আজকে আমরা আমাদের ‘পরকালের পথে যাত্রা’ সিরিজের শেষ পর্বে এসে উপস্থিত হয়েছি, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের জন্য- লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। ধারাবাহিকভাবে মৃত্যু থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে, সাকারাতুল মাউত অর্থাৎ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ, কবরের জীবন, কিয়ামতের আলামতসমূহ, কিয়ামত, পুনুরুত্থান, হিসাব, পুলসিরাত, জাহান্নাম এবং জান্নাতের আলোচনার মাধ্যমে আজকে আমরা ২২নম্বর সেশনে এসে উপস্থিত হয়েছি, আজকের আলোচনা সমাপ্ত হবে ইনশা আল্লাহ জান্নাতের অবশিষ্ট আলোচনার মাধ্যমে- যেখানে আমরা প্রধানত আলোচনা করব কারা দুনিয়া থাকতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন, এবং আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসুন শুরু করা যাক, প্রথমেই একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্নের উত্তর জানা যাক ! জান্নাতে কাদের সংখ্যা বেশি-নারী না পুরুষ? -জান্নাতের অধিকাংশ মানুষ কারা? নারী না পুরুষ? আবু হুরায়রা সাহাবাদের মধ্যে একটি কথোপকথন শুনলেন। উপস্থিত পুরুষদের মধ্যে এমন কেউ কেউ ছিলেন যারা গর্ব ভরে বলছিলেন যে জান্নাতে পুরুষদের সংখ্যা নারীদের থেকে বেশি। এরপর আবু হুরায়রা সেখানে একটি মন্তব্য করলেন, হাদীসটি সহীহ মুসলিমে রয়েছে, আবু হুরায়রা সেখানে উপস্থিত লোকসকল যারা জান্নাতে পুরুষদের সংখ্যা বেশি’ এটা নিয়ে গর্ব করছিল তাদের যুক্তি খণ্ডন করার কাজে ব্যবহার করলেন। আবু হুরায়রা তাদেরকে বললেন, জান্নাতে কোণ পুরুষ অবিবাহিত থাকবেন না, আর প্রত্যেক পুরুষের জন্য দুইজন স্ত্রী থাকবেন, কাজেই জান্নাতের নারীদের সংখ্যা পুরুষদের দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। কাজেই এই সংবাদটি বোনদের জন্য একটি আনন্দের বিষয়। যাই হোক, বোনদের জন্য একটি ছোট্ট আশংকাও আছে- আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত জানি না, সেই দুইজন স্ত্রী কি দুনিয়ার মানুষদের মধ্য থেকে হবেন নাকি তারা হুর আল আইন দের মধ্য হতে হবেন। উপরন্তু সহীহ মুসলিম এবং বুখারীতে বর্ণিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ সা) বলেছেন, জাহান্নামীদের অধিকাংশ মহিলা। ‘আর আমি জাহান্নামের প্রবেশ পথে দাড়ালাম। দেখলাম, যারা প্রবেশ করছে তাদের অধিকাংশ নারী’। (বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : হে নারীগণ! তোমরা দান-সদাক করো। বেশী বেশী করে আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। কেননা আমি জাহান্নামে তোমাদের অধিকহারে দেখেছি। এ কথা শোনার পর উপস্থিত মহিলাদের মধ্য থেকে একজন -যার নাম ছিল জাযলা- প্রশ্ন করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের কেন এ অবস্থা? কেন জাহান্নামে আমরা বেশী সংখ্যায় যাবো? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমরা স্বামীর প্রতি বেশী অকৃতজ্ঞ ও অভিশাপ দাও বেশী। (বর্ণনায় : মুসলিম)
বলতে খারাপ শুনালেও আসলে আমাদের সমাজের নারীদের বাস্তব চিত্র এ রকমই যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। আমি দাম্পত্য জীবনে অনেক সুখী নারীকে দেখেছি তারা স্বামীর প্রতি অনেক সময় তুচ্ছ বিষয়ে চরম অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকে। অনেক সময় সামান্য বিরক্ত হলে নিজ সন্তানদেরও অভিশাপ দেয়। নারীদের জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য এ দুটো স্বভাব পরিহার করতে হবে অবশ্যই। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বলার উদ্দেশ্য এটাই। তিনি নারীদের স্বভাব সংশোধন করার জন্যই এ কথা বলেছেন। নারীদের খাটো করা বা তাদের ভূমিকা অবমুল্যায়নের জন্য বলেননি।
শিশুরা – জান্নাত না জাহান্নাম? শিশুদের ক্ষেত্রে কি হবে? তারা কি জান্নাত লাভ করবে না জাহান্নামে যাবে? আসুন, শিশুদেরকে দুইভাগে ভাগ করা যাক। মুসলিমদের শিশু সন্তান এবং কাফিরদের শিশু সন্তান। আর শিশু বলতে তাদেরকেই বুঝানো হয়েছে যারা বালেগ হওয়ার পূর্বে মারা যায়। ইসলামে বয়সন্ধিকাল বলে কিছু নেই, হয় আপনি একজন বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক অথবা আপনি একজন নাবালেগ বা অপ্রাপ্তবয়স্ক। মুসলিমদের শিশু সন্তান আন নওয়াবী বলেন, আলেমদের ঐকমত রয়েছে যে, মুসলিমদের যে সকল সন্তানাদি দায়িত্বশীল হওয়ার বয়সের পূর্বে মারা যায়, তাকলিফের আগে, তারা জান্নাতে যাবে। আল্লাহ কুর’আনে বলেন, ‘যারা ঈমানদার এবং যাদের সন্তানরা ঈমানে তাদের অনুগামী, আমি তাদেরকে তাদের পিতৃপুরুষদের সাথে মিলিত করে দেব এবং তাদের আমল বিন্দুমাত্রও হ্রাস করব না। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃত কর্মের জন্য দায়ী’ (তুর ২১)। এবং এই সন্তানদের পিতার ব্যপারে বুখারী বর্ণনা করছেন, রাসুল সা) বলেন, একজন মুসলিমের যদি তিনটি সন্তান নাবালেগ অবস্থায় মারা যায়, তাকে আল্লাহর রহমত জান্নাতে প্রবেশ করাবে। কাজেই, মুসলিমদের সন্তানরাও জান্নাতে প্রবেশ করবে, মুসলিম পিতাও জান্নাতে প্রবেশ করবে। মায়ের ব্যাপারে কি হবে? বুখারী বর্ণনায়-আবু সাঈদ আল খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, স্ত্রী লোকেরা নবী করীম সা) কে বলল, পুরুষরা আমাদেরকে পরাজিত করে রেখেছে (অর্থাৎ রাসূল সা) এর অধিকাংশ সময় পুরুষরা নিয়ে নিয়েছে, মহিলাদের জন্য আলাদা কোন সময় ছিল না ) তারা বলল, সুতরাং, আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করে দিন। তিনি তাদেরকে একটি দিনের প্রতিশ্রুতি দিলেন। সেদিন তিনি তাদের সাথে সাক্ষাত করে তাদেরকে উপদেশ আদেশ দিতেন। একবার তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, তোমাদের যেকোন নারীর তিনটি সন্তান মারা গেলে তা তার জন্যে জাহান্নামের আগুন থেকে পর্দাস্বরূপ হবে। একজন মহিলা বলল, যদি দুটি সন্তান হয়? তিনি বললেন, দুটি হলেও। আবু হুরায়রা রা) বলেন, উক্ত হাদীসে বর্ণিত তিনটি সন্তান হওয়ার অর্থ এমন সন্তান যারা গুনাহ করার বয়স হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছে।
