আমাদের দ্বীনের রুচি ও বৈশিষ্ট্য – মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) – ২য় পর্ব

ছয়. দ্বীনের চেতনা ও বৈশিষ্ট্যের আলোচনায় এই বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়া উচিত যে, আম্বিয়ায়ে কেরাম যে কওম ও জাতির প্রতি প্রেরিত হন, বিশেষত খাতামুন্নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের প্রতি প্রেরিত হয়েছেন, সেই উম্মতের সাথে তাঁদের সম্পর্কের স্বরূপ কী। তাঁদের সম্পর্ক ডাকপিয়নের মতো নয়, যার দায়িত্ব শুধু সঠিক ঠিকানায় ডাক পৌঁছে দেওয়া, এরপর ঐ লোকদের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তেমনি যাদের কাছে ডাক পাঠানো হয়েছে তাদেরও এই ডাক-বাহকের সাথে কোনো কাজ নেই। নিজেদের ইচ্ছা ও কর্মে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন-এমন নয়।

নবী ও উম্মতের সম্পর্ককে নিতান্তই সাময়িক ও আইনী সম্পর্ক মনে করা, তাঁদের জীবনাদর্শ ও জীবনধারা, তাঁদের চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি এবং তাদের ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক জীবন সম্পর্কে উম্মতের আগ্রহ ও কৌতুহল অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক মনে করা সম্পূর্ণ ভুল ও ভিত্তিহীন।

অতীতে নবী ও নবুওতের স্বরূপ ও মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞ লোকেরা এরূপ ধারণার শিকার হয়েছিল। আর এখন এর বিস্তার দেখা যায় ঐ সকল লোকের মাঝে, যারা সুন্নাহর মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞ এবং হাদীসের মর্যাদা ও প্রামাণিকতার মুনকির। তেমনি যারা ধর্মের খ্রিস্টীয় ধারণায় প্রভাবিত এবং পশ্চিমা চিন্তা ও দর্শনে আক্রান্ত।

বাস্তবতা হচ্ছে, আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম সমগ্র-মানবতার জন্য পূর্ণাঙ্গ আদর্শ, উন্নত অনুকরণীয় নমুনা। চিন্তা-চেতনা, স্বভাব-চরিত্র, গ্রহণ-বর্জন ও শত্রুতা-মিত্রতার চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গতম মাপকাঠি। তাঁরা হয়ে থাকেন ঐশী করুণার অবতরণস্থল, তাঁর অপার মহিমা ও দানের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁদের আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র ও জীবনের রীতি-নীতি আল্লাহর অতিপ্রিয় হয়ে থাকে। সকল জীবন-ধারার মাঝে তাঁদের জীবন-ধারা, সকলের স্বভাব-চরিত্রের মাঝে তাঁদের স্বভাব-চরিত্র এবং মানুষের বিচিত্র আদত-অভ্যাসের মাঝে তাঁদের অভ্যাস ও আদতই আল্লাহর পছন্দের। তাঁরা যে পথে চলেন তা আল্লাহর প্রিয় হয়ে যায়। অন্য সকল পথ ও পন্থার উপর প্রাধান্য পেয়ে যায়। শুধু এই জন্য যে, নবীগণের মুবারক কদম এতে পড়েছে। তাঁদের প্রিয় সকল বিষয় ও নিদর্শন এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বস্তু ও কর্মের সাথে আল্লাহর সন্তষ্টি যুক্ত হয়ে যায়। এ কারণেই এগুলো গ্রহণ করা এবং নিজের মাঝে তাঁদের আখলাকের একটুখানি ঝলক সৃষ্টি করতে পারাও আল্লাহর মহব্বত ও সন্তুষ্টি লাভের নিকটতম ও সহজতম উপায়। কে না জানে, বন্ধুর বন্ধুও বন্ধু আর শত্রুর বন্ধুও শত্রু।

খাতামুন্নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবানীতে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللهَ فَاتَّبِعُوْنِیْ یُحْبِبْكُمُ اللهُ وَ یَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ  وَ اللهُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ .
বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস তবে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ-খাতা মাফ করে দিবেন। আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৩১

পক্ষান্তরে জালিম অনাচারী ও কুফরীর পথ গ্রহণকারীদের প্রতি আকর্ষণ, তাদের জীবন যাপনের ধারা ও পদ্ধতিকে প্রাধান্য দান, তাদের সাথে অন্তর-বাহিরের সাদৃশ্য স্থাপন হচ্ছে এমন বিষয়, যা আল্লাহর ক্রোধ সঞ্চারকারী ও বান্দাকে আল্লাহ থেকে বিদূরিতকারী। ইরশাদ হয়েছে-
وَ لَا تَرْكَنُوْۤا اِلَی الَّذِیْنَ ظَلَمُوْا فَتَمَسَّكُمُ النَّار  وَ مَا لَكُمْ مِّنْ دُوْنِ اللهِ مِنْ اَوْلِیَآءَ ثُمَّ لَا تُنْصَرُوْنَ .
তোমরা ঝুঁকবে না ওদের প্রতি যারা জুলুম ও সীমালঙ্ঘন করেছে। যদি তা কর তবে তোমাদের স্পর্শ করবে জাহান্নামের আগুন। তোমাদের তো আল্লাহ ছাড়া কোনো বন্ধু নেই। অতপর তোমরা আর সাহায্য পাবে না। -সূরা হূদ (১১) : ১১৩

