পরকালের পথে যাত্রা – পর্ব ০৭ – কিয়ামতের ছোট লক্ষণ ৩৯-৫২


৩৯ নং আলামত – আরব উপদ্বীপ আবার নদ-নদী এবং গাছপালায় পূর্ণ হয়ে যাবেঃ

এইখানে ‘আবার’ কথাটা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।

ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

ততদিন পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা যে পর্যন্ত না আরব উপদ্বীপ আবার গাছপালা ও নদী-নালায় পূর্ণ হবে।

বর্তমানে আরব উপদ্বীপে কোন নদী-নালা নেই। গাছপালার সংখ্যা খুবই কম। চাষাবাদের উপযোগী ভূমির পরিমাণ অতি নগণ্য। কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে আরব উপদ্বীপের পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে যাবে এবং তা গাছপালা ও নদী-নালায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।

এমন দিন আসবে যখন,আরব উপদ্বীপ নদ-নদী এবং গাছপালায় পূর্ণ হয়ে যাবে। ঐ ভুমি, আদ অঞ্চল ও আরবের অন্য অংশগুলো নিয়ে গঠিত হবে।নবী (সাঃ) বলেছেন যে, আরব উপদ্বীপ এমন অবস্থায় ‘ফিরে’ যাবে।অর্থাৎ আগে কখনো তা এই অবস্থায় ছিল।এটি হাদিসের  অলৌকিকতার একটি বৈজ্ঞানিক প্রমাণ। বর্তমানে, বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে জানতে পারেন যে সেসময় আরবের কিছু অঞ্চলেও যেমন – ইয়েমেনের পূর্ব দিকে এবং সৌদি আরবের দক্ষিণ পশ্চিমে নিরক্ষীয় বনাঞ্চল এবং অনেক নদী এবং অববাহিকার অস্তিত্ব ছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় Ice age(তুষার যুগ) এ। Ice Age (তুষার যুগ) এর শেষের দিকে, উত্তর ও দক্ষিণ মেরু তুষারাচ্ছন্ন ছিল। তাই আরব উপদ্বীপে সেসময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হত এবং সেখানে বিস্তৃত বনভূমি ছিল। ধীরে ধীরে হিমবাহ সমূহ গলে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং বনাঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থানও পরিবর্তন হতে থাকে। এবং ধীরে ধীরে এই অঞ্চলটি মরুভূমিতে পরিণত হয়।

কিভাবে তা সম্ভব যে আবার,আরব উপদ্বীপ নদ-নদী এবং গাছপালায় পূর্ণ হয়ে যাবে? আল্লাহু আলাম, হয়ত কোন জলবায়ুর পরিবর্তন অথবা অন্য কোন ভাবে।এমনটা এখনও হয়নি।

অনেকের মতে এমনটা হয়েছে, সৌদি আরব, দুবাই এর মত কিছু শহরের উন্নতির কারনে।তাদের মতে কৃষিকাজের উন্নতির কারনে, আবার আরব উপদ্বীপ গাছপালায় পূর্ণ হয়ে যাবে। আল্লাহু আলাম, এমনটা হয়নি এখনও।

৪০ নং আলামত –  অধিক বৃষ্টিপাত সত্ত্বেও উৎপাদন কমে যাওয়াঃ

রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,”বিচারদিবস ততক্ষণ পর্যন্ত আসবেনা যতক্ষণ না অধিক বৃষ্টিপাত হওয়া সত্ত্বেও  ফসল হবেনা।”

অর্থাৎ বৃষ্টির স্বল্পতা হবেনা কিন্তু ফসলের অভাব হবে। এটা কেন হবে? হয়ত এ কারণে যে মানুষ দুনিয়াতে এত খারাপ কাজ করবে যে জমিগুলোতে আর বারাকাহ থাকবেনা। ওয়াল্লাহু আলাম।

৪১ নং আলামত –  ফোরাতের নিচে স্বর্ণের পাহাড় আবিষ্কারঃ কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে ফোরাত নদী থেকে একটি স্বর্নের পাহাড় আবিষ্কৃত হবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “শীঘ্রই ফোরাত নদীর নিচে স্বর্ণের পাহাড় আবিষ্কৃত হবে আর তোমাদের কেউ সে সময়ে উপস্থিত থাকলে যেন তা থেকে কিছু না নেয়।”[বুখারি]

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,”ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত আসবেনা যতক্ষণ না ফোরাতের নিচ থেকে স্বর্ণের পাহাড় আবিষ্কৃত হয় যার জন্য মানুষ মারামারি করবে। তাদের  ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জনই মারা যাবে কিন্তু তারা প্রত্যেকেই ভাববে সেই হবে সৌভাগ্যবান সেই জন যে বেঁচে যাবে আর স্বর্ণের মালিক হবে।”[মুসলিম]

৪২ নং আলামত – পশু এবং বস্তুর কথা বলাঃ ইমাম আহমাদ হতে বর্ণিত যে এটি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সময়ে ঘটেছিল। আবু সাঈদ আল খুদরি (রাঃ) বলেন যে একজন মেষপালকের পালে একটি নেকড়ে  আক্রমণ করে এবং একটি ভেড়া অথবা ছাগল নিয়ে পালিয়ে যায়। তখন সেই মেষপালক নেকড়েটিকে অনুসরণ করে এবং ভেড়াটি নেকড়ে হতে ছিনিয়ে আনে। তখন নেকড়েটি লেজের উপর বসে মানুষের মত করে বলে উঠে,”আল্লাহকে ভয় কর। তুমি আমার মুখ থেকে সেই খাবার কেড়ে নিচ্ছ যা আল্লাহ্আমাকে দিয়েছেন। মেষ পালকটি বলল, অদ্ভূত! একটা নেকড়ে মানুষের মত কথা বলছে! তখন নেকড়েটি বলল আমি তোমাকে আরো অদ্ভূত কথা বলতে পারি। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  ইয়াসরিবে আছেন এবং সেখানকার লোকেদের কে বিগত জাতিগুলার ব্যাপারে শিক্ষা দিচ্ছেন। 

মেষপালকটি যে কিনা তখনো মুসলিম হয়নি সে দ্রুত মদীনায় গিয়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  এর সাথে দেখা করল এবং তাকে সবকিছু খুলে বলল। তিনি(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল সাহাবাদেরকে একত্রিত করলেন এবং সেই মেষপালককে বললেন যে ঘটেছে তা  বর্ণনা করতে। তখন সে সব কিছু খুলে বলে এবং তারপর রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “বিচার দিবস তার আগে সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না পশুরা তোমাদের সাথে কথা বলে এবং বেত এমনকি তোমাদের পা আর তাতে পরিহিত জুতো ও তোমাদের সাথে কথা বলে। ” রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে এমন সময় আসবে যখন কিছু জিনিস কথা বলবে এমন না যে সব কিছু কথা বলবে।

আল্লাহু আলাম আমরা সাধারণত কোন কিছুর আক্ষরিক অর্থ নিয়ে থাকি যদিনা অন্যথা প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই এখানেও আমরা আক্ষরিক অর্থই গ্রহণ করব।

৪৩ নং আলামত –  মৃত্যুর ইচ্ছা বৃদ্ধিঃ  রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা যতক্ষণ না একজন মানুষ কারো কবরের পাশ দিয়ে হেটে যায় এবং বলে,”যদি আমি তার জায়গায় থাকতাম!””[বুখারী]

মুসলিম থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,”এমন একটা সময় আসবে যখন একজন মানুষ একটা কবরের পাশ দিয়ে যাবে এবং তাকিয়ে বলবে ,”যদি আমি তার জায়গায় থাকতাম!”‘  সাধারণত মানুষ ঋণে জর্জরিত হলে মরে যেতে চায়।তবে রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন যে এটা ঋণের কারণে নয়।

