পরকালের পথে যাত্রা – পর্ব ১৩ – গুনাহগার মুসলিমদের অবস্থা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

ইনশা আল্লাহ আজ আমরা আলোচনা করবো মুসলিম গুনাহগারদের সম্পর্কে। যে সকল মুসলিমরা কিছু সুনির্দিষ্ট গুনাহ করে থাকে তাদের ব্যাপারে আলোচনা করবো। আল্লাহ সুবহানওয়াতালা কেয়ামত দিবসে কিছু গুনাহর সুনির্দিষ্ট শাস্তি সম্পর্কে কুরআনে উল্লেখ করেছেন। আমরা এখনো জান্নাত বা জাহান্নাম নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করিনি; আমরা সবেমাত্র কিয়ামাত দিবসে লোকজনের অবস্থা নিয়েআলোচনা শুরু করতে যাচ্ছি। 

আমরা নয়টি পয়েন্টে কিয়ামত দিবসে লোকজনের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করবো।

 

(১) প্রথমেই আমরা আসি, যেই সকল লোকদের সম্পদ আছে, কিন্তু যাকাত দেয় না, তাদের প্রসঙ্গে; তাদের শাস্তির বিভিন্নতার কথা আমরা বিভিন্ন হাদিসে দেখতে পাই। সহিহ বুখারির একটি হাদিসে উল্লেখ রয়েছে; আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,” যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দিলেন কিন্তু সে যাকাত আদায় করলো না তার সম্পদকে বিষধর সাপে  পরিণত করা হবে। যার  শিংয়ের মত দুটো বিষাক্ত দাঁত থাকবে। কেয়ামতের দিন এ সাপ তার গলায় পেঁচিয়ে দেয়া হবে। এ দিয়ে সে তাকে দংশন করতে থাকবে আল বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার সঞ্চয়। এ কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতটি শেষ পর্যন্ত পাঠ করলেন :

“আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে; বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর হবে। অচিরেই কিয়ামত দিবসে, যা  নিয়ে কার্পণ্য করছে তা দিয়ে তাদের গলায় বেড়ি বানিয়ে পরানো হবে। আর আল্লাহ হচ্ছেন আসমান ও জমিনের পরম সত্ত্বাধিকারী। আর যা কিছু তোমরা করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে জানেন। [আল কুরআন ৩: ১৮০ ]

 

এখানে গেল এক রকম শাস্তির কথা। সহিহ মুসলিমের অন্য এক রেওয়াতে, আবু হুরাইরা(রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা) বলেছেন,“ সোনা রুপার অধিকারী যে সব লোক যাকাত আদায় করে না, কিয়ামত দিবসে তার ঐ সোনা রুপা দিয়ে তার জন্য আগুনের অনেকগুলো পাত তৈরি করা হবে; অতঃপর সেগুলো জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে এবং সেই গরম পাতগুলো দিয়ে তার ললাট, পার্শ্বদেশ ও পিঠে দাগ দিয়ে দেয়া হবে, যখনই পাতগুলো ঠাণ্ডা হয়ে আসবে পুনরায় তা উত্তপ্ত করা হবে। আর তার সাথে এরূপ করা হবে এমনভাবে– একদিনে যার পরিমান হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান — আর তার এরূপ শাস্তি সমস্ত লোকদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। অতঃপর তাদের কেউ যাবে জান্নাতের দিকে আর কেউ যাবে জাহান্নামের দিকে।

 

রাসুল(সা) আরো বললেন, যেসব উট গরু ছাগলের মালিক তাদের পশুর উপর যাকাত প্রদান করবে না, কিয়ামতের দিন তাকে এক সমতল ভুমিতে উপুড় করে ফেলে রাখা হবে। আর তার সেই গরু ছাগল তাকে শিং দিয়ে আঘাত করতে থাকবে এবং খুর দিয়ে মাড়াতে থাকবে। সারাদিন তাকে এভাবে আঘাত করা হবে। রাসুল(সা) বলেন,’’ 
فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ
এই দিনের পরিমান হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।‘’

 

অল্প কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য পঞ্চাশ হাজার বছর শাস্তি ভোগ করা কোন বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। এটি সত্যিই দুঃখজনক।

প্রথমত দেখুন, যেই সম্পদের আপনি যাকাত আদায় করলেন না- সেই সম্পদে কোন বারাকাহ বা বরকত নেই। তারচেয়েও দুঃখজনক হচ্ছে এর জন্য আখিরাতে আপনাকে শাস্তি পেতে হবে।

দ্বিতীয়ত, একটু ভাবুন, যাকাত আদায় না করে যেই টাকাটি আপনি রেখে দিলেন নিজের কাছে – আপনি কত দিনের জন্য এই টাকাটি রাখতে পারবেন ? – অল্প কয়েকদিন; বড়োজোর চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর ! আর যদি আপনি খরচ নাও করেন , অন্য কেউ এই অর্থ খরচ করবে? কিন্তু বিনিময়ে এর জন্য পরকালে আপনি শাস্তি পাবেন কতদিন? – পঞ্চাশ হাজার বছর !

 

আগে হোক পরে হোক আমাকে আপনাকে কিন্তু পৃথিবী থেকে বিদায় নিতেই হবে, তাই আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করার জন্য আমাদের আর নমনীয় হওয়া প্রয়োজন। আল্লাহতায়ালাই কিন্তু আমাদের এই সম্পদ দিয়েছেন।ভেবে দেখুন, আমাদের যখন সৃষ্টি করা হয়েছিল তখন আমাদের কোন সম্পদই ছিল না- কিছুই না- কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট?-বাড়ি গাড়ি?- কিছুই ছিল না।আর আজ যা আছে সব আল্লাহই আপনাকে দিয়েছেন, আল্লাহই আপনাকে এসকল সম্পদ দান করেছেন। আল্লাহর ইচ্ছা হলে তিনি এই সম্পদ আপনার থেকে নিয়েও যেতে পারেনবা হয়তো আরো বেশি সম্পদ আপনাকে দান করতে পারেন।

আল্লাহ আমাকে আপনাকে সৃষ্টি করেছেন- এবং একটি নির্দিষট রিজিক দিয়ে পাঠিয়েছেন। আপনি আপনার রিজিকের বেশিও পাবেন না, কমও পাবেন না।আপনার রিজিক আপনার জন্য লেখা হয়ে গেছে, আপনি এর চেয়ে বেশিও খরচ করতে পারবেন না,কমও পারবেন না।

(২) দুই নম্বর গুনাহ কিয়ামত দিবসে যে সকল গুনাহরজন্য সুনির্দিষট শাস্তির বিধান আছে তার মধ্যে এটি হচ্ছে খুব ভয়াবহ এবং খুবই বড় গুনাহ। এই গুনাহর জন্য ‘’ইবলিশ’’ আল্লাহর ভয়ানক রোষে পড়েছে এবং সৃষ্টির নিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়েছে। আর এই গুনাহটি হচ্ছে ‘’আল কিবর’’ বা অহংকার। এই গুনাহর জন্যই ইবলিশ অতি উচ্চ পর্যায় হতে একেবারে নিম্ন পর্যায়ে পর্যবসিত হয়।

ইবলিশ আল্লাহকে বলেছিল যে ‘ আনা খাইরুন মিন, আমি আদম হতে শ্রেষ্ঠ, আমি আগুনের সৃষ্ট আর আদম মাটির সৃষ্ট’। 
আর এই অহঙ্কারের জন্য আল্লাহর সৃষ্ট সবচেয়ে অভিশপ্ত জীবে পরিণত হয় ইবলিশ।

এই গুনাহটি এতই বিপদজনক যে রাসুল(সা)  বলেছেন, ‘’ কারো অন্তরে যদি তিল পরিমান অহংকারও থাকে তাহলে সে জান্নাতের সুবাস পাবে না ‘’ , অর্থাৎ কারো অন্তরে যদি বিন্দু পরিমান অহংকারও থাকে সে জান্নাতে যাওয়া তো দূরের কথা, জান্নাতের সুবাস পর্যন্ত পাবে না।

রাসুল(সা) বলেছেন যে, কিয়ামতের দিন অহংকারী ব্যক্তি দেখতে মানুষের মত হলেও আকার থাকবে আদ দার বা ছোট্ট পিঁপড়ের মত ; সব দিক থেকেই তাদের অপদস্ত ও অবমাননা করা হবে। আদ দার হচ্ছে খুব ছোট প্রজাতির এক প্রকার পিঁপড়ে , আপনারা জানেন, বড় ছোট বিভিন্ন আকৃতির পিঁপড়া আছে, সাধারণ পিঁপড়াদের বলা হয় নামল, আর এই অতি ক্ষুদ্র আকৃতির পিঁপড়াকে বলা হচ্ছে আদ দার। এই পিঁপড়ের আকার নিয়ে কিয়ামতের দিন অহংকারী ব্যক্তিআল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে। এবং মানুষের পায়ের তলায় এরা পিষ্ট হয়ে যাবে। কিয়ামতের দিন মানুষ অস্থির হয়ে দিক্বিদিক শুন্য হয়ে দৌড়াবে, কোন কিছুই তার খেয়াল থাকবে না। আর এই অহংকারী ব্যক্তিরা মানুষের পায়ের নিচে পদদলিত হবে। অহংকার একটি খুব বড় গুনাহ। 

