কেয়ামতের দিনের দশটি প্রধান লক্ষণ, চিহ্ন বা নিদর্শন আছে। আমরা এতোক্ষণ যে নিদর্শনগুলোর কথা বলেছি সেগুলো ছিল কেয়ামতের সগীরাহ/ ছোট লক্ষণ সমূহ। ‘আলামাতুস সুঘরা বা গৌণ আলামত। প্রধান নিদর্শন দশটি। ছোট বা গৌণ লক্ষণগুলো কয়েক শতাব্দী ধরে সংঘটিত হবে।এদের মধ্যে প্রথমটি ছিল রাসূলুল্লাহ সা এর আগমন।
(কেয়ামতের) প্রধান বা মুখ্য লক্ষণগুলো দেখা দিবে কেয়ামতের খুব নিকটবর্তী সময়ে। তাদের মধ্যে একটা মাত্র আলামত যেই না ঘটবে, ওমনি বাকিগুলিও এরপর দ্রুততার সাথে ঘটতে থাকবে। গৌণ নিদর্শনগুলো প্রকাশ পেতে কোন কোনটার একশ বছর লেগে যায়, যুগের পর যুগ ধরে এগুলো চলতে থাকে। কিন্তু মুখ্য বা প্রধান লক্ষণগুলো সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা (আহমাদে বর্ণিত) হাদীসে বলেনঃ
“কেয়ামতের প্রধান আলামতগুলো যেন একটা সুতোয় বাঁধা কতগুলো পুঁতির মত, যখন সুতো কাটা হবে, সবগুলোই পড়ে যাবে”। অর্থাৎ কেয়ামতের প্রধান নির্দেশকগুলো একে অপরের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। এগুলো একটার পর একটা হতে থাকবে। ঠিক যেন সুতো কাটলে সবগুলো পুঁতি পড়ে যাবার মত ঘটনা।
কেয়ামতের প্রধান দশটি আলামত/ লক্ষণ কি কি?
একটি হাদীসে এ দশটি লক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এখানে দশটি প্রধান আলামতের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কোনটা আগে আর কোনটা পরে ঘটবে তা সঠিক ক্রমানুসারে এ হাদীসে উল্লেখ করা হয়নি।
হুযাইফা বিন উসাইদ গিফারী, রাসূলুল্লাহ সা এর একজন সাহাবি উনি বলেন, আমরা কথা বলছিলাম এমন সময়ে রাসূলুল্লাহ সা আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি বিষয়ে কথা বলছ?’ আমরা বললাম, ‘আমরা কথা বলছি আস-সা’আ নিয়ে’। আস-সা’আ হচ্ছে শেষ সময় বা কেয়ামত।
রাসূলুল্লাহ সা বললেন, কেয়ামত ততক্ষণ ঘটবে না যতক্ষন পর্যন্ত না তোমরা দশটি আলামত দেখছো। তিনি বললেন –
১, আদ-দুখান বা ধোঁয়া
২, আদ-দাজ্জাল বা মিথ্যা মসীহ
৩, আদ-দাব্বাহ অর্থাৎ বিশেষ একটি জন্তু
৪, পশ্চিম দিক থেকে সূর্য ওঠা
৫, ঈসা ইবন মরিয়মের আগমন
৬, ইয়াজুজ এবং মাজুজ
৭, ৮ এবং ৯ হচ্ছে, যথাক্রমে তিনটি ভূমিকম্প, একটি পূর্বে, একটি পশ্চিমে এবং অপরটি আরবে।
১০, এবং সর্বশেষে, ইয়েমেনে এভাবে আগুন লাগবে যা মানুষকে মাশহারে যেতে বাধ্য করবে। মাহশার হলো সেই স্থান যেখানে বিচারকার্য সমাধা হবে। (হাশরের ময়দান)
কেয়ামতের এ দশটি নিদর্শনের মধ্যে প্রথম কোনটি? – আদ-দাজ্জাল। হাদীসে আছে, কেয়ামতের প্রথম আলামত হচ্ছে পশ্চিম দিক থেকে সূর্য ওঠা। তাহলে কোনটা প্রথমে? দাজ্জাল নাকি পশ্চিম দিকে সূর্য?? – দাজ্জাল প্রথমে। যদিও হাদীসে বলা হয়েছে পশ্চিম দিকে সূর্য ওঠা হলো সর্বপ্রথম লক্ষণ। তবুও আলেমগণ বলে থাকেন দাজ্জাল হচ্ছে সবচেয়ে প্রথম চিহ্ন। তো তারা এটা কীভাবে বলতে পারে যেখানে এ বিষয় সম্পর্কিত একটি হাদীস উপস্থিত?
তারা বলেন, কেয়ামতের কিছু নিদর্শন বা চিহ্ন রয়েছে যেখানে এ মহাবিশ্বের পরিবির্তনের কথা বলা হচ্ছে। এই নির্দেশক গুলোর মাঝে প্রথমটি হচ্ছে সূর্য পশ্চিম দিক থেকে ওঠা। কারণ এ পরিবর্তন টা মহাবিশ্ব সংক্রান্ত পরিবর্তন / মহাবিশ্বের একটা পরিবর্তন। অন্যান্য নিদর্শনগুলো , যেমন – দাজ্জাল, ধোঁয়া বা পশু এগুলো হচ্ছে পৃথিবীতে ঘটবে এমন ঘটনা। পৃথিবীর ঘটনাগুলো পৃথিবী-সংক্রান্ত আলামতগুলো মহাবিশ্বে পরিবর্তন আসার আগেই সংঘটিত হবে। মহাবিশ্বের প্রথম পরিবর্তন টি আসবে সূর্য পশ্চিমে ওঠার মধ্য দিয়ে। আর এরপর পুরো বিশ্বজগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। সবকিছু চলতে থাকবে এলোমেলো ভাবে। চাঁদ খসে পড়বে, নক্ষত্র ঝরে যাবে।
মহাবিশ্বের মাঝে সর্বপ্রথম আলামত হবে পশ্চিম দিকে সূর্য ওঠা। কিন্তু কেয়ামতের দিনের প্রথম আলামত বা নিদর্শন হচ্ছে দাজ্জালের আবির্ভাব।
এখন আমরা শুধু দাজ্জাল কথাটার অর্থ বলব। এরপর এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে আমরা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করব। তার পুরো নাম হচ্ছে আল-মাসিহ আদ দাজ্জাল। নামটা দু’টি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। মাসিহ এবং দাজ্জাল। এ দু’টি শব্দের অর্থ কি? একজন আলেম, যিনি কামুস আল মাহিথ শীর্ষক বইয়ের লেখক, তিনি বলেন, মাসিহ শব্দটি ৫০টি অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। এ শব্দ খানা খুবই সমৃদ্ধ। এর প্রচুর অর্থ আছে। এ শব্দের কিছু অর্থ হলোঃ এমন কিছু যা মুছে ফেলা হয়েছে। দাজ্জালকে মাসিহ বলার কারণ হলো – তার এক চোখ মুছে ফেলা হয়েছে বা এক চোখ থাকবে না।
আল-মাসিহ এর অর্থ এমটাও হতে পারে, যে পুরো দুনিয়ায় ‘মাসাহাল’ করেছে বা পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করেছে। রাসূলুল্লাহ সা একটি হাদীসে বলেছেন যে, আদ-দাজ্জাল সমগ্র বিশ্ব ভ্রমণ করবে চল্লিশ দিনের মধ্যে।
