এমন একটা সময় আসবে যখন যার মধ্যে জীবন আছে, এমন সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে , পৃথিবীর সকল প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে, সকল প্রকার জীবনের পরিসমাপ্তি হবে, আল্লাহ্ বলেছেন كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ ‘পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই ধংস হয়ে যাবে’ (আর রাহমান)। তারা কেবল একটা ভয়াবহ শব্দের অপেক্ষা করছে, যা তাদেরকে আঘাত করবে তাদের পারস্পরিক বাকবিতন্ডা কালে। (ইয়াসীন ৪৯)
কেবল একটা বিকট চিৎকারে সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যাবে, এটা এত তাড়াতাড়ি হবে যে, মানুষরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও ঝগড়া করতে থাকবে, কিন্তু সবকিছু থেমে যাবে এবং তখন হাতে কোন সময়ই থাকবে না, পিছনে ফিরে যাওয়ার কোন সুযোগ থাকবে না, নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাব, অসম্পূর্ণ কাজ গুলো শেষ করব, তাদেরকে ভালো মন্দ কিছু উপদেশ দিব, এ ধরণের কোন সময় সুযোগ পাওয়া যাবে না। সবকিছু হঠাৎ করে হয়ে যাবে। যখন সেই সময়টা আসবে, সেই মুহুর্তটি আসবে, তখন সব কিছু বন্ধ হয়ে যাবে, থেমে যাবে, জীবনের সমস্ত স্পন্দন থমকে যাবে”। আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা বলেন, তখন তারা ওছিয়ত করতেও সক্ষম হবে না। এবং তাদের পরিবার-পরিজনের কাছেও ফিরে যেতে পারবে না। (ইয়াসিন ৫০)
“এইটা এত দ্রুত হঠাৎ করে চলে আসবে যে রাসুল (সাঃ) বলছেন, ‘সেই সময়টি যখন চলে আসবে, কোন দুইজন ব্যক্তি একটি লেনদেন নিয়ে আলোচনা করতে থাকবে, একজন ব্যক্তি অপরজনের কাছে এক টুকরো কাপড় বিক্রি করছে, কিন্তু সেই সময়টি যখন চলে আসবে, তখন তারা তাদের সেই কাপড়ের টুকরা গুটানোর সময়টুকুও পাবে না”, বিক্রি করা দূরে থাক’ এটা তাদেরকে থামিয়ে দিবে।
ব্যাপারটা এমন দ্রুত হবে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কিয়ামত চলে আসবে এমন এক মুহুর্তে যখন “কোন একজন মানুষ দুধ নিয়ে তার বাসায় যাবে, তার ঊটের দুধ নিয়ে বাড়িতে যাবে, কিন্তু সে সেটার স্বাদও গ্রহণ করতে পারবে না”। কিয়ামত চলে আসবে এমন এক মুহুর্তে যখন “একজন মানুষ হাত উঁচু করবে খাবার নেয়ার জন্য কিন্তু যখন সেই সময় চলে আসবে, হঠাৎ করে চলে আসবে, তখন সে সেই খাবার মুখের ভিতরে প্রবেশ করানোর সময়টুকুও পাবে না”। এটা এতটাই দ্রুত হবে যে সব কিছু মুহূর্তের মাঝেই থেমে যাবে। কিভাবে এটা হবে? এটা হবে একটি ফুৎকার মাত্র, আস-সুর। কুর’আনে বিভিন্ন স্থানে আস-সুর সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে, আস-সুর কি জিনিস? আস-সুর হচ্ছে একটা শিঙ্গা। আর যিনি এই শিংগাটি ধারণ করে আছেন , তিনি হচ্ছেন ফেরেশতা ইসরাফিল। রাসুলুল্লাহ সা) তাকে দেখেছেন। তিনি তাকে দেখে এসেছেন মিরাজে। এবং তিনি তাকে দেখে এসে যা বলেছেন সেটা হচ্ছে, এরকম, “সেই ফেরেশতার দৃষ্টি সবসময় আল্লাহ্ এর আরশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে”, কেন? কারণ, তিনি ভয়ে আছেন, না জানি “কখন সেই সময় চলে আসে, আল্লাহর আদেশ পালনে না আবার দেরি হয়ে যায়, যখন সেই মুহুর্তটি চলে আসবে তখন তিনি আরশের দিকে মুখ ফেরাবারও সময়টুকুও পাবেন না, তাই তিনি সবসময় আরশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছেন বিচার দিবসের আগমনের অপেক্ষায় জন্য। এরপর রাসুল (সাঃ) আরও বলেছেন, তার চোখগুলো দেখতে জ্বলজ্বলে দুটা তারার মত। রাসূল সা) দেখলেন যে তাঁর চোখগুলো জ্বলজ্বলে তারার মত স্থির দৃষ্টিতে আল্লাহর আরশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায়। যখন রাসুল (সাঃ) এ দৃশ্য দেখলেন, তাঁর নিজের চোখে, তিনি “এরপর এই দুনিয়ার থেকে সমস্ত আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। তারপর তিনি বলেন, কিভাবে আমি নিজেকে উপভোগ করতে পারি? কিভাবে আমি এই দুনিয়ায় কোন কিছুতে বিনোদন খুঁজে পেতে পারি? কিভাবে আমি এই দুনিয়ায় কোন মজা পেতে পারি যখন একজন ফেরেশতা সেই শিঙ্গাটা মুখে নিয়ে বসে আছে, তার কপাল ঝুঁকে আছে সামনের দিকে, দৃষ্টি ফিরে আছে আরশের দিকে, আর কান খুলে সজাগ হয়ে আছে সেই মহা নির্দেশের জন্য, যখন তিনি সেই শিংগায় ফুৎকার দিবেন। তিনি ইতিমধ্যে মুখে শিংগা নিয়ে বসে আছেন, এমনকি তার কপাল সামনের দিকে ঝুঁকে আছে, দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে, কান খুলে শুধু সেই মহা আদেশের অপেক্ষায় আছেন কখন সেই মুহুর্তটি আসবে, যখন তাকে শিংগায় ফুৎকারের আদেশ দেয়া হবে, আর তিনি সেই আদেশ পালন করবেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এরপর কিভাবে আমি এই দুনিয়ার স্বাদ, আনন্দ উপভোগ করবো? যখন ফেরেশতা শিঙ্গায় ফুৎকারের অপেক্ষায় বসে আছেন?
কখন সেই সময় হবে, কখন শিঙ্গায় ফুক দেয়া হবে? কি বার হবে সেদিন? সেটা হবে একটি জুম্মার দিন। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “সবদিনের সেরা দিন হল শুক্রবার, জুম’আর দিন, যে সাতদিন সূর্য উঠে তার মধ্যে সেরা দিন হল জুমুয়ার দিন। সেই দিন আদম (আঃ) সৃষ্টি হয়েছেন, এই দিনেই তিনি জান্নাতের ভিতরে প্রবেশ করেছেন। এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, এবং এই দিনেই কিয়ামত দিবস সংঘটিত হবে”। । হাদীসটি রয়েছে মিশকাত আল মাসাবিহতে।
রাসুল (সাঃ) আরেকটি হাদীসে বলেছেন, “সব দিনই আমার কাছে হাজির করা হল, আমার কাছে শুক্রবারকে মনে হল একটা সাদা আয়নার মত,খুবই উজ্জ্বল ও পরিষ্কার, কিন্ত এর মাঝখানের দিকে দেখি একটা কালো দাগ, যখন জিজ্ঞেস করলাম, এটা কেন? আমাকে বলা হল এটা হচ্ছে সেই সময়ের জন্য” অর্থাৎ কিয়ামত দিবসের জন্য। জুমার দিনে।
আরেক হাদীসে তিনি বলেছেন, “যেদিন সূর্য উঠে তার মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র দিন হল জুম্মাহ এর দিন, যেই দিন আদম (আঃ) সৃষ্টি হয়েছেন, এই দিনেই তিনি পৃথিবীতে এসেছেন, এই দিনেই তার তাওবা কবুল করা হয়েছে এবং এই দিনেই তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন এবং এই দিনেই সেই মুহুর্তটি চলে আসবে, কিয়ামত সংঘটিত হবে”। কিন্তু, এই হাদীসে নতুন কি তথ্য রয়েছে? এই হাদীসের বাকি অংশে বলা হচ্ছে, এই তথ্যের ফলে প্রাণীজগতের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া দেখা যায় সে সম্পর্কে।
রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “প্রত্যেকটি প্রাণী জুম্মাহর দিনে ভীত আতংকিত অবস্থায় থাকে, ফজর নামাজের সূর্য উদয় হওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আতংকিত অবস্থায় থাকে”, কারণ তারা জানে এই দিনেই সেই ঘটনাটি সংঘটিত হবে, তারা আতংকিত অবস্থায় তটস্থ থাকে, ইল্লা জিন ওয়াল ইনসান, শুধু জিন আর মানুষ ছাড়া, আমরা এই দিনেই একটু বাড়তি সময় ঘুমাই, কোন চেতনা নাই, বাকি সৃষ্টিকূল ভয়ে থাকে, আমরা ঘোরাফেরা করি, আমরা এমন ভাবে এই দিনের জন্য পরিকল্পনা করি, যেন এই দিনে কোন কিছুই হবে না।
আল্লাহ সুবাহানা ওয়া তাআলা বলেন “ শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমান ও যমীনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন। অতঃপর আবার শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দন্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে”।
