যাকাতের আভিধানিক অর্থ
যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পবিত্র করা, বৃদ্ধি পাওয়া (বস্তুত যাকাত দিলে মাল পবিত্র হয় এবং বৃদ্ধি পায়।)
পারিভাষিক অর্থ
কোন অসচ্ছল গরীব মুসলমানকে বা মুসলমানদেরকে কোন প্রকার বিনিময় ও শর্ত ছাড়া যে সকল মালের উপর যাকাত প্রযোজ্য ঐ মালের (বর্তমান বাজারের বিক্রয় মূল্যের) চল্লিশ ভাগের এক অংশের মালিক বানানো। (আদ্দুরুল মুখতার ২:২৫৬)
যাকাত আদায়ের হুকুম ও তরককারীর পরিণতি
যাকাত ইসলামের একটি অন্যতম রুকন, নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্দিষ্ট সম্পদের মালিকের জন্য যাকাত আদায় করা ফরয। যাকাত অস্বীকার করলে ঈমান চলে যায়। যাকাতের ফরযিয়্যাত স্বীকার করে আদায় না করা হারাম ও কবীরা গুনাহ।
যারা যাকাত আদায় করবে না তাদের সম্পর্কে কুরআন হাদীসে অনেক কঠোর শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন সূরা তাওবায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন (তরজমা) “যারা স্বর্ণ রূপা (ধন-সম্পদ) জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে খরচ করে না (অর্থাৎ, যাকাত দেয় না) তাদেরকে কঠোর শাস্তির সংবাদ দিন। সে দিন জাহান্নামের আগুনে তাদের সম্পদ উত্তপ্ত করা হবে এবং সে গুলোর দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে।”
সেদিন বলা হবে এগুলো সেই সম্পদ যার যাকাত না দিয়ে তোমরা নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে, সুতরাং এখন তার স্বাদ আস্বাদন কর। (সূরা তাওবা-৩৪/৩৫)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. হতে বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি তার মালের যাকাত আদায় করে না কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার গলায় সেই মালকে সাপ বানিয়ে ঝুলিয়ে দিবেন। অন্য এক হাদীসে আছে যে, সাপ তার দুই চোয়ালে দংশন করতে থাকবে এবং বলবে আমি তোমার মাল, আমি তোমার সঞ্চয়। (তিরমিযী হাঃ নং ২৪৪১, ইবনে মাজাহ হাদীস নং ১৭৮৪)
এছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে আরো অনেক শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে।
যাকাত যোগ্য সম্পদ ও যাকাতের নিসাব
ঋণ ও মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য, অথবা ৫২.৫ তোলার রূপার মূল্য সমপরিমাণ নগদ টাকা বা ব্যবসায়ের মালের মালিক হলে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা আড়াই টাকা হারে যাকাত আদায় করতে হয়। (আলমগীরী ১:১৮৭-১৯২)
উল্লেখ্য যে, কোন প্রকার সম্পদ স্বতন্ত্রভাবে নেসাব পরিমাণ না হয়ে একাধিক প্রকারের অল্প অল্প হয়ে সমষ্টিগতভাবে মূল্য হিসাবে ৫২.৫ তোলার মূল্য সমপরিমাণ হলেও যাকাত প্রযোজ্য হবে। (আল বাহরুল রায়েক ২:৪০০,৪০১)
যাকাত যার উপর ফরয হয়
সাবালক সজ্ঞান মুসলমান নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়ার পর চন্দ্র মাস হিসেবে এক বছর অতিবাহিত হলে তার উপর যাকাত আদায় করা ফরয হয়।
একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তি (যেমন, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে) নেসাবের মালিক হলে প্রত্যেককেই স্বতন্ত্রভাবে যাকাত আদায় করতে হবে। নেসাবের মালিক প্রত্যেকের উপরই যাকাত আদায় করা ফরয। স্ত্রীর যাকাত স্বামীর উপর বর্তায় না, তেমনিভাবে সন্তানদের যাকাত পিতার উপর বর্তায় না। তবে কেউ যদি অন্যের অনুমতিক্রমে তার পক্ষ থেকে যাকাত দিয়ে দেয় তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে।
যাকাত কাকে দিবেন?