আল-মাসিহ এর অর্থ হচ্ছে ‘আল কাযযাব এবং আল সিদ্দিক’। খুবই আশ্চর্যজনক ভাবে এই মাসিহ কথাটার দু’টি বিপরীত অর্থবোধক অর্থ রয়েছে। আরবি ভাষায় একই শব্দ অনেক সময় দু’টি সম্পূর্ণ উল্টো বা বিপরীতধর্মী বস্তু বুঝিয়ে থাকে। সিদ্দিক মানে সত্যবাদী আর কাযযাব মানে মিথ্যুক। অনেকটা আদম শব্দটার মতোই। আদম শব্দের দুটো অর্থ। একটি মূল (অরিজিনাল) অর্থ, আরেকটি অর্থ পরে এসেছে। মূলত আদম শব্দটির অর্থ হলো অন্ধকার, আঁধার, খুব অন্ধকার/ কালো বা গাঢ় কোনকিছু। আবার আদম বলতে এমটাও বুঝানো যায়, যা খুব ফরসা/ সাদা/ হালকা রঙের কিছুকে। অর্থাৎ আদম বলতে কালো ত্বক বুঝানো যায়, আবার ফর্সা ত্বকও বুঝানো যায়। আর একটি হাদীসে এভাবেই আদম কথাটা (এরকম দু’ভাবে) ব্যবহার করা হয়েছিল। আদম (আ) এর বর্ণনার সময় এর দ্বারা বুঝানো হয় কালো ত্বক আর ঈসা আ এর ক্ষেত্রে বুঝানো হয় ফর্সা ত্বক।
তেমনিভাবে মাসিহ শব্দটার অর্থ একই সাথে সত্যবাদী এবং মিথ্যাবাদী। আল্লাহ তা’আলা দুইজন মাসিহ সৃষ্টি করেছেন। একজন আল মাসিহ আদ দাজ্জাল, আরেকজন আল মাসিহ ঈসা ইবন মারিয়াম। ঈসা ইবন মরিয়ম হলেন সত্যবাদী মাসিহ আর দাজ্জাল হচ্ছে মিথ্যাবাদী/ মিথ্যুক মাসিহ।
মাসিহ শব্দটার আরেকটি অর্থ উন্নত করা বা মর্যাদা উচ্চ করা, যা ঈসা ইবন মারিয়াম (আ) এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই ছিল মাসিহ কথাটার কিছু অর্থ।
আদ-দাজ্জালা শব্দের অর্থ কি? আরবিতে কিছু শব্দ আছে যা দিয়ে মূলত বাস্তব (ফিজিক্যাল) কোন কিছুকে বুঝানো হয়। কিন্তু পরে সেগুলো নতুন নতুন সংজ্ঞা নেয়, নতুন কোন অর্থ বুঝাতেও ব্যাবহৃত হয়। দাজ্জাল আল বাইর অর্থ হচ্ছে উটকে কাতরান দিয়ে রঙ করা। কাতরান হলো কালো রং। আরবের লোকেরা তাদের উটগুলোকে মাঝে মাঝে কোন বিশেষ কারণে কালো রং করে ফেলতো। যেমন – কোন রোগবালাই থেকে মুক্তির জন্য/ আরোগ্য লাভের আশার কালো রং করতো। কিন্তু এই কাতরান উটের গায়ের রং বদলে দিত। সুতরাং এটা কোনকিছু কে লুকোয়, গোপন করে, আচ্ছাদন করে বা রং বদলে দেয়। এ অর্থটা দাজ্জালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কারণ সে সত্য বলে না। সে সত্যকে লুকিয়ে রাখে/ গোপন করে/ ঢেকে রাখে। সে সত্যকে বদলে দেয়।
দাজ্জাল আশ-শাইত, দাজ্জাল আশ-শাইত মানে হলো কোন কিছু কে সোনা/ সোনালি রং এর প্রলেপ দেওয়া/ ঢেকে দেয়া। কোনকিছু কে সোনার পানি দিয়ে ধুলে সেটাকে বলা হয় “দাজ্জাল”। যেমন অনেক ধাতু (metal) আছে electroplated, এগুলো সস্তা জিনিস। পরে এগুলো “গোল্ডপ্লেটেড” করাটা কে বলা হয় দাজ্জাল। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে এটা স্বর্ণ, সোনার তৈরি, কিন্তু ভিতরে আসলে কিছুই না। এটাকেও বলা হয় আদ-দাজ্জাল। কেননা তাকে দেখাচ্ছে একরকম, আর বাস্তবে সে অসৎ, খারাপ এবং ক্ষতিকারক। সে দাবি করবে সে ‘আল্লাহ’ (গড), সে দাবি করবে সে সৎ ভালো। সে দাবি করবে সে দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করছে কিন্তু সত্যিকার অর্থে সে অসাধু, অসৎ।
সে কাফির, নাস্তিক। এটাও দাজ্জালের আরেকটা অর্থ। দাজ্জাল শব্দ দিয়ে আরো বুঝানো হয় – ধোঁকা, প্রতারণা, মিথ্যা বলা, ভণ্ডামি ইত্যাদি। আদ-দাজ্জাল শব্দটা এসব অর্থ বহন করে। আর এর প্রতিটা কথাই দাজ্জালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুবহান আল্লাহ! আপনারা দেখুন, কীভাবে একটি মাত্র শব্দ দিয়ে এতোগুলো কথা বুঝানো হচ্ছে। একের ভিতরে অনেক! আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা রাসূলুল্লাহ সা এর কাছে এ নামগুলো প্রকাশ করেছেন।
দাজ্জালের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য/ চেহারা কেমন তাঁর কিছু বর্ণনা রাসূলুল্লাহ সা আবু দাঊদ কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে বলেন, রাসূলুল্লাহ সা বলেনঃ আমি তোমাদেরকে দাজ্জাল নিয়ে অনেক কথা বলেছি আর আমার ভয় হয়, আমি যেসব কথা বলেছি তার প্রতিটি কথা তোমরা রাখতে পারবে না।
রাসূলুল্লাহ সা বেশ ঘন ঘন দাজ্জালকে নিয়ে কথা বলতেন এবং প্রচুর বিষয় উল্লেখ করতেন।
রাসূলুল্লাহ সা বলেন, প্রত্যেক নবী তাঁর জাতিকে তাঁর অনুসারীদের দাজ্জাল কে নিয়ে সতর্ক করেছেন।
তিনি সা আরো বলেন, কোন ফিতনা/ পরীক্ষা, সৃষ্টির শুরু অর্থাৎ আদম (আ) এর সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত, দাজ্জালের ফিতনার চেয়ে কঠিন আর ভয়ংকর নয়।
আর রাসূলুল্লাহ সা বলেন,এমনকি নূহ আ তাঁর অনুসারীদের কে দাজ্জালের ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন।
তো রাসূলুল্লাহ সা সাহাবাদের সাথে দাজ্জাল সম্পর্কে এতো বেশি বার বলেছেন যে তিনি বেশ চিন্তিত ছিলেন যে সাহাবীগণ তাঁর এসব তথ্য মনে রাখতে পারবেন না।
রাসূলুল্লাহ সা বলেন, দাজ্জাল খাটো করে একজন লোক, সে চোখে দেখতে পাবে না………………………।
এরপর রাসূলুল্লাহ সা বলেন যে, দাজ্জাল হলো কানা, এক চোখ বিশিষ্ট। কিন্তু তোমাদের রব একচক্ষুবিশিষ্ট নয়। কারণ আদ-দাজ্জাল আসলে শেষ পর্যন্ত যেয়ে নিজেকে আল্লাহ (ঈশ্বর) দাবি করে বসবে। আর সে জন্যই রাসূলুল্লাহ সা বলছে যে তোমাদের রব কানা নন। দাজ্জাল আল্লাহ না। এটা দাজ্জালের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ যে সে একচোখা হবে।
