প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমি আপনাদের একটা গল্প বলবো। আপনারা অনেকেই হয়তো গল্পটা আগেও শুনেছেন। কিন্তু এই গল্পটা থেকে আমাদের জন্য অনেক কিছুই শেখার আছে।
গল্পটি চারটি গরুকে নিয়ে। তাদের মধ্যে একটি ছিল সাদা আর বাকি তিনটি ছিল কালো বর্ণের। তারা হিংস্র নেকড়ে পরিবেষ্টিত খুব বিপদজনক একটি জায়গায় থাকতো। কিন্তু তারা সবসময় একসাথে থাকতো, একে অপরের প্রতি খেয়াল রাখতো এবং চোখকান খোলা রাখতো। ফলে শ্বাপদসংকুল এলাকায়ও তারা টিকে থাকতে পেরেছিল।
কিন্তু একদিন কালো গরু তিনটি গোপনে এক জায়গায় একত্রিত হলো। তারা বললো, সাদা গরুটা আমাদের জন্য বড্ড ঝামেলা সৃষ্টি করছে। আমরা কালো হওয়ায় রাতে আমাদের কেউ দেখতে পায় না, আমরা সহজেই লুকিয়ে থাকতে পারি। কিন্তু ঐ সাদা গরুকে অনেক দূর থেকেই চোখে পড়ে। ফলে আমরা ধরা পড়ে যেতে পারি। তাই, এক কাজ করা যাক। আমরা তিনজন একসাথে থাকি, আর ঐ ঝামেলাটাকে আলাদা করে দিই।
কথামত সেইদিন থেকে তারা তিনজন, বেচারা সাদা গরুটিকে আলাদা করে দিলো। এদিকে নেকড়ে ছিল খুব চালাক। সে গরুগুলোর ভিতর বিভেদ বুঝতে পেরে সাদা গরুটিকে আক্রমণ করলো। কালো গরু তিনটি কোন বাধাই দিলো না। তাদের ভাইকে যখন টুকরো টুকরো করা হচ্ছিলো, তারা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো।
কিন্তু নেকড়ে পরদিন রাতে তাদের তিনজনকে আক্রমণ করে বসলো। কারণ? নেকড়ে বুঝতে পেরেছিল, যেহেতু একটি গরু কম ছিল, তাই তারা এখন আগের তুলনায় দূর্বল। তাদের শক্তি অনেক কমে গিয়েছিল। ফলস্বরূপ নেকড়ে একটি কালো গরুকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
পরদিন রাতে নেকড়ের কাজ আরো সহজ হয়ে গিয়েছিল, কারণ এখন গরুর সংখ্যা আরো একটি কমে দুইটিতে এসে দাঁড়িয়েছিল। তারা অনেক চেষ্টা করলো, কিন্তু নেকড়ে আরো একটি গরুকে মেরে ফেলতে সক্ষম হলো। তার পরেরদিন মাত্র একটি গরুই বেঁচে ছিল। তাই নেকড়ে যখন তাকে আক্রমণ করতে আসলো, গরুটি বাধা দেয়ার পরিবর্তে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করলো। নেকড়ে খুব ধীরে সুস্থে আগাচ্ছিল, কারণ সে জানে গরুটি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়বে। তাকে বাঁচানোর মত কেউ আর অবশিষ্ট নেই। সুতরাং তাড়াহুড়া না করে নেকড়ে যথাসময়ে গরুটির ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লো। ঠিক তখনই, গরুটি খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি কথা বললো, যে কথা থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। গরুটি বলেছিল,
“আমি তো সেদিনই মারা গিয়েছি, যেদিন সাদা গরুটি মারা গিয়েছিল। আমি নিজের মৃত্যুকে সেদিনই ডেকে এনেছিলাম। আমি এখন মারা যাচ্ছি না। আমি আজ মারা যাচ্ছি না। আমি সেদিনই মারা গিয়েছি, যেদিন আমি সাদা গরুটিকে নেকড়ের হাতে একাকি ছেড়ে দিয়েছিলাম।”
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, নিশ্চয়ই আপনারা অনেকেই গল্পটির মূল বক্তব্য ইতিমধ্যেই ধরে ফেলেছেন। আমি এখানে কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো ইন শা আল্লাহ।
প্রথম শিক্ষা- উম্মাহ