যাদের সাথে দাতার জন্মগত সম্পর্ক আছে যেমনঃ তার পিতা মাতা, দাদা, দাদী, নানা, নানী, প্রমুখ এবং দাতার সাথে যাদের জন্মগত সম্পর্ক আছে যেমনঃ তার ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনী ইত্যাদি তাদেরকে যাকাত ফিতরা দেওয়া যায় না।
অনুরূপ ভাবে স্বামী তার স্ত্রীকে, স্ত্রী তার স্বামীকে যাকাত ফিতরা দিতে পারবে না। অমুসলিম ও ধনী ব্যক্তি (নেসাব পরিমাণ মালের মালিক) কিংবা ধনীর নাবালেগ সন্তানকে দান করলেও যাকাত ফিতরা আদায় হবে না। বরং যাকাত ফিতরা দিতে হবে এমন গরীব ও ফকীর মিসকীনকে যাদের নিকট নিসাব পরিমাণ মাল নেই।
ধর্মীয় খিদমতে রত নিঃস্ব দরিদ্র ব্যক্তিবর্গকে যাকাত ফিতরা দান করলে ধর্মীয় খিদমতের সহযোগিতা হিসেবে অধিক সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়। (সূরা বাকারাঃ ২৭৩)
যাকাত কখন আদায় করতে হয়?
যাকাত ওয়াজিব হওয়ার সময় যদি রমাযান মাস না হয়ে অন্য কোন মাস হয় তাহলে সে মাসেই যথা তারিখে সমুদয় মালের হিসাব নিকাশ করে যাকাতের পরিমাণ বের করা জরুরী। আদায়ের ক্ষেত্রেও রমাযানের অপেক্ষা না করে সাথে সাথে আদায় করে দেওয়া জরুরী। যাতে রমাযানের পূর্বে ইন্তেকাল হয়ে গেলে ফরয জিম্মায় বাকী না থেকে যায়। দেরি করে আদায় করলে যদিও যাকাত আদায় হয়ে যায়। কিন্তু ওয়াজিব তরক করার দরুন গুনাহগার হতে হয়। তবে নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়ার পর বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই যদি যাকাত আদায় করে দেয় তাহলে কোন অসুবিধা নেই। যাকাত আদায় হয়ে যাবে। (কিফায়াতুল মুফতী ৪:২৬২, আলমগীরী ১:১৮৭-১৯২)
যাকাত সংক্রান্ত কিছু মাসায়েল
১। শুধু স্বর্ণ বা রৌপ্য থাকলে তার যাকাত আদয়ের পদ্ধতি
কোন ব্যক্তি যদি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মালিক হয় চাই তা ব্যবহার করুক বা নাই করুক ঋণ মুক্ত অবস্থায় তার নিকট এক বৎসর কাল থাকলে তার উপর যাকাত দেওয়া ফরয। যদি তার নিকট অন্য কোন মাল না থাকে তাহলে উক্ত মালের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ কিংবা তার সমপরিমাণ মূল্য আদায় করতে হবে। প্রয়োজনে উক্ত স্বর্ণ বা রূপা থেকে কিছু অংশ বিক্রি করে হলেও যাকাত আদায় করা জরুরী। (আদদুররুল মুখতার ২:২৯৫)
২। যদি ব্যাংকে বা অন্য কোন তহবিলে কারো টাকা জমা থাকে আর ঐ টাকাগুলো ঋণমুক্ত অবস্থায় নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে চন্দ্র মাস হিসেবে এক বছর অতিক্রান্ত হলে তার যাকাত দিতে হবে। (আলমগীরী ১:৭২, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া ৩:৫৭)
