পরকালের পথে যাত্রা – পর্ব ১৭ – কেমন হবে জাহান্নাম

আলহামদুলিল্লাহ, ওয়াসসালাতু ওয়াসসালাম ‘আলা রাসুলিল্লাহ

আখিরাতের বিষয় নিয়ে এত কথা বলার কি আছে?
যদি আমাদের কখনো এমন মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে, আমরা আসলে সঠিক ভাবে ইসলামের দিকে অগ্রসর হচ্ছি না।

আপনারা আয়েশার (রা) এই কথাটা সম্পর্কে চিন্তা করুন। সাইয়িদা আয়িশা  বলেন, “যদি কুরআনের প্রথম নাযিলকৃত আয়াত হতো ‘তোমরা মদ পান করো না।’, তাহলে লোকেরা বলত ‘আলাহর কসম, আমরা মদ পান করা বাদ দিব না।’ যদি কুরআনের প্রথম নাযিলকৃত আয়াত হতো ‘তোমরা যেনা করো না।’, তাহলে লোকেরা বলত ‘আলাহর কসম, আমরা যেনা করা বাদ দিব না।’ কিন্তু কুরআনের প্রথম আয়াত ছিল ‘সুরাতুল মুফাসসাল (মাক্কি জীবনের প্রথম দিকের নাজিল হওয়া সূরা সমূহ)’, সেখানে রয়েছে জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা। এর ফলে লোকেদের অন্তর আল্লাহর প্রতি অনুগত হয়ে পড়ে, তারপরই হালাল-হারামের আয়াত নাযিল করা হয়।”

আয়েশা (রা) বলছেন যদি কুরআনের প্রথম আয়াতগুলো আমাদের করনীয়-বর্জনীয় নিয়ে আলোচনা করতো, যেমন, 
এটা করা যাবে না! 
ওটা করা যাবে না! 
প্রথমেই বিধি নিষেধ !
তাহলে লোকেরা তাঁর অনুসরণ করতো না। 

আপনি যদি প্রথম দিনেই মানুষকে বলতে শুরু করেন যে এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, মানুষ সেই আহবানে সাড়া দিবে না।

 

আয়েশা (রা) বলছেন যে কুরআনের প্রথম আয়াতগুলো জান্নাত এবং জাহান্নাম নিয়ে কথা বলতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত তাঁদের অন্তর আল্লাহর প্রতি অনুগত হয়ে যায়, তারপর হালাল-হারামের বিধান নাযিল করা হয়।

আয়েশা (রা) এই কথা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে মানুষের অন্তরকে আল্লাহর প্রতি অনুগত করার জন্য আমাদেরকে বেশি বেশি জান্নাত ও জাহান্নামের কথা বলতে হবে। আখিরাতের স্মরণ মানুষের অন্তরকে আল্লাহর প্রতি অনুগত করে দেয়। সংযুক্ত করে দেয়, 

এবং বেশি বেশি আখিরাতের স্মরণ করা, মৃত্যুর স্মরণ করা
আমার মনে হয় আমরা এই বিষয়কে যথেষ্ট গুরুত্ব দেই না, 
আসলে আমরা বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন,  আমরা দুনিয়ার প্রতি বেশি আসক্ত এবং এই দুনিয়াকেই বাস্তব বলে মনে করছি, যেন আমাদের এখানেই থাকার কথা, যেন আমরা চিরদিন এখানেই থাকব- যা আসলে সত্য নয়। আমরা আসলে একটা ঘোরের মধ্যে বাস করছি, যা খুব শীঘ্রই কেটে যাবে এবং আমরা বাস্তবতার সম্মুখীন হব। আর বাস্তবতা হচ্ছে মৃত্যুর পরের জীবন, পরকালের জীবনই হচ্ছে প্রকৃত জীবন।

এবং আমরা আখিরাত সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্কবাণী পাচ্ছি না এবং আমরা যদি এই সতর্কবাণীর চর্চা শুরু না করি, বার বার এই বিষয়টি স্মরণ না করি, তাহলে আমরা ধীরে ধীরে তা ভুলে যাব। উদাসীন গাফেল হয়ে পড়ব।

 

আমরা মানুষেরা অনেকে অনেক কিছুর প্রতি আসক্ত।এই পৃথিবী, আমরা যাদেরকে ভালোবাসি তাদের প্রতি আমরা বেশি আসক্ত, আমাদের ভোগসামগ্রির প্রতি আমরা বেশি আসক্ত। আমাদের বাড়ি, গাড়ি, আমরা এই পৃথিবীর বিলাসিতার প্রতি বেশি আসক্ত। 
কিন্তু আমরা আখিরাতের সাথে যথেষ্ট পরিমাণ কানেক্টেড বা সংযুক্ত নই।
কাজেই আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিৎ , এখন যদি মৃত্যুর ফেরেশতা আমাদের কাছে আসেন, ঠিক এই মুহুর্তেই এবং আমাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা এখন মরতে প্রস্তুত কি না? (যদিও তিনি আম্বিয়াদের ছাড়া আর কারো অনুমতি নেন না)

কি হবে আমাদের উত্তর? আমরা কি প্রস্তুত? আমরা কি আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলার সাথে সাক্ষাৎ করতে প্রস্তুত? আমরা কি এই মুহূর্তে আল্লাহর সাথে দেখা করতে চাই ? না আমরা এখনও এই দুনিয়ার প্রতি আসক্ত? আমরা যদি সবসময় এই বিষয়টা নিয়ে না ভেবে শুধু এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে থাকি, সেটা কি উচিৎ হবে?

রাসুলুল্লাহ (সা) জান্নাত ও জাহান্নাম সম্পর্কে প্রচুর কথা বলতেন, সবসময় তিনি এই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিতেন, তিনি আখিরাত নিয়ে এত বেশি কথা বলতেন, বিশেষ করে জাহান্নাম নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা) এত বেশি বলতেন যে একজন মহিলা সাহাবী সূরা কাহফ মুখস্ত করে ফেলেছিলেন শুধুমাত্র রাসুলুল্লাহর (সা) জুমআর খুতবা শুনে শুনে। এবং সূরা কাহাফে আমরা জানি, আখিরাত নিয়ে, মৃত্যু নিয়ে জাহান্নাম নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

রাসুলুল্লাহ (সা) এত ঘন ঘন জাহান্নামের ব্যাপারে সতর্ক করতেন 
তার কারণ এই যে 
আল্লাহর পরে এই উম্মতের প্রতি সবচেয়ে বেশি যিনি দয়াপরবশ তিনি হলেন রাসুলুল্লাহ (সা)। তিনি চান নি যে তাঁর উম্মত কোন ক্ষতির সম্মুখীন হোক। এবং তিনি সবসময় আমাদেরকে আখিরাত সম্পর্কে, মৃত্যু সম্পর্কে, জান্নাত সম্পর্কে ও জাহান্নাম সম্পর্কে সতর্ক করতেন।

একদা রাসুলুল্লাহ (সা) তাঁর খুতবা শুরু করেন এভাবে, আল্লাহর প্রশংসা এবং রাসুলদের প্রতি সালাম প্রেরণের পরে তিনি বলেন, “আমি তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে সতর্ক করছি! আমি তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে সতর্ক করছি! আমি তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে সতর্ক করছি!”। রাসুলুল্লাহ (সা) একই কথা বার বার বলছিলেন এবং তাঁর গলার আওয়াজ বড় হচ্ছিল। একজন সাহাবা বলেন যে ‘কেউ যদি বাজারে থাকতো তাহলেও রাসুলুল্লাহর (সা) কথা শুনতে পেত।’ 

ঐ সাহাবা আরও বলেন যে মসজিদে সাহাবীদের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। তাঁদের অন্তর এতটাই নরম ছিল। 
কিন্তু আমাদের অন্তর বড়ই কঠিন, আমরা এমন সময়েও হাসতে পারি যখন আসলে আমাদের কান্না পাওয়ার কথা। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখি লোকজন জানাযার জন্য সমবেত হয়েছে কিংবা লাশ দাফন করছে, সেখানেও একে অপরের সাথে হাসি তামাশা করছে। 