আরেকটি বিবরণ রয়েছে বুখারিতেঃ রাসূলুল্লাহ সা বলেন, প্রত্যেক নবী তাঁর জাতিকে/ কওম কে সতর্ক করে দিয়েছেন একচোখা মিথ্যুকের ব্যাপারে। সে কানা, একচক্ষু-বিশিষ্ট, এবং তোমাদের রব তেমন নন। আর তার দুই চোখের মাঝখানে মধ্যবর্তী স্থানে লেখা থাকবে ‘কাফির’। এটি হলো বুখারির একটি হাদীস।
মুসলিমের আরেকটি হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা বলেছেন, দাজ্জালের দু চোখের মাঝে লেখা থাকবে কাফির এবং এ লেখা শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলে পড়তে পারবে। সুতরাং তা অক্ষর জ্ঞানের সীমানা ছাড়িয়ে যাবে। মু’মিন ব্যক্তি মাত্রই অর্থাৎ পূর্ণ বিশ্বাসী মুসলিমের অক্ষরজ্ঞান থাকুক – না থাকুক, সে এ লেখাটা পড়তে সক্ষম হবে।
মুসলিম হাদীসে আরেকটি বর্ণনা এসেছে। এটা রাসূলুল্লাহ সা এর নিজের কথা নয়, তিনি এ কথাগুলোকে অনুমোদন করেছেন/ সমর্থন দিয়েছেন। হাদীসটি অনেক দীর্ঘ, এখানে কিছু লাইন তুলে ধরা হলোঃ
রাসূলুল্লাহ সা এর একজন সাহাবা, তামিম আদ-দারী দাজ্জালকে দেখেছিল। এ হাদীসটি বর্ণিত আছে সহীহ মুসলিমে। সে বলে, আমরা একজন লোক কে দেখলাম, তার চাইতে বিশাল কোন লোক আমরা আর দেখিনি। সুতরাং এখানে বলা হচ্ছে সে ছিল খুবই বৃহৎ।
মনে করে দেখুন, আবু দাঊদের এক হাদীসে বর্ণিত আছে দাজ্জাল হবে খাটো। এখানে মুসলিম হাদীসটি তে আবার বলা হচ্ছে, সে ছিল বড়সড়। দাজ্জালের বর্ণনা পড়তে গিয়ে ভালো রকমের ঝামেলা হতে পারে। আর এটা আরো বিভ্রান্তিকর লাগবে যখন আমরা ইবন সাইয়্যাদ নিয়ে কথা বলা শুরু করব। অতএব বলা চলে, দাজ্জালকে বোঝা অথবা কল্পনা করা এতো সহজ নয় যেমনটা আমরা মনে করছি। এখানে বেশ কিছু জটিলতা আছে। তবে দাজ্জাল যখন আবির্ভূত হবে রাসূলুল্লাহ সা এর হাদীসসমূহ আমাদের এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য যথেষ্ট হবে। আমাদের হয়তো এ মুহূর্তে দাজ্জাল কেমন সেটা অবিকল ভাবে ধারণা করা সম্ভব নয়, কিন্তু যখন সে বের হয়ে আসবে, তখন এ ব্যাপারগুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা একটা হাদীসের পর অন্য হাদীস দেখে মনে করতে পারি, সেগুলোর মাঝে অসঙ্গতি আছে বা সেগুলো একটা অপরটার বিপরীত, কিন্তু আসলে তা নয়। এগুলো আসলে দাজ্জালের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলছে।
এটা আবু সাঈদ আল খুদরীর সাথে এবং ইবন সাইয়্যাদ নামক এক ব্যক্তির কথোপকথন, যা মুসলিম হাদীসে পাওয়া যায়। ইবন সাইয়্যাদ আবু সাঈদ খুদরীকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি রাসূলুল্লাহ সা. কে বলতে শুনেন নি যে আদ-দাজ্জালের কোন সন্তান থাকবে না? আবু সাঈদ উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ’। সুতরাং দাজ্জালের আরেকটা বর্ণনা হচ্ছে এটা যে তার কোন সন্তান-সন্ততি থাকবে না।
এখন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যাক, দাজ্জাল কি এই মুহূর্তে জীবিত? সে কি রাসূলুল্লাহ সা এর সময়ে জীবিত ছিল? সে কি এখন বেঁচে আছে? এর উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, দাজ্জাল এখন বেঁচেই আছে। তো সে এখন নিশ্চিতভাবে কোথায় অবস্থান করছে সেটা নিয়েই আমরা এবারে আলোচনা করবো। আমরা একজন ইহুদী ব্যক্তির কথা বলব যার নাম ইবন সাইয়্যাদ। তিনি ছিলেন মদীনাবাসী একজন ইহুদী। সে জাদু, ভবিষ্যৎবাণী, জিন, শয়তান এইসব নিয়ে উৎসাহী ছিল, এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতো, ছোটবেলা থেকেই। তো ইবন সাইয়্যাদ কি দাজ্জাল ছিল নাকি ছিল না? আমরা এই প্রশ্ন দিয়ে কেন শুরু করছি, তার কারণ কিছু সাহাবা মনে করতেন সে ছিল আদ-দাজ্জাল, এমনকি তাদের অনেকে কসম করে বলেছে যে সেই-ই আদ-দাজ্জাল! উমর বিন খাত্তাব, জাবের আবদুল্লাহ উনারা বলেন, আল্লাহর শপথ, এই লোকই আদ-দাজ্জাল।
এ ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু কথা জানা যাক। সে ছিল মদীনার একজন ইহুদী, পরবর্তীতে মুসলিম হয়ে যায় কি না জানা না গেলেও সে নিজে অবশ্য নিজেকে মুসলিম দাবি করেছিল, এখন সেটা কতখানি সঠিক আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন। তবে, তার সন্তানদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ইমারা, তিনি ছিলেন ইসলামের একজন আলেম।
যাহাবী তার সম্পর্কে বলেন, ইবন সাইয়্যাদের একজন ছেলের নাম/ পুত্রের নাম ইমারা, তিনি ছিলেন একজন সৎকর্মশীল মুসলিম, এবং সাঈদ ইবন মুসাইয়্যাব, তাবেঈনদের আমলের একজন অন্যতম আলেমের সহচারী। ইমারা তার থেকে বেশকিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন, এবং ইমাম মালেক তাকে খুব সম্মান করতেন। সুতরাং ইমারা একজন মুসলিম ছিলেন, কিন্তু সেই লোক (ইবন সাইয়্যাদ) কী ছিল, আসুন তার কাহিনী আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক।