একটু ভেবে দেখুন, অহংকার হচ্ছে এক প্রকার মিথ্যাচার। যে ব্যক্তি অহংকার করে সে আসলে মিথ্যাচার করছে। কারন অহংকার মানে হল আমি যা নই, তা দাবী করা, মিথ্যা ব্যক্তিত্ব, অহংকার মানে সত্যকে অস্বীকার করা, নিজেকে বড় মনে করা, অথচ আমি তা নই, এবং আমরা দেখি যে,  সৃষ্ট জীব হিসেবে মানুষ স্বভাবজাত ভাবেই বিনয়ী। আমরা আল্লাহতালার সৃষ্ট এবং আল্লাহ সুবহানওয়াতালাই একমাত্র যিনি সৃষ্ট জীব হিসেবে আমাদেরকে মর্যাদা দান করেছেন। নতুবা আমরা কিছুই না, একেবারেই মূল্যহীন, অকেজো।

 

আল্লাহ বলেন, “মানুষের উপর এমন কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না” [আল কুরআন ৭৬ঃ ১ ]

এমনও সময় ছিল মানুষ কিছুই ছিল না, এমনও সময় ছিল আমাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। 
আল্লাহতালাই আমাদের মর্যাদা দিয়েছেন,সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সম্মানিত করেছেন, কাজেই আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছ থেকে আমাদের সম্মান মর্যাদা কামনা করা উচিত নয়। সুতরাং আমাদের বিনয়ী হওয়া উচিত এবং বিনয়ী হয়েই পৃথিবীতে বসবাস করা উচিত। যখনই আমরা অহংকার করি আমরা এমন কিছু দাবি করি, সত্যিকার অর্থে আমরা যা নই, তাই অহংকার হচ্ছে এক প্রকার মিথ্যাচার।

 আর এই মিথ্যাচার প্রকাশ করা হবে কিয়ামতের দিন আর অহংকারকারীদের সেই আকৃতিই প্রদান করা হবে যা তাদের জন্য প্রাপ্য ছিল। তারা সত্যিকার অর্থে সম্মানে যোগ্য নয় তাই আল্লাহ তাদের কে পর্যুদস্ত ও অপমানিত করবেন। তারা ছোট পিঁপড়ের আকারেই কিয়ামত দিবসে থাকবে। 

তাই রাসুল (সা) বলেছেন যে,  কিয়ামত দিবসে সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে ছোট ও অপমানিত হবে; যে দুনিয়াতে নিজেকে ‘’শাহেনশাহ’’ বলে দাবি করত’। 

শাহেনশাহ মানে হচ্ছে রাজাদের রাজা। রাসুল(সা) বলেন, সেই সবচেয়ে ক্ষুদ্র ও অপমানিত হবে।- আল্লাহই ভাল জানেন , এটা কাকে নিয়ে বলা হয়েছে; কিন্তু এক সময় ছিল যখন পারস্যের সম্রাট নিজেকে শাহেনশাহ বা রাজাদের রাজা বলে দাবি করত। কিয়ামতের দিন এই রাজাই হয়তবা ছোট পিঁপড়ের আকারে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে, আর সবাই তাকে পায়ের নিচে মাড়িয়ে চলে যাবে, কেউ তাকে খেয়ালই করবে না। তার এই অপমানের কারন হচ্ছে সে দুনিয়াতে অহংকার ভরে এমন কথা বলত যা আল্লাহর সৃষ্ট কোন জীবের পক্ষে শোভনীয় নয়।

 

(৩) তিন নাম্বারে , আমরা এমন কিছু গুনাহ নিয়ে আলোচনা করবো , যার কারনে কিয়ামতের দিন আল্লাহ এই গুনাহগারদের দিকে তাকাবেন না, কথা বলবেন না, গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন না।

আল্লাহ বলেন, ‘’ নিশ্চয় যারা সেসব বিষয় গোপন করে, যা আল্লাহ কিতাবে নাযিল করেছেন এবং সে জন্য অল্প মূল্য গ্রহন করে, তারা আগুন ছাড়া নিজের পেটে কিছুই ঢুকায় না। আর আল্লাহ কিয়ামতের দিন না তাদের সাথে কথা বলবেন, না তাদের কে পবিত্র করা হবে , বস্তুত তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব। এরাই হল সেই সমস্ত লোক , যারা হেদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহি ক্রয় করেছে এবং ক্ষমা ও অনুগ্রহের বিনিময়ে ক্রয় করেছে আযাব। অতঃপর জাহান্নাম, তারা কিরুপে সহ্য করবে? [আল কুরআন ২: ১৭৪-১৭৫]

এখানে যাদের ব্যপারে বলা হয়েছে তারা হচ্ছে সেই ব্যক্তি যারা আলেম ছিল; তাদের আল্লাহ্‌ দ্বীনের জ্ঞান, সত্যের জ্ঞান দিয়েছিল কিন্তু তারা সে সত্য গোপন করেছে। তাদের শাস্তি হচ্ছে আল্লাহ্‌ তাদের সাথে কথা বলবেন না।

 

আরেকটি হাদিসে এসেছে, রাসুল(সা) বলেছেন যে, যাদের সত্যের জ্ঞান দেয়া হয়েছে কিন্তু তারা তা গোপন করেছিল , কিয়ামতের দিন আল্লাহতালা তাদের মুখ আগুন দিয়ে ঝলসে দিবেন।

আল্লাহ্‌ মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন, সত্যমিথ্যার প্রভেদ শিখিয়েছেন,যাতে তা প্রচার করা হয়; অন্যদেরকেও তা জানানো হয়। যদি কেউ তা প্রকাশ না করে প্রচার না করে গোপন রাখলো, তাহলে এই ইলম বা জ্ঞানের প্রয়োজন কি ? এই জ্ঞান কি কাজে লাগল ?

 

ফিকহের একটি মুখ্য বিষয়, একটি মূলনীতি- হচ্ছে জ্ঞান প্রচারে বিলম্ব না করা। 
অর্থাৎ, সময়মত জ্ঞান প্রচার না করা বা দ্বীনের দাওয়াত না দেয়া শারিয়াহ সম্মত নয়। উদাহরন স্বরূপ ঃ আপনি যদি কোন গুনাহ সংঘটিত হতে দেখলেন, তখন আপনার উচিত মানুষকে এই ব্যাপারে সচেতন করা এবং ভুলটি ধরিয়ে দেয়া। আপনি যদি তা না করেন তবে তার পেছনে একটি যুক্তিসঙ্গত কারন থাকতে হবে। ধরুন, কোন ভুল ধরিয়ে দেয়ার কারনে তারা আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলো, কিংবা মারামারি বেঁধে গেল- যা আরো বড় গুনাহর কারন হবে, আরো অনাচার সৃষ্টি করে, এগুলো বৈধ অজুহাত হতে পারে, তবে সাধারণত দ্বীনের জ্ঞান প্রচারে বিলম্ব করার কোন সুযোগ নেই।

 

আরেকটি আয়াতে আল্লাহতালা বলেছেন,’’ যারা আল্লাহর নামে কৃত অঙ্গীকার এবং প্রতিজ্ঞা সামান্য মূল্যে বিক্রয় করে আখিরাতে তাদের কোন অংশ নেই, আর তাদের সাথে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্‌ কথা বলবেন না, তাদের প্রতি দৃষ্টিও দিবেন না। আর তাদের কে পরিশুদ্ধও করবেন না। বস্ততঃ তাদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।‘’ [আল কুরআন ৩ঃ৭৭]

এইখানে আল্লাহতালা তাদের ব্যাপারেই বলেছেন, যারা দুনিয়ার স্বার্থে নিজের স্বার্থে কিছু পাওয়ার জন্য নিজের দ্বীনকে, ধর্মকে বিক্রি করে দেয়। অর্থাৎ যারা দুনিয়ার স্বার্থে, নিজের স্বার্থে আপস করে তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সুলতানদের আলেম বা দরবারী আলেমদের কথা। সুলতান বলতে এখানে বুঝাচ্ছি দেশ এর নেতার কথা, সে রাজা বাদশাহও হতে পারে আবার প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীও হতে পারে। এই সকল আলেম হচ্ছে সেই সকল আলেম যারা প্রেসিডেন্ট বাদশাহকে খুশি করার জন্য ফতোয়া দিয়ে থাকেন। তারা শাসকশ্রেণীর মিথ্যাচার এবং খারাপ কাজ গুলোর বৈধতা দিয়ে দেন, আর এই বৈধতা দেয়ার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেন, এরা আল্লাহর দীনকে বিকৃত করে । আর এই সকল আলেমদের শাস্তি হচ্ছে, আল্লাহ্‌ কিয়ামত দিবসে তাদের দিকে তাকাবেন না , তাদের কে পবিত্রও করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে খুবই কঠিন শাস্তি।

 

আরও কিছুলোক রয়েছে, যারা আল্লাহর নামে কসম খায় এবং মিথ্যা বলে।
যেমনঃ অনেকেই বলে ‘’আল্লাহর নামে কসম খেয়ে বলছি, আমি এই কাজ করেছি/ এই কাজ করি নি।’’ যদি সে আল্লাহর নামে কসম খেয়ে মিথ্যা বলে, তাহলে তার জন্য কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। আল্লাহ্‌ তারদিকে তাকাবেন না, পবিত্রও করবেন না ; তার জন্য রয়েছে খুবই মর্মন্তুদ শাস্তি।

 

