ইউরোপ মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে আইবেবিয়ান উপদ্বীপের ৮৫ ভাগ অংশজুড়ে স্পেনের বিস্তৃতি। খ্রিষ্ট ৮ম শতক থেকে ১৫ শো শতক অবধি একাধারে প্রায় আট শো বছর জুড়ে দাপটের সঙ্গে এ অঞ্চল শাসন করেছেন মুসলমানেরা। মুসলমানদের শাসনামলে স্পেনের নাম ছিল উন্দুলুস। মধ্যযুগীয় ইউরোপের অগ্রযাত্রায় মুসলমানদের উন্দুলুসই পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। এবং মুসলিম উন্দুলুসের ওসিলায়ই আজকের আধুনিক ইউরোপের জন্ম ও বিস্তৃতি।
৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলমানদের স্পেন অভিযানের আগ অবধি তিন শো বছর জুড়ে সেখানে ছিল খ্রিষ্টান গথিক শাসকদের রাজত্ব। খ্রিষ্টান শাসকরা প্রজাদের ওপর এহেন কোনো অত্যাচার নেই, যা প্রয়োগ করত না। ইহুদিসহ ভিন ধর্মাবলম্বীরা তো নির্যাতিত ছিলই, খোদ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরাও ছিল চরম নিষ্পেষণের শিকার।
উমাইয়া খেলাফতের তখন স্বর্ণসময়। রাজধানী দামেশকের মসনদে উমাইয়া বংশের অন্যতম শাসক আল-ওয়ালিদ সমাসীন। খলিফা আল-ওয়ালিদের নিয়োগে উত্তর আফ্রিকার গভর্নর ছিলেন মুসলিম সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর।
এদিকে স্পেনের গথিক রাজ্যের রাজা তখন রডারিক। গথিক রাজ্যের সিউটা এলাকার গভর্নর কাউন্ট জুলিয়ান। ৭১০ খ্রিষ্টাব্দে কাউন্ট জুলিয়ান একদিন এসে হাজির হলেন সেনাপতি মুসা বিন নুসাইরের দরবারে। স্পেনের গথিক রাজার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার আবেদন নিয়ে। জানালেন গথিক রাজা রডারিক কর্তৃক স্পেনের প্রজাদের ওপর সীমাহীন অত্যাচারের কথা।
মুসা বিন নুসাইর প্রথমে তাঁর কথায় পাত্তা দিলেন না। তিনি মনে করলেন, খ্রিষ্টানদের কোনো চাল হতে পারে এটা। রডারিকই হয়তো জুলিয়ানকে পাঠিয়েছে আক্রমণের প্রলোভন দেখিয়ে মুসলমানদেরকে কোনো ফাঁদে ফেলার জন্য। জুলিয়ান তো রডারিকেরই অধীনস্ত গভর্নর।
কিন্তু জুলিয়ান যখন নিজের মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া রডারিকের বর্বরতার কথা জানালেন, যখন বললেন, রডারিকের অনুগত গভর্নর হবার পরও রডারিক তাঁর মেয়েকে রাজপ্রাসাদে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেছে, মুসা বিন নুসাইর তখন বিষয়টার ওপর গুরুত্ব দিলেন। জুলিয়ানের চেহারায় তিনি দেখতে পেলেন একজন অসহায় পিতার করুণ আর্তির চিত্র। জুলিয়ান ততক্ষণে নিজের রাজকীয় তলোয়ার সেনাপতি মুসা বিন নুসাইরের পায়ের কাছে সমর্পণ করেছেন।
আফ্রিকার গভর্নর সেনাপতি মুসা জুলিয়ানকে আশ্বস্ত করলেন, জানালেন, শিগগিরই তিনি আইবেবিয়ান দ্বীপাঞ্চল থেকে এ জুলুমের অবসান ঘটাবেন। তার আগে তিনি জুলিয়ানের বিশ্বস্ততার পরীক্ষা নিতে চাইলেন। নিজের অধীনস্ত সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদকে আদেশ দিলেন সিউটার আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট অভিযান পরিচালনা করতে। এ আক্রমণগুলোতে জুলিয়ানের কী প্রতিক্রিয়া হয় এবং সে কী অবস্থান গ্রহণ করে, মুসা সেটা পরখ করতে চান।
সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ ছিলেন অকতোভয় সিপাহসালার। আফ্রিকার বিভিন্ন অভিযানে ইতিমধ্যেই তিনি নিজের শৌর্য আর অপার সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। শিংহশার্দুল এ সেনাপতি মুসা বিন নুসাইরের অধীনস্ত ছিলেন–এ ব্যাপারে সকল ঐতিহাসিক একমত হলেও তাঁর পরিচয় নিয়ে তাঁরা নানা ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো, তিনি উত্তর আফ্রিকার বার্বার গোত্রের লোক ছিলেন। শুরুতে কৃতদাসের জীবন ছিল তাঁর। মুসা বিন নুসাইর এক অভিযানে গিয়ে তাঁকে ক্রয় করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি মুসা বিন নুসাইরের একান্ত আস্থাভাজন সৈনিকে পরিণত হন এবং ইসলামের আলোয় আলোকিত হন। নিজের দক্ষতা ও সাহসিকতার জোরে মুসা বিন নুসাইরের সেনাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান।