যে জন্য আসলে আমরা ইবন সাইয়্যাদ কে নিয়ে কথা বলছি তার সর্বপ্রথম কারণ হলো রাসূলুল্লাহ সা নিজেই তার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সা ইবন সাইয়্যাদকে নিয়ে কিছু সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। এই লোক কি আদ-দাজ্জাল কি না। সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা কখনো সম্পূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি।
ইবন উমার বলেন, রাসূলুল্লাহ সা, উমার এবং আরো কয়েকজন সাহাবা মিলে ইবন সাইয়্যাদ কে দেখতে গেলেন। সে সময় সে একটা শিশু। সে অন্য বাচ্চাদের সাথে একটা স্থানে খেলছিল, সে জায়গাটার নাম হচ্ছে বানি মাঘালা । ঐ সময়ে তার বয়স প্রায় বয়োঃসন্ধি হবে এমন। ইবন সাইয়্যাদ হঠাৎ অনুভব করলো, রাসূলুল্লাহ সা এর হাত তার গায়ের উপর। রাসূলুল্লাহ সা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সাক্ষ্য দাও আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল? ইবন সাইয়্যাদ বললো, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি অ-ইহুদীদের জন্য রাসূল। যার অর্থ হলো- আপনি আমাদের জন্য রাসূল নন, ইহুদীদের জন্য নন, অ-ইহুদীদের রাসূল। ইবন সাইয়্যাদ বললো, আপনি কি সাক্ষ্য দেন আমি আল্লাহর রাসূল? সে সময় রাসূলুল্লাহ সা তাকে ঠেলা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন আর বললেন, আমি আল্লাহ এবং তাঁর নবী-রাসূলগণে বিশ্বাস করি। রাসূলুল্লাহ সা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ? কারণ এটা ততক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে সে এই তথ্যগুলো কোন জ্বিনের কাছে থেকে পাচ্ছিল। সে বলল, আমি দেখতে পাচ্ছি একটা মিথ্যুক এবং একজন সত্যবাদী। আর ইবন সাইয়্যাদের বেশির ভাগ কথাই প্রতীকী, তাই মাঝে মাঝে সে কি বলছে বুঝতে পারাটা খুবই কঠিন ব্যাপার। সে যখন বললো, আমি সংকেত পাচ্ছি, একটা মিথ্যা আর একটা সত্য। তখন রাসূলুল্লাহ সা বললেন, তুমি বিভ্রান্ত। তুমি দ্বিধাগ্রস্ত।
রাসূলুল্লাহ সা তাকে পরীক্ষা করতে চাচ্ছিলেন, তিনি বললেন, আমি তোমার কাছ থেকে একটা জিনিস লুকাচ্ছি, আমি কী লুকোচ্ছি বলতে পারবে? রাসূলুল্লাহ সা দেখতে চাচ্ছিলেন, যে এই ছেলেটা জ্বিন নিয়ে কি কারসাজি করছে। রাসূলুল্লাহ সা যখন বললেন, আমি তোমার থেকে একটা কিছু গোপন করছি, তিনি আসলে বুঝিয়েছেন, তিনি তাঁর থেকে সূরাহ দুখান গোপন রেখেছেন। সূরাহ আদ-দুখান। রাসূলুল্লাহ সা সূরাহ আদ-দুখানের ওহী পাবার পরে তিনি সেটা ইবন সাইয়্যাদের সামনে তিলাওয়াত করতে চাচ্ছিলেন। সে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তোমার থেকে কি লুকোচ্ছি?
ইবন সাইয়্যাদ বললো, আপনি আমার থেকে ‘দুখ্’ গোপন করেছেন। এটা দুখানের অর্ধেক শব্দ। হয় সে রাসূলুল্লাহ সা এর সাথে খেলার ছলে বলেছিল ‘দুখ্’ অথবা এমনটা হতে পারে, সে জ্বীনদের থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করছিল সেখানে পুরো শব্দটা ছিল না, কিছুটা বাদ পড়েছিল। হয়তো সে অর্ধেক তথ্য পাচ্ছিল জ্বীনদের থেকে, তাই সে বলেছে ‘আদ-দুখ্’।
রাসূলুল্লাহ সা তাকে ঠেলা মেরে বললেন, চুপ। তুমি কখনোই তোমার সাধ্যের বেশি যেতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ সা এ কথা দিয়ে বুঝালেন যে, তুমি কখনোই গায়েব জানতে পারবে না, যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, তুমি কখনোই তার বেশি কিছু জানতে পারবে না। তুমি নিজের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারবে না।
উমার বিন আল খাত্তাব বলেন, আমাকে তার শির বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে দেন।
রাসূলুল্লাহ সা বললেন, ও উমার, যদি এটা সে হয়, তাহলে তুমি তাকে মারতে পারবে না। আর এটা যদি সে না হয়, তাহলে একে মেরে কোন লাভ নেই। যদি এটা আদ-দাজ্জাল হয়, তাহলে তোমার পক্ষে তাকে মারা সম্ভব না। আমরা জানি, একমাত্র যে ব্যক্তি আদ-দাজ্জালকে মারতে পারবেন তিনি হলেন সায়্যিদিনা ঈসা আলাইহিস-সালাম।
তাই রাসূলুল্লাহ সা বলেছিলেন যে এটা যদি সে হয়ে থাকে, তবে তুমি তাকে মারতে পারবে না, আর সে না হলে একে মেরে কোন ভালো হবে না। তাকে একা ছেড়ে দাও, সে কখনোই তার সাধ্যের বাইরে কিছু করতে পারবে না।
আমরা এ অংশটি থেকে এটা জানতে পারি যে রাসূলুল্লাহ সা নিজেও এই লোকটি সম্বন্ধে নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি নিজেও তাকে পরীক্ষা করে দেখছিলেন। এটা ছিল বুখারির হাদীস।
আরেকটি হাদীস, সেখানে বলা হয়, রাসূলুল্লাহ সা, উমার এবং আবু বকর (রা) মদীনার পথ ধরে যাচ্ছিলেন আর তাঁদের ইবন সাইয়্যাদের সাথে দেখা হলো। তখন রাসূলুল্লাহ সা তাকে থামালেন। তিনি বললেন, তুমি কি সাক্ষ্য দাও, আমি আল্লাহর রাসূল? ইবন সাইয়্যাদ বললো, আপনি কি এটা সাক্ষ্য দেন যে আমি আল্লাহর রাসূল? রাসূলুল্লাহ সা বললেন, আমি আল্লাহ-য় বিশ্বাস করি, তাঁর ফেরেশতা এবং কিতাবসমূহে বিশ্বাস করি। তুমি কি দেখছ? কি সংকেত পাচ্ছ? সে বললো, আমি দেখতে পাচ্ছি, পানির উপর আরশ বা সিংহাসন। রাসূলুল্লাহ সা বললেন, সে ইবলিসের রাজ্য দেখতে পাচ্ছে। আমরা জানি যে ইবলিসের জগৎ হলো সমুদ্রে। তো এই লোক খুবই সন্দেহজনক!