একটা বিকট শব্দ হবে, সবাই জেগে উঠবে কিছু লোক ছাড়া, যাদেরকে আল্লাহ জাগাতে চাইবেন না, তারা ব্যতিক্রম, এরপর আরেকটি শব্দ হবে, সবাই দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকবে” । এখন কারা সেই ব্যতিক্রম? সেই সম্পর্কে আলিমদের মতভেদ ছিল, কেউ বলেছেন তারা হবে জান্নাতের সেবক সেবিকারা, কেউ বলেছেন তারা হবে জান্নাতের পবিত্র হুর,হুর আল আইন, কেউ বলেছেন জিব্রাইল (আঃ), মিকাইল (আঃ), ইসরাফিল (আঃ), কেউ বলেছেন তারা হবে ফেরেশতা যারা আরশ বয়ে নিয়ে যায়, কেউ বলেছেন আশ –শুহাদা, আবার কেউ এটা কেউ অন্যটা… কিন্তু শেষে ইমাম কুরতুবি বলেছেন ‘“সঠিক মত হল এসকল মতকে সমর্থন করার মত পর্যাপ্ত দলীল নেই, কোনটা সঠিক তার প্রমাণ নেই” এবং হতে পারে এর সবগুলোই সম্ভব। তিনি আরও বলেছেন আমাদের এইটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোরও প্রয়োজন নেই কারণ আমাদের যা জানা দরকার, আমরা সেটা জানি আর তা হল আমরা সেই ব্যতিক্রম দলের মাঝে অন্তর্ভুক্ত কেউ নই”’।
আমরাও এটা বলব, আমাদের এইটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোরও প্রয়োজন নেই কারণ আমাদের যা জানা দরকার, আমরা সেটা জানি আর তা হল আমরা সেই ব্যতিক্রম দলের মাঝে অন্তর্ভুক্ত কেউ নই’। এবং ‘আমাদের যা জানা দরকার সেটা আমরা জানি’ এটা ইসলামের খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা মূলনীতি, আমাদেরকে প্র্যাকটিকাল হতে হবে, বাস্তব বুঝতে হবে, আমরা সব সময় সেই বিষয়ে আগে জানব যেটা আমাদেরকে সাহায্য করবে। আগে ব্যক্তিগতভাবে এরপর সামাজিকভাবে।
একারণেই আমরা দেখতে পাই, যখন একজন বেদুইন মসজিদে আসলো এবং রাসুল (সাঃ) কে প্রশ্ন করলো, মাতাস সা’আহ ! কখন আসবে সেই মুহুর্ত ! এই লোকটি এমন অবস্থায় এসেছে, যখন রাসূল (সা) মসজিদে কথা বলছেন। সে রাসুলুল্লাহ (সা) এর খুতবার মধ্যে ব্যাঘাত ঘটিয়ে প্রশ্ন করল, কখন সেই মুহুর্ত? রাসুলুল্লাহ তার দিকে কোন মনোযোগ দিলেন না, তিনি খুতবা চালিয়ে যেতে লাগলেন।
আবার বেদুইন টা জিজ্ঞেস করলেন কখন সেই সময় আসবে। রাসুলুল্লাহ তার দিকে কোন মনোযোগ দিলেন না, তিনি খুতবা চালিয়ে যেতে লাগলেন। আবার সে প্রশ্ন করল, কখন সেই মুহুর্ত? মাতাস সা’আহ !
বারবার জিজ্ঞেস করায় সাহাবারা বিরক্ত হতে থাকলেন এই ভেবে যে, রাসুল (সাঃ) প্রশ্নটা পছন্দ করে নি। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার কথা শেষ করে এবার জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় সেই ব্যক্তি যে বার বার প্রশ্ন করছিল?” তখন রাসুল (সাঃ) তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, তুমি সেই দিনের জন্য কি প্রস্তুত করেছো? কেন সে দিনের কথা তুমি জানতে চাও? তোমার সেটাই জানা উচিত যা তোমার কাজে লাগবে সেই দিনের জন্য তুমি কি প্রস্তুত করেছ? আমরা অনেক কাজ ই করি যা আমাদের ঈমান বাড়ায় বা কমায় না, অর্থহীন কাজ, রাসুল(সাঃ) বলেছেন,“আল্লাহুম্মা ইন্নি আস’আলুকা ইলমান নাফিয়া ও ইন্নি আউযুবিকা মিন ইলমিন লা ইয়ানফা আল্লাহ আমাদেরকে সেই জ্ঞান দাও যা আমাদের উপকারে আসবে এবং সেই জ্ঞান দিও না যা আমাদের কোন উপকারে আসবে না”। বেদুইন তখন বলল, “আমি অনেক অনেক সাওম প্রস্তুত করি নি, অনেক বেশি সালাতও প্রস্তুত করিনি, কিন্তু আমি আল্লাহ ও তার রাসুল এর জন্য ভালোবাসা নিয়ে নিজেকে তৈরি করেছি” রাসুল (সাঃ) বললেন, “তুমি তার সাথেই থাকবে যাকে তুমি ভালোবাসো”।
কয়বার সিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে? কিছু উলামা বলেছেন ২ বার, এদের মধ্যে আছেন আল কুরতুবি, ইবনে হাজর, তারা বলেছেন ২ বার বিকট শব্দ হবে। ১ম শব্দে সব কিছু ধংস হয়ে যাবে, আস সা’ফ, আর ২য় শব্দে যা কে বলে আল বা’দ, তখন সব কিছু পুনরায় উত্থিত হবে। কিন্তু অনেক উলামা বলেছেন ৩ টা হবে, প্রথম টা হবে আল ফা’জা, যেই চিৎকার সবার মনে ভয় তৈরি করবে, পরেরটা হবে আস সা’আক, যা সব কিছু ধংস করে দিবে, আর ৩ নম্বরটা আল বা’দ যা সব কিছুই পুনুরুত্থান ঘটাবে। ইবনে কাসির, ইবনে তাইমিয়্যাহ, আল কাজী,আবু বকর আল আরাবি এবং অন্য উলামাদের মতামত এটাই। পুনুরুত্থান আল্লাহ পুনরুত্থান নিয়ে বলেছেন “শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তখনই তারা কবর থেকে তাদের পালনকর্তার দিকে ছুটে চলবে। তারা বলবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে নিদ্রাস্থল থেকে উখিত করল? রহমান আল্লাহ তো এরই ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং রসূলগণ সত্য বলেছিলেন। এটা তো হবে কেবল এক মহানাদ। সে মুহুর্তেই তাদের সবাইকে আমার সামনে উপস্থিত করা হবে। লক্ষ্য করুন, তারা বলবে“কে আমদের এত লম্বা ঘুম থেকে জাগালো?” আমাদের সবচেয়ে বাজে একটা অনুভূতি হয় যখন কেউ আমদের হঠাৎ করে ঘুম থেকে ডাকে। যখন আপনি ঘুমিয়ে থাকেন, এরপর সাধারণত আস্তে আস্তে ঘুম থেকে উঠতে চাইবেন, না হলে হঠাৎ করে কেউ এসে আপনাকে একটা আঘাত করে উঠিয়ে দিলে আপনি অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকবেন। আতংকিত হয়ে যাবেন। কি হল ! কে আমাকে ঘুম থেকে তুলল ! হ্যাঁ ! এবং এবার শুধু কল্পনা করে দেখুন এমন একটা লম্বা ঘুম থেকে আপনাকে উঠান হল, যখন আপনি কবর থেকে উঠে এসেছনে, হঠাট করে কবরগুলো উন্মুক্ত হয়ে যাবে, তারা আতংকিত অবস্থায় উঠা মাত্রই দেখতে পাবে পাহাড় পর্বতগুলো চুরমার হয়ে যাচ্ছে, বিস্ফোরণ ঘটছে, চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, সাগর মহাসাগরে অগ্নিশিখা লেলিহান, আগুন জ্বলছে, চাঁদ তারা খসে পড়ে যাচ্ছে, সূর্য একেবারে মাথার দাঁড়িয়ে উপরে ! পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে থাকবে, নিজদের মাথার খুলি ফেটে উন্মুক্ত হয়ে যাবে, দেখবে আশে পাশের মানুষেরা এমনভাবে দৌড়াচ্ছে যেন তারা মাতাল ! মানুষ তখন বলবে এ আমাদের কি হল ? আমরা কি মাতাল হয়ে গেলাম ? কিন্তু আল্লাহ সুবহানু ওয়া তা’আলা বলবেন, “এবং মানুষকে তুমি দেখবে মাতালের মত; অথচ তারা মাতাল নয় বস্তুতঃ আল্লাহর আযাব সুকঠিন।”
কল্পনা করুন তখন মানুষের অবস্থা কি হবে, তারা চিৎকার করে বলতে লাগবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ ! আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কুর’আনে আমাদের বলছেন এই সকল মানুষদের কি অবস্থা হবে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কি বলছেন সেটা বলার আগে আমি চাই আপনারাও আমার সাথে একটা দৃশ্য কল্পনা করে দেখুন, একটা বাচ্চার কথা চিন্তা করুন , যে কবর থেকে উঠে এসেছে, একটা বাচ্চা, এক বছর বয়সের বাচ্চা, সে এক বছর বয়সে মারা গেছে, মানুষ তাকে কবর দিয়েছে, সে যখন পুনরুত্থান দিবসে বের হয়ে আসবে, এই বাচ্চাটা যখন কবর থেকে উঠে আসবে, সে মানব জাতিকে নিজের সামনে দেখতে পাবে, সে দেখতে পাবে, সবাই ঘামছে, কেউ ঘাম দিয়ে হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা, কেউ ঘামে কোমর পর্যন্ত ঢাকা, আবার কেউ ঘামে কাঁধ পর্যন্ত ঢাকা, কারণ সে সময় সূর্য ঠিক মাথার উপরে। তার পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে, পাহার ভেঙ্গে চুরমার হয়ে ধুলা হয়ে যাচ্ছে, সাগরে আগুন লাগছে, আকাশ ফেটে যাচ্ছে, চাঁদ খসে পরছে, আপনার কি মনে হয় সে সময় ১ বছরের বাচ্চার প্রতিক্রিয়া কি হবে? আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কুর’আনে বলছেন, “অতএব, তোমরা কিরূপে আত্মরক্ষা করবে যদি তোমরা সেদিনকে অস্বীকার কর, যেদিন বালককে করে দিব বৃদ্ধ?” সেদিন সূর্য মাথার ঠিক উপরে থাকবে এবং এতে ঐ বাচ্চা ছেলেটার চুল ধূসর হয়ে উঠবে, বাচ্চা ছেলেটার চুল বৃদ্ধ মানুষের মত ধূসর হয়ে যাবে, সেই দিনের ভয়াবহতার কারণে। ঐ বাচ্চা টা কোন পাপ না করেই চলে গেছে কিন্তু তার চুলও সেই দিনে ধূসর হয়ে উঠবে, তাহলে আমাদের কি হবে? যারা আমরা প্রতিনিয়ত পাপ করে বেড়াচ্ছি, একের পর এক ভুল করছি, কিন্তু তাওবা করছি না! তাহলে আমাদের কি হবে। সেটাই হচ্ছে আসল দিবস, আসল দিন ! আল ইয়াওম আল আজিম !