গল্পটি মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থার খুব ভালো একটি চিত্র উপস্থাপন করেছে। ঠিক এই ঘটনাই যেন ঘটে চলেছে বিশ্বজুড়ে। একের পর এক মুসলিম রাষ্ট্রের পতন হচ্ছে, আর আমরা কিছু না করে বসে বসে শুধু দেখেই যাচ্ছি। যখন ফিলিস্তিন দখল করা হলো, আমরা কিছুই করলাম না। তারপর কাশ্মির, চেচনিয়া, ফিলিপাইন। উম্মাহ নিশ্চুপ। তালিকার সর্বশেষ সংযোজন ইরাক। ইরাকে যখন হত্যাযজ্ঞ চলছে, আমাদের দেখা তখনো শেষ হয়নি। আপনার কি মনে হয় এখানেই এর সমাপ্তি? কখনো নয়! এরপর হয়তো একদিন সিরিয়ায় সমস্যা দেখা দিবে। আল্লাহই ভালো জানেন তালিকায় এরপর কোন দেশ। এই রাষ্ট্রগুলো আজকে দখল হয়নি। আমরা যেদিন প্রথম রাষ্ট্রটি দখল করে নিতে দিয়েছিলাম, সেদিনই আমাদের প্রত্যেকের পতন আমরা ডেকে এনেছি।
দ্বিতীয় শিক্ষা- ঐক্য
অনৈক্যের ফল কি হতে পারে, গল্পটিতে তা ভালভাবেই ফুটে উঠেছে। যখনই ঐ গরুগুলোর মধ্যে বিভেদ দেখা দিলো এবং তারা একটি গরুকে নেকড়ের হাতে ছেড়ে দিলো, তখনই তারা হেরে গিয়েছিল। প্রিয় ভাই ও বোনেরা, নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মাহর একটি সুন্দর উপমা দিয়েছেন। নুমান বিন বাশির হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “পারস্পরিক ভালোবাসা এবং সহমর্মিতার দিক দিয়ে মুমিনরা একটি দেহের মত। যখন দেহের কোন একটি অংশে ব্যথা অনুভূত হয়, অনিদ্রা আর জ্বরের কারণে পুরো দেহেই ব্যথা অনুভূত হয়”। (মুসলিম)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই কথা থেকে আমরা বুঝতে পারি, আপনার আঙুল, পা কিংবা দেহের যে কোন অংশে যদি আঘাত লাগে; আপনি তখন ব্যথায় ঘুমাতে পারেন না! আপনাকে ইনফেকশন থেকে বাঁচাতে ক্ষতস্থানের ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে আপনার শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যুদ্ধ শুরু করে, ফলে আপনার জ্বর আসে। গোটা দেহই শত্রুর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে শামিল হয়।
তাই যদি কোন মুসলিম আক্রান্ত হয়- পূর্বেই হোক আর পশ্চিমে, উত্তরে কিংবা দক্ষিণে- দেহের কেন্দ্রেই হোক বা আঙুলের ডগাতেই হোক, আপনার ঠিক তেমনই ব্যথা লাগা উচিত যেন নিজের পরিবারই আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু যদি আপনি শুধুমাত্র নিজের এবং নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, বুঝতে হবে আপনার কোন সমস্যা আছে। আপনি আসলে এই দেহের অংশই না! রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, উম্মাহ একটি দেহের মত। যতক্ষণ তারা সত্যিকারের মুসলিম হিসেবে পরিচিত; তারা কোন দেশের, কোন দলের, কোন মাযহাবের সেটি কোন বিবেচ্য বিষয় নয়।
কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে এখন আমরা শুধু নিজের দলের মানুষদেরই মুসলিম মনে করি। অমুক আমার মতাদর্শ মেনে চলে না, সুতরাং ঐ ব্যক্তি আমাদের কেউ নয়- এটিই যেন আমাদের মূল কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতক্ষণ আপনি কাউকে কাফির প্রমাণ করতে না পারবেন, সে একজন মুসলিম। যদি কেউ নিজেকে মুরতাদ দাবি না করছে, সে একজন মুসলিম- সে যে দেশের, যে দলের আর যে মাযহাবেরই হোক।