অপরদিকে, উসমান ইবনে আফফান (রা) যখন কোন দাফনে অংশ নিতেন, তখন তিনি কবরের পাশে বসে এত বেশি কাঁদতেন যে তিনি উঠে দাঁড়াতে পারতেন না। তিনি এতটাই আক্রান্ত হতেন যে নিজের পায়ের উপর ভর করে উঠে দাঁড়াতে পারতেন না।
এবং সাহাবারা তাঁর কাছে এসে বলতেন, ‘কি হয়েছে আপনার?’, তিনি বলতেন ‘আখিরাতের প্রথম ধাপ হচ্ছে কবর, এই ধাপটি যদি ভাল করে পার করে ফেলা যায়, পরবর্তী ধাপগুলো পার হওয়া সহজ হয়। আর এই ধাপটি যদি কঠিন হয়, তাহলে পরবর্তী ধাপগুলোও কঠিন হবে।’

এই চিন্তা, এই ভাবনা এবং এই আখিরাতের স্মরণে অন্তরের উপরে প্রভাব, সংবেদনশীলতা, এগুলো আমাদের বড় অভাব, আমার মনে হয় অন্তরের এই সংবেদনশীলতার আমাদের বড় অভাব। আমরা আখিরাতের কথা শুনি কিন্তু আমাদের অন্তরে কোন প্রভাব পরে না !
 এবং আমাদের এই অনুভুতি ফিরিয়ে আনার উপায় হচ্ছে সবসময় সত্য জিনিসটাকে স্মরণ করা। আমরা আসলে স্বপ্নের জগতে বাস করি, আমাদের মনে হয় আমাদের চারপাশে যা রয়েছে, তা চিরদিন থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন! এর কিছুই একদিন থাকবে না, ‘কুল্লু মান ‘আলাইহা ফান। ওয়া ইয়াব’কা ওয়াজহু রাব্বিকা যুল জালালি ওয়াল ইকরাম’ – সূরা আর রাহমান (৫৫-২৬,২৭)

‘(জমিন ও) তার উপর যা কিছু রয়েছে সে সবই (একদিন) ধ্বংস হয়ে যাবে। বাকী থাকবে শুধু একমাত্র আপনার মহিমায় ও মহানুভব পালনকর্তার সত্তা ছাড়া’। 


সুবহানাল্লাহ কুরআন এবং সুন্নাহ আখিরাতের বিষয়ে এত বিস্তারিত আলোচনা করেছে যে আর কোন ধর্মে এত বেশি আলোচনা করা হয় নি। আমরা ইনশাআল্লাহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো যেমন, জাহান্নামের আয়তন, জাহান্নামের গভীরতা, জাহান্নামের দরজাসমূহ, জাহান্নামের জ্বালানী, জাহান্নামের চিরস্থায়ীত্ব, জাহান্নামীদের খাদ্য, তাদের পোশাক, জাহান্নামের শাস্তি, জাহান্নামের বিভিন্ন স্তর এবং আমরা আলোচনা করবো কোন কোন কাজ মানুষকে জাহান্নামে ঠেলে দেয়।

 

আমি আবারও বলছি যে আখিরাতকে আমাদের যতটা গুরুত্ব দেয়া উচিৎ ততটা আমরা দিচ্ছি না। আমরা যদি আধুনিক বিশ্ব এবং সাহাবা (রা) –দের জীবনী লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাব যে তাঁরা কতটা সতর্ক ছিলেন এই ব্যাপারে। সর্বক্ষণ তাঁদের মনে আখিরাতের চিন্তা স্থায়ী থাকতো, তাঁরা সবসময় একে অপরকে আখিরাত সম্পর্কে সতর্ক করতেন। 

আর কুরআন! 

এটা খুবই কম হয় যে আপনি কুরআনের একটি পৃষ্ঠা পড়বেন কিন্তু সেখানে আখিরাতের উল্লেখ থাকবেনা। কেন আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা এত বার জান্নাত এবং জাহান্নামের কথা বললেন? এর থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে এটা আমাদের জন্য খুব জরুরি। 

এবং একই কথা বার বার বলা হয়েছে, এবং রাসুলুল্লাহ (সা) ও আমাদেরকে বার বার সতর্ক করেছেন এ ব্যাপারে। এর কারণ হচ্ছে আমাদের অন্তর পরিবর্তনশীল, তা খুব সহজেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। ‘কালব’  শব্দটি হচ্ছে অন্তরের আরবী শব্দ, ‘কালব’ এসেছে ‘তাকাল্লুব’ থেকে যার মানে হচ্ছে ‘ফুটন্ত পানি’। একটি পাত্রে যেমন ফুটন্ত পানি বার বার উঠা-নামা করে (এমন কিছু যা সদা পরিবর্তনশীল), আমাদের অন্তরও তেমন। আর এটার সুন্দর প্রমান হচ্ছে ছোট বাচ্চা, যে হাসতে থাকে আবার পর মুহূর্তেই কাঁদতে শুরু করে। আর তাই রাসুলুল্লাহ (সা) তাঁর দোয়ায় বলতেন, ‘হে অন্তর পরিবর্তনকারী, আমাদের অন্তরকে তোমার দ্বীনের উপর অবিচলিত রাখ,’রাসুলুল্লাহ (সা) খুব ঘন ঘন এই দোয়াটি পড়তেন, তাই আমাদের উচিৎ এই দোয়াটি সবসময় পড়া। আমাদের উচিৎ সবসময় আখিরাতের কথা স্মরণ করা।

 

রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন যে তাঁর আর আমাদের উদাহরণটা হচ্ছে এমন যে, একজন মানুষ (রাসুল) মরুভূমিতে রাতের অন্ধকারে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন… (যখনই কোন অন্ধকার জায়গায় আলো জ্বালানো হয়, তা পোকাদের আকর্ষণ করে, বাতি জ্বালালে যেমন পোকারা সেটাকে ঘিরে থাকে, তেমনি করেই তারা আগুনকে আলো ভেবে সেখানে ঝাপ দেয় এবং পুড়ে মারা যায়।)

রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন,  তোমরা সেই আগুনকে আলো ভেবে সেখানে ঝাপ দিতে চাচ্ছ কিন্তু আমি (রাসুল) তোমাদেরকে ধরে রাখতে চাইছি, কিন্তু তারপরও কিছু লোক আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেদেরকে আগুনে ফেলে দিচ্ছে।

 

রাসুলুল্লাহ (সা) আমাদের সবসময় সুরক্ষিত রাখতে চান, তিনি চান না আমাদের কোন ক্ষতি হোক। তারপরও কিছু লোক নিজেদেরকে জাহান্নামে ছুঁড়ে দিচ্ছে যদিও তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।

আর আমরা  আখিরাত নিয়ে, পরকাল নিয়ে যত বেশি কথা বলব ততই আমাদের কাছে এই দুনিয়ার জীবন আর আখিরাতের জীবন পরিস্কার হয়ে যাবে। জিবরাঈল (আঃ) এর কাছে বিষয়টা খুব পরিস্কার ছিল। জিবরাঈল (আঃ) বিশ্বাস করতে পারেন না কিভাবে কিছু মানুষ জান্নাতের বিনিময়ে জাহান্নাম কিনে নেয় !! জিবরাঈল (আঃ) বলেন, “আমি বুঝতে পারি না কিভাবে একজন মানুষ ঘুমাতে পারে যখন সে জানে জাহান্নাম তার জন্য অপেক্ষা করছে! আর আমি এও বুঝতে পারি না একজন মানুষ কিভাবে  ঘুমাতে পারে যখন সে জানে জান্নাত তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে!” 