এ বিষয়ে একটি সতর্কতা; সাধারণভাবে, আমরা বলে থাকি যে মুসলিমদের শিশু সন্তানাদি জান্নাতে যাবে, কিন্তু আমরা গ্যারান্টি দিতে পারিনা- সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারিনা-যে অমুক ব্যক্তিটি জান্নাতে যাবেই। কারণ-আয়েশা রা) থেকে বর্ণিত- একটি শিশু মৃত্যুবরণ করল এবং আমি বললাম ‘এই শিশুটির জন্য সন্তুষ্টি রয়েছে যে কিনা জান্নাতের পাখিদের মধ্যে একটি পাখি’ রাসুলুল্লাহ সা) বলেন, ‘তুমি কি জান না, আল্লাহ জান্নাত সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি জাহান্নাম সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি জান্নাত এবং জাহান্নামের বাসিন্দাও সৃষ্টি করেছেন’। অন্য কথায়-রাসূল সা) আয়েশার কথাটি পছন্দ করেননি, কারণ তিনি সুনর্দিষ্টভাবে বলছিলেন যে এই বাচ্চাটি জান্নাতে যাবে।
কাফিরদের সন্তানাদি মুশরিকদের সন্তানাদির কি হবে? বুখারী, রাসুলুল্লাহ সা) কে অমুসলিমদের সন্তানাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। রাসূল সা) বলেন, যখন আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি জানেন তারা কি করবে, কাজেই এখানে এই বিষয়টি রাসূল সা) উন্মুক্ত ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা এই বিষয়ে বিচার করব না যে, তাদের কি পরিণতি ঘটবে। ইবন হাজার এই হাদীসের ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন , তিনি বলেন, আবু ইয়ালা থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীস রয়েছে যেখানে রাসূল সা) আল্লাহর কাছে আবেদন করেন যেন তাকে মানবজাতির সকল শিশুদের ব্যাপারে সুপারিশ করার অনুমতি প্রদান করা হয়-মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে। তিনি তাদের জন্য শাফায়া করেন। রাসূল সা) বলেন যে, আল্লাহ আমাকে সেটা প্রদান করেছেন। এই হাদীসটি হাসান, সহীহ নয়। আমরা এটাকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করতে পারি কিন্তু এটা পূর্বের হাদীসটির মত এত শক্তিশালী নয়। তৃতীয় আরেকটি হাদীস, যা বর্ণিত হয়েছে আবু নাঈমে এবং আবু ইয়ালাতে, যেখানে রাসূল সা) বলেছেন যে, অমুসলিমদের শিশু সন্তানাদিরা জান্নাতীদের খাদেম হবে। সুতরাং তারাও জান্নাতে থাকবে কিন্তু খাদেম হিসেবে, আলেমগণ বলেছেন যে এই হাদীসটি সহীহ। এখন, এই হাদীসগুলোর মধ্যে আলেমগণ কিভাবে সমন্বয় সাধণ করেছেন? কিছু উলামা বলেছেন, সকল শিশুরাই মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে- সবাই জান্নাতী। এই মত দিয়েছেন, আল যাওয়ী, আন নাবওয়ী, এবং আল কুরতুবী। আল কুরতুবী বলেন, এই বিষয়টিতে রাসূল সা) সময়ের ব্যবধানে বিস্তারিত ইলম লাভ করেছেন। শুরুতে তিনি বলেছেন, এরা তাদের পিতাদের সাথে জাহান্নামী হবে। পরবর্তীতে, তিনি বলেছেন এই বিষয়টি আমাদের বিচার করার বিষয় নয় যে, তাদের পরিণতি কি হবে। এরপর, তিনি বলেছেন, তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে এবং তারা জান্নাত লাভ করবে। আল কুরতুবী বলেন, একারণেই এই বিষয়ে আমরা বিরোধপূর্ণ দলীল দেখতে পাই। আরেকটি মত হচ্ছে, তাদের উপর আমরা বিচারক নই। আল্লাহ তাদেরকে বিচারের দিনে পরীক্ষা করবেন। আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি, কিভাবে পাগল অন্ধ এবং বধির ব্যক্তিকে আল্লাহ পরীক্ষা করবেন। এবং এটা হচ্ছে আবু হাসান আল আশয়ারী এর মত। আবু হাসান এটাকে আহলুস সুন্নাহ এর অফিসিয়াল অবস্থান বলে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম ইবন তাইমিয়া এ বিষয়য়ে একমত পোষণ করেছেন। আমরাও এই বিষয়টিকে এখানে ছেড়ে দেই, এ বিষয়ে মতপার্থ্যক্য আছে। এবং এটা গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। আমরা ততটুকু পর্যন্ত কথা বলতে পারি যতটুকু সম্পর্কে আমরা জানি, কিন্তু এর বাইরে আমরা কথা বলব না।
যাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে
জান্নাতের নিশ্চয়তা যে কেউ পেয়েছে এটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। এটা সীমালঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে। কোন ব্যক্তিকে জান্নাত বা জাহান্নামে পাঠানোর কথা বলে আপনি নিজেকে আল্লাহর পর্যায়ে তুলে নিচ্ছেন (নাউযুবিল্লাহ)।
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন: “কোন ব্যক্তির ভালো আমল তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না”। সাহাবারা বললেন: “এমনকি আপনাকেও না হে আল্লাহর নবী?” রাসূল (সাঃ) প্রত্যুত্তরে বললেন, “এমনকি আমাকেও নয়, যদি না আল্লাহর রহমত এবং অনুগ্রহ আমার উপর বর্ষিত হয়”। যদি রাসূল (সাঃ) এর মত একজন ব্যক্তি বলেন যে তাঁর আমল তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না-তাহলে আমাদের অবস্থানটা কি হবে চিন্তা করে দেখুন তো?