ইয়াওমুল কিয়ামাহ…কিয়ামতের দিন কিভাবে সেই পুনুরুত্থানের ঘটনা ঘটবে? যখন সবকিছু ধবংস হয়ে যাবে এবং মরে পড়ে থাকবে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আসমান থেকে একটি বৃষ্টি নাযিল করবেন, এবং আমরা আমাদের বীজ থেকে বেড়ে উঠব, আমাদের বীজ কি ! রাসুল (সাঃ) বলেছেন আমাদের সম্পূর্ণ শরীর নষ্ট হয়ে যাবে, প্রতিটি অংশ মাটি খেয়ে ফেলবে, শুধু মাত্র একটি ছোট্ট অংশ ছাড়া, আমাদের মেরুদণ্ডের শেষ ভাগে একটি ছোট্ট অংশ, সেই অংশটুকুর কিচ্ছু হবে না, এবং সেই বীজ থেকেই আমদের পুনরায় তৈরি করা হবে, আল্লাহ সুব আসমান থেকে একটি বৃষ্টি, আসলে এক প্রকার তরল নাযিল করবেন যার মাধ্যমে আমরা আমাদের বীজ থেকে আবার বেড়ে উঠব। রাসুল (সাঃ) সহিহ আল বুখারিতে বলেছেন, “দুইটি ফুৎকারের মধ্যে ব্যবধান হবে ৪০ ” তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল ৪০ দিন না, ৪০ মাস না ৪০ বছর তিনি উত্তর দেন নি, সুতরাং কত দিন সেইটা আমরা ঠিক করে জানি না
এরপর রা সা) বলেন, এরপর আকাশ থেকে কিছু তরল মাটিতে পড়বে এবং আমরা সেভাবেই বেড়ে উঠব যেভাবে বীজ থেকে গাছ হয়। তাই আল্লাহ বীজ থেকে গাছ তৈরি হওয়ার সাথে মানুষের সে সময় তৈরি হওয়ার সাথে তুলনা করে বলছেন, “তিনিই আল্লাহ যিনি বায়ু প্রেরণ করেন, অতঃপর সে বায়ু মেঘমালা সঞ্চারিত করে। অতঃপর আমি তা মৃত ভূ-খন্ডের দিকে পরিচালিত করি, অতঃপর তদ্বারা সে ভূ-খন্ডকে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করে দেই। এমনিভাবে হবে পুনরুত্থান”। তাই আল্লাহ বলেন মৃত যমীনটাকে দেখো, যেটা ছিল মৃত ! এখন সেটা জীবিত। আল্লাহ বলেন, “এটাই হলো আমাদের পুনরুত্থানের ঘটনা।” এভাবেই হবে পুনুরত্থান, আমাদেরকে আমাদের মৃত বীজ থেকে উদগত করা হবে।
কার কবর প্রথম খোলা হবে? মুহাম্মাদ (সাঃ)। যার কবর বর্তমানে মদিনায়, তাঁর কবরটাই প্রথমে উন্মুক্ত করা হবে, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “আমি মানুষ জাতির নেতা কিয়ামতের দিনে এবং হাশরের দিনে আমার কবর ই প্রথম খোলা হবে”মুসলিম। আরেকটি সহিহ হাদিসে এসেছে একজন মুসলিম একজন ইহুদির সাথে তর্ক করছিলেন এবং ইহুদীটি বলতে লাগলো, তার নামে যিনি মূসার কাছে তাওরাত প্রদান করেছিলেন এবং তখন মুসলিম ব্যক্তিটি ইহুদি কে আঘাত করে বসে এবং সে মুহাম্মাদ সাল্লা)কে প্রশংসা করা শুরু করল। অর্থাৎ, কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ের ইহুদী ব্যক্তি সে তার নিজের নবী তাওরাত নিয়ে গর্ব শুরু করল, আর মুসলিম ব্যক্তিটিও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে গর্ব করা শুরু করল। কিন্তু যখন মুসলিম ব্যক্তিটি ইহুদীকে আঘাত করে বসল, তখন সে ইহুদী নালিশ নিয়ে রা সা) এর কাছে আসল, তখন রাসুল (সাঃ) সেই মুসলিম কে বলেন, আমার স্থান কে মুসা (আঃ) এর উপরে স্থান দিও না, সবার আগে আমার কবর খোলা হলেও আমি দেখতে পাবো মুসা (আঃ) আল্লাহর সিংহাসন ধরে আছেন, তাই আমি নিশ্চিত না, তিনি কি মৃতদের অন্তর্ভুক্ত নাকি না। প্রথম ফুঁৎকারে আস সা’আক, যেটাতে সব কিছু ধংস হয়ে যাবে, সবাই মরে পড়ে থাকবে কিন্তু কেউ কেউ থাকবেন ব্যতিক্রম, তাঁর মাঝে মুসা (আঃ) ছিল কিনা। এখন, তিনি বলেন, “আমাকে মুসা (আঃ) এর উপরে স্থান দিও না”। এর অর্থ কি? হ্যাঁ, অবশ্যই রাসুল (সাঃ) অনেক হাদিসেই বলেছেন তিনি মানব জাতির নেতা, আদম জাতির সাইয়িদ, নেতা আমরাও এটা বিশ্বাস করি রাসুল (সাঃ) আল্লাহর সকল আম্বিয়ার মাঝে শ্রেষ্ঠ, কিন্তু রাসুল (সাঃ) চান না, আমরা আল্লাহর আম্বিয়াদের নিয়ে কোন প্রতিযগিতা করি, শুধু মাত্র এই কারণে যে অবিশ্বাসীরা এতে মন খারাপ করবে, তাদেরকে পরাজিত করার জন্য আমরা যেন কোন আম্বিয়াকে ছোট না করি, আমরা যেন কে শ্রেষ্ঠ আম্বিয়া সেইটা নিয়ে প্রতিযোগিতা করে কোন আম্বিয়া কে ছোট না করি, কারণ এই আম্বিয়াগণ ইহুদি খ্রিষ্টান কারোরই জাতিভুক্ত নয়, তারা এই মুসলিম উম্মাহরই সদস্য। মুসা উম্মাহ এ মুসলিমিন এর একজন। একারনেই, যখন রাসুল (সাঃ) মদিনায় গিয়ে দেখেন আ-শুরার দিনে ইহুদিরা রোজা পালন করছে, তারা বলছে, এইটা এমন একটা দিন যেদিন আল্লাহ ফিরাউনের কবল থেকে মূসাকে রক্ষা করেছেন। তখন তিনি বলেন (২৩।০২-২৩।০৪) “মুসা (আঃ) যতটা না তাদের লোক তার চেয়েও বেশি আমাদের, আমরা এই দিনে রোজা রাখার বেশি হকদার” কারণ, ইহুদীরা তারা মূসাকে অনুসরণ করে না, তারা তাদের তাওরাত বদলে নিয়েছে, কাজেই, আমরা এইগুলো নিয়ে অমুসলিমদের সাথে প্রতিযোগিতা করব না, এর মাধ্যমে আল্লাহর আম্বিয়াদের প্রতি অসম্মান করা হয়, তাদেরকে ছোট করা হয়। এবং আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম আমাদেরই উম্মতের সদস্য। তাই আমাদের উচিত না কোনো ইহুদির কাছে যেয়ে বলা মুসা (আঃ) আমাদের মুহাম্মাদ (সাঃ) এর চেয়ে ভালো, আমাদের উচিত আল্লাহর সকল আম্বিয়া কেই শ্রদ্ধা করা, যদিও আমরা জানি মুহাম্মাদ (সাঃ) সকল সৃষ্টির মধ্যে থেকে বাছাইকৃত, শ্রেষ্ঠ আল মুস্তাফা মিন খালকি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের সবাইকে একত্রিত করবেন। আমরা যেখানেই মারা যাই না কেন সেটা পৃথিবীর বাইরে মহাকাশ হোক, কিংবা সাগর মহাসাগরের অতল গহীনে হোক, কিংবা মাটির নিচে হোক, আল্লাহ সবাইকে একত্র করবেন, আল্লাহ বলেছেন “তুনি যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ তোমাদের সবাইকে একত্রিত করবেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।” (বাকারা ১৪৮) মহাসমুদ্রের অতল গহিনে, মহাশূণ্যের অসীমে, যেখানেই থাকুন না কেন আল্লাহ সবাইকে একত্রিত করবেন, কাউকেই ছেড়ে দেয়া হবে না। কারণ এই সৃষ্টিজগতের পুরোটাই আল্লাহর মালিকানাধীন, কোন একজনও বাদ যাবে না, আল্লাহ বলেন, এবং আমি মানুষকে একত্রিত করব অতঃপর তাদের কাউকে ছাড়ব না। (কাহাফ ৪৭)
আল্লাহ সুব তাঁর সৃষ্টিজগতের সবাইকে একত্রিত করবেন, এর মানে কি সেখানে পশুরাও থাকবে ? হ্যাঁ, সেদিন পশুরাই সেখানে থাকবে। সেইদিন পশুদেরও একত্র করা হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, যখন বন্য পশুরা একত্রিত হয়ে যাবে, আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টি কে একত্রিত করবেন, পশু পাখি, এমনকি পোকামাকড়, সবকিছু। এবং আল্লাহ সেদিন হবেন “আল আদিল” অর্থাৎ ন্যায় বিচারক, আল্লাহর বিচার এমন হবে যে, দুনিয়ায় কোন ছাগলের শিং না থাকে এবং সে যদি শিং ওয়ালা কোন ছাগল থেকে অধিকারবঞ্চিত হয়, আল্লাহ সেই দিন তাঁকে শিং দিয়ে তার অধিকার আদায় করতে বলবেন, এরপর প্রাণীগজগতের মধ্যে সকল বিবাদের মীমাংসা হয়ে গেলে আল্লাহ সুব তায়ালা তাদেরকে ধূলায় পরিনত হয়ে যেতে বলবেন, তুরাব হয়ে যেতে বলবেন। তিনি সবাইকে ধুলায় পরিণত করবেন। এবং এটাই সেই মুহুর্ত যা দেখে অবিশ্বাসীগণ বলবে “হায়, আমিও যদি ধূলা হয়ে যেতাম’ । আল্লাহ কুর’আনে বলছেন, ইয়া লাইতানি কুনতু তুরাবা। কুফফাররা আফসোস করে বলবে, হায় আমি যদি কখনো দুনিয়ায় না থাকতাম, যদি আমার কোন অস্তিত্বই না থাকত, যদি আমি কখনো জীবিতই না থাকতাম, হায় আমার যদি জীবনই না থাকতো, হায় যদি আমি মাটি হয়ে যেতাম”, কিন্তু এই কুফফাররাই যখন দুনিয়াতে ছিল, তারা ইচ্ছে মত চলত, টাকার লোভে যা খুশি তাই করত।
