কল্পনা করুন, আপনি আপনার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে জান্নাতের বিভিন্ন যায়গা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। ইতোমধ্যে আমরা অনেক জায়গার বর্ণনা দিয়েছি এবং এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, যা কিছু আপনি দেখছেন সব আপনার সম্পত্তি, আপনি এখানে বেড়াতে আসেননি বরং এ সব সম্পত্তি কিন্তু আপনার নিজের। এখন পর্যন্ত আপনি আপনার প্রাসাদ, নদী, ঝরনা প্রভৃতি দেখেছেন। এতক্ষণ আপনি অনেককিছু দেখলেও হয়তো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেননি। আর এখন যেহেতু আপনি সেখানে চিরস্থায়ী আবাস স্থাপন করতে চলেছেন সেহেতু এর খুঁটিনাটি আপনার চোখে পড়ছে। সেখানকার আসবাবপত্র, বিভিন্ন সরঞ্জামাদি এমনকি গাছের পাতাগুলির প্রতি এখন আপনি মনোযোগ দিচ্ছেন। সবকিছুই যে একদম নতুন, সবকিছুর মাঝেই যেন আনন্দের উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঠিক যেন সদ্য জন্মলাভ করা একটি শিশুর মত যে কিনা তার চারপাশের সবকিছুর প্রতি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থাকে, সবকিছুর মাঝে সে আকর্ষণ খুঁজে পায়।
হয়তো আপনি আপনার স্ত্রীর সাথে গদির বিছানায় বসে আছেন, ইতোমধ্যেই বালিশের কাপড় ও অন্যান্য বস্তু নেড়েচেড়ে দেখে ফেলেছেন, এখন অন্যান্য সবকিছুর ওপর আপনার চোখ গিয়ে পড়ছে। আপনাকে পানীয় পরিবেশন করা হয়েছে, এখন আপনি যে পাত্রে পানীয় দেওয়া হয়েছে সেটা পর্যবেক্ষণ করছেন। আর আপনি অবাক হয়ে খেয়াল করলেন পাত্রটি সম্পূর্ণ সোনার তৈরি! খাঁটি সোনা, এমন কিছু যেটার সাথে তুলনীয় কিছু আপনি দুনিয়াতে কখনও দেখেননি; যেন এটার দিয়ে তাকিয়ে থাকতে পারাই একটা সৌভাগ্য। পরদিন আপনাকে যে পানীয় দেওয়া হল তার পাত্রটি আবার ভিন্ন রকম, আজকের পাত্রটি সম্পূর্ণ রূপার তৈরি! তাও আবার এমন রূপা যে এটি যে রূপা এ নিয়ে আপনার কোন সন্দেহ নাই, যেন আপনি জানেন এটা রূপা, কিন্তু এটি স্বচ্ছ একরকম রূপা; পাত্রের এদিক থেকে ওদিক দেখতে পাচ্ছেন আপনি। কিভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে আল্লাহ্ই ভালো জানেন। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলছেন, “তাদেরকে পরিবেশন করা হবে রূপার পাত্রে এবং স্ফটিকের মত পানপাত্রে। রূপালী স্ফটিক পাত্রে, পরিবেশনকারীরা তা পরিমাপ করে পূর্ণ করবে। ” (৭৬-১৫)
সুতরাং পাত্রটি রূপার তৈরি হলেও একদম স্বচ্ছ, যা দেখে আপনি বিস্মিত হচ্ছেন, আপনার স্ত্রীর কাছে আপনার মুগ্ধতা প্রকাশ করছেন। এ দেখে আপনার এক খাদেম আপনাকে বলল এর চেয়েও মনোমুগ্ধকর বস্তু আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। এরপর তাঁরা আপনাদেরকে নিয়ে গেল দুটি বিশেষ বাগানে যা কিনা আপনাদেরই সম্পত্তি। বিশাল দুটি বাগান, যার একটিতে সবকিছু স্বর্ণের ও অপরটির সবকিছু রূপার তৈরি। যেমন আপনি রূপার বাগানটিতে গিয়ে দেখলেন এর গাছপালা, গাছের পাতা, সাজানো টেবিল-চেয়ার, থালা-বাসন, চামচ, সংলগ্ন প্রাসাদ সবকিছুই খাঁটি রূপার! একইভাবে অন্য বাগানটিতে গিয়ে আপনি দেখলেন সবকিছু খাঁটি সোনার তৈরি। তখন হয়তো আপনার স্ত্রীর সাথে এগুলি নিয়ে কথা হচ্ছে, সে বলছে যে সোনার বাগানটি তার নিজের জন্য থাক, আপনি রূপারটা নিজের জন্য নিন (যেহেতু পুরুষের জন্য স্বর্ণ হারাম)। কিন্তু এ সময় সেখানকার রক্ষী আপনাদের জানালো সবকিছুই সবার জন্য গ্রহণযোগ্য ও হালাল এবং শুধু তাই না, যেকোনো আনন্দ, উত্তেজনা ও উপভোগের বস্তু যা দেখবেন বা চাইবেন তার সবকিছুই আপনারা পাবেন ও যতখানি চেয়েছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি পাবেন। এটা শুধু শারীরিক সুখ বা মানসিক শান্তি না বরং দুটির এক অপূর্ব সমন্বয় যা শুধু জান্নাতেই লাভ করা সম্ভব। সহিহ বুখারিতে বর্ণীত হাদিসে রসুলুল্লাহ(সঃ) বলছেন, “আর সেখানে দুটি উদ্যান থাকবে। এদুটির সকল পাত্র এবং অভ্যন্তরের সকল জিনিস রৌপ্য নির্মিত হবে। আরও দুটি উদ্যান থাকবে। এ দুটির সকল পাত্র এবং সমুদয় জিনিস সোনার তৈরি হবে। জান্নাতী লোকেরা আদন জান্নাতে তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাত লাভ করবে। এ জান্নাত এবং আল্লাহর এ দীদারের মাঝখানে পরোয়ারদিগারের প্রবল প্রতাপ ও গৌরবের চাদর ভিন্ন আর কোন আড়াল থাকবে না।
জান্নাতের মানুষদের আনন্দময় জীবনের একটি অংশ বলা যেতে পারে তাদের সামাজিক জীবন। অর্থাৎ সেখানে আপনি যে শুধু আপনার স্ত্রীর সাথে বাস করছেন, তার সাথে বিভিন্ন যায়গা ঘুরে দেখছেন যতক্ষণ না দেখতে দেখতে ক্লান্তি চলে আসে তা না বরং সেখানে খুবই প্রাণচঞ্চল একটি সামাজিক জীবন বিদ্যমান। জান্নাতের বাসিন্দারা একে অপরের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করে, কথাবার্তা বলে, একসাথে অনেক সময় কাটায় এমনকি জান্নাতে আপনার আশেপাশে কারা বসবাস করবে জান্নাতে গিয়ে আপনি চাইলে তাদের সবার পরিচয়ও জেনে নিতে ও তাদের সাথে দেখা করে আসতে পারবেন। কোনোকিছুতেই কোন বাধা থাকবে না। আপনি চাইলে রসুলুল্লাহ মুহাম্মদ(সঃ) এর সাথে দেখা করতে বা তার সাথে একবছর সময় কাটিয়ে আসতে পারবেন, কে তাতে আপনাকে বাধা দিবে? কেউ না। একসাথে তাঁর সাথে যেকোনো বিষয়ে আলোচনা করতে পারবেন, যেকোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন। যেমন ধরুন সীরাতে যদি আপনি একই বিষয়ে দুটি ভিন্ন বর্ণনা পেয়ে থাকেন এবং কোন বর্ণনাটি সঠিক তা জেনে নিতে চান, আপনি তা করতে পারবেন। তাঁর সাথে যত খুশি সময় কাটিয়ে আসতে পারবেন। আপনি যেহেতু তাঁরই উম্মাহর, তিনি কেন আপনাকে সময় দিবেন না? আপনি যদি মূসা(আঃ) এর সাথে সময় কাটাতে চান, তাঁর সময় দুনিয়া কেমন ছিল জানতে চান, তা করতে পারবেন। যদি চান আদম(আঃ) এর সাথে