তখন রাসূলুল্লাহ সা তাকে বললেন, আর কি? তুমি আর কি দেখতে পাচ্ছ? সে বললো, আমি দেখতে পাচ্ছি- একজন মিথ্যাবাদী আর দুজন সত্যবাদী, অথবা দুইজন মিথ্যাবাদী আর একজন সত্যবাদী। রাসূলুল্লাহ সা তখন বললেন, একে নিজের মত ছেড়ে দাও, লোকটা দ্বিধাগ্রস্ত। এই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে মুসলিমে।
রাসূলুল্লাহ সা তাকে আরো একটু পরীক্ষা করতে চাইলেন। এবারে রাসূলুল্লাহ সা দেখতে চাচ্ছিলেন সে যখন একা থাকে, নিজের সাথে কথা বলে, তখন কি বলে। এই হাদীস টি আছে বুখারিতে।
উমার রা বলেন, রাসূলুল্লাহ সা এবং উবাই ইবন কা’আব, তাঁরা দুজন যেখানে ইবন সাইয়্যাদ ছিল, সেখানে গেলেন। সে ছিল একটা খেজুর গাছের পাশে। রাসূলুল্লাহ সা সেখানে যেয়ে খেজুর গাছের পিছনে আড়াল করে ছিলেন, যেন ইবন সাইয়্যাদ তাকে দেখতে না । রাসূলুল্লাহ সা তার কথা শুনতে পাচ্ছিলেন, কারণ সেই সময় খুবসম্ভব ইবন সাইয়্যাদ তার জ্বিনের সাথে কথা বলছিল। তাই রাসূলুল্লাহ সা লুকিয়ে ইবন সাইয়্যাদের কথা শোনার চেষ্টা করছিলেন, তাকে (সা) ইবন সাইয়্যাদ দেখে ফেলার আগে। ইবন সাইয়্যাদ একটা পাটির উপর শুয়ে ছিল।
ইবন সাইয়্যাদের মা রাসূলুল্লাহ সা কে দেখলেন। সে তার ছেলেকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘সফ’, তার একটা নাম ছিল সফ। সে বলল, ‘সফ, রাসূলুল্লাহ ওখানে’। এ হাদীসের বর্ণনাকারী উমার রা বলেন, সে লাফ দিয়ে উঠলো, রাসূলুল্লাহ সা বললেন, সেই মহিলা যদি তাকে (ইবন সাইয়্যাদকে) নিজের মত ছেড়ে দিত, তাহলে তার আসল পরিচয় প্রকাশ হয়ে যেত। সে তাকে একা ছেড়ে দিলে, আমি জানতে পারতাম, আসলেই সে কে। কিন্তু এমনটাই ঘটেছিল, রাসূলুল্লাহ সা তার কথা বুঝে ওঠার আগেই ইবন সাইয়্যাদের মা তাকে সতর্ক করে দেয়।
সে কি দাজ্জাল ছিল নাকি ছিল না?
মুহাম্মাদ বিন মুনকাযির, একজন তাবেঈন, তিনি বলেন, আমি জাবের ইবন আবদুল্লাহ কে দেখেছি, আল্লাহর নামে শপথ করে বলতে যে, ইবন সাইয়্যাদ ই আদ-দাজ্জাল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এটা কিভাবে বলতে পারো? কেমন করে এতো নিশ্চিত হচ্ছ যে সেই আদ-দাজ্জাল? জাবের ইবন আবদুল্লাহ বলেন, আমি উমার রা কে দেখেছি আল্লাহর নামে শপথ করে বলতে যে, ইবন সাইয়্যাদ আদ-দাজ্জাল আর রাসূলুল্লাহ সা তাকে কোন বাধা দেন নি। উমার রা রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে বলেছেন, ওয়াল্লাহি, ইবন সাইয়্যাদ হলো আদ-দাজ্জাল, আর রাসূলুল্লাহ সা নীরব ছিলেন।
সুনান আবু দাঊদ হাদীসে আছে, নাফা বলেছেন, ইবন উমার রা বলতেন, ওয়াল্লাহি, আল্লাহর কসম, ইবন সাইয়্যাদ আল মাসিহ আদ-দাজ্জাল। ইবন সাইয়্যাদের সাথে একদিন উমার রা এর দেখা হলো মদীনার এক রাস্তায়। উমার রা এমন কিছু বললেন, যার কারণে তার মন খারাপ হয়ে যায়। সে রাগ হয়ে যায়, আর তার শরীরের আকার বাড়তে থাকে যতক্ষণ না সে পুরো রাস্তার সমান হয়ে যায়! মানে সে বেলুনের মত বড় হতে হতে পুরো রাস্তাটি ভরে ফেলে।
উমার রা রাসূলুল্লাহ সা এর স্ত্রী উম্মে হাফসার কাছে যেয়ে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, তাকে তার মত ছেড়ে দাও। তুমি কি জানো না আদ-দাজ্জাল তখনই বের হয়ে আসবে যখন সে রাগত থাকেবে। দাজ্জাল এখনো বেঁচে আছে, কিন্তু সে দুনিয়ার ঘটনাবলি থেকে দূরে আছে, আর তার আগমন ঘটবে রাগে ফেটে পড়ার মধ্য দিয়ে। তাই উম্ম হাফসা বলছিলেন, তাকে ছেড়ে দাও।
আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, অনেক সাহাবাই তাকে নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, এমনকি রাসূলুল্লাহ সা এর স্ত্রী উম্ম হাফসা।
ইবন সাইয়্যাদ এটা পছন্দ করতো না যে লোকজন তাকে নিয়ে সন্দেহ করবে। তাকে নিয়ে মানুষের এরকম আচরণ তার ভালো লাগতো না। এই হাদীসটি আছে মুসলিমে। (আরবি)
আবু সাইদ আল খুদরি বলেন, একবার আমরা হজ্জ্ব/ উমরার উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম, ইবন সাইয়্যাদও আমাদের সাথে ছিলো। আমরা একটা জায়গায় থামলাম, এরপর সকলে যে যার যার মত করে চলে গেলো, শুধু আমরা দুই জন বাদে। আমি খুব অস্বস্তি বোধ করছিলাম কেননা মানুষ তাকে নিয়ে নানা রকম কথা বলতো। লোকজন তার প্রতি সন্দিহান এটা ভেবে আমি তার আশেপাশে থাকতে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।
সে নিজের মালপত্র এনে আবু সাইদ আল খুদরির জিনিসপত্রের উপর রেখে দিলো। আবু সাইদ বললেন, তুমি তো দেখছ এখন প্রচণ্ড গরম, তুমি দয়া করে তোমার বাক্সগুলো সরিয়ে ঐ গাছের পাশে রেখে দাও। আবু সাইদ চাচ্ছিলেন না তার বাক্স উনার জিনিসের সাথে স্পর্শ করুক তাই তিনি বললেন, তুমি কি দয়া করে তোমার জিনিসগুলো নিয়ে ওখানে গাছটার পাশে রাখবে?