আল হাশর, যেখানে পুনরায় সবাইকে উত্থিত করা হবে, সেই জায়গাটা কেমন হবে? রাসুল (সাঃ) বলেছেন, ঠিক সেভাবেই হাশরের দিনে সবাইকে উঠানো হবে যেভাবে তোমরা জন্মেছিলে, খালি পায়ে, নগ্ন অবস্থায়, আল্লাহ তোমাদের প্রকৃত অবস্থায় নিয়ে আনবেন। এরপর রাসূল সা তিলাওয়াত করেন, যেখানে আল্লাহ বলছেন, সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব, যেমন গুটানো হয় লিখিত কাগজপত্র। যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব। আমার ওয়াদা নিশ্চিত, আমাকে তা পূর্ণ করতেই হবে।
আল্লাহ সবাইতে তার আদি অবস্থায়, যেভাবে জন্মের সময় দুনিয়াতে এসেছিলাম সেই অবস্থায় উঠাবেন, যখন আমরা জন্মেছি, খালি পায়ে, নগ্ন অবস্থায়, আমাদের সেই অবস্থায় আমাদের আবার উঠানো হবে। সবাই নগ্ন অবস্থায় থাকবে, এইটা শুনে হযরত আয়েশা (রাঃ) অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করলেন, যেখানে নারী পুরুষ একই স্থানে থাকবে এবং তারা নগ্ন থাকবে, তাই তিনি জিজ্ঞেস করেন, “মহিলা আর পুরুষরা কি একে অপরের দিকে তখন তাকাবে?” রাসুল (সাঃ) উত্তর দেন, “ইয়া আয়িশা, সেই দিনের বিষয়টা মানুষের একে অপরের দিকে তাকানোর থেকেও বেশি কিছু হবে, সে সময় মানুষের অন্য কোন কিছুর দিক মনোযোগ থাকবে না, এমনকি তারা এটা বুঝবেও না, যে তারা নগ্ন অবস্থায় আছে”। রাসুল (সাঃ) আর বলেন, “এটা অনেক আতঙ্কের একটা দিন আর এই দিন মানুষর একে অপরের দিকে তাকাবে না”
আল্লাহ কাকে প্রথম কাপড় পরাবেন? কারণ যেহেতু সব মানুষ ই নগ্ন থাকবে সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “কিয়ামাতের দিন আল্লাহ তা’য়ালা সর্বপ্রথম পোষাক পরাবেন ইব্রাহীম (আঃ)কে, তিনি হলেন আল্লাহর বন্ধু ” এবং রাসূলুল্লাহ(সাঃ) আরো বলেছেন, “তাঁকে ][ইব্রাহীম(আঃ) কে] জান্নাতের পোষাক পরানো হবে ”।এরপর রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন , “এরপরে আমাকে পোষাক পরানো হবে, সেটাও জান্নাতের এবং তা আর অন্য কারো মত হবে না ” [মুসলিম শরীফ]। রাসূলুল্লাহ(সাঃ) কে সবচেয়ে ভালো পোষাক দেয়া হবে কিন্তু প্রথম পোষাক পরানো হবে ইব্রাহীম(আঃ) কে , যা আল্লাহ সুবহানাতা’য়ালার এক অনন্য রহমত ইব্রাহীম(আঃ)এর প্রতি যাকে আল্লাহ একলাই একটি উম্মাহ বলে আখ্যায়িত করেছেন ।
‘আরদ আল মাহশার ’ বা হাশরের ময়দান ; আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন, “সেই দিন এ পৃথিবী ভিন্ন (আরেক) পৃথিবী দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে যাবে, (একইভাবে ) আকাশসমূহও (ভিন্ন আসমানসমূহ দ্বারা বদলে যাবে) এবং মানুষরা সব (হিসাবের জন্য) এক মহাক্ষমতাধর, অপ্রতিরোধ্য মালিকের সামনে হাজির হবে”। এই পৃথিবীর পরিবর্তন হবে, এটা এখনকার মতো থাকবে না । পৃথিবীর পরিবর্তনের মধ্যে কিছু যদি উল্লেখ করি তাহলে প্রথমত হবে : এটা সোজা ছড়ানো সমতল বিছানো হবে । এটা আর তখন গোলাকার থাকবেনা । এটা বর্ধিত/বিস্তৃত হবে।ওয়া ইযাল আরদু মুদ্দাত ; মুদ্দাত মানে সমতল এবং বিস্তৃত । এখন প্রাসংগিক একটি বিষয় বলি, গ্রাভিটি/অভিকর্ষ কি ? অভিকর্ষ হল একটি বস্তুর সাথে পৃথিবীর ভরকেন্দ্রের আকর্ষণ । আপনি গোলাকার অবস্থায় পৃথিবীকে অন্য একটি বস্তুকে আকর্ষণ করতে দেখবেন এর ভরের কারণে ; এটাই অভিকর্ষ যা ভরের সাথে একটি সমানুপাতিক সম্পর্ক বজায় রাখে । যখন আপনি এই গোলাকার অবস্থাকে সমতলে পরিবর্তন করে দিবেন অর্থাৎ যখন এই পৃথিবী কে সমতল করে দেয়া হবে এবং একটি সমতল শীটের আকারে বানানো হবে ,এর তখনো অভিকর্ষ ক্ষমতা থাকবে কিন্তু সে তা হারাতে থাকবে এবং একসময় যখন একে একদম সমতল বানানো হবে তখন সে তা হারিয়ে ফেলবে । তাই আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেছেন, “ যখন এ ভূ-মণ্ডলকে সম্প্রসারিত করা হবে, (মূহুর্তের মধ্যেই) সে তাঁর ভেতরে যা আছে তা ফেলে দিয়ে খালি হয়ে যাবে”। পৃথিবী এর গর্ভস্থিত সবকিছু ছেড়ে দিবে কারণ এর তখন কোনো ভর থাকবেনা ,এটিকে বিস্তৃত করে দেয়া হবে একটা বিশাল এলাকা জুড়ে শীটের আকারে।
অতএব পৃথিবীকে বিস্তৃত করে দেয়া হবে এবং রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেছেন,“ কিয়ামতের দিন মানুষকে জড় করা হবে সাদা এলাকায় যেটা হচ্ছে ‘আফরা’ ” ; ‘আফরা’ মানে হচ্ছে ফ্যাকাসে । তাই এটা উজ্জ্বল সাদা হবেনা বরং ফ্যাকাসে সাদা হবে । এবং ‘নাকিহ’ হচ্ছে খুব সুন্দর ও বিশুদ্ধ মাটি , তাই নিচের মাটি হবে খুবই বিশুদ্ধ ও সুন্দর ।
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) অন্য এক হাদীসে বলেছেন যে, এই পৃথিবী , গোলাকার আকৃতিকে চাপ প্রদান করে ছড়িয়ে বিস্তৃত করা হবে এবং সমতলে পরিণত করা হবে । তাহলে কল্পনা করুন পৃথিবীকে কত বড় করা হতে পারে ,কারণ একে সমতল করা হবে । এবং এরপর রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন, “ তারপরেও আদমসন্তানেরা, উম্মাতেরা একমাত্র তাদের দাঁড়িয়ে থাকার জায়গাটুকু ছাড়া আর কোনো জায়গা খুজে পাবেনা, যদিও পৃথিবীকে বিস্তৃত করে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে । কিন্তু আল্লাহ সুবহানাতা’আলা যখন তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে জড় করবেন ; মানুষ,জ্বীন,পশু,পোকা-মাকড়,এবং পাখি – এদের সবাই একসাথে জড় হবে , এটা এত বড় জমায়েত হবে যে আপনি শুধু আপনার পা রাখার জায়গাটুকুই খালি পাবেন, শুধু পা দিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা – ব্যস এটুকুই আপনি আর কোনো জায়গা পাবেন না ” । মানুষের বিশাল সমাগম হবে এবং তারা সেই কঠিন দিনে একে অপরকে শুধু চাপ দিবে ।
এবার আমরা কিয়ামতের দিনের কিছু বর্ণণার দিকে যাবো । কিয়ামতের দিন, যদিও এটা একটা দিন কিন্তু এটি একটি অত্যন্ত ভয়ংকর একটা দিন ,ভয়-ভীতি দ্বারা পরিপূর্ণ । কিয়ামত দিনের ও এর কিছু নিদর্শনের অল্প কিছুই আমি আপনাদের সামনে উল্লেখ করব, যা অনুধাবন করা আমাদের জন্যে একটু কষ্টকরই বটে।
১ নাম্বার : কিয়ামতের দিন একটি মহান দিন, ভারী দিন এবং কঠিন দিন :