দেখা করতে, তাকে জিজ্ঞাসা করতে যে আপনি যখন প্রথম মানুষ হিসেবে দুনিয়াতে আসেন তখন কিভাবে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন, কিভাবে ধীরে ধীরে মানব সভ্যতা গড়ে তুললেন, তখন পৃথিবী কেমন ছিল, তখন কি ডাইনোসরদের দেখা যেত ইত্যাদি; আপনি সেগুলিও জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারবেন। [ আমরা এখন জুরাসিক পার্ক বা অন্যান্য ডাইনোসরের মুভি দেখে কৌতূহলবশত প্রশ্ন করে থাকি যেমন ইসলাম এগুলির ব্যাপারে কি বলে ইত্যাদি। প্রাচীন সময়ের মুসলিমদের এসব বিষয়ে প্রশ্ন করে দেখতে পারি যে তাঁরা পৃথিবীতে এসে ডাইনোসর দেখেছিল কি না, কিংবা তাদের কোন ফসিল বা ধ্বংসাবশেষ অবশিষ্ট ছিল কি না, সবই আমরা জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে পারবো। এছাড়া যেহেতু সময়ের কোন বাধ্যবাধকতা নাই, সেহেতু যেকোনো কিছুর জন্যই চাইলে আমরা যত ইচ্ছা সময় বার করে নিতে পারবো। যেকোনো মানুষের সাথে দেখা করা, কথাবার্তা বলার জন্য যতখানি সময় আমরা চাই, তা নিতে পারবো। ]
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জান্নাতে আমাদের মাঝে সংঘটিত হবে এরকম কিছু কথোপকথন সম্বন্ধে কুরআনে বর্ণনা করেছেন। যেমন উদাহরণ হিসেবে এই আয়াতটি, এবং এটি মনে রাখার জন্য একটি বিশেষ বিষয়; আল্লাহ্ তায়ালা বলছেন, “এবং আমরা তাদের অন্তরে ওঁত পেতে থাকা সমস্ত কষ্টের অনুভূতি দূর করে দিবো। তাঁরা হয়ে যাবে (একে অপরের) ভাই, একে অপরের দিকে আনন্দের সাথে মুখোমুখি হয়ে মর্যাদার আসনে বসে।” (১৫-৪৭) ইবন কাসীর- আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যে কারণে আমরা একে অপরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার মাঝে এত সুখের উপকরণ খুঁজে পাবো কারণ আমাদের মাঝে অন্যের প্রতি কোনরকম ঘৃণা-বিদ্বেষ বা অপছন্দের মনোভাব কাজ করবে না। জান্নাতে সবাই সবাইকে ভালবাসবে। রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেন, “তাদের অন্তরসমূহ হবে একজন মানুষের অন্তরের মত।” দুনিয়ায় এক এক মানুষের চিন্তাধারা ও মন মানসিকতা একেক রকম, কাজেই মানুষে মানুষে মনের মিল না থাকায় বিভিন্ন বিষয়ে মন কষাকষি হয়ে থাকে, কিন্তু জান্নাতে তেমনটি হবে না বরং সবাই একইভাবে চিন্তা করবে, সবার অন্তর হবে একইরকম। যে কারণে যখনই কোন ভাই তার ভাই এর সাথে বা কোন বোন তার বোনের সাথে সাক্ষাৎ করবে সেটাই তাদের জন্য উৎফুল্লতার কারণ হবে, যদিও তখনও কথাবার্তাই শুরু হয়নি। কেন? কারণ দুনিয়াতে আমরা যেমন না চাইলেও মনে অনেক রকম অনুভূতি সৃষ্টি হয় যেগুলি অনেক সময় ভালো হয় না, যার কারণে মুসলিম হিসেবে মাঝে মাঝে নিজের মনের সাথেই আমাদের দ্বন্দ্ব করতে হয়, জান্নাতে এই ব্যাপারটা থাকবে না। দুনিয়াতে সামাজিক প্রাণী হিসেবে আমাদের মনের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা প্রভৃতির মূল প্রোথিত থাকে, মুসলিম হিসেবে এসবের বিরুদ্ধে আমাদের সর্বদা জিহাদে লিপ্ত থাকতে হয়, এর ভিত্তিতে একজন মুসলিমের ঈমানের দৃঢ়তা নির্ধারিত হয়। রসুলুল্লাহ(সঃ) এর ক্ষেত্রে আমরা জানি তিনি যখন শিশু ছিলেন তখন জিবরীল(আঃ) এবং অন্য একজন ফেরেশতা নেমে আসেন এবং তাঁর হৃৎপিণ্ড বার করে তার মধ্যে থেকে জমাটবদ্ধ কিছু রক্ত বার করে নেন এবং বলেন যে এটা তাঁর হৃদয়ে শয়তানের অংশ যা তাঁরা বার করে নিচ্ছেন যার ফলে তাঁর হৃদয়ের ওপর শয়তানের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এজন্য রসুলুল্লাহ (সঃ) এর অন্তর পবিত্র এবং তাঁর ওপর শয়তানের কোন প্রভাব নাই। আমাদের প্রত্যেকের সাথে একজন ‘কারীন’ আছে; কারীন অর্থ সঙ্গী। আমাদের প্রত্যেকের ওপর একজন শয়তান নিযুক্ত আছে। এই শয়তানের কাজ আমাদের বিপথগামী করা। আমরা যেখানেই যাই, আমাদের সাথে একজন শয়তান চলাফেরা করে যে আমাদের পথভ্রষ্ট করতে সবসময় সচেষ্ট থাকে। কিন্তু রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেছেন, “আমার কারীন মুসলিম হয়ে গিয়েছে।” যে কারণে রসুলুল্লাহ (সঃ) নিজ অন্তরের সাথে এই যুদ্ধ থেকে মুক্তিলাভ করেছেন। জান্নাতে আমরা এই বিপথগামী প্রবৃত্তির হাত থেকে মুক্তি পাবো। অনেকসময়ই আমরা জানি যে আমরা আমাদের ভাইদের ভালবাসি, কিন্তু মনের ভেতরে যেন কিছু একটা এই ভালোবাসাকে ভুল প্রমাণিত করতে চায়। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর এবং আমরা একে সবসময় দূর করার চেষ্টা করি। কিন্তু জান্নাতে এসব থাকবে না, আমরা সবাইকেই অন্তর থেকে ভালবাসবো। তাই সবার সাথে দেখামাত্রই মন খুশিতে ভরে উঠবে এবং কারো সাথে কথা বলে বিরক্তি বা একঘেয়েমিও ভর করবে না।
জাহান্নামীদের সাথে জান্নাতীদের কথোপকথনঃ জান্নাতবাসীরা পৃথিবীর অবিশ্বাসী সাথিদের অবস্থা দেখতে পাবে যারা জান্নাতে যাবে পৃথিবীতে তাদের এমন কিছু সহকর্মী, সাথি বন্ধু থাকবে যারা জাহান্নামে যাবে। কারণ, তারা পরকালে বিশ্বাস করতো না। জান্নাতে বসে পৃথিবীর সেই অবিশ্বাসী সঙ্গি-সাথিদের কথা মনে পড়ে যাবে। বলবে, আমার তো অমুক বন্ধু ছিল, কিন্তু সে পরকাল, জান্নাত ও জাহান্নামে বিশ্বাস করতো না। তার অবস্থা এখন কী? সে কোথায় আছে? তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার অবিশ্বাসী বন্ধুদের অবস্থা দর্শন করাবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন: “তখন তারা(জান্নাতীরা) একে অপরের দিকে ঘুরে তাকাবে ও প্রশ্ন করবে। তাদের মধ্যে একজন বক্তা বলবে, ‘আমার একজন সঙ্গী ছিল দুনিয়ায় যে (ব্যঙ্গাত্মকভাবে) বলতো, ‘তুমি কি আসলেই তাদের মাঝে একজন যারা বিশ্বাস স্থাপন করে?’ সে আরও বলতো, ‘আমরা যখন মারা যাবো এবং ধূলা ও হাড়গোড়ে পরিণত হবো, এরপর কি আমরা সত্যিই (কর্মফলস্বরূপ) পুরস্কার ও শাস্তি ভোগ করবো?’