ইবন মাসুদ(রাঃ) বলেন,”এমন সময় আসবে যদি মৃত্যু বিক্রি করা হত তবে মানুষ তা কিনত।”

আল হাফিয আল ইরাক্বী এই হাদিসটির একটি সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন যে সাধারণত অনেককেই মরার ইচ্ছা প্রকাশ করতে দেখা যায় কিন্তু যখন মানুষ কারো মৃত্যু দেখে অথবা কবরস্থানে যায় তখন আর কেউ মরতে চায়না। আমরা যখন চোখের সামনে মৃত্যু দেখি তখন সেটাকে ঘৃণা করি। আল ইরাক্বী বলেন যে তারা(এই হাদিসে বর্ণিত মানুষেরা) চোখের সামনে মৃত্যু দেখেও মৃত্যু কামনা করবে। এ থেকে বুঝা যায় যে তারা খুব খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাবে। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে সেই সময় হতে নিরাপত্তা চাই।

এই ফিতনা গুলো মানুষের জন্য হয় পরীক্ষা নয়ত শাস্তিস্বরুপ।

৪৪ নং আলামত – রোমানদের সংখ্যা বৃদ্ধিঃ

মুসলিম হতে বর্নিত একটি হাদিসে রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “শেষ বিচারের দিন উপস্থিত হবে এবং রোমানরা সংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম জাতি হবে।” রোমান কারা?- এরা হল ইউরোপিয়ানরা যারা ল্যাটিন আমেরিকা, কানাডা, আমেরিকা প্রভৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত-

এদেরকে ককেশিয়ান ও বলা হয়।

এই হাদিসটি কি বোঝায়? এটাকি ভাল লক্ষণ নাকি খারাপ? আল্লাহু আলাম। এরা কি  মুসলিম নাকি অমুসলিম? আল্লাহু আলাম।

আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে ইউরোপের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেয়েছে। কোন কোন দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখন ঋণাত্মক।

সুবহানআল্লাহ্‌! এটি এমন একটি পরিবর্তন যা এখনো ঘটেনি।

আর-রুম বলতে অমুসলিমদের বোঝানো হয়না এরা মুসলিমও হতে পারে। পরবর্তী আলামতটি থেকে আমরা জানতে পারব যে তাদের একাংশ মুসলিমও থাকবে।

৪৫ নং আলামত – রোমানদের সাথে যুদ্ধঃ এই রোমান কারা? রোমানরা ছিল রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর সময়কার একটি রাজনৈতিক শক্তি যা ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু অংশ শাসন করছিল। সেসময় পৃথিবীতে দুটি প্রভাবশালী সাম্রাজ্য ছিল। একটি হোলো পারস্য সাম্রাজ্য আরেকটি রোমান সাম্রাজ্য। ইরাক, আরবের পূর্বাঞ্চল,ইরান এবং মধ্য এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। রোমান সাম্রাজ্যে ছিল বর্তমান কালের তুরস্ক,সিরিয়া,,ফিলিস্তিন, জর্ডান,লেবানন,ইরাকের পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্ব ইউরোপ।এটি ছিল পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্য যা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। এছাড়াও রোমান সাম্রাজ্যের আরেকটি অংশ ছিল যার রাজধানী ছিল ইটালির রোমে। তাই আজকের দিনে আর-রুম বলতে বোঝায় ইউরোপ কিংবা ইউরোপের বর্ধিতাঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিমা দেশগুলোকে। আমরা এখন যে হাদিসটি নিয়ে কথা বলবো তা দুটি জিনিস নির্দেশ করে। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে যে এটি ভবিষ্যতে মুসলিমদের সাথে  রোমানদের বিশাল যুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে তাদের মধ্যেও অর্থাৎ রোমানদের মধ্যেও অনেক মুসলিম থাকবে। মুসলিমরা একটি রাজনৈতিক শক্তির সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে কিন্তু সেই সময় একই সাথে অনেক রোমান থাকবে যারা মুসলিমদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করবে। তারাও মুসলিম হবে। এ থেকে বোঝা যায় যে ইসলাম পশ্চিমে অনেক বিস্তার লাভ করবে। এই হাদিসটি বুখারি থেকে বর্ণিত। এই বিষয়ে একাধিক হাদিস রয়েছে। তার মধ্যে একটি সম্পর্কে আমরা আগেই আলোচনা করেছি যেখানে রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন, বিচার দিবসের ছয়টি লক্ষন গুণে রাখ। তার মধ্যে একটি হচ্ছে যে তোমাদের সাথে রোমানদের একটি শান্তিচুক্তি হবে। কিন্তু একসময় তারা সেই চুক্তি ভংগ করবে এবং তোমাদের উপর আক্রমণ করবে। রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন তারা ৮০ টি পতাকা নিয়ে অর্থাৎ ৮০টি সেনাবাহিনী একত্রিত করে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। প্রতিটি সেনাবাহিনীতে থাকবে ১২০০০ সৈন্য। অর্থাৎ মোট সৈন্য সংখ্যা হবে ৯৬০০০০!

আরেকটি হাদিসে রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন, তোমাদের আরবদের সাথে যুদ্ধ হবে এবং তোমরা জয়লাভ করবে। এরপর তোমাদের সাথে পার্সিয়ানদের যুদ্ধ হবে এবং তোমরা জয়ী হবে। এরপর তোমরা রোমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবে এবং আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে বিজয় দান করবেন। এবং তারপর তোমরা দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবে এবং আল্লাহ্‌ তোমাদের বিজয় দান করবেন। তাই নাফা (একজন সাহাবি) জাবেরকে বলেন সুতরাং রোমানদের সাথে আমাদের যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে দাজ্জাল আসবেনা। এই হাদিসের মানে এই নয় যে এই যুদ্ধ গুলো পর পর ঘটতে থাকবে। এগুলোর একেকটার মাঝে শত শত বছরেরও ব্যবধান থাকতে পারে। কারণ আমরা জানি আরবদের সাথে যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জীবদ্দশায়ই জয় লাভ করা হয়েছিল এবং সমগ্র আরব উপদ্বীপই ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল। আর পারস্য সাম্রাজ্য খলিফা উমরের সময় ইসলামী শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। এবং তারপর থেকে রোমানদের সাথে অনেক যুদ্ধ হয় যা এখনো চলছে। এবং একটি হাদিস রয়েছে যদিও তা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন, পারস্য সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে দুটি ধাক্কাই তাদের শেষ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু রোমানদের অবস্থা অনেক শিং ওয়ালা দৈত্যের মত। একটি শিং ভেংগে দিলে আরেকটি শিং গজিয়ে উঠবে। সুবহানআল্লাহ্‌! এমনটাই ঘটেছে। পার্সিয়ানদের সাথে দুটি বড় যুদ্ধ হয় এবং তাই যথেষ্ট ছিল। প্রথমটি ছিল আল ক্বাদিসিয়ার যুদ্ধ আর অপরটি ছিল নাহওয়ানের যুদ্ধ। আর এতেই পারস্য সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু রোমানদের ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে এটি যেন এক অনন্ত মোকাবিলা। সকল খলিফা দের সময়ই এই যুদ্ধ চলছিল। রোমানদের সাথে যুদ্ধ রাসুলুল্লাহ(সঃ) এর সময় থেকেই শুরু হয়েছিল। তাবুক এবং মুতার যুদ্ধ রোমানদের বিরুদ্ধেই ছিল।  আবু বকর(রাঃ) উসামা বিন জায়েদের নেতৃত্বে রোমানদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। তারপর উমার (রাঃ) ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তারপর উসমান(রাঃ) ও। তারপর মুয়াবিয়ার সময় থেকে শুরু করা উমাইয়া খলিফা এবং আব্বাসীয় খলিফাদের সময়েও এই যুদ্ধ চলমান থাকে। তারপর অনেক পরে মুহাম্মাদ আল ফাতিহ এর হাতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন হয়। কিন্তু তারপর পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য এগিয়ে আসে এবং উসমানি(অটোমান) সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। উসমানি সাম্রাজ্য তার অস্তিত্বের শুরু থেকে প্রায় শতাব্দীকাল ধরে রোমানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। পরবর্তীকালে মুসলিম ভূমিতে দখলদারিত্বে নেতৃত্ব দেয় বৃটেন, ফ্রান্স এবং ইটালি। তাই এটি একটি দীর্ঘ শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। যখনই তাদের একটা শিং ভেংগে দেয়া হয় আরেকটি গজিয়ে উঠে।