পুরুষদের মধ্য থেকে
তিরমিযী’র এক হাদীসে এসেছে, হযরত ’আলী (রা) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে রাসূল (সাঃ) তাঁকে বলেছেন: ‘তারা উভয়ে বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুবরণকারী মুসলিমদের সরদার হবে- তারা পূর্ববর্তী উম্মতের লোক হোক আর পরবর্তী উম্মতের। তবে নবী রাসূলগণ ব্যতীত।”। রাসূল (সাঃ) বলেন, “আম্বিয়াদের পরেই জান্নাতীদের মধ্যে তাঁরা দুজন সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি”। তারপর রাসূল (সাঃ) ’আলী (রাঃ)কে বলেন, “তাঁদেরকে তুমি একথা জানিয়ো না” -তিরমিযি। সুতরাং আম্বিয়াদের পরে আবু বকর (রাঃ) এবং ’উমার (রাঃ) আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি। তিরমিযি, মানাকেব অধ্যায়, হাদিস:২৮৯৭
তিরমিযীতে আরো একটি বর্ণনায় এসেছে যে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে জান্নাতে তরুণদের সর্দার হবে হাসান (রাঃ) এবং হুসাইন (রাঃ)”। তারা রাসূল (সাঃ) এর নাতি, ’আলী বিন আবি তালিব (রাঃ) এর সন্তান। তিরমিযি, হাদিস: ৩৭৪১; ইবনে মাযাহ, হাদিস:১১৮
আহমাদে বর্ণিত একটি হাদীসে রয়েছে, “একজন ফেরেশতা রাসূল (সাঃ) এর নিকট আসলেন এবং রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে এই ফেরেশতা কখনোই তাঁর নিকট আগমন করেননি। সেই ফেরেশতা রাসূল (সাঃ) কে এটা বলতে এসেছিলেন যে জান্নাতে যুবকদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিদ্বয় হলেন হাসান (রাঃ) এবং হুসাইন (রাঃ)”।
কেন বয়স্ক এবং তরুণদের কথা বলা হল? জান্নাতে কি সবাই সমবয়সী হবে না? হ্যা, কিন্তু কিছু মানুষকে বয়স্ক বলার কারণ তাঁরা বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আর কিছু মানুষকে তরুণ বলার কারণ হল তাঁরা অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
নারীদের মধ্য থেকে
রাসূল (সাঃ) বালুর মধ্যে লাঠি দিয়ে চারটা রেখা টানলেন আর বললেন, “তোমরা কি জানো কেন আমি এই লাইন চারটি টানলাম?” সাহাবারা বললেন, “না আল্লাহর রাসূল (সাঃ)”। রাসূল (সাঃ) বললেন, “জান্নাতে নারীজাতির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন চারজন-মারইয়াম বিনত ’ইমরান, খাদিজা বিনত খোয়াইলিদ, ফাতিমা বিনত মুহাম্মাদ এবং আসিয়া ইবন মুযাহিম”।
কেন রাসূল (সাঃ) ঐ লাইন চারটি টেনেছিলেন? এটা ছিল সাহাবাদের মনযোগ আকর্ষণের জন্য একটি নির্দেশনামুলক পদ্ধতি। সাধারণত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মনযোগ আকর্ষণের জন্য এরকম করেন। তিনি (সাঃ) জানতেন যে উত্তরটি তাঁদের অজানা, কিন্তু তিনি তাঁদের মনযোগ আকর্ষণের জন্য এটা করেছিলেন। রাসূল (সাঃ) এটা প্রায়ই করতেন।
সুতরাং, নারীদের মধ্যে এ যাবৎ সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ যে নারী পৃথিবীর বুকে বেঁচেছিলেন তিনি হলেন- মারইয়াম বিনত ’ইমরান (ঈসা আঃ এর মাতা)। তারপরেই রয়েছেন হযরত খাদিজা (রাঃ), তৃতীয় হলেন ফাতিমা (রাঃ) এবং চতুর্থ হলেন ’আসিয়া।
প্রথমজন, মারইয়াম সম্বন্ধে স্বয়ং আল্লাহ পাক কুরআনে বলেছেন: “আর যখন ফেরেশতা বলল হে মারইয়াম!, আল্লাহ তোমাকে পছন্দ করেছেন এবং তোমাকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। আর তোমাকে বিশ্ব নারী সমাজের উর্ধ্বে মনোনীত করেছেন” (৩:৪২)
পরবর্তী আছেন, খাদিজা রা) । আমরা জিবরাঈল (আঃ) এর হাদীসটি বর্ণনা করেছি যেখানে জিবরাঈল (আঃ) সালাম প্রেরণ করেছিলেন খাদিজা (রাঃ) এর প্রতি তাঁর পক্ষ থেকে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আর তাঁকে জান্নাতে একটি প্রাসাদের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন। আমল অনুযায়ী পুরস্কার- খাদিজা (রাঃ) মক্কাতে স্বল্প পরিসরের একটি জায়গায় বাস করতেন, তাই আল্লাহ তাঁকে জান্নাতে একটি প্রাসাদ প্রদান করেছেন। তাছাড়া খাদিজা (রাঃ)কে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল কেবলমাত্র রাসূল (সাঃ)কে সহযোগিতা করার জন্য আর এই কারণেই আল্লাহ জান্নাতে তাঁকে চিরশান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করবেন।
এবং, আসিয়া সম্বন্ধে আল্লাহ্ রাব্বুল ’আলামিন বলেছেন: “আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের জন্যে ফেরাউন-পত্নীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। সে বললঃ হে আমার পালনকর্তা! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্যে একটি গৃহ নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরাউন ও তার দুস্কর্ম থেকে উদ্ধার করুন এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিন।”। (৬৬:১১) আসিয়া বিনত মুযাহিম পৃথিবীর বুকে ফেরাউনের নির্মিত সবচেয়ে চাকচিক্যময় প্রাসাদে বাস করতেন। দুনিয়ার বুকে একজন মানুষ যা কিছু আকাঙ্খা করতে পারে তার সবই আসিয়ার ছিল, কিন্তু তারপরও তিনি বলেছেন: “ও আল্লাহ্, আমাকে জান্নাতে একটি প্রাসাদ দান করুন”। সুবহানাল্লাহ্, এমন একজন মহিলার কথা আমরা বলছি যাকে যাবতীয় জাগতিক সামগ্রী প্রদান করা হয়েছিল কিন্তু তিনি বলেছেন তাঁর এগুলোর কিছুই প্রয়োজন নেই, তিনি চেয়েছিলেন জান্নাতে একটি শান্তিময় স্থান আর ফেরাউন এবং তার কৃতকর্ম থেকে মুক্তি। আসিয়ার সবকিছু ছিল, ক্ষমতা, সম্পদ, খ্যাতি কিন্তু এগুলো কিছুই তিনি চাইলেন না। অথচ, বর্তমানে নারীরা কত সামান্য বিনিময়ে, নিজেদের নষ্ট করছে।
আমরা চারজন জান্নাতী নারীর কথা জানলাম, বরং তারা হচ্ছেন জান্নাতী নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাদের মধ্যে কী এমন বিষয় ছিল যা তাদেরকে অপরাপর নারীদের থেকে মর্যাদা শ্রেষ্টত্ব দান করল? তার কোন পেশা বেছে নিয়েছিলেন, তাদের ক্যারিয়ার কী ছিল?