আল্লাহ বলবেন, তোমরা কি উঁকি দিয়ে দেখবে? অতঃপর সে উঁকি দিয়ে দেখবে এবং তাকে (পৃথিবীর সঙ্গীকে) দেখবে জাহান্নামের মধ্যস্থলে। সে বলবে, আল্লাহর কসম! তুমি তো আমাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিলে! আমার রবের অনুগ্রহ না থাকলে আমিও তো (জাহান্নামে) হাযিরকৃতদের একজন হতাম। (সূরা সাফফাত, আয়াত ৫০- ৫৭)
এ আয়াতসমূহ থেকে আমরা শিখতে পারলাম, পৃথিবীর কর্মস্থল, পড়াশুনা, যাত্রাপথ ইত্যাদি সুত্রে যে সকল সঙ্গী-সাথি আছে তাদের মধ্যে যারা অবিশ্বাসী তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা উচিত। যেমন এ আয়াতে আমরা দেখি জান্নাতী লোকটি বলবে, তুমি তো আমাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিলে। হ্যা কুরআনের কথা সত্যি। এ সকল অবিশ্বাসী মানুষের সাথে চলাফেরা উঠা-বসা করলে তারা বিশ্বাসীদের আকীদা-বিশ্বাস নষ্ট করে ফেলে। কারণ, মানুষ তার বন্ধুর স্বভাব চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়। রাসূল সা) বলেছেন, কার সাথে বন্ধুত্ব করছ, তা যাচাই করে নেবে, কারণ মানুষ তার বন্ধুর ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত।
এই আয়াত দ্বারা বোঝা আরো যায় যে, জান্নাতীরা জাহান্নামীদের পরিণাম স্বচক্ষে দেখতে পাবে যা তাদের প্রশান্তি দেবে। কারণ আল্লাহ্ তাদের কি হতে নিস্তার দিয়েছেন তা তারা উপলব্ধি করতে পারবে। এই লোকটি যেমন বলবে যে তার একজন সাথী দুনিয়াতে ইসলামকে কটাক্ষ করতো, পুনরুত্থান দিবসকে অস্বীকার করতো; অতঃপর সে তার পরিণতি দেখতে চাইবে এবং তাকে জাহান্নামে দেখতে পাবে।
একইভাবে দুনিয়াতে অবিশ্বাসীরা যেমন বিশ্বাসীদের দেখে হাসি-ঠাট্টা করতো, আখিরাতে জান্নাতীরা জাহান্নামীদের দেখে হাসি–ঠাট্টা করবে। আল্লাহ্ বলছেন, “উদ্যানের বাসিন্দারা আগুনের বাসিন্দাদের ডাক দিয়ে বলবে, ‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের প্রতি আমাদের প্রতিপালকের ওয়াদাসমূহকে সত্য হিসেবে পেয়েছি, তোমরাও কি তোমাদের প্রতিপালকের ওয়াদাসমূহকে সত্য হিসেবে পেয়েছ?’ তারা জবাব দিবে, ‘হ্যাঁ।’ অতঃপর একজন ঘোষক উভয়ের মাঝখানে ঘোষণা করবেঃ আল্লাহর অভিসম্পাত জালেমদের উপর।” (৭-৪৪ )
কুরআনে প্রাপ্ত তৃতীয় কথোপকথন, “যারা অপরাধী, তারা বিশ্বাসীদেরকে উপহাস করত। এবং তারা যখন তাদের কাছ দিয়ে গমন করত তখন পরস্পরে চোখ টিপে ইশারা করত। তারা যখন তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরত, তখনও হাসাহাসি করে ফিরত। আর যখন তারা বিশ্বাসীদেরকে দেখত, তখন বলত, নিশ্চয় এরা বিভ্রান্ত। অথচ তারা বিশ্বাসীদের তত্ত্বাবধায়করূপে প্রেরিত হয়নি। আজ যারা বিশ্বাসী, তারা কাফেরদেরকে উপহাস করছে। সিংহাসনে বসে, তাদেরকে অবলোকন করছে, কাফেররা যা করত, তার প্রতিফল পেয়েছে তো?” [৮৩(২৯-৩৬)]
অবিশ্বাসীরা দুনিয়াতে বিশ্বাসীদের প্রতি যা কিছু করেছে তার সবকিছুর প্রতিফল তাদের দেওয়া হবে।
এগুলি ছিল জান্নাত ও জাহান্নামের অধিবাসীদের মাঝে সংঘটিতব্য কিছু কথোপকথন। এবং অবশ্যই, জান্নাতীরা জাহান্নামে যা কিছু হচ্ছে, তার সবকিছুই অবলোকন করতে পারবো, যার সাথে ইচ্ছা কথা বলতে পারবো, এর দ্বারা আল্লাহ্ জান্নাতীদের যা কিছু দিয়েছেন তার জন্য তাঁরা কৃতজ্ঞতাবোধ করবে।
ইবাদাতমূলক কর্মকাণ্ডঃ জান্নাতে আল্লাহর প্রতি কোনোপ্রকার ইবাদাতমূলক কর্মকাণ্ড থাকবে না, কোন নামাজ, রোজা বা যাকাত প্রদানের উপায় থাকবে না। আমাদের ওপর কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না, আল্লাহর ইবাদাতের সবরকম প্রয়োজন তখন শেষ। ইবাদাতের শুধু একরকম মাধ্যমই তখন বিদ্যমান থাকবে, তা হল তাসবীহ অর্থাৎ আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা স্বীকার। রসুলুল্লাহ(সঃ) সহিহ বুখারির হাদিসে বলছেন, “তাঁরা(জান্নাতীরা) আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করবে, সকালে ও সন্ধ্যায়।” কিন্তু আলিমরা উল্লেখ করেছেন যে এটা এমন কোন ইবাদাত না যা তাদের প্রতি আদেশ করা হয়েছে বরং এটা তাদের জন্য আনন্দ ও উৎফুল্লতা লাভের একটি মাধ্যম, তাঁরা নিজেদের প্রশান্তিলাভের জন্যই এটা করবে। তাঁরা তাসবীহ করবে যেভাবে তাঁরা এই দুনিয়াতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকে। অর্থাৎ আল্লাহর মহিমাকীর্তন হবে তাদের কাছে নিশ্বাসের মত, যা সম্পূর্ণ বিনা প্রচেষ্টায়, প্রাকৃতিকভাবে বেরিয়ে আসে। আর এটাই ইবাদাতের একমাত্র মাধ্যম, যা ছাড়া অন্য সব কর্মকাণ্ডই অবকাশযাপনের ন্যায়।
জান্নাতে একজন যা চায় তাই পেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ সহিহ বুখারীর এই হাদিসটা উল্লেখ করা যায়, “রসুলুল্লাহ(সঃ) কথা বলছিলেন এবং সেখানে একজন গ্রাম্য বেদুঈন উপস্থিত ছিল। তিনি বলছিলেন যে একজন মানুষ জান্নাতে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, ‘ও আল্লাহ, আমি চাষাবাদ করতে চাই!’ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাকে বলবেন, ‘তোমার আবশ্যকীয় দ্রব্যসমূহ কি তোমার নিকট নেই?’ সে জবাব দিবে, ‘হ্যাঁ তবে আমি কৃষিকাজ করতে চাই। তাই সে এ ব্যাপারে তাড়াহুড়া করে বীজ বপন করবে। চোখের পলক ফিরাবার আগেই ফসল অংকুরিত হয়ে বৃদ্ধি পাবে, কর্তন করা হবে এবং পাহাড়ের মত স্তুপীকৃত হয়ে যাবে। আল্লাগ তায়ালা বলবেন, হে বনী আদম ! তুমি এগুলো নিয়ে যাও। কেননা কোন কিছুই তোমার তৃপ্তি হয় না। তখন গ্রাম্য আরব লোকটি বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! দেখবেন সেই লোকটি কোন আনছার অথবা কুরাইশ গোত্রীয় হবে, যেহেতু তারাই কৃষিকাজ করে। আর আমরা তো কৃষিকাজ করি না। একথা শুনে রাসুলুল্লাহ সা) হেসে দিলেন। (বুখারি) কিছু মানুষ এতটাই কর্মপ্রিয় হয় যে তারা জান্নাতে গিয়েও কাজ ছাড়া থাকতে পারবে না। যেমন এই লোকটি জান্নাতে গিয়েও চাষাবাদ করতে চাইবে। আল্লাহ তাকে জান্নাতে চাষাবাদ করতে দিবেন, পাহাড়সমান ফসলও দিবেন এবং আদমসন্তান অর্থাৎ মানুষের কখনো সন্তুষ্ট না হওয়ার প্রবণতাকে ইঙ্গিত করবেন। এটা শুনে বেদুঈন লোকটি অবাক হয়েছিল। কারণ বেদুঈনরা যাযাবর জীবনযাপন করে ও পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করে। অপরপক্ষে মদীনার মানুষেরা চাষাবাদে অভ্যস্ত। একারণে তার মতে সেই লোকটি কুরাইশ বা আনসারদের মাঝে থেকে হবে; যা শুনে রসুলুল্লাহ(সঃ) হেসে ফেলেছিলেন।