মুসলিম থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন,  কিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত আসবেনা যতক্ষণ না রোমানরা সিরিয়ার আল-আমাক বা দাবাক নামক জায়গায় আক্রমণ করে। তখন মদিনা থেকে একটি সেনাবাহিনী সেখানে যাবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন, তারা হবে তাদের সময়ের পৃথিবীর সর্বোত্তম মানুষ।  তারা যখন যুদ্ধের জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে যাবে তখন রোমানরা বলবে আমাদের হাতে তাদেরকে ফিরিয়ে দাও যাদেরকে তোমরা যুদ্ধবন্দি হিসাবে আটক করেছো। রোমান সেনাবাহিনীর কিছু অংশ মুসলিমদের সাথে থাকবে এবং তাদেরকে রোমানরা ফেরত চাইবে যাতে তারা তাদেরকে হত্যা করতে পারে। কেন রোমানরা এই রোমানদেরকে হত্যা করতে চাবে? কারণ এই রোমানরা মুসলিম হয়ে যাবে। তখন মুসলিমরা বলবে, আল্লাহ্‌র শপথ! আমরা কখনোই আমাদের ভাইদেরকে তোমাদের হাতে তুলে দিবনা। দেখুন ইসলাম শত্রুদেরকে ভাই এ পরিণত করেছে। এই রোমানরা মুসলিমদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছে কিন্তু পরবর্তীতে তারা মুসলিম হয়ে যায় এবং তাদের পক্ষ হয়েই যুদ্ধ করবে।

তারপর যুদ্ধ শুরু হবে। এই রোমান সেনাবাহিনীটি হবে অত্যন্ত শক্তিশালী এবং  যুদ্ধ হবে রক্তক্ষয়ী। এই যুদ্ধে মুসলিম সেনাবাহিনীর এক তৃতীয়াংশ পালিয়ে যাবে এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, আল্লাহ্‌ কখনো এদের তাওবা কবুল করবেন না। কারণ যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া একটি কবিরা গুনাহ। এবং এই মুসলিম বাহিনীর আরেক তৃতীয়াংশ নিহত হবে এবং আল্লাহ্‌র কাছে এরাই হবে শ্রেষ্ঠ শহীদ। অবশিষ্ট এক- তৃতীয়াংশ যুদ্ধে জয়লাভ করবে এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন, এরা কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা। আল্লাহ্‌ এদেরকে দীনের উপর স্থিরতা দান করবেন। এরাই কন্সটান্টিনোপল জয় করবে। কন্সটান্টিনোপল হচ্ছে বর্তমান ইস্তাম্বুল যা আগে একবার মুহাম্মাদ আল ফাতিহ জয় করেছিলেন। কিন্তু প্রেক্ষাপট আবার বদলাবে।  এবং এই মুসলিম বাহিনীটি আবার কন্সটান্টিনোপল জয় করবে। এ থেকে বুঝা যায় যে কিছু মুসলিম ভূমি আবার রোমানরা দখল করবে। এই বিজয়ের পর তারা একটি খবর শুনতে পাবে যে আল-মাসীহ আদ-দাজ্জাল বের হয়ে এসেছে। এ থেকে আমরা আরো বুঝতে পারি যে এই ঘটনাগুলো দাজ্জালের সময়ের খুব কাছাকাছি হবে। এরপর রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন যে এরপর ঈসা (আঃ) ফিরে আসবেন। এ বিষয়ে শেষ হাদিসটি আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, যে ‘ফুসতাত’ অর্থাৎ মুসলিমদের তাঁবু বা মিলিটারি ক্যাম্প আল-গুতা নামক জায়গায় থাকবে যা দামাস্কাসের পাশে অবস্থিত এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ) আরো বলেন, তখন আশ-শামের শ্রেষ্ঠ শহর হবে দামাস্কাস। তাই তখন মুসলিম সেনাবাহিনীর ঘাঁটি হবে দামাস্কাস।

৪৬ নং আলামত –  কন্সটান্টিনোপোল বিজয়ঃ আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্নিত আল্লাহ্‌র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবিদের জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা কি সেই শহরের (কন্সটান্টিনোপোল) কথা শুনেছ যার এক অংশ স্থলে আরেক অংশ সমুদ্রে?” তারা বলল,”হ্যা আল্লাহ্‌র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)”যদি আলেমগণ এটি ব্যাখ্যা না করতেন তবে কেউ হয়ত ভাবত যে এখানে ইউরোপের কোন শহরের কথা বলা হচ্ছে যার এক অংশ স্থলে অপর অংশ জলে যেমন ইটালির ভেনিস। ভেনিসের এক অংশ পানিতে এবং বাকিটা স্থলে। কিন্তু হাদিস বিশারদগণ এ বিষয়ে একমত যে এখানে কন্সটান্টিনোপলের কথা বলা হচ্ছে। এটি এভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে ইস্তাম্বুলের এক অংশ এশিয়াতে এবং এক অংশ ইউরোপে। এবং এই দুই অংশের মাঝখানে রয়েছে বসফরাস প্রণালী। তাই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেন যে এর এক অংশ সমুদ্রে এবং অপর অংশ স্থলে। তখন তিনি বলেন,”ততক্ষণ পর্যন্ত শেষ সময় আসবেনা যতক্ষণ না বনী ইসরাইলের সত্তর হাজার বংশধর সেই শহর আক্রমণ করে। সেখানে পৌছে তারা অস্ত্র দিয়ে কিংবা তীর ছুঁড়ে লড়াই করবেনা। তার শুধু বলবে,”লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার!” তাতেই শহরের একাংশ ধসে পড়বে। সাউর(একজন বর্ণনাকারী) বলেন ,”আমি মনে করি এটি সমুদ্রের অংশটি।” তারপর তারা দ্বিতীয় বার বলবে,”লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার!” এবার অপর অংশও ধসে পড়বে। এরপর তারা তৃতীয়বারের মত বলবে,”লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার!”এবার শহরের প্রবেশদ্বার গুলো খুলে যাবে আর তারা শহরে প্রবেশ করবে। তারপর তারা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ ভাগাভাগির সময় হঠাত একটি চিৎকার শুনতে পাবে ,”দাজ্জাল এসেছে!!” তখন তারা সব ফেলে রেখে তার দিকে ছুটে যাবে। “[মুসলিম -৬৯৭৯]

বনী ইসরাইলের এই ৭০০০০ বংশধর কারা? ইসরাইল বা ইসহাকের বংশধর হচ্ছে ইহুদিগণ। ইবন কাসির এবং ইমাম নববীর মত হাদিসের পন্ডিতগন বলেন যে এখানে রোমান মুসলিমদের কথা বলা হয়েছে। প্রথমদিকের মুসলিম ইতিহাসগণ বলেন যে রোমানরা আল ঈস ইবন ইসহাকের উত্তরসূরি। তারা মুসলিম সেনাবাহিনীর রোমান অংশ হতে পারে। তারা ইহুদি থেকে ধর্মান্তরিত মুসলিমও হতে পারে। তারা যিকরের মাধ্যমে কন্সটান্টিনোপোল জয় করবে সুতরাং তারা মুসলিম। তারা ওই অঞ্চলের অধিবাসী মুসলিম ও হতে পারে। তুরস্ক একসময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ ছিল হয়ত তারাই আবার ইস্তাম্বুল(কন্সটান্টিনোপোল) জয় করবে।ওয়াল্লাহু আলাম।

