কুরআন মজীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ হক হিফযে কুরআন। প্রত্যেকের যতটুকু সম্ভব হিফয করা, সন্তান-সন্ততি ও অধীনস্তদের হিফয করানো এবং সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝে হিফযে কুরআনের প্রচলন ও ব্যবস্থা করা কুরআন মজীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হক।
হাদীস শরীফে কুরআন শেখা ও শেখানোর যে তাকীদ আছে তার উপর সাহাবায়ে কেরাম এভাবে আমল করেছেন যে, প্রথমে বারবার শুনে আয়াতটি মুখস্থ করেছেন এরপর তার মর্ম ও বিধান শিক্ষা করেছেন।
এখন আমাদের মাঝে হাফেযের সংখ্যা কম নয়; তবুও তুলনা করলে দেখা যাবে, অধিকাংশ মানুষ হিফযে কুরআনের নেয়ামত থেকে বঞ্চিত। এর মৌলিক কারণ তিনটি : প্রথম কারণ তো ঈমানের কমযোরি ও কুরআনের প্রতি মহববত ও ভালবাসার অভাব। দ্বিতীয় কারণ এই ভুল ধারণা যে, হাফিয হওয়া শিশুদের কাজ। সুতরাং শৈশবে যদি অভিভাবকরা হিফযখানায় ভর্তি করেন তাহলেই শুধু হাফেয হওয়া যায়; অন্যথায় যায় না। তৃতীয় কারণ এই ভুল ধারণা যে, হয় পূর্ণ কুরআনের হাফেয হও, নতুবা কেবল এতটুকু মুখস্থ কর যে, কোনোমতে নামাযগুলি আদায় করা যায়। মাঝামাঝি কোনো ছূরত নেই!!
আসলে হিফযের কোনো বয়স নেই। যে কোনো বয়সের মানুষ হিফযে কুরআনের নিয়ত করতে পারে এবং ধীরে ধীরে পূর্ণ কুরআনের হাফেযও হয়ে যেতে পারে। আর পুরা কুরআন হিফয করা সম্ভব না হলেও শুধু নামায আদায়ের পরিমাণে সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়; বরং যত বেশি সম্ভব হিফয করতে থাকাই হল মুমিনের শান ও সৌভাগ্য। বরং ঈমানের দাবি তো এই যে, প্রত্যেক মুমিন নিজ নিজ পরিবারে এই নীতি নির্ধারণ করবে যে, আমরা জীবিকার প্রয়োজনে পরবর্তী জীবনে যে পেশাই গ্রহণ করি না কেন আমাদের সূচনা ও ভিত্তি হবে আলকুরআন। ঈমান ও কুরআন শেখার পরই কেবল আমরা আমাদের সন্তানদের অন্য কোনো শিক্ষা প্রদান করব বা অন্য কোনো পেশায় নিয়োজিত করব। আমাদের এক বন্ধু (ভাই সেলিম সাহেব) আমাকে বলেছেন, ১৪২৮ হিজরীর হজের সফরে আবদুর রহমান নামক একজন সুদানী ভদ্রলোকের সাথে তাঁর সাক্ষাত হয়েছিল, যিনি একজন এ্যারোনেটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ও রিয়াদে কর্মরত। তিনি তাঁকে বলেছেন, ‘দীর্ঘ কয়েক শ বছর যাবৎ আমাদের খান্দানের ঐতিহ্য হল, আমরা যে শিক্ষাই গ্রহণ করি না কেন এবং যে পেশাতেই নিয়োজিত হই না কেন প্রথমে আমাদের হাফিযে কুরআন হতে হয়। তাই আমাদের খান্দানের প্রত্যেকে, সে পৃথিবীর যে দেশেই থাকুক এবং যে পেশাতেই নিয়োজিত থাকুক, হাফিযে কুরআন।’
আমাদের দেশেও এর নজির আছে। শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আযীযুল হক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের (আল্লাহ তাঁকে ছিহহত ও আফিয়াত দান করুন) সন্তান ও নাতী-নাতনীরা সবাই হাফেয এবং মাশাআল্লাহ এদের নতুন প্রজন্ম হাফিযে কুরআন হওয়াকে খানদানের জন্য অপরিহার্য করে নিয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আরব ও আজমের এই ব্যক্তিদের অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। হিফযে কুরআন যেন হয় আমাদেরও খান্দানের পরিচয়-চিহ্ন। আমীন!
