ্য করবেন সুবহান’আল্লাহ, সাহাবাদের প্রজ্ঞা, তাদের জ্ঞানের গভীরতা এবং কত তীব্র অনুধাবন ক্ষমতা ছিল ! সাহাবারা তখন জিজ্ঞেস করলেন, আমাদের বোধশক্তি তখন কোথায় থাকবে? অর্থ, এটা কিভাবে সম্ভব! মুসলিমরা মুসলিমদের কিভাবে হত্যা করতে পারে ?  আমাদের বোধশক্তি তখন কোথায় থাকবে?

রাসুলুল্লাহ সা বললেন, তখনকার মানুষদের বোধ শক্তি তুলে নেয়া হবে, আর তখন থাকবে নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা, যারা মনে করবে যে তারা কিছু একটার অনুসরণ করছে, কিন্তু আদতে তারা কিছুরই অনুসরণ করবেনা। তারা মনে করবে তারা আল্লাহ প্রদত্ত জীবনাদর্শ অনুসরণ করছে, কিন্তু তারা বস্তুত তা করবে না।  তাদের বোধ শক্তি থাকবে অত্যন্ত ক্ষীণ, এবং তারা এভাবে একে অপরকে হত্য করবে।

 রাসুলুল্লাহ সা মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে বলেন, এমন এক সময় আসবে, যখন একজন হত্যাকারী জানবে না কেন সে হত্যা করছে, এবং নিহত ব্যক্তি জানবে না কেন তাকে হত্যা করা হচ্ছে’। 
অর্থ্যাৎ, একজন লোক বাইরে বের হয়ে গিয়ে হত্যা করবে এটা না জেনে যে কেন সে হত্যা করছে, এবং যে নিহত হবে সেও জানবে না কেন তাকে জীবন দিতে হচ্ছে। রাসুলুল্লাহ সা কে জিজ্ঞেস করা হলো, এটা কিভাবে সম্ভব? রাসুলুল্লাহ সা বললেন, সেটা হবে হারাজের সময়, খুনোখুনির সময়। সেটা হবে হত্যাযজ্ঞের সময়, এবং রাসুলুল্লাহ সা বললেন, যে হত্যা করবে এবং যে নিহত হবে, উভয়েই জাহান্নামি হবে। কেন? কারণ সবাই সবাইকে হত্যা করতে চাইবে। যদিও নিহত ব্যক্তি নিজের জীবন দিবে, কিন্তু তার নিয়্যত থাকবে অন্যকে হত্যা করার। 

সেটা এমন ফিতনার সময় হবে যে, তখন সব বিষয় অস্পষ্ট থাকবে, মানুষ মানুষের রুহকে হালকা ভাবে গ্রহণ করবে এবং যাচ্ছেতাই ভাবে রক্তপাত ছড়াবে। তখন মানুষের পক্ষে পৃথিবীতে বাস করা অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশ হবে।

 

তবে অন্যভাবে দেখলে, আমাদের আবি বুরদা এবং একজন আনসারের এই কথোপকথনের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে,আমি বুরদা বলেন,আমি উমর আল জিয়ার সময়ে একদিন বাজারে ছিলাম। আমি কিছু একটা শুনে আশ্চর্য হয়ে তালি বাজালাম। এটা ছিলো আশ্চর্য বা অবাক হওয়ার চিহ্ন। তখন একজন আনসার, যার পিতা ছিলেন রাসুলুল্লাহ সা এর একজন সাহাবী, জিজ্ঞেস করলেন তুমি এতো অবাক কেন? তখন আবি বুরদা বললেন, এই যে লোকেরা, এদের ধর্ম এক, নবী এক, দাওয়াহ এক, হজ্ব এক, জিহাদ এক,আর এরাই এরা একে অপরকে হত্যা করবে।  এটা কিভাবে হতে পারে? এই উম্মাহ, যাদের রব এক, নবী এক, বই (কুর’আন) এক, ইবাদাত এক, সব কিছুই এক, তারা কি করে পরস্পরে যুদ্ধ করতে পারে? এটা কি করে হতে পারে? আমরা কিভাবে এই পর্যায়ে যেতে পারি। 

তখন সেই আনসারি বললেন, অবাক হয়োনা। আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, রাসুলুল্লাহ সা বলেছেন, আল্লাহ এই উম্মাহর উপর করুণা করেছেন, তারা আখিরাতে শাস্তি প্রাপ্ত হবে না, তাদের শাস্তি এই দুনিয়ায়। তাদের শাস্তি পরকালে নয়, এই পৃথিবীতে। এসব হবে এবং উম্মাহ অনেক দুঃখ দুর্দশার মধ্যে দিয়ে যাবে, কিন্তু এটা হচ্ছে আল্লাহর করুণার নিদর্শন। কারণ এর অর্থ হলো এই উম্মাহ এসবের মাধ্যমে তার গোনাহ মুক্ত হবে। 

কিন্তু এই অবস্থায় আমাদের করণীয় কি?

আমরা এই ফ্যাসাদ চাইনা, আমাদের এসব বন্ধ করা উচিত, আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত এসব প্রতিরোধের। কিন্তু একইসাথে আমাদের এটাও ভুললে চলবে না যে, মুসলিমদের এই জীবনে যে দুঃখ দুর্দশাই আসুক না কেন, তার মাধ্যমে কেয়ামতের দিন তাদের কিছুটা গোনাহ মুক্ত করবে।

 

২০ আলামত

  – সময়ের সঙ্কোচন বা সময়  ছোট হয়ে আসাঃ 

রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, যা আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, বুখারিতে লিপিবদ্ধ, যে কেয়ামত যতোই ঘনিয়ে আসবে, সময় ততোই সঙ্কোচিত হতে থাকবে। রাসূলুল্লাহ সা এই ব্যাপারটার বিশদ ব্যাখ্যা অন্য একটি হাদীসে করেছেন, যেটি আহমাদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, কেয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত হবে না, যতক্ষণ না সময় সঙ্কোচিত হচ্ছে। বছর গড়াবে মাসের মতো, মাস গড়াবে সপ্তাহের মতো, সপ্তাহ গড়াবে একটি দিনের মতো, একটি দিন যাবে এক ঘন্টার মতো আর এক ঘন্টা নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে। এভাবে এতো দ্রুতই সময় গড়িয়ে যাবে। এর অর্থ কি? সময়ের সঙ্কোচনের সত্যিকার অর্থ কি? এ ব্যাপারে আলেমদের কিছু মতামত আছে।

 প্রথমত, এ সময় পৃথিবীতে আল্লাহর বরকতের অভাব হবে। সময়ের মধ্যে কোন বরকত থাকবে না। সময় বরকত শূন্য অবস্থায় থাকবে। এবং আমরা এর প্রমাণ এখন দেখতে পাচ্ছি। একটি সম্পূর্ণ দিন কেটে যায় কিন্তু আপনি অনুভব করেন সারা দিনে প্রায় কিছুই করা হয় নি। সমস্ত বছর গড়িয়ে যায়, কিন্তু নিজের মধ্যে পূর্বের বছরের চেয়ে খুব বেশি উন্নতি ঘটাতে পারেন নি। যদিও আমাদের প্রত্যকদিন এখনও ২৪ ঘন্টাই আছে, যা আবু বকর (রা), উমর (রা) এবং অন্যান্য সব সালফে সালেহিনদের ছিলো। কিছু মানুষ সেই সময়েও আমাদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি সময়ের ব্যবহার করছেন, যেখানে আপনার মনে হয় সময় কিছু করার আগেই অতি দ্রুত বয়ে যাচ্ছে।

 

আমরা এখন কিছু মানুষের কথা বলবো যাদের সময়ে সুবহান’আল্লাহ সত্যিকারের বারাকাহ ছিলো। এদের একজন ইবনুল যাওঝি । ইবনুল যাওঝি যখন মৃত্যু বরণ করেন, যখন তাঁর সমস্ত কাজ একত্র করা হয়,তখন তাঁর লিখিত সমস্ত বইয়ের হিসেব করা হলো, তারা এসমস্ত বইয়ের পাতাকে তাঁর জীবনে কাটানো প্রতিটি দিন দিয়ে ভাগ করে পেলেন তিনি প্রতিদিন দিনে গড়ে ১১ পৃষ্টা করে লিখে গেছেন। আমরা যখন ছাত্র হিসেবে টার্ম পেপার লিখছি, তিনি তখন এই দ্বীনের জন্য প্রতিদিন ১১ পৃষ্টা লিখে গেছেন। সুবহান’আল্লাহ।

 ইবনে তাইমিয়্যা তার বিখ্যাত আকিদার বই লিখেছেন যার নাম – আল আকিদা আল ওয়াসিতিয়্যা, এটি একটি বিখ্যাত বই, যা কিছু ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার জুড়ে পড়ানো হয়, কখনো বছর জুড়ে, তিনি এই বই জোহর থেকে আসরের মাঝে লিখে শেষ করেছেন। সুবহানআল্লাহ তিনি এই আকিদার বিশাল বইটি জোহর থেকে আসর পর্যন্ত লিখে শেষ করেছেন। যোহরের সালাত পড়ে লিখতে বসেছেন, আসর আসতে আসতেই এটি লিখা শেষ হয়ে গেছে। আর আমাদের ছাত্ররা অভিযোগ করে এটি নাকি এক বছরে শেষ করা তাদের জন্য খুব কঠিন।

 

এটি আরেক ভাবে দেখা যায়।  আমেরিকার জীবন যাত্রা মানুষের সময়কে অত্যন্ত ক্ষুদ্র করে দেখায়। আমরা যদি বিশ্বের অন্যান্য দেখে যাই যেখানে জীবন এতো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে না, যেখানে জীবন এতো জটিলতায় পরিপূর্ণ না, সেখানে আপনি অনুভব করবেন যে সারাদিনে আপনার অনেক ফ্রী সময় হাতে থাকছে, যা আমেরিকায় পাওয়া যায় না। সবাই ছুটে চলছে। এমনকি এই আমেরিকাতেও স্থান ভেদে ব্যস্ততার পরিমাণ পরিবর্তিত হয়। শহুরে এলাকায় জীবন খুব দ্রুত, কিন্তু কিছুটা গ্রাম্য এলাকায় জীবন এ তুলনায় মন্থর। এই স্পষ্ট পার্থক্যটা আমরা ধরতে পারি । 