৩। দোকান/বাড়ী ভাড়ার জন্য প্রদত্ত এডভান্স টাকায় যাকাত
যদি কোন সাহিবে নিসাব ব্যক্তি দোকান কিংবা বাড়ী ভাড়া নেয় আর মালিকের নিকট সিকিউরিটি হিসাবে জমা রাখে যা পরবর্তীতে ফেরতযোগ্য তাহলে উক্ত টাকার যাকাত দেয়া ফরয। কারণ, উক্ত টাকা তার মালিকানায়ই রয়েছে । জমা রাখার দরুন তার মালিকানা শেষ হয়নি, সুতরাং অন্যান্য মালের সাথে হিসাব করে তার এ টাকার যাকাতও আদায় করতে হবে। (আদদুররুল মুখতার ২:৩০৫, দারুল উলূম ৬:৭৭ আহসানুল ফাতাওয়া ৪:২৫১)
তবে উক্ত টাকা যদি এডভান্স ভাড়া হয় যা থেকে মাসে মাসে কিছু কিছু কাটা যায় তাহলে উক্ত টাকার যাকাত দিতে হবে না।
৪। টাকা ও স্বর্ণ রূপা মিলে নিসাব পরিমাণ হলে তার যাকাতের হুকুম
স্বর্ণ বা রূপার মধ্যে যে কোন একটির গহনা আছে, কিন্তু নিসাব পরিমাণ নয়, কিন্তু তাহার সাথে নগদ টাকা (চাই পাঁচ/দশ টাকাই হোক না কেন) সারা বৎসর হাতে আছে। যদি উক্ত স্বর্ণ বা রূপার সাথে টাকা একত্র করলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার দামের সমান হয় তাহলে তার উপর যাকাত ফরয হবে। (রদ্দুল মুহতার ২:২৯৬, ফাতাওয়া দারুল উলূম, ৬:৫০)
৫। করয দেয়া টাকার উপর যাকাত
করয দেয়া টাকা উসূল হওয়ার পর উক্ত টাকার যাকাত দিতে হবে এবং বিগত বছর সমূহে উক্ত টাকার যাকাত না দিয়ে থাকলে সেই বকেয়া যাকাতও দিতে হবে। তবে কেউ যদি করযের টাকা উসূল হওয়ার পূর্বে প্রতি বছর উক্ত টাকার যাকাত দিয়ে দেয়, তাহলেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। (আদ্দুররুল মুখতার ২:২৬৬, দারুল উলূম ৬:৪৫,৭৭)
যে করযের টাকা পাওয়ার কোন আশা নেই সে টাকার যাকাত দিতে হবে না। আর যদি কখনো উসূল হয় তাহলে সে বছর থেকে যাকাত দিবে। অতীতের যাকাত দিতে হবে না। (কিতাবুল ফিকহ ১:৫৪৮, দূররে মুখতার ও রদ্দুলমুহতার খণ্ড-২ পৃ-২৬৬)
৬। যাকাতের নিয়তে ঋণ মাফ করে দেওয়া
যাকাতের নিয়্যতে ঋণ মাফ করে দিলে যাকাত আদায় হবে না। যাকাত আদায় হওয়ার জন্য তামলীক তথা অন্যকে খালেছ ভাবে যাকাতের মালের মালিক বানিয়ে দেওয়া শর্ত। আর যাকাতের নিয়্যতে ঋণ মাফ করে দিলে গরীবকে যাকাতের টাকার মালিক বানানো হচ্ছে না । তাই এ পদ্ধতিতে যাকাত আদায় হবে না।
তবে এরূপ ক্ষেত্রে যাকাত আদায়ের সঠিক পন্থা হলো, ঋণ দাতা প্রথমে নিজের পক্ষ থেকে গরীব ঋণ গ্রহীতাকে নিঃশর্তভাবে যাকাতের টাকার মালিক বানিয়ে দিবে। তারপর তার থেকে পাওনা ঋণের টাকা উসূল কবে নিবে, এতে যাকাত আদায় হয়ে যাবে এবং ঋণও উসূল হয়ে যাবে। (আদদুররুল মুখতার ২:২৭০, ফাতাওয়া আলমগীরী ১:১৭১, রহীমিয়া ২:১২)
৭। রাজনৈতিক দলকে যাকাত দেওয়ার বিধান
