আবু গারিব কারাগার : ইসলামোফোবিয়ার জাহান্নাম

(ইরাক আগ্রাসন শুরু হয় ২০০৩ সালের ২০ শে মার্চ। সে আগ্রাসনের অন্যতম বড় ক্ষত আবু গারিব কারাগার। এই কারাগার ছিল সাক্ষাৎ জাহান্নাম ; আধুনিক মানুষের অসুস্থতা ও বর্বরতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আধুনিক মানুষের মনের মধ্যে আছে ঘৃণা, বর্ণবাদ ও অসুস্থতা; সবমিলিয়ে আবু গারিব ছিল ইসলামোফোবিক জাহান্নাম। )

নানান দৃষ্টিকোণ থেকেই বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া শব্দটি বহুল প্রচলিত। এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অনেক। এদের মধ্যে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ আছেন, কোনো প্রকার ধর্ম না-মানা মানুষও আছেন। এমনকি খোদ ইসলাম পালনকারী অনেক মানুষও এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত। ইসলামফোবিয়া কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, তা সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান সিনেটর ফ্রেজার এনিংয়ের বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায়। প্রায় অর্ধশত নিরাপরাধ মানুষ নির্মমভাবে খুন হওয়ার পর সেই খুনের দায় নিহতদের উপরে চাপিয়ে দেয়ারই অপরনাম ইসলামোফোবিয়া।

মূলত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজেদের অপকর্ম ঢেকে রাখতে এই ফোবিয়ার ধারণাকে জনপ্রিয় করেছে। এবং এর মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের জুলুম ও শত্রুদের ওপর প্রতিশোধের পথকে সুগম করেছে। ইরাকের আবু গারিব কারাগার হচ্ছে এমনই একটি ইতিহাস, যেটা ইসলামোফোবিয়ার ফলে একটি পাশবিক দোজখে পরিণত হয়েছে।

কারগারটি প্রথমে ইরাকের একটি কুখ্যাত কারাগার ছিল। সাদ্দাম হোসাইনের আমলে সেখানে ৫০ হাজার বন্দী ছিল। তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো। এরপর ২০০৩ তিন সালে আমেরিকার আক্রমণে সাদ্দাম হোসাইনের পতন ঘটে। আমেরিকা ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লুটপাট শুরু করে। তন্মধ্যে আবু গারিব কারাগারটিও ছিল। কারাগার দখলে নিয়ে আমেরিকান সেনাবাহীনি এর রূপ বদলের চেষ্টা করে। প্রবেশদ্বার থেকে সাদ্দাম হোসাইনের ছবি সরিয়ে সেখানে ভিন্ন একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়। তাতে লেখা ছিল, America is the friend of all Iraqi people. আমেরিকা আদতেই ইরাকি জনতার কতটা বন্ধু হয়ে উঠেছিল তা বেরিয়ে আসে ২০০৪ সালে।

‘সিবিএস নিউজ 60 minutes’ নামক একটি টিভি-অনুষ্ঠানে আবু গারিব কারাগারে চলমান নৃশংসতার কিছু চিত্র প্রদর্শন করা হয়। দৃশ্যগুলি এতটাই ভয়াবহ ও বিভৎস ছিল যে বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষকেই তা নাড়িয়ে দেয়। এত নিষ্ঠুরভাবেও যে মানুষ মানুষকে নির্যাতন করতে পারে তা বিশ্ববাসীর জানা ছিল না।

ছবিগুলো আমেরিকা এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড় তোলে। চারদিক থেকে সমালোচনা ধেয়ে আসতে থাকে নির্যাতনকারী সৈন্যদের দিকে। এর জের ধরে একে একে বেরিয়ে আসে কারাগারে ইরাকি বন্দিদের সাথে ঘটে যাওয়া নৃশংস অনেক ঘটনা। কিন্তু এতকিছুর পরও আমেরিকার বেশ কিছু রক্ষণশীল গণমাধ্যম নির্যাতনকারী সৈন্যদের পক্ষে সাফাই গেয়ে যায়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ এসব নির্যাতনের ছবিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেন এবং এগুলো আমেরিকান বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের নিছক ভুলের ফসল বলে দাবি করেন।