এখন আমাদের কাছে সময় পরিমাপের সঠিক পদ্ধতি আছে। যদিও গ্রাম্য ও শহুরে – এই দুই এলাকায় ঘড়ির হিসেবে সময়ের অবর্তনের কোন পার্থক্য নেই, তারপরেও আমরা পার্থক্যটা অনুভব করতে পারি। কিভাবে? আল্লাহু সর্বজ্ঞ। তাই, এটি আলীমদের মত যে এটি সময়ে বরকতের অভাবের ফসল।

 

দ্বিতীয়ত, কিছু আলেমগণ বলেন, এটি আল মাহদীর সময়ে ঘটবে। মানুষের জীবনের এতো বিলাসিতা থাকবে যে সময় অতি দ্রুত বয়ে যাবে। যখন আপনি বিলাসপূর্ণ অবস্থায় থাকেন, আপনি অনুভব করতে পারেন সাধারণ সময়ের চেয়ে এ বিশেষ সময় অতি দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। আলাহ সর্বজ্ঞ। কিন্তু এটা আলেমদের একটা মত।

 যানবাহনের উন্নতির ফলে সময়ের সময়ের সঙ্কোচন। একটি ভ্রমণে, যা কয়েক শতাব্দী আগেও একমাস লাগতো, এটি এখন কয়েক ঘন্টায় সম্ভব। আপনি এখন দুনিয়ার একপ্রান্ত থেকে অপর  প্রান্তে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই যেতে পারবেন। যা পূর্বের মানুষের বছরের মতো সময় নিত। সমুদ্র পাড়ি দিতে সারা বছর লেগে যেতো, এখন মানুষ সেটি কয়েক ঘন্টাতেই পাড়ি দেয়। আর এটিই যানবাহনের পরিবর্তনের ফল।

 অতঃপর, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে আমাদের পরস্পরের যোগাযোগ খুব দ্রুত সম্পাদিত হচ্ছে। আপনি পৃথিবীর যেকোন স্থানে থাকা একজন মানুষকে ই মেইল করতে পারেন, যা পেতে তার মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় নিবে। আপনি পৃথিবীর যেকোন স্থানে থাকা মানুষকে কল দিয়ে কথা বলতে পারবেন। এর মাধ্যমে আপনি খুব কম সময়ে এমন কাজ করতে পারবেন, যা আগে করতে মানুষের অনেক সময় লাগতো। এসব গুলোই মূলত সময়ের সঙ্কোচন ঘটাচ্ছে।

 

শেষ মতামত হচ্ছে যে, কেয়ামতের আগে সময় আক্ষরিক অর্থেই হ্রাস পাবে । একটি বছর অথবা মাস অক্ষরিক অর্থেই ছোট হবে। আল্লাহু আলাম, এটা হতে পারে পৃথিবীর নিজের কক্ষপথে ঘূর্ণণ এর গতিবেগ বেড়ে যাওয়ার ফলে, অথবা সূর্যের চারিদিকের আবর্তনের গতি বেড়ে যাওয়ার ফলে। এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে এসব গতি অপরিবর্তনীয়। বিশ্বজগত পরিবর্তনশীল। এটি উত্তোরুত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এই বিশ্বজগতের ধ্বংস হওয়া নিয়ে বিজ্ঞানীদের কাছে  অনেক থিওরি বিদ্যমান। 

বর্তমানে বিগব্যাংগ থিওরি বিজ্ঞানীদের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয়, যা বলে একটি অতিকায় বিস্ফোরনের ফলে এই বিশ্বজগতের জন্ম, যার পরবর্তিতে এই বিশ্বজগতের বিস্তৃত হচ্ছে, সেভাবেই সব একত্রে চুপসে যেয়ে এই বিশ্বজগতের মৃত্যু ঘটবে। আল্লাহও কুর’আনে বলেছেন, সূর্য পৃথিবীর নিকটে আসবে, নক্ষত্র খসে পড়বে, চাঁদ খসে পড়বে। 
এটা এখনও থিওরী, আমরা অবশ্য এটাকে কুর’আনের তাফসীর করতে ব্যবহার করছি না। এইসব আয়াত হচ্ছে কেয়ামত নিয়ে। তো, সময়ের সঙ্কোচন হতে পারে, বছর খুব দ্রুত গড়াতে পারে, ৩৬৫ দিনের বছর কমে আসতে পারে, পৃথিবী্র নিজের ঘুর্ণন বৃদ্ধির ফলে একটি দিন ২৪ ঘন্টার কমও হতে পারে। 

আর আমরা জানি, একটি দিনের আবর্তন স্থানের উপর নির্ভর করে। আমরা যদি চাঁদে থাকি, তাহলে দিনের হিসেব ভিন্ন। বুধ গ্রহে একটি দিন প্রায় একটি বছরের সমান। এগুলো হচ্ছে এই হাদীসের সম্পর্কে আলেমদের অভিমত।

 

আলামত নং ২১ – 

বাজারের নিকটবর্তিতাঃ
 আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা বলেছে, কেয়ামতের আগমনের অন্যতম এক আলামত হলো বাজার সমূহ পরস্পরের খুব নিকটে হবে। সুবহান’আল্লাহ, এটা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। আগে প্রত্যেক মহল্লার জন্য দু একটা করে দোকান থাকতো, আর সমস্ত শহরের জন্য কেন্দ্রীয় বড় বাজার থাকতো। এটা মূলত শহরের কেন্দ্রের দিকে থাকতো। তাদের একটা বাজার থাকতো, আর দৈনন্দিন পণ্যের জন্য ছোট ছোট দোকান থাকতো মহল্লার আসে পাশে। এখন সব মহল্লার জন্য বড় বড় শপিং মল থাকে, আর বিশাল বাজার চতুর্দিকে। উদাহরণ সরুপ, ইয়েমেনে, এক শহরের বাজার থাকতো ‘সুখ আল খামিস’।  অন্য শহরের থাকতো ‘সুখ আর রাবুয়াহ’/’সুখ আল জুমাহ’। সুখ আল খামিস অর্থ বৃহস্পতিবারের বাজার। কারণ এই বাজার শুধু বৃহস্পতিবারেই খোলতো। এটা তাদের কেন্দ্রীয় বাজার। এই শহরের বাজার ছিলো সপ্তাহে একদিন। কৃষকরা খাদ্যশস্য নিয়ে আসতো এবং বিক্রি করতো, সপ্তাহে একবার। এর বেশি না, সেটাই শহরের প্রধান ও একক বাজার। এখন এসব বাজার প্রতিদিন খোলা থাকে, প্রতিদিন নতুন নতুন স্থাপনা গড়ে উঠছে এসব বাজারকে ঘিরে। বিশাল বিশাল আমেরিকান স্টাইলের সুপারস্টোর। আর এসবই এখন মুসলিম বিশ্বে হচ্ছে। আগে, আগে বলতে খুব বেশি আগে না, আমরা কয়েকশ বছর আগের কথা বলছি না, আমরা দু’তিনেক দশক আগের কথা বলছি, চারিদিকে বাজারের এতো ছড়াছড়ি ছিলো না। আর এখন? চতুর্দিকে! 

আগে আমাদের বাজারে যেতে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিতে হতো। নতুবা নিজেদের নিজস্ব জমি থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের যোগান হতো। বাজারের জন্য দূরে যেতে হতো অথবা সাপ্তাহিক দিন আসার জন্য অপেক্ষা করতে হতো।

 

২২ নম্বর – এটি বাজারের নিকটবর্তিতার সাথে সম্পর্কিত। ২১ নম্বরে আমরা বাজারের নিকটবর্তিতা নিয়ে কথা বলেছি, আর এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার নিয়ে। 

রসূলুল্লাহ সা একটি হাদীসে বলেছেন যে টাকা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক বিস্তার হবে। সুবহান’আল্লাহ, এই আলামত আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি। ব্যবসা ব্যাপক হারে বিস্তৃত হচ্ছে। মানুষ কৃষিকাজ ছেড়ে ব্যবসা করছে। মানুষ ভিন্ন ভিন্ন পেশা ছেড়ে ব্যবসা করছে। সবাই ব্যবসা করতে চাচ্ছে। নিত্যনতুন ব্যবসা আলোর মুখ দেখছে। ই-কমার্স এর আগমনের ফলে ব্যবসার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন হয়েছে। এখন আমরা ইন্টারনেটে অনলাইনে পণ্যের অর্ডার দিতে পারছি। এই ব্যবসা একই সাথে অত্যন্ত চাহিদামূলক।

 

এখন আমরা এও পাই যে, যেখানে স্বামীর ব্যবসা করার কথা এবং স্ত্রীর ঘরে সন্তান পালন তথা ঘর সামাল দেয়ার কথা, সেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ব্যবসা করছে। পারিবারিক ব্যবসা ইদানিং আধিক হারে দেখ যাচ্ছে, যা স্বামী-স্ত্রী উভয়েই অধিকর্তা, উভয়েই সমান তালে শ্রম দিচ্ছে। এখন মা বাবা উভয়েই একসাথে ব্যবসা করছে নতুবা চাকরি করছে, এবং বাচ্চারা ডে কেয়ার সেন্টারে থাকছে। বাচ্চারা তাদের প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, মায়ের পরিবর্তে কাজের লোক বা কর্মচারীর হাতে মানুষ হচ্ছে।

 রসূলুল্লাহ সা বলেছেন, যেটি আহমদ কর্তিক বর্ণিত, ব্যবসা-বাণিজ্যের এমন পর্যায়ের বিস্তার হবে যে স্ত্রী তার স্বামীকে ব্যবসায় সাহায্য করবে। আমরা রাস্তাঘাটে বিভিন্ন দোকানের নাম দেখি, অমুক তমুক ভাই ভাই স্টোর, ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজ ইত্যাদি আর এখন এটা যেন মা-বাবা স্টোর, সুবহান’আল্লাহ। এটা কি মঙ্গলজনক হতে পারে? 

