আমানতদারী ও অন্যের হক – মাওলানা মুহাম্মাদ ফজলুল বারী

একবার পল্টন থেকে মিরপুরের উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম, বাস যদি ফার্মগেট পৌঁছতে মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে যায় তাহলে ফার্মগেট নেমে নামায পড়ব। অন্যথায় মিরপুর পৌঁছেই নামায পড়ব। সুপারভাইজার ভাড়া চাইতে আসল। বললাম, ভাই আমি ফার্মগেটেও নামতে পারি আবার মিরপুর পর্যন্তও যেতে পারি, দয়া করে ভাড়াটা ফার্মগেটের পরে নিন। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা;বলল, এখনই দিয়ে দেন। শেষে আমি মিরপুরের ভাড়া দিলাম। ফার্মগেট পৌঁছতে দেরি হল, আমি নামার জন্য গেটে এলাম, সুপারভাইজার আমাকে ফার্মগেট থেকে মিরপুরের ভাড়া (১৪ টাকা) ফেরৎ দিল। আমি নেমে দেখি আমার হাতে চবিবশ টাকা। সাথে সাথে বাস থামাতে বললাম ও তাকে বিশ টাকার নোটটি দেখিয়ে বললাম, আমাকে দশ টাকা বেশি দিয়েছেন। সে বাস থামিয়ে আমাকে দশ টাকা দিয়ে বিশ টাকার নোটটি ফেরৎ নিল।

বিষয়টি খুব সাদামাটাভাবে ঘটেছে। কিন্তু এর মাঝে আমার জন্য ও আমাদের জন্য রয়ে গেছে শিক্ষা। তাই লিখতে বসলাম। আল্লাহ আমাকে টাকাটা ফেরৎ দেওয়ার তৌফিক দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। দশ টাকায় আর কী আসে যায়, কিন্তু এ দশ টাকার অর্জন অনেক মহৎ। আবার যদি টাকাটা ইচ্ছাকৃত ফেরৎ না দেয়া হত, তাহলে এ দশ টাকার ক্ষতি অনেক বড় ও ব্যপক।

আমাদের অনেকেরই জীবনে এমন ঘটনা ঘটবে বা ঘটেছে। এগুলোর মাধ্যমে আমরা নিজেকে চিনতে পারি। যদি আমি আমানতদারীর পরিচয় দিয়ে থাকি তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি ভিন্নটা হয় তাহলে আমি আল্লাহর কাছে তওবা করব, সম্ভব হলে হক ফিরিয়ে দিব ও নিজেকে শুধরে নিব।

এ লেখাটা যখন লিখছি তখন আমার এক বন্ধু বলল, কয়েকদিন আগে আমারও এমন হয়েছে। ফলের দোকান থেকে ফল কিনেছি। ৩০০ টাকার ফল কিনে ১০০০ টাকার নোট দিয়েছি। দোকানদার আমাকে ১২০০ টাকা ফেরৎ দিয়েছিল। প্রথমে খেয়াল করিনি, তারপর দেখি দোকানদার তার দেওয়া ১০০০ টাকার নোটকে ৫০০ টাকা ভেবে আমাকে শাতশ টাকার স্থলে বারশ টাকা ফেরৎ দিয়েছে। (কারণ, কিছু নোট আছে যেগুলোর ৫০০ ও ১০০০ টাকা একই রকম দেখা যায়)। সাথে সাথে আমি তার টাকাটা ফেরৎ দিয়ে দিলাম।

বান্দার হক। অনেক গুরুত্বের দাবি রাখে। হকটি ছোট হোক বা বড়। এ হকের মূলকথা হল, তা আমাকে কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দিতে হবে। দুনিয়াতে বা আখেরাতে; যেদিন এ রকম দশটি টাকা ব্যক্তিকে পৌছে দিতে পারে জাহান্নামের দ্বারপ্রান্তে বা দশ টাকার এ সামান্য আমানত রক্ষা তাকে দাখেল করতে পারে জান্নাতে। দশ টাকার আমানতদারী আমাকে দশ কোটি টাকা কিংবা দশ হাজার কোটি টাকার আমানতদারী শেখাবে। আজ আমি ছলে বলে কৌশলে এপারে পার পেয়ে গেলাম বা আমাকে পার করে নিল (অর্থ বা শক্তির মাধ্যমে) যারা পার করে নেয়, কিন্তু ওপারে? ওপারে কীভাবে আমি পার পাব? কে আমাকে পার করে নেবে?

থানবী রাহ.-এর একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে। একবার থানবী রাহ. সাহারানপুর থেকে কানপুর যাচ্ছিলেন। রেলগাড়িতে আরোহণের উদ্দেশ্যে স্টেশন পৌঁছে তিনি বুঝতে পারেন যে, একজন যাত্রীর জন্য যে পরিমাণ মালপত্র বিনা ভাড়ায় নেওয়ার অনুমতি রয়েছে, তাঁর সঙ্গে সে তুলনায় অধিক মাল রয়েছে। তাই তিনি যেখানে মাল ওজন করে অতিরিক্ত মালের ভাড়া উসূল করা হয়, তাঁর মাল বুক করানোর জন্য সেখানে যান। তখন সেখানে যে অফিসারটি কর্মরত ছিল, সে ছিল অমুসলিম। কিন্তু সে হযরত থানবী রাহ.কে চিনত এবং তাঁকে অত্যধিক শ্রদ্ধা করত। হযরত মাল বুক করার কথা বললে অফিসারটি বলল, মাওলানা! রেখে দিন। আপনার থেকে আর মালের ভাড়া কি নেব? আপনার মাল বুক করাতে হবে না। আমি এখনই গার্ডকে বলে দিচ্ছি। অতিরিক্ত মালের জন্য সে আপনাকে কিছুই বলবে না।

মাওলানা বললেন, এই গার্ড আমার সঙ্গে কতদূর পর্যন্ত যাবে?

– গাজীয়াবাদ পর্যন্ত। রেলওয়ে অফিসার উত্তর দিল।

– গাজীয়াবাদের পর কি অবস্থা হবে? মাওলানা জিজ্ঞাসা করলেন।

– এই গার্ড পরবর্তী গার্ডকেও বলে দেবে। সে বলল।

মাওলানা জিজ্ঞাসা করলেন, দ্বিতীয় গার্ড কোন পর্যন্ত যাবে?

অফিসারটি বলল, সে কানপুর পর্যন্ত আপনার সঙ্গে যাবে।

কানপুরের পর কি অবস্থা হবে? মাওলানা জিজ্ঞেস করলেন।

অফিসারটি বলল, কানপুরের পর আর কি হবে? সেখানে তো আপনার সফর শেষ হয়ে যাবে।

হযরত বললেন, না, আমার সফর তো অনেক দীর্ঘ, কানপুরে গিয়েও তা শেষ হবে না। এ দীর্ঘ সফর শেষ হবে সেই আখেরাতে গিয়ে। এবার বলুন, যখন আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞাসা করবনে, তোমার মাল ভাড়া দেওয়া ছাড়া কেন এবং কীভাবে নিয়ে গেলে? তখন কি এই গার্ডরা আমার কোন প্রকার সাহায্য করতে পারবে?

তারপর থানবী রাহ. তাকে আখেরাতের জবাবদিহিতার কথা বোঝালেন।

তো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি আমরা এ জাতীয় ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি তাহলে দুনিয়া আখেরাতে আমরা বিপদ থেকে বেঁচে যাব ইনশাআল্লাহ!

শাওয়াল ১৪৩৪ – আগস্ট ২০১৩

মাসিক আল কাউসার