আমরা কিছু ছাগল দেখতে পেলাম। ইবন সাইয়্যাদ গিয়ে কাপে করে খানিকটা দুধ নিয়ে আসলো। সে আমাকে বললো, ‘খাও’ (পান করো)। আমি বললাম, আজকে খুবই গরম পড়েছে, তাই দুধও গরম হবে। সত্যি বলতে ঐ দুধ না খাওয়ার পিছনে একমাত্র কারণ ছিল আমি তার হাত থেকে কিছু নিতে চাচ্ছিলাম না। তাই আমি একটা অজুহাত খুঁজে তাকে বললাম যে আবহাওয়া খুব গরম, সুতরাং দুধও গরম হবে, তাই আমি এটা খেতে চাই না।
তিনি বললেন, “হে আবু সাঈদ, আমার ইচ্ছা করছে আমি একটা দড়ি নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলে পড়ি এবং আত্মহত্যা করি, সবাই আমার ব্যাপারে যা বলাবলি করছে তা আর সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। ইবনে সাইয়েদ জানতেন যে, আবু সাঈদ তার হাত থেকে কিছু নিতেও চাচ্ছে না। তারপর তিনি বললেন, “হে আবু সাঈদ, তোমরা আনসাররা যারা আছ, তোমরা কি রাসূল (সাঃ) এর হাদীস সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অবগত নও ? বিশেষ করে, তুমি আবু সাঈদ, তুমি কি রাসূল (সাঃ) এর হাদীসের ব্যাপারে অনেক জ্ঞান রাখ না ?” তারপর তিনি বললেন, “রাসূল (সাঃ) কি একথা বলেন নি যে, দাজ্জাল হবে কাফের ? আমি তো একজন মুসলিম ! রাসূল (সাঃ) কি এ কথা বলেননি যে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হবে, তার কোন সন্তান থাকবে না ? আমি তো আমার সন্তানদের মদীনায় রেখে এসেছি। রাসূল (সাঃ) কি এ কথাও বলে যান নি যে আদ দাজ্জাল কখনও মদীনা বা মক্কায় প্রবেশ করতে পারবে না, অথচ আমাকে দেখ আমি মাত্র মদীনা থেকে বের হয়ে এসেছি এবং মক্কায় যাচ্ছি !
এ যুক্তি থেকে সহজেই বোধগম্য হল যে ইবনে সাইয়্যেদ দাজ্জাল নন। আমরা যদি এখানেই থেমে যাই তাহলেই দেখব যে তিনি দাজ্জাল নন, শুধু লোকেরা তাকে মিছিমিছি সন্দেহ করছে। কিন্তু এরপর কি হল ? আবু সাঈদ বললেন, “আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম এবং তাকে দাজ্জাল হবার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি প্রায় দিয়েই দিয়েছিলাম”। কিন্ত এরপর ইবনে সাইয়্যাদ বলে বসেন, “কিন্তু আমি জানি দাজ্জাল কে, কোথায় তার জন্ম এবং এখন সে কোথায় আছে”। এই কথা বলে তিনি আবার সব তালগোল পাকিয়ে ফেললেন। আবু সাঈদ তাকে তখন বললেন, “তোমার সারাটা দিন অকল্যাণময় হোক”।
আরেকটি বর্ণণায় এসেছে, এটি আছে মুসলিম শরীফে, এটি রাসূল (সাঃ) এর কোন হাদীস নয়, সাহাবাদের হাদীস মুসলিম শরীফে লিপিবদ্ধ হয়েছে, এ বর্ণণায় আবু সাঈদ তাকে বলেন, “তুমি যদি দাজ্জাল হও তবেই কি তোমার শখ পূরণ হবে?”, ইবনে সাইয়্যাদ বলেন, “আমার সামনে যদি প্রমাণ আনতে পার তাহলে আমি তা মেনে নেব”।
আবার বিভ্রান্তি সৃষ্টি হল ইবনে সাইয়্যাদ কি আসলেই দাজ্জাল ? ইবনে সাইয়্যাদ যে দাজ্জাল নন তার ব্যাপারে আমাদের হাতে আরেকটি দলীল আছে, এটি আছে মুসলিম শরীফে, বড় একটি হাদীস।
রাসূল (সাঃ) এর একজন সাহাবিয়াত, ফাতিমা বিনতে কাইসিম, তিনি বলেন, “আমি মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি শুনে মসজিদে গেলাম, রাসূল (সাঃ) এর সাথে সালাহ আদায় করলাম, আমি ছিলাম মহিলাদের সারিতে। মহিলারা মসজিদের পেছনের দিকে বসে সালাহ আদায় করছিলেন, আর আমি ছিলাম মহিলাদের সারির একদম সামনে, তাই আমি ছিলাম পুরুষদের সবচেয়ে কাছে। সালাহ আদায় করার পর, রাসূল (সাঃ) মিম্বরে বসলেন, তিনি হাসিমুখে ছিলেন এবং সবাইকে বলছিলেন, “তোমরা তোমাদের জায়গায় বসে থাক”। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি জান কেন আমি তোমাদেরকে জড়ো করেছি?”, তারা উত্তর দিল, “আল্লাহ এবং তার রাসূলই ভাল জানেন”। রাসূল (সাঃ) বললেন, “আমি তোমাদের এজন্য ডাকি নি যে, তোমাদের কাছে ওয়াদা করেছিলাম এমন কিছু দেব, কিংবা তোমাদেরকে কোন বিষয়ে সাবধান করব। আমি তোমাদেরকে জড়ো করেছি এ জন্য যে তামিম আদ দারি একজন খ্রিস্টান ছিল এবং একটু আগে আমার কাছে সে এসেছে এবং মুসলিম হয়েছে। আর সে আমার কাছে এমন একটা কাহিনী বর্ণণা করেছে, যা তোমাদের কাছে আমি দাজ্জালের ব্যাপারে যা বলেছিলাম তার সাথে মিল আছে”।
রাসূল (সাঃ) বললেন, লাখমান জুদাম নামক স্থান থেকে কিছু খ্রিস্টান আরব গোত্রের কিছু লোক তারা যখন জাহাজে করে যাচ্ছিল, বড় ঢেউ খেলে তাদের জাহাজ ওলটপালট হয়ে গেল, আর একটা অজানা দ্বীপে তরী ফেলার আগ পর্যন্ত তারা এক মাস ধরে দিকভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেই দ্বীপের সন্ধান পেলে তারা নৌকায় করে সেই দ্বীপ অভিমুখে যাত্রা শুরু করল, এটা ছিল রাতের বেলা, তারা সকালে সেই দ্বীপে পৌছল। এরপর তারা একটা জন্তুকে দেখল, যেটার সারা শরীর ছিল পশমে ভর্তি, তাই সে জন্তুটির সামনের দিক পেছনের দিক থেকে আলাদা করা যাচ্ছিল না। তারা তাকে বলল, “ওহে, তুমি কে?”, জন্তুটি উত্তর দিল, “আমি জাসসাসা”। তারা