আমরা ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত, দারিদ্রতা নিয়ে চিন্তিত, অথচ রসূলুল্লাহ সা বলেছেন, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের মাঝে দারিদ্র্যতা নিয়ে চিন্তিত নই। আমার উদ্বেগ তোমাদের প্রাচূর্যতা নিয়ে। কারণ এর ফলে তোমরা দুনিয়াবী বিষয় নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করবে যেভাবে পূর্বের লোকেরা করতো, আর এটি তোমাদের সেভাবেই ধ্বংস করে দিবে যেভাবে পূর্বের লোকেরদের ধ্বংস করেছিলো।’ 

দারিদ্র নয়, দুনিয়াবী বিষয়ের প্রতিযোগিতা ধ্বংস টেনে আনে, যেভাবে এটা পূর্ববর্তীদের ধ্বংস টেনে এনেছিলো। রসূলুল্লাহ সা বলেছেন এটাই উনার উদ্বেগের কারণ। কারণ রসূলুল্লাহ সা জানতেন দারিদ্র্য এই উম্মাহর জন্য বড় সমস্য হবে না। এই উম্মাহকে আল্লাহ অনেক বরকত দান করেছেন। এর অনেক রিসোর্স বিদ্যমান। যেখানেই দারিদ্র্যতা পরিলক্ষিত হয়েছে, এর কারণ এই নয় যে রিসোর্সের অভাব, এর মূল কারণ সম্পদের অসম বন্টন। সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার। এটাই সমস্যা। যদিও এই উম্মাহর নিচের জমিনেই পৃথিবীর সমূহ সম্পদ আছে। এখানেই বেশিরভাগ রিসোর্স বিদ্যমান।

 

২৩ নং আলামত, শিরক এর ফিরে আসা, মূর্তিপুজার ফিরে আসা উম্মাহর মধ্যে শিরকের আগমনঃ 

 রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, কেয়ামতের এক অন্যতম আলামত হলো এই উম্মাহর মধ্যকার কিছু গোত্র মুশরিকদের অনুসরণ করবে এবং কিছু গোত্র  মূর্তি পূজাও করবে।’ অর্থ্যাৎ পৌত্তলিকতা। আর, এদের কিছু ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, আল্লাহু আলেম কিছু বাকি রয়ে গেছে কি না। কিন্তু এরকম পৌত্তলিকতা শুরু হয়ে গেছে।  মৃতের আছে, কবরের কাছে মানত করা,কবর পূজা, মাযার পূজা, পীর পূজা এসব ইতিমধ্যে চলছে। বিভিন্ন দিবস এর নাম করে পাথর, মিনার আর আগুনের পূজাও চলছে।

 

২৪ নং আলামত,

 ভূমিকম্প বা জালজালা

 অর্থ ভূমিকম্প। আবার এর আরেক অর্থ হতে পারে বড় পরীক্ষা-দুর্দশা। রাসূলুল্লাহ সা বুখারির একটি হাদীসে বলেছেন, কেয়ামতের একটি আলামত হলো যে নিয়মিত ভূমিকম্প হবে।’

আহমদ থেকে বর্ণিত অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, হে ইবনে হাওয়ালা! তুমি যদি দেখ খেলাফত পবিত্রভূমির (জেরুজালেম) দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন ভূমিকম্প-দূর্যোগ সহ বিভিন্ন্য বড় বিষয় সংঘটিত হচ্ছে, তবে জেনে রেখ কেয়ামতের সাথে তখনকার মানুষের ঠিক ততখানি পার্থক্য থাকবে, যতটুকু তোমার আমার হাতের মধ্যে বিদ্যমান।’

এখন,তুমি যদি দেখ খেলাফত পবিত্রভূমির (জেরুজালেম) দিকে এগিয়ে যাচ্ছে’ কথার অর্থ কি? আল্লাহু আলেম। এটা হয়তো সামনের সময়ের নির্দেশ করছে। খেলাফতের কেন্দ্র হবে পবিত্রভূমিতে। কারণ সেখানে মাহদি ও ইসা ইবনে মরিয়ম আ থাকবেন। সেটা হবে শান্তির ও নিরাপত্তার সময়। তারপর তখন ভয়ঙ্করতম সব দূর্যোগ সংঘটিত হবে, অতঃপর পৃথিবীর সমাপ্তি হবে।

 

নম্বর ২৫  জলোচ্ছাস, পাথরাঘাত, পশুতে রুপান্তরঃ আয়েশা থেকে বর্ণিত, যা তিরমিযিতে সংরক্ষিত, রাসূলুল্লাহ সা বলছেন, এই উম্মাহর শেষের দিকে জলোচ্ছাস, পাথরাঘাত এবং পশুতে রুপান্তরের মতো ঘটনা ঘটবে। আয়েশা তখন প্রশ্ন করলেন, আমরা কি তখন ধ্বংস হয়ে যাব, যদিও আমাদের মাঝে নেককার বান্দাগণ থাকেন? রাসূলুল্লাহ সা, হ্যা, যখন খারাপ লোকের সংখ্যাধিক্য হবে।’

 খুব বেশি খারাপ মানুষ থাকবে, যদিও উম্মাহের মাঝে নেককার বান্দাগণ থাকবেন, তারপরেও উম্মাহ ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। আর এই হাদীস ‘খস্ফ’ নিয়ে কথা বলছে, যার অর্থ জলনিমগ্ন বা আমরা ধরে নিতে পারি জলোচ্ছাস। অর্থ্যাত পৃথিবীর কিছু অংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। আর ‘কাদফ’, যার অর্থ পাথরাঘাত। আর ‘মাস্খ’, এর অর্থ পশুতে রুপান্তর ঘটা। অর্থ্যাত, মানুষ বানর, শুকর অথবা অন্য পশুতে রুপান্তরিত হবে। আধিকাংশ আলেমরা বলেন, এটি সত্যিকার শারিরিক পরিবর্তন, আবার কিছু আলেম বলেন এটি অন্তরের পরিবর্তন। এটি হচ্ছে গৌণ অংশের অভিমত, যে অন্তর পশুর ন্যায় আচরণ করবে। এর মানে দেহ মানুষের মত হলেও পাশবিক অন্তর, পাশবিক আচরণ। যদিও অধিকাংশের মত এটি শারিরিক পরিবর্তন।

 

নম্বর ২৬,

 ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন আবু হুরায়রার বরাতে, রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, এমন এক প্রতারণাপূর্ণ সময় আসবে, যখন মিথ্যেবাদীকে বিশ্বাস করা হবে এবং সত্যবাদীকে বিশ্বাস করা হবে না। এবং বিশ্বাসঘাতককে বিশ্বাস করা হবে, নির্ভরযোগ্য বা বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বিশ্বাস করা হবে না।  এবং রুয়াই বুদাহ কথা বলবে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন রুয়াই বুদাহ কে? রাসূলুল্লাহ সা বললেন, নিচু জাতের লোক; তুচ্ছ লোকেরা জন মানুষের বিষয়াদীতে কথা বলবে।’ 

রাসূলুল্লাহ সা একে প্রতারণাপূর্ণ বা কূট সময়, ধুর্ততার বলেছেন। যখন সব কিছুই প্রতারণার জ্বালে ঢাকা। কেন? একজন মিথ্যেবাদীকে বিশ্বাসী মনে করা হবে। মানুষ মিথ্যেবাদীকে বিশ্বাস করবে। হিটলারের প্রজ্ঞাপন মন্ত্রি বলেছিলো, ‘আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মিথ্য কথা বলতেই থাকবো, যতক্ষণ না মানুষ আমাদের এই মিথ্যাকে সত্য হিসেবে বিশ্বাস না করে নেয়।’ এখন অবস্থা আরও অবনতি হয়েছে, এখন আর কাউকে কষ্ট করে  এভাবে বারবার একই মিথ্যা চালিয়ে নিতে হয় না। যদি কেউ উপরের দিকের পদে আদিষ্ট থাকে, মানুষ তাকে বিশ্বাস করে। এবং, সত্যবাদী মানুষকে বিশ্বাস করা হবে না। 

সৎ, নিষ্টাবান। এবং আমরা তা এখন দেখছি। মিথ্যুকদের বিশ্বাস করা হচ্ছে এবং সৎদের করা হচ্ছে না। আমরা দেখছি আমাদের শাসকরাই এখন মিথ্যাবাদী। আর যারা অত্যাচারীত, নিপীড়িত, তারা হচ্ছে সত্যনিষ্ট আলেমরা ও অন্যান্য তাকওয়া সম্পন্ন ব্যক্তিরা। আর নির্ভরযোগ্যতার ব্যাপারে, নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিকে বিশ্বাস করা হবে না। কিন্তু অসৎ চতুর ব্যক্তিকে বিশ্বাস করা হবে। এরপর, সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রুয়াই বাদাহ কথা বলবে।  রুয়াই বাদাহ কে? রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, সে হচ্ছে নিচু জাতের লোক। এর অর্থ এই নয় যে বর্তমান পৃথিবীতে যে শ্রেণী বৈষম্য বিদ্যমান, সে মাপ কাঠিতে নিচু, বরং এটি ধর্মের মাপ কাঠিতে যারা নিম্ন, যারা ধর্ম পালনে সবচেয়ে অনগ্রসর। এরা নিচু জাত, দ্বীনের নিচু জাত। কারণ এরা দ্বীনের অনুসরণ করে না বা করতে চায় না। নৈতিকতা এবং ধার্মিকতা বিবর্জিত।

 

রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, ইয়াতাকাল্লাব, মানে এই নিচু ও তুচ্ছ মানুষ, যার কথা কারো শুনার কথা ছিলো না, কিন্তু সে গনমানুষের বিষয়াদীতে কথা বলবে, সে নেতাতে পরিনত হবে, সে পরিকল্পনা তৈরী করবে, সে শিক্ষা দেবে, সে নেতৃত্ব দিবে, আর এইসব হচ্ছে নেতৃত্বস্থানীয় পদ, যা বর্তমান মুসলিম দেশ সমূহে ঠিক এই রকম মানুষের দ্বারাই পূর্ণ। যাদের কোন দ্বীনি কাজকর্ম নেই, তুচ্ছ মানুষ। আর যার জ্ঞান আছে, নৈতিকতা আছে, ন্যায়পরায়নতা আছে,সাধ্য আছে এবং নেতৃত্বের সামর্থ্য আছে, তাদের হত্যা করা হয় অথবা জেলে পুরা হয়। এই হাদীস বর্তমান মুসলিম বিশ্বের হুবহু চিত্র তুলে ধরে। এইভাবেই মুসলিম বিশ্ব এখন চলছে। এটি রোয়াই বাদাহরা চালাচ্ছে। 

আহমদ থেক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা এমন সময় আসবে যখন এই বিশ্ব লুকা বিল লুকাদের জন্য হয়ে যাবে।’ লোকা বিল লোকা কারা? লোকা অর্থ দুর্বৃত্ত। রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, একটা সময় আসবে যখন পৃথিবী দুবৃত্তের ছেলে দুবৃত্তের জন্য হয়ে যাবে। এর অর্থ কি যে পৃথিবী তাদের জন্য হয়ে যাবে? 