কিন্তু ঐক্যবদ্ধ থাকার অর্থ এই নয় যে, আমরা সব দল কিংবা মাযহাবের মতপার্থক্য দূর করে একে অন্যের কপি হয়ে যাব, এটি একটি অবাস্তব ব্যাপার। ইসলামের জন্য করা কাজের পদ্ধতিতে আপনার সাথে অন্যের পার্থক্য থাকতেই পারে, আপনার সাথে আরেকজনের মাযহাবে হয়তো ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু আপনার ভাই যখন বিপদে পড়বে, আপনিই সবার আগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেন- এটিই হলো ঐক্য। আপনি হয়তো এক ধরনের কাজ করেন, আরেকজন হয়তো অন্য ধরনের। এই পার্থক্যেরও দরকার আছে। আমরা আজ সব দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েছি, তাই সব জায়গাতেই মুসলিমদের প্রবেশ করা প্রয়োজন। কেউ দাওয়াহর কাজে, কেউ ইলম অর্জনের কাজে আর কেউ ইবাদাহর প্রতি মনোনিবেশ করবে। সবার পক্ষে সব কাজ করা অসম্ভব।
একেক মানুষের দক্ষতার ক্ষেত্র একেক জায়গায়। কেউ ভালো আলিম হয়, কেউ ভালো ইমাম, কেউ ভালো শিক্ষক আবার কেউ হয়তো খুব ভালো উপদেষ্টা। প্রত্যেকটি মানুষই ভিন্নধর্মী। অনেকেই দেখবেন ঘাড় গুঁজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করছে, কথা বলার মত সময়ও তাদের নেই। কিন্তু তারাই মুসলিমদের নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করছে। কারো কাজকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তাই ঐক্যবদ্ধ থাকার অর্থ হলো, আপনার ভাইয়ের প্রয়োজনের সময় তার মতাদর্শ বিচার করতে না বসে, তার বিপদকে নিজের মনে করে ঝাপিয়ে পড়া। এটিই ঐক্যের সংজ্ঞা।
তাই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতিত মুসলিমদের দুঃখ কষ্ট আপনাকেও যেন স্পর্শ করে। আপনার জন্মভুমি না হলেও, ফিলিস্তিন আর ইরাকে কি ঘটছে, তার খবর আপনাকে রাখতে হবে। কাশ্মীরে কি হচ্ছে, আপনার সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। অনেক মুসলিম দেশের নিজেদের মধ্যেই রাজনৈতিক বিরোধ বিদ্যমান, হয়তো যুদ্ধও চলছে। তবুও একজন মুসলিম হিসেবে আপনি তাদের প্রতি বৈষম্য করতে পারেন না। সমস্যা কিংবা বিরোধের জন্য দায়ী রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারগুলো। কিন্তু ঐ দেশের মুসলিমরা তো কোন দোষ করেনি, তারা আমাদের ভাই- বিষয়টা এভাবেই দেখতে হবে। মুসলিম উম্মাহর জন্য আমাদের দরদ থাকতে হবে। মুসলিমদের সমস্যা নিয়ে যার কোন চিন্তাই নেই, সে উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত নয়।
আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেক ব্যক্তি তার সাথেই থাকবে, যাকে সে ভালবাসে” (বুখারি)। তাই আপনি যদি মুসলিমদের ভালোবাসেন, হাশরের দিন আপনি তাদের সাথেই থাকবেন। আর আপনার ভালোবাসা যদি কাফিরদের জন্য হয়, আপনার হাশরও হবে তাদের সাথে। এটিই আল্লাহর বিচার। যারা মুসলিমদের ভালোবাসে, মুসলিমরা যেখানে যাবে তারাও সেখানেই যাবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমরা জানতে পারি, কিয়ামতের দিন আল্লাহ মুশরিকদের বলবেন, তোমরা দুনিয়াতে যাদের উপাসনা করতে তাদের অনুসরণ করো। তাই যারা ক্রুশের উপাসনা করতো, তারা ক্রুশের পিছে পিছে যাবে। আর যারা মূর্তি পূজা করতো, তারা মূর্তির পিছে পিছে যাবে। আল্লাহ বলবেন, তোমরা তো দুনিয়াতে আমার ইবাদাত করোনি, তাহলে এখন আমার কাছে চাইতে এসেছ কেন? তোমরা যাদের উপাসনা করতে, তাদের কাছেই তোমাদের প্রতিদান খুঁজে নাও। তারপর আল্লাহ তাদের সেই সব নকল ঈশ্বর আর মূর্তিকে জাহান্নামের আগুনে ছুড়ে ফেলবেন আর তারাও অনুসরণ করতে বাধ্য হবে। আল্লাহর চেয়ে অধিক ন্যায়বিচারক আর কে আছে?
