ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)

ইমাম আবূ হানীফার জীবনী প্রসঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হাম্বালী ফকীহ আল্লামা যাহাবী (৭৪৮ হি) প্রসিদ্ধ একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:

‘‘ইলমুল ফিকহ ও এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে নেতৃত্বের মর্যাদা এ ইমামের জন্য সংরক্ষিত। এতে কোনোই সন্দেহ নেই। যদি দিবসকে প্রমাণ করতে দলিলের প্রয়োজন হয় তবে আর বুদ্ধি-বিবেক বলে কিছুই থাকে না’’।

অর্থাৎ দিবসের দিবসত্বে সন্দেহ করা বা দিবসকে দিবস বলে প্রমাণ করতে দলিল দাবি করা যেমন নিশ্চিত পাগলামি, তেমনি ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদার বিষয়ে সন্দেহ করা বা তাঁর মর্যাদা প্রমাণের জন্য বিস্তারিত আলোচনা করাও জ্ঞান জগতের পাগলামি বলে গণ্য হওয়া উচিত। তারপরও কিছুটা ‘পাগলামি’ করতে বাধ্য হলাম।

যুগ পরিচিতি:

মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ চার মুজতাহিদ ফকীহের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা (৮০-১৫০ হি) প্রথম। তিনি ছিলেন তাবিয়ী প্রজন্মের। ইমাম মালিক ইবন আনাস (৯৩-১৭৯ হি) ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস শাফিয়ী (১৫০-২০৪ হি) উভয়ে তাবি-তাবিয়ী প্রজন্মের। আর ইমাম আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন হাম্বাল (১৬৪-২৪১হি) ছিলেন তাবি-তাবিয়ীদের ছাত্র পর্যায়ের। রাহিমাহুমুল্লাহু: মহান আল্লাহ তাঁদেরকে রহমত করুন। বস্ত্তত তাবিয়ী যুগের ফকীহগণের মধ্যে একমাত্র ইমাম আবূ হানীফাই এরূপ প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।

৪১ হিজরী সালে মুআবিয়া (রা)-এর খিলাফত গ্রহণের মাধ্যমে উমাইয়া যুগের শুরু। ৬০ হিজরীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইয়াযিদ ইবন মুআবিয়া প্রায় চার বৎসর শাসন করেন (৬০-৬৪ হি)। তার মৃত্যুর পর কয়েক মাস তার পুত্র মুআবিয়া এবং বৎসর খানেক মারওয়ান ইবনুল হাকাম রাজত্ব করেন (৬৪-৬৫ হি)। তার পর তার পুত্র আব্দুল মালিক প্রায় ২১ বৎসর রাজত্ব করেন (৬৫-৮৬ হি)। ১৩২ হিজরী পর্যন্ত পরবর্তী প্রায় ৪৬ বৎসর আব্দুল মালিকের পুত্র, পৌত্র, ভাতিজাগণ রাজত্ব পরিচালনা করেন। ৯৯ থেকে ১০১ হিজরী সাল: প্রায় তিন বৎসর উমার ইবন আব্দুল আযীয খিলাফত পরিচালনা করেন। তাঁর শাসনামল ‘‘খিলাফাতে রাশেদার’’ পর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য।

৯৯ হিজরী সাল থেকেই ‘‘নবী-বংশের রাজত্ব’’ শ্লোগানে গোপনে আববাসী আনেদালন শুরু হয়। ১২৭ হিজরী থেকে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ও যুদ্ধ শুরু হয়। ১৩২ হিজরীতে উমাইয়া খিলাফতের পতন ঘটে ও আববাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠা পায়। প্রথম আববাসী খলীফা আবুল আববাস সাফফাহ প্রায় চার বৎসর (১৩২-১৩৬ হি) এরপর আবূ জাফর মানসূর প্রায় ২২ বৎসর (১৩৬-১৫৮ হি) রাজত্ব করেন। রাষ্ট্রীয় উত্থান-পতন, অস্থিরতা ও পরিবর্তনের পাশাপাশি ধর্মীয় বিশ্বাস ও কর্মেও নানা দল-উপদল জন্ম নেয় এ সময়েই। আভ্যন্তরীণ সমস্যাদি সত্ত্বেও মুসলিম রাষ্ট্র তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। চীন, রাশিয়া ও ভারতের কিছু অংশ থেকে উত্তর আফ্রিকা ও স্পেন পর্যন্ত- তৎকালীন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি- মুসলিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জ্ঞানচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে।