জুলিয়ানের এলাকার আশপাশে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনার পর তারিক বিন যিয়াদ মুসা বিন নুসাইরের কাছে ইতিবাচক রিপোর্ট করলেন—জুলিয়ান সত্যিকার অর্থেই চাচ্ছে গথিক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আক্রমণ হোক, তারমধ্যে কোনো দুরভিসন্ধি নেই।
মুসা বিন নুসাইর আশ্বস্ত হয়ে এবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। নিজের বিশ্বস্ত সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদকেই সেনাপতি নিযুক্ত করে সাতহাজার বার্বার মুসলিম ও ৩০০ আরব মুসলিম সৈন্যের একটি বাহিনী প্রস্তুত করলেন স্পেন আক্রমণের জন্য। কাউন্ট জুলিয়ান স্বপ্রণোদিত হয়ে দিলেন চারটি জাহাজ। চার জাহাজ বোঝাই করে ৭ হাজার মুজাহিদের কাফেলা নিয়ে তারিক বিন যিয়াদ ৭১১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে সমুদ্রপথে যাত্রা করলেন স্পেন অভিযানের উদ্দেশ্যে।
৭১১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ এপ্রিল তারিক বিন যিয়াদ চার জাহাজ-বোঝাই মুজাহিদ নিয়ে স্পেনের উপকূলে অবতরণ করেন। সৈন্যরা উপকূলে নামার পর এক অভাবিত আদেশ জারি করেন তারিক বিন যিয়াদ। যা ইতিহাসের পাতায় মুসলিম মুজাহিদদের অতুলনীয় বীরত্বগাথার অধ্যায়ে অমলিন হয়ে আছে।
তারিক বিন যিয়াদ জাহাজের ক্যাপ্টেনদেরকে আদেশ করলেন, যে চারটি জাহাজে করে তাঁরা এসেছিলেন, সবক’টি জাহাজ যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। আদেশ মুতাবিক তৎক্ষনাৎ জ্বালিয়ে দেওয়া হলো চার জাহাজে। তারিক তখন সৈন্যদের উদ্দেশে জ্বালাময়ী এক ভাষণ দেন, যার সারমর্ম মোটামুটি এরকম—’মুজাহিদ ভাইয়েরা, ইসলামের আলো জ্বালবার জন্য আমরা এ ভূমিতে অবতরণ করেছি। পেছন ফিরে পলায়নের জন্য নয়। তাই এ জাহাজগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। এখন আমাদের সামনে দুশমন, পেছনে সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি। হয়তো বিজয় অর্জন করে স্পেনের মাটিতে আমরা ইসলামের পতাকা উড্ডীন করব, নয়তো শাহাদাতের পেয়ালা পান করব, তৃতীয় কোনো রাস্তা চাইলেও আমরা আর খুঁজে পাব না। অতএব আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে সামনে বাড়ো, বিজয়ের মালিক তিনিই।’
তারিকের এ ভাষণে অভাবনীয় এক উদ্দীপ্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠলেন সাত হাজার মুজাহিদ। তাঁরা সামনে বাড়তে লাগলেন। বেশ অনেক দূর অবধি উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই তাঁরা জয় করে নিলেন। খ্রিষ্টান রাজা রডারিককে মুসলমানদের এ জয়যাত্রা ভাবিয়ে তুলল। সে তার বিশেষ সেনাপতি থিওডমিরের নেতৃত্ব বিশাল একবাহিনী প্রেরণ করল প্রতিরোধের জন্য৷ মুসলমানদের সঙ্গে দফায় দফায় লড়াই হলো থিওডমিরের বাহিনীর। প্রতিটা লড়াইয়েই মুসলমানদের হাতে শোচনীয় পরাজয়ের শিকার হতে হলো তাদেরকে৷
থিওডমির এবার দূতমারফত
রডারিককে জানাল, এদেরকে কোনোভাবেই পরাস্ত করা যাচ্ছে না, এরা সংখ্যায়
স্বল্প, কিন্তু লড়াই করে বিস্ময়করভাবে, স্বয়ং রাজাকেই মোকাবেলা করতে হবে এ
বাহিনীর।
রডারিক ক্রোধান্বিত হয়ে ১ লক্ষ সৈন্যের সমাবেশ করল নিতান্ত অল্প সময়ের
ভেতর। এদিকে মুসা বনি নুসাইরের কাছে আরও কিছু সৈন্যের আবেদন জানিয়ে তারিক
দূত পাঠালেন। পাঁচ হাজার মুজাহিদের ছোট্ট একটি সাহায্য এলো, মুজাহিদদের
সর্বমোট সংখ্যা দাঁড়ালো ১২ হাজার। অপরদিকে শত্রুসেনা এক লাখ!