তৃতীয় শিক্ষা- বিশ্বাসঘাতকতার কুফল এবং মুসলিমদের পরিত্যাগ করার শাস্তি
আবদুল্লাহ ইবন উমার থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, তাই তার উচিত নয় ভাইয়ের উপর অত্যাচার করা কিংবা কোন অত্যাচারীর হাতে তাকে তুলে দেয়া। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন মিটাবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন মিটাবেন; যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার কষ্ট দূর করবেন; আর যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ ত্রুটি গোপন রাখবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষ ত্রুটি গোপন রাখবেন” (বুখারি ও মুসলিম)
গল্পের কালো গরুগুলো সাদা গরুটিকে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েছিল। তারা নিজেদের নিরাপত্তা চেয়েছিল। তারা ভেবেছিল, সাদা গরটিকে আলাদা করে দিলেই তারা নিরাপদ হয়ে যাবে। ঐ সাদা গরুটাই যত সমস্যার মূল। ওটা একটা জঙ্গি। ওটাকে জেলে ঢুকিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু তারা যে বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেনি, সেটা হলো তারাই নেকড়ের পরবর্তী টার্গেট হতে যাচ্ছে। সুতরাং প্রিয় ভাই, আপনি যদি নিজেকে বাঁচাতে চান- আমরা এখন বিপদ্গ্রস্থ কোন মুসলিমের কথা বলছি না- আপনার নিজের নিরাপত্তার কথা বলছি। আপনি যদি নিজেকে বাঁচাতে চান, এই খেলা আপনাকে বন্ধ করতে হবে। একজন মুসলিমকেও যদি আপনি শত্রুর হাতে ছেড়ে দেন, আপনি আল্লাহর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়ে যেতে পারেন-“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন মিটাবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন মিটাবেন; যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার কষ্ট দূর করবেন”- আপনি আজ আপনার মুসলিম ভাইকে যদি বিপদে সাহায্য করেন, কিয়ামতের কঠিন দিনে আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবেন।
আমরা সবাই জানি আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমরা একাকি কিছুই করতে পারবো না। যদি আপনি আল্লাহর সাহায্য পেতে চান, তাহলে আপনার ভাইয়ের সাহায্যে ঝপিয়ে পড়ুন। আপনি কোন ভাইকে শত্রুর হাতে তুলে দিয়েই ভেবে বসবেন না যে তারা সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। কখনোই নয়। শয়তান কখনোই সন্তুষ্ট হবে না। গোটা উম্মাহকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। আপনি অন্য কোন কিছুর বিনিময়েই তাকে খুশি করতে পারবেন না। আদমের সৃষ্টিলগ্ন থেকে তার সাথে আমাদের যে শত্রুতার সূচনা হয়েছিল, কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। আপনি আপনার এক ভাইকে বলি দিলেই, সে সন্তুষ্ট হয়ে যাবে না। তার পেট কখনোই ভরবে না। তার তৃষ্ণা কিছুতেই মিটবে না।