আমরা কিভাবে ঘুমের স্বাদ আস্বাদন করবো যখন আমাদের জন্য হয় জান্নাত অথবা জাহান্নাম অপেক্ষা করছে।

উমর ইবনে আব্দুল আজিজের (র) স্ত্রী বর্ণনা করেন যে এক রাতে উমর ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ থর থর করে কাঁপতে শুরু করলেন এবং বাকি রাত ঘুমোতে পারলেন না। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেন, ‘আমার মনে পড়লো যে এমন একদিন আসবে যেদিন আমাকে হয় জান্নাতে অথবা জাহান্নামে যেতে বলা হবে।’

এটা শুধু উমর ইবনে আব্দুল আজিজের জন্য সত্য নয়, এটা আমাদের সবার জন্য সত্য। 

আমাদের সবাইকেই বিচার দিবসে দাঁড়াতে হবে। 

আমরা মনে করি এটা অনেক দূরের ঘটনা অথবা কাল্পনিক জগৎ। 
কিন্তু সত্য হচ্ছে যে শীঘ্রই আমাদেরকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। আমরা জান্নাত আর জাহান্নাম নিজের চোখে দেখতে পাবো। 
আমাদের উচিৎ সেদিনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া।

 এটা আমাদের ভবিষ্যৎ, আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছি। 

আমাদের আত্মা সৃষ্টি করা হয়েছে অনন্তকালের জন্য। আমাদের আত্মাকে ক্ষণস্থায়ী সময়ের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, একটা সময় আমাদের আত্মার কোন অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু একবার যেহেতু এর সৃষ্টি হয়েছে, এটা অনন্তকাল বেঁচে থাকবে। এমন কোন সময় আসবে না যখন আমাদের আত্মার অস্তিত্ব থাকবে না।

 

আর সেই অনন্ত জীবনের জন্য পরীক্ষা হচ্ছে এই দুনিয়া, তারপর হয় জান্নাত অথবা জাহান্নাম। অতীতে যারা এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তাঁরাই জীবনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা সাফল্যের জন্য কষ্ট করেছেন, একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করেছেন। আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা বলেন,

‘এ বিষয়ে প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত।’ ৮৩;২৬

আর সেটাই হলো প্রতিযোগিতার মাঠ, আমাদের বৈষয়িক বিষয়ে প্রতিযোগিতা করা উচিৎ নয়, আমাদের উচিৎ পরকালের সাফল্যের জন্য প্রতিযোগিতা করা।

কোরআনে কারিমে আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা এবং হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে জান্নাত এবং জাহান্নাম সম্পর্কে বিশদভাবে বর্ণনা দিয়েছেন। আজ আমরা জাহান্নামের বর্ণনা সম্পর্কে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ।

 এবং মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য সবচেয়ে ফলপ্রসূ অনুপ্রেরণা হচ্ছে পুরস্কার অথবা শাস্তির কথা। 

ভাল কাজের পুরস্কার আর মন্দ কাজের জন্য শাস্তি।

 আল্লাহ আমাদেরকে এই পৃথিবীতে অল্প সময়ের জন্য পাঠিয়েছেন, আমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। পরীক্ষার প্রশ্ন আমরা জানি, উত্তরও জানি। আমাদের কাছে কোরআন হাদিস আছে। আমাদেরকে উত্তর দিতে হবে আর ফলাফল ঘোষণা হবে কিয়ামত দিবসে। আর এই ফলাফল চূড়ান্ত, এর কোন পরিবর্তন হবে না।

 

এবার জাহান্নাম প্রসঙ্গে আসি। আমরা জাহান্নাম নিয়ে যতই কথা বলি না কেন আমরা কখনই আসল চিত্রটা কল্পনা করতে পারবো না। এটা শুধুমাত্র আমাদের কাছে বিষয়টা একটু পরিস্কার করার প্রচেষ্টা। এবং জান্নাতের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। কেন?
কারণ এই দুনিয়ায় এমন কিছু নেই, যার সাথে আমরা মিল দেখাতে পারি। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন,

‘জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের চাইতে ৭০ গুন বেশি তীব্র।’ 
এটা বলা হয়েছে শুধুমাত্র তীব্রতা বুঝানোর জন্য, কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। এই দুনিয়ায় কোন শাস্তি কিংবা পুরস্কার নেই,

এই দুনিয়াটা আসলে পুরস্কার অথবা শাস্তি হওয়ার যোগ্য নয়। এই দুনিয়াটা যদি পুরস্কার হিসেবে যথেষ্ট হতো, তাহলে আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা মুমিনদের জন্য দুনিয়াকেই পুরস্কার বানিয়ে দিতেন। আবার এই দুনিয়াটা যদি শাস্তি হিসেবে যথেষ্ট হতো, তাহলে আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা কাফিরদের জন্য দুনিয়াকেই শাস্তি বানিয়ে দিতেন। 

এই দুনিয়াটা আসলেই পুরস্কার অথবা শাস্তি হওয়ার যোগ্য নয়। তাই মুমিন অথবা কাফির কেউই এই দুনিয়াতে পুরস্কার অথবা শাস্তি লাভ করবে না।

 

মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের দুটো বৈশিষ্ট্য দরকার, দুটো বৈশিষ্ট্যের সামাঞ্জস্য থাকা দরকার। সেগুলো হচ্ছে ভয় এবং আশা। আশা রাখতে হবে যে আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা আমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন, আর ভয় করতে হবে এটা জেনে যে আল্লাহর শাস্তি ভয়াবহ। 

এই দুটো পাখির ডানার মতো, দুটোর মাঝে সামাঞ্জস্য থাকতে হবে। একটা যদি আরেকটার চাইতে শক্তিশালী হয়ে যায়, তাহলে আর পাখি ঠিকমত উড়তে পারবে না। আপনি যদি আল্লাহর কাছ থেকে খুব বেশি শুধু আশাই করেন, তাহলে প্রত্যাশার পাল্লা ভারী হয়ে যাওয়ায় আপনি অলস হয়ে যাবেন। 

তাহলে আপনি জান্নাতের জন্য কষ্ট করতে পারবেন না। আপনি ভাববেন যে আল্লাহ তো ক্ষমাশীল তিনি আমাকে মাফ করবেনই, আপনি তখন যা মন চায় তাই করবেন। আবার আপনি যদি আল্লাহর ক্ষমা আশা না করে শুধু ভয় করেন, তাহলে আপনার মনে হবে আল্লাহ আপনাকে কখনই মাফ করবেন না, যার ফলে আপনি হতাশ হয়ে যাবেন। 
ভাল কাজ করা বাদ দিয়ে দিবেন। দুটোই চরম অবস্থা, কখনই এই দুই চরমে যাওয়া আমাদের কাম্য নয়। আমাদের উচিৎ একটা ভারসাম্যের মধ্যে জীবনযাপন করা। আল্লাহকে ভয় করা এবং তাঁর কাছ থেকে ভাল আশা করার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে জীবনযাপন করতে হবে। এই ভারসাম্য নষ্ট হতে দেয়া যাবে না।

আমরা যদি তুলনা করি, তাহলে দেখতে পাবো যে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে ঈশ্বরকে এমন ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যা পড়লে মনে হবে যে ঈশ্বর খুব রাগি আর গম্ভীর আর মানুষের উচিৎ তাঁকে বেশি বেশি ভয় করা। আবার যদি নিউ টেস্টামেন্ট পড়েন তাহলে দেখবেন সেখানে এমন এক ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে যিনি খুব দয়ালু আর ক্ষমাশীল। দুটোতেই ভারসাম্যের অভাব রয়েছে। ইসলামে আছে ভারসাম্য। আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা বলেন যে তিনি , দয়ালু আবার এও বলেন যে তাঁর শাস্তি ভয়ানক।

খেয়াল করুন আল্লাহর দুটো নাম হচ্ছে ‘দয়ালু’ আর ‘ক্ষমাশীল’ আর তাঁর শাস্তিও প্রবল। কিন্তু শাস্তি-প্রদানকারি তাঁর নাম নয়, তাঁর নাম হচ্ছে দয়ালু।

 

পরকালের পথে যাত্রায় জাহান্নাম আমাদের ভয়ের কারণ আর জান্নাত আমাদের আশার আলো। 

আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন কাফিরদের জন্য, মুনাফিকদের জন্য আর সেই সব বিশ্বাসীদের জন্য যারা অনেক পাপ কামিয়েছে। তাদের জন্যই জাহান্নামের সৃষ্টি। জাহান্নামের আয়তন সম্পর্কে যদিও আমরা সঠিক কোন মাপ জানি না কিন্তু এর বর্ণনা শুনে বুঝতে পারি যে তা অনেক বড়। 

এবং জাহান্নাম সবসময় আরো চাইবে, এটা কখনও পূর্ণ হয় না। যখনই তার মধ্যে কিছু মানুষ রাখা হবে তখনই সে বলবে, ‘আরও আছে কি? হাল মিন নাযির?’ আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা বলেন,

“একদিন আমরা জাহান্নামকে জিজ্ঞেস করবো, ‘তুমি কি পূর্ণ হয়েছ?’, সে বলবে, ‘আরও আছে কি?’”