ইমাম আবূ হানীফার জন্মের পূর্বেই আলী (রা)-এর খিলাফতের সময়ে খারিজী ও শীয়া দুটি রাজনৈতিক-ধর্মীয় ফিরকার জন্ম হয়। উমাইয়া যুগের মাঝামাঝি সময় থেকে কাদারিয়া, মুরজিয়া, জাহমিয়া, মুতাযিলা প্রভৃতি ফিরকার উদ্ভব ঘটে। এ সময়েই উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিকের রাজত্বকালে ইমাম আবূ হানীফার জন্ম ও আববাসী খলীফা মানসূরের সময়ে তাঁর ওফাত।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

বংশ ও জন্ম:

ইমাম আবূ হানীফার (রাহ) পূর্ণ নাম ‘আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত ইবন যূতা। তাঁর পৌত্র ইসমাঈল তাঁর বংশ বর্ণনায় বলেন, আমি ইসমাঈল ইবন হাম্মাদ ইবন নুমান ইবন সাবিত ইবন নুমান ইবন মারযুবান। আমরা পারস্য বংশোদ্ভূত এবং কখনো দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইনি। আমার দাদা ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। সাবিত শৈশবকালে আলী (রা)-এর নিকট উপস্থিত হন এবং তিনি তাঁর ও তাঁর বংশের মঙ্গলের জন্য দুআ’ করেছিলেন । আমরা আশা করি তাঁর ঐ দুআ নিষ্ফল হয় নি।

তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে কেউ ৬০ হি. এবং কেউ ৭০ হি. সাল উল্লেখ করেছেন। তবে অধিকাংশের মতে তিনি ৮০হি. (৬৯৯ খৃ.) সালে জন্ম গ্রহণ করেন।

শিক্ষাজীবন ও উস্তাদগণ:

ইমাম আবূ হানীফা তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরুতে কুরআন কারীম মুখস্থ করেন। ঐতিহাসিকগণ উল্লে­খ করেছেন যে, তিনি কুরআন কারীমের প্রসিদ্ধ ৭ কারীর অন্যতম কারী আসিম ইবন আবিন নাজূদ (১২৮ হি)-এর নিকট ইলমুল কিরাআত শিক্ষা করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বুৎপত্তি অর্জন করেন।

আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সাহাবীদের কেউ কেউ ১১০ হিজরী সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কাজেই ইমাম আবূ হানীফার জন্য কোনো কোনো সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করা ও শিক্ষা গ্রহণ করা খুবই সম্ভব ছিল। বাস্তবে কতজন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। হানাফী জীবনীকারগণ দাবি করেছেন যে, কয়েকজন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। পক্ষান্তরে দু-একজন বিরোধী দাবি করেছেন যে, কোনো সাহাবীর সাথেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় নি। এ প্রসঙ্গে সপ্তম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও শাফিয়ী ফকীহ ইবন খালি­কান আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম (৬০৮-৬৮১ হি) বলেন:

‘‘আবূ হানীফা চার জন সাহাবীর (রা) সময় পেয়েছিলেন: (১) (বসরায়) আনাস ইবন মালিক (৯২ হি), (২) কূফায় আব্দুল­vহ ইবন আবী আওফা (৮৭ হি), (৩) মদীনায় সাহল ইবন সা’দ সায়িদী (৮৮ হি) এবং (৪) মক্কায় আবুত তুফাইল আমির ইবন ওয়াসিলা (১১০ হি)। তাঁদের কারো সাথেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় নি এবং কারো থেকেই তিনি কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। তাঁর অনুসারীরা বলেন যে, কয়েকজন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং তিনি তাঁদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণের নিকট এ বিষয় প্রমাণিত হয় নি।’’

হানাফী জীবনীকারগণের বর্ণনায় ৭ জন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল:

(১) জাবির ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন হারাম আনসারী খাযরাজী মাদানী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৭০ হিজরীর পর)

(২) আব্দুল্লাহ ইবন উনাইস. রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৫ হি বা তাঁর পূর্বে)

(৩) ওয়াসিলা ইবনুল আসকা ইবন কা’ব ইবন আমির লাইসী শামী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৫ হি)

(৪) আব্দুল্লাহ ইবন আবী আওফা: আলকামা ইবন খালিদ ইবনুল হারিস আসলামী কূফী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৭ হি)