হিফযে কুরআন সম্পর্কে ‘মিন সিহাহিল আহাদীসিল কিছার’ (হাদীসের আলো)র ভূমিকায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। পাঠকবৃন্দ ঐ আলোচনাটিও পাঠ করতে পারেন।
এখানে আমি শুধু কুরআন বোঝার চেষ্টা ও তার নিয়মকানুন সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু কথা আরজ করতে চাই।
হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. সূরা নিসার (৪) ৮২ নম্বর আয়াতের আলোচনায় লেখেন, ‘প্রতিটি মানুষ কুরআনের অর্থ ও মর্ম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করুক এটিই কুরআনের দাবি। সুতরাং একথা মনে করা ঠিক নয় যে, কুরআন মজীদের আয়াতসমূহে চিন্তা-ভাবনা করা শুধু ইমাম ও মুজতাহিদ (বা বড় বড় আলিমের) কাজ। অবশ্য জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পর্যায়ের মতোই চিন্তা-ভাবনারও বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। …
সাধারণ মানুষ যখন নিজের ভাষায় কুরআন মজীদের তরজমা ও তাফসীর পড়বে এবং চিন্তা-ভাবনা করবে তখন তাদের অন্তরে আল্লাহ তাআলার মহত্ম ও ভালবাসা এবং আখিরাতের ফিকির ও চিন্তা সৃষ্টি হবে। আর এটিই হচ্ছে সকল সফলতার চাবিকাঠি। তবে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার জন্য সাধারণ মানুষের উচিত কোনো আলিমের কাছে অল্প অল্প করে পাঠ করা। এর সুযোগ না থাকলে কোনো নির্ভরযোগ্য তাফসীরের কিতাব পাঠ করবে এবং যেখানেই কোনো প্রশ্ন ও সংশয় দেখা দেয় নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি দ্বারা উত্তর না খুঁজে বিজ্ঞ আলিমের সাহায্য নিবে।-মাআরিফুল কুরআন ২/৪৮৮
কোনো কোনো বুযুর্গ মনে করেন যে, আরবী ভাষা ও দ্বীনের প্রাথমিক বিষয়াদির জ্ঞান অর্জন ছাড়া কুরআন মজীদের তরজমা পাঠ করা ক্ষতিকর এবং এজন্য তা পরিহার করা উচিত। তাঁদের কথা একেবারে কারণহীন নয়। বর্তমানে তরজমা পাঠের বেশ প্রচলন আছে, কিন্তু যাকে বলে কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ সে সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় না। অনেকটা কুরআনের অর্থ বোঝার গৌরব অর্জনের প্রচেষ্টাই দেখা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তো শরীয়তের বিধিবিধান নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত হওয়ারও প্রবণতা দেখা যায়। বলাবাহুল্য, এতে কুরআন বোঝার স্থলে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তির দ্বার উন্মুক্ত হয়।
এই বিপথগামিতার কারণেই ঐসব বুযুর্গ নিরুৎসাহিত করেছেন। তাই তাঁদের সম্পর্কে ভুল ধারণা করা উচিত নয়; বরং হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. (১২৮০ হি.-১৩৬২ হি.)-এর মতে তাদের সম্পর্কেও সুধারণা রাখা জরুরি।
হাকীমুল উম্মত রাহ. বলেন, ‘যে কাজে লাভের চেয়ে ক্ষতির দিক প্রবল সেক্ষেত্রে মূলনীতি হল কাজটি যদি শরীয়তে ‘কাম্য ও করণীয়’ পর্যায়ের না হয় তাহলে মূল কাজটি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে যদি ‘কাম্য ও করণীয়’ হয় তাহলে মূল কাজটি নিষিদ্ধ করা হয় না, ক্ষতির দিকগুলি বন্ধ করা হয়। এজন্য যারা নিষেধ করেন তাদের খেদমতে এই মূলনীতি উপস্থাপন করে পরামর্শ দেওয়া যায় যে, তারা যেন পাঠন-পঠনের অনুমতি দেন তবে সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করেন।’-ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/৮৪
মোটকথা, কুরআন-তরজমা পাঠ করতে গিয়ে কিছু মানুষ নিয়ম রক্ষা করে না ও বিপথগামিতার শিকার হয় বলে কুরআন বোঝার প্রচেষ্টাকেই নিষেধ করে দেওয়া সমীচীন নয়।
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত আলিমগণ যে বিভিন্ন ভাষায় তরজমা ও তাফসীর লিখেছেন তা তো পঠন-পাঠনের জন্যই লিখেছেন। তাই সম্পূর্ণ নিষেধ না করে এমন বলা ভালো যে, তরজমা পাঠ করুন এবং কুরআন বোঝার চেষ্টা করুন। তবে তা যেন হয় সঠিক পন্থায়। অন্যথায় লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি।
কিছু নিয়ম-কানুন ও আদব-কায়েদা
প্রথমে কিছু আদব উল্লেখ করছি :