কিয়ামতের লক্ষণ গুলোর কথা বলার সময় আমরা আসলে গায়বের ব্যাপারে কথা বলছি যা আমাদের অজানা। এসব ক্ষেত্রে আলেমদের ব্যাখ্যা ঠিক হতেও পারে নাও পারে। এসব হাদিসের উদ্দেশ্য হুবহু ভবিষ্যত  বলে দেয়া নয় বরং এগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ

১। ইসলামের অলৌকিকতা তুলে ধরা। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদিসের অলৌকিকতা তুলে ধরা।

২। এগুলো মুমিনদের জন্য আগাম সুসংবাদ স্বরূপ। এগুলো আমাদের আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ়তা দেয়। একসময় বিষয়াদি কঠিন হয়ে উঠবে, তখন এই হাদিসগুলো আমাদের জন্য পথ প্রদর্শক হিসাবে কাজ করবে। আলামত গুলো ঘটার আগে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারিনা যে এগুলো ঠিক কি বুঝাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মদিনা থেকে নির্গত আগুনের কথাই ধরুন। আমরা জানতাম না কিসের কথা বলা হচ্ছিল কিন্তু যখন সেটা ঘটে যায় তখন আমরা বুঝতে পারি যে  আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কথা বলা হয়েছিল।

৪৭ নং আলামত –  ক্বাহতানের রাজত্বঃ আবু হুরায়রা(রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “কিয়ামত সংঘটিত হবেনা যতক্ষণ না ক্বাহতান থেকে একজন লোকের আবির্ভাব হয় এবং সে তার ছড়ি দ্বারা মানুষকে শাসন করে।”[বুখারি]

হাদিসটি শুনলে মনে হতে পারে লোকটি খারাপ কিন্তু অন্য একটি হাদিস ব্যাখ্যা করে যে সে সৎকর্মশীল এবং খলিফাদের একজন। সুতরাং সে হবে ন্যায়পরায়ণ কিন্তু কড়া। ইবন আব্বাস বলেন,”তারা সকলেই ন্যায়পরায়ণ”

ক্বাহতান হচ্ছে ইয়েমেনের আরবদের বংশধর। সে একজন খলিফা হবে। কিন্তু সে খুবই কড়া এবং কঠোর হবে। এর মানে সে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে খুবই কঠোর হবে। এজন্যই তাকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে সে “তার ছড়ি দ্বারা মানুষকে শাসন করে”। আল্লাহু আলাম এটা মাহদি আসার আগেও হতে পারে তবে খুব সম্ভবত তা মাহদির পরে হবে।

৪৮ নং আলামত – ইহুদিদের সাথে যুদ্ধঃ মুসলিম এর একটি হাদিসে এই যুদ্ধের ব্যাপারটি এসেছে। মুসলিমদের সাথে ইহুদীদের যুদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবেনা। এই যুদ্ধের পরিণতি জানা যায় রাসূল সাঃ থেকে  বর্ণিত অপর একটি হাদিসে। তিনি (সাঃ) বলেন ইহুদিরা যুদ্ধের সময় পাথরের পিছনে গাছের পিছনে লুকাবে আর তখন পাথর ও গাছ গুলো মুসলিমদের বলে উঠবে ও মুসলিম ও আল্লাহর দাস আমার পিছনে একজন ইহুদি রয়েছে, আস এবং তাকে হত্যা কর তবে শুধুমাত্র ‘শাজারুল গারকাত’ ব্যাতীত। আল- গারকাত হল এক ধরনের গাছ। ফিলিস্তীন থেকে আগত ফিলিস্তীনীদের কাছ থেকে জানা যায় ইহুদীরা প্রচুর পরিমাণে এই গাছ লাগাচ্ছে । এই গাছটি মুসলিমদের কে ইহুদিদের সম্পর্কে কোন কিছু জানাবেনা ,বলবেওনা ও মুসলিম আমার পিছনে একজন ইহুদি রয়েছে ।রাসূল সাঃ বলেন এর কারণ হল এই গাছটি ইহুদিদের গাছ। এবং আমি যেরকমটা বললাম যে অনেক ফিলিস্তীনীর কাছ থেকেই জানা যাচ্ছে যে ইয়াহুদিরা প্রচুর পরিমাণে ঐ গাছটি লাগাচ্ছে যার কারণ এই ঘটনাটি হতে পারে।এই হাদিস টি আছে মুসলিম এ।

এই হাদিসের একটি ব্যাপারে আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষন করছি -ইহুদিদের সাথে আগেও মুসলিমদের যুদ্ধ হয়েছিল তবে সেই যুদ্ধ গুলো কোন সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে হয়নি।জাতীয়তা কিংবা উপজাতীয়তা থেকেই সংঘটিত হয়েছিল,ইসলামের পতাকাতলে হয়নি। 

ইহুদিদের বিরুদ্ধে মুসলিমরা সেই যুদ্ধ গুলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ কায়েম করার জন্য করেনি। যুদ্ধ গুলো পরিচালিত হয়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের দ্বারা যাদের আনুগত্য, আনুগত্যের দিক থেকে মুসলিমদের চাইতে আলাদা ছিল।তাদের আনুগত্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার প্রতি ছিলনা।মূলত প্রকৃত মুসলিম উম্মাহএখনো ইহুদিদের সাথে যুদ্ধ করেনি যার কারণে আগের যুদ্ধ গুলোতে ইহুদিরা বিজয়ী হয়েছিল

কিন্তু আমরা যেই যুদ্ধে ইহুদিদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের কথা বলছি তা আগের যুদ্ধ গুলো থেকে ভিন্ন। এই বিজয় আসার কারণ হল মুসলিমরা এই যুদ্ধ এই কারণে করবে যে তাদের সত্যিকারের পরিচয় হল তারা মুসলিম। যখন পাথর কিংবা গাছ মুসলিম সৈন্যদের ডেকে বলবে যে তার পিছিনে একজন ইহুদি রয়েছে সেটা এই জন্য বলবেনা যে সে একজন ফিলিস্তীনী কিংবা একজন আরব অথবা একজন ইন্ডিয়ান।বরং যেই দেশ বা অঞ্চলেরই হোক না কেন গাছ বা পাথর তাকে হে মুসলিম হে আল্লাহর দাস বলেই সম্বোধন করবে ।গাছ এবং পাথর জানেনা আপনি কোথায় থাকেন ,কোথা থেকে এসেছেন আপনার দেশ কি, কি আপনার সাংস্কৃতিক পরিচয়ই। সে শুধু মাত্র এইটুকুই জানে যে আপনি একজন মুসলিম এবং আপনি আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলার একজন দাস।  যদি এই পরিচয় ব্যাতীত অন্য কোন পরিচয়ে আপনি যুদ্ধ করেন তবে তারা আপনাকে চিনবেনা,জানবেওনা আপনি কে, শুধুমাত্র তখনই তারা আপনাকে চিনবে যখন আপনি পরিচয় বহন করবেন একজন মুসলিমের এবং ডাকবে শুধু মাত্র এই নামেই।