আল মানাওয়ি এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, পৃথিবীর সম্পদ থাকবে দুবৃত্তের কাছে, ক্ষমতা থাকবে দুবৃত্বের কাছে এবং সম্মান থাকবে দুবৃত্তের কাছে। আর আপনি যদি দেখতে চান এরা কারা, তাহলে ধনী ও বিখ্যাতদের দিকে চোখ ফেরান। সেখানেই আপনি তাদের দেখতে পাবেন। এখন, সুবহান’আল্লাহ, বিনোদনের সম্পূর্ণ ফিল্ডই নিফাক তথা ভন্ডামিতে পরিপূর্ণ। তারা এখন শেখে কিভাবে ভন্ডামি করতে হয়। এই ভণ্ডামি এখন মানুষের বিনোদন ! অভিনয়। 
আপনি ততক্ষণ পর্যন্ত ভালো অভিনেতা হতে পারবেন না, যতক্ষণ না আপনি একজন ভালো ভন্ড হচ্ছেন। কারণ তখন আপনি জানবেন কি করে অভিনয় করতে হয়।

 

আর সুবহান’আল্লাহ, আমরা দেখি, ১৭-১৮ বছরের বাচ্চারা পপ গান গেয়ে মিলিওনিয়ার-বিলিওনিয়ারে পরিণত হচ্ছে, তারা তুমুল জনপ্রিয় হচ্ছে, প্রত্যেক ম্যাগাজিনের কাভারে আসছে। সুবহান’আল্লাহ, আপনি যদি বাইরে গিয়ে মানুষকে জিজ্ঞেস করেন যে তারা এই গায়ক সম্পর্কে কি মনে করে, অথবা এই অভিনেতা সম্পর্কে, মানুষেরা বলবে সেই গায়ক অথবা অভিনেতা তো জোসস, সে কতই না বুদ্ধিমান। আর সুবহান’আল্লাহ, এটা এই হাদীসের একেবারে মূল ভাব।

 সুবহান’আল্লাহ, আমরা রাসূলুল্লাহ সা এর কি নিখুঁত বর্ণনা দেখতে পাই। আর এই হাদীসটি মুত্তাফাকুন আলাইহ। রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, 

এমন এক সময় আসবে, লোকেরা একজন মানুষ কে বলবে, ‘মা আকালাহু’, সে কতোই না বুদ্ধিমান! ‘ওয়ামা আদ্রাফা’, ‘মা আদ্রাফা’র অর্থ কি? সে কতোই না জোস ইংরেজিতে কুল, হি ইজ কুল!  তো লোকেরা বলবে, দেখ, সে কতো বুদ্ধিমান, কতো জোস, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা বললেন, কিন্তু তার হৃদয়ে একটি শস্যদানা পরিমাণও ইমান নেই। একটা ছোট্ট শস্যদানা পরিমাণও নয়। যদিও লোকেরা তাকে জোসস বলবে, কুল বলবে। 

ওয়াল্লাহি, এসব বিনোদন জগত কিংবা খেলার জগতের স্টাররেরা, যাদের নৈতিকতা, ধার্মিকতা প্রভৃতি বিষয়ে কোন যোগ্যতা নেই, যাদের নিম্নস্তরের ব্যক্তিত্ব, আর তারাই বর্তমানে সেসব ব্যক্তি, যারা জোস বলে পরিচিত।

 

নম্বর ২৭  শুধু মাত্র পরিচিতজনদের সালাম প্রদানঃ আনাস ইবনে মাসুদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, কেয়ামতের অন্যতম একটি আলামত হলো, মানুষ শুধু মাত্র তার পরিচিতজনদের সালাম দিবে। এটি আহমদ থেকে বর্ণিত। আগে একটা সময় ছিল, যে কেউ যে কোন অপরিচিত ব্যক্তিদের বাজারে কিংবা মসজিদে পেলে সালাম দিত। এখন, মানুষ শুধু তাদেরই সালাম দেয়, যাদের সে চিনে, পরিচিত ব্যক্তি।  তো, সালাম আর মুসলিমদের হক্ব হিসেবে থাকে নি, এটা এখন আমাদের পরিচিতদের সম্পত্তি হয়ে গেছে। যদিও এটা শুধু মাত্র মুসলিমদের জন্য, সে যেই হোক না কেন, সালাম মুসলিমদের জন্য। 

সুবহান’আল্লাহ, এখান যদি আপনি একটা তুলনা করেন, বর্তমানে আমরা যে সমস্ত বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান পালন করে থাকি, সেই সময়ে মানুষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের হার  মুসলিমদের সালাম বিনিময়ের চেয়ে বেশি। 

আপনি যদি কোন অপরিচিত মুসলিমকে সালাম দেন, সে এমন ভাবে তাকাবে, যেন তার চোখ বলবে যে আমি কি তোমাকে চিনি? সে হয়তো কিছুক্ষণ চেষ্টা করবে আপনাকে চেনার, পরে ব্যর্থ হয়ে ভাববে যে সে হয়তো আপনাকে ভুলেই গেছে। এখন আর মুসলিমদের মধ্যে সালাম দেয়ার জন্য সালাম দেয়া বলে কিছু নেই।

 

এখন, নম্বর ২৮ , নিসা কাসিয়াত আরিয়াত,

 যেটি সেসব নারী, যারা কাপড় পড়েও নগ্নঃ 

রাসূলুল্লাহ সা এই মুসলিম শরিফের হাদীসে বলেন, কেয়ামতের অন্যতম এক আলামত হলো, এমন এক শ্রেণীর মহিলা থাকবে, যারা ‘কাসিয়াত আরিয়্যাত’। ‘কাসিয়াত আরিয়্যাত’ অর্থ তারা পোশাক পরিহিতা, কিন্তু নগ্ন। তারা পোশাক পরিহিতা হলেও নগ্ন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা তাদের মাথাকে ‘আসমি মাতুম বুখতিম মা’ইলাহ’ অর্থ্যাত ‘উটের কূঁজের মতো মাথা’ বলে বর্ণিত করলেন। এখানে খুব সম্ভবত কোন এক ধরণের চুলের স্টাইলের কথা বলা হয়েছে। ‘লা ইয়াদ খুলনাল জান্নাহ’, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এটি কুফফারদের না, বরং মুসলিম মহিলাদের কথা বলছে। 

কুফফার, এরা তো জান্নাতে ঢুকবেই না। কিন্তু এখানে, এই হাদীসে গোনাহগার বিশ্বাসীদের কথা বলছে। তারা জান্নাতে ঢুকবে না, এমনকি তারা জান্নাতের ঘ্রানও পাবে না। যদিও জান্নাতের সুঘ্রান অনেক দূর থেকে পাওয়া যায়। অন্য একটি হাদীসে বলা আছে, আমরা ৭০ বছর দূরত্ব থেকে জান্নাতের সুঘ্রান পাবো। রাসূলুল্লাহ সা তাদের কাসিয়াত আরিয়্যাত বলে অভিহিত করেছেন। তারা পোশাক পরিহিতা নগ্ন নারী। এর অর্থ কি? এর অর্থ, যদিও তাদের শরীরে কাপড় থাকবে, কিন্তু এমন ভাবে যেন কোন কাপড়ই নেই। আর এখন বাজারে দেখা যায়, কিছু দড়ি জাতীয় কাপড় পোশাক হিসেবে বাজারে বিক্রি হয়। শুধু মাত্র কয়েকটা দড়ি, এটা যদিও একটি এক্সট্রিম উদাহর, কিন্তু এমনও অনেক কাপড়ে বাজার ভরে গেছে, যাগুলো শরীরের সাথে এমন আঁটো হয়ে বসে যে বুঝাই যায় না শরীরে আদৌ কোণ কাপড় আছে কি নেই। এটি শুধু শরীরের চামড়ার রংটাকে  ঢাকতে পারে। কিন্তু এটি শরীরের গঠনকে ঢাকতে পারে না, শরীরের সকল বাঁক প্রতীমান করে। আরোও কিছু কাপড় আছে যেগুলো স্বচ্ছ। এগুলো এতো চিকন ও পাতলা যে কাপড়ের ভেতর দিয়ে দেহের বিভিন্ন অংশ দেখা যায়। এগুলো সবই কাসিয়াত আরিয়াতের উদাহরণ, আবৃত কিন্তু নগ্ন। 
এই ফ্যাশান আমেরিকা থেকে শুরু হয়ে এখন সমগ্র বিশ্বে পৌছে গেছে।

 

২৯ নং আলামত,
 রাসুল বলেন, ভবিষ্যৎ এ আমার উম্মাহর এমন কিছু মানুষ থাকবে যারা সুরুয এর উপর বসে থাকবে, (সুরুয হচ্ছে এক প্রকার আসন,যা দেখতে অনেকটা ঊটের পিঠে যে আসনে বসা হয় তার মত)। রাসুলুল্লাহ এটাকে ঊটের আসনের কথা  বলেন নি, তিনি বলেছেন এটা এক রকম বাহন কিন্তু ঊটের পিঠে চড়ার আসনের মত, কিন্তু হুবুহু সেটাই নয়। আরেকটি হাদিস এ বলা হয়েছে অনেক চওড়া আসনের কথা, রাসুলুল্লাহ বলেন তারা বসে থাকবে অনেক চওড়া আসনের উপর। এখন আমরা জানি ঊটের পিঠ (বসার জায়গা) অনেক ছোট এবং অনেকটা গাধার মত। রাসুলুল্লাহ বলন এটা চওড়া এবং এটা আসলে  উটের পিঠের গদি নয়। 