১. কুরআন মজীদের উপর ঈমানকে দৃঢ় করুন এবং পুনঃপুনঃ তার নবায়ন করুন।
২. অন্তরে কুরআনের আকর্ষণ ও ভালবাসা বৃদ্ধি করুন।
৩. বিশ্বাস রাখুন যে, কুরআন মজীদের বিধান ও শিক্ষা চিরন্তন ও শাশ্বত, যা বিশেষ স্থান বা কালের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয় কিংবা বিশেষ শ্রেণী ও জনগোষ্ঠীর জন্যও প্রদত্ত নয়; বরং স্থান-কাল নির্বিশেষে গোটা মানবজাতির জন্য অবশ্যগ্রহণীয় ও অপরিহার্যরূপে অনুসরণীয়। এর প্রতি বিশ্বাস ও ঈমান এবং এর মর্যাদা ও ইহতিরাম মানুষ মাত্রেরই অপরিহার্য কর্তব্য। বিশ্বাস রাখুন যে, ‘উন্নতি ও অগ্রগতি’র এই যুগেও সত্যিকারের উন্নতি শুধু কুরআনের পথেই অর্জিত হতে পারে এবং ‘জ্ঞান’ ও ‘আলো’র এই যুগেও প্রকৃত আলো কুরআন থেকেই পাওয়া যেতে পারে।
৪. বিশ্বাস রাখুন যে, আমাদের পূর্বসূরী সালাফে সালেহীন কুরআন আমাদের চেয়ে বেশি বুঝতেন এবং কুরআনের প্রতি ভক্তি ও ভালবাসাও তাঁদের বেশি ছিল। তেমনি জীবনের সকল অঙ্গনে কুরআনের অনুসরণ, কুরআনী বিধান বাস্তবায়ন এবং এ পথে সর্বস্ব ত্যাগের প্রেরণা ও আকাঙ্খাও তাঁদের অন্তরে বহুগুণ বেশি ছিল।
৫. ইয়াকীন করুন যে, দ্বীনের আমানত বহনকারী আলিমগণ, যারা রাতদিন কুরআন-হাদীস, সুন্নাহ ও সীরাতের পঠন-পাঠনে মশগুল তাঁরা আমাদের চেয়ে কুরআন বেশি বোঝেন। কুরআনের মর্যাদা ও ইহতিরাম তাঁদের অন্তরে আমাদের চেয়ে বেশি এবং সমাজে কুরআনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খাও তাঁদের অন্তরে প্রবল।
৬. বিশ্বাস রাখুন যে, কুরআন বোঝা, কুরআনের শিক্ষা ও বিধান মুখস্থ করা এবং সে অনুযায়ী আমল করা আজকের নতুন বিষয় নয়। কুরআন নাযিলের যুগ থেকেই তা চলে আসছে। আর ইসলামের প্রথম যুগে, বিশেষত খাইরুল কুরূনে (সাহাবা-তাবেয়ীন যুগে) তা হয়েছে সম্পূর্ণ নববী তরীকায়। এজন্য কুরআনের কোনো আয়াত বা পরিভাষার এমন কোনো ব্যাখ্যা যদি কেউ করে, যা ইসলামের কোনো মুতাওয়ারাছ ও খাইরুল কুরূন থেকে চলে আসা আকীদা কিংবা ইজমায়ী ও সর্বসম্মত বিধানের পরিপন্থী তাহলে বুঝতে হবে, লোকটি হয় নিজেই বিভ্রান্তির শিকার কিংবা পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে লিপ্ত।
৭. ইয়াকীন রাখুন যে, কুরআন হল আসমানী ফরমান ও ইলাহী-নসীহতনামা, আহকামুল হাকিমীনের আইন-কানূন ও তাঁর দেওয়া বিধান-শরীয়ত। কুরআন হল আসমানী ওহীর শাশ্বত, চিরন্তন ও সুসংরক্ষিত সূত্র। কুরআন হল নূর ও জ্যোতি এবং শিফা ও উপশম। কুরআন হল সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় এবং আলো-অন্ধকারের মাঝে পার্থক্য নিরুপনকারী। হেদায়েত ও গোমরাহি এবং সুন্নত ও বিদআতের মাঝে স্পষ্ট পার্থক্যরেখা। কুরআন হল মাওলার যিকর ও স্মরণের সর্বোত্তম উপায়। যে আল্লাহকে ভালবাসে কুরআন তার প্রেম-যন্ত্রণার উপশম, যে আল্লাহকে পেতে চায় কুরআন তার সান্নিধ্য-পিপাসার ‘আবে যমযম’।
কুরআন কি শুধু জ্ঞানের সূত্র? কেবল জ্ঞানার্জনের জন্যই কি আপনার কুরআন-অধ্যয়ন? বরং কুরআনের যতগুলো গুণ কুরআনে লেখা আছে সবগুলোকে চিন্তায় হাজির রাখুন এবং সে হিসেবেই কুরআনের সাথে আস্থা ও সমর্পণের সম্পর্ক গড়ুন।
কুরআনের জ্যোতিতে শুধু চিন্তা ও মস্তিষ্ক নয়, কর্ম ও হৃদয়কেও উদ্ভাসিত করুন। আপনার সর্বসত্তা ঐ আদর্শ-মানবের অনুকরণে গড়ে তোলার চেষ্টা করুন, যাঁর উপর কুরআন নাযিল হয়েছে এবং যাঁর চেয়ে অধিক অন্তরঙ্গ কুরআনের সাথে ও অধিক সমর্পিত কুরআনের প্রতি আর কেউ নেই।
৮. বিশ্বাস রাখুন যে, কুরআনের সাথে যুক্ত হতে পারা মানব-সন্তানের পরম সৌভাগ্য এবং কুরআনকে শিক্ষক ও রাহনুমা এবং বিচারক ও সিদ্ধান্তদাতা বলে গ্রহণ করতে পারা ব্যক্তি ও সমাজের চূড়ান্ত সফলতা। সুতরাং এই মহাসৌভাগ্য কিছুমাত্র অর্জিত হলেও আপনার হৃদয় যেন আনন্দে উদ্বেলিত হয় এবং যবান আল্লাহর শোকরে তরতাজা হয়।
৯. কুরআনের নূর ও হেদায়েত থেকে বঞ্চিতকারী সকল দোষ ও দুর্বলতা পরিহার করুন। বিশেষত অহঙ্কার, বিবাদ-বিসংবাদ, দুনিয়ার মোহ ও আখেরাত-বিস্মৃতির মতো ব্যধি থেকে দিল-দেমাগ ও আচরণ-উচ্চারণকে পবিত্র করুন।