ইবনে কাসির এই আয়াতের তাফসিরে বেশ কিছু হাদিস উল্লেখ করেছেনঃ

আবু যার (রা) হতে বর্ণিত রাসুল(সা) বলেছেন’’ তিন প্রকারের লোক রয়েছে যাদের সাথে আল্লাহ্‌ তালা না কথা বলবেন,না তাদের দিকে করুনার দৃষ্টিতে তাকাবেন, আর না তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিবেন।‘’ একথা শুনে আবু যার(রা) বল্লেন,’’হে আল্লাহর রাসুল(সা) এই লোকগুলো কে ? এরা তো বড় ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। রাসুল(সা) তিনবার এই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন।তারপর রাসুল(সা) বলেন ‘’১। যে ব্যক্তি টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে দেয়। ২। মিথ্যে শপথ করে যে ব্যাক্তি নিজের পণ্য বিক্রয় করে এবং ৩। আল মান্নান- অনুগ্রহ করার পর যে তা প্রকাশ করে । হাদিসটি মুসলিম শরীফে রয়েছে। 

তাছাড়া আরেকটি হাদিসে শুধু অহংকার বশত টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে রাখার প্রসঙ্গে হাদিসটি এসেছে।

 

দুই নম্বরে রাসুল(সা) তাদের কথা বলেছেন, যারা নিজের পণ্য বিক্রয় করার সময় আল্লাহ্‌র কসম খেয়ে মিথ্যে বলে ,যেমন ‘’ আল্লাহ্‌র কসম ! এই জিনিসটি কিনতে আমার ১০০ টাকা খরচ হয়েছে।‘’ কিন্তু সে আসলে ৫০ টাকা দিয়েই জিনিসটি কিনেছে। এরূপ মিথ্যেবাদীদের সাথে আল্লাহ্‌ কিয়ামত দিবসে কথা বলবেন না, পবিত্রও করবেন না বরং তার জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে।

তিন নাম্বারে, রাসুল(সা) বলেছেন, “আল মান্নানের কথা। আল মান্নান হচ্ছে সেই সকল ব্যক্তি যে কাউকে উপকার করলে তা বারবার তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।যেমন,  “কেউ বলল মনে আছে এক বছর আগে আমি তোমার জন্য এটা করেছিলাম, ওটা করেছিলাম।‘’ অর্থাৎ এটা দ্বারা বোঝায় সে সাহায্যটি আল্লাহ্‌র জন্য না করে, আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য না করে নিজের স্বার্থের জন্য করেছে। উলটো তার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশায় তা করেছে।

সহিহ বুখারি ও মুসলিমে উল্লেখ রয়েছে, রাসুল (সা) বলেন, “যে ব্যক্তি কারো সম্পদ ছিনিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যে মিথ্যে শপথ করে , সে যখন আল্লাহ্‌ পাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে তখন আল্লাহ তালা তার প্রতি অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হবেন।‘’

 

মুসনাদে আহমাদের মধ্যে রয়েছে যে, রাসুল(সা) বলেছেন, ‘’ তিন ব্যক্তির সঙ্গে আল্লাহ্‌ কিয়ামতের দিন কথা বলবেন না, তাদের দিকে দেখবেন না এবং তাদের পবিত্রও করবেন না ; আর তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। প্রথম ঐ ব্যক্তি যার নিকট প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি রয়েছে, কিন্তু কোন মুসাফিরকে সে প্রদান করে না।‘’ দ্বিতীয় ঐ ব্যক্তি যে আসরের পর মিথ্যে কসম খেয়ে নিজের মাল বিক্রি করে।‘’ আর তৃতীয় যারা ইমামের কাছে বায়াহ দিবে, যদি সে ইমাম বা নেতা তাদেরকে অর্থ প্রদান করে তাহলে তারা খুশি থাকে আর যদি অর্থ প্রদান না করে তাহলে তারা প্রত্যাহার করে।

আপনার কাছে প্রচুর পানি রয়েছে, কিন্তু মুসাফিরের কাছে কোন পানিই নেই। আপনি তাকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি থাকা সত্তেও দিলেন না। আরেকটি হাদিসে এসেছে, আল্লাহ্‌ মুসাফিরকে পানি দিতে অস্বীকার করা ব্যক্তিকে বলবে, ‘’ তুমি কি করে সে জিনিস দিতে চাও না, যার মালিক তুমি নও ?’’

পানি সবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থাৎ সৃষ্টির সকল জীবের জন্য পানি প্রয়োজন। অতিরিক্ত পানি থাকা সত্তেও যার পানি নেই আপনি তাকে পানি দিবেন না; অথচ এই পানির প্রকৃত মালিক আপনি নন। যার পানির প্রয়োজন তাকে অবশ্যই পানি দিতে হবে।

তারপর রাসুল (সা) বলেছেন, ‘’ দ্বিতীয় ঐ ব্যক্তি যে আসরের পর মিথ্যে কসম খেয়ে নিজের মাল বিক্রি করে।‘’

এখানে আসরের পর মিথ্যা কসম খেয়ে নিজের মাল বিক্রি করা দিয়ে কি বুঝান হয়েছে? সাধারণত মানুষ দ্বীনের বেলা ই মাল বিক্রয় করে থাকে; কিন্তু আসরের পর যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে তখন বিক্রেতার মনে শঙ্কার সৃষ্টি হয় যে তার মাল অবিক্রিতই থেকে যাবে এবং তাকে এটা বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। তাই বিক্রেতা প্রায়ই এই বোঝা বাড়িতে নিয়ে যেতে চায় না, তখন তারা শেষ সময়ে আল্লাহ্‌র কসম খেয়ে নিজের মালামাল বিক্রয় করার চেষ্টা করে এবং মিথ্যা বলে। আগে মানুষ সাধারণত সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনের আলোয় কাজ করত, কেনা বেচা করত। তাদের কাজের সময় সীমা ছিল ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত। দেখুন, কত দীর্ঘ সময় ধরে তারা কাজ করত আর আমাদের কাজ করার সময় তাদের তুলনায় কতই না কম। 

আমরা এখন আমাদের ইসলামি দায়িত্ব, ইবাদাতে গাফিলতির অজুহাত হিসেবে আমাদের কাজ কে কর্মব্যস্ততাকে দোষারোপ করে থাকি, আমরা ৮টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত অফিস, ৯ টা থেকে ৪ টা পর্যন্ত অফিস তাই আমার পক্ষে এটা করা সম্ভব না। কিন্তু আমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করার পরেও তারা তাদের ইসলামিক দায়িত্ব, ইবাদাত সব সুন্দর ভাবে পালন করেছেন। তারা এত ব্যস্ততার মাঝেও জিহাদ করেছেন, কিয়ামুল লাইল করেছেন, কুরআন পড়েছেন , কুরআন হিফয করেছেন এবং শিখেছেন। তাঁদের কাজে বারাকাহ ছিল কারন তাঁদের দ্বীনের প্রতি সত্যিকারের সংকল্প ছিল, তাঁদের তাকওয়া ছিলতাই আল্লাহ্তাঁদের কাজে বারাকাহ দিয়েছিলেন

যারা সৎপথপ্রাপ্ত হয়েছে, তাদের সৎপথপ্রাপ্তি আরও বেড়ে যায় এবং আল্লাহ তাদেরকে তাকওয়া দান করেন। [ মুহাম্মাদ ১৭]

এখন কথা হচ্ছে আমাদের মনে যদি সেই ইখলাস থাকে, সত্যিকারের ইচ্ছা থাকে তাহলে আল্লাহ্‌ তালা অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন।

আর যারা ইমামের কাছ থেকে বায়াহ নিবে……কোন ইমাম? ইমাম হচ্ছে যিনি খালিফা বা নেতা। কিছু আরব ছিল যারা বায়াহ নিত অর্থের বিনিময়ে অর্থাৎ যারা তাদের যত্ন আত্তি করত তারা সেই দিকেই ঝুকে পরতো। যারাই তাদের আর্থিক সহায়তা করত, তারা তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করত। এই খানে তাদের কাছে প্রধান বিষয় ছিল? টাকা। 

সেই আরবদের যদি রাসুল(সা) এর থেকেও ইহুদি বা অন্য কেউ বেশি টাকা, সাহায্য সহযোগিতা দিলে তারা ইসলাম ত্যাগ করে ফেলত।  আর্থিক সুযোগ সুবিধা এর উপর নির্ভর করেই তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ , দ্বীন পরিবর্তিত হত। এই জাতীয় লোকদের সাথে আল্লাহ্‌ সুবহানওয়াতালা কিয়ামতের দিন না কথা বলবেন, না পবিত্র করবেন।

এই বিষয় বস্তুর উপর প্রায় একই রকম একটি হাদিস রয়েছে বুখারি শারিফে,

আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা) বলেন,’’ তিন প্রকারের লোকের দিকে আল্লাহ্‌ কিয়ামতের দিন তাকাবেন না , তাদের পবিত্রও করবেন না বরং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।তারা হচ্ছে: শাইখ উন যানি- বুড়ো ব্যভিচারী , মালিকুন কাযযাব- একজন রাজা যে মিথ্যেবাদী , আ’ইলুন মুসতাকবির- দরিদ্র ব্যক্তি কিন্তু সে অহংকারী । ‘’

এইখানে তিন প্রকারের ব্যক্তির মধ্যে একটি মিল রয়েছে আর তা হচ্ছে তাদের এই প্রকারের গুনাহ করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই, কোন তাড়া নেই।

