তাঁর সবচে’ বড় অভিধা—ইমামুল হারামাইন। উদিত হয়েছিলেন নিশাপুরের আকাশে, আলো ছড়িয়েছিলেন হেজায, শাম, ইরাক ছাড়িয়ে আরো অনেকদূর। ইসলামি চিন্তা ও মননের দীপ্ত এই প্রদীপকে আমরা শ্রদ্ধায় ডাকি—শায়খে শাফেয়ী। ভাষা ও বর্ণনায় স্বীকৃতি দিই তাঁর কারনামার, ইলম ও আমলের সুরভিত দৃশ্যের।
জ্যোতির্ময় এই জ্ঞানতাপসের নাম—আবুল মাআলি আবদুল মালেক ইবনুল ইমাম আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাইওয়াইহ জুয়াইনি, নিশাপুরী, শাফেয়ী।
যেখানে বেড়ে ওঠেন
১৪ মুহররম ৪১৯ হিজরী মুতাবেক ১২ ফেব্রুয়ারি, ১০২৮ খ্রিষ্টাব্দ। খোরাসান প্রদেশের প্রসিদ্ধ শহর নিশাপুর। সেই নিশাপুরের একটি গ্রাম জুওয়াইনে জন্মগ্রহণ করেন ইমাম জুয়াইনি। যে পরিবারে তাঁর জন্ম, সেখানে ইলম ও আমলের বসন্ত থাকে সারা বছর। ইলমি ও দ্বীনি আবহাওয়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা, মন ও মননের ভিত নির্মাণ। স্বপ্ন দেখার শুরু যে পরিবারে, সে পরিবার তাঁর বুকে রোপণ করে দেয় দুর্দমনীয় স্বপ্নের বীজ। ইলমের ময়দানে মহীরুহ হয়ে ওঠার সুতীব্র ইচ্ছে।
তাঁর বাবা ইমাম আবু মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ ইবনে মুহাম্মদ জুয়াইনি ছিলেন নিশাপুরে সেকালের সবচে বড় আলেম। ফিকহের দক্ষ এবং প্রাজ্ঞ উসতাদ। ফিকহ বিষয়ে তিনি রচনা করেছেন সারগর্ভ, সমৃদ্ধ সব কিতাব। তৈরী করেছেন শাফেয়ী মাজহাবের বিভিন্ন ব্যাখ্যাগ্রন্থ। শুধু ইলম নয়, আমলেও এগিয়ে। সারাক্ষণ ইবাদতের এক নিশ্চিন্ত মগ্নতার ছাপ থাকতো তাঁর অবয়বজুড়ে। প্রশান্তির মখমল আলো তাঁর চেহারাজুড়ে তৈরী করতো আশ্চর্য এক আকর্ষণ! ৪৩৮ হিজরীতে তিনি প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান।
তাঁর চাচা আবুল হাসান আলী ইবনে ইউসুফ জুয়াইনি ‘শায়খুল হিজায’ নামে পরিচিত ছিলেন। আল্লামা ইয়াকুত হামাভী রহ. তাঁর জীবনীতে লিখেন, ‘তিনি ছিলেন সূফী, বিনয়ী, জ্ঞানী, ইলম ও হাদীসে সদামগ্ন। ইলমে তাসাউফের ওপর অধ্যায় -পরিচ্ছেদ বিন্যস্ত করে ‘কিতাবুস সালওয়াহ’ নামে একটি কিতাবও লিখেছেন। আলোকোজ্জ্বল এই মানুষটি ৪৬৩ হিজরীতে নিশাপুরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আর তাঁর দাদা ছিলেন ভাষা সাহিত্যের বিদগ্ধ আলেম। ইয়াকুত হামাভী আবুল মাআলির বাবার জীবনীতে লিখেন, ‘তিনি তাঁর পিতার কাছে সাহিত্য পড়েছেন জুওয়াইনে।’ এর থেকে প্রতীয়মান হয়, তাঁর দাদা ছিলেন সাহিত্যে পণ্ডিত।