৪৯ নং আলামত – আল-মদীনা থেকে অপবিত্রতা দূরীকরণঃ রাসূল(সাঃ) আল বুখারী থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলেন একটা সময় আসবে যখন মানুষ তার আত্মীয় স্বজনদের বিলাসবহুল ও আরামদায়ক জীবনের দিকে ডাকবে।  যারা ডাকবে তারা হচ্ছে সেই লোক যারা এমন সব দেশে যাবে যেখানে জীবন অনেক বেশী বিলাসবহুল।মদীনায় থাকা তাদের বাকি আত্মীয়স্বজনদের তারা মদীনা ত্যাগ করে তাদের কাছে চলে আসতে বলবে। বলবে মদিনার জীবন থেকে এই জীবন আরো অনেক সচ্ছল অনেক উন্নত। রাসুল (সাঃ) বলেন মদীনা তাদের জন্য উত্তম কিন্তু যদি তারা তা জানত । যেই সত্ত্বার হাতে আমার প্রাণ তার কসম অর্থাৎ আল্লাহর কসম খেয়ে তিনি(সাঃ)  বলেন যদি কেউ মদীনা ত্যাগ করে, মদিনাকে ছেড়ে চলে যায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার চাইতে উত্তম কাউকে তার পরিবর্তে নিয়ে আসবেন।মদীনা ভাল না বলে যদি কেউ মদীনা ছেড়ে চলে যায় তবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তার প্রতিস্থাপন ঘটাবেন এমন কাউকে দিয়ে যে তার চাইতে অনেক বেশী উত্তম। অতঃপর রাসুল (সাঃ) বলেন মদীনা হচ্ছে সেই আগুনের মত যা সোনা থেকে খাদ আলাদা করে দেয় এবং নিশ্চয়ই মদিনা সব খাদ দূর করে দেবে।  যে লোকটি মদীনা থেকে কোন বিলাসবহুল দেশে গিয়ে তার আত্মীয়স্বজনদের উন্নত জীবনের দিকে আহ্বান জানাতে লাগল তার বিষয়টা এইভাবে কল্পনা করা যায় এখন যেমন বিভিন্ন দেশ থেকে লোকেরা আমেরিকায় আসে, এসে এখানকার বিলাসবহুল আরামদায়ক জীবন উপভোগ করা শুরু করে,তখন তারা তাদের ভাই এবং আত্মীয়স্বজনদেরও আমেরিকায় চলে আসতে বলে জীবন যাত্রার উন্নত মানের জন্য।রাসূল সাঃ এর বর্ণিত হাদিসে মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়া লোকদের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটা  ঘটার কথাই বলা হয়েছে যে তারা মদীনা থেকে অন্য কোথাও যাবে এবং মদীনাতে তাদের বাকী আত্মীয়স্বজন যারা আছে তাদেরকেও চলে আসতে বলবে কিন্তু মদীনাই ছিল তাদের জন্য উত্তম কিন্তু তারা সেটা জানতনা।

এখন প্রশ্ন হল এই হাদিস টি কি সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য নাকি একটা নির্দিষ্ট সময়ের কথা এখানে বলা হচ্ছে। আল কাদি আইয়াদ  এর মতে এই হাদিসটি শুধু মাত্র রাসূল (সাঃ) এর সময়ের জন্যই। ইমাম আন-নাওয়াবী বলেন এই হাদিস টি সুনির্দিষ্ট করে আদ-দাজ্জাল এর সময় এর কথা বলছে। এই হাদিসের ব্যাপারে এই দুটো মত ই আছে এবং প্রত্যেকটি মতের স্বপক্ষেই হাদিস থেকে প্রমাণ রয়েছে। আল কাদি ইয়াদ তার মতের স্বপক্ষে যে হাদিস টি প্রমান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন সেটা বুখারী থেকে বর্ণিত,  জাবের ইবন আবদুল্লাহ বলেন একজন বেদুঈন একবার রাসূল (সাঃ) এর কাছে আসেন এবং তার বায়াত গ্রহন করেন। তিনি মদীনায় ইসলাম এর উপর জীবন যাপন করতে থাকেন কিন্তু তিনি এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন । তিনি তখন রাসূল (সাঃ) এর কাছে ফিরে আসলেন এবং বললেন ও রাসূল(সাঃ) আমার করা অঙ্গীকার থেকে আমাকে রেহাই দিন ।রাসূল সাঃ বললেন না, ধর্মের অঙ্গীকার তুমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কে দিয়েছ তুমি সেটা প্রত্যাহার করতে পারবেনা।  বেদুঈন টি আবার আসল এবং বলল ও রাসূল(সাঃ) আমি অঙ্গীকার প্রত্যাহার করতে চাই কিন্তু রাসূল (সাঃ) আবারো প্রত্যাখ্যান করলেন।এরপর তিনি তৃতীয় বারের মত আসেন আর এইবার ও রাসূল (সাঃ) যখন প্রত্যাখ্যান করলেন লোকটি তখন এমনিতেই চলে গেল। রাসূল (সাঃ) বলেন, আল-মদীনাকে এমন এক পার্থক্যকারী যা ভাল এবং খারাপ কে আলাদা করে দেয়ে এবং সব মন্দকে প্রকাশ করে দেয়।

মদীনার পরিবেশ খুব কঠিন এবং এমনকি মদীনার উল্লেখযোগ্য জায়গা গুলোর পরিবেশও খুব রূঢ় ও কঠোর এবং খুবই শুষ্ক। সাহাবারা যখন মক্কা থেকে মদীনায় এসেছিলেন তারা মদীনার আবহাওয়া সহ্য করতে পারেননি।মক্কা মদীনা থেকে খুব দূরে ছিলনা, তারপরো মক্কায় একটা নির্দিষ্ট পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়ায় মুহাজিরিনরা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মদীনায় সেই সময়  জ্বরের প্রকোপ প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। মদীনায় এই জ্বর অনেক দিন যাবত স্থায়ী হয়েছিল। মুহাজিরিনরা এই রোগে বেশ ভুগেছিলেন। মদীনা যেহেতু আনসারদেরই শহর ছিল তাই তাদের এতটা কষ্ট হয়নি যতটা হয়েছিল মুহাজিরিনদের। এই খবরটি মক্কার কুরাইশদের কাছেও পৌছেছিল যে তারা মদিনায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাই প্রথম উমরাহর সময় রাসুলুল্লাহ(সঃ) সাহাবিদেরকে নির্দেশ দেন যেন তাওয়াফ করার সময় তারা প্রথম তিনবার দৌড়ে তাওয়াফ করেন। কেন? কারণ রাসুলুল্লাহ(সাঃ) কুরাইশদেরকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে সাহাবিরা সুস্থ-সবল ছিলেন এবং মদিনার জ্বর তাদেরকে কাবু করতে পারেনি। তারপর রাসুলুল্লাহ(সাঃ) মদিনা থেকে এই জ্বর সরিয়ে দেয়ার জন্য দুআ করেন। তারপর রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর দুআর কল্যাণে এই জ্বর মদিনা থেকে দূর হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও মদিনার আবহাওয়া খুবই চরমভাবাপন্ন। তাই এটি হচ্ছে আল কাদি ইবন আইয়াদের মতের পক্ষে দলিল যে এটি শুধুমাত্র রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এর সময়কালের জন্য প্রযোজ্য।

তাহলে ইমাম নববির মতের পক্ষে প্রমাণ কি? কারণ তিনি বলেন এটি শুধু দাজ্জালের সময়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাঁর দলিল হচ্ছে বুখারি থেকে বর্ণিত একটি হাদিস। যেখানে রাসুলুল্লাহ(সাঃ) বলেন, দাজ্জাল মদিনার কাছে আসবে এবং তখন মদিনা তিনবার কেঁপে উঠবে এবং মদিনা তার ভিতরে বসবাসরত সব কাফির এবং মুনাফিককে বের করে দেবে। এটিই ইমাম নববির মতের পক্ষে দলিল। ইবন হাজার আল-আসকালানি বলেন, এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ(সাঃ) এবং দাজ্জাল উভয়ের সময়ের কথাই বলা হচ্ছে। অনেকের মত হচ্ছে যে হাদিসটি আম অর্থে বলা অর্থাৎ এটি সবসময়ের জন্য প্রযোজ্য কিন্তু তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় যে তাহলে কেন অনেক মহান সাহাবি মদিনা ছেড়ে গিয়েছিলেন? মুআয ইবন জাবাল, আবু উবাইদাহ প্রমুখ সাহাবি মদিনা ছেড়ে গিয়াছিলেন। আলী (রাঃ) কুফাকে তাঁর রাজধানী করেছিলেন। তিনি ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানী ইরাক নিয়ে যান। তাই এই হাদিসটি আম হতে পারেনা বলেই মনে হয়। ওয়াল্লাহু আলাম।