তো জাহান্নাম সবসময় বেশি বেশি চাইবে। তার ভেতর জায়গা রয়েছে যত খুশী তত মানুষ নেয়ার। সে তখনই থামবে যখন আল্লাহ সুবহানা ওয়া তা’আলা তাকে থামতে বাধ্য করবেন।

 

জাহান্নামের বিশালতার আরেকটা মাপকাঠি হচ্ছে তার গভীরতা। এই হাদিসটি একটি অলৌকিক হাদিস, আমরা এটাকে বিজ্ঞান দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারবো না। সহিহ মুসলিমের এই হাদিসটি আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেন, একদা রাসুলুল্লাহ (সা) সাহাবীদের নিয়ে বসে ছিলেন, হঠাৎ তাঁরা একটি বিকট আওয়াজ শুনতে পান। রাসুলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা কি জানো এটা কিসের আওয়াজ?’ সাহাবারা বললেন, ‘আল্লাহ আর তাঁর রাসুলই ভাল জানেন।’ রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, ‘৭০ বছর আগে জাহান্নামের উপর থেকে একটি পাথর ছাড়া হয়েছিল, তা এই মাত্র জাহান্নামের ভুমি স্পর্শ করলো।’

এই আওয়াজটা তাঁরা কিভাবে শুনলেন? এটা একটা অলৌকিক ব্যাপার। আওয়াজটা পৃথিবীর সব মানুষ শুনেছিল নাকি শুধু রাসুলুল্লাহ (সা) আর সাহাবা (রা) শুনেছেন তা আল্লাহই ভাল জানেন। কিন্তু হাদিসটি থেকে আমরা জানতে পারি যে পাথরটির ৭০ বছর সময় লেগেছিল জাহান্নামের গভীরতা ভেদ করতে। তার মানে জাহান্নাম খুবই গভীর।

 

৩য় আরেকটি বিষয় থেকে জাহান্নাম সম্পর্কে ধারনা করা যায়। তা হচ্ছে জাহান্নামকে ধরে রাখা ফেরেশতাদের সংখ্যা। সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন,

‘কিয়ামতের দিন জাহান্নামকে সত্তর হাজার শিকল দিয়ে বেধে রাখা হবে, প্রতিটি শিকল ধরে থাকবেন সত্তর হাজার জন ফেরেশতা।’

জাহান্নামের বিশালতা সম্পর্কে ৪র্থ ইঙ্গিত পাওয়া যায়, 
সহিহ মুসলিমের আরেকটি বর্ণনা পাওয়া যায় যেটাতে বলা হয়েছে যে চন্দ্র এবং সূর্যকেও জাহান্নামে ছুঁড়ে দেয়া হবে। আমরা বুঝতে পারি যে জাহান্নাম বিশাল কারণ চন্দ্র এবং সূর্যের আয়তন সম্পর্কে আমরা জানি। আপনারা ভাবতে পারেন কেন চন্দ্র আর সূর্যকে জাহান্নামে ফেলা হবে? এটা কি তাদের শাস্তি? কি কারণ?

আল্লাহ ছাড়া আর যারই উপাসনা করা হয়েছে তাকেই জাহান্নামে ছুঁড়ে ফেলা হবে। চন্দ্র এবং সূর্যকেও আল্লাহর পাশাপাশি উপাসনা করা হয়েছে, তাই তাদেরকেও সেখানে ফেলে দেয়া হবে।

 

জাহান্নামের স্তরভেদঃ

জাহান্নামের লেভেল বা স্তর আছে। জান্নাতের উপরের স্তর নিচের গুলা থেকে তুলনামূলকভাবে ভালো। আর জাহান্নামের স্তর যত নিচে তা তত ভয়াবহ। অর্থাৎ জান্নাতের স্তর নিচের থেকে উপরের দিকে বাড়ে। আর জাহান্নমের স্তরগুলো উপর থেকে নিচের দিকে বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেন, ইন্নাল মুনাফিকিনা ফিদ দারকিল আসফালি মিন আন্নার – অবশ্যই মুনাফিকরা, ভণ্ডরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। (সুরা আন-নিসাঃ ১৪৫)

 

এর উপরেও জাহান্নামের আরও স্তর আছে। যেমন আমরা জানি যে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে তার চাচা আবু তালিব থাকবেন জাহান্নামের একটি অগভীর খাদে। তার পায়ের গিরা পর্যন্ত আগুন থাকবে। এই যা। অন্যান্যদের চারপাশে আগুন দিয়ে ঘেরাও করা থাকবে। আবু তালিবের পায়ের গিরা পর্যন্ত আগুন থাকবে আর তাতেই তার মাথার মগজ ফুটতে থাকবে। এটাই জাহান্নামের সবচেয়ে কম শাস্তি। সুতরাং আপনারা কল্পনা করার চেষ্টা করুন বড় শাস্তিগুলো কেমন হতে পারে।

জাহান্নামের দরজা বা বলা যায় গেইট আছে। জাহান্নামের দরজার সংখ্যা মোট সাতটি। আর জান্নাতের দরজার সংখ্যা আটটি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “এর সাতটি দরজা আছে, প্রত্যেক দরজার জন্য একটি নির্দিষ্ট দল রয়েছে।” (সুরা হিজরঃ ৪৪)

 

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, “ যেসব লোক কুফরি করেছে তাদেরকে দলে দলে জাহান্নমের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, এমনি যখন তারা জাহান্নামের নিকট উপস্থিত হবে তখন এর দরজা গুলি খুলে দেয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের নিকট কি তোমাদের মধ্য হতে কোন রসূল আসে নাই যারা তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের আয়াত পড়ে শুনাতো, এই দিনের সাক্ষাত সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করত?’ তারা বলবে, ‘অবশ্যই এসেছিল।’ আসলে কাফিরদের প্রতি শাস্তির কথা বাস্তবায়িত হয়েছে।” (সুরা যুমারঃ৭১)

 

জাহান্নামের জ্বালানী হবে জাহান্নমের মানুষ আর পাথর। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “হে মুমিনরা ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার পরিজনকে আগুন থেকে রক্ষা কর, যার জ্বালানী হবে মানুষ এবং পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে দয়ামায়াহীন, কঠোর স্বভাব ফিরিশতাগণ, যারা অমান্য করে না, যা আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করেন।” (সুরা তাহরীমঃ৬)

আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে এর থেকে মুক্তি চাই। তিনি আমদের এবং আমাদের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করুন। (আমীন)

জাহান্নামের আগুনের জ্বালানী এর মধ্যেই থাকবে। জাহান্নামের মানুষ আর জাহান্নামের আগুন এক অপরকে পুড়াতে থাকবে।

এবার জাহান্নামের উত্তাপ। আমরা এ ব্যাপারে কী জানি ? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “  আর বাম দিকের দল, কত হতভাগ্য বাম দিকের দল ! তারা থাকবে অতি গরম বাতাস আর উত্তপ্ত পানিতে। কালো ধুঁয়ার ছায়ায়। যা ঠান্ডাও  না, আরামদায়কও না।” (সুরা ওয়াকি’য়াঃ৪১-৪৪)

 