আম্বিয়ায়ে কেরামের এই রীতি-নীতি ও আদত-অভ্যাস শরীয়তের পরিভাষায় ‘খিসালে ফিতরাত’ ও ‘সুনানুল হুদা’ নামে অভিহিত। ইসলাম এগুলোর প্রতি উৎসাহিত করে।

জীবন ও কর্মে এই আদত-অভ্যাস, রীতি-নীতি গ্রহণের দ্বারা মানুষ নবীগণের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে, যে রঙ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-
صِبْغَةَ اللهِ وَ مَنْ اَحْسَنُ مِنَ اللهِ صِبْغَةً وَّ نَحْنُ لَهٗ عٰبِدُوْنَ
(বল, আমরা গ্রহণ করেছি) আল্লাহর রঙ, আর কার রঙ হবে আল্লাহর রঙের চেয়ে ভালো। আমরা তো তাঁরই বন্দেগী করি। -সূরা বাকারা (২) : ১৩৮

ইসলামে এক রীতির উপর অন্য রীতির এবং এক জীবনধারার উপর অন্য জীবনধারার শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্যের তাৎপর্য এখানেই নিহিত। একারণেই ইসলামী শরীয়তে আম্বিয়ায়ে কেরামের রীতি-নীতিকে ঈমানদারের নিদর্শন ও স্বাভাবিকতার দাবি বলে অভিহিত করা হয়। পক্ষান্তরে এর বিপরীত পথ ও পদ্ধতি চিহ্নিত হয় স্বাভাবিকতা-বিরুদ্ধ ও আহলে জাহিলিয়াতের নিদর্শন বলে। এই দুই পথের মাঝে পার্থক্য শুধু এই যে, একটি আল্লাহর নবী ও প্রিয় বান্দাদের গৃহীত পথ আর অপরটি এমন সব লোকের, যারা হেদায়েতের আলো ও আসমানী শিক্ষার রাহনুমায়ী থেকে বঞ্চিত।

এই মৌলনীতি থেকেই বের হয়ে আসে পানাহারে ও অন্যান্য কাজে ডানহাত-বামহাত ব্যবহারের পার্থক্য এবং পোশাক-পরিচ্ছদ, বেশভূষা ও জীবনযাত্রার নানা ক্ষেত্রের বহু নীতি ও আদব, যা সুন্নতে নববী ও ফিকহে ইসলামীর এক বিরাট অধ্যায়।

তো দ্বীনের এই যে বৈশিষ্ট্য, নবী ও উম্মতের এই যে সম্পর্ক এ তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেলায় আরো বেশি গুরুত্বের দাবিদার। তাঁর সঙ্গে নিছক বিধিগত সম্পর্ক নয়, হতে হবে আত্মা ও আবেগের সম্পর্ক, গভীর ও স্থায়ী মুহাব্বতের সম্পর্ক, যা জান-মাল পরিবার-পরিজনের ভালবাসার চেয়েও বেশি হবে। সহীহ হাদীসে আছে-
لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتّى أَكُونَ أَحَبّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ، وَوَلَدِهِ، وَالنّاسِ أَجْمَعِينَ.
তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন  হবে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার প্রাণ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হই। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১২৮১৪

এক্ষেত্রে ঐ সকল পথ ও পন্থা, কারণ ও কার্যকারণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, যা এই ভালবাসার ধারাকে ক্ষীণ করে দেয়, ভালবাসার আবেগ-অনুভূতিকে নিস্তেজ করে দেয় এবং ইত্তিবায়ে সুন্নাতের জযবা ও প্রেরণাকে কমযোর করে দেয়। তাঁকে সকল পথের সুবিজ্ঞ, সর্বশেষ রাসূল ও সর্বজনের অভিভাবক বলে মেনে নিতে দ্বিধান্বিত করে আর হাদীস ও সীরাত-গ্রন্থসমূহের প্রতি বিমুখ ও অনাগ্রহী করে তোলে।

কুরআনে কারীমের সূরা আহযাব, সূরা হুজুরাত, সূরা ফাত্হ ইত্যাদি গভীরভাবে পাঠ করলে, তাশাহহুদ ও সলাতুল জানাযায় দরূদ ও সালাতের উপস্থিতি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে, এবং কুরআন মাজীদে দরূদ পাঠের যে আদেশ-উৎসাহ, হাদীস শরীফে দরূদের যে ফযীলত-মাহাত্ম্য- এই সকল  কিছুর তাৎপর্য সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে একজন মুমিনের কাছে নিছক বিধিগত সম্পর্কের চেয়ে বেশি কিছু কাম্য। আইনী সম্পর্কের দাবি তো বাহ্যিক আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমেই পূরণ হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে কাম্য ঐ আদব-লেহাজ, ঐ ভক্তি-ভালবাসা, ঐ কৃতজ্ঞতা-কৃতার্থতার আপ্লুত প্রেরণা, যা হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হয়ে দেহের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হতে থাকবে। ভক্তি-ভালবাসার এই যুগপৎ অবস্থাকে আলকুরআনে তা‘যীর ও তাওকীর  শব্দে প্রকাশ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- وَ تُعَزِّرُوْهُ وَ تُوَقِّرُوْهُ
তোমরা তাঁর নুসরত করবে এবং তাকে শ্রদ্ধা করবে। -সূরা ফাত্হ (৪৮) : ৯