আল্লাহ সুবহানাতা’আলা কিয়ামতের দিনকে আখ্যায়িত করেছেন একটি মহান দিবস, সব দিবসের বড় দিবস ও একটি ভারী দিবস এবং কঠিন দিবস বলে । এগুলো আল্লাহ সুবহানাতা’আলার বর্ণণা কিয়ামত দিবসকে ঘিরে । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন, “এরা কি ভাবে না তাদের (সবাইকে একদিন কবর থেকে) তুলে আনা হবে ? এক কঠিন দিনের জন্য, সেদিন সমগ্র মানব সমাজ সৃষ্টিকুলের মালিকের সামনে এসে দাঁড়াবে ”[৮৩:৪-৬] । এটি একটি মহান দিন, ‘ইয়াওমুন আযীম’ । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা একে বর্ণণা করেছেন ‘ সাকিল ’ – ভারী দিন হিসেবে । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন,“ এরা (অবিশ্বাসীরা) বৈষয়িক স্বার্থের এ পার্থিব জগৎ কেই বেশি ভালবাসে এবং পরে যে তাদের ওপর একটা কঠিন দিন আসছে তা উপেক্ষা করে” [৭৬:২৭] । – তাই এই দিনটি ভারী । এবং আল্লাহ সুবহানাতা’আলা একে বর্ণণা করেছেন ‘ ’আসিরা ’- কঠিন দিন বলে ।আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন, “সত্যই, সেদিন হবে অত্যন্ত কঠিন দিন ”[৭৪:৯] -অবিশ্বাসীদের জন্যে সহজতা/স্বস্তি থেকে অনেক দূরে ।
২ নাম্বার নিদর্শন কিয়ামত দিনের কঠিনতার : সেই দিনের ভয়–ভীতি :
আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন,“ হে মানুষ, তোমরা তোমাদের মালিককে ভয় করো, অবশ্যই কিয়ামতের কম্পন হবে একটি ভয়ংকর ঘটনা । সেদিন তোমরা তা নিজেরা দেখতে পাবে, বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে এমন প্রতিটি নারী (ভয়াবহ আতংকে) তার দুগ্ধপোষ্যকে ভুলে যাবে, প্রতিটি গর্ভবতী তার গর্ভস্থিত বস্তুর বোঝা ফেলে দিবে, মানুষকে যখন তুমি দেখবে তোমার মনে হবে তারা বুঝি কিছু নেশাগ্রস্ত মাতাল, কিন্তু তারা আসলে কেউই নেশাগ্রস্ত নয়; আর (এটা এক ধরনের আযাব) আল্লাহ তা’আলার আযাব কিন্তু অত্যন্ত ভয়াবহ” [২২:১-২] । কল্পনা করুন একজন মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো রেখে ছুটে পালায়, একজন মহিলা যে গর্ভবতী সে তাঁর গর্ভে যা আছে তা ফেলে দেয় এবং মানুষ আপনার চারদিকে মাতালের মত ছুটে বেড়ায় যদিও তারা মাতাল হওয়ার মত কিছুই খায়নি – এ সবকিছুই শুধু সেই দিনের ভয়াবহতার জন্য । কিয়ামতের দিন ভয়, আতংক থাকবে ,এত ভয় এবং আতংক থাকবে যে, যারা অত্যাচারী যালিম ছিল, তাদের দৃষ্টি শুধু উপরের দিকে থাকবে, তাদের চোখ নিচে নামবেনা, এমনকি চোখের পলকও পড়বে না । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন, “ (হে নবী,) তুমি কখনো মনে করো না, এ যালেমরা যা কিছু করে যাচ্ছে তা থেকে আল্লাহ তা’আলা গাফেল রয়েছেন;(আসলে) তিনি তাদের সেদিন আসা পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে রেখেছেন যেদিন (তাদের) চোখ স্থির হয়ে যাবে, তারা আকাশের দিকে চেয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় (দৌড়াতে) থাকবে, তাদের নিজেদের প্রতি নিজেদেরই কোনো দৃষ্টি থাকবে না, (ভয়ে) তাদের অন্তর বিকল হয়ে যাবে ”। তারা উপরের দিকে তাকিয়ে থাকবে,তাদের মাথা উর্ধ্বমুখী হয়ে থাকবে এবং তারা আকাশের দিকে তাকিয়েই থাকবে, তাদের চোখ নিচে নামবে না , এমনকি চোখের পলকও পড়বে না । এবং এরপর আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলছেন যে ‘ওয়া আফইদাতু হুম হাওয়া’ -তাদের হৃদয়ও শুন্য হয়ে যাবে আর এত হালকা মনে হবে যে তা ঊড়ে যেতে পারে! এবং তাদের হৃৎপিন্ড যেন ভয়ে গলায় এসে আটকে থাকবে।
৩ নাম্বার নিদর্শন কিয়ামত দিবসের কঠিনতার (আমরা আল্লাহ সুবহানাতা’আলার কাছে সেইদিন আমাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দেবার দোয়া করি ) :
দুনিয়াতে আমাদের যত সম্পর্ক আছে, যত শক্ত বন্ধন মানুষ হিসেবে আমাদের আছে আমাদের স্ত্রী,পিতা-মাতা,সন্তান, বন্ধুদের সাথে ; কিয়ামতের দিন এ সব হারিয়ে যাবে । পরিস্থিতি এতটাই কঠিন হবে যে এইসব সম্পর্ক উধাও হয়ে যাবে ।আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন, “ অতঃপর যেদিন শিংগায় ফুঁ দেয়া হবে, সেদিন তাদের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন অবশিষ্ট থাকবে না, না তারা একজন আরেকজন কে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে” । সেদিন কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবেনা এবং কোনো আত্মীয়তার বন্ধন কোনো সম্পর্ক থাকবেনা । দুনিয়ায় আমাদের যে সমস্ত সম্পর্ক ছিলো তা সেদিন উধাও হয়ে যাবে । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন, “ অতঃপর যখন বিকট একটি আওয়াজ আসবে, সেদিন মানুষ তার নিজ ভাইয়ের কাছ থেকে পালাতে থাকবে, (পালাতে থাকবে) তার নিজের বাবা-মা’র থেকে, স্ত্রীর থেকে, এমনকি তার ছেলেমেয়ের থেকেও, সেদিন তাদের প্রত্যেকের জন্যেই পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হবে যে তাই তার ব্যস্ততার জন্য যথেষ্ট হবে ”[৮০:৩৩-৩৭] । আপনি আপনার ভাই এর থেকে দূরে সরে যাবেন, আপনার মা-বাবা, এবং স্ত্রী-সন্তানদের থেকেও দূরে সরে যাবেন, কারণ আপনি তখন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন ।
৪ নাম্বার নিদর্শন কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতার – অবিশ্বাসীরা, নিজেদেরকে যে কোনো কিছুর বিনিময়ে শাস্তি থেকে বাঁচানোর ইচ্ছা :
তারা সেইদিন যে কোনো কিছু করতে করতে চাইবে , যে কাফের আল্লাহর জন্যে এক ডলার বা একটি শব্দ ব্যয় করতে ইচ্ছুক ছিলো না সেদিন সে সবকিছু দিয়ে দিতে চাইবে, সে এমনকি পৃথিবী ও এর মাঝে যা কিছু আছে তাও দিতে চাইবে ।আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন, “ যদি প্রতিটি যালেম ব্যক্তির কাছে সেদিন যমীনের সমুদয় সম্পদ এসে জমা হয়, তাহলে সে তার সব কিছু মুক্তিপণ হিসেবে ব্যয় করে আযাব থেকে বাঁচার চেষ্টা করবে; যখন এ যালেম মানুষরা জাহান্নামের আযাব দেখবে তখন তারা মনে মনে ভারী অনুতাপ করবে কিন্তু তখন তা কোনোই কাজে আসবে না, সম্পূর্ণ ইনসাফের সাথেই তাদের বিচার মীমাংসা সম্পন্ন হবে এবং তাদের ওপর বিন্দুমাত্র যুলুম ও করা হবে না” ।