তিনটি জিনিসের দ্বারা আমরা গরম থেকে ঠান্ডা হতে পারি বা আমরা তাপ থেকে বাঁচতে পারি। “বাতাস”, “পানি”, “ছায়া”। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই তিনটি জিনিসের বর্ণনা দিয়েছেন যা বিকল্প হিসেবে জাহান্নামিদের কাছে থাকবে ঠান্ডা হবার জন্য। “ফী সামুমীও ওয়া হামীম”- “সামুম” মানে হচ্ছে অত্যন্ত গরম আর শুকনা বাতাস। আরবে একটা বাতাস উত্তর দিক থেকে প্রবাহিত হয়। যা থাকে খুবই শুষ্ক আর যখন তা আরব মরূভুমির উপর প্রবাহিত হয় তা আরও গরম হয়ে যায়। একে “সামুম” বলা হয়। তো জাহান্নমিদের কাছে ঠান্ডা হওয়ার জন্য বাতাস হিসেবে থাকবে এই “সামুম” বাতাস যা খুব শুকনা আর গরম।

 

“হামীম” মানে পানি- কিন্তু ফুটন্ত পানি। এই পানিই তারা পাবে। “ওয়া যিল্লিম মিন ইয়াহমুম”- ছায়া। তারা ছায়া খুজতে থাকবে। আর তারা পাবে ঘন কালো ধুঁয়ার ছায়া। তারা যখন এর ছায়ায় আসবে, তাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইবে। সুতরাং জাহান্নামীরা  পানি আর ছায়া হিসেবে এগুলোই পাবে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “তুমি কি জান ‘সাকার’ কী ? যা তাদেরকে ফেলেও রাখবে না আবার রেহাইও দিবে না।  বরং তা মানুষের গায়ের চামড়া জ্বালিয়ে দিবে।” (সুরা মুদ্দাসসিরঃ ২৭-২৯)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আদম সন্তান যে আগুন ব্যাবহার করে তা জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের এক ভাগ।” এটি মুসলিম শরিফের হাদীস। সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুম বলেন, “আল্লাহর কসম ! এমনকি দুনিয়ার সাধারণ আগুনও যথেষ্ট হত।” মানে যদি দুনিয়ার আগুন দিয়ে শাস্তি দেয়া হত তবে তাই যথেষ্ট ছিল। চিন্তা করে দেখুন দুনিয়ার সব থেকে বেশী তাপমাত্রা থেকেও তা সত্তর গুন বেশী শক্তিশালী। আর এটাই জাহান্নমের উত্তাপ।

 

সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ যা জাহান্নামীদের জন্য আছে তা হল, আল্লাহ কুরআনে বলেন যে তাদেরকে বলা হবে , “অতএব তোমরা আযাব উপভোগ করতে থাকো, (আজ) আমি তোমাদের উপর শাস্তির মাত্রা ছাড়া কিছুই বৃদ্ধি করব না। ”  (সুরা নাবাঃ ৩০)

জাহান্নামীরা গিয়ে আল্লাহর কাছে তাদের অবস্থার কথা জানাবে। আর তার উত্তরে তাদেরকে বলা হবে যে, প্রতিদিন তাদের শাস্তি হবে আগের দিন গুলো থেকে বেশী। অর্থাৎ এর সাথে অভ্যস্ত হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। কারন অবস্থা উন্নত হচ্ছে না। বরং তা দিন দিন খারাপের দিকে যাবে। এর সময়কাল আসীম। চিরকাল এমনটি হতে থাকবে।

 

আমি মনে করি এই একটি আয়াতই আমদের ভয় দেখানোর জন্য যথেষ্ট। যাতে আমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের শাস্তির সম্মুখীন হবার ঝুকি না নিই। কারণ তা কমবে না। বরং বাড়বে।

রাসুল্লুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, জাহান্নাম দেখতে এবং শুনতে পায়। আর কুরআন থেকেও আমরা জানি যে জাহান্নাম শ্বাস নেয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “’যখন দূর থেকে তা তাদেরকে দেখতে পাবে, তখন তারা তার গর্জন আর হুঙ্কার শুনতে পাবে।”  (সুরা ফুরকানঃ ১২) অর্থাৎ জাহান্নাম রাগে ফুঁসতে থাকবে।

 

এটি তিরমিযিতে আছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, 

“বিচারের দিনে জাহান্নাম থেকে আগুনের একটি স্তম্ভ বের হয়ে আসবে যার দুইটি চোখ আছে যা দেখে, 
দুইটি কান আছে যা শুনতে পায় আর আছে একটি জিহ্বা যা বলতে পারে। এবং সে বলবে আমি এমন প্রত্যেককে পাকড়াও করব যারা ‘জাব্বার’ মানে একরোখা বা যালিম, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে রব বানিয়েছে আর যারা মূর্তি তৈরী করত”- অর্থাৎ উপাসনার জন্য মূর্তি বানাত।

 

জাহান্নাম চিরকাল থাকবে। এমন কোন মুহূর্ত আসবে না যখন জাহান্নাম শেষ হয়ে যাবে। আত ত্বহাবী তাঁর আকিদার বইতে বলেন, “জান্নাত এবং জাহান্নাম চিরদিনই থাকবে। কোন সময় এমন আসবে না যে তারা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।” 

আর ইবনে হাযম বলেন, “আর এটাই এই উম্মাহর আলেমদের ঐক্যমত।”

জান্নাতে যারা থাকবে আর জাহান্নামে যারা থাকবে তাদের শরীরের আকৃতি আমাদের বর্তমানের আকৃতির মত থাকবে না। সেখানে মানুষের আকৃতি ব্যাপক পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি হাদীস আছে আর এটি ইমাম তিরমিযি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “জাহান্নামিদের চামড়ার পুরুত্ব হবে ৪২ ‘জিরা’।” 

এক ‘জিরা’ সমান প্রায় ১ মিটার বা তিন ফিট। মানে প্রায় এক গজ। অর্থাৎ তাদের চামড়া হবে প্রায় ১২৬ ফিট মোটা। কেন বিশেষ করে চামড়ার কথা বলা হল। কারণ চামড়ায় সব অনুভুতির স্নায়ু গুলো শেষ হয়। আর সেখানেই আসলে ব্যথা যন্ত্রণা অনুভব হয়। এটা গেল তাদের চামড়ার পুরুত্ব।

 

তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তাদের তিল বা আচিল হবে উহুদ পাহাড়ের সমান।” আর যারা উহুদ পাহাড় দেখেছেন তারা জানেন তা বিশাল। “তারা যখন বসবে তখন যেই পরিমাণ জায়গা দখল করবে তা হবে মক্কা থেকে মদীনা পর্যন্ত দূরত্বের সমান।” তো, কী কারণে তাদের আকার বড় করে দেয়া হবে? কেন? যাতে শাস্তি গ্রহনের জায়গা বৃদ্ধি পায়। যত বড় আকার হবে তত বেশী পরিমাণ জায়গা জাহান্নামের আগুনের সংস্পর্শে থাকবে। জান্নাতবাসীরা যদিও আকারে বৃদ্ধি পাবে কিন্তু তাদের মত এত বড় হবে না।

 

জাহান্নামের খাদ্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “খাবার হিসেবে কাটাবিশিষ্ট গাছ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না তাদের জন্য। এটি তাদের পুষ্ট করবে না, তেমনি তাদের ক্ষুধাও মিটবে না।” (সুরা গাশিয়াহঃ ৬-৭)

এটি কেমন খাবার আমরা নিশ্চিত জানি না। আল্লাহ এটিকে বলেছেন “দরী’ ”। এটি দেখতে কেমন? আল্লাহু আ’লাম। আল্লাহ্‌ই ভালো জানেন। কিন্তু আল্লাহ এও বলেছেন যে এটি মানুষের না ক্ষুধা দূর করবে আর না তাদের কোন পুষ্টি দিবে।

জাহান্নামীদের প্রধান খাদ্য হবে এক রকম গাছের ফল যার নাম “আয যাক্কুম”। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আল কোরআনে বলেন, “অবশ্যই (জাহান্নামে) যাক্কুম গাছ থাকবে। গুনাহগারদের খাদ্য।” (সুরা আদ দুখানঃ ৪৩-৪৪)

 

আর আল্লাহ কোরআনে যাক্কুম গাছ সম্পর্কে বলেন, “গলিত তামার মত তা পেটের ভিতর ফুটতে থাকবে। ফুটন্ত গরম পানির মত।” (সুরা আদ দুখানঃ ৪৫-৪৬)