এই গভীর ভক্তি-ভালবাসার প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে, গযওয়ায়ে রজী‘তে হযরত খুবাইব ইবনে আদী রা. ও যায়েদ ইবনুদ দাছিনার ঘটনা, উহুদ যুদ্ধের পর বনু দীনারের এক মুসলিম নারীর কথোপকথন এবং হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি সেই অতুলনীয় ইশক ও মহব্বত, আদব-ইহতিরাম, যা লক্ষ করে আবু সুফিয়ান (যিনি ঐ সময় পর্যন্ত ইসলাম কবুল করেননি) বলে উঠেছিলেন, আমি কারো প্রতি কারো এইরকম ভক্তি-ভালবাসা দেখিনি, যে রকম মুহাম্মাদের প্রতি তাঁর সঙ্গীদের দেখেছি।

হুদায়বিয়ার সন্ধিকালে কুরাইশের দূত উরওয়া ইবনে মাসউদ বলেছিল, কসম আল্লাহর! আমি কিসরা ও কায়সারের দরবারেও গিয়েছি, কিন্তু মুহাম্মাদের সাথীদের যেভাবে তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে দেখেছি, কোনো বাদশাহকেও তেমন ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে কাউকে দেখিনি।

এই ইশকে রাসূলেরই বড় হিস্যা পেয়েছিলেন উম্মাহর ঐ সকল বিজ্ঞ উলামা, মুসলিহ ও মুজাদ্দিদ, রাহনুমা ও রাহবারগণ, যাঁরা দ্বীনের প্রকৃত চেতনা ও প্রাণসত্তাকে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। তাকদীর যাদের নির্বাচন করেছিল মিল্লাতের সংস্কার ও পুনরুজ্জীবনের কীর্তি সম্পাদনের জন্য।

শরীয়তের সীমা ও বিধানের অনুগত থেকে, সাহাবায়ে কেরামের উসওয়া ও আদর্শ অনুসারে এই পবিত্র রাসূলপ্রেমই হচ্ছে ঐ উপাদান, যা ছাড়া নবী-আদর্শের পূর্ণ অনুসরণ, শরীয়তের পথে পূর্ণ অবিচলতা, নফসের  ন্যায়নিষ্ঠ মুহাসাবা ও সুখে দুঃখে, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের যথাযথ ইত্তিবা সম্ভব নয়। এই মহব্বতই বহু মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধির উপশম এবং স্বভাব-চরিত্রের শুদ্ধি ও ইসলাহ-তাযকিয়ার কার্যকর উপায়। ভালবাসার জোয়ারই ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে সকল ময়লা-আবর্জনা। আর তা দেহের শিরা-উপশিরায় এমনভাবে ছড়িয়ে যায় যেমন উষার সমীরণ জাগিয়ে তোলে পুষ্প-বৃক্ষের স্নিগ্ধতা। আল্লাহ ও রাসূলের প্রেমে যেই মুসলিম জাতি একদিন ছিল লকলকে অগ্নিশিখার মতো এরই অভাবে আজ তারা পরিণত হয়েছে শীতল ছাই গাদায়।

প্রেমের আগুন নিভে গেছে তাই আধাঁর

মুসলিম তো নয় এরা মাটির পাহাড়।

সাত. এই দ্বীনের আরেক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পূর্ণাঙ্গতা ও চিরন্তনতা। খোদায়ী এলান হয়ে গেছে যে, আকীদা ও শরীয়ত তথা যা কিছুর উপর দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি নির্ভরশীল তা পূর্ণাঙ্গরূপে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَاۤ اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَ لٰكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَ خَاتَمَ النَّبِیّٖنَ  وَ كَانَ اللهُ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمًا۠.
মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন; তিনি তো আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী। আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ। সূরা আহযাব (৩৩) : ৪০

কুরআন কারীম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিয়েছেন, দ্বীন তার পূর্ণাঙ্গতা চিরন্তনতা ও মানবতার চাহিদা ও প্রয়োজন পূরণের চূড়ান্ত মানযিলে পৌঁছে গেছে।

اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا .
আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম।