এই ঘটনার জের ধরে আমেরিকান প্রতিরক্ষা দপ্তর ১৭ জন সৈন্য এবং অফিসারকে বাহিনী থেকে অপসারণ করে। কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। কিন্তু এসব কিছুই যেন ছিল অনেকটা লোক-দেখানো। কারণ বন্দী-নির্যাতনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তাই থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

আবু গারিব কারাগারে তিন ধরনের বন্দীদের আটক রাখা হয়। সাধারণ চোর-ডাকাত, বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা এবং মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলাকারী বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য–এই তিন শ্রেণীর অন্তর্গত। বন্দীদের মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশই ছিল নিষ্পাপ এবং সন্দেহের বশে আটককৃত। বন্দীদের মার্কিন আর্মি এবং সিআইএ’র সদস্যরা বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি, অত্যাচার, ধর্ষণ এবং হত্যা করতো। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কারপিনস্কি ছিলেন এই কারাগারের প্রধান কমান্ডার, যিনি পূর্বে কখনো কোনো কারাগারের দায়িত্বে ছিলেন না।

কারাগারে বছরের পর বছর ধরে বন্দীদের ওপর যেসকল শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়, তা বর্ণনাতীত। কেবল ভুক্তভোগীকেই তা তাড়িয়ে ফিরবে আমরণ। তবে আবু গারিব থেকে মুক্তি পাওয়া কিছু মানুষের জবানবন্দী আর সংবাদকর্মীদের তৎপরতায় যেসকল নির্যাতনের বিবরণ বেরিয়ে এসেছে তার মধ্যে কয়েকটি নিম্নে তুলে ধরা হলো।

ইলেক্ট্রিক শক

বন্দীর শরীরে এক টুকরা কাপড় জড়িয়ে মাথায় কালো হুড পরিয়ে দিয়ে হাত-পায়ের আঙুল ও পুরুষাঙ্গে ইলেক্ট্রিক তার লাগিয়ে একটি সরু বক্সের ওপর অনির্ধারিত সময়ের জন্য দাঁড় করিয়ে রাখা। বক্স থেকে পা ফঁসকে পড়ে গেলেই ইলেক্ট্রিক শকে মৃত্যু হবে হতভাগ্য বন্দীর। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে এই সরু পুলসিরাতের ওপর প্রবল জীবনের ভয় আর অসীম অনিশ্চয়তার ভেতর দুলতে থাকতেন স্বাধীনতাকামী মুসলিম বন্দীরা।

যৌন নির্যাতন

অনেক পাশবিক উপায়ে যৌন নির্যাতন করা হয় বন্দীদের। সেলের সামনের দিকটা লোহার শিক দিয়ে তৈরি করা। ফলে অন্য সেল থেকে বা আশপাশ থেকে সবাই দেখতে পেতো। কমবয়সী কিশোরদের আমেরিকান সৈন্যরা সবার সামনে নির্মমভাবে বলাৎকার করত। এছাড়াও পুরুষাঙ্গে ভারী বস্তু ঝুলিয়ে দেয়া এবং টিউব লাইট ও পাইপজাতীয় বস্তু পশ্চাদ্দেশে প্রবেশ করানোর মতো বিভৎস শাস্তির বর্ণনাও প্রত্যক্ষদর্শীরা দিয়েছেন। সাইদ আল-শেইখ নামক এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে নগ্ন করে তাঁর শরীরের পেছনের অংশে একটি মেয়ের প্রতিকৃতি এঁকে তাঁকে সকলের সামনে বাধ্যতামূলক দাঁড় করিয়ে রাখা হয় বলে তিনি জানিয়েছিলেন।

ইসলামিক ব্যক্তিত্বদের ওপর পাশবিক ক্ষোভ

একবার কারাগারে একজন ইমামকে বন্দী করা হয়। এক নারী সৈনিক এই মুসলিম ধর্মগুরুর ওপর ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে একটি কৃত্রিম পুরুষাঙ্গ দিয়ে তার উপর ঘৃণ্যতম অত্যাচার চালায়।