রাসুলুল্লাহ আমাদের কাছে গাড়ি সম্পরকে বর্ণনা করছিলেন যদিও তখন গাড়ী বলতে কিছু ছিল না। তার পরও রাসুলুল্লাহ এই শব্দটা ব্যবহার করেছেন আমাদের কাছে।

 

তারা বসে থাকবে ছাদুর উপর, ছাদু এক প্রকার গদি যুক্ত আসন। কিন্তু সেই ছাদুগুলো হচ্ছে আজকে আমরা যা দেখছি, খুবই চওড়া মবিল চালিত গাড়ির আসনের মতন, অনেক চওড়া।  একটি গাড়িতে যেমন থাকে । রাসুলুল্লাহ বলেন এটা নতুন একটি বাহন, এই বাহনের বিষয়টা কুরআনেও বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ বলেন, তোমাদের আরোহণের জন্যে এবং শোভার জন্যে তিনি ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি এমন জিনিস সৃষ্টি করেন যা তোমরা জান না’। (নাহল ৮)

 আর বিমান, মবিল চালিত গাড়ীসহ আমাদের অন্যান্য যেসব যানবাহন আছে এসবও আমরা জানতাম না এবং ভবিষ্যত এ কি বাহন আসবে সেটাও শুধু আল্লাহই জানেন।  কাজেই এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে, বর্তমানে আমরা যা উন্নয়ন, পরিবর্তন বা প্রযুক্তি দেখছি এগুলোই সব, প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমরা অনেক নতুন আবিষ্কার দেখছি। তাই হয়তোবা এই রকম বাহন গুলইতেও পরিবর্তন আসবে।  এরপর, রাসুলুল্লাহ(স) সেই লোকদের সম্পরকে বলেন , আর তারা তাদের গাড়ী মাসজিদের সদর দরজায় পাঠাবে। তারা তাদের গাড়ী মাসজিদের পাশে রাখবে এবং মসজিদে যাবে কিন্তু রাসুলুল্লাহ বলেন, তাদের স্ত্রীরা কাপড় পড়ার পরও নগ্ন থাকবে এবং তাদের প্রতি অভিসম্পাত, কারন তারা অভিসপ্ত।

 

৩০নং আলামত – বিশ্বাসীদের স্বপ্নঃ তিরমিযি বর্ণিত একটি হাদিসে রাহুলুল্লাহ বলেন, শেষ সময়ের দিকে বিশ্বাসীদের স্বপ্ন প্রায় কখনই মিথ্যা হবে না। বিশ্বাসীদের স্বপ্ন প্রায় সবসময়ই সত্য হবে। তারা স্বপ্নে যা দেখবে তাই ঘটবে, এবং এটা হবে শেষের দিকের সময়। আলেমদের মতে এর একটা কারন হচ্ছে তখন উম্মার কোন আম্বিয়া থাকবে না, যেই আম্বিয়া আল্লাহর কাছ থেকে ওহী গ্রহন করবেন। কাজেই আম্বিয়া না থাকার কারণে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ তখন অনেক কঠিন হয়ে যাবে, এবং সময়টা হবে তকলিফের।

 

আল্লাহ স্বপ্ন সত্যি করার মাধ্যমে বিশ্বাসীদেরকে সাহায্য করবেন। এটা তাদের জন্য এক প্রকার সাহায্য। এটা তাদের জন্য সুসংবাদ। কিন্তু আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে, সেই স্বপ্ন কখনই শারিয়াহ এর উৎস হতে পারবে না। শারিয়াহর এমন কোন অংশ নাই যেটা স্বপ্নে পাওয়া গেছে । শারিয়াহ নাজিল হয়েছিল মুহাম্মাদ(সঃ) এর কাছে। এই স্বপ্ন গুলোকে মুহাম্মাদ(সঃ) বলেছেন বুশারাত বা সুসংবাদ। উদাহরন স্বরুপ ইমাম বুখারি বলেছেন তিনি একটি স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে রাসুলুল্লাহ তার কাজকে অর্থাৎ হাদীস সংকলের কাজকে সমর্থন করেছেন, প্রশংসা করেছিলেন।

 সেটা ছিল একটি সুসংবাদ। আরেকটি উদাহরন ছিল ইমাম খুরতির , যখন তিনি সাহিহ আল জামীহ সাহিহ 
লিখছিলেন তখন তিনি একটি স্বপ্ন দেখেন যেই স্বপ্নে  রাসুলুল্লাহ ওনার কাছে একটি হাদিস বর্ণনা করছিলেন। এসবই ছিল সুসংবাদ, যেখানে কোন নতুন ওহী বা শিক্ষা ছিল না, এমনকি স্বপ্নেও না।

 

শারিয়াহর কোন পরিবর্তন নাই। এই স্বপ্ন শুধু মাত্র একটা খুশির সংবাদ(gladtidings)। উদাহরন স্বরুপ , প্রথম দিকের একজন মুসলিম স্বপ্নে দেখেন যে  রাসুলুল্লাহ(স) এসে তাকে বলছেন তুমি একজন শহীদ হবে। এবং ইবনে আসসান, তিনি সাওম পালন অবস্থায় শাহিদ হয়েছিলেন এবং তিনি একদিন স্বপ্নে দেখেছিলেন যে রাসুলুল্লাহ(স) ওনাকে বলছেন, তুমি আমাদের সাথে সাওম ভঙ্গ করবে।এবং তিনি সেইদিন ই মারা যান। তিনি আর কখনই দুনিয়াতে সাওম ভঙ্গ করতে পারেননি, রাসুলুল্লাহ(স) তাকে বলেছিল তুমি আমাদের সাথে সাওম ভঙ্গ করতে যাচ্ছ। এবং এসব হচ্ছে উদাহরন, আল্লাহ বিশ্বাসীদের কে স্বপ্নের মাধ্যমে সুসংবাদ দান করেন। কিন্তু স্বপ্নের মাধ্যমে কখনই দীণ এর কোন নতুন বিষয় শিখানো বা পরিবর্তন করা হয় না।

 

রাসুলুল্লাহ(স) বলেন, যারা তাদের কাজকর্মে যতটা নিষ্ঠাবান, তাদের স্বপ্নই ততোটা সত্যি হয়।
 আপনি যতটা সত্যবাদী, আপনার স্বপ্নও ততোটা সত্যি হবে। কারন সত্যবাদীর অন্তর থেকেই একটি সত্য স্বপ্ন আসে। যে ব্যক্তি সত্যবাদি, তখন তার স্বপ্ন সত্য হওয়ার সম্ভাবনা ততো বেশী। রাসুলুল্লাহ আরো বলেন, বিশ্বাসীদের স্বপ্ন নব্যুয়াতের ৪৬ অংশের একটি। এটা দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে?

 

আমরা জানি, জিরবাইলের কাছ থেকে ওহী গ্রহন করার আগে রাসুলুল্লাহ ৬ মাস ধারাবাহিক ভাবে রাতে যা স্বপ্নে দেখেছেন, দিনে ঠিক তা ই ঘটেছে, টানা ৬ মাস। এরপর রাসুলুল্লাহ ২৩ বছর জিব্রাইলের কাছ থেকে ওহী গ্রহন করেছেন। ৬ মাস এবং ২৩ বছরের মধ্যে অনুপাত কত? এটা ১:৪৬।

৬ মাসের তুলনায় ২৩ বছরের অনুপাত হচ্ছে ১:৪৬। এর মানে হচ্ছে স্বপ্ন নব্যুয়াতের ৪৬ ভাগের ১ ভাগ। এবং এটাই হচ্ছে  একমাত্র অংশ যেটা এখন বাকী। ফেরেস্তার মাধ্যমে একজন মানবের কাছে ওহী প্রেরন ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে। এখন আর কোন মানুষ ফেরেস্তার থেকে ওহী গ্রহন করছে না। এটা সমাপ্ত হয়েছিল রাসুলুল্লাহর দ্বারা, যিনি ছিলেন নবী রাসূলদের সিলমোহর স্বরুপ।

রাসুলুল্লাহর পরে জিব্রাইলকে আর কারও কাছে পাঠানো হবে না। কিন্তু স্বপ্ন চলতে থাকবে, যা কিনা আল্লাহর তরফ থেকে এক ধরনের অনুপ্রেরনা।

 

৩১নং আলামত – কালামের প্রকাশ হবেঃ রাসুলুল্লাহ(স) বলেন, কিয়ামত সন্নিকটে আসার সময় কালামের’ প্রকাশ হবে। কালাম’ শব্দটি আরবি, এর একটি অর্থ হচ্ছে, কলম, কিন্তু এর দ্বারা লিখিত যে কোন কিছুকেই বুঝানো হয়। লিখিত যে কোন কিছু কেই কালাম বলা যেতে পারে। এটা কি আমাদের ব্যবহৃত কলমের মত? নাহ, এটা অন্য রকম। এটাকে কালাম বলা হয়েছে কারন এটা লিখিত বস্তু। যে কোন কিছু যা লিখিত বা ছাপানো বা সংরক্ষিত যা কিনা কলমের মাধ্যমে লিখা হয়েছে, তাই ই কালাম। এবং এই আলামতটি ইতমধ্যেই দেখা দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ বলেন, এটা উম্নুক্ত হবে,প্রকাশিত হবে। কালামের আত্মপ্রকাশ ঘটবে। মানে হচ্ছে লিখিত বস্তুর ব্যাপক প্রচলন হবে, বই ডকুমেন্ট ইত্যাদি কালামের কিছু উদাহরন।