‘’বুড়ো ব্যভিচারী’’ –  সাধারনত বুড়ো বয়সে মানুষ তার যৌবন হারিয়ে বসে, তার যৌবনের চাহিদা, কামনা বাসনা প্রায় কমে আসে। তারপরও বুড়ো মানুষ যদি ‘ব্যভিচার’ বা ‘জেনাহ’ করে বসে। অর্থাৎ এটি কোন স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নয় বরং খারাপ কাজ হতে নিজেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হওয়া; কারন এই কাজের পেছনে কোন তীব্র অভিলাস বা তাড়না নেই।

 

“ মিথ্যেবাদী রাজা” – একজন রাজার সাধারনত মিথ্যে কথা বলার কোন প্রয়োজন নেই , কারণ তার হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। সাধারণত মানুষ মিথ্যে কথা বলে বিপদ থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু একজন রাজার সবরকম ক্ষমতা রয়েছে, তারপরও সে মিথ্যে কথা বলবে এইটা স্বাভাবিক নয়; এটি প্রবৃত্তি বিরুদ্ধ।

“ অহংকারী দরিদ্র ”- তার বিত্ত বৈভব কিছুই নেই, তারপরও সে অহংকার করে।

 

এই তিন প্রকার লোকের মধ্যে মিল হচ্ছে তাদের গুনাহ করার কোন তীব্র তাড়না নেই তবুও গুনাহ করে। তারমানে হচ্ছে তাদের সমস্যা হচ্ছে, তাদের হৃদয়ে ঈমানের ঘাটতি রয়েছে- ন্যায়নিষ্ঠার অভাব রয়েছে, এবং এই গুনাহগুলো করার কারণ একটাই, সেটা হল এত বেশিবার তারা এগুলো করেছে ফলে কোন কামনা বাসনা ছাড়াই এখন অভ্যাসবশত সে এগুলো করে যাচ্ছে, বেঁচে থাকতে পারছে না।

রাসুলাল্লাহ (সা) বলেন, “ তিন প্রকারের লোক রয়েছে যাদের দিকে আল্লাহ্‌ কিয়ামত দিবসে তাকাবেন না, তারা হচ্ছে : ১। পিতামাতার অবাধ্য সন্তান ২। পুরুষালী ভাব সম্পন্ন মহিলা, যে মহিলা পুরুষদের অনুকরণ করে  ৩। আদ- দাইয়ুস।”

আদ- দাইয়ুসশব্দটির অনেক বিস্তৃত অর্থ। আদ- দাইয়ুস হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার খারাপ কাজের প্রতি কোন ঘৃণা নেই। যেমন কারো মা, বোন অথবা স্ত্রী কোন অশ্লীল কাজে লিপ্ত, অথচ এতে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, কোন চিন্তা নেই- এই সকল লোকরাই হচ্ছে দাইয়ুস।

এই তিন প্রকারের লোকের দিকেও আল্লাহ্‌ কিয়ামতের দিন দৃষ্টিপাত করবেন না।

“ পিতামাতার অবাধ্য সন্তান ‘’- আল্লাহ্‌ বলেছেন যে পিতামাতার প্রতি সদয় হও। আল্লাহ্‌র ইবাদাত করো, ঠিক এর পরেই আল্লাহ্‌ পিতামাতার প্রতি সদয় হওয়ার কথা বলেছেন।

“ পুরুষালী ভাব সম্পন্ন মহিলা ”- এই খানে পুরুষালী ভাব সম্পন্ন মহিলা বলতে বোঝনো হয়েছে সেই সকল মহিলাদের যারা পুরুষের মত হতে চায়, পুরুষের মত পোশাক পরে, পুরুষের মত চলাফেরা করে। বর্তমান সময়ে এই অসুস্থতা, এই ব্যাধি খুব ছড়িয়ে পড়েছে এবং অহরহ দেখা যাচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে এদের ব্যাপারে অবগত করেছেন যে,  আল্লাহ্‌ তালা এদের দিকে তাকাবেন না, পবিত্রও করবেন না।

 

(৪) আমরা এখন ধনীদের এবং অপচয়কারিদের অবস্থা কি হবে তা কিছু আলোচনা করবো ঃ

এই হাদিসটি রয়েছে তিরমিজি, ইবনে মাজাহ আর আল হাকিমে , একদিন এক লোক রাসুল(সা) এর সাথে বসে ছিল এবং ঘন ঘন ঢেকুর তুলছিল। রাসুল(সা) বললেন, “ তোমার ঢেকুর আমাদের থেকে দূরে রাখো! যে ব্যক্তি দুনিয়াতে নিজের পেট বেশি ভর্তি রাখবে, কিয়ামত দিবসে সেই সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত থাকবে।’’ -অর্থাৎ দুনিয়াতে যে সবচেয়ে বেশি খাবে, কিয়ামতের দিন সেই সবচেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত থাকবে।

আরেকটি হাদিসে এসেছে , যা বুখারি ও মুসলিমে আছেঃ

আবূ যার (রা) হতে বর্ণিত , রাসুল(সা) বলেছেন যে, যে ব্যক্তির দুনিয়াতে যত বেশি সম্পদ, কিয়ামতের দিন তার তত কম পুরস্কার। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রমী ছাড়া যারা তাদের সম্পদ ডানে , বামে, সামনে, পেছনে ভাল কাজে ব্যয় করেছে।

 

আরেকটি হাদিসে এসেছে , যাদের দুনিয়া তে বেশি রয়েছে তাদের কিয়ামত দিবসে সবচেয়ে কম থাকবে। তারা ব্যতীত যারা ডানে বামে ভাল পথে খরচ করে এবং হালাল রুজি উপার্জন করে।- অর্থাৎ যারা হালাল রুজি উপার্জন করে এবং সৎ পথে তা খরচ করে। সুতরাং, বলা যায় “ টাকা ” জিনিসটি খারাপ নয়;অনেকেই বলে টাকা খারাপ কিন্তু এটি নিজে কোন অর্থ বহন করে না বরং আল্লাহ কুরআনে একে “ খায়ের’’ বলেছেন। রাসুল (সা)ও হাদিসে একে ‘’ খায়ের” বলেছেন। খায়ের মানে হচ্ছে ভাল বা কল্যাণকর কিছু। আল্লাহ্‌ একে একইসাথে ‘খায়ের’ ও ‘জিনা’ বলেছেন। ‘জিনা’ অর্থ হচ্ছে “ জীবনের শোভা”। টাকা জিনিসটি তখনই খারাপ যখন তা খারাপ কাজে ব্যবহৃত হবে। এটি একটি ‘টুলস’ বা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটাকে যে কেউ খারাপ কাজে ব্যবহার করতে পারে ভাল কাজেও ব্যবহার করতে পারে। যেমন আমরা নিজেদের জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধা এবং স্বাস্থ্য কিংবা আল্লাহ্‌র দেয়া যে কোন রিজিক ভাল কাজেও ব্যবহার করতে পারি, খারাপ কাজেও ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, আমাদের অর্থ সম্পদ টাকা পয়সা নিয়মিত পরিশুদ্ধ করতে হবে যাতে তা ভাল এবং পবিত্র থাকে। এবং কৃপণতা পরিহার করে তা সৎ পথে বেশি বেশি খরচ করতে হবে।

 

আমরা যদি সাহাবীদের দিকে দেখি, দেখব যে অনেক প্রসিদ্ধ সাহাবারা-ই ছিল অর্থশালী। উসমান বিন আফফান(রা) ছিলেন সবচেয়ে ধনীদের একজন এবং আব্দুর রাহমান বিন আওফ(রা) ছিলেন মুসলিম দের মধ্যে সবচেয়ে বিত্তশালী। উসমান বিন আফফান এর মত আব্দুর রাহমান বিন আওফ হচ্ছেন ‘ আশহারে মুবাসশারা’ অর্থাৎ যে দশ জন ব্যক্তি দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন। জুবাইর বিন আওয়াম ও ধনী ছিলেন। তাছাড়া আবু বকর(রা) ও উমার(রা) দুজনও বেশ সচ্ছল ছিলেন। তারা জানত কিভাবে অর্থ ব্যয় করতে হবে। এছাড়া বেশ কিছু নবী ও রাসুল বেশ বড়লোক ছিলেন, যেমন দাউদ(আ) ও সুলাইমান(আ)।

 


(৫) ধনী ও অপচয়কারিদের পর আমরা এখন আলোচনা করবো ‘আল গাদির’ বা ‘বিশ্বাসঘাতক’ দের সম্পর্কেঃ আল গাদির হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে বিশ্বাসঘাতকতা করে। রাসুল (সা) একটি হাদিসে বলেছেন যা সহিহ মুসলিমে রয়েছে, কিয়ামতের দিন যখন সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবাই একত্রিত হবে তখন যেই লোকটি দুনিয়াতে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সে একটি পতাকা বহন করবে যাতে লেখা থাকবে ‘এই লোকটি একজন বিশ্বাসঘাতক ‘- অর্থাৎ বিচার দিবসে বিশ্বাস ভঙ্গকারী ব্যক্তি সকলের সামনে সে যে একজন বিশ্বাস ভঙ্গকারী ছিল তা সে প্রকাশ করবে।