গভীরভাবে চিন্তা করলে স্পষ্ট হবে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে নবুওতের সমাপ্তির মাঝে নিহিত আছে মানবতার মর্যাদা এবং আল্লাহর বিশেষ দয়া ও করুণা। এটি এই ঘোষণার ইঙ্গিতবাহী যে, মানবজাতি এখন পরিণত ও পরিপক্ক বয়সে উপনীত হয়েছে। বহুকাল যাবৎ সে যে সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে বিকশিত হচ্ছিল এখন তা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন সে প্রবেশ করতে যাচ্ছে পরস্পর পরিচিত, বিশ্ব-ঐক্য, জ্ঞান, সভ্যতা ও বিশ্বজগতের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহারের এক উন্মুক্ত দিগন্তে। সম্ভাবনা জেগেছে সকল প্রাকৃতিক বাধা ও ভৌগোলিক সীমারেখা অতিক্রম করার এবং স্ব স্ব অঞ্চলে আবদ্ধতার প্রবণতা থেকে মুক্ত হওয়ার। গোষ্ঠীবদ্ধতা ও স্বাদেশিকতার স্থলে সে এখন পরিচিত হচ্ছে বিশ্বজগৎ ও বিশ্বমানবতার ধারণার সাথে। পরিচালিত হচ্ছে বিশ্বজনীন হিদায়াত ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্মিলিত প্রয়াসের পথে। সে প্রস্তুত হচ্ছে প্রকৃতির শক্তি, বিশ্বাসী মস্তিষ্ক, সুস্থ হৃদয় ও সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে জীবনের বিস্তৃত অঙ্গনে কাজে লাগানোর জন্য।

অতীতে নবুওতের ধারা চলমান থাকায় সত্য-মিথ্যা উভয়ের সম্ভাবনা, মিথ্যা নবুওত দাবি, আসমানী শিক্ষা ও দাওয়াতের মিথ্যা দাবিদারদের প্রাদুর্ভাব, ঐসকল মিথ্যা দাবির প্রতি আহ্বান এবং সেসবের ভিত্তিতে মুমিন-কাফির নির্ধারণের প্রবণতা হেতু অতীত উম্মতসমূহকে বিরাট বিপদের মুখোমুখী থাকতে হয়েছে।

তৎকালীন ইহুদী ও খ্রিস্টান-সমাজে মিথ্যা নবুওত দাবি একপ্রকার শখের বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। তা ছিল সে সময়ের বড় মাথাব্যথার কারণ। মানুষের মেধা, ধর্মীয় কাজের শক্তি ও যোগ্যতা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় ও কল্যাণের কাজে ব্যবহৃত না হয়ে এই সমস্যার পেছনেই খরচ হয়ে যাচ্ছিল এবং এটিও ইহুদী ও  খ্রিস্টীয় সমাজে দ্বন্দ্ব-কলহ, অস্থিরতা-অরাজকতা এবং সন্দেহ-সংশয়ের দুয়ার খুলে দিয়েছিল।

কিছুদিন পর পরই একেক মহল্লায় নতুন নবুওতের দাবি ও দাওয়াতের অভ্যুদয়ের কারণে ধর্মীয় সমাজ সমকালীন সকল সমস্যা থেকে চোখ ফিরিয়ে এই আহ্বানের স্বরূপ নির্ণয়ে এবং এই ‘নবীর’ সত্য-মিথ্যার বিচার-বিশ্লেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। নবুওত-ধারার সমাপ্তি ঘোষণার মাধ্যমে এই বিপদের অবসান ঘটল রোজ রোজকার এই বিপদ ও পরীক্ষা থেকে সীমাবদ্ধ মানবীয় শক্তি ও সক্ষমতা নাজাত পেয়ে গেল। এখন নতুন ওহী ও নতুন নির্দেশনার প্রতীক্ষায় থাকার স্থলে সর্বশেষ ও চূড়ান্ত নির্দেশনার ভিত্তিতে আল্লাহপ্রদত্ত মেধা ও শক্তিকে বিশ্ব ও বিশ্বমানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করার দাওয়াত দেওয়া হল। আর এভাবেই দ্বন্দ্ব-সংশয় ও সামাজিক অনৈক্যের ঐ মহা বিপদ থেকে মানুষের চিরমুক্তি ঘটল।

খতমে নবুওতের আকীদার মাধ্যমেই এই উম্মত ভয়াবহ সব ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেছে এবং ধর্ম ও আকীদার ঐক্য রক্ষার দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়েছে।

এই উম্মতের আছে এক আধ্যাত্মিক কেন্দ্র, আছে বিশ্বজনীন জ্ঞান ও সংস্কৃতির উৎস। আছে এক স্পষ্ট ও সুদৃঢ় স্বকীয়তা, যার সঙ্গে তার সম্বন্ধ অতি গভীর ও শক্তিশালী। এরই ভিত্তিতে যুগ-যুগান্তরে দেশ-দেশান্তরে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে মুসলিমের একতা। এ থেকেই সৃষ্টি হতে পারে শক্তিশালী দায়িত্ববোধ। অন্যায়-অসত্যের প্রতিরোধে, ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠায়, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে এবং দ্বীনে খালিসের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে যাকে ব্যবহার করা যেতে পারে।

এই উম্মতের এখন না কোনো নতুন নবীর প্রয়োজন আছে, না কোনো ‘মাসুম’ নিষ্পাপ ইমামের, যিনি নবীদের সেই কাজ সমাধা করতে আসবেন যা তাঁরা -আল্লাহ মাফ করুন- সম্পন্ন করে যেতে পারেননি।৫