১০. কুরআনের সঠিক মর্ম অনুধাবনে সহায়ক সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্য অর্জনের চেষ্টা করুন। বিশেষত সত্যিকারের অন্বেষণ, শ্রবণ ও সমর্পণ, গাইবের প্রতি ঈমান, তিলাওয়াত ও তাদাববুর (চিন্তা-ভাবনা), আল্লাহর ভয়, তাকওয়া ও তহারাত দ্বারা কুরআনের জ্যোতি লাভের চেষ্টা করুন।
কিছু উসূল ও নিয়মকানূন
১. সবার আগে সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন পড়তে শিখুন। এটি খুবই জরুরি। কিছু সূরাও মুখস্থ করুন। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, যরূরিয়াতে দ্বীন বা দ্বীনের স্বতঃসিদ্ধ বিষয়াদি এবং সার্বক্ষণিক ফরয আমলসমূহের জ্ঞান অর্জন করুন। এগুলো যেহেতু কুরআন মজীদের বিধান ও আহকাম তাই এগুলো যখন জানছেন তখন আপনি কুরআনের ইলমই হাসিল করছেন।
২. কোন তরজমা বা তাফসীর পাঠ করবেন তা আলিমের পরামর্শক্রমে নির্বাচন করুন। এক্ষেত্রে মনে রাখুন, সকল দ্বীনদার ব্যক্তি ‘মাওলানা’ নন। আর সকল ‘মাওলানা’ আলিম নন।
পরামর্শ না করলে এমন কারো তরজমা বা তাফসীর পাঠের আশঙ্কা থাকে, যে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকীদার লোক নয়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এ জাতীয় লোকেরা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তরজমা ও তাফসীরের স্বীকৃত মূলনীতি লঙ্ঘন করে থাকেন। তাছাড়া লেখকের রুচি ও প্রবণতা এবং চিন্তা ও চরিত্র পাঠককে কিছু না কিছু পরিমাণে প্রভাবিত করেই থাকে। তাই এক্ষেত্রে সাবধানতা খুবই জরুরি।
৩. তরজমা ও তাফসীর পাঠের ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অধ্যয়ন ঝুঁকিমুক্ত নয়। তাই কোনো আলিমের কাছে অল্প অল্প করে তরজমা ও তাফসীর পাঠ করুন। কারো মনে হতে পারে, তরজমা ও তাফসীর যখন মাতৃভাষায় করা আছে তখন আলিমের কাছে পড়ার আর প্রয়োজন নেই। এই ধারণা ভুল এবং একাধিক কারণে ভুল। সংক্ষেপে এটুকু কথা সবাই মনে রাখতে পারেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে কুরআন শেখার আদেশ করেছেন। তাই আমরা যেমন সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত উস্তাদের কাছে শিখি তেমনি কুরআনের অর্থ ও মর্মও উস্তাদের কাছেই শিখতে হবে। কুরআনের শব্দ উস্তাদের কাছে শিখব আর অর্থ ও মর্ম শিখব নিজে নিজে-এমন কথা তো নিবুর্দ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সাহাবায়ে কেরাম, কুরআনের ভাষাই ছিল যাঁদের মাতৃভাষা, তাঁরা তো কুরআনের মর্ম ও ব্যাখ্যা এবং কুরআনী বিধানের প্রায়োগিক রূপ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট থেকেই শিখেছেন। এরপর তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনও উস্তাদের কাছ থেকেই শিখেছিলেন। তাহলে কুরআনের ভাষা যাদের মাতৃভাষা নয় তারা কীভাবে উস্তাদ থেকে বে-নিয়ায হবে?
বিভিন্ন ভাষায় আলিমগণ যে তরজমা ও তাফসীর লিখেছেন তা এজন্য লেখেননি যে, যার যেভাবে ইচ্ছা পাঠ করবে; বরং সঠিক পদ্ধতিতে পাঠ করার জন্যই ঐসব গ্রন্থ লিপিবদ্ধ হয়েছে। অনেক আলিম তা স্পষ্ট ভাষায় বলেও গেছেন।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ. (১১১৪ হি.-১১৭৬ হি.) ‘‘ফাতহুর রহমান’’ নামে ফার্সী ভাষায় (যা ছিল ঐ সময়ের প্রচলিত ভাষা) কুরআন মজীদের যে তরজমা করেছেন তার ভূমিকায় লিখেছেন, ‘এই তরজমাটি যেন নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবাইকে পড়ানো হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘কুরআন শুদ্ধ করে পড়তে শেখার পর সহজে ফার্সী ভাষা বোঝে এমন সকলকে এই তরজমা পড়ানো উচিত, যাতে সবার আগে তাদের অন্তরে প্রবেশ করে কুরআনের বাণী।’ (সংক্ষিপ্ত)