কল্পনা করুন, আপনি সমস্ত পৃথিবীর(সম্পদের) অধিকারী এবং আপনি তা সব দিয়ে দিবেন নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্যে । তারা নিজেদের বাচাতে শুধু সমস্ত পৃথিবীই নয় বরং এর দ্বিগুণও দিয়ে দিতে চাইবে । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন,“ যারা তার মালিকের আহবানে সাড়া দেয় না কেয়ামতের দিন তাদের অবস্থা হবে, তাদের পৃথিবীতে যা কিছু সম্পদ আছে তা সমস্ত যদি তাদের নিজেদের অধিকারে থাকত ও তার সাথে যদি থাকত আরো সমপরিমাণ সম্পদ, তাহলেও আযাব থেকে বাঁচার জন্য তারা তা নির্দ্বিধায় মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করে দিত” । এমনকি তারা নিজেদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্যে পৃথিবীর দ্বিগুণ এবং এর চেয়েও বেশি কিছু দিয়ে দিতে চাইবে । আল্লাহ বলেন, “ এটা সুনিশ্চিত, যারা আল্লাহ তা’আলাকে অস্বীকার করেছে ও কুফরী অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছে, তারা যদি নিজেদের আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে এক পৃথিবীপূর্ণ স্বর্ণও মুক্তিপণ হিসেবে খরচ করে , তবু তাদের কারো কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হবে না” । তাদের যদি সমস্ত পৃথিবীভর্তি স্বর্ণ থাকে, আমি বলতে চাচ্ছি কল্পনা করুন, আমাদের যদি এরকম এক টুকরাও স্বর্ণ থাকত আমরা তা সাদকা হিসেবে দিতে চাইতাম না ।
কিয়ামতের দিন যখন তারা বাস্তবতা দেখবে, এটাই মূলত সমস্যা, আমরা বাস্তবতা সম্পর্কে চিন্তিত নই । আমরা স্বপ্নের মধ্যে বাস করছি । একজন সালাফ বলেছিলেন, “মানুষ এখন ঘুমাচ্ছে আর তারা জেগে উঠবে যখন তারা মৃত্যুবরণ করবে ” । আমরা ঘুমন্ত অবস্থায় আছি । আমরা ঘুমিয়ে আছি, যদিও আমাদের চোখ সম্পূর্ণ খোলা, আসলে আমরা অসচেতন । আমরা অনেক পরিমাণে পিছিয়ে আছি । কিয়ামতের দিন যখন অবিশ্বাসীরা বাস্তব পরিস্থিতি দেখবে তখন তারা নিজেদের মুক্তিপণ হিসেবে সমস্ত পৃথিবী দিয়ে দিতে চাইবে । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা এত কিছু চান নি, তাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বুখারী(র) এর বর্ণিত হাদীসে বলেছেন , ‘কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসীদের ধরে আনা হবে এবং জিজ্ঞেস করা হবে ‘যদি তোমার সমস্ত পৃথিবীর সমপরিমাণ স্বর্ণ থাকে তবে তুমি কি তার বিনিময়ে নিজেকে মুক্ত করতে চাইবে ?’ সে বলবে, ‘হ্যাঁ’ । তখন আল্লাহ সুবহানাতা’আলা তাকে বলবেন, ‘ আমি তোমার কাছে এর চেয়ে অনেক কমই চেয়েছিলাম, দুনিয়াতে আমি চেয়েছিলাম তুমি বলবে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই, আমি তোমাকে সালাত আদায় করতে,সাওম পালন করতে, য্বিকির আর দু’আ করতে, সাদকাহ দিতে, মুসলিম উম্মাহর দেখ-ভাল করতে বলেছিলাম-এটুকুই । আমি তোমাকে সমস্ত পৃথিবী সমান স্বর্ণ দিতে বলিনি । ’ ” কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে । আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি এবং আপনি যদি কুর’আন পড়েন তো আপনি দেখবেন অধিকাংশ জাহান্নামবাসীদের আর্তচিৎকার,হাহাকার আর কান্নার কারণ এই দেরি করে ফেলা- এই দীর্ঘসূত্রিতা, এখন না পরে, আজ নয় কাল এই মাননসিকতা।
অবিশ্বাসীরা বস্তুবাদী অর্জন ত্যাগ করতে চায় না । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেছেন, “ সেদিন অপরাধী ব্যক্তি আযাব থেকে নিজেকে বাঁচাতে মুক্তিপণ হিসেবে তার পুত্র সন্তানদের দিতে পারলেও তা দিতে চাইবে, নিজের স্ত্রী এবং নিজের ভাইকেও দিতে চাইবে, এবং নিজের পরিবারভুক্ত এমন আপনজনদেরও, যারা তাকে জীবনভর আশ্রয় দিয়েছিলো, সম্ভব হলে ভু-মণ্ডলের সবকিছুই সে দিতে চাইবে তারপরও জাহান্নাম থেকে সে বাঁচতে চাইবে”। আমরা এই আয়াতগুলো পড়ি অথচ এগুলো আমাদের ভাবায় না, আমরা চিন্তা করি না। চিন্তা করুন এটা নিয়ে, এভাবে ভাবুন যে এটা আপনার সন্তান । কল্পনা করুন যে আপনি আপনার নিজের সন্তানদের একত্র করেছেন এবং তাদের জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে ফেলেছেন । কল্পনা করুন যে আপনার একটা বাড়ি আছে যেটা এখন আগুনে পুড়ছে , উত্তপ্ত আগুনের কুণ্ডলী , এবং আপনি আপনার সব সন্তানদের নিয়ে ওই আগুনে ছুঁড়ে ফেলেছেন এবং আপনি আপনার চোখের সামনে তাদের পুড়তে দেখছেন, আপনি এটা করতে চাইবেন কিয়ামতের দিন । আমরা আমাদের সন্তানদের,ভাই দের, বাবা-মা দের এবং আরো যারা আমাদের পরিবারে আছে তাদের আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইবো, আমরা সমস্ত পৃথিবী সমান স্বর্ণ দিয়ে দিতে চাইবো নিজেদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্যে এবং এটা আমরা চাইবো শুধুমাত্র একবার জাহান্নামের আগুন দেখার কারণে । মাত্র এক মূহুর্ত জাহান্নামের আ গুন দেখার কারণেই আমাদের চিন্তা-ধারার পরিবর্তন হয়ে যাবে । আমরা যে কোনো কিছু এবং পারলে সবকিছু দিয়ে দিতে চাইবো এই জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য । রাসূলুল্লাহ(সাঃ) সেই বাস্তবতা দেখেছেন বলেই তিনি বলেছেন,“ যদি তোমরা জানতে যা আমি জানি, তবে তোমরা খুব কমই হাসতে বরং বেশি বেশি কাঁদতে ” [বুখারী] – আমরা তাহলে দুনিয়ার সময়টা হেসে কাটাতাম না ।
হাসান আল বসরী(র) একবার একজন মানুষের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন যে হা হা করে হাসছিলো এবং মজা করছিলো । হাসান আল বসরী(র) তাকে হাসতে দেখে বললেন,‘ ওহে আমার ভাতিজা, তোমাকে কি আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেছেন যে তিনি তোমাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন ? ’ বলল, ‘ না’ । তিনি বললেন, ‘ আল্লাহ কি তোমাকে বলেছেন যে তিনি তোমাকে জান্নাত দান করবেন ?’ বলল, ‘না’ । তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি হাসছ এবং মজা করছ কেন ?’ আমাদেরকে এই বিষয়টা গুরুত্বের সাথে নিতে হবে । যদি ব্যাপারটা এতটাই খারাপ হয় যে, আমরা আমাদের সন্তান,স্ত্রী,বাবা-মা দের আগুনে ছুঁড়ে ফেলার বিনিময়ে ও পৃথিবী সমান স্বর্ণ দিয়ে দেয়ার বিনিময়ে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে চাইব; তবে এই বিষয়টার জন্যে দুনিয়ায় থাকতে একটু হলেও ভয় পাওয়া দরকার বৈকি । এবং আমি একটু ভয় পাওয়ার কথা বলেছি কারণ আমরা নিজেদের বাঁচাতে যতো বেশি কিছুই দিতে চাই বা দেই না কেন এটা কখনো পর্যাপ্ত হবে না, এটা অপর্যাপ্তই রয়ে যাবে । তাই রাসূলুল্লাহ(সাঃ) সহীহ হাদীসে বলেছেন, “ যদি তোমাদের কাউকে যদি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে মুখের উপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকে, আর তাকে ধরে টানাহ্যাঁচড়া করা হয় তবে তাও সে কিয়ামতের দিন এটাকে এমন গুরুত্বহীন হিসেবে দেখবে যেন এটা কিছুই না ” । শুধু সিজদাহ বা য্বিকির নয়, আপনাকে যদি রাস্তায় মুখের উপর দিয়ে টেনে হেচড়ে নেয়াও হয়ে থাকে আপনার জন্ম থেকে কিয়ামতের দিন (বা আপনার মৃত্যু) পর্যন্ত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যে, মোটামুটি ৮০-৯০ বছর, তবুও কিয়ামতের দিন বাস্তব পরিস্থিতি দেখে আপনার এই কাজটাকে মূল্যহীন মনে হবে । তখন আপনি বুঝতে পারবেন হক কি ! হাক্ক শব্দটা মানে সত্য, বাস্তব, বাস্তব কি সেটা সেদিন মানুষ বুঝতে পারবে এর আগে নয়। মৃত্যু সত্য, জাহান্নামের আগুন সত্য, জান্নাত সত্য এবং মুহাম্মাদ(সাঃ) সত্য –এগুলোই সত্য, ওই পরিস্থিতিটাও সত্য ।