তারা সেই ফল খাবে আর তা তাদের পেটে গলে যাওয়া উত্তপ্ত তামার মত ফুটতে থাকবে।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনের অন্য জায়গায় যাক্কুম গাছ সম্পর্কে বলেন, “এই মেহমানদারী ভালো নাকি যাক্কুম বৃক্ষের? যালেমদের জন্য আমি তা বিপদ স্বরূপ বানিয়ে রেখেছি। তা হচ্ছে এমন একটি গাছ যা জাহান্নামের তলদেশ থেকে বের হয়েছে। এর ফলগুলি এমন (বিশ্রী), মনে হবে তা যেন (একেকটা) শয়তানের মাথা। তারা এ থেকেই খাবে আর এ দিয়েই তাদের পেট ভরাবে। অতঃপর তাদেরকে ফুটন্ত পানি (আর পুঁজ) মিলিয়ে তাদের দেয়া হবে। তারপর নিঃসন্দেহে তাদের গন্তব্য হবে ভয়ঙ্কর আগুনের দিকে।” (সুরা আস সাফফাতঃ ৬২-৬৮)

 

“যাক্কুম” গাছের মূল উৎপন্ন হয়েছে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। যেখানে মুনাফিকরা থাকবে। আর আমরা জেনেছি জাহান্নামের যত নিচে যাওয়া হবে তত বেশী তা ভয়াবহ হতে থাকবে। জাহান্নামীরা এই গাছের ফল খাবে। তারা যত খাবে তত বেশী তারা ক্ষুধা অনুভব করবে, তত বেশী তারা পিপাসা অনুভব করবে। তারা যখন পিপাসা মেটাতে যাবে তখন তাদেরকে দেয়া হবে ফুটন্ত গরম পানির মিশ্রণ।

আল্লাহ আরও বলেন, “অতঃপর হে পথভ্রষ্ট মিথ্যা প্রতিপন্নকারী ব্যক্তিরা” (সুরা ওয়াকি’য়াঃ৫১)

এখানে আল্লাহ বিশেষ ভাবে তাদের কে সম্বোধন করে বলছেন যারা সত্যকে জেনেশুনে মিথ্যা বানাত। আল্লাহ পরে বলছেন, “তোমরা ভক্ষন করবে যাক্কুম গাছের অংশ। অতঃপর তা দিয়েই তোমরা পেট ভরাবে। তার উপর পান করবে (জাহান্নামের) ফুটন্ত পানি। তাও আবার রোগাক্রান্ত পিপাসারত উটের মত। আর এই হবে তাদের বিচার দিনের আপ্যায়ন।” (সুরা ওয়াকি’য়াঃ৫২-৫৬)

উটের একরকম রোগ হয়। তখন তারা পানি পান করতেই থাকে, করতেই থাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা মারা যায়। এরা পিপাসা অনুভব করে। আর তাই তারা পানি পান করতেই থাকে। কিন্তু তাদের এই পিপাসা আর ফুরায় না। এজন্য যতক্ষন তারা মারা না যায় তারা পানি পান করতেই থাকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন যে জাহান্নামিরা এই রকম রোগে আক্রান্ত উটের মত পানি পান করতে থাকবে। কিন্তু তারা স্বাভাবিক পানি পান করবে না। তারা পান করবে ফুটন্ত পানি। সেই সাথে তাদের পিপাসা বাড়তেই থাকবে। তাদের আরও কী পানীয় থাকবে সে ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “এ হচ্ছে (তাদের পরিণাম), অতএব তারা তা আস্বাদন করুক, (আস্বাদন করুক) ফুটন্ত পানি ও পুঁজ। এ ধরনের আরও (বীভৎস) শাস্তি।”(সুরা সোয়াদঃ ৫৭-৫৮)

এই আয়তে “হামীম” এবং “গাস্সাক” সম্পর্কে বলা হয়েছে। “হামীম” এর অনুবাদ করা হয় ফুটন্ত গরম পানি। আর “গাসসাক” এর অনুবাদ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আলী করেছেন – ঘন, কালো, পচা দুর্গন্ধ যুক্ত, অত্যন্ত ঠান্ডা এক প্রকার তরল পদার্থ। আর আল কুরতুবী রহীমাহুল্লাহ বলেন “গাসসাক” হল পুঁজ। ইমাম কুরতুবি আরও বলেন যে, এই পুঁজ হল জাহান্নামীদের মাংস পোড়া রস। জাহান্নামী দের মাংস আর চর্বি পুড়ে যে রস বের হবে তা আর তাদের ঘাম সংগ্রহ করা হবে। আর তাই তাদেরকে পান করার জন্য দেয়া হবে। এটাই হল “গাসসাক”।

 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “ যখন তারা পানীয় চাইবে, তাদেরকে গলিত সীসার মত জল দেয়া হবে যা তাদের মুখমন্ডল জ্বালিয়ে দিবে, এ এক নিকৃষ্ট পানীয়।” (সুরা কাহফঃ ২৯)

জাহান্নামীদের বিভিন্ন প্রকার পানীয় সম্পর্কে আমরা কোরআন থেকে যা জানি সেগুলো মোট চার প্রকার। 
(১) হামীম, যা হচ্ছে ফুটন্ত পানি 
(২) গাসসাক, এগুলো হচ্ছে শারীরিক বর্জ্য পদার্থ  
(৩) সাদীদ, আস সাদীদ হচ্ছে পুঁজ যা মানুষের ক্ষতস্থান থেকে বের হয়। মুসলিম শরিফের একটি হাদীস রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “ সকল প্রকার নেশার দ্রব্য হারাম। যারা দুনিয়াতে নেশার দ্রব্য গ্রহণ করবে, জাহান্নামে তারা পান করবে ‘তীনাত আল খাবাল’। সাহাবারা ‘তীনাত আল খাবাল’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন এটি হল জাহান্নামীদের রক্ত আর পুঁজ” ; আর সবশেষে 
(৪) আল মুহল ( মানে ফুটন্ত তেল। ‘হামীম’ হল ফুটন্ত পানি আর ‘মুহল’ হল ফুটন্ত তেল। 

একটি হাদীস, এটি আত তিরমিযির বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “এই পানীয় যা জাহান্নামীরা পান করবে, যখন তারা তা তাদের মুখের কাছে নিয়ে আসবে, তাদের মুখের মাংস গলে পড়তে থাকবে। তার পড়েও তারা তা পান করবে।” এত যন্ত্রণা সত্ত্বেও তারা তা পান করবে। এর থেকে বুঝা যায় যে কি পরিমাণ পিপাসা তারা জাহান্নামে অনুভব করবে। তারা এই ফুটন্ত পানি আর ফুটন্ত তেল পান করতে বাধ্য হবে।

 

জাহান্নামবাসীদের পোশাক সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কোরআনে বলেন, “অতঃপর এদের মধ্যে যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে তাদের জন্যে আগুনের পোশাক কেটে রাখা হয়েছে; শুধু তাই নয়, তাদের মাথার উপর সেদিন প্রচণ্ড গরম পানি ঢেলে দেয়া হবে।” (সুরা হাজ্জঃ ১৯)

তার মানে দাড়ালো তাদের পোশাক হবে আগুনের তৈরী। কোরানের অন্য আয়াতে বলা হয়েছে তাদের পোশাক হবে গলিত তামা। বিষয়টা ভেবে দেখুন উত্তপ্ত গলিত তামা সবসময় তাদের শরীরের সাথে কাপড় হিসেবে লেগে থাকবে।


জাহান্নামে বাসকারীদের শাস্তি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় হবে। কারও কম কারো বেশি।

সর্বনিম্ন শাস্তি পাবে যে ব্যক্তি তার সম্পর্কে সহিহ বুখারীতে বর্ণীত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে জিজ্ঞাসা করবেন ,একজন কাফেরকে সামনে আনা হবে, এবং তাকে আল্লাহ প্রশ্ন করবেন ‘তোমার কাছে যদি গোটা দুনিয়া পূর্ণ করে ফেলার মত স্বর্ণ থাকে তুমি কি তা নিজেকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মুক্তিপণ হিসাবে দেবে?’ সে উত্তর দেবে,’হ্যা।’ আল্লাহ্‌ তখন জবাব দিবেন, ‘আমি তো তোমার কাছে এর অনেক কম চেয়েছিলাম।’ 