যদি আমরা বিশ্লেষন করি এবং মিল খুঁজে বের করি, আমরা দেখতে পাব, এই চারজন নারীর সর্বোচ্চ মর্যাদার কারণ কোন নির্দিষ্ট পেশার অধীন জীবনধারা ছিল না, যে জীবনধারা বর্তমান যুগের নারীবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎরা তাদের অনুসারীদের জন্য কামনা করেন। লক্ষ্য করে দেখুন এই চারজন মহীয়সী নারীর মধ্যে একটা ব্যাপারে খুব মিল ছিল-তাঁরা সকলেই কোন না কোনভাবে নবী-রাসূলদের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুইজন সরাসরি আল্লাহর দুইজন ক্ষমতাবান আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম)কে প্রতিপালন করেছেন, বড় করে তুলেছেন, দেখাশোনা করেছেন, যত্ন নিয়েছেন- মা এর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তাঁরা হলেন মারইয়াম ও আসিয়া। মারইয়াম হযরত ঈসা (আঃ)কে লালন-পালন করেছেন আর আসিয়া হযরত মূসা (আঃ)কে প্রতিপালন করেছেন। তাই এটা ছিল তাঁদের তারবিয়্যা-প্রচেষ্টা’ যার মাধ্যমে তাঁরা এই পৃথিবীর জন্য ঈসা (আঃ) এবং মূসা (আঃ) এর মত মহাপুরুষ তৈরি করেছিলেন আর এরই ফলস্বরূপ তাঁদেরকে আল্লাহ সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারিনী করেছেন। খাদিজা (রাঃ)কে এমন মর্যাদা দানের কারণ তিনিও একজন নবীর সহযোগী ছিলেন-রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)। তিনি তাঁকে (সাঃ) স্বীয় সম্পদ দ্বারা সহযোগিতা করেছিলেন এবং মানসিকভাবে তাঁকে স্বস্তি দিয়েছিলেন, মানসিক সমর্থন, স্বামীকে তাঁর সৎকাজে সহযোগিতা করা, মানসিকভাবে সমর্থন দেয়া, খাদিজা রা) একজন আদর্শ স্ত্রী এর ভূমিকায় সফলতা অর্জন করেছেন। ফাতেমা (রাঃ) কে এরূপ মহান মর্যাদা দেয়ার কারণ তিনি এক পবিত্র সংসারে বড় হয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর পিতার সাথে সকল দুর্দশার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তিনি একজন কন্যা হিসেবে সফলতা অর্জন করেছেন।
এটা রাসূল (সাঃ) এর জন্য সম্মানজক ব্যাপার ছিল কেননা দুইজন সর্বশ্রেষ্ঠ নারী তাঁর সাথে সম্পর্কিত ছিলেন-একজন তাঁর স্ত্রী আর অপরজন তাঁর কন্যা।
কাজেই, আপনি যদি সত্যিই একজন মুসলিম হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার জীবনের প্রধান অংশ এবং মূল অংশ হচ্ছে আখিরাত, দুনিয়া কেবল একটা ওয়েটিং রুমের মত! আজ আছি কাল নাই, কাজেই যখন আপনি আপনার নিজের জীবনের সফলতা ব্যর্থতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব করবেন, তখন দাড়িপাল্লার অপরপাশে আখিরাতকে রাখতে ভুলবেন না, এই চারজন নারী তারা দুনিয়ার অবস্থা, জাঁকজমক, বিলাসিতা, ক্ষমতার দম্ভ, লোকদেখানো ইত্যাদি কারনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেননি, তারা কয় সংখ্যার বেতন আয় করেন, সেটাও কোন বিষয় ছিল না, বরং তাদের সফলতার কারণ ছিল- তাদেরকে যে কারণে সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই ভূমিকা তারা সফলতার সাথে সম্পাদন করেছেন। এবং সৃষ্টিগতভাবে যেভাবে আল্লাহ পুরুষদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শীতা দান করেছেন, তেমনিভাবে তিনি নারীদেরকেও বিভিন্ন দিকে পারদর্শীতা দান করেছেন। কাজেই, নারীদের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে তারা যে কাজে পারদর্শী সেটার মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করবে। নারীরা একটি পুরো প্রজন্ম তৈরি করতে পারেন, একটি শিশু তার মায়ের সাথেই অধিকাংশ সময় কাটায়, এই শিশুদের গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি জেনারেশন গড়ে তোলা, এই দায়িত্বে নারীরা পুরুষদের চেয়ে অগ্রগামী। যতদিন অবধি না এই উম্মাহর নারীরা এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করবে যারা এই উম্মাহর অগ্রগতির পথিকৃৎ হবে, ততদিন পর্যন্ত এই উম্মাহ সামনে এগুতে পারবে না। আজকের উম্মাহর জন্য সবচেয়ে জরুরী যেটা, সেটা হল এমন এক নারীজাতি যারা এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করবে যাতে তাদের মাধ্যমে এই উম্মাহ সদর্পে সামনে এগিয়ে যাবে।
মূসা (আঃ) এবং ঈসা (আঃ) হলেন দুজন নারীর গর্ভজাত সন্তান যারা তাঁদেরকে বড় করে তুলেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, আপনি যদি মূসা (আঃ) এর জীবনী দেখেন তাহলে দেখবেন যে তিনি সার্বক্ষণিকভাবেই কয়েকজন নারী দ্বারা সহায়তাপ্রাপ্ত হন যারা সবসময় তাঁকে সহায়তে করেছিলেন এবং তাঁকে মূসা (আঃ) হিসেবে তৈরি করেছিলেন। প্রথমে ছিলেন তাঁর মা, এর পরে তাঁর বোন এবং পরবর্তীতে ফেরাউনের স্ত্রী, অতঃপর হযরত শু’আইব (আঃ) এর কন্যাদ্বয় এবং তারপরে শু’আইব (আঃ) এর কন্যা যিনি তাঁকে বিয়ে করেন।রাসূল (সাঃ) এর অবলম্বন ছিলেন দুইজন মানুষ-তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রাঃ) এবং চাচা আবু তালিব। তাঁরা দুজনেই এক সপ্তাহর ব্যবধানে ইন্তেকাল করেন আর এই কারণে সেই বছরটা ছিল মুহাম্মদ (সাঃ) এর জন্য সবচেয়ে কষ্টকর বছর।
আমরা আলোচনা করছিলাম, জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্তদের সম্পর্কে, প্রচলিত একটি ধারনা আছে যে, দশজন জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন,কিন্তু জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্তদের সংখ্যা দশজনেরও বেশি, কিন্তু একসাথে একই হাদীসে একত্রে যে দশজনের নাম এসেছে সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিবর্গ কারা?
সৌভাগ্যবান দশজন
তিরমিযীতে বর্ণিত আছে যে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আবু বকর জান্নাতী, ’উমার জান্নাতী, উছমান জান্নাতী, ’আলী জান্নাতী, তালহা জান্নাতী, আয-যুবাইর জান্নাতী, ’আব্দুর রহমান ইবন ’আউফ জান্নাতী, সা’দ জান্নাতী, সা’ঈদ জান্নাতী, আবু ’উবাইদা ইবন আল-জাররাহ জান্নাতী”।
আবু মূসা আল আশ’আরী কর্তৃক বুখারীর একটি বর্ণনায় আছে: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ’উছমান (রাঃ)কে বলেছিলেন, “আল্লাহ সুবহানাওয়াতা’আলা আপনাকে একটি পরিচ্ছদ (পরার জন্য) দান করবেন। মানুষজন এটা ছিনিয়ে নেয়ার জন্য আপনার সাথে বিগ্রহে লিপ্ত হবে; আপনি তাদেরকে সেটা দিবেন না”। ’উছমান তখন জানতেন না এ কথার মানে আসলে কি। সেই পরিচ্ছদ হল খিলাফত। ’উছমান ইবন আফফান (রাঃ) উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে রাসূল (সাঃ) এই ব্যাপারেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন; তিনি খিলাফত ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানান, কিন্তু তিনি এও বলেছিলেন যে এর বিভক্তির জন্য এক ফোঁটা রক্তপাতও তিনি চান না। সাহাবাদের মধ্যে অনেক তরুণ সাহাবীরা তাঁকে রক্ষ করতে প্রস্তুত ছিলেন-এদের মধ্যে ছিলেন আল হাসান এবং আল হুসাইন (রাঃ ’আনহুম)-কিন্তু তিনি চাননি যে তাঁর জন্য রক্তপাত শুরু হোক। খারেজিরা তাঁর গৃহে জোরপূর্বক প্রবেশ করে এবং ’উছমান (রাঃ)কে হত্যা করে যখন তিনি কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন আর মুসহাফের উপর তাঁর রক্ত ছড়িয়ে পড়ে।