কয়েক শতাব্দি আগেও মানুষের কোন লাইব্রেরী ছিল না, মানুষের বাড়িতে বই থাকত না। তখন কোন সংবাদ পত্র বা ম্যাগাজিনও ছিল না। তখন লিখিত কোন কিছুর সাক্ষাত পাওয়া ছিল কঠিন। এমন ও ছিল যে পুরো একটি সমাজে কোন বই পুস্তক নাই। সমাজে, একটি সম্পুর্ণ সমাজের মানুষ বই নামের কিছুকে চিনত না, যা কিনা লিখা হয়েছে । তখনকার সম্প্রদায় গুলোতে শুধুই মুখের ভাষা ছিল, এর কোন লিখিত ধরন ছিল না।এমনকি আজকের দিনেও এমন অনেক ভাষা আছে যার কোন লিখিত রীতি নাই।

 

আর মুহাম্মাদ(স) এর সময় পড়ালিখা জানা মানুষের সংখা এতই কম ছিল যে আপনি তা  হাতে গুনতে পারবেন। এবং ইসলামের বানী ছড়িয়ে পড়ার পর যারা শিক্ষিত সমাজের লোকেরা ছিলেন মুসলিম, আর বাকিরা ছিল অন্ধকারের ভেতর, জাহিলিয়াতের ভেতর। কিন্তু এর পরেও প্রত্যেক বাড়ীর থেকেই একজন মুসহাফ অর্থাৎ সম্পূর্ণ লিখিত কুর’আন নিয়ে এসেছে এমন নয়।তখন মাসজিদে মুসাহাফ থাকত, যেন মানুষ সেখানে গিয়ে পড়তে পারে। 

 আপনি যদি ইতিহাস পড়েন, তাহলে দেখতে পাবেন বড় বড় লাইব্রেরি এগুলো ছিল মুসলিম শহরগুলোতেই, যেমন বাগদাদের লাইব্রেরী, কুরতবার লাইব্রেরী, দামেস্কর লাইব্রেরী, সামারকান সহ মূল শহরগুলোতে। সেই যুগে আপনি অন্য কোন ধর্মের লোকদের বসবাসের জায়গায় গেলে সেখানে কোন বই পাবেন না, তাদের কোন মুসহাফ ছিল না। বই বা মুসাহাফ সেখানে তখন ছিল না, আর সংবাদ পত্র ও ম্যাগাজিন সম্পরকেও মানুষের কোন ধারনা ছিল না।

লিখিত ডকুমেণ্ট সেটা বই, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন যাই হোক না কেন এগুলোর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছে টাইপরাইটার বা মুদ্রণ যন্ত্র এর আবিস্কারের পর।  জারমান চিত্রকর জোহানেস গুটেনবার্গ দ্বারা ছাপাযন্ত্র উদ্ভাবন করার আগ পর্যন্ত এর একেবারেই চল ছিল না, ব্যাপারটি আসলে তা নয়। এমনকি আরও আগেই চায়নাসহ অন্যান্য জায়গায় এটার প্রচলন ছিল। কিন্তু ছাপাযন্ত্রের বিপ্লবের পর, মানে ১৫ শাতাব্দির পর ছাপা মাধ্যম(প্রিন্ট মেশিন) সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। আগের দিনে কৃষক বা অন্যদের বাড়িতে কোন লিখিত বই থাকত না। কিন্তু এখন সবার বাড়িতেই একটি লাইব্রেরী আছে। সবারই বই আছে । প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই আপনি ম্যাগাজিন বা পত্রিকা পাবেন । এটা এখন দুনিয়া ব্যপী বিস্তৃত । একদম প্রত্যন্ত এলাকাতেও আপনি বইয়ের দেখা পাবেন। সেখানে স্কুল পাবেন।  অর্থাৎ ছাপানো মাধ্যম এখন সারা দুনিয়াতেই রয়েছে।

 

আর এখন ইন্টারনেটের উন্নতির কারনে এটা আরও দ্রুত প্রসার পাচ্ছে। তাই এখন আপনি কয়েকটা আঙ্গুলের খোচাতেই (ক্লিক করে)লাখ লাখ বই এবং ছাপানো ডকুমেন্ট আপনার হাতে পেয়ে যাচ্ছেন । এখন কম্পিউটার ছাপানোর কাজের একটি মাধ্যম হয়ে দাড়িয়েছে, আপনি এর মাধ্যমে পড়তেও পারবেন, এটা কাগজে না লিখা থাকলেও চলবে। যে কোন কিছুর লিখিত ধরন, সেটা কাগজে, বোর্ডে বা কম্পিউটার পর্দাতে অথবা দেয়ালেই হোক না কেন, সেটা একধরনের প্রিন্ট। এটা সাহিত্য বা লিখিত বস্তু বহনের একটি মাধ্যম । এবং এটাই হচ্ছে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের পরিপূরনতা যা কেয়ামতের আগে আবিরভূত হওয়ার কথা তিনি বলে গিয়েছেন।

কিন্তু কালামের প্রকাশ মানে এই না যে জ্ঞান ছড়িয়ে পরবে। দুনিয়া ব্যপী ছাপা মাধ্যমের উন্নতি মানেই মানুষন জ্ঞানী হয়ে যাবে, এমনটা নয়। হ্যা, মানুষ এখন বেশী জানছে, তারা বিভিন্ন ভাবে সারা দুনিয়া থেকেই শিখছে, কিন্তু এটার মানে এই না যে তারা সাহিহ জ্ঞ্যানটা পাচ্ছে। কারন বেশীরভাগ মানুষই অনাস্থাভাজন (জাঙ্ক) মাধ্যমের উপর নির্ভর করে, ঠিক যেমন খাবারের মধ্যে ম্যাকডোনাল্ড, বারগার কিং এগুলো জাঙ্ক’ খাবার, ঠিক তেমনি জাঙ্ক’ মিডিয়া আছে। এবিসি, এনবিসি, সিবিএস এইসব জাঙ্ক গনমাধ্যম।

 

সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন শুধুমাত্র সাহিহ এবং আস্থাভাজন বই থেকে টেক্সট থেকে হয়, আপনি টিভি দেখে এটা শিখতে পারবে না। আপনি টিভির মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে না। আপনার জানার উৎস যদি টিভি হয়, আপনি মূলত বেশী কিছু শিখছেন না। কিন্তু দুরভাগ্যবশত বেশীর ভাগ মানুষই যা জানছে, বা শুনছে তা টিভির মাধ্যমেই । আর এটাই হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ মাধ্যম । এটা ব্যবসানির্ভর, এটা অনাস্থাজন, এটা মানুষের ব্রেইন ওয়াশ করার জন্য তথ্য প্রচার করে। এটা মানুষের মন এবং চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রন করতে পারে। কিন্তু সত্য জ্ঞ্যানারজন শুধুমাত্র আস্থাজনক এবং কালোত্তীর্ণ গ্রন্থ থেকেই সম্ভব, যেখান থেকে আপনি জানতে পারবে।

 

৩২নং আলামত – চাঁদের আয়তন বৃদ্ধিঃ হিলাল বা চাঁদ কেয়ামতের আগে আয়তনে বৃদ্ধি পাবে। এর মানে চাঁদকে আকারে বড় হতে হবে এমনটি নয়, বরং আমাদের চেতনাতে বা দৃষ্টিতে চাঁদকে আমরা বড়  দেখব। আমরা এটাকে বড় দেখি। রাসুলুল্লাহ (স) বলেননি যে চাঁদ বড় হবে, তিনি বলেছেন, চাঁদ বিস্তৃত হবে বা দেখে বড় বলে মনে হবে। 

তাবরানী বর্ণিত এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ(স) বলেছেন, কেয়ামতের একটি লক্ষণ হচ্ছে চাঁদ বিস্তৃত হবে, এটাকে বড় দেখাবে। আগে যেমন দেখাত তার থেকে বড় দেখাবে। এই সম্পরকে রাসুলুল্লাহ(স) বলেন, মানুষ একদিন বয়সের চাদ দেখে বলবে, ওহ, এটা তো দ্বিতীয় দিনের চাঁদ কারন এটাকে বড় দেখাবে, বিস্তৃত দেখাবে।

 আল্লাহই জানেন, কেন এমন হবে, কিন্তু আপনি যদি চাদের দিকে তাকান, যখন এটা দিগন্তের কাছাকাছি থাকে, এবং যখন আকাশের মাঝামাঝি থাকে , কোনটাকে বড় মনে হয়? দিগন্তের কাছেরটা নাকি খোলা আকাশেরটা? সূর্যোদয় বা সূর্য অস্তের সময় লক্ষ্য করলে দেখবেন চাঁদ অনেক বড় দেখায়, প্রায় সূর্যের মতই মনে হয়। দিগন্তের দিকে প্রায় সূর্যের আকারের মনে হয়। এটা যখন আকাশের মাঝের দিকে আসে, তখন আস্তে আস্তে ছোট হতে থাকে, এবং যখন একদম মাঝ বরাবর চলে আসে তখন সবচেয়ে ছোট হয়ে যায়। 

এর কারন হচ্ছে, এটা দুরত্বের কারনে হচ্ছে না, কারন দূরত্ব পরিবর্তন হয় না। এটা দিগন্তের দিকে বড় দেখায় কারন তুমি যখন বায়ুমন্ডলের প্রস্থ বরাবর তাকাও তখন তোমার ও চাদের মধ্যে দুরত্ব, আকাশের মাঝ বরাবর থেকে বেশী হয়।

 

যখন এটা দিগন্তের দিকে থাকে, আপনি  ধোঁয়া দেখবেন, গ্যাস, দূষিত বাতাস থাকে, অনেক বেশী অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড থাকে, তখন আপনি চাঁদকে অনেক বড় দেখেন । যেমন একটা সহজ উদাহরণ হচ্ছে, একটি এক টাকার কয়েন, এই গোল কয়েনকে আপনি খালি চোখে যে আকারের দেখবেন, যদি সেই একই এক টাকার কয়েনকে একটি পানি ভর্তি গ্লাসের মধ্য দিয়ে দেখেন তাহলে সেটাকে দেখে বড় বলে মনে হয়। আসলে কিন্তু পয়সার আকার একই আছে, কিন্তু আপনার এবং পয়সার মধ্যে অর্থাৎ মাধ্যমের পরিবর্তনের কারণে সেই গোল কয়েনকে দেখে বড় বলে মনে হয়। একই ভাবে আমাদের এই বায়ুমন্ডলের কারনে এবং বাতাসে দুষিত পদার্থ কার্বন ডাই অক্সাইড ইত্যাদি বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে চাঁদকে এর আসল আয়তন থেকে বড় দেখায়।