(৫) আবুল হারিস আব্দুল্লাহ ইবনুল হারিস ইবন জুয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মা’দীকারিব যাবীদী মিসরী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৮ হি)

(৬) আনাস ইবন মালিক ইবনুন নাদর ইবন দামদাম ইবন যাইদ হারাম আনসারী নাজ্জারী মাদানী, রাদিয়াল্লাহ আনহু (৯২/৯৩ হি)

(৭) আয়েশা বিনত আজরাদ। তাঁর মৃত্যু তারিখ এবং অন্যান্য পরিচয় জানা যায় না। তিনি ইবন আববাস ও অন্যান্য সাহাবী থেকে কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। ঐতিহাসিক ও রিজালবিদগণ তাঁকে তাবিয়ী হিসেবেই উলে­খ করেছেন। কেউ কেউ তাঁকে সাহাবী বলে গণ্য করেছেন।

এ প্রসঙ্গে নবম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক ও হানাফী ফকীহ আল্লামা মাহমূদ ইবন আহমদ বদরুদ্দীন আইনী (৭৬২-৮৫৫ হি) বলেন: জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাতের বর্ণনাটি বাহ্যতই সঠিক নয়। তবে অন্যান্যদের সাথে তাঁর সাক্ষাতের সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না। যেহেতু তাঁর জীবনীকারগণ তা উলে­খ করেছেন সেহেতু সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া তা অস্বীকার করা অযৌক্তিক পক্ষপাতমূলক আচরণ বলে গণ্য।

বাস্তবে প্রায় সকল জীবনীকার, রিজালবিদ ও ঐতিহাসিক একমত যে সাহাবী আনাস ইবন মালিক (রা)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। আল্লামা আইনী বলেন:

‘‘আবূ হানীফা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাবিয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। এ বিষয়ে একমাত্র কোনো মুর্খ বা হিংসুক ছাড়া কেউ সনেদহ করেন নি। ইবন কাসীর তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে বলেন: আবূ হানীফা … সাহাবীদের যুগ পেয়েছিলেন। তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। বলা হয় যে তিনি অন্য সাহাবীকেও দেখেছেন। খাতীব বাগদাদী তারীখ বাগদাদ গ্রন্থে উলে­খ করেছেন যে, আবূ হানীফা আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। মিয্যী তাঁর তাহযীবুল কামাল গ্রন্থে উলে­খ করেছেন যে, তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। যাহাবী তাঁর ‘আল-কাশিফ’ গ্রন্থে বিষয়টি উলে­খ করেছেন। অন্যান্য আলিমও একই কথা লিখেছেন।’’

এছাড়া আবূ হানীফা (রাহ) তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের, বিশেষত ইরাকের সকল প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিম থেকে ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (৮৫৫ হি) উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আযমের শিক্ষকদের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলির সংকলন ‘‘মুসনাদ আবী হানীফা’’ গ্রন্থের মধ্যে তাঁর তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী উস্তাদগণের সংখ্যা প্রায় ২০০।

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, রিজালবিদ ও শাফিয়ী ফকীহ ইমাম ইউসূফ ইবন আব্দুর রাহমান আবুল হাজ্জাজ মিয্যী (৭৪২ হি) সিহাহ-সিত্তাহ গ্রন্থগুলোর রাবীগণের জীবনীমূলক ‘তাহযীবুল কামাল’ গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর হাদীসের উসতাদগণের মধ্যে ৭৭ জনের নাম উলে­খ করেছেন, যাদের সূত্রে বর্ণিত ইমাম আবূ হানীফার হাদীস বিভিনণ গ্রন্থে সংকলিত। তাঁদের অধিকাংশই তাবিয়ী। কেউ কেউ ইমাম আযমের সমসাময়িক এবং কেউ কেউ তাবি-তাবিয়ী। এদের অধিকাংশই তৎকালীন যুগের সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হাদীসের ইমাম বলে গণ্য ছিলেন। এদের অধিকাংশের বর্ণিত হাদীস বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থে সংকলিত।

অধ্যাপনা ও ছাত্রগণ:

উস্তাদদের জীবদ্দশাতেই ইমাম আবূ হানীফার প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত ফিকহে তাঁর প্রধান উস্তাদ প্রসিদ্ধ তাবিয়ী হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান (১২০ হি)-এর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং কূফার শ্রেষ্ঠ ফকীহ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। পরবর্তী ত্রিশ বৎসর তিনি গবেষণা ও অধ্যাপনায় অতিবাহিত করেন। ইমাম আবূ হানীফার মূল্যায়ন বিষয়ক পরিচ্ছেদে আমরা দেখব যে, ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মত তাঁর জীবদ্দশাতেই মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাবিয়ী যুগের আর কোনো ফকীহ এরূপ প্রসিদ্ধি লাভ করেন নি। স্বভাবতই মুসলিম বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা তাঁর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতেন। তাঁর ৯৭ জন মুহাদ্দিস ছাত্রের একটি তালিকা পেশ করেছেন ইমাম মিয্যী। তাঁদের অধিকাংশই সে যুগের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন এবং তাঁদের বর্ণিত হাদীস সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থসমূহে সংকলিত। এছাড়া ইমাম আবূ হানীফার এ সকল ছাত্রের অনেকেই পরবর্তী প্রায় অর্ধ শতাব্দী যাবৎ কূফা, বসরা, বাগদাদ, শীরায, ওয়াসিত, রাই, খুরাসানসহ মুসলিম বিশ্বের সকল প্রসিদ্ধ জনপদের বিচারক বা কাযির দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের সকলেই ১৫০ থেকে ২৩০ হিজরীর মধ্যে ইন্তেকাল করেন।

আল্লামা আইনী এ সকল ছাত্রের বাইরে আরে ২৬০ জন ছাত্রের নাম উলে­খ করেছেন যারা ইমাম আযম থেকে হাদীস ও ফিকহ শিক্ষা করেছিলেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের তৎকালীন প্রসিদ্ধ প্রতিটি শহরের নাম উলে­খ করে তথাকার কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলিমের নাম উলে­খ করেছেন যারা ইমাম আবূ হানীফা থেকে হাদীস ও ফিকহ শিক্ষা করে এ সকল শহর ও নগরে ইলম প্রচারে রত থেকেছেন। তাঁদের অনেকেই এ সকল শহরের বিচারপতি, ইমাম বা প্রসিদ্ধ আলিম ছিলেন। এভাবে দেখা যায় যে, তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি শহরেই ইমাম আবূ হানীফার অনেক প্রসিদ্ধ ছাত্র ছিলেন।

আখলাক:

ইমাম আবূ হানীফার আখলাক ও ইবাদত সে মুবারক যুগের নেককারদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করত। ঐতিহাসিকগণ উলে­খ করেছেন যে, তিনি আরবী ভাষায় উচ্চাঙ্গের সাহিত্য প্রতিভা ও প্রাঞ্জল ভাষার অধিকারী ছিলেন। তাঁর বক্তব্য শ্রোতাকে আকর্ষণ করত। যখন কথা বলতেন তখন মনে হতো সকল মানুষের মধ্যে তিনিই সবেচেয়ে ভাল কথা বলতে পারেন এবং তাঁর কথাই সবচেয়ে সুমিষ্ট। সহজেই তিনি নিজের বক্তব্য শ্রোতাকে বুঝাতে পারতেন। তাঁর দেহের রঙ ছিল সুন্দর এবং কিছুটা বাদামী। মুখমন্ডল ও অবয়ব ছিল সুন্দর ও আকর্ষণীয়। তিনি সুন্দর ও পরিপাটি পোশাক পরিধান করতেন এবং সর্বদা সুগন্ধময় থাকতেন। এমনকি তিনি যখন বাড়ি থেকে বেরোতেন তখন তাঁকে দেখার আগেই তাঁর সুগন্ধির মাধ্যমে তার আগমন বুঝা যেত। তাঁর ছাত্র আবূ ইউসুফ তার বর্ণনা দিয়ে বলেন: ‘‘আবূ হানীফা ছিলেন মাঝারি আকৃতির মানুষ, বেঁটেও নন এবং বেশি লম্বাও নন। মানুষদের মধ্যে কথাবার্তায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর, তাঁর কথার মাধুর্য্য ছিল সবচেয়ে বেশি এবং তিনি তাঁর মনের উদ্দেশ্য সবার চেয়ে ভাল বুঝাতে পারতেন।’’