আবু মূসা আল আশ’আরী বলেন যে তিনি ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করেছেন যেভাবে কূপের কিনারায় তাঁদের বসার অবস্থান বিন্যস্ত ছিল। রাসূল (সাঃ) বসেছিলেন কূপের কিনারায়, আবু বকর ও ’উমার (রাঃ ’আনহুম) ঠিক তাঁর (সাঃ) পাশেই বসেছিলেন। ’উছমান (রাঃ) একটু দূরে উল্টো পাশে বসেছিলেন কারণ রাসূলের পাশে যথেষ্ট বসার জায়গা ছিল না। রাসূল (সাঃ), আবু বকর এবং ’উমার (রাঃ ’আনহুম) আ’য়িশা (রাঃ) এর গৃহে সমাহিত কিন্তু ’উছমান (রাঃ) বাকিউ তে সমাহিত।
অন্যান্য যাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছিল
১) হামযা রা) – রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে ‘শহীদদের সর্দার হলেন হামযা (রাঃ)’। এর দ্বারা এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে তিনি জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানের বাসিন্দা।
২) জাফর ইবন আবি তালিব রা) – তিরমিযীতে বর্ণিত(?) আছে যে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আমি জা’ফর ইবন আবি তালিবকে দেখেছি জান্নাতে ফেরেশতাদের সাথে দুইটি পাখা নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন” কেন তিনি দুইটি পাখা নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন? তিনি ছিলেন রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানো সেনাবাহিনীর সেনাপতি। তিনি সমর পতাকা তাঁর হাতে বহন করছিলেন আর তাঁর দুটি বাহুই ছেদ করা হয়েছিল, তাই তিনি যুদ্ধপতাকাটি তাঁর বুকের উপর বহন করেছিলেন, আর এভাবেই তিনি শাহাদাত বরণ করেছিলেন। যেহেতু মৃত্যুর সময় তাঁর দুটি বাহু শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, সেই কারণে আল্লাহ্ তাঁর বাহুদ্বয়কে পাখা দ্বারা পরিবর্তন করেছেন।
৩) আবদুল্লাহ ইবন সালাম (রা)- মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে যে, যখন মু’আয ইবন জাবাল (রাঃ) মরণাপন্ন ছিলেন, তখন তাঁর এক ছাত্র বলেন, “আমাদের একটি উপদেশ দিন”। মু’আয ইবন জাবাল বলেছিলেন, “জ্ঞান তার স্বীয় স্থানেই রয়েছে; তুমি যদি এটা আকাঙ্খা কর, তাহলেই তুমি তাকে পাবে”। তিনি প্রথম যে কথাটি বলেছিলেন তার মানে হল যে জ্ঞান মৃত্যুবরণ করবে না কিংবা অদৃশ্য হবে না। তারপর তিনি বলেন, “যদি তুমি জ্ঞান আহরণ করতে চাও চারজন ব্যক্তির কাছে যাও: আবু দারদা, সাল আল-ফারসি, ’আব্দুল্লাহ্ ইবন মাস’উদ এবং ’আব্দুল্লাহ্ ইবন সালাম।’ আব্দুল্লাহ ইবন সালাম ছিলেন একজন ইহুদি যিনি পরবর্তীতে মুসলিম হন, এবং আমি রাসূল (সাঃ)কে বলতে শুনেছি যে তিনি (রাঃ) ছিলেন জান্নাতবাসী দশম ব্যক্তি”। আমরা বলছি না যে তিনি দশম ব্যক্তি হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবেন বরং এর দ্বারা এটা বুঝানো হচ্ছে যে তিনি সবার আগে জান্নাতে প্রবেশকৃতদের একজন। ’আব্দুল্লাহ্ ইবন সালাম ছিলেন মদীনার প্রধান ইহুদি ধর্মযাজক। তিনি তাওরাতে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) এর বর্ণনা সম্পর্কে জানতেনআর যখন রাসূল (সাঃ) মদীনায় আগমন করেন, তিনি তাঁকে চিনতে পারেন এবং তাঁর উপর ঈমান আনেন। তিনি জ্ঞানী ছিলেন বলেই সেই জ্ঞান তাঁকে মুসলিম হতে সাহায্য করেছিল। ইহুদিদের মধ্যে যাঁরা মুসলিম হয়েছিলেন, তাঁদের সংখ্যা ছিল অল্প, কিন্তু তাঁরা অনেক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন কারণ তাঁরা ছিলেন শিক্ষিত জাতি। আরবরা ছিল অক্ষর জ্ঞানহীন, কিন্তু ইহুদিদের কাছে আসমানী কিতাব ছিল যেটা তারা অধ্যয়ন করেছিল।
৪) যাইদ ইবন হারিসা – রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, “আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম আর একজন তরুণীকে দেখলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম: ‘আপনি কার সহধর্মিণী?’ সে জবাব দিল, “যাইদ ইবন হারিছার”। যাইদ ইবন হারিছা হলেন আরেকজন ব্যক্তি যিনি জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত।
৫) যাইদ ইবন আমর – আ’য়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম আর দেখলাম যে জান্নাতে যায়িদ ইবন ’আমর এর দুইটি স্থান ছিল”। যাইদ ইবন ‘আমর ইবন নুফাইল রাসূল (সাঃ) এর নবুওয়্যাত লাভের পূর্বে ইন্তেকাল করেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর সাথে জান্নাতে সাক্ষাৎ করেছিলেন। যাইদ, ইব্রাহিম (আঃ) এর দ্বীন প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সত্যের ওপর অবিচল থাকার এক অভূতপূর্ব উদাহরণ। তিনি কখনোই মূর্তির উপাসনা করেন নি। তিনি মানুষদের দাওয়াহ করতেন আর বলতেন যে এইসব মূর্তিসমূহ তোমাদের প্রভু নয়; তারা ভ্রান্ত; তোমাদের উচিত আল্লাহর ইবাদাত করা।তিনি মক্কার অধিবাসীদের জবাইকৃত মাংস খেতেন না। তিনি বলতেন যে আল্লাহ্ এই সকল মেষদের খাদ্য প্রদান করেন আর আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, কিন্তু যখন তোমরা তাদের জবাই কর, তোমরা এই ভ্রান্ত মূর্তিগুলোর জন্য সেগুলো জবাই কর?! তিনি এমন কোন পশুর মাংস ভক্ষণ করতেন না যেগুলো জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি; তিনি তাঁর ফিৎরাত থেকে এই বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, সুবহানাল্লাহ্। রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে জান্নাতে যাইদের দুটি স্থান ছিল।
৬) হারিছা ইবন নুমান রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, “আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম আর তিলাওয়াত শ্রবণ করলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কে সেই ব্যক্তি যিনি কুরআন তিলাওয়াত করছেন?” তাঁরা বলল, “হারিছা ইবন নু’মান”।
৭) বিলাল রা) রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, “আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম এবং কিছুর আওয়াজ শুনলাম (তিনি কারো পদচারণার আওয়াজ শুনেছিলেন) আর জিজ্ঞাসা করলাম, “ইনি কি?” জিবরাঈল (আঃ) বললেন, “ইনি বিলাল, মুয়ায্যিন”। যখন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, “বিলাল সফল হয়েছে”।