 

৩৩নং আলামত – দীন সম্পর্কে মিথ্যা ও অতিরঞ্জনঃ

রাসুলুল্লাহ(স) বলেন, কেয়ামতের আগমনের দিকে দাজ্জালুন আসবে, দাজ্জাল হচ্ছে এমন একজন যে ভান করে। এই হাদিসটি মসীহ আদ্দাজ্জাল সম্পরকে বলছে না, এটা অন্য দাজ্জালকে বুঝিয়েছে । দাজ্জাল হচ্ছে যেসব মানুষ মিথ্যা বলে, যারা অন্যরকম হওয়ার ভান করে, তারা। মিথ্যাবাদী। তারা আপনার সাথে এমন কথা বলবে যা আপনি এমনকি আপনার পিতৃপুরুষ ও আগে কখনো শুনে নি। তাই, তারা এমন জিনিস সামনে নিয়ে আসবে যা আপনি বা আপনার পিতৃপুরুষ আগে কখনো শুনো নি। এসব কোন মুসলিম আগে কখনও শুনে নি।

 

রাসুলুল্লাহ(স) বলেন, তাদের থেকে সাবধান হও, তাদেরকে তোমাকে ভ্রান্ত পথে চালিত করার সু্যোগ দিও না। এর মানে,এরা এমন কিছু মানুষ যারা হয়তোবা ধর্মের নামে আসবে এবং মানুষের কাছে এমন কিছু ইসলামের নামে উপস্থিত করবে যা মুলত ইসলামে নাই; আপনি নিজেও এসব কখনও শুনেন নাই এবং আপনার আগের লোকেরাও কখনও শুনে নাই। তারা এসব বানাচ্ছে এবং তারা মিথ্যা বলছে। এবং সে জন্যই তাদেরকে মিথ্যাবাদী(ভানকারী) বলা হবে। এখানে দাজ্জাল মানে মুলত দক্ষ্যতার সাথে চরম মিথ্যাচার । 

রাসুলুল্লাহ(স) আমাদেরকে তাদের সম্পরকে সতর্ক করে দিচ্ছেন, এবং এই জন্যই দীন সম্পর্কিত তথ্য যাচাই করে নেয়া গুরুত্বপূর্ণ । যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারন আমাদের অন্ধ অনুকরন করা উচিত নয়। যত বড় নামকরা আলেমই হোক না কেন, যাচাই না করে শুধুমাত্র শুনেই কোন কিছুর অনুকরন করা উচিত নয়। 

ঠিক যেভাবে ইমাম মালেক বলেছেন, তোমাদের সবাই ই কথার হেরফের কর, শুধুমাত্র যিনি কবরে আছেন(রাসুলুল্লাহ(স)) তিনি ব্যতীত।  রাসুলুল্লাহ(স) ব্যতীত, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার কথা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিতে হবে। কিন্তু অন্য সবার ক্ষেত্রেই, সে যতবড় জ্ঞ্যানীই হোক না কেন, আমরা তাদের কিছু কথা গ্রহন করব এবং কিছু ছেড়ে দিব। 

এবং বিশেষ করে যখন হাদিসের অনেক ভুল ব্যখ্যা ছড়িয়ে পড়ে তখন এই বিষয়ে আরও সতরক হওয়া দরকার। হাদিসকে মানুষ জাল করতে পারে, কেউ কুরান কে জাল করতে পারে না। কুরান অতিরঞ্জিত নয়। হাদিসকে মানুষ জাল করে, তবে হাদিসও সংরক্ষিত হতে পারে, যদি আমরা আমাদের প্রচেষ্টা ব্যয় করি , আমরা যেভাবে এতক্ষন শুনছিলাম। 

আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন,(মুসলিম) শয়তান নিজেকে একজন মানুষরুপে এভাবে উপস্থাপন করবে এবং মানুষের সাথে এমনভাবে কথা বলবে যে তারা এটা শুনবে এবং এরপর একেবারে হৃদয় দিয়ে এটা জানাবে,প্রচার করে বেড়াবে কিন্ত তারা সেগুলো যাচাই করে নি, তারা শুধু তার চেহারাটা দেখেছে, কিন্তু সে ব্যক্তি কে সেটা আমার জানা নাই। এবং শুধু তথ্যগুলো বহন করে নিচ্ছে। তাই আমদের উচিত আমরা মানুষকে যা জানায় তা যাচাই করে নেয়া, কারন এটা সত্য নাও হতে পারে। মানুষের মাঝে অনেক ছড়িয়ে যাওয়া প্রচলিত ভুল রয়েছে, যা কিনা অবিশ্বাস্য । মানুষের মধ্যে এমন অনেক কিছু ছড়িয়ে পড়েছে যার ধর্ম ভিত্তিক কোন দলিল নাই।

 

৩৪নং আলামত আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবন আস বলেন, সাগরের মধ্যে বন্দি কিছু শয়তান আছে এবং তারা বন্দি হয়েছিল সুলাইমান(আ) এর দ্বারা। এমন একটা সময় আসবে যখন তারা বের হয়ে আসবে এবং মানুষের কাছে আবৃত্তি করবে, বলবে এগুলো কুরআন। কুরান বলতে সাধারনত যে কোন কিছু যা আবৃত্তি করা হয় বুঝানো হয়, কিন্তু এই হাদিসে কুরানকে বুঝানো হয় নাই। এই শয়তান গুলো সাগর থেকে বেড়িয়ে আসবে এবং কিছু শব্দ আবৃত্তি করবে এবং বলবে যে এসব ওয়াহী, পবিত্র গ্রন্থ থেকে। তারা বলবে যে এটা পবিত্র ধর্মশাস্ত্র, পবিত্র গ্রন্থ।

তারা হয়তোবা এটাকে কুরআন ও বলবে, কিন্তু কেউ এটাকে কুরআন হিসেবে বিশ্বাস করবে না কারন কুরআন সংরক্ষিত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, আমরা কুরআন নাজিল করেছি, আমরাই এটার সংরক্ষন করব। আল্লাহ এটা সংরক্ষনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

 

৩৫নং আলামত –  মিথ্যা সাক্ষ্যঃ আহমেদ বর্ণিত এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ(স) বলেন, কেয়ামতের আগে মানুষ মিথ্যা সাক্ষ্য দিবে। মানুষ বিচারালয়ে যাবে এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দিবে এবং যারা সত্য ঘটনা জানবে তারা তা গোপন রাখবে। এবং এসব কখন ঘটবে? এটা হবে সমাজের অবক্ষয়, কারন সে সমাজই কখনোই পুরো পুরি ন্যায়ের উপর ছিল না।

ন্যায় পরায়নতাই একটি সমাজকে টিকিয়ে রাখে। যখনই এটা দূর হয়ে যায়, মানুষের জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠে। তুমি যদি মানুষের দুর্দশার কথা চিন্তা করেন দেখতে পাবেন যেখানে ন্যায়ের চর্চা যত কম, সেখানে জীবন যাপনের অবস্থা তত খারাপ, এমনকি তাদের অনেক সম্পদ থাকলেও । এখানে টাকা পয়সা ব্যপার না। মানুষের নিরাপত্তা ও মনের শান্তি ন্যায় পরায়নতার উপর নিরভর করে। এবং এটা খুবই খারাপ সময় যখন মানুষ মিথ্যা সাক্ষ্য দিবে, এবং সুবহানাল্লাহ, ন্যায়পরায়নতার এত গুরুত্বের কারনেই মানুষের মিথ্যা সাক্ষ্যদানকে প্রধান ৭ টি গুনাহর একটি করা হয়েছে।

 

৭ টি গুনাহ হচ্ছে মারাত্মক, এর মধ্যে একটি হচ্ছে মিথ্যা সাক্ষ্যদান। আর যখন রাসুলুল্লাহ(স) প্রধান ৭ টি গুনাহ নিয়ে কথা বলছিলেন, যেমন শিরক, বিদাত, সুদ , তিনি কিছুটা ঝুঁকে বসে ছিলেন, এবং এরপর তিনি সরাসরি বললেন, মিথ্যা সাক্ষ্য! মিথ্যা সাক্ষ্য! মিথ্যা সাক্ষ্য! এভাবে তিনি কয়েকবার একই কথা বললেন। রাসুলুল্লাহর সাহাবীগন বলেন, রাসুলুল্লাহ এর উপর অনেক বেশী জোড় দিয়েছেন এবং এটা বলার সময় ওনাকে চিন্তিত লাগছিল। কারন মিথ্যা সাক্ষ্যদান সম্পরকে রাসুলুল্লাহর অনেক উদ্বেগ ছিল। এটা প্রধান ৭টি গুনাহর একটি! এটা মানুষের ভাল কাজগুলোকেও ধংস করে দেয়। এই গুনাহগুলো মানুষের নেক কাজগুলো নষ্ট করে দেয়। মিথ্যা সাক্ষ্যদান এতটাই মারাত্মক।

এরপর আছে যদি আপনি সত্য জানা সত্বেও তা গোপন রাখেন। আপনি যদি সত্য জানেন এবং তা না বলেন, তখন এটাও একটা পাপ।

৩৫নং আলামত – পুরুষ ও নারীর সংখ্যার অনুপাত বৃদ্ধি পাবেঃ আল বুখারী বর্ণনা করেন, রাসুসুল্লাহ বলেছেন, কেয়ামতের একটি লক্ষণ হচ্ছে এমন ভাবে নারীর সংখ্যা বাড়বে এবং পুরুষের সংখ্যা কমবে যে প্রতি ৫০ জন নারীর জন্য একজন পুরুষ থাকবে। এদের সংখ্যার পার্থক্য এতটাই বেশী হবে, ৫০ জন নারীর জন্য ১ জন পুরুষ। এবং ইমাম নববী এই হাদিসের বরাতে বলেছেন, এর কারন হচ্ছে সভ্যতার বিপ্লবের জন্য অনেক যুদ্ধ হবে, অনেক পুরুষ মানুষ নিহত হবে কারন পুরুষরাই হচ্ছে যোদ্ধা। পুরুষরা দুনিয়া জুড়ে বিভিন্ন যুদ্ধে নিহত হবে, এই কারনেই নারীর সংখ্যার সাথে পুরুষের সংখ্যার একটি বড় পার্থক্য হবে, ৫০ জন নারী আর ১ জন পুরুষ।