তাঁর পুত্র হযরত মাওলানা শাহ আবদুল কাদের দেহলভী রাহ. (১১৬৭ হি.-১২৩০ হি.) ‘‘মুযিহুল কুরআন’’ নামে উর্দু ভাষায় কুরআনের তরজমা ও সংক্ষিপ্ত টীকা লিখেছেন। ভূমিকায় তিনিও বলেছেন, ‘লক্ষ করুন, মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য রবের পরিচয় লাভ করা, তাঁর গুণাবলি জানা এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ ও সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির জ্ঞান অর্জন করা। কারণ এটা ছাড়া বন্দেগী হতে পারে না। আর যে বন্দেগী করে না সে বান্দা নয়। আর মানুষ আল্লাহর পরিচয় পাবে (শিক্ষকের) শেখানোর দ্বারা। কারণ মানব-সন্তান সম্পূর্ণ অজ্ঞ অবস্থায় জন্মলাভ করে, এরপর শেখানোর দ্বারা সব কিছু শিখে ফেলে। আর যদিও (উর্দু তরজমার দ্বারা) কুরআনের অর্থ বোঝা সহজ হয়েছে তবুও উস্তাদের সনদ প্রয়োজন। কারণ একে তো সনদ ছাড়া কুরআনের মর্ম গ্রহণযোগ্য নয়, দ্বিতীয়ত পূর্বপর মিলিয়ে সঠিক অর্থ বোঝা এবং ভুল ও বিচ্ছিন্ন অর্থ গ্রহণ থেকে বেঁচে থাকা উস্তাদের সহায়তা ছাড়া হয় না। কুরআনের ভাষা আরবী হওয়ার পরও তো আরবদের উস্তাদের প্রয়োজন হয়েছে।’
একই কথা কিছুটা বিস্তারিতভাবে বলেছেন শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমূদ হাসান রাহ. (১২৬৮ হি.-১৩৩৯ হি.) তাঁর কুরআন-তরজমার ভূমিকায়।
হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ.-এর কাছে এক ব্যক্তি একটি দীর্ঘ প্রশ্ন লিখেছিলেন এবং দলীল-প্রমাণের সাথে এই প্রস্তাব পেশ করেছিলেন যে, ছেলে-মেয়েদেরকে (এবং বিশেষভাবে মযদুর ও শ্রমজীবী পরিবারের ছেলেমেয়েদেরকে) কুরআন তিলাওয়াত ও মাতৃভাষার শিক্ষা গ্রহণের পর আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের কোনো আলিমের কুরআন-তরজমা পড়িয়ে দেওয়া উচিত, আরবী ভাষা ও নাহব-ছরফের জ্ঞান অর্জনের উপর তা মওকুফ রাখা ঠিক নয়।
হযরত রাহ. জবাবে যা লিখেছেন তার সারকথা এই যে, কুরআন মজীদের শিক্ষা সকল শ্রেণী-পেশার ও সকল বয়সের নারী-পুরুষের জন্য। এ কথা তরজমা শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে শরীয়তের নীতিমালা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তরজমার পঠন-পাঠন তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন নিম্নোক্ত শর্তগুলি পালন করা হয় :
১. শিক্ষককে বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ আলিম হতে হবে, যাতে তরজমা বোঝানো ও তাফসীরের বিষয়বস্ত্ত নির্বাচনের ক্ষেত্রে শ্রোতার বুঝ-বুদ্ধির দিকে লক্ষ রাখতে পারেন।
২. ছাত্রকে অনুগত ও মেধাসম্পন্ন হতে হবে। নিজের বুঝ-বুদ্ধি সম্পর্কে অতি আত্মবিশ্বাসী হওয়া যাবে না। অন্যথায় তাফসীর ভুল বুঝতে পারে কিংবা তাফসীর বির রায়ের দুঃসাহস করতে পারে।
৩. কোনো বিষয় যদি ছাত্রের ধারণ-শক্তির তুলনায় সুক্ষ্ম ও জটিল হয় তাহলে শিক্ষক তাকে উপদেশ দিবেন যে, ‘এই অংশের তরজমা শুধু বরকতের জন্য পড় বা আপাতত এটুকুই মনে রাখ। এর চেয়ে গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করো না।’ ছাত্রও এই উপদেশ মান্য করবে। এরপর যখন সে তাফসীর বোঝার যোগ্য হবে, তা অধ্যয়নের দ্বারা হোক, জ্ঞান-বৃদ্ধির কারণে হোক কিংবা আলিমগণের সাহচর্যের দ্বারা হোক তখন কোনো বিজ্ঞ আলিমের কাছে ব্যাখ্যাসহ তরজমা পাঠ করবে। প্রাথমিক পাঠের উপর সমাপ্ত করবে না।
হযরত থানভী রাহ. আরো লেখেন, ‘একইভাবে যারা (শিক্ষিত বয়স্ক ব্যক্তিবর্গ) উস্তাদ ছাড়া তরজমা ও তাফসীর অধ্যয়ন করেন তাঁদের জন্যও অনেক বিজ্ঞ আলিমের পরামর্শ এটাই। তবে যোগ্য শিক্ষক পাওয়া না গেলে তাঁরা পরামর্শ দেন যে, প্রথমে দ্বীনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করবে, যাতে কুরআনের বিষয়বস্ত্তর সাথে পরিচিতি গড়ে ওঠে। এরপর অধ্যয়নের সময় কোথাও সামান্যতম খটকা হলেও নিজে নিজে চিন্তা না করে জায়গাটি চিহ্নিত করে রাখবে এবং কোনো বিজ্ঞ আলিমের সাক্ষাত পেলে তাঁর কাছ থেকে সমাধান নিবে।-ইমদাদুল ফাতাওয়া খ : ৪, পৃষ্ঠা : ৭৯-৮৫
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা কুরআন মুখস্থ করা ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা সহজ করে দিয়েছেন, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। কুরআনের শব্দ তো আল্লাহ তাআলা অর্থের চেয়েও সহজ করে দিয়েছেন। এরপরও সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত শেখা এবং হিফয করার জন্য উস্তাদের প্রয়োজন হয় কেন? তাহলে অর্থ শেখার ক্ষেত্রে উস্তাদের প্রয়োজন অস্বীকার করার কী অবকাশ থাকতে পারে?