যদি কোন রাজনৈতিক দল যাকাতের টাকা কুরবানীর চামড়া ইত্যাদি সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা সেবার নামে সংগ্রহ করে আর সেগুলোকে ইলেকশনে ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও ব্যয় করে এবং রাজনৈতিক কর্মীদের ভাতা হিসেবে প্রদান করে তাহলে তাদেরকে এ জাতীয় সদকা (অর্থাৎ, সদকায়ে ওয়াজিবাহ) প্রদান করা জায়িয নয়। এবং এতে যাকাত দাতার যাকাত আদায় হবে না। (খাইরুল ফাতাওয়া ৩:৩৯৭)
৮। মসজিদ মাদরাসার কাজে যাকাতের টাকা ব্যয় করা
মসজিদ, মাদরাসা, এতীমখানা, হাসপাতাল ইত্যাদির নির্মাণ কাজে যাকাতের টাকা ব্যয় করলে যাকাত আদায় হবে না। যাকাত আদায় হওয়ার জন্য শর্ত হলো, যাকাতের প্রকৃত হকদারকে বিনিময়হীন ভাবে উক্ত মালের মালিক বানিয়ে দেয়া। নির্মাণ কাজে ব্যয় করলে যেহেতু কোন হকদার ব্যক্তিকে মালিক বানানো হয় না তাই এ সুরতে যাকাত আদায় হবে না। সুতরাং এসব নির্মাণ কাজে কেউ যাকাত দিয়ে থাকলে ঐ পরিমাণ টাকার যাকাত দ্বিতীয়বার আদায় করতে হবে। উল্লেখিত কারণেই যাকাতের মাল জনকল্যাণমূলক কাজে যেমন, রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ইত্যাদির জন্য ব্যয় করা না জায়িয। অনুরূপভাবে ইসলামের নামে টিভি চ্যানেল বা পত্র-পত্রিকার কাজে যাকাত দিলে সে যাকাত আদায় হবে না। (আলমগীরী ১:১৮৮, আহসানুল ফাতাওয়া ৪:২৮২)
৯। হিসাব করে যাকাত দেয়া জরুরী
বহু লোক যাকাত-ই দেয় না। আর কিছু লোক এমনও রয়েছে যারা যাকাত দেয় ঠিক কিন্তু যাকাত দেয়ার সঠিক পদ্ধতি তারা অবলম্বন করে না।
শরী‘আতে যখন শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে বলা হয়েছে তখন উহার দাবী হলো যাকাতযোগ্য সমস্ত সম্পদ হতে হিসাব করে শতকরা আড়াই ভাগ বের করে যাকাত দেয়া। যদি কেউ হিসাব না করে যাকাত আদায় করে আর এই টাকাও নির্দিষ্ট পরিমাণ হতে কম আদায় করে তাহলে তার জন্যও আখিরাতে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। (সূরা তাওবা ৩৪/৩৫)
হিসাব করার সময় যাকাতযোগ্য মালের বর্তমান বাজার দর হিসেবে হিসেব বের করবে। যে দামে খরিদ করা হয়েছে বা ভবিষ্যতে যে দামে বেচা যাবে তা ধর্তব্য নয়। (ফাতাওয়ায়ে শামী ২:২৮৬)
উল্লেখ্য যে, গরীব আত্মীয়-স্বজনকেও যাকাতের মাল দেয়া যায় বরং তাদেরকেই আগে দেওয়া উচিত। অবশ্য তাদেরকে হাদিয়া বলে দেয়া ভালো যাতে তারা মনে কষ্ট না পায়। তবে মেহমানে রাসূল তালিবে ইলমের কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাদেরকে যাকাতের বড় অংশ দেয়া উচিৎ তাতে যাকাত তো আদায় হবেই সেই সাথে কুরআনী তা‘লীমের সহযোগিতা করার দরুন ছদকায়ে জারিয়ার সাওয়াবও হাসিল হবে। (সূরায়ে বাকারা ২৭৩)