তবে এমন একটি সময় আসবে যখন মদিনায় কেউই থাকবেনা। মদিনা পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। এটি ইমাম মাহদি এবং ঈসা (আঃ) এর পরবর্তী সময়ের কথা। এটি একদম শেষ সময়ের কথা এবং তখন মদিনা পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। রাসুলুল্লাহ(সাঃ) বলেন যে মানুষ মদিনা বসবাসের যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও পরিত্যাগ করবে। মদিনা এমনই পরিত্যক্ত ভূমিতে পরিণত হবে যে পশু পাখি সেখানে বিচরণ করবে। এবং আরো বর্ণিত আছে যে দুজন মেষপালক তাদের ভেড়া চরাতে মদিনাতে আসবে এবং মদিনাকে জনমানবশূন্য অবস্থায় পাবে। ফেরার পথে ওয়াদা   উপত্যকার কাছে তাদের মৃত্যু ঘটবে।

 

ইমাম মালিকের মুয়াত্তা থেকে গৃহীত আরেক হাদিসে বলা হয়, আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাঃ) বলেন, মদিনাকে তার উত্তম অবস্থাতেই পরিত্যাগ করা হবে এবং তা এরুপে পরিত্যক্ত হবে যে একটি কুকুর অথবা নেকড়ে এসে মসজিদের মিম্বরের কাছে মূত্রত্যাগ করবে। এ থেকে বুঝা যায় যে মদিনা সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যক্ত হবে তা না হলে কিভাবে একটি কুকুর মসজিদে নববিতে ঢুকে মূত্রত্যাগ করতে পারে? এরপর সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন হে রাসুলুল্লাহ(সাঃ) তাহলে ফল এবং ফসলের কি হবে? কারণ তখন মদিনা তার খেজুর এবং অন্যান্য ফলের জন্য বিখ্যাত ছিল। রাসুলুল্লাহ(সাঃ) বলেন, সেগুলো পশু পাখির জন্য পড়ে থাকবে। এটি কখন ঘটবে? আমি যেমনটা আগে বলেছি এটি ঘটবে একদম শেষ সময়ের দিকে। ইবন কাসির বলেছেন মদিনা দাজ্জালের সময়ে জীবন্ত এবং গতিশীল থাকবে। ঈসা(আঃ) এর সময়ও তাই থাকবে। এরপর ঈসা (আঃ) মদিনাতেই মৃত্যুবরণ করবেন এবং সেখানেই তাকে দাফন করা হবে এবং এরপরই মদিনা ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে এটা তখনই ঘটবে যখন পৃথিবীর বুকে আর সৎকর্মশীল কেউ থাকবেনা। মদিনা কতদিন পরিত্যক্ত থাকবে? চল্লিশ বছর। চল্লিশ বছর ধরে মদিনা পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকবে। মদিনা তখন পরিত্যক্ত থাকবে কারণ তখন কোন আবিদ( উপাসনাকারী) থাকবেনা। আজ কি মদিনাকে জীবন্ত রেখেছে? ব্যবসা-বানিজ্য? না, আল্লাহ্‌র ইবাদত। উম্মাহ ইসলামের পবিত্র আচার অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমেই মক্কা এবং মদিনাকে জীবন্ত রেখেছে। যখন আর কোন ইবাদাতকারী থাকবেনা তখন মদিনা খালি হয়ে যাবে।

৫০ নং আলামত –  পবিত্র বাতাস দ্বারা মুমিনদের রুহ তুলে নেয়াঃ আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ(সাঃ) বলেন, আল্লাহ্‌ ইয়েমেনের দিক থেকে এক বাতাস প্রেরণ করবেন যা রেশমের চেয়েও মসৃণ হবে এবং তা যাদের অন্তরে দানা পরিমাণও ঈমান অবশিষ্ট থাকবে তাদের সকলের রুহ নিয়ে নেয়া হবে। তাই তখন যারা থাকবে তাদের কারো অন্তরে বিন্দুমাত্র ঈমানও থাকবেনা। আর একারণেই পবিত্র জায়গাগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। এবং এর ফলশ্রুতিতেই কা’বা ধ্বংস করা হবে যা হচ্ছে ৫১ নং নিদর্শন।

৫১ নং আলামত – কা’বার ধ্বংসঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ” যারা কা’বার পবিত্রতার সীমালঙ্ঘন করবে তারা এই উম্মতেরই লোক।” কোন শত্রু কা’বাকে ধ্বংস করতে পারবেনা। এর বিরুদ্ধে সীমালঙ্ঘন শুধু তখনি সম্ভব যখন এই উম্মতের লোকেরা তা করবে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,”যখন তা ঘটবে তখন আরবদের ধ্বংসের ব্যাপারে আর কোন সংশয় থাকবেনা।” তারপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  বলেন,” আবিসিনিয়ার লোকেরা আসবে এবং কা’বাকে ধ্বংস করে দিয়ে তার ধন সম্পদ নিয়ে যাবে।”

সহিহ বুখারির একটি হাদিসে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  নির্দিষ্ট করে আমাদের বলে দিয়েছেন যে কারা কা’বা ধ্বংস করবে। আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,”ইথিওপিয়ার  “যুস সুয়াইক্বাতাইন(সরু পায়ের অধিকারি) ” কা’বা ধ্বংস করবে।”[বুখারি ২/২৬/৬৬৬]

ইবন আব্বাস থেকে বর্ণিত যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)  বলেছেন,”আমি যেন দেখতে পাচ্ছি যে সরু পায়ের অধিকারী এক কালো লোক একটা একটা করে কা’বার ইট ভাঙছে।” [বুখারি ২/২৬/৬৬৫]

৫২ নং আলামত –  আল মাহদিঃ  এ বিষয়ে কথা বলেই আমরা কেয়ামতের ছোট নিদর্শন নিয়ে আমাদের আলোচনা শেষ করব।  ইমাম আল মাহদি কাবা ধ্বংসের পরে আসবেন না, বরং উনার আগমন সে ঘটনার আগেই ঘটবে। কিন্তু আমি সবার শেষে এসে তাঁর কথা উল্লেখ করছি কারণ উনার বর্ণনা কেয়ামতের প্রধান নিদর্শন/লক্ষণ গুলোর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ; যেমন ঈসা (আ:), আদ-দাজ্জাল, এবং অন্যান্য। কিন্তু কাবা ধ্বংসের ঘটনাটি ঘটবে একদম শেষ সময়ে, অর্থাৎ কেয়ামত সংঘটনের একেবারে আগ মুহূর্তে।

আল মাহদি কেয়ামতের ছোট নিদর্শনগুলোর মাঝে একটি। ইমাম আল মাহদি আগমনের সত্যতা সম্পর্কে হাদীস কোন সন্দেহের অবকাশ রাখে না।

তাই রাসূলুল্লাহ সা এর উম্মত হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, শেষ সময়ের দিকে ইমাম আল মাহদি নামক এমন এক ব্যক্তির আগমন ঘটবে, অন্যায় অবিচার দ্বারা দুনিয়া শাসিত হবার পর যিনি এসে পৃথিবীতে ন্যায়ভাবে শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন।

তিনি আহলুল বাইত বা রাসূলুল্লাহ সা এর ঘরের বাসিন্দা/অধিবাসী। আর তাঁর নাম হবে মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহ বা আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ। তিনি হবেন আল হাসান ইবন আলী ইবন আবি তালিবের বংশধর এবং ফাতিমা বিনত মুহাম্মদ সা এর বংশধর। এবং তিনি এ উম্মতের উপর ৭/৮ বছর শাসন করবেন।