৪. কুরআন মজীদের সাথে শুধু তরজমা ও তাফসীরভিত্তিক পরোক্ষ সম্পর্ক নয়, প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তৈরিরও চেষ্টা করুন। এর প্রথম উপায় তিলাওয়াত। দৈনিক তারতীলের সাথে এবং অর্থ জানা থাকলে তারতীল ও তাদাববুরের সাথে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবশ্যই তিলাওয়াত করুন। দ্বিতীয় উপায় এই যে, কুরআনের ভাষা অন্তত এটুকু শেখার চেষ্টা করুন যে, আয়াতের অর্থ বোঝার সাথে সাথে কোন শব্দের অর্থ কী এবং কোন বাক্যের বিষয়বস্ত্ত কী তাও যেন বুঝে আসে। কুরআনের ভাষার সাথে যদি এটুকু সম্পর্কও হয়ে যায় তাহলে ইনশাআল্লাহ তিলাওয়াতের স্বাদ দ্বিগুণ হয়ে যাবে, নামাযে ইমামের তিলাওয়াত শুনতে আনন্দ লাগবে এবং কুরআনের মিষ্টতা আগের চেয়ে অনেক বেশি অনুভূত হবে। কুরআনের ভাষার এই প্রাথমিক ইলমের জন্য হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুমের ‘আতত্বরীক ইলাল আরাবিয়্যা’ (এসো আরবী শিখি) এর তিনটি খন্ড ইনশাআল্লাহ যথেষ্ট হবে। এর সাথে যদি ‘আততামরীনুল কিতাবী আলাত ত্বরীক ইলাল আরাবিয়্যা’ অনুশীলনের সাথে সমাপ্ত করা যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। এরপর তাঁর কিতাব ‘আতত্বরীক ইলাল কুরআনিল কারীম’ (এসো কুরআন শিখি)-এর সবক নেওয়া যায়।
হযরত প্রফেসর হামীদুর রহমান ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমও দীর্ঘদিন যাবত কুরআনের ভাষা শিক্ষার একটি প্রাথমিক প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন। বুয়েট বাইতুস সালাম মসজিদে প্রতি মঙ্গলবার বাদ ইশা তাঁর এই দরস হয়ে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ এর দ্বারাও অনেক ফায়েদা হচ্ছে।
হযরত প্রফেসর ছাহেব সব সময় সাবধান করে থাকেন যে, এটি একটি প্রাথমিক মেহনত। এর উদ্দেশ্য শুধু কুরআনের শব্দাবলির প্রাথমিক অর্থ-জ্ঞান অর্জন করা, যাতে ভাষাগত দূরত্ব হ্রাস পায়। এটুকু শিখে না একথা ভাবার সুযোগ আছে যে, আমরা আরবী ভাষা শিখে ফেলেছি, আর না এই চিন্তার বিন্দুমাত্র অবকাশ যে, নাউযুবিল্লাহ আমরা তাফসীরুল কুরআনের উপযুক্ত হয়ে গেছি!!!
এই সচেতনতা খুবই জরুরি। কুরআনের ভাষা বা কুরআনের তরজমার সাথে কিছুটা জানাশোনা ও পরিচয় লাভের উদ্দেশ্যে যারা আরবী ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করবেন তাদের একথা সব সময় মনে রাখা উচিত। অন্যথায় যদি উজব ও অহঙ্কার সৃষ্টি হয় এবং এই সামান্য জেনে কেউ যদি আত্মবিস্মৃতির শিকার হয়ে যায় তাহলে শুধু ক্ষতি আর ক্ষতি!
উপরোক্ত ক্ষেত্রে কুরআন মজীদের এমন কোনো তরজমা, যাতে শব্দে শব্দে অনুবাদ করা হয়েছে কিংবা লিসানুল কুরআন ও লুগাতুল কুরআন বিষয়ে বাংলা বা ইংরেজি কোনো বইয়ের সহায়তা নেওয়া যায়। তবে গ্রন্থনির্বাচনে অবশ্যই কোনো বিজ্ঞ আলিমের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে উস্তাদে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুমের ঐ কথাটিও স্মরণ রাখা কর্তব্য, যা তিনি মাসিক আলবালাগে (মুহাররম ১৩৯২ হি.) লুগাতুল কুরআন বিষয়ের কোনো কিতাবের উপর আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন। তিনি লেখেন, ‘যারা কুরআন মজীদের সাধারণ নির্দেশনা, উপদেশ ও ঘটনাবলি বুঝতে চান এবং ধীরে ধীরে এতটুকু যোগ্যতা অর্জন করতে চান যে, তিলাওয়াতের সময় কুরআন মজীদের বিষয়বস্ত্ত থেকে যেন একদম বে-খবর থাকতে না হয় তাদের জন্য এই কিতাব অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও উত্তম সহযোগী হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে যে, ভাষা বিষয়ক গ্রন্থাদির মাধ্যমে কুরআন বোঝার প্রয়াস শুধু ঐ পর্যন্তই উপকারী হবে যে পর্যন্ত উদ্দেশ্য হয় উপদেশ গ্রহণ ও কুরআনের সাধারণ বিষয়াদির পরিচিতি। কিছু মানুষ শুধু ভাষার ভিত্তিতে কুরআনের বিধিবিধান ও আকীদা সংক্রান্ত বিষয়াদিতে ‘ইজতিহাদ’ আরম্ভ করেন। এটা একদিকে যেমন চরম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ অন্যদিকে যুক্তি ও ইনসাফেরও বিরোধী। এ ধরনের বিষয়ে কথা বলার জন্য কুরআন-হাদীসের সকল ইলম ও শাস্ত্রে পারদর্শী হতে হয়। শুধু লুগাতের মাধ্যমে ফয়সালা করা যায় না। এই বিষয়টি সামনে রেখে এই কিতাব থেকে যত পারুন উপকৃত হোন, ইনশাআল্লাহ ফায়েদাই ফায়েদা।’’-তাবসেরে পৃ. ৪০২
৫. সবশেষে যে কথাটি আরজ করতে চাই তা এই যে, কুরআন মজীদের অর্থ শেখা অনেক বড় নেক আমল। তাই তা হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত তরীকায়। অর্থাৎ এই কাজেও ইখলাস ও ইহতিসাব এবং ইহসান ও ইত্তেবায়ে সুন্নত লাগবে। আরো চেষ্টা করতে হবে, কুরআন মজীদের শিক্ষা গ্রন্থের পাতা থেকে গ্রহণ করার পাশাপাশি জীবনের পাতা থেকেও গ্রহণ করার, যেমনটি সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে ছিল। তাহলে ইলমের নূরের সাথে সাথে ঈমান ও আমলের নূরও হাসিল হতে থাকবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই হাদীসও আমাদের সামনে থাকা চাই-
من طلب العلم ليجاري به العلماء، وليماري به السفهاء أو يصرف به وجوه الناس إليه أدخله الله النار.