আখিরাতে জান্নাতের বিনিময়ে আল্লাহ্‌ আমাদের কাছে এই পৃথিবীতে তো খুব বেশি কিছু চান না। আল্লাহ আমাদেরকে সারা দুনিয়া পরিমাণ স্বর্ণ প্রদান করতে বলেননি, তিনি আমাদের কাছে সামান্য কিছু বিষয় চেয়েছেন, কিন্তু আজকে সেগুলো আমাদের কাছে অনেক বেশি আর কঠিন বলে মনে হয়, অথচ সুবহানাল্লাহ, সেদিন যখন মানুষ নিজের চোখে জাহান্নামের ভয়াবহতা দেখবে সেদিন তার কাছে সারা দুনিয়া ভর স্বর্ণও সামান্য মনে হবে এবং সে নির্দ্বিধায় তা দিয়ে দিতে চাইবে। 

কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমদের কাছে এত কিছু চাননি, সামান্য কিছু বিষয়, আমাদের করণীয়-বর্জনীয়, এগুলো মেনে চলা। ব্যস এতটুকুই, কিন্তু বহু মানুষ আজকে নিজেদের দীনকে বিক্রি করে দিয়েছে , সারা দুনিয়া ভর স্বর্ণের বিনিময়ে নয়, সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে, কত শত মানুষ সালাতের ব্যাপারে উদাসীন সামান্য কিছু টাকা উপার্জনের জন্য, 
সালাতের সময় চলে যাচ্ছে অথচ তারা টাকা উপার্জনের পিছনে ছুটছে, এমনকি ইস্লামের বিষয়ে চিন্তা ভাবনাও নেই তাদের অন্তরে, 
শুধুমাত্র দুনিয়ার কারণে।

 

সত্যি বলতে কি আমরা সারাজীবন খেটেখুটে যা উপার্জন করি সেই সম্পদ কিংবা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটির সম্পদও আখিরাতে কোনো কাজে আসবে না। আল্লাহ্‌ সেদিন বলবেন,’ আমি তো শুধ চেয়েছিলাম তোমরা আমাকে ইলাহ বলে মেনে নাও। তোমরা তা নাও নি।’

এই ব্যক্তিটির শাস্তি কি হবে এই সম্পর্কে সহিহ বুখারির বর্ণনা অনুসারে, রাসূল(সঃ) বলেছেন, জাহান্নামে সবচেয়ে ছোট শাস্তি পাবে যে ব্যক্তিটি, তার পায়ের তলায় জ্বলন্ত কয়লা রাখা হবে যার ফলে তার মস্তিষ্ক ফুটতে থাকবে। এটাই জাহান্নামের সর্বনিম্ন শাস্তি। এছাড়া সহিহ বুখারি হতে বর্ণীত আছে, রসুলুল্লাহ(সঃ) একবার কিছু সাহাবীর সাথে অবস্থান (আবু তালিব) কথা উঠলো। তখন তিনি বললেন, হয়তো আমার আবেদনের কারণে তাকে আগুনের একটা অগভীর চৌবাচ্চায় রাখা হবে যার আগুন শুধু তাঁর পায়ের গোড়ালি স্পর্শ করবে, যার ফলে তার মস্তিষ্ক ফুটতে থাকবে

 

আর জাহান্নামীদের সর্বোচ্চ শাস্তি কি হবে এই সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই মুনাফিকদের স্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। আমরা বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জাহান্নামের বিভিন্ন শাস্তিগুলোর কথা জানতে পারি। আল্লাহ বলেন, যারা আমার সতর্কতাসমূহ অস্বীকার করবে, আমি তাদেরকে খুব শীঘ্রই আগুনে নিক্ষেপ করবো। যখনই তাদের চামড়া ঝলসে যাবে, এর পরিবর্তে পুনরায় নতুনভাবে চামড়া তৈরি হয়ে যাবে, যেন তারা তাদের অপরাধের শাস্তি ভোগ এই আয়াতে একটি বৈজ্ঞানিক সত্য লক্ষ্য করা যায়। আমরা জানি যে, মাংসপেশি বা চর্বিস্তরের তুলনায় ত্বকে স্নায়ুকোষের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। একারণেই চামড়া হচ্ছে ব্যথার অনুভূতি সৃষ্টির সবচেয়ে বড় অঙ্গ। এজন্য একটা সুঁই চামড়া ভেদ করলে যে ব্যথা অনুভূত হয়, মাংসপেশি ভেদ করার সময় আর তত ব্যথা হয় না। একারণে যখনই চামড়া ঝলসে যাবে, স্নায়ুকোষগুলি পুড়ে যাবে, আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে সাথে নতুন চামড়া দান করবেন।/

আরেকটি শাস্তি হচ্ছে গলিত হওয়া। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, কিন্তু যারা তাদের সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করে, তাদের জন্য থাকবে আগুন দ্বারা তৈরি বস্ত্র এবং তাদের মাথার ওপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেওয়া হবে। এর সাথে তাদের চামড়াসহ শরীরে যা কিছু আছে তা গলে মিশে যাবে। এরপর আছে মুখমণ্ডলের শাস্তি। মুখমণ্ডল মানবদেহের সবচেয়ে সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এ কারণে রাসুলুল্লাহ(স) মুখমন্ডলে আঘাত করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন, আগুনে তাদের(জাহান্নামীদের) মুখমণ্ডল পুড়ে ঝলসে যাবে, ঠোঁট বিকৃত হয়ে যাবে এবং দাঁতগুলি বেরিয়ে আসবে। এগুলো ছাড়াঅন্য একরকম শাস্তির উল্লেখ আছে, তা হল ছেঁচড়িয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া। এটা তাদু ওয়া তায়ালা যার যা কৃতকর্ম, সেই অনুযায়ী প্রতিদান দিবেন। তিনি সুবিবেচক ও ন্যায়বিচারক। তিনি বলেন, যারা শয়তানকে অনুসরণ করেছে, তাদের শয়তানের মতই প্রতিফল দেওয়া হবে। লজ্জা,অপমান তাদের মুখে ছেয়ে যাবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন সাহায্য তাদের জন্য থাকবে না। তাদের মুখমণ্ডলগুলি এমন হবে যেন তা রাতের গভীরতম অন্ধকার দ্বারা আচ্ছন্ন। তারাই হল আগুনের অধিবাসী, তারা সেখানে অনন্তকাল ধরে বাস করবে। চিন্তা করে দেখুন, অনন্তকাল এরকম শাস্তি পেতে থাকা, কোন অল্প সময় না, লক্ষ কোটি বছর ধরে সামনে, পিছে, উপর-নিচ সব দিক দিয়ে প্রচণ্ড শাস্তি, কতটা ভয়াবহ হতে পারে! আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, আগুন তাদের ঘিরে ধরবে। তারা যেদিক যাবে, আগুন তাদের ওপর ছেয়ে যাবে। আর তারপর তাদের চামড়া পুড়ে ঝলসে শেষ হয়ে যাবে না। এর কারণ তাদের নিজেদেরই কৃতকর্ম। আল্লাহ বলেন, যারা মন্দের মাঝে সমৃদ্ধির অন্বেষণ করে এবং নিজেদের পাপকাজের দ্বারা আবৃত করে রাখে, তারাই আগুনের অধিবাসী, তারা সেখানে চিরকাল বসবাস করবে।। তারা নিজেদের পাপকর্ম দ্বারা ঘিরে রেখেছিল, আল্লাহ তাদের আগুন দ্বারা ঘিরে রাখবে। যেমন তাদের কর্ম তেমন তার ফল। এবং আল্লাহ বলেন, এবং আগুন তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করবে– আল্লাহই ভালো জানেন এর দ্বারা শারীরিক না মানসিক কষ্টের কথা বোঝানো হচ্ছে। কক্ষনো না, তাকে অবশ্যই নিক্ষেপ করা হবে যা খণ্ডবিখন্ড হয়ে ভেঙ্গে পড়ে(হুতামাহ্‌), তার মধ্যে। আর কি দিয়ে (তোমাকে) বোঝানো যাবে এই হুতামাহ্‌ কি? এটা আল্লাহর (দ্বারা সৃষ্ট) আগুন। যা প্রজ্জ্বলিত হয় হৃদয় ভেদ করে।