তাঁর বিষয়ে উমার ইবনু হাম্মাদ বলেন: ‘‘আবূ হানীফা কিছুটা লম্বা ছিলেন। তাঁর গায়ের রঙ ছিল কিছুটা বাদামী। তিনি পরিপাটি পোশাক পরিধান করতেন। তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ ও অবয়ব ছিল সুন্দর। তিনি আতর ব্যবহার খুবই পছন্দ করতেন। তিনি যখন কোথাও যেতেন বা বাড়ি থেকে বের হতেন তখন তাঁকে দেখার আগেই সুগন্ধি থেকেই তাঁর আগমন বুঝা যেত।’’

হাইসামী বলেন: লম্বা হওয়া ও মাঝারি হওয়ার মধ্যে মূলত বৈপরীত্য নেই। এ দুটি বর্ণনার সমন্বয় হলো যে, তিনি বেশি লম্বা ছিলেন না, কাজেই তাকে মাঝারিই বলতে হবে। তবে মাঝারিদের মধ্যে তিনি লম্বা বলে বিবেচিত ছিলেন।

তাঁর অন্য ছাত্র প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক বলেন: ‘‘তাঁর বাহ্যিক প্রকাশ ও অবয়ব ছিল সুন্দর, মুখমন্ডল ছিল সুন্দর এবং পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল সুন্দর।’’

তাঁর অন্য ছাত্র প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ নুআইম ফাদল ইবনু দুকাইন বলেন: ‘‘আবূ হানীফার মুখন্ডল, পোশাক, জুতা সবই ছিল সুন্দর। তাঁর আশেপাশে যারা থাকতেন তাদের প্রত্যেকের উপকার, কল্যাণ ও সহমর্মিতায় তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন।’’

ইমাম আবূ হানীফা বড় ব্যবসায়ী ও ধনী ছিলেন। আর তাঁর ধনসম্পদ মানুষের জন্য, বিশেষত আলিমদের জন্য ব্যয় করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উদারহস্ত। তিনি নিজের পরিবারের জন্য যেভাবে খরচ করতেন সেভাবেই খরচ করতেন আলিম, তালিবুল ইলম ও ছাত্রদের জন্য। নিজের জন্য কাপড় কিনলে তাদের জন্যও কিনতেন। ফলমূল বা খাদ্যাদি ক্রয় করলে তিনি আলিম ও ছাত্রদের জন্য আগে ক্রয় করে তারপর নিজের পরিবারের জন্য ক্রয় করতেন। আর হাদীয়া, দান, অনুদান ও পরোপকারের জন্য যখন কিছু ক্রয় করতেন তখন তাঁর সর্বোচ্চ সাধ্যানুসারে তা ক্রয় করতেন। নিজের বা পরিবারের জন্য কিছু নিম্নমানের দ্রব্য ক্রয় করলেও অন্যদের জন্য তা করতেন না। আর ছাত্রদের তিনি নিজেই ভরণপোষণ করতেন। এমনকি অনেক দরিদ্র ছাত্র তার সাহচার্যে এসে সচ্ছল হয়ে যায়। তাঁর প্রিয় ছাত্র আবূ ইউসুফ ও তার পরিবারকে তিনি দশ বৎসর প্রতিপালন করেন।

তৎকালীন সুপ্রসিদ্ধ আলিম ও বুজুর্গ ফুদাইল ইবনু ইয়াদ (১৮৭ হি) বলেন: ‘‘আবূ হানীফা অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি কাজ বেশি করতেন এবং কথা কম বলতেন। তিনি ইলম এবং আলিমগণকে অত্যন্ত সম্মান করতেন।’’

তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল অসাধারণ ইবাদত, তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল­ লাইল। পাশাপাশি তিনি ছিলেন হক্কের বিষয়ে আপোষহীন। ইমাম আবূ হানীফার প্রকৃতি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন ইমাম আবূ ইউসূফ। খলীফা হারূন রাশীদ (খিলাফাত ১৭০-১৯৩ হি) বিচারপতি আবূ ইউসুফকে বলেন: আবূ হানীফার আখলাক ও প্রকৃতির একটি বিবরণ আমাকে বলনু তো। তখন ইমাম আবূ ইউসুফ বলেন:

‘‘আল্লাহর দীন বিরোধী সকল কিছুকে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোষহীন। তিনি অত্যন্ত পরহেযগার ও আল্লাহভীরু ছিলেন। দীনের বিষয়ে না জেনে কিছুই বলতেন না। তিনি চাইতেন যে, আল্লাহর আনুগত্য করা হোক এবং তার অবাধ্যতা না হোক। তিনি তাঁর যুগের দুনিয়ামুখি মানুষদেরকে পরিহার করে চলতেন। জাগতিক সম্মান-মর্যাদা নিয়ে তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতেন না। গভীর জ্ঞানের অধীকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন এবং চিন্তা-গবেষণায় রত থাকতেন। বেশি কথা বলা বা বাজে কথা বলার কোনো স্বভাব তাঁর ছিল না। কোনো মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি শ্রুতি বা হাদীসের ভিত্তিতে তার জবাব দিতেন। সে বিষয়ে কোনো শ্রুতি না থাকলে সঠিক কিয়াসের মাধ্যমে উত্তর দিতেন ও তা অনুসরণ করতেন। তিনি তাঁর নিজেকে ও তাঁর দীনকে সংরক্ষণ করতেন। তাঁর জ্ঞান ও সম্পদ তিনি অকাতরে খরচ করতেন। তিনি সকল মানুষের থেকে নিজেকে অমুখাপেক্ষী রাখতেন। কোনো লোভ তাকে স্পর্শ করতো না। তিনি গীবত বা পরচর্চা থেকে দূরে থাকতেন। কারো কথা উলে­খ করলে শুধু ভাল কথাই বলতেন।’’

তাঁর আপোষহীনতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন ছিল রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও ক্ষমতা গ্রহণে অস্বীকৃতি। শত চাপাচাপি ও নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি এ সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেন নি। কারণ তিনি কারো মুখ চেয়ে বিচার করতে বা অন্যায় বিচারের দায়ভার নিয়ে আল­vহর দরবারে হাযির হতে রাযি ছিলেন না। রাবী ইবনু আসিম বলেন, উমাইয়া সরকারের গভর্নর ইয়াযিদ ইবনু উমার ইবনু হুবাইরা (১৩২ হি)-এর নির্দেশে আবি আবূ হানীফাকে তার কার্যালয়ে নিয়ে আসি। তিনি তাকে বাইতুল মালের দায়িতব গ্রহণ করতে নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু আবূ হানীফা তা অস্বীকার করেন। একারণে ইবনু হুবাইরা তাকে ২০ টি বেত্রাঘাত করেন। ইবন হুবাইরা তাঁকে বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করলে তিনি তাও প্রত্যাখ্যান করেন।

এ ঘটনা ঘটে ১৩০ হিজরী সালের দিকে, যখন তাঁর বয়স প্রায় ৫০ বৎসর। আববাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর দ্বিতীয় আববাসী খলীফা মানসূর ১৫০ হিজরীতে ইমাম আবূ হানীফাকে বাগদাদে ডেকে বিচারপতির দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। তিনি অস্বীকার করলে ক্রুদ্ধ খলীফা তাকে কারারুদ্ধ করেন এবং কারাগারেই তাঁর মৃত্যু হয়।

ইমাম আবূ হানীফার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল হৃদয়ের প্রশস্ততা। তিনি বলতেন: ‘‘হে আল্লাহ, আমাদের বিষয়ে যার অন্তর সংকীর্ণ হয়েছে, তার বিষয়ে আমাদের অন্তর প্রশস্ত হয়েছে।’’

আব্দুস সামাদ ইবনু হাস্সান বলেন: ‘‘সুফইয়ান সাওরী ও আবূ হানীফার মধ্যে বিরোধ-সমস্যা ছিল। এক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে আবূ হানীফা অধিক বাকসংযমী ছিলেন।’’

ইয়াযিদ ইবনু হারূন বলেন: ‘‘আমি আবূ হানীফার চেয়ে অধিক স্থিরচিত্ত ও প্রশস্তহৃদয় আর কাউকে দেখিনি। …. একবার এক ব্যক্তি তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং তাঁকে বলে: হে যিন্দীক। তিনি উত্তরে বলেন: আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন, তিনি জানেন যে তুমি যা বলেছ আমি তা নই।’’

মৃত্যু:

ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ১৫০ হিজরী সালের মধ্য শাবানের রজনীতে বাগদাদের কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। বাগদাদের খাইযুরান কবরস্থানে তাঁর দাফন হয়। প্রসিদ্ধ মত অনুসারে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৭০ বৎসর।


উৎস: আল-ফিকহুল আকবার (বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা), ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
প্রকাশনায়: ইসলামিক অনলাইন মিডিয়া