ইসলামের পুনর্জাগরণ ও নতুন ধর্মীয় আন্দোলনের জন্য এমন কোনো রহস্যময় ব্যক্তি বা আহ্বানেরও প্রয়োজন নেই, যা বোধ-বুদ্ধির ঊর্ধ্বের ও স্বাভাবিকতার পরিপন্থী, যাকে ভাগ্যান্বেষী শ্রেণি তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহারের ও রাজনৈতিক স্বার্থ-হাসিলের হাতিয়ার বানাবার সুযোগ পায়। মানবতার উপর এ আল্লাহর এক মহা অনুগ্রহ, কিন্তু অধিকাংশ লোকই শুকরিয়া আদায় করে না।

আট. এই দ্বীনের আরেক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আপন স্বরূপ ও সজীবতাসহ এর উপস্থিতি। এই দ্বীনের কিতাব আলকুরআন সুসংরক্ষিত ও সর্বযুগে অনুধাবনযোগ্য। এই কিতাবের বাহক উম্মাহ ঐ ব্যাপক অজ্ঞতা ও ভ্রষ্টতা থেকে, ঐ সর্বগ্রাসী বিচ্যুতি ও ব্যাপক ষড়যন্ত্রে প্রতারিত হওয়া থেকে নিরাপদ থেকেছে অতীতের বহু জাতি তাদের ইতিহাসের কোনো পর্বে যার শিকার হয়েছিল, বিশেষত খ্রিস্টান জাতি তো একেবারে শুরুতেই এই অবস্থার শিকার হয়ে গিয়েছিল।

কুরআন আল্লাহর পক্ষ হতে অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ ও মুজিযা হওয়ার এক প্রমাণ হচ্ছে, এই কিতাবের সর্বাধিক পঠিত সূরা-সূরাতুল ফাতিহায় খ্রিস্টানদের চিহ্নিত করা হয়েছে الضالين ‘পথভ্রষ্ট’ বলে (অথচ ইহুদীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে المغضوب عليهم)। এই ‘পথভ্রষ্ট’ শব্দের তাৎপর্য, খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের এই বিশেষণে অভিহিত করার যথার্থতা তিনিই উপলদ্ধি করতে পারবেন, যিনি খ্রিস্টবাদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস সম্পর্কে গভীরভাবে ওয়াকিফহাল।

খ্রিস্টধর্ম তার যাত্রার একেবারে শুরুতেই, যাকে বলা যায় ‘ধর্মের শৈশব’- সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিল, যে পথের উপর হযরত ঈসা আ. একে রেখে গিয়েছিলেন। শুধু বিচ্যুত হওয়াই নয়; বরং এক ভিন্ন পথে এই ধর্ম-কাফেলা চলতে আরম্ভ করে। ফলে যতই তারা চলতে থাকল ততই সঠিক পথ থেকে দূরে বহু দূরে সরে যেতে থাকল। এ প্রসঙ্গে শুধু একটি সাক্ষ্যই যথেষ্ট মনে করছি। এক খ্রিস্টান পণ্ডিত Ernest De Bunsen  তার  Islam or true Christianity  গ্রন্থে লেখেন, যে আকীদা ও ধর্ম-ব্যবস্থার উল্লেখ আমরা বর্তমান ইঞ্জিলে পাই, হযরত মসীহ তাঁর কথা ও কাজে এই ধর্ম-ব্যবস্থার দাওয়াত কখনো দেননি। বর্তমানে ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মাঝে যে বিভেদ এর দায়-দায়িত্ব হযরত মাসীহের উপর বর্তায় না, এ হচ্ছে সেই ইহুদী সন্তান বেদ্বীন পলের কীর্তি এবং পবিত্র গ্রন্থসমূহকে রূপক ও দেহাশ্রয়ী ব্যাখ্যায়, ভবিষ্যদ্বাণী ও উদাহরণে আকীর্ণ করে দেওয়ার পরিণাম। এসেনিয় (essenio) ধর্মমতের আহ্বায়ক স্টিফেনের অনুকরণে পল হযরত মাসীহ আ.-এর সাথে বৌদ্ধ ধর্মের বহু আচার সংশ্লিষ্ট করে দিয়েছে। বর্তমান ইঞ্জিলে যেসব পরস্পর বিরোধী কথা ও কাহিনী দেখা যায়, যা হযরত মাসীহ আ.-কে তার প্রকৃত অবস্থান থেকে অনেক হীন করে উপস্থাপন করে, তার সবই এই পলের রচনা। হযরত মাসীহ নন, পল ও তার পরবর্তী পাদ্রী-সন্ন্যাসীরাই এই গোটা আকীদা-ব্যবস্থা প্রস্তুত করেছে, যাকে আঠারো শতক থেকে অর্থোডকস খ্রিস্টানজগৎ নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের বুনিয়াদ বানিয়ে রেখেছে।

পক্ষান্তরে ইসলাম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার ইরশাদ- اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ.