৮) আবু দারদা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আবু দারদা’ (রাঃ) কে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন তাঁর মহত্ত্বের জন্য। তিনি মদীনায় সর্বোৎকৃষ্ট ভূমি খয়রাত করেছিলেন। এছাড়াও আরও কিছু হাদীস রয়েছে যেগুলোতে অন্যান্য কিছু সাহাবীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে তারা জান্নাতী-তাদের মধ্যে আছেন আম্মার ইবন ইয়াসির, সালমান ফারেসী, উক্কাসা ইবন আবি মিহসান প্রমুখ সাহাবীগণ, আল্লাহ তাদের সকলের উপর রাযি হয়ে যান। সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি, সাহাবাগণ দলগতভাবে জান্নাতের সুসংবাদ লাভ করেছেন।
৯) দলগতভাবে জান্নাতের সুসংবাদ লাভঃ দলগতভাবে যারা জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন বদর যুদ্ধে এবং হুদায়বিয়ার সন্ধির পূর্বে গাছের নিচে বাইয়াত গ্রহণকারী সাহাবীগণ- “জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবলেছেন: বদরের যুদ্ধে এবং হুদাইবিয়ার সন্ধিতে অংশগ্রহণকারী কোন লোক জাহান্নামী হবে না।” (আহমদ, আল্লামা আলবানীর সিলসিলাতুল আহাদিস আস সহীহা, হাদিস: ২১৬০)
১০) আরও আছেন, মুহাজির সাহাবীগণ (রা) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকারীদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামজান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। “আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামবলেছেন: তোমরা কি জান যে, আমার উম্মতের মধ্যে কোন দলটি সর্ব প্রথম জান্নাতে যাবে? আমি বললাম: আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলই সর্বাধিক জ্ঞাত। তখন তিনি বললেন: মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকারীরা কিয়ামতের দিন জান্নাতের দরজায় আসবে আর তাদের জন্য দরজা খুলে যাবে। জান্নাতের দারওয়ান তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে- তোমাদের হিসাব নিকাশ হয়ে গেছে? তখন তারা বলবে কিসের হিসাব? আমাদের তরবারি আল্লাহর পথে আমাদের কাঁধে ছিল আর ঐ অবস্থায়ই আমরা মৃত্যুবরণ করেছি। তখন জান্নাতের দরজা তাদের জন্য খুলে দেয়া হবে। আর তারা অন্যদের জান্নাতে প্রবেশের চল্লিশ বছর পূর্বে সেখানে প্রবেশ করে আনন্দের অবস্থান করতে থাকবে। (আল্লামা আলবানীর সিলসিলাতুল আহাদিস, আস সহীহা, হাদিস: ৮৫২)
মুহাজির এবং আনসার সাহাবীদের সম্পর্কে সাধারণভাবে কুর’আনে উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ বলেন, “আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনছারদের মাঝে পুরাতন, এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কানন-কুঞ্জ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত প্রস্রবণসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান কৃতকার্যতা।” তাওবা ১০০
জান্নাত সংশ্লিষ্ট সর্বশেষ কিছু কথা-কিছু স্মরণিকা
১) জান্নাত আমাদের কর্মফলের বিনিময় মূল্য নয়
আমাদেরকে কর্মফলস্বরূপ জান্নাত প্রদান করা হবে না। আমরা যতই আল্লাহর ইবাদাত করি না কেন, তা কখনোই এক মূহুর্তের জন্যও আমাদের জান্নাত নিয়ে যাওয়ার জন্য যোগ্য নয়।
একটা গল্প আছে-আল্লাহু ’আলিম এর সত্যতা কতটুকু যেহেতু এটি একটি ইসরাঈলী বর্ণনা, আমরা একে সত্যও বলব না, মিথ্যাও বলব না-ঘটনাটি হচ্ছেঃ বনী ইসরা’ঈলের এক ব্যক্তি ছিল যে বহুকাল যাবৎ আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন ছিল। শেষ বিচারের দিন, তার সামনে পাহাড়সম নেক আমল উপস্থাপন করা হবে। ফেরেশতারা তাকে জিজ্ঞেস করবেন, “তুমি কি তোমার নেক আমলের বিনিময়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে চাও নাকি আল্লাহর রহমতের কারণে?” তারপর সে তার আমলের পাহাড়ের দিকে তাকাবে আর বলবে, “আমি আমার কৃত আমলের প্রতিদানস্বরূপ জান্নাতে প্রবেশ করতে চাই”। আল্লাহ্ তখন হুকুম করবেন ঐ লোকটির আমলের পাহাড়কে মীযানের এক পাল্লায় আর আল্লাহর রহমতকে অপর পাল্লায় স্থাপন করতে। যখনই আল্লাহর রহমতকে মীযানের এক পাল্লায় রাখা হবে তখনই লোকটির পাহাড়সম নেক আমল বাতাসে উড়ে যাবে। যে রহমতের দৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের ঘিরে রেখেছেন, তা ঐ লোকটির সারা জীবনের নেক আমলের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। যদিও সে ধারণা করেছিল যে সে আল্লাহর সবচেয়ে বেশি ইবাদতকারী একজন বান্দা, কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে কি সে একবারও গুনাহ্ করে নি? সে কি বিশ্রাম নেয় নি? তার কি উত্থান-পতন হয় নি? যদিও সে আল্লাহকে ইবাদাতের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে, তথাপি চব্বিশ ঘন্টা আল্লাহর রহমতে সে পরিবেষ্টিত ছিল, কিন্তু নিশ্চয়ই সে প্রতিদিন চব্বিশ ঘন্টা ইবাদতে কাটায় নি। এর সাথে তার কর্ণ, মন, সুস্বাস্থ্য, সম্পদ আর অন্যান্য নিয়ামত তো রয়েছেই…..
রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন যে, ‘তাঁর নিজের আমলও তাঁকে জান্নাতে প্রবেশের নিশ্চয়তা দিতে পারবে না’। এই হাদীস বুখারীতে বর্ণিত।
তাহলে আমাদের কৃত আমলের ভূমিকা কি? সেটা নির্ধারণ করবে জান্নাতের কোন স্থানে আমরা দাখিল হব। এজন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা যত বেশি সম্ভব নেক আমল সম্পাদনের চেষ্টা চালাবো।
জান্নাত সংশ্লিষ্ট খুঁটিনাটি কয়েকটি বিষয়-আমাদের দৈহিক আকৃতি, বয়স, ঘুম ইত্যাদি
২) দৈহিক গঠন রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহ্ ষাট বিঘত (প্রায় ৩০ মিটার) উচ্চতাসম্পন্ন আদম (আঃ) কে সরাসরি নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন পূর্ণ আকৃতিতে…সুতরাং, জান্নাতে যারা প্রবিষ্ট হবে; তাদের সবার আকার-আকৃতি হবে হযরত আদম (আঃ) এর ন্যায়। আদম সৃষ্টির পরবর্তীতে তাঁর থেকে উৎসারিত সন্তান-সন্ততি তথা মানবজাতির আকৃতি কালানুক্রমে হ্রাস পেয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে।” (বুখারী:৮/৭৪/২৪৬)
৩) বয়স কেমন হবে জান্নাতে? তিরমিযী শরীফে বর্ণিত আছে যে জান্নাতে প্রবিষ্টদের বয়স হবে তেত্রিশ বৎসর।
৪) ঘুম? রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন, “ঘুম মৃত্যুর ভ্রাতৃস্বরূপ আর জান্নাতীরা ঘুমাবে না। সেখানে থাকবে বিরামহীন আনন্দ- কে সেখানে ঘুমাতে চাইবে?