তাঁর দাদা বরণীয় সাহিত্যিক। চাচা সূফী মুহাদ্দিস। পিতা ফকীহ, উসূলবিদ। এক পরিবারে এতগুলো প্রতিভার সঙ্গ পেয়ে বড় হয়ে উঠেছেন আবুল মাআলি। একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন নিজেকে। খানিকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে ইবনে আসাকির বলেন, ‘তাঁকে প্রতিপালন করেছে ইমামের কোল। তাঁর দোলনায় দুলুনি দিয়েছে সৌভাগ্যের দূত। তাঁকে দুধ দিয়েছে ইলম ও আমলের স্তন—যতদিন না তিনি ইলম ও আমলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছেন।’
কেমন ছিলেন তিনি
এমন ঈর্ষণীয় এক স্থানে আল্লাহ তাঁকে উন্নীত করেছেন, যেখানে চাইলেই কেউ উঠতে পারে না। আলেমদের আলোচনার মজলিশে উচ্চারিত হতো তাঁর নাম। বিজ্ঞজনদের আসরে উদ্ভাসিত হতো তাঁর দ্যুতি। তিনি এতটাই বিনয়ী ছিলেন, তার সঙ্গীরা মনে করতো তিনি নিজেকেই নিজে ছোট করছেন। অন্তর ছিলো মাখনের মতো কোমল। আবেগী শে’র কিংবা কবিতা শুনলেই তাঁর চোখ বেয়ে পড়তো মুক্তোর মতো জল। নিজেতেই নিজে ডুবে থাকতেন, নিমজ্জিত হয়ে থাকতেন মুরাকাবায়।
আশ্চর্য মেধা এবং স্মৃতিশক্তি ছিলো তাঁর। শৈশবেই চমকে উঠেছিলো তাঁর মেধা ও আভিজাত্যের ঝলক। অধ্যাবসায় এবং নিবিড় একনিষ্ঠতায় বসে থাকতেন পড়ার টেবিলে। বইয়ের পাতায় উবু হয়ে থাকতেন সকাল-সন্ধ্যা। দিন রাত্রি। খুব ছোট বয়সেই শিক্ষকতার জন্য বসিয়ে দেয়া হয়েছিলো তার বাবার আসনে। তবুও পড়াশুনা থেকে মুখ ফেরাননি। দাঁত কামড়ে আঁকড়ে ধরেছেন।
মনটা যেমন নরম ছিলো তাঁর, তেমনি হাতটা ছিলো বড়। কখনো ব্যবসায় জড়াননি, রাখেননি কোন সঞ্চয়।
নির্মোহ সাদামাটা এক জীবন ছিলো। ইলম ও আমলের সৌরভে তিনি কেবল জীবনের প্রতিটি পাতা সুরভিত করে গেছেন।
পড়ার টেবিলে
তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি ঘরেই। বাবার কাছে পড়েছেন তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, উসূলে হাদীস এবং ফিকহ, সাহিত্য। পড়েছেন আরও অনেক লেখকের কিতাব। মনের ভেতর গেঁথে রেখেছেন টীকা-টিপ্পনিসহ সব ব্যাখা-বিশ্লেষণ।
ইবনে খাল্লিকান বলেন, ‘তিনি তাঁর পিতার সব কিতাবে টীকা-টিপ্পনি যুক্ত করেছেন। পরিমার্জন-পরিবর্ধন করেছেন। ফলে কোথাও কোথাও তাঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পিতার চেয়েও বেশী হয়ে গেছে।’
পিতা যখন মারা যান, তিনি বিশ বছরের তরুণ। পড়াশোনার টেবিলেই যার সব উৎসাহ। এবার সেই টেবিল থেকে তুলে তাঁকে বসিয়ে দেয়া হলো তাঁর বাবার শিক্ষকতার আসনে। তিনি পাঠদান শুরু করলেন। বাবার কাছে যেমন শুনেছেন, অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে যেমন ব্যাখা পেয়েছেন, সে অনুযায়ী পাঠদান করতে লাগলেন। কিছুদিনের ভেতরেই তাঁর দক্ষতা প্রতিভাত হয়ে উঠলো তাঁর পাঠে, দৃষ্টিভঙ্গিতে, মাসলা-মাসায়েলের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে। ছাত্রদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠলেন তিনি।