নিশ্চয়ই আমিই এই যিকর (আলকুরআন) নাযিল করেছি। আর আমিই এর হেফাযতকারী। সূরা হিজর (১৫) : ৯

কুরআনের হেফাযত ও সংরক্ষণের এই দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা এবং অনুগ্রহ বর্ণনার রূপে এই প্রতিশ্রুতির দাবি কী? স্বভাবতই এই ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতিতে কুরআনের অর্থ-মর্ম, ভাব-ব্যাখ্যা, এর শিক্ষা ও বিধানের অনুসরণ, জীবনের নানা ক্ষেত্রে প্রয়োগ ও বাস্তবায়নও শামিল। ঐ গ্রন্থের কী মূল্য বা ঐ সংরক্ষণেরই বা কী অর্থ, যে গ্রন্থের অর্থ-মর্ম যুগ যুগ ধরে ধাঁধার মতো দুর্বোধ্য হয়ে থাকে এবং যা বাস্তব জীবনে বর্জিত ও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে? খোদ ‘হিফয’ শব্দটি যা উপরের আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে আরবী ভাষায় অতি গভীর ও বিস্তৃত মর্ম ধারণ করে।

তাছাড়া শুধু এইটুকুই বলা হয়নি, এরই সাথে ঘোষণা দেয়া হয়েছে-
اِنَّ عَلَیْنَا جَمْعَهٗ وَ قُرْاٰنَهٗۚ فَاِذَا قَرَاْنٰهُ فَاتَّبِعْ قُرْاٰنَهٗۚ ثُمَّ اِنَّ عَلَیْنَا بَیَانَهٗ.
একে (কুরআনকে) একত্র করা এবং পড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। আমি যখন তা পড়ব তখন তুমি শুনবে। পরে সেভাবেই পড়বে। অতপর এর ব্যাখ্যাও আমার দায়িত্বে।
সূরা কিয়ামাহ (৭৫) : ১৭-১৯

তেমনি ঐ ধর্মও আস্থাযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য হতে পারে না, যার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে দীর্ঘ অন্ধকার বিরতির মাঝে মাঝে কিছুকালের জন্য। যে বৃক্ষ দীর্ঘকাল অনুকূল আবহাওয়া পেয়েও ফল দিতে পারে না তা কি আস্থা ও যতেœর দাবি করতে পারে? তার সম্পর্কে কি প্রযোজ্য হতে পারে এই উদাহরণ- تُؤْتِیْۤ اُكُلَهَا كُلَّ حِیْنٍۭ بِاِذْنِ رَبِّهَا  .
(এই বৃক্ষ) সর্বদা ফল দেয় তার রবের আদেশে। সূরা ইবরাহীম (১৪) : ২৫

তদ্রুপ এই উম্মত তো নিছক ‘উম্মতে দাওয়াত’ বা আসমানী কিতাব ও পয়গামের শুধু সম্বোধিত শ্রোতামাত্র নয়; বরং তারাই এই দ্বীনের ধারক-বাহক, বিশ্বজুড়ে এর প্রচার-প্রসার; এর সঠিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, নিজের জীবনে এর বাস্তবায়ন এবং অন্যদেরকে এর প্রতি আহ্বানের যিম্মাদার। কাজেই এই কিতাব সম্পর্কে তাদের জ্ঞান ও উপলব্ধি হতে হবে ঐ জাতির জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে অনেক গভীর ও উৎকৃষ্ট, যাদের বৈশিষ্ট্য শুধু এইটুকু যে, ওদের ভাষায় কিতাব নাযিল হয়েছিল।

নয়. শেষ কথা হচ্ছে, ইসলাম চায় এক অনুকূল পরিবেশ। আরো স্পষ্ট ও সতর্ক ভাষায় বললে, ইসলামের প্রয়োজন এক উপযুক্ত মওসুম ও নির্দিষ্ট মাত্রার শীতোষ্ণতা। কারণ, এই ধর্মাদর্শ এক জীবন্ত জীবনাদর্শ। এ নিছক বুদ্ধিজাত তত্ত্ব-দর্শন নয়, যার অবস্থান মস্তিষ্কের কোনো নিভৃত কোষে কিংবা গ্রন্থাগারের কোনো নীরব কোণে। এ তো একইসাথে বিশ্বাস ও কর্ম, স্বভাব-চরিত্র, আবেগ-অনুভূতি জীবনবোধ ও জীবনদর্শনের নাম। মানুষকে সে ঢেলে নিতে চায় এক নতুন ছাঁচে, জীবনকে সে রাঙিয়ে তুলতে চায় এক নতুন রঙে। তাই দেখি, আল্লাহ তাআলা ইসলামকে উল্লেখ করেছেন সিবগাতুল্লাহ (صبغة الله) বিশেষণে। ‘সিবগা’ একটি রঙ, একটি বিশিষ্টতা।