আরেকটি হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা) বলেন যে , বিশ্বাস ভঙ্গকারী ব্যক্তির পিছন দিক হতে পতাকার ঝাণ্ডাটি উঠবে এবং পতাকার ঝাণ্ডা নিয়েই সে চলাচল করবে। আকার ও আকৃতি দ্বারা তার বিশ্বাস ভঙ্গের মাত্রার তীব্রতা বোঝা যাবে।

আবু সাইদ (রা) হতে বর্ণিত, রাসুল(সা) বলেন,“ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাস ভঙ্গকারী লোকের একটি করে ঝাণ্ডা থাকবে। ঝাণ্ডার অনুপাত হবে গুনাহগারের গুনাহর উপর নির্ভর করে, এবং সেই ব্যক্তি সবচেয়ে বড় বিশ্বাস ঘাতক যে, সাধারণ মানুষের আমির- আমির আম্মা, খলিফা হয়ে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।‘’

 

-এই বিশ্বাস ঘাতকতা খুব খারাপ কারন খালিফা বা শাসক হয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করা মানে সবার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। তেমন একটি বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ হচ্ছে, ইসরাইলের কাছে প্যালেস্টাইন কে বিক্রয় করে দেওয়া। এটি হচ্ছে আল গাদরার খুব ভাল নমুনা। দুনিয়ার স্বার্থে তারা ইহুদিদের কাছে তা সই করে বিক্রয় করে দিয়েছে দুনিয়ার খুব স্বল্প মূল্যে; আর আমরা জানি ইহুদিরা খুব বেশি মূল্য দেয়ও না। খুবই স্বল্প মূল্যে কিছু লোক প্যালেস্টাইন কে বিক্রয় করে দিয়েছে।

(৬) এখন আসি, ‘আল- ঘালুলে’র বিষয়েঃ আল ঘালুলের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, গনিমতের মাল হতে কোন কিছু চুরি করা। যখন যুদ্ধ লব্ধ সম্পদ একসাথে করা হয় এবং তা থেকে কেউ যদি তা চুরি করে তাকে ‘আল ঘালুল’ বলে। সাধারন অর্থে এটি আরও বোঝায় নিজের অধিকারের বাইরে কোন কিছু রেখে দেয়া যাতে ঐ ব্যক্তির কোন অধিকার নেই।এই অপরাধের শাস্তি হচ্ছে, আল্লাহ্‌ কুরআনে বলেন,

খেয়ানত করা কোন নবীর কাজ হতে পারে না৷১১৪ যে ব্যক্তি খেয়ানত করবে কিয়ামতের দিন সে নিজের খেয়ানত করা জিনিস সহকারে হাজির হয়ে যাবে৷ তারপর প্রত্যেকেই তার উপার্জনের পুরোপুরি প্রতিদান পেয়ে যাবে এবং কারো প্রতি কোন জুলুম করা হবে না৷

 

পেছনের অংশের প্রতিক্ষার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে তীরন্দাজ বাহিনী মোতায়েন করেছিলেন তারা যখন দেখলো শত্রুসৈন্যদের মালমাত্তা লুটে নেয়া হচ্ছে তখন তারা আশংকা করলো, হয়তো সমগ্র ধন-সম্পদ তারাই পাবে যারা সেগুলো হস্তগত করছে এবং গনীমাত বন্টনের সময় আমরা বঞ্চিত হবো। তাই তারা নিজেদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে শত্রু সেনাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেবার কাজে লেগে গিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফিরে এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঐ তীরন্দাজ বাহিনীর লোকেদের ডেকে তাদের এ নাফরমানীর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তারা এমন কিছু ওজর পেশ করলো যা ছিল আসলে অত্যন্ত দুর্বল। তাদের জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ  “আসল কথা হচ্ছে, আমাদের ওপর তোমাদের আস্তা ছিল না। তোমরা মনে করছিলে আমরা তোমাদের সাথে খেয়ানত করবো এবং তোমাদের অংশ দেবো না”। এ আয়াতটিতে আসলে এ বিষয়টির প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। আল্লাহর বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর নবী নিজেই যখন ছিলেন তোমাদের সেনাপতি এবং সমস্ত বিষয়ই ছিল তাঁর হাতে তখন তোমাদের মনে এ আশংকা কেমন করে দেখা দিল যে, নবীর হাতে তোমাদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে না৷ আল্লাহর নবীর ব্যাপারে তোমরা কি এ আশংকা করতে পারো যে, তাঁর তত্বাবধানের যে সম্পদ থাকবে তা বিশ্বাস্ততা, আমানতদারী ও ইনসাফের সাথে বন্টন না করে অন্য কোনভাবে বন্টন করা হবে৷

.

 

রাসুল(সা) বলেন যে, কেউ যদি কোন উট চুরি করে, কিয়ামতের দিন সে কাঁধে করে তা বহন করবে- তেমনি কেউ যদি কোন গরু বা ছাগল চুরি করে কিয়ামতের দিন তার অবস্থা একই রকম হবে।

সহিহ মুসলিম ও বুখারির রেওয়াতে একটি হাদিস রয়েছে, আবু হুমাইদ আস সাইদি বর্ণিত, তিনি বলেন, আসাদ গোত্রের ইবন লুতবিয়া নামক জনৈক ব্যক্তিকে রাসুল(সা) সুলাইম গোত্রের যাকাত উসুল করার কাজে পাঠান। যখন সে ফিরে আসলো সে বলল, ‘’ এটি আপনার জন্য, আর এটি আমাকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে। তৎক্ষণাৎ মুহাম্মাদ (সা) মিম্বারে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্‌র শোকরিয়া আদায় করলেন, তারপর রাসুল (সা) বললেন, **“ তার ব্যাপারে কি বলব, যাকে আমি যাকাত উসুল করার কাজে পাঠালাম আর সে এসে বলছে ‘এই টি আপনার জন্য আর এই গুলো আমাকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে’?’’ সে কেন নিজ গৃহে অবস্থান করে দেখে না সে একই উপহার পেত কিনা যদি সে উসুল এর কাজে না যেত? যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তার কসম খেয়ে বলছি, তোমরা এই কাজের বিনিময়ে কিছু গ্রহন করবে না কিন্তু কেউ যদি তা করে তাহলে কিয়ামতের দিন সেই জিনিসটি নিয়েই উথিত হবে ,সে তার কাঁধে একটি ক্রুব্ধ উট বহন করবে কিংবা  রাগত স্বরে চেঁচাতে থাকা গরু কিংবা ভেড়া। তারপর রাসুল (সা) উপর দিকে হাত তুললেন এমন ভাবে যাতে আমরা সবাই তার হাত(বগল) এর শুভ্রতা দেখতে পেয়েছিলাম। এবং রাসুল (সা) দুবার বললেন, “ হে আল্লাহ্‌! আমি আপনার আদেশ পালন করেছি।”

 

এখানে কি কারনে যাকাত উসুল করার কাজে পাঠানো ব্যক্তিকে উপঢৌকন দেয়া হল? কারন, তার উচুঁ পদে থাকার কারনে। এই উপহার দেয়ার ফলে অধস্তন ব্যক্তিটি যাতে যাকাত প্রদানকারী ব্যাক্তির প্রতি সহজ, দয়ালু ও বন্ধুসুলভ হয়। এটি উপহারসামগ্রী হিসেবে বলে দিলেও সত্যিকার অর্থে এটি এক প্রকার উৎকোচ বা ঘুষ। রাসুল (সা) বলেছেন যে কেউ যদি এভাবে কিছু গ্রহন করে তবে কিয়ামতের দিন সে নিজ কাঁধে তা বহন করবে। এখানে পাশাপাশি আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন যে, কেউ যদি কোন দায়িত্বশীল পদে থাকে তারমানে এই নয় যে সে কারো কাছ থেকে উপহার গ্রহন করতে পারবে না। যে কেউ যে পদেই থাকুক না কেন সে অবশ্যই উপহার গ্রহন করতে পারবে। কিন্তু কেউ যদি আপনাকে এই উপহারের মাধ্যমে নিজের কোন কাজ হাসিল করতে চায়, নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে চায় – তাহলে সেই উপহার আপনার জন্য হালাল নয়। কারন, তা ‘উপহার’ আর মোড়কে মোড়ান এক প্রকার ঘুষ। তাছাড়া আপনাকে ভালবেসে কেউ যদি কিছু দিতে চায়, তাহলে তা আপনার জন্য বৈধ হবে। তাই রাসুল (সা) লোকটিকে বলেছেন, তুমি যদি নিজ গৃহে অবস্থান করতে তাহলে কি তারা তোমাকে এই উপহার সামগ্রি দিয়ে যেত। সে নিজ গৃহে অবস্থান করলে ঐ লোকেরা তাকে এই উপহার সামগ্রি দিত না , সে ঐখানে যাকাত উসুল এর কাজে গিয়েছিল বলেই তাকে এই উপহারসামগ্রি দেয়া হয়েছিল। তাই, এটি উপহার নয় এটি এক প্রকারের ‘ঘুষ’।

(৭) এরপরে, আমরা আলোচনা করব অবৈধ ভাবে জমি দখলদারিদের সম্বন্ধে: রাসুল (সা) বলেন, ‘’ যদি কেউ অবৈধ ভাবে কারো  এক টুকরো জমিও জবর দখল করে, তবে কিয়ামতের দিন সে সাত আসমান পরিমান দুবে যাবে ” (বুখারী) -এটি হচ্ছে অন্যায় ভাবে জমি দখলকারীদের কিয়ামত দিবসের শাস্তি।