পাঠদানের ব্যস্ততায় ভুলে যাননি নিজের পাঠের কথা। বরং রাতদিন এক করে বইয়ের পাতায় মগ্ন হয়ে থাকছেন। ফজরের পর চলে যান উসতাদ আবু আব্দুল্লাহ খাব্বাযির মসজিদে। তাঁকে কোরআন পড়ে শুনান। তাঁর কাছ থেকে খুঁটে খুঁটে শিখে নেন বিভিন্ন বিষয়ের বিভিন্ন জ্ঞান, কৌশল, সমাধান। তারপর সেখান থেকে চলে এসে ব্যস্ত হয়ে পড়েন পাঠদানে। পাঠদান শেষ হলে আবার চলে যান মাদরাসায়ে বায়হাকীতে। সেখানে ইমাম আবুল কাসেম ইস্পাহানির কাছে পড়েন ইলমে কালাম, উসূলে ফিকহ। প্রতিনিয়তই যান এবং গিয়েছেন ছোট থেকে বৃদ্ধবয়স পর্যন্ত। কখন কোন আলেম থেকে উপকৃত হওয়া যায়, তার-ই সুযোগ খুঁজতেন। উসতাদ এবং শায়খের কাছ থেকে যতটুকু শিখেছেন, ততটুকু নিয়েই বসে থাকতেন না; প্রচুর পাঠ এবং মুতালাআ করতেন। তিনি নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি তাঁর কিতাবে টীকা যুক্ত করেছি।’ অর্থাৎ আবুল কাসেম ইস্পাহানির উসূলের কিতাবে নির্দিষ্ট অংকের একটি অংশ আমি যুক্ত করেছি।
তাঁর মাযহাব
আকিদায় তাঁর অনুসরণ আশআরী মাযহাব। ফিকহে তাঁর অনুকরণ শাফেয়ী মাযহাব। ইলমে কালামের ক্লাসে আশআরীদের পদ্ধতিতেই পাঠ দেন, কিতাব লিখেন। ফিকহের ক্লাসে আপাদমস্তক তিনি ধারণ করেন শাফেয়ীর অবয়ব। লেখায়, বলায়, দাওয়াতে, বক্তৃতায় ছড়িয়ে দেন শাফেয়ী মাযহাব। এজন্যই তাঁকে বলা হয় ‘শায়খে শাফেয়ী’।
বড় সুন্দর বলেছেন সুবকি রহ., ‘ফিকহে শাফেয়ী, সাহিত্যে আসমাঈ, ওয়াজ-নসিহতে হাসান বসরী। যেখানেই যান, সেখানেই তিনি সব ইমামের ইমাম, সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি যখন ফিকহ নিয়ে আলোচনা করেন, মনে হয় মুযনি রহ. তার কাছে এক বিন্দু। ইলমে কালাম নিয়ে যখন আলোচনা করেন, মনে হয় আশআরী রহ. তার কাছে একটি চুল। তাঁর বয়ান মানেই মার্জিত ভাষার এক মোহন যাদু।’
লেখার টেবিলে
লেখার টেবিলে বিষয় বৈচিত্রে অনন্য জুয়াইনি রহ.। এত লিখেছেন তিনি, সুবকি রহ.-এর দৃষ্টিতে তা এক কারামত। যত পৃষ্ঠা লিখেছেন, তাঁর পুরো জীবনকে যদি ঘণ্টায় নির্ণয় করা হয়, লিখিত পাতাগুলোকে ঘণ্টায় ভাগ করে দেয়া হয়, তাহলে ঘণ্টা কম পড়ে যাবে। বেশী হয়ে যাবে কিতাবের পাতা। তিনি যে শুধু লিখেছেন এমন নয়—শিক্ষকতা করেছেন, বয়ান করেছেন।
তাঁর লেখার বিষয়-বৈচিত্র্যকে ৪০টি শিরোনামে সাজানো যায়। কিছু আমাদের হাতে আছে, কিছু নেই, হারিয়ে গেছে। ফিকহ, উসূলে ফিকহ, তর্কশাস্ত্র, ইলমে কালাম, তাফসীর, বয়ান—এমন আরও অনেক।
বিষয়ভিত্তিক তাঁর কিছু কিতাবের নাম নিম্নে প্রদত্ত হলো।