আজ যদি বিপদ্গ্রস্থ কোন মুসলিমকে আপনি পরিত্যাগ করেন, নিশ্চিত থাকুন কাল আল্লাহ আপনাকে পরিত্যাগ করবেন। আর পশ্চিমা দেশগুলোতে বসবাসকারী ভাই ও বোনেরা, আপনাদের সন্তান সম্পূর্ণ অনৈসলামিক একটি পরিবেশে বেড়ে উঠছে। আজ হয়তো আপনি তাদের আগলে আছেন, কিন্তু আপনি তো চিরদিন বেঁচে থাকবেন না। কাল যখন আপনি মারা যাবেন, তাদের কি হবে তা কি ভেবে দেখেছেন? আল্লাহই ভালো জানেন, হয়তো তারা অমুসলিম হয়ে যাবে! এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমরা আল্লাহর কাছে দু’আ করি তিনি যেন আমাদের সন্তানদের সঠিক পথে অটল রাখেন। কিন্তু প্রিয় ভাই, আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য, তাকে সঠিক পথে রাখার জন্য আপনার অবশ্যই আল্লাহর পথে কিছু বিনিয়োগ করে যাওয়া উচিত। কিয়ামতের দিন আপনার পরিবারের ব্যাপারে নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর কাছে অভিযুক্ত হতে চাইবেন না? যেহেতু আপনিই তাদের এই অমুসলিম দেশে নিয়ে এসেছেন, আপনাকেই তাদের গুনাহের ভার বহন করতে হবে। জেনারেশনের পর জেনারেশন আসবে আর তাদের সবার দোষ আপনার ঘাড়েই চাপবে। তাই আপনার সন্তানের জন্য এখনই কিছু বিনিয়োগ করুন। আপনার বিপদ্গ্রস্থ ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। আল্লাহ আপনার পাশে এসে দাঁড়াবেন এবং আপনার মৃত্যুর পর আপনার সন্তানদের পাশে থাকবেন।
ইবন আব্বাসের হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যদি তুমি আল্লাহর প্রতি (আদেশ পালনের ব্যাপারে) যত্নবান হও, আল্লাহ তোমার প্রতি যত্নবান হবেন। কিন্তু কিভাবে? ইবন রজব আল-হাম্বলি তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে-
১) যদি আপনি আল্লাহর প্রতি যত্নবান হন, আল্লাহ খারাপ চিন্তা এবং ঈমানি দূর্বলতা থেকে আপনাকে মুক্ত রাখার মাধ্যমে আপনার প্রতি যত্নবান হবেন।
২) যদি আপনি আপনার যৌবনে আল্লাহর আদেশ পালনের ব্যাপারে যত্নবান হন, আল্লাহ বৃদ্ধাবস্থায় আপনার প্রতি যত্নবান হবেন।
৩) যদি আপনি আল্লাহর আদেশ পালনের ব্যাপারে যত্নবান হন, আল্লাহ আপনার সন্তানদের প্রতি যত্নবান হবেন।
তৃতীয় ব্যাখ্যাটির ব্যাপারে ইবন রজব মুসা এবং খিযিরের ঘটনার উদাহরণ দেন। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করছেন,
“আবার তারা চলতে শুরু করলো। (কিছুদূর এগিয়ে) তারা জনপদের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছালো, তারা অধিবাসীদের কাছে কিছু খাবার চাইলো, কিন্তু অধিবাসীরা তাদের মেহমানদারি করতে অস্বীকার করলো, অতপর তারা একটি ভগ্নপ্রায় প্রাচীর দেখতে পেল, সে (খিযির) প্রাচীরটি সোজা করে দিলো, সে (মুসা) বললো, তুমি চাইলে তো এর বিনিময়ে কিছু পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতে!” [ভাবার্থ- সূরা কাহাফ:৭৭]