৫) জান্নাত আমাদের কল্পনার বাইরে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন যে সেখানে এমন সব নিয়ামত থাকবে যা কোন মানবচক্ষু কখনোই দেখেনি, কোন কান কখনোই শুনে নি এবং কোন হৃদয় কখনোই উপলব্ধি করতে পারেনি। এই হাদীসে বলা আছে যে তিনি জান্নাত সম্বন্ধে বর্ণনা করেন এবং তারপরে বলেন, “তোমাদের চিন্তার পরিধি এই দুনিয়াতেই সীমাবদ্ধ।”
একজন জন্মান্ধ ব্যক্তিকে আপনি যতই বলেন না কেন, দুধের রঙ সাদা, সে সাদা কি জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজের চোখে সেটা দেখতে পাচ্ছে। একইভাবে, আমরা যতক্ষণ নিজের চোখে জান্নাত না দেখতে পাচ্ছি, আমরা কিছুতেই এর সামান্যটুকুও কল্পনা করতে পারব না, এরপরও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বুঝানোর জন্য বিভিন্ন উদাহরণ এবং উপমা পেশ করেছেন যেন আমরা একে পাওয়ার জন্য আগ্রহী হই এবং শেষ পর্যন্ত নিজেরাই গিয়ে দেখতে সক্ষম হই, আসলে জান্নাত কিরূপ। আল্লাহ কবুল করেন, আমিন। একবার, কতিপয় নৃতত্ত্ববিদ একটি আদিম গোত্রের কাছে গিয়েছিলেন। সেই গোত্রটি প্রচন্ড গরম জলবায়ুবেষ্টিত একটি এলাকায় বাস করত, তাই তারা জীবনে কখনো তুষারপাত দেখেনি। সেই নৃতত্ত্ববিদরা তাদেরকে তুষারপাত কি রকম সেটার বর্ণনা দিতে লাগলেন ঐ এলাকার পরিবেশে বিদ্যমান বস্তুসমূহ দ্বারা যেগুলোর সাথে তারা পরিচিত ছিল। অতঃপর তাদের সামনে যখন তুষার দেখানো হল, তারা সেটাকে চিনতে পারলো না। ঠিক তেমনি, জান্নাতে প্রবেশ ব্যতীত আমরা কখনোই জান্নাতের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারবো না।
৬) জান্নাতে মলমূত্রত্যাগ বা থুতু নিক্ষেপ অথবা অন্য কোন ধরনের বিরক্তিকর ব্যাপার থাকবে না। “আপনি যখন সেখানে দেখবেন,তখন নেয়ামতরাজি ও বিশাল রাজ্য দেখতে পাবেন।”(৭৬:২০)
আল্লাহর দানের কারণে আমরা হব রাজার ন্যায় আর বোনদের ক্ষেত্রে, তারা হবে রাণীর ন্যায় ইনশাল্লাহ্। আল্লাহ্ বলেছেন: “কেউ জানে না তার জন্যে কৃতকর্মের কি কি নয়ন-প্রীতিকর প্রতিদান লুক্কায়িত আছে।”(৩২:১৭)
জান্নাত বনাম দুনিয়া
আল্লাহ্ মুহাম্মাদ (সাঃ)কে বলেছেন: “আমি এদের বিভিন্ন প্রকার লোককে পরীক্ষা করার জন্যে পার্থিবজীবনের সৌন্দর্য স্বরূপ ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ দিয়েছি, আপনি সেই সব বস্তুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন না। আপনার পালনকর্তার দেয়া রিযিক উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।”(২০:১৩১)
মুহাম্মাদ (সাঃ), যিনি ছিলেন দরিদ্র,আল্লাহ্ তাঁকে বলছেন যে অন্যকে তিনি যে সম্পদ ও বিলাস সামগ্রী দিয়েছেন, সেগুলোর দিকে দৃকপাত না করতে। তাদের অট্টালিকা, বাগান আর সম্পদের দিকে না তাকাতে, কারণ আল্লাহর নিকট যা রয়েছে তা অধিকতর উত্তম।
আমেরিকায় একটি অনুষ্ঠান আছে যেটাতে তারা আপনাকে বিখ্যাত ও সম্পদশালী ধনাঢ্যদের বিশাল প্রাসাদ ও বিলাসবহুল বাড়ীতে নিয়ে যায়। এবং বর্তমানে এ ধরণের বহু অনুষ্ঠান আছে, যেগুলোতে বিত্তশালী ব্যক্তিদের জীবন বিলাসিতা ইত্যাদি হাইলাইট করা হয়, একজন মুসলিম হিসেবে আমরা সতর্ক থাকব, যেন আমাদের অন্তর এগুলোর প্রতি আসক্ত না হয়ে যায়। আমরা আমাদের অন্তরকে দুনিয়ার মোহে আসক্ত করতে চাই না।
সবশেষে, এখন আমরা কিছু তুলনামূলক আলোচনা করব, এই দুনিয়ার সাথে আখিরাতের কয়েকটি বিষয়ে তুলমামূলক চিত্র আমরা তুলে ধরছি ইনশা আল্লাহ, যে চারটি বিষয়ে আমরা কথা বলতে চাই সেগুলো হচ্ছে,
১) সংখ্যাগত পরিমাণ,
২) গুনগত পরিমা্
৩) জান্নাত বিশুদ্ধ, দুনিয়া দূষিত,
৪) জান্নাত চিরস্থায়ী , দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী
অন্যতম এই চারটি বিষয়ের কারণে জান্নাত , দুনিয়া থেকে উত্তম:
১. পরিমাণ–কোয়ানটিটি–বা প্রাচুর্য্য: জান্নাতে সবকিছুর প্রাচুর্য্য মিনিমাম দুনিয়ার দশগুণের অধিক। আল্লাহ্ বলেছেন: “( হে রসূল) তাদেরকে বলে দিন, পার্থিব ফায়দা সীমিত। আর আখেরাত পরহেযগারদের জন্য উত্তম। আর তোমাদের অধিকার একটি সূতা পরিমান ও খর্ব করা হবে না। (৪:১৭৭)
‘ক্বালীল’ শব্দটিকে এখানে ‘সংক্ষিপ্ত’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, কিন্তু এখানে যেটা বলা হচ্ছে তার মর্মার্থ হল যে পরিমাণে খুবই অল্প। আল্লাহ্ জান্নাতে যা রেখেছেন তা অনেক ব্যাপক। সবার শেষে যে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তার কাছে এই দুনিয়ার দশগুণ পরিমাণ থাকবে।
২. গুনগত মান – কোয়ালিটি – বুখারীতে বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, “জান্নাতে একটি চাবুক পরিমাণ জায়গার মূল্য হবে পুরো দুনিয়া ও এর মধ্যস্থিত যাবতীয় সামগ্রীর চেয়ে উত্তম।” (বুখারী:৮/৭৬/৪২৪) সেই জায়গা কতটুকু স্থান দখল করবে? এক ইঞ্চি বাই এক ফুট? সুতরাং, ঐ পরিমাণ জায়গার মালিক যদি আপনি জান্নাতে হন, তাহলে সেটার মূল্য এই পুরো দুনিয়ার চাইতেও বেশি। জান্নাতে দূরত্বের পরিমাণ হিসাব করা হবে আলোক বর্ষের স্কেলে।
রাসূলুল্লাহ্ আরো বলেছেন: “আল্লাহর শপথ, দুনিয়ার সাথে আখিরাতের তুলনায় এরকম, যখন তোমাদের কেউ সমুদ্রের পানিতে তার আঙ্গুল (এটা বুঝানোর জন্য তিনি তাঁর তর্জনী নির্দেশ করছিলেন) ডুবিয়ে বের করার পর যে সামান্য পানিটুকু লেগে থাকে, দুনিয়া আখিরাতের নিকট সেরকমই নগণ্য।” (মুসলিম:৪০/৬৮৪৩) দুনিয়া আখিরাতের নিকট এক ফোঁটা পানির ন্যায় নগণ্য। আমরা সেই এক ফোঁটা পানির জন্য নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ–বিগ্রহ ও হানাহানিতে লিপ্ত! আমরা এক ফোঁটা পানির জন্য আমাদের দ্বীনকে অবহেলা করছি।
যদি সবাইকে প্রতিদিন ভোরে ফজরের নামাযে আসার জন্য ৫০০টাকা করে দেয়ার অঙ্গীকার করা হত, তাহলে মসজিদ লোকারণ্য হয়ে যেত। এই ৫০০টাকা কি জান্নাতের চেয়েও বেশি দামি? আসলে আমরা ভুল জিনিসের পিছনে ছুটছি, আমরা ভুল জিনিসের দাম কষাকষি করছি! রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, “আমি তোমাদের জন্য দারিদ্র্যের ভয় করি না আমরা দুশ্চিন্তা হল যে তোমরা সম্পদশালী হবে, আর যখন তোমরা সম্পদশালী হবে তখন তোমরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির ন্যায়। আর এটা তোমাদের ধ্বংস করবে ঠিক যেভাবে তাদেরকে ধ্বংস করেছিল।”
৩. জান্নাত পবিত্র, দুনিয়া কলুষিত