- তিরমিজী শরিফের আর এক হাদিস হতে জানা যায়, “জান্নাতে কেউ যদি সন্তান জন্ম দিতে চায়, তবে গর্ভাবস্থা, সন্তানের জন্ম, বেড়ে ওঠা হবে তাৎক্ষণিক, ঠিক যেমন সে চায়।” এই হাদিস কি বোঝায় এ ব্যাপারে আলীমদের মতপার্থক্য আছে; অনেকের মতে জান্নাতে যেহেতু স্বামী-স্ত্রীগণ নিজেদের উপভোগ করবে, এর মাঝে কোনরকম সন্তানধারণ ঘটবে না। তারা এভাবে ব্যাখ্যা করেন ব্যাপারটা যে, তারা যদি চায় সন্তান জন্ম দিতে তবে তাই হবে, কিন্তু তারা এটা চাইবে না। প্রকৃতপক্ষে এই ব্যাখ্যাটি অনেকের অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দিয়ে দেয়। অনেকেই জিজ্ঞাসা করে থাকেন জান্নাতে এটা হবে কিনা, সেটা হবে কিনা, ওটা চাইলে পাওয়া যাবে কি না। উত্তরটা একই- তারা চাইলেই পাবে, কিন্তু তারা চাইবে না। যেমনঃ কেউ (জান্নাতে নিম্ন কোন স্তরে থেকে) জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরের মর্যাদা চেয়ে বসবে না, কেননা সে জানে অন্য কেউ এই মর্যাদার যোগ্য, সে না। প্রত্যেকের মাঝে এমন এক কৃতজ্ঞতাবোধ কাজ করবে যে তাকে যাই দেওয়া হোক, সে সন্তুষ্ট থাকবে, এমনকি যদি (জান্নাতে) কোন নিম্নস্তরে নামিয়ে দেওয়া হত তবুও সে তাতে খুশি ও সন্তুষ্ট থাকতো। আমরা ইতোমধ্যেই সেই ব্যক্তির কথা বলেছি যে জান্নাতে শেষ ব্যক্তি হিসেবে প্রবেশ করবে। এক বর্ণনায় এসেছে, “আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে সমগ্র দুনিয়ায় যা কিছু আছে তার দশগুণ দান করবেন এবং তার সাথে তার দুই স্ত্রীর দেখা হবে। তারা তাকে বলবে, ‘প্রশংসা আল্লাহর, যিনি অবশেষে তোমাকে আমাদের কাছে এনেছেন’। সে লোকটি তখন বলবে, ‘আল্লাহ আমাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাকে এমনকিছু দান করেছেন যা তিনি আর কাউকে দেননি।” সুতরাং, জান্নাতের সর্বশেষ ব্যক্তিটিকেও এতকিছু দেওয়া হবে যার ফলে সে মনে করবে তাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, যদিও সে জান্নাতের নিম্নতম স্তরে আছে, এবং ফলশ্রুতিতে সে আর কিছুই চাইবে না।
রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেন, জান্নাতে একটি সুক অর্থাৎ মার্কেট বা বাজার থাকবে। এখানে একটা জিনিস উল্লেখ করা উচিত; রসুলুল্লাহ(সঃ) জান্নাতের সবরকম বর্ণনা এমনভাবে দিয়েছেন যেন তা সেই সময়কার মদীনার লোকদের কাছে বোধগম্য হয়। যেমনঃ কোন জায়গায় যদি কোন কাজের প্রতিদান হিসেবে ৭০০ উটের কথা বলা হয় তবে সেটা অন্য কোন সময়ের মানুষের জন্য সমতুল্য কোন কিছু বোঝাবে; সেটা হতে পারে ৭০০ গরু, যদি সেই সময়ে বা স্থানে গরু সহজলভ্য হয়। সেই সময়ে আরবে কবিতা, বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রও ছিল বাজার এলাকা। এখানে মানুষ একত্র হত, যে কারনে সবাইকে জানানোর মত কোন ঘোষণা, বক্তব্য বাজারে দেওয়া হত। এমনকি রসুলুল্লাহ(সঃ) দাওয়াহ এর কাজে বাজার এলাকাকে ব্যবহার করেছেন। জান্নাতেও অনুরুপ সুল্ক থাকবে, তবে এর উদ্দেশ্য ব্যবসাবাণিজ্য না বরং হবে সবার একত্র হওয়া ও কুশল বিনিময় করা। কিছুটা আমেরিকার সিটি সেন্টার বা ডাউনটাউনের মত যেখানে মানুষ জড়ো হয় আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠার জন্য।
মুসলিম শরীফের হাদিসে রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেন, “জান্নাতে এমন একটি সুক্ব বা বাজার আছে সুতরাং তারা এই বাজারে যাবে ও যেরকম গিয়েছিল তার চেয়ে উন্নত অবস্থায় ফিরে আসবে এবং তাদের পরিবারকেও উৎকৃষ্টতর অবস্থায় পাবে। জান্নাত সময়ের সাথে আরও উন্নত হয়, জাহান্নামের আগুন সময়ের সাথে শুধু আরও ভয়াবহ হয়। জান্নাতে সবাই নিজ নিজ পরিবারের সাথে আরাম আয়েশে সময় কাটাবে, এমন সময় একটা ডাক বা আহ্বান শুনতে পাবে তারা যা শুনে তারা সবাই বাজারে গিয়ে একত্র হবে। এবং শুধু তাই না, জাহান্নামের অধিবাসীরাও একটা সময় কোন এক জায়গায় গিয়ে একত্র হবে। অতঃপর জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানের অঞ্চলে ফেরেশতাগণ মৃত্যুকে একটি ভেড়ার আকৃতিতে নিয়ে আনবে। জান্নাত-জাহান্নামের সবাই গলা বাড়িয়ে (অর্থাৎ অত্যান্ত উৎসাহী হয়ে ও মনোযোগ দিয়ে) দেখতে থাকবে। অতঃপর ফেরেশতাগণ একটি ছুরি দ্বারা মৃত্যুকে কুরবানি করে দিবে। এরপর তারা জান্নাতবাসীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করবে, “হে জান্নাতীগণ, অনন্তকাল বেঁচে থাক, তোমাদের মৃত্যু নেই।” এরপর জাহান্নামবাসীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করবে, “হে জাহান্নামীগণ, অনন্তকাল বেঁচে থাক, তোমাদের মৃত্যু নেই।” রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন, “এমন কোন মুহূর্ত যদি থাকে যখন অত্যাধিক আনন্দ-উত্তেজনার ফলে কেউ মারা যেতে বসে তবে জান্নাতের মানুষদের জন্য এটা হবে সেই মুহূর্ত এবং এমন কোন মুহূর্ত যদি থাকে যখন অত্যাধিক দুঃখ-হতাশার ফলে কেউ মারা যেতে বসে তবে এটা হবে সেই মুহূর্ত জাহান্নামের মানুষদের জন্য।” এটা জান্নাতীদের জন্য সর্বোত্তম এবং জাহান্নামীদের জন্য নিকৃষ্টতম মুহূর্ত হবে। কেননা এর মাধ্যমে যেমন জান্নাতবাসীরা উপলব্ধি করবে তাদের এই আনন্দের জীবনের আর শেষ নেই, ঠিক তেমন জাহান্নামীরা বুঝতে পারবে এই কষ্টের মাঝে তাদেরও আর কোন আশা নেই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “তারা সেখানে মৃত্যু আস্বাদন করবে না, প্রথম মৃত্যু ব্যতীত এবং আপনার পালনকর্তা তাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করবেন।”(৪৪-৫৬)
কোন নতুন জায়গায় স্থায়ীভাবে আসার পরও যেমন সবকিছুর সাথে পরিচিত হবার পূর্বে আমরা সবকিছুর সাথে অভ্যস্ত হতে পারি না, জান্নাতে আসার পর জান্নাতবাসীরাও শুরুতে কিছু সময় সবকিছুর সাথে পরিচিত হবার জন্য নিবে। অতঃপর যখন তারা তাদের প্রাপ্য বুঝে নিবে এবং পুনরায় মৃত্যুরও আর কোন ভয় থাকবে না, এ সময় জান্নাতবাসীরা শেষবারের মত দুয়া করবে। আল্লাহ বলেন, সেখানে তাদের প্রার্থনা হল ‘পবিত্র তোমার সত্তা হে আল্লাহ’। আর শুভেচ্ছা হল সালাম আর তাদের প্রার্থনার সমাপ্তি হয়, ‘সমস্ত প্রশংসা বিশ্বপালক আল্লাহর জন্য’ বলে। শেষ যে কথাটা তারা বলবে তা হল, “আলহামদুলিল্লাহ”- সকল প্রশংসা আল্লাহর।
তারা মনে করবে তারা সবকিছু ইতোমধ্যে পেয়ে গিয়েছে। প্রতিদানস্বরূপ এতকিছু তারা জান্নাতে লাভ করবে যে তাদের মনে হবে এর চেয়ে বেশি কিছু হতেই পারে না। কিন্তু না! একটা চমক তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। মুসলিম শরীফে বর্ণীত হাদিসে রসুলুল্লাহ (সঃ) বলছেন, আল্লাহ তাআলা জান্নাতবাসীদের বলবেন: হে জান্নাতবাসীগণ! তারা বলবে, উপস্থিত হে প্রভূ, সৌভাগ্য ও কল্যাণতো আপনারই হাতে। তারা বলবে, তোমরা কি সন্তুষ্ট হয়েছো? তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা কেন সন্তুষ্ট হবো না? আপনি আমাদের এমন নেয়ামত ও সূখ-শান্তি দিয়েছেন যা কখনো অন্য কাউকে দেননি। আল্লাহ তাআলা বলবেন, আমি কি তোমাদের এরচেয়ে উত্তম কোন কিছু দেব? তখন তারা বলবে, হে প্রতিপালক! যা দিয়েছেন তার চেয়ে আবার উত্তম কোন জিনিষ আছে কী? আল্লাহ তাআলা বলবেন, আজ থেকে আমার সন্তুষ্টি তোমাদের উপর স্থায়ী হয়ে গেল। আর কোন দিন তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হবো না। (বর্ণনায়: বুখারী ও মুসলিম)
এটা হবে এমন এক মুহূর্ত যখন জান্নাতবাসীদের মানসিক সুখ, আনন্দ প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। কারণ তারা জানতে পারবে যে তারা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করেছে, তাদের কর্মকাণ্ডে আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহকে তাদের কাজের মাধ্যমে খুশি করেছে; তাদের জন্য এর চেয়ে আনন্দদায়ক আর কি হতে পারে?