পরবর্তীতে খিযির তার এই কাজের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, “প্রাচীরটি ছিল শহরের দুটি এতিম বালকের, এর নিচেই ছিল তাদের জন্য রক্ষিত ধনভাণ্ডার, তাদের পিতা ছিল একজন নেককার ব্যক্তি, (এ কারণেই) তোমার মালিক চাইলেন ওরা বয়ঃপ্রাপ্ত হোক এবং তাদের সম্পদ বের করে আনুক, এ ছিল তোমার মালিকের অনুগ্রহ, এর কোনটাই আমি নিজে থেকে করিনি, আর এটিই হচ্ছে সেসব কাজের ব্যাখ্যা, যে ব্যাপারে তুমি ধৈর্য ধারণ করতে পারছিলে না।” [ভাবার্থ- সূরা কাহাফ:৮২]
অতএব দেখতেই পারছেন আল্লাহ কিভাবে তাদের পিতার সৎ কর্মের কারণে ছেলে দুটির সম্পদ রক্ষা করলেন। ছেলে দুটি বড় হয়ে ভালো হবে নাকি খারাপ হবে তা এখানে বিবেচ্য ছিল না, শুধুমাত্র তাদের পিতার সৎ কর্মের কারণেই আল্লাহ স্বয়ং খিযিরকে পাঠিয়ে তাদের রক্ষা করলেন! আল্লাহ আপনার এবং আপনার সন্তানদের প্রতি যত্নবান হবেন, এর চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে? তাই আমাদের উচিত আল্লাহর আদেশ পালনের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া। আপনার দায়িত্ব আপনি এড়িয়ে যেতে পারেন না। কারণ আপনিই হবেন পরবর্তী টার্গেট।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমি এতক্ষণ যা বললাম, তার জন্য আপনাকে ইরাক কিংবা ফিলিস্তিন যেতে হবে না। আপনার শহরে, আপনার প্রতিবেশিদের দিকেই একটু খেয়াল করে দেখুন। আপনি জানেন? আপনার নিজের দেশেই কত মুসলিমকে গ্রেফতার করা হয়েছে? আপনি যখন গুয়ান্তানামো বে নিয়ে আহাজারি করেন, মনে রাখবেন, আপনার নিজের দেশেই গুয়ান্তানামো বে আছে। শত শত মুসলিম, বিনা অপরাধে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, জেলগুলোতে পঁচে মরছে, আপনি কি করেছেন তাদের জন্য? আপনার উত্তর আফ্রিকার ভাইয়েরা রাস্তায় পড়ে আছে, কেউ এগিয়ে আসছে না তাদের সাহায্য করতে। কোথায় মুসলিম কমিউনিটি ? আপনি কি করেছেন তাদের জন্য? (সম্ভবত খুতবাটি আমেরিকায় দেয়া, তাই আফ্রিকানদের কথা বলা হচ্ছে। আমাদের আত্মতৃপ্তিতে ভোগার কোন কারণ নেই। মনে আছে? আমরা রোহিঙ্গাদের সাথে কি করেছি?)
এক ভাই আমাকে তার পরিবারের অবস্থার কথা বলেছিলেন। এসব অসহায় ভাইবোনদের দেখাশুনা করার মতও কেউ নেই। পরিবারগুলো না খেয়ে মারা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের সাহায্যে কেউই এগিয়ে আসছে না। কিছুদিন আগে কয়েকজন ব্রিটিশ ভাইদের গ্রেফতার করা হয়। কোন অভিযোগ না পেয়ে পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের একজনকে গ্রেফতারের সময় সে কোন প্রতিরোধ না করে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাত মাথার উপর তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু পুলিশ বিনা কারণে তাকে মারধোর শুরু করে। মার খেতে খেতে যখন তার শরীরের বিভিন্ন স্থান ফেটে রক্ত ঝরতে শুরু করে, তার চোখে কালশিটে দাগ পড়ে যায় এবং প্রস্রাবের সাথে রক্ত বেরুতে থাকে, পুলিশ তাকে সিজদারত অবস্থায় বসিয়ে দিয়ে ব্যাঙ্গ করে প্রশ্ন করে, “তোমার আল্লাহ এখন কোথায় গেল?”