‘যে আলিমদের সাথে (আলিম নামে) গর্ব করার জন্য, কিংবা জাহিলদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার জন্য অথবা মানুষের মনোযোগ নিজের দিকে আকর্ষণ করার জন্য ইলম অন্বেষণ করে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন।’-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৬৫৪
এই হাদীসের আলোকে একটি কথা আমি বলে থাকি, কিছুদিন আগে এক বন্ধু কথাটা ‘‘রাহে বেলায়েত’’ নামক একটি বই থেকেও দেখালেন। আলোচনাটি ঐ বই থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি :
বিশেষ সাবধানতা
আমরা সাধারণত আল্লাহর কিতাবের জন্য এত পরিশ্রম করার সময় পাই না। এত আগ্রহও আমাদের নেই। কিন্তু যদি কেউ সেই তাওফীক পান, তবে শয়তান অন্য পথে তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেষ্টা করে। শয়তান তার মধ্যে অহঙ্কার প্রবেশ করায়। তিনি মনে করতে থাকেন যে, তিনি একজন প্রাজ্ঞ মানুষ, তিনি সমাজের অন্য অনেকের চেয়ে ইসলাম ভাল জানেন, সমাজের আলিমগণ কুরআন বুঝেন না, আলিমরাই ইসলাম নষ্ট করলেন ইত্যাদি।
পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখব যে, সকল প্রকারের অহঙ্কারই কঠিন পাপ ও ধ্বংসের কারণ। সবচেয়ে খারাপ অহঙ্কার জ্ঞান বা ধার্মিকতার অহঙ্কার। বস্ত্তত মুমিন কুরআন পাঠ করেন ও অন্যান্য ইবাদত বন্দেগি পালন করেন একান্তই নিজের জন্য। কুরআন পাঠ করে মুমিন আল্লাহর রহমত ও পুরস্কার আশা করেন। মুমিন কুরআনের জ্ঞান অর্জন করেন নিজের ভুলত্রুটি সংশোধন করে নিজের জীবনকে পরিচালিত করার জন্য। অহঙ্কারের উৎপত্তি হয় অন্যের দিকে তাকানোর কারণে। মুমিন কখনোই অন্যের ভুল ধরার জন্য বা অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করার জন্য ইবাদত করেন না। যখনই মনে হবে যে, আমি একজন সাধারণ শিক্ষিত মানুষ হয়ে কুরআন পড়ি, কয়েকখানা তাফসীর পড়েছি, অথচ অমুক আলিম বা তমুক ব্যক্তি তা পড়েনি, অথবা সমাজের আলিমগণ কুরআন পড়ে না … ইত্যাদি তখনই বুঝতে হবে যে, শয়তান মুমিনের এত কষ্টের উপার্জন ধ্বংস করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। বাঁচতে হলে সতর্ক হতে হবে। অন্য মানুষদের ভুলভ্রান্তি চিন্তা করা, অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করা সর্বোতভাবে পরিত্যাগ করতে হবে। সর্বদা আল্লাহর কাছে দুআ করতে হবে যে, আল্লাহ যেন কুরআন তিলাওয়াত, চর্চা ও পালনের ইবাদত কবুল করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই নিয়ামত বহাল রাখেন।
এই অহঙ্কারের আরেকটি প্রকাশ যে, আল্লাহর তাওফীকে কিছুদিন কুরআন চর্চার পর নিজেকে বড় আলিম মনে করা এবং বিভিন্ন শরয়ী মাসআলা বা ফাতওয়া প্রদান করতে থাকা। কুরআন চর্চাকে নিজের আখেরাত গড়া ও আল্লাহর দরবারে অগ্রসর হওয়ার জন্য ব্যবহার করতে হবে। নিজের জীবন সে অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। ফাতওয়ার দায়িত্ব আলিমদের উপর ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, প্রত্যেক মুসলিমই কুরআন পড়বেন, শিখবেন ও চর্চা করবেন নিজের জন্য। তবে প্রত্যেক মুসলিমই বিশেষজ্ঞ আলিম হবেন না। আল্লাহ আমাদেরকে চিরশত্রু শয়তানের ধোঁকা থেকে রক্ষা করুন।
-রাহে বেলায়েত, ড. খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গির। পিএইচডি (রিয়াদ) এম.এ (রিয়াদ) এম এম (ঢাকা) অধ্যাপক, আলহাদীস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। পৃষ্ঠা : ১৭২-১৭৩