ইমাম আল মাহদি নিয়ে কিছু হাদীসঃ

প্রথম হাদীসটি সহিহ আল মুসলিমেঃ  (আরবি)

রাসূলুল্লাহ সা বলেন, এ উম্মাহর মাঝে এমন একটি দল থাকবে যারা সত্যের উপর যুদ্ধ করতে থাকবে এবং কেয়ামতের দিন পর্যন্ত জয়ী হবে। এ উম্মাহ-য় সবসময় এমন একটি দল থাকবে যারা সত্যের উপর থাকবে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সংগ্রাম/লড়াই করবে এবং বিজয়ী হবে।

অর্হাৎ এই দ্বীনের সবচেয়ে খারাপ সময়গুলোতে, একেবারে অধঃপতনের সময়েও রাসূলুল্লাহ সা বলেন, এই উম্মতে এমন কিছু মানুষ থাকবে যারা সত্যের উপর অটল থাকবে এবং ইসলামের জন্য যুদ্ধ করবে। সুতরাং এই উম্মতে সবসময় ভালো বা খাইর বিরাজমান থাকবে। তাই আগের জাতিগুলোর সাথে যা হয়েছিল, এ উম্মাহর সাথে সেটা হবে না। পূর্বের জাতিগুলো কিছুকালের জন্য তাদের নবীকে অনুসরণ করতো, এরপর তারা অধঃপতিত হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে চলে যাবে, যখন তাঁরা তাদের ধর্ম থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাবে, পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে আর কোন ভালো/খাইর অবশিষ্ট থাকবে না আর এজন্যই আল্লাহ তাআলা আরেকজন নবী প্রেরণ করবেন।  এই উম্মত বা মুসলিম জাতির মাঝে রাসূলুল্লাহ সা এর পরে আর কোন নবী আগমন করবে না। এ উম্মাহকে যারা পুনর্জীবিত করবে তারা এ উম্মতের-ই সদস্য। রাসূলুল্লাহ সা এর পরে তারাই এ দ্বীনের বার্তা বহন করবে। আর এই উম্মাহ শেষ দিন পর্যন্ত টিকে থাকবে। কারণ আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাব বা কুরআনকে সংরক্ষণ করেছেন, আর এই উম্মতের মধ্যে ভালো বিদ্যমান রেখেছেন।

 

রাসূলুল্লাহ সা বলেন, আমার উম্মাহ হলো বৃষ্টির মত, এর কোথায় ভালো আছে তুমি জানবে না এর কোথায় অনুগ্রহ/ উপকার নিহিত আছে। যখন বৃষ্টি পড়ে, মাঝে মাঝে এক পশলা খুব জোর-বর্ষণ হয়। তুমুল বর্ষণে চারিদিক শীতল হয়ে যায়। কিন্তু আপনি যদি এমন কোন এলাকায় থাকেন যেখানে চার-পাঁচ ঘণ্টা যাবৎ বৃষ্টি পড়ছে, তো আপনি দেখতে পাবেন, বৃষ্টি পড়ার মাত্রাটা এক নয়,  কখনো খুব জোরে বৃষ্টি হবে, এরপর আবার আস্তে আস্তে, এরপর আবার বেশি, আবার কম; এভাবে কম-বেশি হতে থাকে। তাই আপনি জানতে পারবেন না যে খাইর/অনুগ্রহ/ উপকার কী শুরুতে আছে না কি শেষে। রাসূলুল্লাহ সা বলেন, আমার উম্মাহ হচ্ছে এরকম। আপনার মনে হতে পারে যে উম্মাহ ক্ষতিগ্রস্ত/ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, কিন্তু এরপরই আপনি দেখতে পাবেন উম্মাহর মাঝে সৎকর্মের ঢেউ এসেছে। আপনি মনে করবেন, উম্মাহ মৃত, একে আর পুনর্জাগরন করা যাবে না, এটা ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু হঠাৎ করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আবারো উম্মাহর মধ্যে আলো জ্বালিয়ে দিবেন। এমনভাবেই রাসূলুল্লাহ সা এই উম্মাহর বর্ণনা করেছেন।

আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে মুসলিমে, সেখানে রাসূলুল্লাহ সা বলেন, তোমাদের মাঝে এমন একজন খলীফা থাকবে- যিনি অগুনতি অর্থ বিতরণ করবে। আর এই খলীফা হচ্ছে আল মাহদি। সে গুনে গুনে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিবে না, সে শুধু দিতে থাকবে। তাঁর সময়ে/ শাসনামলে এতো অনুগ্রহ/বরকত থাকবে যে সে শুধু বিলি করতে থাকবে।

এরপরের হাদীসটি রয়েছে ইমাম আহমাদের মুসনাদে।  রাসূলুল্লাহ সা বলেন, আমি তোমাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছি ইমাম মাহদির যাকে আমার উম্মতে প্রেরণ করা হবে বিবাদপূর্ণ সময়ে। যখন উম্মতে ইখতিলাফ বা বিবাদে পূর্ণ থাকবে, সে সময় আল্লাহ তাআলা ইমাম মাহদিকে প্রেরণ করবেন। আর সেসময় থাকবে যালাযাল, যালাযাল মানে ভূমিকম্প, অথবা এটা দিয়ে বুঝানো হচ্ছে সে সময় উম্মতে খুব বিপর্যয় বা দুর্যোগ চলতে থাকবে। এমন দুর্দশাগ্রস্ত একটা সময়ে ইমাম মাহদির আগমন হবে। রাসূলুল্লাহ সা বলেন, আমি তোমাদেরকে ইমাম মাহদির সুসংবাদ দিচ্ছি।

আর তারপর তিনি (সা) বলেন, সে পৃথিবীর অন্যায়-অবিচারকে ন্যায় এবং সুবিচার দিয়ে প্রতিস্থাপন করবেন। রাসূলুল্লাহ সা বলেন, জাওরারুল উম্মাহ, যখন উম্মাহ অন্যায় অত্যাচারে পূর্ণ থাকবে, তখন ইমাম মাহদি বিশ্বে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। পৃথিবীর অধিবাসীগণ তাকে নিয়ে সন্তুষ্ট হবে এবং আকাশের অধিবাসীরাও তাকে নিয়ে সন্তুষ্ট হবে। অর্থাৎ শুধু মানুষ খুশি হবে, তার উপর সন্তুষ্ট থাকবে তা নয়, এমনকি ফেরেশতারা পর্যন্ত তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে।

রাসূলুল্লাহ সা বলেন, তিনি অর্থ বিতরণ করবে সিহাহান, একজন সাহাবা জিজ্ঞেস করেন, সিনাহান অর্থ কি? রাসূলুল্লাহ সা বলেন, তিনি মানুষের মাঝে টাকা বন্টন করবেন সমানভাবে সম পরিমাণে। বর্তমান মুসলিম বিশ্বের একটা অন্যতম অন্যায়-অবিচার বিরাজ করছে- তা হলো অর্থের ব্যবস্থাপনা/কীভাবে অর্থবন্টন করা হয়। আপনার কানেকশন যদি ভালো থাকে, তো আপনি যা চাবেন তাই পাবেন। কিন্তু আপনি যদি নীতিবান-ভালো, সহজ-সরল, সৎ ব্যক্তি হন, তাহলে আপনাকে একপেশে করে ফেলা হবে। আমরা দেখতে পাই, এই উম্মাহর যত সম্পদ আছে, তার অপব্যবহার হচ্ছে, নষ্ট করা হচ্ছে, আর এমন কাজে ব্যয় করা হচ্ছে না, যেসব কাজে আল্লাহ তাআলা অর্থব্যয় করতে বলেছেন।