(৮) তারপর, আমরা আসি ‘দুল – ওয়াজহাইন’ বা দ্বি-মুখিদের সম্বন্ধে: ‘দুল – ওয়াজহাইন’  মানে হচ্ছে দ্বিচারিতা বা দ্বিমুখীতা। রাসুল (সা) বলেন যে কিয়ামত দিবসে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকবে এই দ্বিমুখী লোকেরা। তারা এক মুখে কিছু লোকের সাথে কিছু লোকের সাথে দেখা করবে, আবার আরেক মুখে কিছু লোকের সাথে দেখা করবে।

আরেকটি হাদিসে রাসুল(সা) বলেন যে কিয়ামতের দিন দ্বিমুখী লোকেদের জিহবা আগুনের তৈরি হবে। দ্বিমুখী লোকের সবচেয়ে ঘৃণ্য অঙ্গ হচ্ছে তার জিহবা – কারন তা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। 

দেখুন, ইসলাম একটি সহজ সরল জীবন ব্যবস্থা, এটি কোন জটিল কুটিল ব্যাপার নয়। ইসলাম পছন্দ করে ন্যায়পরায়ণতা, স্পষ্টতা  ও সততা। আবার পাশাপাশি আপনাকে একরোখা প্রকৃতির হলে ও চলবে না। অনেকে মনে করতে পারে আমাদের দিমুখিতা দূর করতে হলে কঠোর ও একরোখা হতে হবে, না ! তা কিন্তু ঠিক নয়। ইসলাম বলে মানুষের সাথে সৎ থাকতে হবে, এবং তাদের সাথে ভাল ব্যবহার ও সত্য কথা বলতে হবে।

 

তারপরে আমরা আলোচনা করব 

(৯) সে শাসকের ব্যাপারে যে জনগন এর প্রয়োজন পূরণ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে:  রাসুল (সা) বলেন যে, যেই মুসলিমদের থেকে নেতৃত্ব দেক না কেন, সে যদি অভাবী ও গরীব লোকদের থেকে পালিয়ে থাকে ; তাহলে কিয়ামাত দিবসে আল্লাহ্‌ নিজের মাঝে আর ঐ ব্যক্তি আর তার প্রয়োজনের মধ্যে পর্দা তুলে দিবেন। – আপনি যদি কোন নেতা বা শাসক হন এবং আরপর আপনি অভাবী আর দরিদ্র লোকদের থেকে দেখা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন; আপনি তাদের কোন দায়িত্ব নিতে চান না অথচ শাসক হিসেবে আপনি তাদের কাছে দায়বদ্ধ। আর কিয়ামত দিবসে আপনার যখন আল্লাহ্‌র সাহায্য প্রয়োজন হবে তখন আল্লাহ্‌ আপনাকে সাহায্য করবেন না। কারন , আল্লাহ্‌ আপনাকে দুনিয়াতে যেই দায়িত্ব দিয়েছে আপনি তা সঠিক ভাবে পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আপনি যদি মুসলিম খিলাফার খালিফাদের দিকে লক্ষ্য করবেন, দেখবেন তাঁদের দরজা সকল শ্রেণীর মানুষের সব সরকম সাহায্য সহযোগিতার জন্য উন্মুক্ত ছিল। 

একবার, তেমনি মিশর থেকে এক লোক ঐ খানের গভর্নর আমর ইবন আস(রা) এর ছেলের ব্যাপারে অভিযোগ নিয়ে মদিনায়  খালিফা উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) এর কাছে আসেন। উমার (রা) কোন রাজপ্রাসাদ বা দুর্গে বাস করতেন না, তিনি বাস করতেন সাধাসিধা একটি কুটিরে, আশ্চর্যজনক হচ্ছে সেটিতে দরজা পর্যন্ত ছিল না- শুধু একটি মাত্র পর্দা দিয়ে বাহির হতে অন্দর মহল আলাদা ছিল। তা কেউ আসলে বাহির হতে উমার(রা) কে ডাকতো, ঊমার (রা) অনুমতি দিলেই তবেই কেউ ঘরে প্রবেশ করত। তারপর মুসলিমদের খালিফার সাথে বসে একসাথে কথা বলত।

তেমনি একবার পারস্যের এক রাজা উমার ইবনে খাত্তাব (রা) এর সাথে দেখা করতে আসল। পার্সিয়ায় তখন বড় রাজা, ছোট রাজা এরকম ভাগ ছিল। তা এইরকম এক রাজা মুসলিমদের খালিফা উমার(রা) এর জন্য বার্তা নিয়ে আসল। রাজা মদিনায় এসে জিজ্ঞেস করল, ‘’ তোমাদের খালিফা কোথায় ?’’ লোকেরা বলল , ‘’ সে তাঁর বাড়িতে আছে নতুবা মসজিদে আছে !” তারপর পারস্যের রাজা তাঁর বাড়িতে গেল কিন্তু খালিফা কে পেল না,তারপর সে মসজিদে গেল দেখল সেইখানেও খালিফা নেই। তখন একজন মুসলিম দেখিয়ে দিল এবং বলল,’’ ঐ খানে গাছের নিচে শুয়ে একজন ঘুমাচ্ছে, তিনিই আমাদের খালিফা !’’ তারপর পারস্যের ঐ রাজা মরুভুমির গাছের নিচে শুয়ে থাকা উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)এর কাছে  গেল এবং আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘’ তুমি ন্যায়বিচার কর , এজন্যেই তুমি এত শান্তিতে আর এইভাবে ঘুমোতে পারছো। – কারন পারস্যের রাজা নিজেদের সাথে তুলনা করে দেখছে যে, পার্সিয়াতে এইভাবে একজন রাজা রাজকীয় নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়া গাছের নিচে শুয়ে ঘুমানো অসম্ভব। উমার(রা) এই ভাবে নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়া ঘুমাচ্ছে কারন উমার একজন ন্যায় বিচারক।

 

অভাবী লোকদের থেকে পালিয়ে বেড়ানো একটি অত্যন্ত গহিত কাজ। তার আগে আমাদের ‘’নেতৃত্ব’’ বা ‘’শাসক ‘’ শব্দ গুলো পুনঃ সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন।  যেহেতু আমরা জুলুম ও নিপীড়নমূলক সমাজ ও শাসন ব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি তাই আমাদের নেতৃত্ব সম্পর্কে বেশ খারাপ ধারণা রয়েছে। যখনই আমাদের দেশে বা সমাজে কোন নেতা কোন ভাল কাজ করে, আমরা তার অনেক প্রশংসা করি এবং তার কাজের জন্য ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই এটাই তাদের দায়িত্ব , এটা আমাদের প্রতি তার কোন অনুগ্রহ নয়। তাদের কে এই কাজ করার জন্যই নেতা বানানো হয়েছে। আর যখনই এই নেতারা কোন মন্দ কাজ করে তখন আমরা একেবারে চুপ মেরে যাই ; মনে হয় সমগ্র জাতিকে অপমানিত করার অধিকার তাদের দেয়া হয়েছে।

 

অন্যদিকে, ইসলামে নেতৃত্ব মানেই হচ্ছে দায়িত্বশীলতা , এবং আপনি ঠিক ভাবে আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন কিনা সেই ব্যাপারে আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। নেতাদের নেতৃত্বে বসানোই হয়েছে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার জন্য। কেউ যদি কোন ভাল কাজ করে তাদের দায়িত্বই পালন করে , এটাই তাদের থেকে জনগন আশা করে। আর তারা যদি তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে তাদের নেতৃত্ব কেড়ে নেয়া দরকার। আমাদের এরকম ধ্যান ধারণা চিন্তা ভাবনা থাকা উচিত নয় নেতারাই দেশের এবং জনগনের মালিক। বরং দেশ ও জনগনের মালিক হচ্ছেন সর্ব শক্তিমান আল্লাহ্‌। নেতারা হচ্ছেন জনগণের প্রতিনিধি, এবং তারা জনগণের প্রয়োজন পূরণের জন্যেই সেই পদে আদিষ্ট হয়েছেন, তারা জনগণের প্রয়োজন পূরণ করবেন, জনগণ এর কাজ নয় তাদের প্রয়োজন পূরণ করা।

কিন্তু এই কনসেপট আজকে আমাদের মধ্যে থেকে হারিয়ে গেছে ,আমাদের আর এখন এই রকম ধ্যান ধারণা নেই , কিন্তু সাহাবা রাদিয়াল্লহ গন এই ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন এবং এই বিষয় গুলো ওনারা নিজেদের হৃদয়ে লালন করতেন। একদিন , উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন “ শুনো এবং মানো !” সালমান আল ফারিসি(রা) হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল এবং বলল, “আমরা কিছুই শুনব না , কিছুই মানব না। সালমান আল ফারিসি (রা) ছিলেন অত্যন্ত নীতিবান সাহাবি। উমার (রা) জিজ্ঞেস করলেন, লিমা- “কেন ?