জান্নাতের সবকিছুই পবিত্র, অন্যদিকে দুনিয়ার সবকিছুই কলুষিত। দুনিয়ার সবকিছুই পঙ্কিল, নাপাকযুক্ত-এমনকি আপনি যেটাকে সবচেয়ে আনন্দদায়ক ভাবেন সেটাও। দুনিয়াতে absolute বা চূড়ান্ত আনন্দ বা চূড়ান্ত তৃপ্তি বলে কিছু নেই, দুনিয়ার সবকিছুরই কিছু না কিছু সাইড ইফেক্ট বা ত্রুটি আছে। দুনিয়ার কোন কিছুই পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ নয়।
চলুন দেখা যাক কিছু জিনিস যেগুলোকে আমরা আনন্দদায়ক ভাবি-উদাহরণস্বরূপ খাদ্যের কথাই ধরুন। এক মূহুর্তের জন্য ভাবুন আপনার পরিপাকতন্ত্র আপনার সামনে স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত করে দেয়া হল আর আপনি দেখতে পাচ্ছেন একবার খাবার মুখে যাওয়ার পর কি অবস্থা হয়। আপনি দেখছেন খাবার লালার সাথে মিশ্রিত হচ্ছে, রং পরিবর্তন হচ্ছে। আপনি দেখতে পাবেন এটা আপনার পেটের মধ্যে গিয়ে তরলের সাথে মিশ্রিত হচ্ছে। কেমন হয় যদি আপনি একই সাথে গন্ধও পান? যখন বদহজম হয়, তখন এই বাজে গন্ধের ব্যাপারটা আপনারা বুঝতে পারেন, এই পুরো পরিপাক ক্রিয়া দেখার পর আপনি পরবর্তীতে কারো সাথে বসে কখনোই খাওয়ার চিন্তা করবেন না! এতদ্বসত্ত্বেও আমরা খাবার ভালোবাসি, যদিও আভ্যন্তরীণভাবে সেটা একটা বিভীষিকাময় প্রক্রিয়া। যেমন- অনেকেই মাইক্রোস্কোপে দই দেখার পর, কিভাবে তার উপর জীবাণু ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা দেখার পর চিরদিনের জন্য সেটা খাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
আমরা ছবি কল্পনা না করে যদি চিন্তা করি, প্রজনন পদ্ধতির কথাই ধরুন, শুধুমাত্র পদ্ধতিটা একবার ভাবুন। যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি না করে দিতেন,তাহলে কেউই এ ধরণের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চাইত না । পুরো ব্যাপারটাই হতো নিদারূণ বিতৃষ্ণাময়। ইবনুল জাওযি চুম্বন সম্পর্কে চিন্তা করতে বলেছেন-‘যদি মানুষ এটা সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে চিন্তা করত, তারা কখনোই তা করত না’। সুতরাং, এটাই হল দুনিয়া, দুনিয়ার সবকিছু- মুখোশে ঢাকা। যখনই আপনি সেটা খুলবেন, তখন দেখতে পাবেন ভেতরে সেটা কত পঁচা।
আসুন জান্নাতে আছে আবার দুনিয়াতেও আছে, এমন চারটি উপাদানের মধ্যে তুলনা করা যাক। সেই চারটি জিনিস হচ্ছে, মদ, পানি, দুধ, মধু।
১) মদ-দুনিয়ার মদ বিশুদ্ধ নয়, তাতে নানা ক্ষতিকর উপাদান মিশ্রিত থাকে, অপরদিকে আল্লাহ্ জান্নাতের মদ সম্বন্ধে বলেন, “তাতে মাথা ব্যথার উপাদান নেই এবং তারা তা পান করে মাতালও হবে না।”(৩৭:৪৭)
২) পানি-যদি পানি কোথাও দীর্ঘসময়ের জন্য আটকে থাকে তাহলে সেখানে শৈবাল জন্মায়। আল্লাহ্ বলেছেন যে জান্নাতের পানি অদূষণীয়।
৩) দুধ-আর ফ্রিজের বাইরে গরমে দুধ কিছুক্ষণ রাখলে তা নষ্ট হয়ে যায় ও তেঁতো হয়ে পড়ে। আল্লাহ্ বলেছেন যে জান্নাতের দুধ কখনোই পরিবর্তিত হবে না।
৪) মধু-মধুর একটা সমস্যা হল যে এটা বিশোধন করা খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। আল্লাহ্ বলেন যে জান্নাতের মধু আপনার জন্য পবিত্র করে দেয়া হবে।
আল্লাহ্ জান্নাতে চারটি নদীর কথা বলেছেন যেগুলোর মালিকানা হবে আপনার আর সেগুলো হবে পবিত্র। আপনার সাথীরা হবেন পবিত্র। দুনিয়াতে মহিলারা যেসকল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া অতিক্রম করেন যেমন-ঋতুচক্র, সেগুলোর অস্তিত্ব জান্নাতে থাকবে না। উপরন্তু, তারা হবেন একটি বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারিনী, অনেক মানুষ বাহ্যিকভাবে সুন্দর কিন্তু তাদের অন্তর দূষিত, এ ধরণের সৌন্দর্য্য অর্থহীন, কিন্তু আপনার জান্নাতের সাথীরা তাদের- অন্তরের পাপাচার ও কলুষতা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হবে। হৃদয়সমূহ হবে কেবল একটি মাত্র মানব হৃদয়ের ন্যায়।
আল্লাহ্ এই পৃথিবীতে আমাদেরকে জান্নাত ও জাহান্নামের কেবল সামান্য, এক ঝলকের বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু প্রকৃত বিষয়সমূহ থাকবে কেবল আখিরাতে। আসল বাস্তবতা হল আখিরাত।
জাহান্নাম সম্পর্কে আমাদের সবাই আগুনের যন্ত্রণা সহ্য করেছি-হয়তবা গরম পানির ভাঁপে, নয়ত ফুটন্ত তেলের ছিঁটায় অথবা উন্মুক্ত অগ্নিশিখার তাপে। এর মাধ্যমে আল্লাহকে সবাইকে আগুনের যন্ত্রণার স্বাদ পাইয়েছেন আসল অগ্নির হুশিয়ারি হিসেবে। এটা আমার একটি ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, আমি এমন কোন মানুষ পাইনি যারা জীবনে কখনো আগুনের জ্বালা অনুভব করেননি।
৪. জান্নাত চিরস্থায়ী, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী
দুনিয়াতে যদিও বা কোন আনন্দ থেকে থাকে, তাহলে সেটা হয় ক্ষণস্থায়ী। আখিরাতে তা হবে চিরস্থায়ী। দুনিয়ায় যদি আপনি খাবার ভালোবাসেন, আপনি একনাগাড়ে খেতে পারবেন না, কারণ তাহলে আপনার স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দিবে।
এই পৃথিবীতে আপনি দেখবেন যে যারা চমকপ্রদ খাবার কেনার সামর্থ্য রাখে, তারা সেটা খেতে পারেনা- তাদের উচ্চ কোলেস্টেরল সমস্যাসহ ইত্যাদি নানা সমস্যা রয়েছে।
জান্নাতের সবকিছুই চিরস্থায়ী। আপনি চাইলেই আপনার নদীর সবটুকু পানি পান করতে পারবেন।
আপনার পছন্দসই ফলমূল ও গোশত পেতে পারেন। আপনি আপনার স্ত্রী কর্তৃক বছরের পর বছর যাবৎ আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন। দুনিয়াতে মানুষ এই সামান্য সময়ের আনন্দের জন্য অনেকে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়, ব্যভিচারে লিপ্ত হয় অথচ এই আনন্দ সাময়িক, এর কত কুফল রয়েছে, পরিবারে অশান্তি এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে। ব্যভিচারের শাস্তি হল প্রস্তরাঘাতে মৃত্যু। সুবহানাল্লাহ্, তারা সাময়িক ফূর্তির জন্য এই ধরনের ভয়ংকর শাস্তির মধ্য দিয়ে যাবে। আখিরাতে, তার শাস্তি হবে চিরকাল। দুনিয়ার সবকিছু ক্ষণস্থায়ী আর আখিরাতের সবকিছুই চিরস্থায়ী।
জান্নাত ও জাহান্নামের এই বর্ণনা শোনার পর, পরকালের পথে যাত্রা’র এই ভ্রমণ শেষে আমাদের উচিত নিজেদের কাছে অঙ্গীকার করা এই মর্মে যে আমরা যেন সর্বদা তা স্মরণে রাখি এবং এ নিজেদের জীবনে এ বিষয়ে আলোকপাত করি। যদিও আমরা দুনিয়ার বুকে চলাফেরা করছি, আমাদের উচিত আখিরাতে বাস করা। আর সর্বদা দু’আ করুন-সিজদারত অবস্থায়, রাতের সালাতে, দুহাত উপরে তুলুন দু’আর জন্য। কুরআনে বর্ণিত দু’আগুলো দ্বারা প্রার্থনা করুন। জাহান্নামের অগ্নি থেকে পানাহ্ চাইতে থাকুন এবং জান্নাতের জন্য দু’আ করুন।