কিন্তু এই ১২ হাজারের কাছেই পরাজয় বরণ করতে হলো ১ লক্ষ সৈন্যকে। ৭১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুলাই ওয়াদি লাস্কের নিকটবর্তী একটা ময়দানে সংঘটিত হয় এ লড়াই। শোচনীয় পরাজয়ের পাশাপাশি রাজা রডারিক এ যুদ্ধে নিহত হয়। মারা পড়ে তার বেশুমার সৈন্য। বাকিরা পালিয়ে যায়। পতন ঘটে তিন শো বছরের খ্রিষ্টান গথিক সাম্রাজ্যের সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনের।
তারিক বিন যিয়াদ এবার মুজাহিদ বাহিনীকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে স্পেনের বাকি সব অঞ্চল জয়ের জন্য প্রেরণ করেন। নিজে ১৮ শো মুজাহিদের একটি বাহিনী নিয়ে অতি সহজে করতলগত করেন মেদিনা, সেভিল ও মেরিদা শহর।
তারপর মুসা বিন নুসাইরও এসে যোগ দেন এ বিজয়াভিজানে। মুসা ও তারিকের সম্মিলিত মুজাহিদ বাহিনী লিও, গ্যাসিলিয়া ইত্যাদি এলাকা জয় করেন। মাত্র দুই বছরে গোটা স্পেন চলে আসে মুসলমানদের দখলে। প্রতিষ্ঠিত হয় উমাইয়া খেলাফতের শাসন। উন্দুলুসে গড়ে ওঠে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসংখ্য কেন্দ্র। ইতিমধ্যে স্থানীয় বাসিন্দারাও ইসলামের সৌন্দর্য ও বিজয়ে বিমোহিত হয়ে দলে দলে মুসলমান হতে থাকেন।একসময়কার গথিক সাস্রাজ্য স্পেনের নতুন নাম হয় উন্দুলুস।
অন্ধকার ইউরোপে সভ্যতার আলোক মশাল জ্বেলে ১৫ শ শতাব্দী অবধি ইউরোপকে আজকের আধুনিক ইউরোপে রূপান্তরিত করতে মুসলমানেরা অমূল্য কোশেশ ব্যয় করেন। গড়ে তোলেন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, গবেষণাগার আর দৃষ্টিনন্দন সব ইমারত। তারপর আসে ঝড়। যে ঝড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ইউরোপে মুসলমানদের সমস্ত কীর্তি। খ্রিষ্টানদের পাশবিক অত্যাচারে মুসলমানেরা হন ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা ও নৃশংশতার শিকার। স্পেন থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয় মুসলমানদের সমস্ত অবদান। বিতাড়িত করা হয় তাঁদেরকে।
তারিক বিন যিয়াদ স্পেনের যে উপকূলে সর্বপ্রথম অবতরণ করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তার নামে সে জায়গার পাহাড়ের নামকরণ করা হয় জাবাল আত-তারিক। পশ্চিমারা যে নামের বিকৃতি ঘটিয়ে বলে জিব্রাল্টার। আজকের স্পেনের সেই জিব্রাল্টার, কর্ডোভা, গ্রানাডা আর সেভিল মুসলমানদের হারানো উন্দুলুসেরই নীরব সাক্ষী হয়ে আছে।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, ইতিবৃত্ত এবং রোর বাংলা
হামমাদ রাগিব
সূত্রঃ fateh24