আমরা দুনিয়াতে যখন কাউকে ভালবাসি তখন তার প্রতিটি বিষয়ে আমরা সচেতন থাকি। প্রতিদানে যখন জানতে পারি যে যাকে আমরা ভালবাসি সে আমাদের ব্যবহারে সন্তুষ্ট, আমাদের মন আনন্দে ভরে ওঠে। জান্নাতে যখন আমরা জানতে পারবো আল্লাহ আমাদের আচরণে সন্তুষ্ট, আমাদের আনন্দের মাত্রা এতটাই বেশি হবে যতটা জান্নাতেও কখনো আমরা পাইনি।
সহিহ মুসলিমে বর্ণীত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যখন জান্নাতবাসীরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন: তোমাদের আরো কিছু বাড়িয়ে দেই এমন কিছুকি তোমরা চাও? তারা বলবে, আপনি কি আমাদের চেহারা হাস্যোজ্জল করেননি? আপনি কি আমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাননি? আপনি কি আমাদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেননি? এরপর আল্লাহ তাআলা তার চেহারা থেকে পর্দা উঠিয়ে তাদের জন্য নিজ চেহারাকে উম্মুক্ত করবেন। তখন তাদের অনুভুতি হবে আমাদের যা কিছু দেয়া হয়েছে তার চেয়ে আল্লাহ তাআলার এ দর্শনই সর্বাধিক প্রিয়। এ কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর এ বাণীটি তেলাওয়াত করেন: ‘যারা ভালো কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম (জান্নাত) এবং আরো বেশী ( তা হলো আল্লাহকে সরাসরি দেখা)-ইউনুস ২৬। (বর্ণনায়: মুসলিম) আল্লাহর চেহারা, যা কি না সকল সৃষ্টির কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা আছে এবং কাউকে এর দর্শন দেওয়া হয়নি, জান্নাতবাসীরা তা দেখতে পাবে। অন্যদিকে জাহান্নামীদের জন্য যেটা সবচেয়ে বড় বঞ্চনা হবে তা হল তাদের স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে দেখতে না পাওয়া। মূসা(আঃ) এর সাথে আল্লাহ কথা বলেছিলেন। একজন মানুষ হিসেবে সবসময় বেশি বেশি চাওয়ার কারণে মূসা(আঃ) বললেন, “ও আল্লাহ, আমি তোমাকে দেখতে চাই।” আল্লাহ বললেন, “ও মূসা, তুমি আমাকে দেখতে পারবে না। কিন্তু ঐ পাহাড়ের দিকে চেয়ে দেখ। যদি সেটা নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, আমি নিজেকে (নিজের চেহারাকে) তোমার কাছে প্রকাশ করবো।” এরপর আল্লাহ নিজের চেহারাকে পাহাড়ের কাছে প্রকাশ করলেন। এতে পাহাড় ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল এবং ধূলায় মিশে গেল। মূসা(আঃ) পাহাড়ের এই অবস্থা দেখেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন, না জানি তার কি অবস্থা হবে যদি তিনি আল্লাহকে দেখতে পান! আল্লাহর নূরের রূপ-মহিমা সহ্য ও উপলব্ধি করতে পারার মত ক্ষমতা দুনিয়াতে আমাদের দেওয়া হয়নি। কিন্তু আল্লাহ জান্নাতের নারীদের সম্পর্কে বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমি তাদের সৃষ্টি করেছি বিশেষ সৃষ্টিতে।” আরও যেমন উল্লেখ করেছেন ‘খাল্কান আখ্র’ অর্থাৎ ভিন্ন গঠন। জান্নাতে আমাদের গঠন ও অবয়ব আরও শক্তিশালী, উন্নত হবে যেন আমরা জান্নাত উপভোগ করতে পারি। জান্নাতে এত বেশি সুখ ও ভোগের উপকরণ থাকবে যা সাধারণ অবস্থায় আমাদের দেহের পক্ষে ধারণ করা সম্ভব না। রসুলুল্লাহ যেমন বলেছেন যে, জান্নাতে একজন মানুষের একশত মানুষের সমান শক্তি থাকবে। আর আমরা ইতোমধ্যেই বলেছি জান্নাতের একজন মানুষের তুলনায় দুনিয়ার একজন মানুষ ধ্বজের ন্যায়। একজন জান্নাতী ব্যক্তির জন্য এটা অনেক বড় একটা মর্যাদা এবং তারা যে আল্লাহর চেহারা দেখতে পাবেন এটা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় মর্যাদা।
জান্নাতের নিম্নতর স্তরগুলির বাসিন্দারা আল্লাহ্কে সপ্তাহে একবার দেখতে পাবেন এবং এটা হবে জুম্মার দিন, সালাতুল জুমা যে সময়টায় হত সেই সময়। জুম্মা একটি বিশেষ দিন। এটা সপ্তাহের সেরা একটি দিন যেটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মুহাম্মাদ(সঃ) এর উম্মাতের জন্য উপহারস্বরূপ দিয়েছেন। রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেছেন, “পূর্ববর্তী উম্মতগুলি এটিকে ভুলভাবে গ্রহণ করেছে; ইহুদীগণ শনিবার এবং খ্রিষ্টানরা রবিবার। কিন্তু আল্লাহ এই দিনটি আমাদের জন্য সংরক্ষণ করেছেন এবং আমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন।” শুক্রবার হচ্ছে এমন একটা দিন যেদিন আল্লাহ আদম(আঃ) কে সৃষ্টি করেছিলেন এবং এটা সেই দিন যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে। উল্লেখিত আছে যে, জান্নাতে এই জুমার দিনে যেখানে সবাই একত্র হবে, সেখানে যে কেউ এসে ঢুকে যেতে পারবে না, বরং প্রত্যেকের আসন সংরক্ষিত থাকবে। আপনার যেখানে বসবার কথা, ফেরেশতাগণ সসম্মানে আপনাকে সেখানে নিয়ে যাবে। আপনি সেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করবেন এবং আল্লাহ একসময় আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত হবেন। কিন্তু এখন আপনি সালাতুল জুম্মায় ইমাম-এর যত নিকটে থাকবেন, সেদিন আপনার আসন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার তত নিকটবর্তী হবে। অর্থাৎ জুমার সালাতের জন্য আপনি যত আগে পৌঁছাবেন, এই দিনে আপনি আল্লাহর তত নিকটে যেতে পারবেন। এখানে আল্লাহর সাথে আপনার কথোপকথন হবে। অতঃপর আল্লাহ আপনাদের সকলকে আপনাদের ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা অর্থাৎ আপনি আর কিছু চান কিনা এ সম্পর্কে জানতে চাইবেন। সবাই তাদের নিজ নিজ ইচ্ছার কথা আল্লাহ তাআলাকে জানাবেন এবং সবশেষে সবাই বাড়ি ফিরে যাবে। এটা ছিল জান্নাতের নিম্নস্তরের বাসিন্দাদের জন্য। উচ্চস্তরের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে উল্লেখ আছে যে তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সাথে দিনে ২ বার দেখা করতে পারবেন।
জান্নাতে আমাদের সফর মোটামুটি এখানেই শেষ তবে ছোটখাটো কিছু বিষয় এখনো বাকি আছে। জান্নাতের মানুষদের সম্পর্কে এবং জান্নাত ও দুনিয়ার কিছু তুলনামূলক আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করছি।
জান্নাতে পরে যারা প্রবেশ করবে জাহান্নাম থেকে এসে তাদের সম্পর্কে রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেছেন, “কিছু মানুষ তাদের কৃত গুনাহের কারনে আযাব ভোগ করবে এবং সেজন্য জাহান্নামের আগুনে তারা ঝলসে যাবে। তারপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর রহমত ও দয়ায় তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং তাদেরকে (জান্নাতের বাসিন্দারা) সম্বোধন করা হবে ‘আল জাহান্নামিন ’(জাহান্নামী) বলে”। (সহিহ বুখারি) সুতরাং জাহান্নাম থেকে জান্নাতে গমনকারী ব্যক্তিরা জান্নাতে যাবার সময় তাদের চামড়ার রঙ পরিবর্তিত হবে জাহান্নামের আগুনে পোড়ার কারণে এবং জান্নাতের মানুষেরা তাদের দেখে চিনতে পারবে এবং জাহান্নামী বলে সম্বোধন করবে। এক ভাই এটা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন যে এটা তাদের জন্য অপমানজনক বা বৈষম্যমূলক হিসেবে দেখা দিবে কি না। না, জান্নাতে কোনোপ্রকার বৈষম্য থাকবে না। কোনোপ্রকার ২য় শ্রেণীর নাগরিক বা কোনোরকম অধিকার হরণ এর মত দৃশ্যও দেখতে হবে না। অন্যান্য সবাই যা ভোগ করছে, তারাও তেমনই ভোগ করতে পারবে। আমরা আমাদের অক্ষমাশীল মানবীয় প্রবৃত্তির কারণে আসলে এমনটা চিন্তা করতে পারি যে তারা হয়তো স্বাভাবিক অধিকার হতে কিছুটা হলেও বঞ্চিত হচ্ছে। এটা মানুষ হিসেবে আমাদের বৈশিষ্ট্য। কেউ আমাদের প্রতি কোন ভুল করলে আমরা সেটা মনে রাখি; সে ব্যক্তি এ ব্যাপারে তওবা করে ফেললেও। ১০ বছর চলে যাক না কেন, অন্য সবকিছু ভুলে গেলেও এই জিনিসগুলি মনে রাখি আমরা। সে ব্যক্তিটি অনুতপ্ত হয়ে পরে এ জিনিসগুলি ভুলে যেতে চাইলেও আমরা তাদের অতীতকে টেনে আনি। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা হচ্ছেন ক্ষমাশীল এবং করুণাময়। এই লোকগুলিকে আল্লাহ জাহান্নামে শাস্তি দেন, কিন্তু যেই তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অতীতের দেয়া-নেয়া চুকে যাবে। আল্লাহ তাদের ভালোবাসবেন। আল্লাহ তাদেরকে নিয়ে সন্তুষ্ট ও খুশি থাকবেন। এছাড়া আল্লাহ এই লোকগুলিকেও সেরকম ক্ষমাশীল করে তুলবেন। কারণ আমি যদি পাপ করে থাকি, আমি সেটা জেনে থাকবো। আল্লাহ যদি ক্ষমাশীল না হতেন, আমি জান্নাতে আসতে পারতাম না এটাও আমি জানবো। সুতরাং আমার নিজের মাঝেও সেইরূপ ক্ষমাশীল দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব ঘটবে। যার কারণে আমাকে যদি জাহান্নামী বলে ডাকা হয়, তবে তা অপমান হবে না, বরং হবে আমাদেরকে চেনার উপায়, কোনোভাবেই কোন অবমূল্যায়নকারী মন্তব্য না। কেননা জান্নাতে আমরা সবাই সমান। আমরা সবাই মানুষ, সবাই কিছু না কিছু পাপ করেছি, কেউ কম কেউ বা বেশি এবং সবশেষে সবাই জান্নাতে প্রবেশ করতে পেরেছি।
রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেছেন, “জাহান্নামের চিরস্থায়ী বাসিন্দা তারাই, যারা এর দ্বারা দণ্ডপ্রাপ্ত এবং তারা সেখানে মরবেও না এবং বাঁচবেও না। কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক যারা নিজেদের অপরাধের কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এমনভাবে মারবেন যে তারা অগ্নিদগ্ধ হয়ে চারকোল বা কয়লার মত হয়ে যাবে। অতঃপর তাদের জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দেয়া হবে। এরপর তাদেরকে পৃথকভাবে দলে দলে আনা হবে এবং জান্নাতের নহরের মধ্যে ছেড়ে দেয়া হবে। তারপর বলা হবে, হে জান্নাতবাসীরা, এদের উপর পানি বর্ষণ কর। অতপর তারা এমনভাবে তরতাজা ঘাসের মত সজীব হয়ে উঠবে যেভাবে প্রবহমান স্রোতের ধারে বীজ অংকুরিত হয়ে উঠে। (সহিহ মুসলিম)
সুতরাং এগুলি হচ্ছে সেই বিশ্বাসীগণ যারা তাদের গুনাহের কারণে জাহান্নামে পতিত হবে এবং তারা কত তাড়াতাড়ি তাদের শাস্তি শেষ হয় এর ভিত্তিতে দলে দলে জাহান্নাম থেকে বেরিয়ে এসে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এছাড়া তারা কাঠকয়লার টুকরার মত হয়ে বেরিয়ে আসবে, এতটাই তারা আগুনে পুড়বে যে কয়লার টুকরা ছাড়া কিছু বাকি থাকবে না। এরপর তাদের জান্নাতের নদীতে ফেলে দেয়া হবে এবং জান্নাতের বাসিন্দাদের বলা হবে তাদের ওপর পানি ঢেলে দিতে, তারা তাই করবে, অর্থাৎ তারা তাদের ভাইদের সাহায্য করবে। এতে তারা বেড়ে উঠবে যেমনভাবে নদীর পানির সংস্পর্শে পলিমাটিতে বীজ অঙ্কুরিত হয়। পাশে উপস্থিত ছিল এমন একজনের মতে, তখন এমন মনে হচ্ছিল যেন আল্লাহর রসূল জলবেষ্টিত কোন অঞ্চলে থেকেছেন। কারণ মক্কায় সবুজ গাছপালা, নদী ইত্যাদির কোন অস্তিত্ব ছিল না, ফলে এ বিষয়ে জ্ঞানলাভের কোন উপায় ছিল না তাঁর জন্য। তাই লোকটি মনে করেছিল রসুলুল্লাহ(সঃ) হয়তো মক্কার বাইরে কোথাও থেকে অভ্যস্ত ছিল না হয় এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করার কথা না। এবং সত্যি বলতে রসুলুল্লাহ(সঃ) এর সেই অভিজ্ঞতা আসলেও ছিল কেননা তিনি একসময় একজন রাখালবালক ছিলেন।
নবীগণ, ফেরেশতাগণ ও ঈমানদারগণ শুপারিশ করবেন। এরপর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলা বলবেন, আমার শুপারিশ বাকী আছে। তিনি জাহান্নাম থেকে অগ্নিদগ্ধ এক মুষ্ঠিকে বের করে আনবেন। তাদের জান্নাতের সম্মুখে একটি নদীতে ছেড়ে দিবেন। সেই নদীটির নাম মা-উল হায়াত (জীবন নদী) সেখানে তারা নতুনভাবে গঠিত হবে যেমন ভাবে নতুন পলি পেয়ে উদ্ভিদ অংকুরিত হয়। যেমনটি তোমরা দেখে থাকো যে রোদ লাগা বৃক্ষটি সবুজ হয় আর রোদের আড়ালে থাকা বৃক্ষটি সাদা হয়ে যায়। তারা এ নদী থেকে বের হয়ে আসবে হীরার মত উজ্জল হয়ে। তাদের গল দেশে সীলমোহর করে দেয়া হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। তখন জান্নাতবাসীরা বলবে, এরা হল দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বা আল্লাহর পক্ষ হতে আযাদকৃত লোক। এরা কোন কল্যাণ ও পুন্যময় কাজ না করা সত্ত্বেও আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
অন্য এক হাদিসে রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেন, “তিনি ফেরেশতাদের নির্দেশ দিবেন তাদেরকে বের করে আনতে যারা আল্লাহর সাথে কোনোকিছুকে শরীক করেনি, যাদের প্রতি আল্লাহ করুণা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা যারা বলে আল্লাহ ব্যতিত কোন ইলাহ নেই।”
এ হাদীসটি রয়েছে সহীস মুসলিমে , আবু সাঈদ আল খুদরী থেকে বর্ণিত, ইফা ৩৬২- রাসূল সা) বলেন, কিয়ামতের দিন একজন ঘোষক ঘোষণা করবে, প্রত্যেক উম্মত যারা যে জিনিসের ইবাদাত বা পূজা করতে তারা যে জিনিসের অনুগমন করো। ফলে মুশরিকদের কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। যারা আল্লাহ ছাড়া মূর্তি ও মুর্তিপূজার বেদীতে উপাসনা করতো তাদের সবাইকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে। অবশেষে যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতো, তারা গুনাহগার বা নেককার যাই হোক না কেন, অবশিষ্ট থাকবে। আর তাদের সাথে আহলে কিতাবীদের কিছু লোক থাকবে। অতঃপর ইয়াহুদীদের ডাকা হবে, তাদের জিজ্ঞেস করা হবে, হে আমাদের রব ! সামান্য পরিমাণ ঈমানের অধিকারী আর একজন লোককেও আমরা জাহান্নামে অবশিষ্ট রেখে আসিনি। হাদীসের হাদীসটির বর্ণনাকারী আবু সায়ীদ রা. বলেন, যদি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস না করো তবে আল্লাহ তাআলার এ বাণীটি পড়ে দেখ : নিশ্চয়ই আল্লাহ কারো প্রাপ্য হক বিন্দু-বিসর্গও রাখেন না; আর যদি তা সৎকর্ম হয়, তবে তাকে দ্বিগুণ করে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে বিপুল সওয়াব দান করেন। নিসা ৪০ সুতরাং যাদের অন্তরে অনু পরিমাণ ঈমান থাকবে তাদেরকে একসময় জাহান্নাম থেকে বের করে আনা হবে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, ফেরেশতাগণ তাদের কিভাবে চিনবে? রসুলুল্লাহ(সঃ) বলতে থাকেন, “ফেরেশতাগণ তাদের চিনতে পারবে তাদের সাজদার চিহ্ন দ্বারা। কারণ জাহান্নামের আগুন আদমসন্তানের সবকিছু গ্রাস করে ফেলবে শুধু সাজদার চিহ্নগুলি ব্যতিত।” সুতরাং জাহান্নামের আগুন সিজদার স্থানগুলি ব্যতিত সবকিছু পুড়িয়ে ফেলবে। এখানে একটি বিশেষ ইঙ্গিত আছে। কেউ যদি সালাত না আদায় করে, তার শরীরে যদি সিজদার কোন চিহ্ন না থাকে, ফেরেশতারা কি করে তাকে জাহান্নামের আগুনের মাঝে খুঁজে বের করবে? সুতরাং সালাত খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এখানে যেমন উল্লেখ করেছেন রসুলুল্লাহ(সঃ) ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ মানুষকে জাহান্নাম থেকে বার করে আনতে পারবে, কিন্তু এটাও প্রকারান্তরে উল্লেখ করেছেন যে তাদের সালাত আদায় করতে হবে। আল্লাহ জাহান্নামের আগুনকে নির্দেশ দিয়েছেন সিজদার চিহ্নবিশিষ্ট স্থানগুলিকে অক্ষত রাখতে। অতঃপর জাহান্নামে আজাব ভোগ করা এই লোকগুলিকে বের করে আনা হবে, তাদের ওপর জান্নাতের পানি ঢেলে দেওয়া হবে এবং তারা অঙ্কুরিত বীজের মত বিকশিত হবে। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে প্রার্থনা করবো আমাদের সরাসরি জান্নাতে দাখিল করতে, জাহান্নামের আগুন এক মুহূর্ত সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের কারো নাই। আমরা যদি এই দুনিয়ার আগুনে এক মুহূর্ত নিজের আঙ্গুল না রাখতে পারি, কিভাবে সেই জাহান্নামের ভয়াবহ আগুনে সারা শরীর রাখতে পারবো আমরা বছরের পর বছর? আমরা জান্নাতের সুখ-সমৃদ্ধি ও জাহান্নামের কঠোর শাস্তির কথা জেনেছি ইতোমধ্যেই। এতকিছু জানার পরও যদি কেউ তার যা করার কথা টা না করে বা করতে পারে, তাহলে তাকে আর কি বলার থাকে? যেমন জাহান্নামের বাসিন্দারা বলবে, وَقَالُوا لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ أَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِي أَصْحَابِ السَّعِيرِ [٦٧:١٠]