 


৩৭নং আলামত – হঠাত মৃত্যুঃ আত তাবরানী বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ(স) বলেন, কেয়ামতের আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে হঠাত মৃত্যু । অনেক মানুষ হুট করে মারা যাবে। এটা হতে পারে হারট এটাক,স্ট্রোক,এখানে কোন বাহ্যিক দুর্ঘটনার কথা বলা হয় নি, এখানে মানুষের শরীরের ভেতরের কোন হঠাত সৃষ্ট কারনকে বুঝানো হয়েছে। হার্ট এটাক বা স্ট্রোক। আর এসব হচ্ছে আধুনিক সমাজের মানুষের রোগ। এসব প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত এলাকার মানুষের অসুস্থতার কারন। 
প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত এলাকার মানুষের কাছে এখন হার্ট এটাক বা স্ট্রোক মহামারী বা অনেক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এর কারন মানুষ এখন চলাফেরা করে না, বসে বসে কাজ করে। এখন মানুষ এভাবেই কাজ করছে। আগের মানুষেরা কাজে যেত, কাজ করত, অনেক পায়ে হাটতে হত, ব্যাবসায়ীদেরা অনেক ভ্রমন করত, একারনেই এখন মানুষের জীবন যাত্রায় অনেক পরি বরতন এসেছে। তাই এটা আধুনিক সমাজের একটি সমস্যা। 

আগের মানুষের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের জীবনযাত্রার ধরনটাই তাদেরকে করমক্ষম রাখত। আগের যুগের ইতিহাসে আপনি কোন বিনোদনের কেন্দ্র খুজে পাবেন না। তোমার কোন ওজন কমানোর ঘর, জিম ছিল না। আর এখন মানুষ সকাল ৬টায় প্রাত ভ্রমনে বের হয়। মানুষ কি চন্তা করে কেন সে এভাবে দৌড়াচ্ছে? কিন্তু মানুষ এখন এই কাজগুলো করে বিনোদনের মাধ্যমে। অতিতের কোন বইয়ে মানুষের ব্যায়ামের কথা পাওয়া যায় না। এখন মানুষ দৌড়াচ্ছে, ওজন কমাচ্ছে, এসবকে ঘিরে ব্যাবসা শুরু হয়েছে, এখন আমেরিকার অন্যতম বড় ব্যাবসা হচ্ছে সাস্থ্য ও ফিটনেসের। কেন? মানুষের জীবন যাত্রার কারনে । আর এই ধরনের জীবন যাপনই হঠাত মৃত্যুর কারন হচ্ছে। আগের যুগে মানুষ প্রক্রিতিগত ভাবেই অনেক শক্তিশালী ছিল, তখন কোন গাড়ী ছিল না, ঊড়োজাহাজ ছিল না, মানুষ পায়ে হেটে অনেক দুরের পথ, শত শত মাইল পাড়ি দিত।

 

৩৮নং আলামত – রাসুলুল্লাহ(স)কে কেয়ামতের সময় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, এই সময় সম্পর্কে শুধুমাত্র আল্লাহই জানেন, তবে আমি কিছু আলামতের কথা বলতে পারি। অনেকগুলো আলামতের একটি হবে ফিতনা এবং হারজ। সাহাবীগন বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমারা ফিতনা সম্পরকে জানি, কিন্তু হারজ মানে কি? রাসুলুল্লাহ(স) বলেন, (আবিসিনীয় ভাষা) এর মানে হত্যা করা। ব্যপক, পাইকারী হারে হত্যাযজ্ঞ।

 

এরপর রাসুলুল্লাহ(স) বলেন, মানুষ একে অপরকে চিনবে না, অপরিচিত। এই অপরিচিত অবস্থা কেমন হবে?
 মানুষ একে অপরের নাম পরিচয় জানবে না এমনটি তিনি বলেন নি বরং, মানুষ একে অপরের সাথে এমন ভাবে কাজকর্ম করবে যে তারা একে অপরের কাছে অপরিচিত ঠেকবে। 

শত্রুতা, মানুষের মাঝে শত্রুতা। আপনি হয়তোবা একজন মানুষকে খুব ভাল করে চিনেন,নাম কি পরিচয় কি? কোথায় থাকে কি করে ইত্যাদি আপনি জানেন, কিন্তু আপনি তার সাথে এমন আচরন করবেন যেন সে অপরিচিত, কেউ না, এভাবেই মানুষ একে অপরের সাথে আচরন করবে। এটা জঙ্গলের কৃষ্টি, জংলী কৃষ্টি। আর সেই সময়েই মানুষ অনেক বেশী শত্রুভাবাপন্ন হয়ে পড়বে। 
সাহাবাগন এটা সম্পর্কে জানতেন তাই তারা একে অপরকে এটা সম্পর্কে সতর্ক করতেন এবং উপদেশ দিতেন।  

মুয়ায ইবন জাবাল এবং আবু উবাইদাহ বিন যাররাহ, তারা উমর ইবন আল খাত্তাব রা) কে একটা পত্র লিখে পাঠালেন, এটা সম্পর্কে তাকে উপদেশ দিয়ে, এবং এটা তাবারানী বর্ণিত হাদীস, 

নুয়াইম ইবন আবি হিন্দ, তাঁর সাথে একটি পত্র প্রেরণ করা হয়েছিল, আর এটা প্রেরণ করা হয়েছিল মুয়ায ইবন জাবাল এবং আবু উবাইদাহ বিন যাররাহ রা) এর পক্ষ হতে, উমর (রা) এর প্রতি ;

এবং তারা তাকে একটা উপদেশ দিচ্ছিলেন, তারা বলেছিলেন, আমরা আমাদের মাঝে এই উম্মাহর শেষের সময় সম্পর্কে কথা বলছিলাম, যখন মানুষ  ভাই ভাই থাকবে জনসম্মুখে আর শত্রু হবে গোপনে । তারা উমার ইবনে খাত্তাবকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, মানুষ মানুষ জনসম্মুখে ভাই ভাই থাকবে তারা পরস্পর মুলাকাত করবে, তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরবে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে(মনে মনে মুলত) তারা শত্রু।

 

উমার ইবনে খাত্তাব উত্তরে বললেন, তোমরা আমাকে চিঠিতে বলেছ মানুষ জনসম্মুখে ভাই ভাই থাকবে আর গোপনে শত্রু হবে, কিন্তু সেই মানুষ তোমরা নও আর এই সময়টিও এখন নয়। এটা সেই সময় সম্পরকে বলা হয়েছে যখন মানুষের আগ্রহ শুধুমাত্র সেই বিষয়েই থাকবে যাতে তাদের কিছু দুনিয়াবি লাভ হয়। আমি তোমার প্রতি আগ্রহী হব, শুধুমাত্র যদি এতে আমার কোন দুনিয়াবি লাভ থেকে থাকে। এটা ব্যবসায়ীক সম্পর্ক, শুধুমাত্র দুনিয়ার লাভের জন্য এই সম্পর্ক, এর ভেতর আল্লহর জন্য কিছুই নাই।

এই সম্পর্ক আল্লাহর উপর ভিত্তি করে নয়, এটা হবে শুধুমাত্রই দুনিয়াবি সারথের কারনে। আর আমরা এর অনেক প্রতিফলন এখন দেখছি। আল্লাহরকে ভালবাসার কারনে গঠিত সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। সম্পর্ক গুলো টাকা এবং এই দুনিয়ার সাধারন সারথের উপর ভিত্তি করে হচ্ছে। আর এ কারনেই মানুষের মনের মিল নেই।

 এই দুনিয়ার সারথের উপর ভিত্তি করে যাই হোক না কেন, বেশী দিন তা টিকবে না, আর যা কিছু আখিরাতের উপর ভিত্তি করে, তা টিকে থাকবে। 

মানুষের মন বিভিন্ন দিকে ছুটছে, কুরানেও এমনটি বলা হয়েছে। وَقُلُوبُهُمْ شَتَّى –শাত্তা মানে শতধাবিচ্ছিন্ন 
‘তাদের অন্তর শতধাবিচ্ছিন্ন’

কারন প্রতিটি মানুষই দিগ্বিদিক ছুটছে। আখিরাতের দিকই হচ্ছে একমাত্র ইউনিফাইদ পথ।কিন্তু দুনিয়াতে সব সময়ই আমার আর তোমার স্বার্থএর ভেতর বিরোধ হবে। এটাই ঘটবে। কিছু সময় হয়তবা এসব নিয়ে ঝামেলা হবে না, আবার মাঝে মাঝে হবে। এ কারনেই সব সময় সবার জয় হবে না। এমন হবে কারন স্বার্থগুলো পরম্পরবিরোধী। মানুষ যদি একজন আরেকজনের সাথে এভাবে প্রতিযোগিতা(ধাক্কাধাক্কি) করে তাহলে দুনিয়াটা দুরনিতিতে ভরে যাবে। 

আল্লাহ বলেন,  وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا 
আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে (খ্রীষ্টানদের) নির্ঝন গির্জা, এবাদত খানা, (ইহুদীদের) উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত, যেগুলাতে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়।
(হাজ্জ ৪০) 

যদি জিহাদের মাধ্যমে আল্লাহ এক দল মানুষ দ্বারা আরেক দলকে প্রতিহত না করতেন তাহলে তা একে অপরকে ধ্বংস করে ফেলত। কারণ, দুনিয়াবী বিষয়ে প্রতিযোগিতায় একে অপরের সাথে স্বার্থের সঙ্ঘাত হয়ে থাকে,আর আখিরাতের বিষয়ে প্রতিযোগিতায় একে অপরের সহযোগীতা হয়ে থাকে। 

এভাবে যখন অবস্থা পরম্পরবিরোধী হয়ে যায়, তখন একজন অপরজনের উপরে জয়ী হয়। উমার ইবনে খাত্তাব তাদেরকে বলেন, চিন্তা করো না , এইটা সেই যুগ নয়। এটা সেই সময় না, সেটা হবে ভবিষ্যৎ এ ।