অন্যান্য ধর্মাদর্শের তুলনায় ইসলাম অনেক বেশি সংবেদনশীল। এর আছে সুনির্ধারিত সীমারেখা, যা অতিক্রম করার অধিকার কোনো মুসলিমের নেই। অন্য কোনো ধর্মে ইরতিদাদ বা ধর্মত্যাগের এত স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন মর্ম ও বিধান নেই, যা ইসলামে আছে। তেমনি ধর্মত্যাগের হীনতা ও ঘৃণ্যতার বিবরণও কোথাও এমনভাবে নেই, যেমনভাবে ইসলামে রয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনী, তাঁর শিক্ষা ও নির্দেশনা, তাঁর অনুপম আদর্শ ও সুন্নাহ (আকীদা-ইবাদত থেকে শুরু করে চরিত্র, নৈতিকতা, লেনদেন, আচার-ব্যবহার, এমনকি আবেগ-অনুভূতি পর্যন্ত) সকল ক্ষেত্রে দ্বীনের জন্য ঐ পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে দ্বীন-ইসলামের অংকুরিত চারাটি সতেজ ও পল্লবিত হয়ে ওঠে। কারণ এই দ্বীন জীবনের সকল বৈশিষ্ট্য- অনুরাগ-বিরাগ, প্রফুল্লতা-প্রাণবন্ততা, গর্ব ও গৌরব ইত্যাদির সমষ্টি। ফলে তা রাসূলের আবেগ-অনুভূতি ও তাঁর জীবনের বাস্তব ঘটনাবলী ছাড়া যিন্দা থাকতে পারে না। আর এরই উৎকৃষ্ট সংকলন হচ্ছে সহীহ হাদীস ও সুন্নাহ। এই হাদীস ও সুন্নাহর মাঝেই ঐ আদর্শ ও অনুসরণীয় সমাজের কাঠামো সংরক্ষিত হয়েছে, যা ছাড়া দ্বীন-ইসলাম যথার্থরূপে থাকতে পারে না।

একারণে আল্লাহ তাআলা কুরআনের হেফাজতের পাশাপাশি কুরআনের বাহক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সীরাতও সংরক্ষণ করেছেন। এরই বদৌলতে সেই পবিত্র জীবনের ফয়েয-বরকত, এর সঞ্জিবনী ধারাও নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবহমান রয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে যুগে যুগে উম্মাহর আলিমগণ মারূফ-মুনকার, সুন্নত-বিদআত এবং ইসলাম ও জাহিলিয়্যাহ্র মাঝে পার্থক্য নিরূপণের যোগ্য হয়েছেন। এরই মাধ্যমে ঐ মাপকাঠি তাদের হাতে এসেছে, যার মাধ্যমে তারা স্ব স্ব যুগের মুসলিম সমাজের প্রকৃত ইসলামী আকীদা ও আমল থেকে সরে যাওয়ার মাত্রা পরিমাপ করে থাকেন। এরই বরকতে তারা এই উম্মতের দ্বীনী মুহাসাবা, খাঁটি ও প্রকৃত দ্বীনের প্রতি আহ্বানের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়েছেন।

হাদীস ও সুন্নাহর এই বিরাট সংকলন [যার মধ্যে সিহাহসিত্তা (কুতুবে সিত্তাহ) সমধিক প্রসিদ্ধ ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত] এর পঠন-পাঠন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনার নিমগ্নতাই যুগে যুগে ইসলাহ ও তাজদীদের এবং উম্মাহর মাঝে বিশুদ্ধ ইসলামী চেতনা ও কর্ম রক্ষার অন্যতম প্রধান উৎস থেকেছে। এরই সাহায্যে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে সমাজ-সংস্কারের কর্মী ও সৈনিকেরা শিরক-বিদআত ও জাহেলী রসম-রেওয়াজকে নির্মূল করার এবং সুন্নতের প্রচার-প্রসারের ঝা-া উড্ডীন করেছেন। এই ভাণ্ডারই উম্মাহর উলামা ও সচেতন শ্রেণিকে অন্যায়-অনাচারের ও বিদআত-গোমরাহীর অসংখ্য শক্তি ও আন্দোলনের সাথে পাঞ্জা লড়ার এবং এদের মোকাবিলায় মাথায় কাফন বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা যুগিয়েছে।

ইতিহাস সাক্ষী, এই উম্মাহর সংস্কার ও সংশোধন-প্রচেষ্টার ইতিহাস জড়িয়ে আছে ইলমে হাদীসের চর্চা ও অনুশীলন এবং সুন্নাহর প্রতি ভালবাসা ও পৃষ্ঠপোষকতার সাথেই। মুসলিম মনীষীদের মাঝে যখনই হাদীস ও সুন্নাহর চর্চা ও অবগতিতে ভাটা পড়েছে এবং এর স্থলে অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা বেড়েছে তখনই মুসলিমসমাজ সৎ ও বিজ্ঞজনদের উপস্থিতি সত্ত্বেও নতুন নতুন বিদআত, জাহেলী রীতি-নীতি এবং অপরাপর ধর্ম ও মতবাদের আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। এমনকি কখনো কখনো এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে যে, না জানি এই সমাজও জাহেলী সমাজেরই দ্বিতীয় সংস্করণে পরিণত হয়ে যায়।