তারা আরও বলবেঃ যদি আমরা শুনতাম অথবা বুদ্ধি খাটাতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসীদের মধ্যে থাকতাম না।
“হায়! আমাদের যদি সামান্য জ্ঞান-বুদ্ধি থাকতো, আমরা এখানে আসতাম না।” মুসলিম হিসেবে আল্লাহ আমাদের কাছে সত্যটা উন্মোচিত করেছেন। আমরা যদি সত্যটা জেনেও চুপ থাকি, সেই মোতাবেক কাজ না করি, এর পরিণাম তো আরও ভয়াবহ হবে! কেন মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে? কারণ তারা সত্যটা জানে, কুফফারদের চেয়েও বেশি জানে, কিন্তু তারা স্বেচ্ছায় এর বিপরীতে চলার সিদ্ধান্ত নেয়।
দেখুন ব্যাপারটা যখন এরকম দাঁড়ায় যে আমি অনন্তকাল বেঁচে থাকবো, আমার মধ্যে কোনোরকম দুঃখ, কষ্ট, হতাশা থাকবে না, যা চাইবো তাই পাবো, তাহলে এই দুনিয়ার সকলপ্রকার আনন্দ-উত্তেজনা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে, যেন এগুলো কিছুই না। তাই আসুন আমরা সময় থাকতে সচেতন হই, জেগে উঠি।
জিবরাঈল(আঃ) যখন জান্নাত কেমন এটা জানতে পারলেন, আর যখন তিনি জাহান্নাম কেমন এটা জানতে পারলেন, তিনি বললেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা যখন জান্নাত এবং জাহান্নাম সৃষ্টি করলেন তিনি জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে পরিদর্শন করতে পাঠিয়ে দিলেন, জিবরাঈল আলাইহিস সালাম, তিনি জান্নাত এবং জাহান্নাম কেমন দেখতে গেলেন, যখন তিনি জান্নাতের বিভিন্ন সামগ্রী এবং নিয়ামত আনন্দ বিলাস দেখে এলেন তিনি বললেন, তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে রিপোর্ট করলেন, ‘আপনার ইজ্জতের কসম, যে কেউ জান্নাতের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সম্পর্কে শুনবে, সেই তাতে প্রবেশের ইচ্ছা প্রকাশ করবে’ অর্থাৎ তিনি যেন বললেন, “ইয়া আল্লাহ! আমি বুঝতে পারছি না কি করে একজন এর সম্পর্কে জানবে অথচ এখানে আসতে হলে যা কিছু করা লাগে তা করবে না”। আবার যখন তিনি জাহান্নাম দেখতে গেলেন, জাহান্নামের শাস্তিকষ্ট ভয়াবহতা দেখে এসে তিনি রিপোর্ট করলেন, ‘আপনার ইজ্জতের কসম, যে কেউ এর বিবরণ শুনবে, সে এতে প্রবেশ করবে না’ অর্থাৎ তিনি যেন বললেন, “ইয়া আল্লাহ! আমি বুঝতে পারছি না কি করে একজন এর সম্পর্কে জানবে অথচ এটা থেকে দূরে থাকতে হলে যা কিছু করা লাগে তা করবে না।” জিবরাঈল(আঃ) বুঝতে পারছিলেন না, কিভাবে একজন মানুষ জান্নাতের ভোগ বিলাস আর পুরষ্কারের কথা জেনেও তা অর্জনের চেষ্টা না করে বসে থাকতে পারে ! এত পুরষ্কারের কথা জেনেও কিভাবে একজন মানুষ জাহান্নামী হবে, তিনি বুঝতে পারছিলেন না, কিভাবে একজন মানুষ জাহান্নামের ভয়াবহতার কথা জানা সত্ত্বেও তা থেকে বাঁচার চেষ্টা করবে না, অলস বসে থাকবে তিনি বুঝতে পারছিলেন না। আমাদের অবস্থা মিলিয়ে দেখুন, আমরা কত সহজেই এ বিষয়গুলিকে অবজ্ঞা করি। আমরা জান্নাতের কথা জানি কিন্তু তা পাবার প্রচেষ্টা করি না, আমরা জাহান্নামের কথা জানি কিন্তু তা থেকে বাঁচার চেষ্টা করি না।
আমরা জান্নাত সম্পর্কে আলোচনা করেছি এবং এতে একটি সংক্ষিপ্ত সফর নিয়েও কথা বলেছি যেখানে আমরা এটা কল্পনা করে নিয়েছিলাম যে আমরা জান্নাতে চলে গিয়েছি। কিন্তু আসলে সেখানে যাওয়াটাও অত সহজ না, এর জন্য অনেক কাজ, অনেক আত্মত্যাগ প্রয়োজন এবং এতকিছু দেওয়ার পরেও যে আমাদের কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবো এটা ধরে নিতে পারি না। রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেই দিয়েছেন যে সেখানে যেতে হলে আমাদের অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করতে হবে। সহিহ বুখারি ও মুসলিমে আবু হুরায়রা(রাঃ) হতে বর্ণীত আছে, রসুলুল্লাহ(সঃ) বলছেন, “জাহান্নাম সবরকম কামনা-বাসনা কুপ্রবৃত্তি ও লালসা দ্বারা পরিবেষ্টিত আর জান্নাত হচ্ছে সর্বপ্রকার অপছন্দনীয় ও অনাকাঙ্খিত বস্তু দ্বারা বেষ্টিত।”
এই হাদিসের পিছনের কাহিনী হল, যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জান্নাত ও নার(জাহান্নাম) সৃষ্টি করলেন, তিনি জিবরাঈল(আঃ) কে বললেন সেগুলোকে পরিদর্শন করে আসতে। অতঃপর জিবরাঈল(আঃ) সেখানে পরিদর্শন করে আসলেন এবং সবশেষে আল্লাহ তায়ালাকে বললেন, “আমি এমন কোন কারণ দেখি না যে জন্য একজন মানুষ এর(জান্নাত) সম্পর্কে জানবে এবং এতে প্রবেশ করবে না। আর আমি এমন কোন কারণও দেখি না যে জন্য একজন মানুষ এর(জাহান্নাম) সম্পর্কে জানবে এবং এটা থেকে দূরে থাকবে না।”
অর্থাৎ জিবরাঈল(আঃ) এর কাছে এটা কমনসেন্স-এর ব্যাপার মনে হয়েছে যে কারণে সবাই জান্নাতে যেতে যা যা করা লাগে সবই করবে এবং পরিশেষে সবাই জান্নাতেই যাবে, কেউই জাহান্নামে যাবে না। এরপর আল্লাহ তায়ালা জিবরাঈল(আঃ) কে পুনরায় জান্নাত ও নার পরিদর্শনের নির্দেশ দিলেন। এবার আল্লাহ জাহান্নামকে ‘শাহাওয়াত’ অর্থাৎ আমাদের সর্বদা কাঙ্ক্ষিত ও কাম্য বস্তুগুলি দ্বারা লোভ লালসা দ্বারা বেষ্টিত করে দিলেন। এই জিনিসগুলোই আমাদের পাপের প্রতি প্রলুদ্ধ করে। জাহান্নামকে কল্পনা করুন একটি চুম্বক হিসেবে যেটা আপনাকে এর দিকে আকর্ষণ করছে। রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেছেন, “তোমাদের আর আমার মাঝে সাদৃশ্য হচ্ছে মরুভূমির মাঝে একটি ব্যক্তি ও একটি আগুনের কুণ্ডের ন্যায়।” ধরে নিন একজন ব্যক্তি মরুভূমির মাঝে আগুন জ্বালিয়ে কুণ্ড তৈরি করেছে শীতের রাতে আলো ও উত্তাপ এর আশায় এবং মরুভূমির ছারপোকা ও অন্যান্য পোকামাকড় সেই আগুনকে আলো মনে করে দলবেঁধে এসে এতে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে কিন্তু লোকটি পোকামাকড়গুলিকে আগুনে লাফিয়ে পড়া হতে রক্ষা করছে। রসুলুল্লাহ(সঃ) এর সাথে আমাদের সম্পর্কটাও এরকম। রসুলুল্লাহ(সঃ) বলছেন, “আমি তোমাদের কাপড় ধরে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করতে চাইছি কিন্তু তবুও তোমরা জোর করে এর প্রতি অগ্রসর হচ্ছো।” অন্ধকার রাতে বাইরে খোলা জায়গায় কোন বাতি জ্বালিয়ে রাখলে পোকামাকড় আলো মনে করে এর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং খুব দ্রুত ছুটে এসে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিজের অজান্তে আত্মাহুতি দেয়। আগুন জিনিসটা যতই ভয়াবহ হোক, যেহেতু আলো পোকাদের জন্য আকর্ষণীয়, তাই পোকাগুলি যেমন আলোর উৎস মনে করে এতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, আমরাও দুনিয়ার আকর্ষণীয় বস্তুসমূহের মোহে পড়ে জাহান্নামের প্রতি ধাবিত হচ্ছি। রসুলুল্লাহ(সঃ) শুধু আমাদের সতর্ক করছেন না, তিনি আমাদের কাপড় ধরে টেনে আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিতে চাইছেন, কিন্তু আমরা তার তোয়াক্কা না করে আগুনের দিকেই ধেয়ে চলেছি। যাই হোক, এরপর জিবরীল(আঃ) জান্নাতের দিকে গেলেন এবং দেখতে পেলেন জান্নাতের পথে এতগুলি বাধা-বিপত্তি এবং জান্নাত সবরকম অপছন্দনীয় বস্তু দ্বারা বেষ্টিত। এরপর জিবরীল (আঃ) আল্লাহ তাআলার কাছে ফিরে এলেন এবং বললেন, “এখন আমার মনে হয় না কেউ জান্নাতে যেতে পারবে, বরং সবাই জাহান্নামে পতিত হবে।”