” সালমান (রা) বললেন, “কারন আপনি আমাদের সবাইকে এক খণ্ড কাপড় দিয়েছেন, কিন্তু নিজে দুই খণ্ড নিয়েছেন। এই কাপড় গুলো আমির উল মুমিনিন উমার(রা) সবাইকে এক খণ্ড করে দিয়েছিল, কিন্তু উমার (রা) যখন খুতবা দিতে মিম্বারে দাঁড়ালেন তখন সালমান আল ফারিসি (রা) খেয়াল করলেন খালিফা আসলে নিজে দুই খণ্ড নিয়েছেন। উমার (রা) ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন তাই নিজে কিছু বললেন না , তিনি তার পুত্র আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) কে বললেন, ‘’ আব্দুল্লাহ, তুমিই বল।” তখন আব্দুল্লাহ (রা) দাঁড়ালেন এবং বললেন ,” আমার পিতা অনেক লম্বা, চওড়া আর সুস্বাস্থ্যবান। একখণ্ড কাপড়ে তাঁর কোন জামা তৈরি করা সম্ভব নয়, তাই আমি আমার নিজের ভাগের অংশটুকু আমার পিতাকে দিয়ে দিয়েছি। তারপর দুই খণ্ড কাপড়ে ওনার জামা তৈরি হয়েছে। ‘’

 

বর্তমানে আমাদের  নিজেদের ভূমি আমাদের থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে, আমাদের সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে, সবকিছু দখল করা হয়েছে আর আমরা এই ব্যাপার গুলো স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছি। একখণ্ড কাপড় তো দূরের ব্যাপার আমরা সহ আমাদের মুসলিম উম্মাহই পরহস্তগত হয়েছে। আমাদের উম্মাহর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খবরদারি ফলাচ্ছে অন্যেরা। আমাদের মুসলিমদের ভূমি চুক্তি করে বিক্রয় করে দেয়া হয়েছে , এটা অপমানজনক এবং অগ্রহণযোগ্য। যারা এই কাজে সহযোগিতা করেছে আল্লাহ তালা তাদের সাথে বিচার দিবসে কথা বলবেন না, পবিত্রও করবেন না।

 

তারপরে আসি, (১০) ভিক্ষুকদের প্রসঙ্গে: আবু দাউদ ও নাসাই হতে বর্ণিত, রাসুল (সা) বলেন,” যার যথেষ্ট পরিমান থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষা করে, কিয়ামতের দিন তার এই ভিক্ষা তার মুখমণ্ডলে কাল দাগ হয়ে যাবে।‘’ – অর্থাৎ আপনার যথেষ্ট পরিমান সম্পদ রয়েছে , যাতে আপনি ভালই চলতে পারেন কিন্তু তারপরেও আপনি যদি ভিক্ষা করেন তাহলে আপনার মুখে দাগ হয়ে যাবে তা বিচার দিবসে। আপনি অপদস্ত হবেন, কারন আপনার কাছে যা ভাল পরিমানে রয়েছে তাই আপনি ভিক্ষা চেয়েছিলেন। 

ইসলাম মানুষকে শেখায় সম্মানজনক ভাবে বেঁচে থাকতে। পাশপাশি ইসলাম আপনার জরুরি চাহিদা আর সমস্যাও বুঝে, যে দুর্যোগের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলাম তাকে ভিক্ষা করার অনুমতি দেয়, যে খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে আর যার সত্যিকার অরথেই প্রয়োজন সেই খেত্র ইসলাম আপনাকে অনুমতি প্রদান করে। তাদের যেমন অধিকার দেয়া হয় সাহায্যর জন্য হাত পাততে, তেমনি আমাদের উপরও দায়িত্ব বর্তায় ঐ সকল অভাবী, দুর্দশাগ্রস্ত লোকদের সাহায্য করার জন্য। আর যাদের যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র সেজে সাহায্য চায়, তারা সত্যিকার অর্থে লোভী; আর লোভ জিনিসটি আল্লাহ্‌ সুবহান ওয়াতালা পছন্দ করেন না।

শেষভাগে, (১১) আমরা আলোচনা করব সেই সকল ব্যক্তিদের ব্যাপারে যারা তাদের স্বপ্ন সম্পর্কে মিথ্যা বলে:  রাসুল (সা) বলেন, “ কেউ যদি দাবি করে সে একটি স্বপ্ন দেখেছে, সত্যিকার অর্থে তিনি তা দেখেন নি; তাহলে কেউ যদি দাবি করে সে একটি স্বপ্ন দেখেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে তা দেখে নি তাহলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্‌ তালা তাকে দুটি ছিল বা শস্য কনার মধ্যে গিঁট দিতে বলবেন। রাসুল (সা) আরও বলেন সে এই গিঁটটি দিতে পারবে না। এইটা অত্যন্ত কঠিন কাজ, যা স্বপ্ন নিয়ে মিথ্যে কথা বলা লোকদের বিচার দিবসে করতে বলা হবে। স্বপ্ন নিয়ে মিথ্যে কথা বলা খুবই খারাপ একটি কাজ।কারন, প্রায়ই লোকেরা স্বপ্ন দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হয়। এবং আপনি যখন কাউকে বলবেন আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি, তোমার সাথে এই হচ্ছে ঐ হচ্ছে, তোমাকে সাপে কামড়াচ্ছে, তুমি মারা যাচ্ছ – 

তখন ঐ ব্যক্তি তীব্র মানুষিক চাপ অনুভব করে। কিন্তু আপনি তাকে ভয় দেখানোর জন্য বা যে কোন কারনেই হোক বানিয়ে স্বপ্নটি বলে তাকে মর্মবেদনায় ফেলে দিলেন। আবার কিছু কিছু লোক নিজেকে উচ্চ মর্যাদাশীল ও আল্লাহ্‌র আউলিয়া  হিসেবে বোঝানোর জন্য বানিয়ে বানিয়ে বলে আমি মোহাম্মাদ (সা) কে স্বপ্নে দেখেছি।সাধারনত নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে। এটি একটি মারাত্মক গুনাহ। কারন আপনি স্বপ্ন নিয়ে মিথ্যে কথা বলছেন আর অধিকাংশ মানুষই স্বপ্নে বিশ্বাস করে।

 

তারপর আসি, (১২) কানপাতা ও গুপ্তচর বৃত্তির শাস্তি সম্পর্কে: আপনি যদি কারো গোপনীয়তা ভেদ করে কারো গোপন কথা বা ব্যক্তিগত কথা কান পেতে শোনেন তাহলে কিয়ামতের দিন আপনার কানে গরম উত্তপ্ত গলিত ধাতু বা সীসা আপনার কানে ঢেলে দেয়া হবে। আল্লাহ্‌ তালা আপনার কানে গরম উত্তপ্ত সীসা ঢেলে দিবেন কারন আপনি অপরের অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছেন। মানুষের নিজ গোপনীয়তা রক্ষা করার অধিকার রয়েছে। 

ইসলাম মানুষকে গোপনীয়তা রক্ষা করার অধিকার দিয়েছে। আপনি কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে নজরদারি বা গোয়েন্দাগিরি করতে পারবেন না। কেউ যদি গোপনে মন্দ কোন কাজও করে আপনি তার উপর গুপ্তচরবৃত্তি করতে পারবেন না। এমনকি কেউ যদি গোপনে কোন গুনাহও করে; আমার আপনার অধিকার নেই তা খুঁজে বের করার। কেউ যদি তার নিজের বাড়িতে মদ পানও করে তারপরও আমাদের অধিকার নেই তার উপর গুপ্তচরগিরি করার। যদিও মদ পান করা কাবিরা গুনাহ। এই সকল গুনাহ কেউ যদি গোপনে করে তার জন্য আমরা দায়ী থাকব না, এটি ঐ ব্যক্তি ও আল্লাহ্‌ সুবহান ওয়াতালার মধ্যকার বিষয়। কারন সেই এই কাজটি জনসম্মুখে করছে না। আল্লাহই এই ব্যক্তির ব্যাপারে কিয়ামতের দিন ফয়সালা করবে। 


আবার, কেউ যদি প্রকাশ্যে এই গুনাহ করে, তাহলে এর জন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে। এমনকি খালিফা উমার (রা), উসমান (রা), হয়তবা আবু বকর (রা) এর সময় এমন কিছু লোক ছিল যারা গোপনে নিজ বাড়িতে এই সকল গুনাহর কাজ করতো- কিন্তু তারা এর জন্য কখন শাস্তি পায় নি কারন তারা জনসম্মুখে এই সকল কাজ করতো না। যদিও তারা ছিল মুনাফিক ; তাদের শুধু মুসলিম নামই ছিল- তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে এই গুনাহ করতো বলে তাদের কে তাদের মত ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। ইসলাম চায় না গোপন গুনাহ গুলো লোকচক্ষুর সম্মুখে প্রকাশিত হোক। হয়তোবা এই সকল লোকদের আল্লাহ্‌ হেদায়েত দান করবে এবং তাওবা করার সুযোগ দিবে। তারা যদি হেদায়েত না পায়, তাওবা না করতে পারে তাহলে আল্লাহ্‌ তালা তাকে কিয়ামতের দিন শাস্তি দিতে পারেন আবার আল্লাহ্‌ তালা এই সকল ব্যক্তিদের ক্ষমাও করে দিতে পারেন। আল্লাহ্‌ যাকে খুশি ক্ষমা করেন, যাকে খুশি শাস্তি দেন।

আমরা এতক্ষণ আলোচনা করলাম, বিশ্বাসী হওয়ার পরেও যারা গুনাহগার তাদের অবস্থা কিয়ামতের দিন কি হবে সেই সম্পর্কে।

এখন আমরা আলোচনা করব কিয়ামতের দিন সৎ কর্মশীলদের অবস্থা কি হবে সেই সম্পর্কে , কারা কিয়ামতের দিন নিরাপদ থাকবে? তারা কারা?