৫ নাম্বার – কিয়ামতের দিন ভয়াবহ হওয়ার অন্যতম কারণ এই দিনের দৈর্ঘ্য/ব্যপ্তি :
আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন,“ এমন একটি দিন, যার দৈর্ঘ্য হবে ৫০ হাজার বছর” । ৫০ হাজার বছর; এটাই সেই দিনের দৈর্ঘ্য , কিয়ামতের দিন । যদিও এটা একটা দিন, কিন্তু আমরা এটাকে অনেক গুরুত্ব দেই কেননা এটা ৫০ হাজার বছরের সমান । এবং এই কারণেই আমরা আল্লাহ সুবহানাতা’আলার কাছে দু’আ করি যে,“ ইয়া আল্লাহ, আমাদের দিনগুলোর মাঝে সেই দিনকে তুমি সবচেয়ে ভালো দিন কোরো যে দিন আমরা তোমার সাথে সাক্ষাৎ করব ” – কারণ সব দিনের মাঝে এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিন এবং এটা ৫০ হাজার বছরের সমান একটা দিন । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন , ‘যখন তারা এটা দেখে’ ; আমরা এখন কিয়ামতের দিন দেখতে পারছিনা । আমরা কিয়ামতের সময়ে বাস করছিনা , তাই আমরা এর প্রশংসা করি না বা এর ব্যাপারে কথা বলিনা বরং আমরা এর প্রকৃত গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি । কিন্তু যখন আমরা কিয়ামতের দিন দেখব, তখন কি হবে? আল্লাহ সুবহানাতা’আলা আমাদের কুর’আনে এই কিয়ামতের দিনের কথা বলেছেন, বর্ণনা করেছেন ।ভবিষ্যতের কিছু ঘটনার ব্যাপারে কুর’আনে বলা হয়েছে । দেখুন কুর’আনে যেমন অতীতের অনেক ঘটনার ব্যাপারে বর্ণনা রয়েছে তেমনি ভবিষ্যতের ঘটনারও বর্ণনা রয়েছে যেন এগুলোর ব্যাপারে ফয়সালা হয়ে গেছে এবং আমরা ইতিমধ্যেই তা জানি । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা কুর’আনে যেমন কিয়ামতের দিনের কিছু কথোপকথন (একে অন্যের সাথে কথাবার্তা) নাযিল করেছেন, তেমনি জান্নাতীদের কথোপকথন আর জাহান্নামীদের কথোপকথনও নাযিল করেছেন । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা আসলে ভবিষ্যতে কি ঘটবে সে ব্যাপারে আমাদের কিছু বলেছেন । তাই আল্লাহ আমাদের বলছেন মানুষ যখন কিয়ামতের দিন দেখবে তখন কি করবে ।
আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন, “ যেদিন তারা কিয়ামত দেখতে পাবে, সেদিন এদের মনে হবে তারা এক বিকাল বা এক সকাল পরিমাণ সময় দুনিয়ায় অতিবাহিত করে এসেছে”। – যখন তারা(মানুষরা) কিয়ামতের দিন দেখবে তখন তারা বুঝবে এই দুনিয়ার জীবন কত ছোট ছিল ,কারণ শুধুমাত্র কিয়ামতের দিনের সকালটাই এক হাজার বছরের চেয়ে বড় । আমরা কথা বলছিলাম ৫০হাজার বছরের দীর্ঘতা নিয়ে- ৫০ হাজার বছর, ৫০০ শতাব্দী, ৫০০০ যুগ, ৫০ হাজার বছর ঠিক এমনটাই লম্বা । তাই এই দুনিয়া যা আপনার কাছে এখন খুব দীর্ঘস্থায়ী মনে হয় এবং আপনার চাহিদা ও পরিকল্পনামাফিক সবকিছু করার ও পাওয়ার জন্যে যথেষ্ঠ সময় আছে বলে আপনার মনে হয়, এটাই আপনি যখন কিয়ামতের দিন দেখবেন তখন আপনি এসব চাওয়া-পাওয়া ছেড়ে দিবেন, আপনার কাছে এই দুনিয়াকে শুধুমাত্র একটি সকাল বা একটি বিকালের সমান মনে হবে; কফি ব্রেকের মত মনে হবে অথবা দুপুরে খাবারের বিরতির মত – এরকমই মনে হবে । এটাই এই দুনিয়ার বাস্তবতা ।
আমরা এই দুনিয়াকে যতটুকু গুরুত্ব দেয়া দরকার তার চাইতে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি, যদিও আমরা এটা পছন্দ করি বা না করি, স্বীকার করি বা না করি এটাই প্রকৃত বাস্তবতা । কারণ আমরা সবসময়ই দাবি করি যে আমরা আখিরাতকে ততটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি যতটুকু দেয়া উচিত, একইভাবে দুনিয়াকে ততটুকুই গুরুত্ব দিচ্ছি যতটুকু দেয়া উচিত – এটাই ইসলাম । এটা সত্য যে ইসলামে[কুর’আনে] বলা হয়েছে , ইয়া আল্লাহ আমাদেরকে এই দুনিয়াতে কল্যাণ দান কর আর আখিরাতেও কল্যাণ দান কর’ । কিন্তু এখানে অবশ্যই একটা অনুপাত বজায় রাখতে হবে, আমাদের অবশ্যই এই দুটিকে তারা যতটুকুর যোগ্য ঠিক সেই পরিমাণ গুরুত্ব দিতে হবে । আমরা কতদিন দুনিয়ায় থাকব? ধরুন, ১০০ বছর । অথচ কিয়ামত দিবস কত বড়? ৫০ হাজার বছর । এদের মাঝে একটা অনুপাত তৈরি করুন আর এরপর এদের জন্যে ততটুক সময় ব্যয় করুন যতটুকুর যোগ্য তারা । এবং এই কারণেই লোকমান হাকীম যখন তার ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিলেন তিনি বলেন, “এই দুনিয়ার জন্য সেই অনুযায়ী কাজ কর যত সময় তুমি এই দুনিয়ায় কাটাবে আর আখিরাতের জন্যে সেই অনুযায়ী কাজ কর যত সময় তুমি আখিরাতে কাটাবে ”। আমি আপনাদের বলছিনা যে দুনিয়ার জন্য কাজ করবেন না, বরং বলছি কাজ করুন সেই অনুযায়ী যতসময় আপনি দুনিয়ায় কাটাবেন । আমরা যদি ৬০,৮০,বা ১০০ বছরের জন্যে এখানে বেঁচে থাকি তবে ততটুকু সময় ব্যয় করুন যতটুকু প্রস্তুতি ৬০ বা ৮০ বছরের জন্য নেয়া প্রয়োজন । কিন্তু আমাদের যে কোটি কোটি বছর বা অসীম সময়ের জন্য আখিরাতে কাটাতে হবে তার জন্যে যেই পরিমাণ সময় ব্যয় করুন যতটুকু এর যোগ্য । অথচ আমরা তা করছিনা। আমরা তা করছি না । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন, “ যেদিন কিয়ামত কায়েম হবে সেদিন অপরাধী ব্যক্তিরা কসম খেয়ে বলবে, তারা তো কবরে মূহুর্তকালের বেশি অবস্থান করেনি” । এবং তারা আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে আমরা দুনিয়াতে শুধু এক ঘণ্টার মত অবস্থান করেছি । কারণ তারা ৩০০,৪০০ বা ৫০০ বছর ধরে শুধু এক জায়গাতে দাঁড়িয়েই থাকবে । তখন এই দুনিয়ার অবস্থানকে আর কতক্ষণই বা মনে হবে – কিছুই মনে হবে না ।
কিয়ামত দিবসের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা যা তখন ঘটবে :
আসমানকে গুটিয়ে নেয়ার ঘটনা :