আন-নববী, যিনি সহিহ মুসলিম এর হাদিসের ব্যাখ্যায় অন্যতম সেরা, তিনি এই হাদিস সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “জাহান্নাম ও জান্নাত পর্দা দ্বারা আবৃত। একজন জান্নাত বা জাহান্নামে যেতে পারবে না যদি সে পর্দাটি অতিক্রম করতে না পারে। আর এই পর্দা ভেদ করে জান্নাতে যাবার উপায় হচ্ছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় ও কঠিন কাজগুলির মধ্যে দিয়ে যাওয়া। উদাহরণস্বরূপ, ইবাদাতের প্রতি খুবই সচেষ্ট ও দায়িত্বশীল থাকতে হবে। ধৈর্যশীল, ক্ষমাশীল, করুণাময়, দানশীল হতে হবে, ক্রোধ দমন করতে হবে, পাপ হতে দূরে থাকতে হবে।” সুতরাং জান্নাত লাভ করতে হলে এই কাজগুলি করতে হবে যতই কঠিন ও অপছন্দনীয় হোক না কেন।
আমরা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি যে জান্নাতের বাসিন্দারা জাহান্নামের বাসিন্দাদের সহায়-সম্পত্তির মালিকানা ভোগ করবে। দুনিয়াতে বসবাসকারী সকল মানুষের জান্নাতে কিছু না কিছু সম্পত্তি আছে। কারণ আমাদের আদি আবাসস্থল হচ্ছে জান্নাত, সেখান থেকেই আমাদের আবির্ভাব ঘটেছে। আমরা পরবর্তীতে একরকম অন্য যায়গায়(দুনিয়ায়) নিজেদের আশ্রয় করে নিয়েছি, আর একেই আমরা জন্মস্থান বলি, যদিও আমাদের প্রকৃত উৎস হচ্ছে জান্নাত। আমরা জান্নাতের উত্তরসূরি, কেননা আদম(আঃ) ও হাওয়া(আঃ) হচ্ছে আমাদের আদি পিতা-মাতা যাদের জন্ম জান্নাতে হয়েছিল। যে কারণে প্রত্যেকেরই জান্নাতে আশ্রয়স্থল বা কিছু না কিছু সম্পত্তি আছে। একজন যদি দুনিয়াতে পাপকর্ম ও অবাধ্যতায় জীবন ব্যয় করতে চায়, পরিশেষে সে জাহান্নামে পতিত হবে আর জান্নাতে তাদের সম্পত্তিগুলোর মালিকানা চলে যাবে সেই অল্প কয়েকজন আদমসন্তানের হাতে যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে। সুতরাং জান্নাতের একজন বাসিন্দা হয়তো অনেক সম্পদের মালিক হয়ে যাবে কারণ আমরা জানি জাহান্নামের বাসিন্দাদের তুলনায় জান্নাতের বাসিন্দাদের সংখ্যা অনেক কম হবে, এক হাজারে একজন জান্নাত লাভ করবে, বাকিরা জাহান্নামে পতিত হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন, “এই যে, জান্নাতের উত্তরাধিকারী তোমরা হয়েছ, এটা তোমাদের কর্মের ফল।” ৪৩-৭২ অর্থাৎ, একজনের সৎকর্মগুলির কারণে তাকে জান্নাতে সম্পদের উত্তরাধিকারী করা হবে।
রসুলুল্লাহ(সঃ) সহিহ বুখারিতে বলেন, “জান্নাতে বসবাসকারীদের অধিকাংশ হবে ‘আদ-দুয়াফা’দের অন্তর্ভুক্ত।” তিনি বলছেন, “আমি কি তোমাদের জান্নাতের বাসিন্দাদের সম্পর্কে বলবো? এর মধ্যে থাকবে প্রতিটি গরিব বিনয়ী ব্যক্তি এবং সে যদি কিছু করার জন্য আল্লাহর নামে শপথ করে, আল্লাহ তা মঞ্জুর করবেন। যেখানে জাহান্নামের বাসিন্দাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে সকল নিষ্ঠুর, কঠোর, অহংকারী ব্যক্তি।”
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: জান্নাত ও জাহান্নাম পরস্পর বিতর্ক করবে। জাহান্নাম বলবে, আমাকে প্রতাপশালী, শক্তিধর, স্বৈরাচারদের দেয়া হয়েছে। আর জান্নাত বলবে, আমার যে কী হলো? শুধু আমার এখানে দুর্বল আর সমাজের পতিত মানুষগুলো আসছে। তখন আল্লাহ জান্নাতকে বলবেন: তুমি হলে আমার রহমত ও করুনা। আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা আমার রহমত দ্বারা অনুগ্রহ করি। আর তিনি জাহান্নাম-কে বলবেন: আর তুমি হলে আমার আযাব। বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা আমি আমার আযাব দিয়ে শাস্তি দিয়ে থাকি। (বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
গরিব ব্যক্তিরা সাধারণত বিনয়ী হয়ে থাকে। তাদের এমন কোন সম্পত্তি বা এমন কিছু থাকে না যা তাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে। তাই তারা সাধারণত সৎকর্মের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এজন্য জান্নাতের জনসংখ্যার সিংহভাগ তারাই দখল করে রাখবে। এর মানে অবশ্য এই না যে কারো যদি অর্থ-সম্পদ থেকে থাকে তাহলে তারা জান্নাত থেকে বঞ্চিত হবে। একজন ব্যক্তি কোথায় গিয়ে থামবে, জান্নাতে না জাহান্নামে এর পিছে টাকাপয়সার কোন ভূমিকা নেই, বরং এটা কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে তার গন্তব্যস্থল। কেউ যদি সৎ উদ্দেশ্যে, সৎপথে তার সম্পদ ব্যয় করে, তবে তার এই অতিরিক্ত ত্যাগ এর কারনেই সে জান্নাতে একজন দরিদ্র ব্যক্তির চেয়ে বেশি মর্যাদা পাবে। সাহাবাদের মধ্যে যে ১০ জনকে জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই ছিল সবচেয়ে ধনীদের অন্তর্ভুক্ত। আবু বকর আস-সিদ্দিক, উমার ইবন আল-খাত্তাবদেরকে সম্পদশালী সাহাবা হিসেবে গণ্য করা হত। উসমান ইবন আফফান সন্দেহাতীতভাবে ছিলেন সবচেয়ে ধনীদের একজন। আব্দুর রাহমান ইবন আউফ, যিনি সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জনের একজন ছিলেন, তিনি ছিলেন সে সময়কার কোটিপতি। একই কথা আলি ইবন আবি তালিব এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, তিনিও সম্পদশালী ছিলেন। কিন্তু তারা জানতেন যে তাদের এই সম্পত্তি কিভাবে খরচ করতে হবে। সমস্যা হল এটা যে, যখন কোন ব্যক্তির দুর্বলতা দূর হয়ে যায়, অর্থবিত্তের মোহ তাকে প্রলুদ্ধ করে, তখন সে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। দরিদ্র ব্যক্তির যেহেতু এতকিছু থাকে না, তারা সাধারণত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বেশি নিকটবর্তী হয়ে থাকেন। এছাড়াও কারো যদি অনেক সম্পত্তি থেকে থাকে, সম্পদের হাত ধরেই ক্ষমতা আসে। যথেষ্ট টাকাপয়সা থাকলে অনেক কিছু সম্ভব হয় যা অন্যদের পক্ষে সম্ভব না, আর এটাই ক্ষমতা। এটা একজন মানুষকে এই অনুভুতি দিবে যে সে স্বাবলম্বী, তার আর কারো সাহায্য প্রয়োজন নেই, যদি সেই সাহায্য আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে তবুও। আর ঠিক এটাই কারূন বলেছিল। রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেছিলেন, “সম্পদ তোমাদের সীমা লঙ্ঘন করতে বাধ্য করবে।” সুতরাং সম্পদের কথা যদি আসে, আখিরাতে এটি আমাদের জন্য কি ভূমিকা রাখবে এর সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান রাখা গুরুত্বপূর্ণ। রসুলুল্লাহ(সঃ) বলেন, “আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাই সবচেয়ে ভালো জানেন তার সৃষ্টির জন্য কোন জিনিসটা উত্তম। কিছু মানুষের জন্য সম্পদই উত্তম, আল্লাহ যদি তাদের দরিদ্র করে দুনিয়ায় পাঠাতেন সেটাই তাদের অসৎ করে দিত। আর কিছু মানুষের জন্য দারিদ্র্যই উত্তম, আল্লাহ তাদের সম্পদ দান করলে সেটা তাদের জন্য ধ্বংসের কারণ হিসেবে দাঁড়াতো। কিছু মানুষের জন্য স্বাস্থ্যই উত্তম, আল্লাহ যদি তাদের অসুস্থতা দান করতেন, সেটা তাদের ক্ষতির কারণ হত। আর কিছু মানুষের জন্য অসুস্থতাই উত্তম, আল্লাহ যদি তাদের সুস্থতা দান করতেন, তবে সেটাই তাদের পথভ্রষ্ট করে দিতো। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন, এবং আমাদের জন্য কি উত্তম সেটা তিনিই ভালো জানেন’।