জিজ্ঞেস করল, “জাসসাসা কি”। সে এই প্রশ্নের উপেক্ষা করে বলল, তোমরা আমার সাথে একটা আশ্রমে আস, সেখানে একটা লোক বসে আছে সে তোমাদের সাথে দেখা করতে চায়। তারা এটা বর্ণণা করছেন নিজের ভাষায়, সেটা শুনে আমরা কিছুটা সংশয়ে পড়ে গেলাম, আমাদের কাছে মনে হল সে বিপদজনক কিছু হতে পারে। আমরা ভেতরে গেলাম, তাকে দেখলাম, সে অতিকায় এক লোক, এমন অতিকায় কাউকে আমরা কখনও আগে দেখি নি। লোকটিকে তার হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমরা বললাম, “ওহে, তুমি কে?” সে বলল, “তোমরা তো আমাকে দেখলে, তোমরা কারা সে সম্বন্ধে আমাকে কিছু বল”। তো এরপর তারা বলল, “আমরা আরব, আমরা সাগরে পথ হারিয়েছি এরপর এই দ্বীপে এসে পৌছেছি”। লোকটি অতঃপর বলল, “আমাকে বাইসান নামক স্থানের তালগাছ সম্পর্কে কিছু বল”। বাইসান হচ্ছে আশ-শামের একটি অঞ্চল। তারা বলল, “বাইসানের তালগাছ সম্পর্কে তুমি কি জানতে চাও?”, সে বলল, “সেগুলোতে কি ফল ধরে?”, তারা বলল, “হ্যাঁ, ধরে”। এরপর লোকটি বলল, “এমন একটা সময়ের আগমন হবে যখন সেই গাছে আর ফল ধরবে না। সে বলল, “আমাকে তাবারিয়াতে যে একটা হ্রদ আছে না, সেটা নিয়ে কিছু বল, সেই হ্রদে কি এখন পানি আছে?”। তাবারিয়া ফিলিস্তিনের একটি হ্রদ। তারা উত্তর দিল, “হ্যাঁ”, লোকটি তখন বলল, “এমন একটা সময়ের আগমন হবে যখন সেই পানি শুকিয়ে যাবে”। আল্লাহু আলম, ইহুদীরাই এ হ্রদ শুকিয়ে ফেলবে। এরপর সে তাদের কাছে জানতে চাইল, জুগারে বসন্ত কালে কি পানি থাকে কিনা, তারা উত্তর দিল, থাকে। সে বলল, “লোকেরা কি সেই পানিকে সেচকাজে ব্যবহার করে, তারা বলল, হ্যাঁ করে, আর সেখানে অনেক পানি আছে, লোকে সেগুলো কৃষিকাজে ব্যবহার করে। সে জবাবে আর কিছু বলল না। তারপর সে বলল, “সেই নিরক্ষর নবী সম্পর্কে আমাকে কিছু বল”। এই নিরক্ষর নবী হচ্ছে নবী মুহাম্মদ (সাঃ)। তারা বলল, “তিনি মক্কা ছেড়ে গিয়েছেন আর এখন মদীনায় আছেন”। সে জিজ্ঞেস করল, “আরবরা কি তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে?”, তারা বলল, “হ্যাঁ”। সে জিজ্ঞেস করল, “উনি তাদের সাথে কেমন আচরণ করছেন? তার সাথে আরবদের যুদ্ধে কে জিতেছে?”, তারা উত্তর দিল, “তিনি জয়লাভ করেছেন আর এখন তারা তার অনুগত। তাদের জন্য এটাই কল্যাণকর যে তারা তাকে মেনে নেবে”।
এবার লোকটির পরিচয় দেবার পালা। সে বলল, “আমি হচ্ছি মসীহ। এটা সময়ের ব্যাপার যে আমাকে মুক্ত করে দেয়া হবে আর আমি সারা বিশ্ব ভ্রমণ করব, এবং আমি ৪০ দিনের মধ্যে প্রতিটি শহর এবং গ্রামে প্রবেশ করব, মক্কা এবং তাইয়্যেবা-এ দুটো শহর ছাড়া, তাইয়্যেবা হচ্ছে মদীনা। আমাকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। আমি যখনই সেখানে ঢুকতে যাব, সেখানে কিছু ফেরেশতা থাকবে, তারা মক্কা এবং মদীনার প্রতিটি প্রবেশপথে পাহারা দেবে।
এতটুকু বলে, রাসূল (সাঃ) তার হাতের লাঠি দিয়ে মিম্বরে আঘাত করে ৩ বার বললেন, “এটাই হল তাইয়্যেবা”। তারপর তিনি বললেন, “আমি কি তোমাদেরকে আগে এমনটি বলি নি?”, লোকে উত্তর দিল, “হ্যাঁ বলেছেন”, তিনি বললেন, “আমি তোমাদেরকে তামিমের গল্পটি শোনাতে চেয়েছি কারণ সে যা বলেছে আর আমি তোমাদের আগে যা বলেছি তার মধ্যে মিল আছে”। এরপর রাসূল (সাঃ) বললেন, “সে এখন আশ-শামের সাগরে অবস্থান করছে”। আশ-শামের সাগর হচ্ছে ভূমধ্যসাগর, অথবা ইয়েমেনের সাগর। আর ইয়েমেনের সাগর হচ্ছে লোহিত সাগর কিংবা আরবসাগর। তারপর রাসূল (সাঃ) বললেন, “না”, তিনি পূর্বদিক নির্দেশ করে ৩ বার বললেন, “সে পূর্ব দিকে আছে”। এর মানে আমরা বুঝতে পারলাম, দাজ্জালের অবস্থান মদীনার পূর্বে, কিন্তু পূর্বের ঠিক কোথায় আছে, তা কেবল আল্লাহই জানেন।
এই হাদীস থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে, এর মধ্যে একটা হচ্ছে, আদ-দাজ্জাল এখন জীবিত অবস্থায় আছে এবং তামিম আদ দারি তাকে দেখেছিলেন। রাসূল (সাঃ) তার বক্তব্যকে অনুমোদন দিয়েছিলেন এবং আমরা এও জানি যে দাজ্জাল ৪০ দিনে সারা দুনিয়া ভ্রমণ করবে এবং সে মক্কা, মদীনা এবং জেরুসালেম এই তিনটি শহর ছাড়া পুরো বিশ্বে অবস্থান করবে।
আসুন আবার আমরা ফিরে যাই ইবনে সাইয়্যাদ এর ব্যাপারে। ইবন সাইয়্যাদ কি দাজ্জাল হতে পারে ? যখন তামিম আদ দারি দাজ্জালকে সেই দ্বীপে দেখেছেন ? আল-ক্বুরতুবী বলেন, এটা নিয়ে কোন কোন সন্দেহ নেই। তিনি মনে করেন ইবন সাইয়্যাদ হচ্ছে আদ দাজ্জাল এবং তার জন্য এটা অসম্ভব নয় যে তামিম আদ দারি যখন তাকে দেখেছেন তখন সে ঐ দ্বীপে অবস্থান করেছিল আর মদীনায় সে অন্য কোন সময়ে অবস্থান করছিল। কিন্তু অন্য কিছু স্কলার এই ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন এই যুক্তিতে যে কিভাবে এটা হতে পারে, যে ইবনে সাইয়্যাদ মদীনায় কমবয়সী যুবক আর ঐ দ্বীপে একজন প্রাপ্তবয়স্ক বৃদ্ধ এক লোকে পরিণত হয়েছে ?