আল্লাহ সুবহানাতা’আলা সে দিন পৃথিবীকে তাঁর হাতের মুঠোয় নিবেন আর এরপর তিনি আসমানকে গুটিয়ে ফেলবেন খড়কুটোর মতন । আপনারা খড়কুটো দেখেছেন, যখন একে গুটিয়ে নেয়া হয় ; সেরকমই সোজা হবে আল্লাহর হাতে সমগ্র মহাবিশ্বকে গুটিয়ে নেয়া । এখন মনে করুন, আমরা কথা বলছি আসমান নিয়ে , আমরা পৃথিবীর বাইরে যে বায়মণ্ডলের স্তর আছে তা নিয়ে বলছিনা, বরং এর চেয়েও বিশাল কিছু নিয়ে, সাত আসমান যা কিনা একটির উপর আরেকটি এভাবে বিস্তৃত তা নিয়েও নয় । আমরা বাস করছি সবচেয়ে নিচের আসমানে, এটা হল আস সামা আদ দুনিয়া , সবচেয়ে নিচের আসমান। সমস্ত তারা যেগুলো আমরা আকাশে দেখতে পাই, এ ব্যাপারে আলেম এবং মহাকাশ গবেষণার বিজ্ঞানীরা আমাদের বলেছেন সেগুলো শতকোটি আলোক বর্ষ দূরে । এই পৃথিবী আর তারা গুলোর মাঝের দূরত্ব কিলোমিটার বা মাইল এককে হিসাব করা যায় না, এতে হিসাব অনেক বড় হয়ে যায়, আপনাকে অনেক গুলো শূণ্য (০) ব্যবহার করতে হবে তখন । তাই এই দূরত্ব হিসাব করা হয় আলোর গতি দিয়ে, আলো এক সেকেণ্ডে ৩০০০০০( ৩ লক্ষ) কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে । এখন কল্পনা করুন যে তারা গুলো পৃথিবী থেকে আলোক বর্ষ দূরে আছে । তাহলে ঐ তারাগুলো থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে কয়েক বছর সময় নেয় । আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র অবশ্যই সূর্য , কিন্তু সূর্যের পর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র আমাদের থেকে প্রায় সোয়া ৪ আলোক বর্ষ দূরে । এছাড়া আরো কিছু নক্ষত্র আছে যেগুলো হাজার আলোক বর্ষ দূরে, কিছু নক্ষত্র শতকোটি আলোক বর্ষ দূরে – এর মানে ঐ সব নক্ষত্র থেকে আলোর পৃথিবীতে আসতে শতকোটি বছর লাগে যেই আলো প্রতি সেকেণ্ডে ৩লক্ষ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়; আর এসবই আস সামা আদ দুনিয়া অর্থাৎ সবচেয়ে নিচের আসমানের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলেন,“আমি তোমাদের নিকটবর্তী আসমানকে নয়নাভিরাম নক্ষত্ররাজি দ্বারা সুসজ্জিত করে রেখেছি” [আস-সাফফাত ৩৭:৬]। আল্লাহ সুবহানাতা’আলার কাছে এটা শুধুমাত্র ‘যিনাহ ’ অর্থাৎ সুসজ্জিতকরণ । এই বিশাল সৃষ্টিজগৎ যা আমাদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল, আল্লাহ তা শুধু সাজিয়েছেন এবং তিনি এটা কিয়ামতের দিন হাতের মুঠোয় নিবেন।
আলেমগণ বলেন এই সর্বনিম্ন আসমান আকারের দিক দিয়ে এর উপরের আসমানের তুলনায় মরুভূমিতে একটা আংটির মত । মরুভূমিতে একটি আংটি ছুড়ে মারুন – এটাই এই সর্বনিম্ন আসমানের সাথে তাঁর উপরের আসমানের আকারের তুলনা । আর আল্লাহ সুবহানাতা’আলা এই সবগুলোকে তাঁর হাতের মুঠোয় নিবেন । আমরা আল্লাহর সত্ত্বার প্রকৃতরূপ অনুধাবন করতে পারবো না । আপনি আপনার সাধ্যের সর্বোচ্চ সীমা পর্যন্ত ভাবুন তাও আল্লাহর সত্ত্বার প্রকৃতরূপ অনুধাবন করতে পারবেন না । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন,“ আসলে এ মূর্খ লোকগুলো আল্লাহ তা’আলার সেভাবে মূল্যায়নই করেনি যেভাবে তাঁর মূল্যায়ন করা উচিত ছিলো, কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবীই থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আসমানসমূহ একে একে ভাঁজ করা অবস্থায় তাঁর ডান হাতে থাকবে” [আয-যুমার ৩৯:৬৭] । আল্লাহ আসমানসমূহকে খড়কুটোর মত গুটিয়ে নিবেন । “একে (আসমানসমূহকে ) খড়কুটোর মত গুটিয়ে নেয়া হবে ” ।
এই পৃথিবীর কি হবে –আমরা আগে যেমনটি বলেছি, আল্লাহ সুবহানাতা’আলা একে বিস্তৃত সমতল করে দেবেন, বিছিয়ে দিবেন ।
পর্বতসমূহের কি হবে – আল্লাহ বলেছেন, “ অতঃপর যখন শিংগায় ফুঁ দেয়া হবে(তা হবে প্রথমবারের) একটি মাত্র ফুঁ, আর তখন ভূমণ্ডল ও পাহাড় পর্বত স্বস্থান থেকে উপড়ে নেয়া হবে, অতঃপর উভয়টাকে একবারেই একটা আরেকটার ওপর আছড়ে ফেলে চুর্নবিচূর্ণ করে লণ্ডভণ্ড করে দেয়া হবে, ঠিক সেদিনই সে মহাঘটনাটি সংঘটিত হবে” [আল-হাক্ক্বাহ ৬৯:১৩-১৫] । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা আরো বলেন, “ পাহাড়গুলো রঙ বেরঙ্গের ধুনা তুলার মত হবে” [আল-ক্বারিয়াহ ১০১:৫] । আল্লাহ আরো বলেন,“ যখন পাহাড়গুলোকে ধুলার মত উড়িয়ে দেয়া হবে” [আল-মুরসালাত ৭৭:১] ।
সমুদ্রগুলোর কি হবে – আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন, “ইযাল বিহারু- ফুজ্জিরাত ” এবং আরো বলেন, “ ইযাল বিহারু- সুজ্জিরাত”(আল-তাকবীর ৮১:৬) । “ইযাল বিহা রা ফুজ্জিরাত” মানে ‘যখন সাগরকে উত্তাল করে দেয়া হবে ’[আল-ইনফিতার ৮২:৩] । “ সুজ্জিরাত” মানে ‘ জ্বলন্ত ’- একে প্রজ্জ্বলিত করা হবে। তাহলে পৃথিবীর সমুদ্রগুলো বিদীর্ণ হবে ও একই সাথে জ্বলতে থাকবে। এটা পানির ক্ষেত্রে কিভাবে ঘটতে পারে? আমরা এখন এই ব্যাপারে অল্প কিছু বুঝতে পারি যে এটা কিভাবে ঘটবে তা অবশ্যই আল্লাহ জানেন । হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম বা ইউরেনিয়ামের পরমাণু ভাংগা যায় এবং অনেক খণ্ডে বিভক্ত করা যায়। আর এটার ফল হল নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া, চেইন রিএকশন যা কিনা পরবর্তীতে বিস্ফোরণ ঘটাবে আর আগুন ধরাবে ; সশব্দ বিস্ফোরণ আর আগুন । আর এটা অনেক শক্তিশালী, আপনি খুব অল্প পরিমাণ ইউরেনিয়াম বা অল্প পরিমাণ হাইড্রোজেন নিবেন এবং খুব শক্তিশালী বোমা পাবেন । এরকম খুব অল্প পরিমাণই যথেষ্ট একটা পুরো শহরকে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য । এখন কল্পনা করুন, এটা যদি সমুদ্রের প্রতিটি পরমাণুর ক্ষেত্রে ঘটে তো কি হবে । ঐ পরমাণুগুলো নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে আগুনের সৃষ্টি করবে এবং সবকিছু নিয়ে সশব্দে বিস্ফোরিত হবে । তাহলে ,কিয়ামতের দিন আপনার চতুর্দিকে সারা পৃথিবীতে বিশাল বিস্তৃত সমুদ্রে বিস্ফোরণ ঘটবে আর আগুন জ্বলবে ।
আসমানের কি হবে – ‘ইয়াওমা তামুরুস সামা ওয়া মাওরা’ – প্রথমে এটি নড়তে শুরু করবে আর কাঁপতে থাকবে । আপনি পৃথিবীতে একটি বাড়িতে আছেন এবং এটি কাঁপতে শুরু করল । কি হবে যখন এটি কাঁপতে থাকবে ? এটি কর্কশ বিকট শব্দে ভাংতে শুরু করবে এবং ছিদ্র তৈরি করে ভেংগে পড়তে থাকবে । আল্লাহ সুবহানাতা’আলা বলেন, “ইযাস সামাউ’ন ফাত্বারত”- “ যখন আসমান ফেটে পড়বে ”[আল-ইনফিত্বার ৮২:১] এবং “ ইযাস সামাউ’ন শাক্ক্বাত্”- “ যখন আসমান টুকরো টুকরো হয়ে ভেংগে পড়বে” যখন আসমান নড়তে শুরু করবে তখন একটি বড় বাড়ির মতন এটি কর্কশ শব্দে এখানে-সেখানে ভাংতে শুরু করবে। আল্লাহ বলেন,“ আসমান ছিদ্র হওয়া শুরু হবে ”, ‘ইযাস সামাউন শাক্কাত’ – এটা কর্কশ শব্দে ভাংতে থাকবে । এবং শেষে যা ঘটবে তা হল –“ এবং আকাশ ফেটে পড়বে, অতঃপর সেদিন তা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে” [আল-হাক্ক্বাহ ৬৯:১৬] । ‘ওয়াহিয়া’ মানে ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল । আর এটা ভেংগে পড়তে শুরু করবে ।
সূর্য, চাঁদ আর তারাগুলোর কি হবে – সূর্যকেও গুটিয়ে নেয়া হবে , এটা তাঁর আলো হারিয়ে ফেলবে । আর চন্দ্রগ্রহণ ঘটবে ও চাঁদ তাঁর কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ে যাবে । আর তারা বা নক্ষত্র গুলোও তাদের কক্ষপথ থেকে সরে যাবে এবং সবকিছু তার স্থানচ্যুত হয়ে পাশে পড়ে যাবে ।