এই হচ্ছে আমাদের দ্বীনের বিশেষ চেতনা ও বৈশিষ্ট্য, কাঠামো ও রূপরেখা, যা এই দ্বীনের স্বরূপ ও স্বকীয়তা নির্দেশ করে এবং অপরাপর দর্শন ও ধর্মাদর্শ থেকে এর স্বাতন্ত্র্য বিধান করে। মুসলিমমাত্রেরই করণীয়- এই সকল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগত ও সচেতন হওয়া এবং এক্ষেত্রে প্রচ- গৌরববোধ পোষণ করা।

এরই মাধ্যমে আমরা আপন যুগে হক-বাতিলের সংঘাত ও সংমিশ্রণের কালেও (যা কখনো সংঘাতের চেয়েও ভয়াবহ ও ক্ষতিকর হয়ে থাকে) সঠিক দ্বীনের উপর অবিচল থাকতে পারব এবং এর খিদমত ও হিফাযতের সৌভাগ্য লাভেও ধন্য হতে পারব।

وَ اللهُ یَهْدِیْ مَنْ یَّشَآءُ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ.
আল্লাহ যাকে চান সীরাতে মুসতাকীমের পথনির্দেশ দান করেন।  সূরা বাকারা (২) : ২১

অনুবাদে : মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ
জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৯ – মার্চ ২০১৮
মাসিক আলকাউসার


বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, লেখকের গ্রন্থ ‘মানসাবে নবুওয়াত আওর উসকে আলী মাকাম হামিলীন’ পৃ. ১১৮-১২০

বিস্তারিত ঘটনা সীরাতের কিতাবে দেখুন। সংক্ষেপে : হযরত যায়েদ ইবনুদ দাছিনা রা.-কে কাফিররা হত্যার উদ্দেশ্যে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন আবু সুফিয়ান তাঁকে বলল, তুমি কি পছন্দ করবে, তুমি তোমার ঘরে নিরাপদে থাক আর এখানে তোমার স্থলে মুহাম্মাদকে নিয়ে আসা হোক? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, আল্লাহর কসম! আমি তো এটুকুও সহ্য করব না যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেখানে আছেন সেখানেও একটি কাঁটা তাঁর গায়ে ফুটুক আর আমি ঘরে আরামে বসে থাকি!

বনু দীনারের এক সাহাবিয়ার স্বামী, বাবা ও ভাই প্রত্যেকে উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। তাকে এই সংবাদ দেয়া হলে তিনি অস্থিরকণ্ঠে বলে উঠলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেমন আছেন। সাহাবীরা বললেন, আলহামদু লিল্লাহ, তিনি ভালো আছেন। সাহাবিয়া বললেন, আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে চল। তাকে নিয়ে যাওয়া হল, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখামাত্র তিনি বলে উঠলেন, আপনি যখন বেঁচে আছেন তখন আমার সকল মুসীবত তুচ্ছ।

উহুদ যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর কাফিরদের তীব্র আক্রমনের মুখে হযরত আবু দুজানা রা. নিজের দেহকে ঢাল বানিয়ে দিয়েছিলেন। হযরত আবু তালহা রা. নিজের হাত দিয়ে কাফিরদের তীর তরবারির আঘাত ঠেকিয়ে দিচ্ছিলেন। ফলে সারা জীবনের জন্য তার হাতটি  অকেজো হয়ে গিয়েছিল।

এই আয়াত দশম হিজরীতে বিদায় হজ্জ্বের আরাফার দিন নাযিল হয়। অতীত ধর্মসমূহের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন জনৈক ইহুদী পণ্ডিত উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন- এ এক অনন্য মর্যাদা, যা শুধু মুসলিমেরাই লাভ করল। এ শুধু ইসলামেরই বৈশিষ্ট্য, অন্য কোনো ধর্ম-মিল্লাতের এতে কোনো হিস্যা নেই। সেই ইহুদী পণ্ডিত হযরত ওমর রা.-কে বলেছিলেন, আমীরুল মু’মিনীন! আপনাদের কিতাবে এমন একটি আয়াত আছে তা যদি আমাদের উপর নাযিল হত তাহলে ঐ দিনটিকে আমরা জাতীয় উৎসব-দিবসে পরিণত করতাম।

হযরত ওমর রা. জবাবে বলেছিলেন, এই আয়াত কবে, কোথায় নাযিল হয়েছিল, সে সময় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় অবস্থান করছিলেন আমি তা খুব ভালো করে জানি। সেই দিনটি ছিল আরাফার দিন। (সহীহ বুখারী, কিতাবুত তাফসীর) অর্থাৎ আমাদের নতুন কোনো উৎসব উদ্ভাবনের প্রয়োজন নেই। ঐ দিনটিই ছিল আমাদের এক ঈদের দিন। আর অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলাম কোনো উৎসবপ্রিয় ধর্ম নয়।

.চিন্তাভাবনার এই বিশৃঙ্খলা ও সমস্যার ভয়াবহতা বুঝতে হলে দেখুন : Encyclopedia of Religion and Ethics  Edwin knox Michele-এর প্রবন্ধ ৮ : ৫৮৮

অনেক ইছনা আশারী শীয়ার আকীদা এইরূপ।

Islam  or true Christianity p. 128