আশ-শাওকানি সবগুলো মতকে একত্র করেন এবং বলেন, ইবনে সাইয়্যাদ এর ব্যাপারে প্রচলিত মতগুলোর কোনটির সাথে কোনটির কোন মিল নেই, এ ব্যাপারে সবাই খুব বিভ্রান্ত এবং প্রত্যেকের নিজস্ব মত আছে। আমরা এই হাদীস থেকে শিখতে পারি যে, ইবনে সাইয়্যাদ এর দাজ্জাল হবার ব্যাপারটি রাসূল (সাঃ) নিজেই নিশ্চিত ছিলেন না। কাজেই রাসূল (সাঃ) যে ব্যাপারে নিশ্চিত নন, সে ব্যাপারে আমরাও কোন নিশ্চিত অবস্থান নিতে পারি না।
ইমাম আন-নভভীর মতে, আদ-দাজ্জালের এই কাহিনীটি সংশয়াবিষ্ট। এটা নিয়ে সন্দেহ আছে যে ইবনে সাইয়্যাদ আসলেই দাজ্জাল কিনা, তবে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই সে একজন প্রতারক, ভণ্ড। সে হয়ত প্রতারক দাজ্জাল নয়, তবে সে প্রতারকদের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু সে কি দাজ্জাল ? তা আমরা জানিনা। আল্লাহু আলম।
খ্রিস্টান ধর্মে দাজ্জালকে antichrist বলে অভিহিত করা হয়। এই নামটি যথার্থ। Christ শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ Christa থেকে, এর মানে হল মেসিয়াহ, যা আরবী মসীহ শব্দের সমার্থক। Christ মানে হচ্ছে অবাঞ্চিত, আরবীতে মসীহ শব্দের এই একটাই অর্থ। অর্থাৎ, সত্যিকারের মসীহ একজনই আছে, তিনি হচ্ছে ঈসা ইবন মারইয়াম। আর একজন হচ্ছে মিথ্যা মেসিয়াহ, তাকেই বলা হয় দাজ্জাল।
ইবনে হাজার আল আসকালানি একটি ঘটনা বর্ণণা করেছেন, কিন্তু সে ঘটনাটি বর্ণণাসূত্রের একজন বর্ণণাকারী বা রাবী আছেন যার পরিচয় অজ্ঞাত। কোন হাদীস সহীহ হতে হলে, সেই হাদীসের বর্ণণাসূত্রে যত রাবী আছে তাদের প্রত্যেককেই নির্ভরযোগ্য এবং সত্যবাদী ব্যাক্তি হতে হবে, তা না হলে সেই হাদীসটি দূর্বল বলে গণ্য হবে। এই হাদীসে একজন রাবী সম্পর্কে কিছু জানা যায় না, বাকিরা সকলে নির্ভরযোগ্য, সত্যবাদী এবং খাঁটি।
এই ঘটনাটি বর্ণণা করেছেন আবু না’ঈম আল আসবাহানী, যেটি ঘটেছিল আসবাহানী নামের একটি জায়গায়। এ ঘটনাটি আবু সাইয়্যাদ এর দাজ্জাল হবার ব্যাপারটিকে সমর্থন করে। আসবাহান জায়গাটি মধ্য এশিয়ায়। তিনি বলেন, আমরা যখন আসবাহান জয় করলাম তখন সেখানে কিছু উহুদী বসবাস করত। আমরা তাদের পাড়ায় যেতাম মুদির জিনিষপাতি কেনার জন্য। একদিন আমরা দেখলাম তারা আনন্দ উদযাপন করছে। আমার এক ইহুদী বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন এ উদযাপন, সে জবাব দিল, আমাদের রাজা আরবদেরকে পরাজিত করবে এবং সে ঘটনা এইখানে ঘটবে। এ ঘটনার পর আমি রাতে ঘুমাতে চলে গেলাম এবং পরের দিন সকালে আমি ঘুম থেকে উঠে বাসার ছাদ থেকে দেখতে চেষ্টা করলাম তাদের রাজা কে, এবং আমি আবিষ্কার করলাম ইবনে সাইয়্যাদ হচ্ছে তাদের রাজা।
সে মদীনা থেকে পথ ধরে আসবাহানে গিয়েছিল এবং সে আর ফিরে আসে নি, আমরা তাকে এরপর কখনও দেখি নি। এই ঘটনাটা খুবই কৌতূহলুদ্দীপক, কারণ আমরা একটা হাদীস জানি যেখানে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, দাজ্জাল এর আগমন ঘটবে খুরাসান থেকে, আর খুরাসান হচ্ছে আসবাহানের নিকটের একটি জায়গা, সেখানে দাজ্জালের সাথে ৭০,০০০ ইহুদী থাকবে। এখানে আমরা দেখছি যে ইবনে সাইয়্যাদ মদীনা থেকে আসবাহানেই গিয়েছে, সেখানেই থেকেছে এবং কখনই আর ফিরে আসে নি। কিন্তু তারপরেও আমরা এ হাদীসটির আপাত অর্থ নিতে পারি না, কারণ এই হাদীসের একজন রাবীর পরিচয় আমাদের জানা নেই। ওয়াল্লাহু আলম।
এই ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়্যা বলেন, ইবনে সাইয়্যাদ এর ব্যাপারটি খুবই সমস্যাপূর্ণ, কিছু সাহাবা তাকে দাজ্জাল মনে করতেন, কিন্তু রাসূল (সাঃ) এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেন নি, যতক্ষণ না তার কাছে এটা পরিষ্কার হয়েছিল যে সে দাজ্জাল নয়, বরং সে একজন মিথ্যাবাদী এবং জাদুকর যে মৃত্যু নিয়ে কাজ করত। ইবনে তাইমিয়্যা বলেন, রাসূল (সাঃ) শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে সে দাজ্জাল নয় বরং সে একজন শয়তানের পূজারী এবং শয়তানের সাথে তার কাজকর্ম ছিল।
ইবনে কাসীর বলেন, আমরা এই উপসংহারে আসতে পারি যে নিশ্চিত ভাবেই ইবনা সাইয়্যাদ দাজ্জাল নয় যার আগমন ঘটবে শেষ জমানায় আর এটি প্রমাণে তিনি ফাতিমা বিনতে কাইসিমের ঘটনাটিকে নিশ্চিত হিসেবে উত্থাপন করেন। জাবির বলেন, ইয়াওমুল হাররাহ যুদ্ধে, যে যুদ্ধটি হয়েছিল বনী উমাইয়াহ এর শাসনকালে, সেই যুদ্ধের পর থেকে ইবা সাইয়্যাদ উধাও হয়ে যায়, পরে সে কোথায় গিয়েছে তা আর জানা যায় নি। এটা আবু দাউদে বর্ণিত আছে।