আরেকটি কথা আরজ করেই শেষ করছি। ইতিপূর্বে তিলাওয়াতের গুরুত্ব ও মর্যাদা এবং বরকত ও ফযীলত সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল তা পাঠ করে আমাদের একজন সাধারণ শিক্ষিত দ্বীনী ভাই জনাব সেলিম সাহেব আমাকে বললেন, ‘আপনি খুব জরুরি কথা লিখেছেন। আমাদের অনেক ইংরেজি শিক্ষিত ভাইয়ের কাছে তিলাওয়াত শুদ্ধ করার গুরুত্ব নেই, অর্থ বোঝাকেই তারা প্রথম ও প্রধান কাজ মনে করেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘শুধু কুরআনের অর্থ বোঝাই যদি কাম্য হত তাহলে মানুষ হিফযে কুরআনের জন্য এত কষ্ট কেন করে?’ তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ঘটনা। আমাদের এক বন্ধু রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। ঐ সময় সেখানে ইসলামের চর্চা ও প্রচার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। ঘটনাক্রমে এমন এক ব্যক্তির সাথে আমাদের ঐ বন্ধুটির সাক্ষাত হল, যিনি একজন সাধারণ মানুষ হয়েও কুরআনের হাফেয ছিলেন। রাশিয়ার মতো দেশে ঐ সময় কীভাবে তিনি কুরআন মজীদ হিফয করলেন জিজ্ঞাসা করলে মানুষটি বললেন, আমি একজনের সাথে দর্জির কাজ করতাম। তিনি হাফিয ছিলেন। আমি দৈনিক তার কাছ থেকে দশ আয়াত করে শুনতাম এবং মুখস্থ করতাম। এভাবে আল্লাহর রহমতে পূর্ণ কুরআন হিফয হয়েছে। কিন্তু আফসোস! জীবন শেষ হয়ে এল, এক জিলদ কুরআন দেখার সৌভাগ্য আমার হল না।’ আমাদের বন্ধুটির কাছে কুরআনের একটি জিলদ ছিল। তিনি তা হাদিয়া দিলেন। ঐ হাফিযে কুরআন তখন জার জার হয়ে কাঁদতে লাগলেন এবং বার বার কুরআন মজীদের জিলদটিতে চুম্বন করতে লাগলেন!’
ভাই সেলিম বলেন, ‘যদি কুরআনের শব্দে ও বাক্যে নূর ও বরকত না থাকত তাহলে তা স্মৃতিতে ধারণের জন্য মানব-হৃদয় এত ব্যাকুল হত না, বিশেষত যাদের অর্থ শেখার সুযোগ হয়নি তারাও কুরআনের হিফয ও তিলাওয়াতের জন্য এমন কুরবান হত না এবং তাহাজ্জুদে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে তিলাওয়াত করতে পারত না। বান্দার জন্য সবচেয়ে লযযত ও আনন্দের বিষয়ই তো এই যে, গভীর রাতে কিংবা শেষ রাতে আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে কালামে পাক পাঠ করবে। সুষুপ্ত রজনীর গভীর নির্জনতায় শুধু সে ও তার মাওলা! বান্দা পড়বে, মাওলা শুনবেন! মাওলার একান্ত সান্নিধ্যে বান্দা তাঁর হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই উপমাহীন স্বাদ ও লযযত প্রমাণ করে, কুরআন আল্লাহর মাখলুক নয়, তাঁর সিফাত ও কালাম। পৃথিবীতে আল্লাহর অসংখ্য মাখলুক রয়েছে, কিন্তু কোথাও তো নেই এত স্বাদ, এত লযযত।’
এই হল একজন সাদাসিধা আল্লাহর বান্দার স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি, যিনি ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, তবে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের আছরমুক্ত একজন ভদ্র ও সুশীল মানুষ এবং ইনশাআল্লাহ উলুল আলবাবের (বুদ্ধিমান) অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নিজেদের অবস্থান বোঝার তাওফীক দিন এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিনয় ও আদব রক্ষা করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
হে আল্লাহ! আমি আপনার বান্দা, আপনার বান্দার ও আপনার বাঁদীর পুত্র। আমি আপদমস্তক আপনার কবজার ভেতর। আমার সম্পর্কে আপনার হুকুম সতত কার্যকর। আমার সম্পর্কে আপনার ফয়সালা সম্পূর্ণ ন্যায়ভিত্তিক। আপনি যে সকল নামে নিজেকে অভিহিত করেছেন, বা নিজ কিতাবে অবতীর্ণ করেছেন, বা আপনার কোন সৃষ্টিকে অবহিত করেছেন কিংবা নিজের কাছেই গায়ব রেখে দিয়েছেন, সেই সকল নামের উসীলায় আমি আপনার কাছে দরখাস্ত করছি যে, কুরআন মজীদকে আমার হৃদয়ের সজীবতা, আমার চোখের আলো, আমার দুঃখ-নিবারক ও আমার পেরেশানী বিদূরক বানিয়ে দিন-আল্লাহুম্মা আমীন! ছুম্মা আমীন।
وصلى الله تعالى وسلم على سيدنا ومولانا محمد خاتم النبيين وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.
জুমাদাল উখরা-১৪৩২ – মে-২০১১
মাসিক আলকাউসার