ইসলামের, ধর্মের, উম্মাহর এত অপমানের পরও আপনি শুধু দেখেই যাবেন? এই অপমান শুধু ঐ ভাইকে করা হয়নি, এই অপমান করা হয়েছে ইসলামকে। কাউকে সিজদায় ফেলে, আল্লাহ কোথায় প্রশ্ন করা? আল্লাহু আকবার! তারা আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করছে? আল্লাহ ন্যায়বিচারক, তিনি এর যথাযোগ্য শাস্তিই দিবেন। আল্লাহ কোনভাবেই আমাদের মুখাপেক্ষী নন। আমাদের সাহায্যের কোন দরকার নেই তাঁর। কিন্তু আমরা কি জবাব দিবো?
আপনি শুধু বসে বসে দেখেই যাচ্ছেন। আপনি হয়তো ভাবছেন, শুধু শুধু ঝামেলায় জড়িয়ে কি লাভ! তার চেয়ে চুপচাপ থাকাই নিরাপদ। কিন্তু আপনি যদি আজ কোন প্রতিবাদ না করেন, কাল আপনার সাথে, আপনার স্ত্রীর সাথে, আপনার নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে একই ঘটনায় ঘটবে। এই ঘোড়া লাগাম ছাড়া হওয়ার আগেই একে থামাতে হবে। যেভাবেই হোক। আপনার যতটুকু ক্ষমতা আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে হলেও আপনাকে এগিয়ে আসতেই হবে। মুসলিম ভাই, উম্মাহ এবং সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি আপনার দায়িত্ব আপনাকে পালন করতেই হবে। উম্মাহর সমস্যা থেকে দূরে বসে শুধুমাত্র তত্ত্বকথা কপচানো কখনোই ইসলামের বিশিষ্ট নয়। শুধুমাত্র এই কারণেই স্পেনের মুসলিমরা স্পেনের দখল হারিয়েছিল। ঐতিহাসিক আল-মাকারি লিখেছিলেন, ক্রুসেডাররা একের পর এক শহর আক্রমণ করছিলো আর দখল করে নিচ্ছিলো, কিন্তু আন্দালুসের মাসজিদ্গুলোতে এই বিষয়ে কোন আলোচনাই করা হতো না। মুসলিমদের করণীয় সম্পর্কে খুতবাগুলোতে কিছুই বলা হতো না, কিছুই না। উলামাগণ তখনও বিভিন্ন বৈষয়িক আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। তারা উম্মাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।
আন্দালুসের প্রখ্যাত আলিম ইবন হাজম আল-আন্দালুসি আন্দালুসের উলামা এবং ইমামদের এই নিশ্চুপ ভূমিকায় হতাশ হয়ে বলেছিলেন, “এইসব ফাসিকদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ো না, যারা নেকড়ের অন্তরের উপর ভেড়ার পোশাক পরিয়ে নিজেদের আলিম দাবি করছে”। তিনি আরো বলেছিলেন, “তারা করছে টা কি? তারা উম্মাহর কোন উপকারেই আসছে না। উম্মাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে! আল-আন্দালুসের উপর শত্রুরা আক্রমণ করে দখল করে নিতে চলেছে, আর তারা এখনও ফিকহি বিষয় নিয়ে তর্ক করে চলেছে।”
তাই আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে, আমাদের জড়তা কাটিয়ে সোজা হতে হবে, আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের কণ্ঠস্বর জোরাল করতে হবে। এটিও ইবাদাহ। আপনি আপনার ভাইকে সাহায্য করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদাতই করছেন। এর বিনিময়ে আল্লাহ আপনাকে দুনিয়ায় সাহায্য করবেন এবং আখিরাতে পুরস্কৃত করবেন। উম্মাহ এখন কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমাদের সবার পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। আমরা আল্লাহর কাছে দু’আ করি, তিনি যেন আমাদের নিজেদের, আমাদের পরিবারগুলোকে এবং আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের রক্ষা করেন।
আমিন।
আর বিজয় তো শুধু এক আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। ওয়াল-হামদুলিল্লাহ। সাল্লাল্লাহু আ’লা সায়্যিদিনা মুহাম্মাদ, ওয়া আ’লা আলিহি , ওয়া আসহাবিহি, ওয়া সাল্লাম, তাসলিমান কাছিরা।
[শাইখ আনোয়ার আল-আওলাকির খুতবা থেকে অনূদিত]