আল্লাহ্‌ সুবহানওয়াতালা বলেন, ‘’যাদের জন্য প্রথম থেকেই আমার পক্ষ থেকে কল্যাণ নির্ধারিত হয়েছে তারা দোযখ থেকে দূরে থাকবে।তারা তার ক্ষীণতম শব্দও শুনবে না এবং তারা তাদের মনের বাসনা অনুযায়ী চিরকাল বসবাস করবে।মহা ত্রাস তাদেরকে চিন্তান্বিত করবে না এবং ফেরেশতারা তাদেরকে অভ্যর্থনা করবেঃ আজ তোমাদের দিন, যে দিনের ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হয়েছিল। ‘’ [ ২১ঃ ১০১-১০৩]

 

যারা কিয়ামতের দিন নিরাপদ থাকবে, তারা কারা ? তারা হচ্ছে যাদের জন্য প্রথম থেকেই আল্লাহ্‌র কল্যাণ নির্ধারণ করা হয়েছে; তাদের আল্লাহ্‌ নিরাপদ রাখবেন সেই ওয়াদা আল্লাহ্‌ তালা করেছেন। আল্লাহ্‌ তালা তাদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘’ লা ইয়া জুনুহুমুল ফাজাআল আকবার’’।‘’ ফাজাআল আকবার’’- মানে হচ্ছে মহা ত্রাস। আর আল্লাহ্‌ তালা কিয়ামতের দিনকে ‘’মহা ত্রাস’’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই দিনটি হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিন। কিয়ামতের দিনের চেয়ে ভয়ংকর দিন আর নেই।আল্লাহ্‌ বলছেন, “ লা ইয়া জুনুহুমুল ফাজাআল আকবার’’- মানে মহা ত্রাস তাদের চিন্তান্বিত করবে না। অর্থাৎ ন্যায় পরায়ন ঐ সকল মুমিনরা সবচেয়ে ভয়ংকর দিনেও চিন্তামুক্ত থাকবে, নিরাপদে থাকবে। এই সকল ব্যক্তিদের এত নিশ্চিন্ত নিরাপদ থাকার কারন কি? যখন অন্যেরা ভীতসন্ত্রস্ত, ভীষণ চিন্তায় থাকবে। আর এইসকল লোকরা থাকবে ফুরফুরে মেজাজে। এর উত্তর রয়েছে কুরআন ও হাদিসে , এই সকল লোকেরা যখন দুনিয়ায় থাকত তখন বলত, ‘’ আমরা আমাদের পালনকর্তার তরফ থেকে এক ভীতিপ্রদ ভয়ংকর দিনের ভয় রাখি।‘’ [৭৬ঃ১০]

 

এই সকল পুণ্যশীল নারি ও পুরুষ, যখন দুনিয়ায় থাকত তখন বলত যে আমরা এমন এক দিনের ভয় রাখি যা “ আবুস” এবং “কানতারির”। “আবুস” মানে হচ্ছে কোন কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকা যার ছাপ চেহারায় পড়ে অর্থাৎ ভয় করা। ইবনে আব্বাস (রা) এর মতে “কানতারিরা” হচ্ছে অনেক বড় ও দীর্ঘস্থায়ী একটি দিন। কাতাদা(রা) এর মতে কানতারিরা মানে হচ্ছে অত্যন্ত কঠিন এবং ভয়ঙ্কর একটি দিন। ঐ পুণ্যশীল নারী ও পুরুষেরা দুনিয়ায় থাকতে এই দিনটিকে ভয় পেত। তারা এইদিন এর ভয় পেত দুনিয়া থেকে তাই আল্লাহ্‌ সুবহান ওয়াতালা এই ভীতিপ্রদ ভয়ংকর দিনে তাদের নিরাপদ রাখবেন।

রাসুল (সা) একটি হাদিসে কুদসি তে বলেন, “আল্লাহ্‌ তালা বলেন, ‘আমার নামের শপথ! আমি কখনই আমার বান্দাদের দুই কালেই সুখী বা দুখী রাখবনা। আমার বান্দা যদি দুনিয়াতে থাকতে কিয়ামত দিবস কে ভয় না পায়, তাহলে তারা কিয়ামত দিবস তাদের জন্য এক ভীতিকর দিন হবে।আর কেউ যদি দুনিয়াতেই এই দিনটিকে ভয় পায়, তাহলে কিয়ামত দিবসের দিন সে থাকবে নিরাপদ এবং তার মনে তাকবে শান্তি।” – অর্থাৎ আপনি যদি দুনিয়াতে থাকতে কিয়ামত দিবসকে ভয় না পান, তাহলে অবশ্যই আপনি কিয়ামত দিবসের দিন ভীতসন্ত্রস্ত থাকবেন। আর আপনি যদি, দুনিয়া থেকেই এই দিনটিকে ভয় করে আসতে থাকেন, তাহলে আপনি এই দিন থাকবেন ফুরফুরে মেজাজে, নিরাপদে। আর ঐ ভয়ংকর দিন ভীতসন্ত্রস্ত থাকার চেয়ে, দুনিয়াতে ঐ দিনটিকে ভয় করা ঢের ভাল। কারন, আমরা এই আলোচনা থেকে আগেই জানতে পেরেছি, আপনি যদি আগে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যান, পরে আপনার জন্য তা ততটাই সহজ হয়ে যাবে। দুনিয়াতে আপনি যত সহজে আপনার গুনাহ থেকে পরিত্রাণ পাবেন,পরবর্তীতে তত সহজে পরিত্রাণ পাবেন না।

 

কিভাবে আপনি আপনার গুনাহ থেকে পরিত্রাণ পাবেন?


প্রায় ১১টির বেশি উপায়ে আপনি আপনার গুনাহ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন। একটু বিস্তারিত বলছি: আপনার গুনাহর ফয়সালা হয়ত আল্লাহ্‌ দুনিয়াতেই করে দিবেন। কিভাবে? আপনাকে শোকে ,অসুখে বিপদে, দুর্যোগে, আর্থিক সঙ্কটে বিপর্যস্ত করে আপনার গুনাহ দূরীভূত করবে দুনিয়াতে। কিন্তু সেটাও যদি পর্যাপ্ত না হয় তাহলে আপনার মৃত্যুর সময় তীব্র “মৃত্যুযন্ত্রণা”র মধ্যে দিয়ে যাবেন। তাও যদি আপনার গুনাহ থেকে যায় তাহলে কবরে আপনার জন্য আজাবের ব্যবস্থা করা হবে। কবরের আজাব দুনিয়ার দুঃখ কষ্ট  থেকে আরও কঠিন আরও ভয়ংকর। তাও যদি আপনার গুনাহ রয়ে যায়, তারপর আপনাকে গ্রাস করবে কিয়ামতের দিনের মহা ত্রাস। তাও যদি আপনার জন্য যথেষ্ট না হয়, আপনাকে কিছু কাল জাহান্নামের আগুনে থাকতে হবে। কারন, আল্লাহ্‌ তালা কাউকে জান্নাতে নেবেন না সে যদি শতভাগ শুদ্ধ ও পাপমুক্ত না হয়। কারন,জান্নাতে কেউ গুনাহগার প্রবেশ করতে পারবেন না, তাকে তা অবশ্যই দূরীভূত করে আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় প্রবেশ করতে হবে। এই শাস্তির প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আপনাকে আপনার কৃতকর্মের ফলই ভোগ করতে হচ্ছে। দুনিয়াতে আপনার কৃত গুনাহ থেকে বাঁচা অনেক অনেক সহজ- কারন আপনাকে শুদ্ধ চিত্তে তাওবা করলেই কৃত গুনাহ থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন। আর দুনিয়ার দুঃখ কষ্ট আখিরাতের দুঃখ কষ্টের চেয়ে হাজার হাজার গুন ভাল।কারন আল্লাহ্‌ বলীন,”কেউই জাহান্নামের আগুনে ধৈর্যশীল নয়।‘’ কোন ব্যক্তিই জাহান্নামের আগুন সহ্যও করতে পারবে না।জাহান্নামে মানুষ যেই পরিমান কষ্ট ও অসহনশীল পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যাবে, তার চেয়ে অনেক সহজ এই সকল গুনাহর ব্যাপারে দুনিয়াতে ফয়সালা করে ফেলা। আর যাদের সাথে আল্লাহ্‌ তালা ওয়াদা করেছিলেন ”আল হুসনার” তারা ইতিমধ্যে দুনিয়াতেই এই দিনের ভয়ে ভীত ছিল, তাই আল্লাহ্‌ সুবহান ওয়াতালা এই সকল পুণ্যশীল নর নারীদের কিয়ামতে নিরাপদে শান্তিতে রাখবেন।

আমরা নিজেদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারছি, আমরা কিয়ামত দিবসের ব্যাপারে সচেতন নই। আমরা এই ব্যাপারে অসচেতন ও ভীষণ অমনোযোগী। সুবহানআল্লাহ্‌ ! আখিরাতের ব্যাপারে সাহাবা রাদিয়াল্লাহু দের মনোযোগ সিকি ভাগও সরে নি। যখনই রাসুল(সা) আখিরাতের ব্যাপারে, কিয়ামতের ব্যাপারে আলোচনা করতো, তখনই সাহাবা রাদিয়াল্লাহুরা কাঁদত, চোখের পানি ফেলত এবং আল্লাহ্‌র সাথে সাক্ষাতের ভয়ে ভীত হত।