উসূলে ফিকহ : আততালখিস, আলবুরহান, আল গুনইয়াহ, আততুহফাহ, আল ওরাকাত।
ইলমে ফিকহ : নিহায়াতুল মতলব ফি দিরায়াতিল মাযহাব, মুখতাসারুত তাকরীব, মুখতাসারুন নিহায়াহ, আর রিসালাতুন নিজামিয়্যাহ ফিল আরকানিল ইসলামিয়্যাহ।
তর্কশাস্ত্র : আল আসালিব, গুনইয়াতুল মুসতারশিদিন, আল কাফিয়াহ ফিল জাদল, আল উমদ, আদ দুররাতুল মাজিয়্যাহ ফিমা ওকাআ ফিহিল খিলাফ বাইনাশ শাফিইয়্যাহ ওয়াল হানাফিয়্যাহ।
ইসলামি রাজনীতি : কিতাবুল গিয়াসি।
ইলমে কালাম : আশ শামিল ফি উসূলিদ দ্বীন, আল ইরশাদ ইলা কাওয়াতি’ল আদিল্লাতি ফি উসূলিল ই’তেকাদ, লুমাউল আদিল্লাহ ফি কাওয়াইদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, আল আকিদাতুন নিজামিয়্যাহ ফি আরকানিল ইসলামিয়্যাহ।
তাঁর ছাত্ররা
শিক্ষক হিসেবে ফিকহে ইসলামির ক্লাসে যে মর্যাদা দখল করে আছেন তিনি, তা সবাই স্পর্শও করতে পারে না। তিনি নিজের সন্তানের মতো খেয়াল রাখতেন ছাত্রদের প্রতি। তাদের সাহস দিতেন, স্বপ্ন দেখাতেন, প্রেরণা দিতেন। কৌশলে জাগিয়ে তুলতেন ছাত্রদের ভেতরের শক্তি, তীব্র স্পৃহা। কিতাবের বিবরণমতে, মৃত্যুর সময় তাঁর ছাত্রসংখ্যা ছিলো ৪০০।
তাঁদের মধ্যে অন্যতম—হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজালী, খাওয়াফি, বাখরযী, আবদুল গাফের ফারসী, আবু নসর আবদুর রহীম, হাশেম ইবনে আলী ইবনে ইসহাক, আবদুল করীম ইবনে মুহাম্মদ দামগানী, আবদুল জাব্বার ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবি সালেহ, আবু আবদুল্লাহ ফারাবি, আবুল মুজাফফর আবউরদী, সাদ ইবনে আবদুর রহমান উসতারবাজী প্রমুখ।
ইন্তেকাল
ইলম ও আমলে সমৃদ্ধ একটি জীবন পাড়ি দেবার পর, কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হন জুয়াইনি রহ.। সুবকি রহ. বলেন, ‘এই পীড়া কিছুদিন তাকে প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে। এরপর তিনি পীড়া থেকে আরোগ্য পেয়ে আবার ক্লাসে মজলিসে আসা-যাওয়া শুরু করেন। তাঁর আরোগ্য লাভে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় ছাত্র এবং আম জনতার মাঝে। অল্পকিছুদিন সুস্থ থাকার পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তীব্র জ্বরে তিনি কেবল দুর্বল হতে থাকেন। বায়ু পরিবর্তনের জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ‘শানকানে’। লাভ হয় না, বাড়তেই থাকে দুর্বলতা।
২৫ রবিউল আওয়াল, ৪৭৮ হিজরী মুতাবেক ২০ আগস্ট, ১১৮৫ খ্রিষ্টাব্দ বুধবারের এক ঘন রাত্রিতে নিভে যায় ৫৯ বছর ধরে আলো বিলিয়ে যাওয়া প্রদীপটি।
আল জাজিরা থেকে অনূদিত
মূল : ডাঃ আলী আস সাল্লাবি
অনুবাদ : রাকিবুল হাসান
সূত্রঃ fateh24