বিবিধ

জিজ্ঞাসাবাদের সময় বন্দীর গায়ের ওপর কুকুর লেলিয়ে দেয়া হতো। এবং অনেক সময় বন্দীকে মাটিতে শুইয়ে কানের কাছে ফুলস্পিডে মিউজিক ছেড়ে দিয়ে শ্রবণশক্তি বিকল করে ফেলা হতো। ২০০৫ সালের নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে এক বন্দীর জবানবন্দি প্রকাশ করা হয়। তিনি বলেন, সৈনিকরা আমাদের ওপর মূত্রত্যাগ করত। গলায় রশি বেঁধে হামাগুড়ি দিয়ে গাধা বানিয়ে পিঠে আরোহন করত। উলঙ্গ করে একজনের ওপর একজনকে রেখে মানুষের পিরামিড তৈরী করে বিকৃত আনন্দ লাভ করত। লোহার রড দিয়ে প্রহার করত। এবং গায়ের ওপর ফসফরিক এসিড ঢেলে দিত।

পরবর্তী সময়ে আবু গারিব সংক্রান্ত আরও কিছু অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বারাক ওবামা সরকার এবং সাম্রাজ্যবাদের একান্ত অনুগত সহচর মিডিয়া তা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গোপন করে।

২০০৩ সালের ৪ নভেম্বর আবু গারিবে মৃত্যু ঘটে সশস্ত্র বিপ্লবী মানাদিল আল জামাদির। আবু গারিব কারাগারে ঘটে যাওয়া নির্যাতন সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায়, নেভি সিলের একটি দল মানাদিলকে আবু গারিব কারাগারে ধরে আনে। এ সময় তাঁর মুখ একটি বালুর বস্তা দ্বারা ঢাকা ছিল। কারাগারে আনার পরপরই শুরু হয় নির্যাতন। নেভি সিলের সদস্যরা অনবরত তাঁকে ঘুষি মারছিল, কেউ একজন তাঁর গলা টিপে ধরে এবং তাঁর চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেয়। নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গেলে একজন তাঁর মাথায় বন্দুকের বাট দিয়ে সজোরে আঘাত করে।

একদফা নির্যাতনের পর মানাদিলকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি শাওয়ার রুমে। সেখানে সিআইএ এবং আর্মি ইন্টিলিজেন্সের কয়েকজন সদস্য তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর এক ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে মানাদিল আল-জামাদির মৃত্যু ঘটে।

মৃত্যুর পরে মানাদিলের লাশের পাশে মার্কিন সার্জেন্ট চার্লস গ্র‍্যানার হাসিমুখে ভিক্টরি সাইন দেখিয়ে ছবি তুলেন। ভেবে কুল পাওয়া যায় না, মানুষের বিরুদ্ধে মানুষ এতটা বিদ্বেষ কোথায় লুকিয়ে রাখে! আমেরিকানরা ইরাকে দখলদার ছিল। মানাদিল ছিলেন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা। তাঁর মৃত্যুতে মার্কিন সার্জেন্টের এই উল্লাস তাঁর মস্তিষ্ক নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। আবু গারিবে যেসব শাস্তি প্রয়োগ হতো, এসব কিছুতেই সামরিক হতে পারে না। কিছু বর্বর রুচিবিকৃত মানুষের হাতে অসহায় হয়ে পড়েছিল হাজার হাজার বন্দী।

বস্তুত যেসকল ঘটনা সামনে এনে পশ্চিমা মিডিয়া ইসলামোফোবিয়ার ধারণাকে মজবুত করে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নাইন/ইলেভেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো–আফগান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ইত্যাদি তুলে রাখি–শুধুমাত্র আবু গারিবের মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের মাত্রাই বহু আগে নাইন-ইলেভেন অতিক্রম করে ফেলেছে।


কাজী মাহবুবুর রহমান
মূলঃ fateh24