 

এরপর আছে বৃহদান্ত্র দ্বারা টানা, যে শাস্তিটা দেওয়া হবে যারা অন্যকে ভালো কাজের নির্দেশ দেয়, মন্দকাজ থেকে দূরে থাকতে বলে, কিন্তু নিজেই তা করে না। উসামা(রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূলকে বলতে শুনেছি, একজন মানুষকে  জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে এবং তাকে বৃত্তাকার পথে ঘুরানো হবে ঠিক একটি আটার কলের গাধার মত তার বৃহদান্ত্রকে মাঝে রেখে এবং লোকটি যন্ত্রণায় চিৎকার করবে। এতে জাহান্নামের অধিবাসীরা বলবে, তুমি তো আমাদের ক্ষতি? তুমি কী অপরাধে এখানে এসেছ?  করেছো। তারপর তারা জিজ্ঞাসা করবে, তুমি কি সেই ব্যক্তিটি না যে আমাদের সৎকাজ করতে বলতো আর মন্দকাজ থেকে বিরত থাকতে বলতো, তখন সে জবাব দিবে, আমি সৎকাজ করতে বলতাম কিন্তু নিজে কখনো সেটা করতাম না এবং অন্যকে মন্দকাজ থেকে দূরে থাকতে বলতাম কিন্তু নিজে সবসময় মন্দকাজে ডুবে থাকতাম।(সহিহ বুখারী)

 

পুরাতন আমলে একরকম কল ছিল যাতে একটির ওপর একটি বড় পাথরের মাঝে গম রাখা হত। গাধা দিয়ে উপরের পাথরটা বৃত্তাকারে ঘুরানো হতো আর তাতে করে আটা তৈরি হতো। যে লোক অন্যকে সৎপথে ডাকবে, পাপকাজ থেকে দূরে থাকতে বলবে অথচ নিজেই তা করবে না, তাকে তার শাস্তিস্বরূপ এরকম আটার কলকে নিজ অন্ত্র দ্বারা টানতে হবে। এটাই তার দ্বিমুখীতার পরিণাম। যা প্রচার করা তা নিজে না মেনে চলার ফল। এবং শুধু তাই না, তাদের শেকল দিয়ে টানা হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, তাদেরকে শেকল দ্বারা বাঁধা হবে, তাদের বাহুগুলি তাদের ঘাড়ের সাথে বাঁধা থাকবে। এরপর শেকল টানা হবে এবং শেকলের সাথে তাদেরকেও টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। এছাড়াও আল্লাহ বলেন, জাহান্নামের অধিবাসীরা এর দেওয়াল টপকে পালাতে চেষ্টা করবে। এর রক্ষীরা তখন তাদের লোহার তৈরি হাতুড়ি দ্বারা আঘাত করে ফেলে দিতে থাকবে, এবং তাদের শিকল দিয়ে বেঁধে নামিয়ে আনা হবে। আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন, দুনিয়ায় সুখেশান্তিতে থাকার পর শেষ বিচারের দিনে তার কষ্ট-অনুতাপগুলি ফুটে উঠবে। যখনই তারা তাদের শাস্তিসমূহ প্রত্যক্ষ করবে, তখনই তাদের আক্ষেপ প্রকাশ পাবে। কারণ তাদের কথা শোনার মত তখন কেউ থাকবে না। তারা আল্লাহর নবীদের দ্বীনের দাওয়াতকে অবজ্ঞা করেছিল, আল্লাহ সেই দিন তাদের অবজ্ঞা করবে। আল্লাহ বলেছেন, সেই দিন তোমাদের সেভাবে উপেক্ষা করা হবে যেমনভাবে তোমরা এই দিনকে উপেক্ষা করেছিলে। তারা যেহেতু তাদের ওপর প্রেরিত দ্বীনকে অস্বীকার করেছিল, আল্লাহও তেমন তাদের অনুনয়-অনুতাপকে অস্বীকার করবেন, যার ফলে জাহান্নামীদের অন্তর প্রচণ্ড আক্ষেপবোধে জর্জরিত হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, যখন তাদের একসাথে বেঁধে বদ্ধ স্থানটিতে ফেলে দেওয়া হবে, তারা তাঁদেরকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য যতই অনুনয় করুক না কেন, তাদের কথা শোনা হবে না। তারা আল্লাহ তায়ালাকে তাদেরকে ধ্বংস করে দিতে বলবে, এজন্য বারবার অনুরোধ করবে, কিন্তু আল্লাহ তাদের কথা শুনবেন না, যতই তারা এজন্য হা-হুতাশ করুক না কেন। আল্লাহ বলেন, তারা সেখানে উচ্চস্বরে কাঁদবে এই বলে যে, হে আমাদের প্রভু, আমাদের এখান থেকে বের করে আনো। আল্লাহ বলবেন, ওখানেই থাকো, এখান থেকে (তোমরা) বের হতে পারবে না। আরেক আয়াতে উল্লেখ আছে, তারা(জাহান্নামীরা) বলবে, হে আমাদের প্রভু, আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের আচ্ছন্ন করেছিল এবং আমরা পথভ্রষ্ট হয়েছিলাম। আমাদের প্রভু, আমাদের এখান থেকে মুক্তি দাও, নিশ্চয়ই আমরা যদি অসৎপথে ফিরে যাই, আমরা ভ্রান্তিতে পতিত হবো।

 

তারা আল্লাহর সাথে যাদের শরীক করতো তাদের কি পরিণতি হবে এই সম্পর্কে আরেক আয়াতে আছে, নিশ্চয়ই তোমরা (মুশরিকগণ) ও তোমাদের মিথ্যা দেবতারা যাদের তোমরা আরাধনা করতে, তারা জাহান্নামের জ্বালানী ছাড়া আর কিছুই না, এবং এতেই তোমাদের শেষ পরিণতি ঘটবে। শেষ বিচারের দিনে যারা মূর্তিপূজা করতো তাদের বলা হবে তাদের আরাধ্য মূর্তিগুলোর কাছে সাহায্য চাইতে। এটাই আল্লাহর ন্যায়বিচার। সে যে মূর্তির পূজা করতো, তাকে সেই মূর্তির কাছে এর পুরস্কার চাইতে বলা হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করেনি, তাকে আল্লাহ কোনরকম সাহায্যও করবেন না। আল্লাহ তাদের বলবেন তাদের উপাস্য মূর্তিগুলোকে অনুসরণ করতে। অতঃপর সেই মূর্তিগুলোকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে এবং তারা(মুশরিকগণ) মূর্তিগুলোকে অনুসরণ করে আগুনে পতিত হবে। সূর্যকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং সূর্য-উপাসকরাও সেখানে পতিত হবে। এখন যদি প্রশ্ন আসে যে যীশুখ্রিষ্টের, অর্থাৎ ঈসা(আঃ) এর অনুসারীদের কি পরিণতি হবে, তাহলে এটা বলা দরকার যে ঈসা(আঃ) কখনো চাননি তাকে উপাসনা করা হোক। একজন সম্মানিত রাসূল হিসেবে ঈসা(আঃ) স্থান হবে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরে। এজন্য ক্রুশকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং তাঁর অনুসারীদের বলা হবে, হে ক্রুশের অনুসারীগণ, ক্রুশকে অনুসরণ করো। অতঃপর তারা সেটাকে অনুসরণ করে জাহান্নামে পতিত হবে। একই পরিণতি আল্লাহ ব্যতিত অন্য সকল দেবতা বা উপাস্যের ক্ষেত্রেও ঘটবে। আমি যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মেনে থাকি, আমাকে তাঁর কাছেই এর প্রতিদান নিতে হবে। একারণেই আল্লাহর সাথে অন্য কারো শরীক করা অর্থাৎ শিরক করা সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আল্লাহ মুশরিকদের বলবেন, তুমি আমার উপাসনা করনি, তাই যার উপাসনা করেছিলে, তার কাছে এর প্রতিদান চেয়ে নাও।