সুতরাং ইমাম মাহদির একটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি সকলের মাঝে সমানভাবে/ সুষ্ঠুভাবে অর্থ বন্টন করবে। এটা সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্যাদির/দায়িত্বের একটি- সুষ্ঠুভাবে/ সঠিকভাবে অর্থের পরিচালনা করা। আপনি দেখবেন, সুবহান আল্লাহ, কিছু এলাকার মুসলিম তাদের সরকার নিয়ে সন্তুষ্ট, আর আপনি যখন তাদেরকে অন্যায়-অবিচার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিবেন, তারা সেটাও বুঝতে চায় না। টাকা-পয়সা নিয়ে অরাজকতা বিশাল ব্যাপার! যখন অর্থের অপব্যবহার হচ্ছে, উচ্চস্থানীয় ব্যক্তিরা সেই অর্থ ভোগ করছে, যা আসলে উম্মাহর টাকা, আর তারা তাদের ইচ্ছা মত যেভাবে খুশি টাকা উড়াচ্ছে, সেটা হচ্ছে ক্ষমতার সাংঘাতিক অপব্যবহার। এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য না, যে এমন বিষয় না যা আমরা উপেক্ষা করে দিব! এটা অত্যন্ত বড় একটা গুনাহ।

রাসূলুল্লাহ সা বলেন, তিনি উম্মাহর অন্তর পরিতৃপ্তি দিয়ে ভরে দিবেন, অর্থাৎ এমন হবে না যে শুধু মানুষের শরীর খুশি হবে, আপনারা প্রায়ই দেখবেন, অনেকে মানুষকে টাকা দিয়ে কিনে নেয়, তাদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য। যদিও তাদের মন এতে সন্তুষ্ট হয় না। কিন্তু ইমাম মাহদির সময় এমন হবে যে মানুষ শুধু তাদের যে সম্পদ আছে সেটা নিয়েই খুশি হবে না, বরং তাদের মন-অন্তর ভিতর থেকে সন্তুষ্ট থাকবে। উম্মাহর অন্তরসমূহ তৃপ্ত হয়ে যাবে। আর অন্তরের কথাই সবচেয়ে জরুরি। মানুষের হৃদয় তাকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে, পরিতৃপ্ত থাকবে আর তার(ইমাম মাহদির) ন্যায়পরায়ণতা এ উম্মাহকে ঘিরে রাখবে/ বেষ্টন/ পরিবেষ্টিত করে রাখবে। তারা তার ন্যায়বিচারে আবৃত হয়ে থাকবে।

আর তিনি জনগণের কাছে ঘোষণা করবেন,  কার অর্থ প্রয়োজন? কার অর্থ প্রয়োজন? কেউ এ কথার জবাব দিবে না। তিনি মানুষকে জিজ্ঞেস করছেন কার টাকা লাগবে কিন্তু কেউ উত্তর করবে না, একজন লোক ব্যতীত, যে দাঁড়িয়ে বলবে আমার

আল মাহদি তাকে বলবেন, ঐ ধনভাণ্ডারের নিকটে যাও। অতএব আল মাহদি তাকে বলবে ধনভাণ্ডারে যেতে, কোষাগারকে নির্দেশ দিবেন তাকে টাকা দিতে। যখন সে ভাণ্ডারের কাছে পৌঁছবে, আল মাহদির হুকুম দিবে, তার দিকে টাকা ছুড়ে মারো, গুনার দরকার নাই, শুধু তার হাতে টাকা তুলে দাও। তো লোকটা সেই ভাণ্ডারের কাছে যায় এবং আল মাহদির আদেশের কথা বলে, আর তার শরীরের সব কাপড়চোপড় টাকাপয়সা দিয়ে ভরে দেয়া হয়। সে যখন এই অর্থসম্পদ দেখে,  সে অনুশোচনা/আফসোস করতে থাকে, সে বলে, আমি ছিলাম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের সবচেয়ে লোভাতুর ব্যক্তি। কীভাবে  এটা হতে পারে যে সবাই যেমন তৃপ্ত ছিল তেমন আমিও ছিলাম না? আমি সব চাইতে লোভী ছিলাম।

তো এখন সে তার হাতে অর্থসম্পদ দেখে আক্ষেপ করতে থাকবে যে কেন আমি এতো লোভী ছিলাম? কারণ সে বাদে উম্মাহর আর কেউ বলেনি যে তার টাকা লাগবে! তাই সে আবার ফিরে যাবে।

সে ফিরে যেয়ে এই টাকা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করবে। কোষাগার রক্ষক বলবে, এখানে ফেরত দেয়ার কোন ব্যবস্থা/ নিয়ম নেই। আমরা এখানে টাকা ফেরত নেই না। তুমি টাকা ফিরাতে পারবে না। সুবহান আল্লাহ! আপনি দেখুন, একজন ধনভাণ্ডারের কাছে যেয়ে টাকা ফেরত দিতে চাচ্ছে, টাকা ফেরানোর জন্য অনুনয়-বিনয় করছে কিন্তু তাকে বলা হচ্ছে, এখানে ফিরিয়ে দেয়ার নিয়ম নেই।

রাসূলুল্লাহ সা বলেন, ৭, ৮ বা ৯ বছরের জন্য এরূপ থাকবে। আর এরপর আর কোন খাইর/ভালো অবশিষ্ট থাকবে না। সুতরাং মাহদির শাসনামল থাকবে ৭, বা ৮, বা ৯ বছর।

আলী বিন আবি তালিব বলেন, রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, আল মাহদি আমদের অন্তর্ভুক্ত, রাসূলুল্লাহর পরিবারের একজন। আর এক রাত্রিতে আল্লাহ তাকে পথ প্রদর্শন করবেন। ইউসলিহাহু অর্থ যখন কোনকিছু ভেঙ্গে যায়, সেটা ঠিক করাকে মেরামত করাকে বলে ইসলাহ্‌। সেটাকে সবচেয়ে উন্নত অবস্থায়/ সর্বোৎকৃষ্ট পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াকে বলে ইসলাহ্‌, কোন কিছুর উৎকর্ষ সাধন করাকে বলা হয় ইসলাহ্‌।

আলী বিন আবি তালিব বলেন তিনি রাসূলুল্লাহ সা কে বলতে শুনেছেন ইমাম মাহদি রাসূলুল্লাহ সা এর বাড়ির বাসিন্দা। এবং তিনি আলী ইবন আবি তালিবের বংশধর। কিন্তু ইসলাহুল লাইলু দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে তা আল্লাহ ভালো জানেন! এটার অর্থ হতে পারে, আল্লাহ তাআলা তাকে কোন এক রাতে শক্তি এবং ক্ষমতা দান করবেন। এর মানে হতে পারে আল্লাহ তাআলা তাকে পথ দেখাবেন এবং দ্বীন বোঝার সামর্থ্য দিবেন কোন এক রাতে। কিন্তু এসবই হবে এক রাতের মধ্যে।

আর পরের হাদীস।

রাসূলুল্লাহ সা বলেন, যদি দুনিয়াতে মাত্র একদিন বাকি থাকে, তাহলে আল্লাহ সেই দিনটা কে দীর্ঘ করে দিবেন যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ যে আমার থেকে এসেছে, তাঁর নাম হবে আমার নামের মত এবং তাঁর পিতার নাম হবে আমার পিতার নামের মত, এবং সে এই পৃথিবীকে ন্যায়বিচারে পরিপূর্ণ করে দিবে, ঠিক যেভাবে পৃথিবী অন্যায়-অবিচারে ভরে ছিল।

তাই ইমাম মাহদির নাম হবে রাসূলুল্লাহ সা এর মত, মুহাম্মাদ নতুবা আহমাদ।  তাঁর বাবার নাম হবে আব্দুল্লাহ, রাসূল্লাহ সা এর বাবার নামের মত। তিনি হবেন রাসূলুল্লাহ সা এর একজন বংশোদ্ভূত। এই ছিল ইমাম মাহদির বিবরণ।

আমরা কেয়ামত দিবসের ছোট লক্ষণ/ নিদর্শনগুলো নিয়ে কথা বলা শেষ করলাম।