আসমা বিনতু আবী বকর (রাঃ)

ঐতিহাসিকরা বলেন, ‘হযরত আসমা রা. একশ’ বছর জীবিত ছিলেন। কিন্তু এ দীর্ঘ জীবনে তাঁর একটি দাঁতও পড়েনি বা তাঁর সামান্য বুদ্ধিভ্রষ্টতাও দেখা যায়নি।’

এ মহিলা সাহাবী সর্বদিক দিয়েই সমমান ও মর্যাদার অধিকারিণী ছিলেন। তাঁর পিতা, পিতামহ, ভগ্নি, স্বামী ও পুত্র সকলেই ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী। একজন মুসলমানের এর চাইতে বেশী সম্মান, মর্যাদা, ও গৌরবের বিষয় কি হতে পারে?

পিতা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. রাসূলুল্লাহর সা. জীবনকালের বন্ধু, ওফাতের পর তাঁর প্রথম খলীফা। মাতা কুতাইলা বিনতু আবদিল ’উয্‌যা। পিতামহ হযরত আবু বকরের পিতা আবু কুহাফা বা আবু আতীক। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা রা. তাঁর বোন। রাসূলুল্লাহর সা. হাওয়ারী বিশেষ সাহায্যকারী যুবাইর ইবনুল আওয়াম রা. তাঁর স্বামী ও সত্য এবং ন্যায়ের পথে শহীদ হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর তাঁর পুত্র। এ হলো হযরত আসমা বিনতু আবু বকরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। হিজরাতের ২৭ বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন।

প্রথম যুগেই যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, আসমা রা. তাঁদেরই একজন। মাত্র সতেরো জন নারী পুরুষ ব্যতীত আর কেউ তাঁর আগে এ সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেনি। তাঁকে ‘জাতুন নিতাকাইন’- দু’টি কোমর বন্ধনীর অধিকারিণী বলা হয়। কারণ মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের সময় তিনি রাসূল সা. ও তাঁর পিতার জন্য থলিতে পাথেয় ও মশকে পানি গুছিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর মুখ বাঁধার জন্য ধারে কোন রশি খুঁজে পেলেন না। অবশেষে নিজের কোমরের নিতাক বা বন্ধনী খুলে দু’টুকরো করে একটা দ্বারা থলি ও অন্যটি দ্বারা মশকের মুখ বেঁধে দেন, এ দেখে রাসুল সা. তাঁর জন্য দু’আ করেনঃ আল্লাহ যেন এর বিনিময়ে জান্নাতে তাঁকে দু’টি ‘নিতাক’ দান করেন। এভাবে তিনি ‘জাতুন নিতাকাইন’ উপাধি লাভ করেন।

যুবাইর ইবনুল আওয়ামের সাথে যে সময় তার বিয়ে হয় তখন যুবাইর অত্যন্ত দরিদ্র ও রিক্তহস্ত। তাঁর কোন চাকর-বাকর ছিলনা এবং একটি মাত্র ঘোড়া ছাড়া পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কোন সম্পদও ছিলনা। তবে যুবাইর একজন পূর্ণবতী ও সৎকর্মশীলা স্ত্রী লাভ করেছিলেন। তিনি স্বামীর সেবা করতেন, নিজ হাতে তাঁর ঘোড়াটির জন্য ভুষি পিষতেন ও তাঁর তত্ত্বাবধান করতেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে প্রাচুর্য দান করেন এবং তাঁরা অন্যতম ধনী সাহাবী পরিবার হিসাবে পরিগণিত হন।

হযরত আসমা রা. বর্ণনা করেছেন। যুবাইর রা. যখন আমাকে বিয়ে করেন তখন একটি ঘোড়া ছাড়া তাঁর আর কিছু ছিলনা। ঘোড়াটি আমিই চরাতাম ও ভূষি খাওয়াতাম। খেজুরের আটি পিষে ভূষি বানাতাম। আমি যুবাইরের ক্ষেত থেকে- যে ক্ষেত রাসুল সা. তাঁকে দিয়েছিলেন মাথায় করে খেজুরের আটি নিয়ে আসতাম। ক্ষেতটি ছিল পৌনে এক ফারসাখ দূরে। একদিন আমি খেজুরের আটি মাথায় করে ঘরে ফিরছি, এমন সময় পথে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে দেখা। তাঁর সাথে তখন আরও কয়েকজন লোক ছিল। তিনি আমাকে ডাকলেন এবং তাঁর বাহনের পিঠে উঠে বসার জন্য বললেন। কিন্তু আমি লজ্জা পেলাম এবং যুবাইর ও তার মান-মর্যাদার কথা মনে করলাম। রাসূল সা. চলে গেলেন। বাড়ী ফিরে আমি এ ঘটনার কথা যুবাইরকে বললাম। এরপর পিতা আবু বকর রা. আমার জন্য একটি চাকর দেন। সে-ই তখন ঘোড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে যেন আমাকে মুক্তি দিল। (সিয়ারু আলাম আন নুবালা– ২/২৯০-২৯১, তাবাকাত- ৮/২৫০, মুসনাদে আহমাদ- ৬/৩৪৭,৩৫২)

মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাতের সময় ঘনিয়ে এলো। তিনি তখন পূর্ণ অন্তঃসত্তা, আবদুল্লাহ তাঁর গর্ভে। তা সত্ত্বেও এ কষ্টকর দীর্ঘ ভ্রমণে ভয় পেলেন না, আল্লাহর নামে বেরিয়ে পড়লেন। কুবা পৌঁছার পরই তিনি প্রসব করেন আবদুল্লাহকে। এ আবদুল্লাহ ছিলেন মদীনার মুহাজিরদের গৃহে, মদীনায় আসার পর জন্মগ্রহণকারী প্রথম সন্তান। এ কারণে মুসলমানরা তাঁর জন্মের খবর শুনে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করে। তাঁর মা আসমা সদ্য প্রসূত সন্তানটিকে কোলে করে রাসূলুল্লাহর সা. কাছে নিয়ে যান এবং তাঁর কোলে তুলে দেন। রাসুল সা. নিজের জিহ্বা থেকে কিছু থু থু নিয়ে শিশুটির মুখে দেন এবং তার জন্য দু’আ করেন। তাই পার্থিব কোন জিনিস তার পেটে প্রবেশ করার পূর্বে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর সা. পবিত্র থু থু তার পেটে প্রবেশ করেছিল।

হযরত আসমা বিনতু আবু বকরের মধ্যে সততা, দানশীলতা, মহত্ব ও প্রখর বুদ্ধি মত্তার মত এমন সব সুষম চারিত্রিক গুণাবলীর সমন্বয় ঘটেছিল যা ছিল বিরল। তাঁর দানশীলতা তো একটি প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ বলেনঃ ‘আমি আমার মা আসমা ও খালা আয়িশা থেকে অধিক দানশীলা কোন নারী দেখিনি। তবে তাঁদের দু’জনের দান প্রকৃতির মধ্যে প্রভেদ ছিল। আমার খালার স্বভাব ছিল প্রথমতঃ তিনি বিভিন্ন জিনিস একত্র করতেন। যখন দেখতেন যে যথেষ্ট পরিমাণে জমা হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ করে একদিন তা সবই গরীব মিসকীনদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার মার স্বভাব ছিল ভিন্নরূপ। তিনি আগামীকাল পর্যন্ত কোন জিনিস নিজের কাছে জমা করে রাখতেন না।’

আসমা রা. ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী। তাঁর বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন সংকটের সময়ে। ইবন হিশামের বর্ণনা থেকে জানান যায়, রাসূল সা. ও আবু বকরের হিজরাতের খবর মক্কায় ছড়িয়ে পড়লে পরদিন আবু জাহল ও আরো কতিপয় কুরাইশ নেতা আবু বকরের বাড়ীতে আসে এবং আসমাকে সামনে পেয়ে তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার বাবা আবু বকর কোথায়?’ আসমা বলতে অস্বীকৃতি জানালে নরাধম আবু জাহল তাঁর গালে জোরে এক থাপ্‌পড় বসিয়ে দেয়। ফলে তাঁর কানের দুল দু’টি ছিটকে পড়ে যায়।

হিজরাতের সময় রাসূল সা. ও আবু বকরের রা. সাওর পর্বতের গুহায় অবস্থানকালে রাতের অন্ধকারে আসমা তাঁদের জন্য খাবার ও পানীয় নিয়ে যেতেন।

তাঁর পিতা আবু বকর রা. হিজরাতের সময় যাবতীয় নগদ অর্থ সাথে নিয়ে যান। দাদা আবু কুহাফা তা জানতে পেরে বলেন, ‘সে জান ও মাল উভয় ধরণের কষ্ট দিয়ে গেল।’ আসমা দাদাকে বললেন, ‘না, তিনি অনেক সম্পদ রেখে গেছেন।’ একথা বলে আবু বকর রা. যেখানে অর্থ-সম্পদ রাখতেন সেখানে অনেক পাথর রেখে দিলেন। তারপর আবু কুহাফাকে ডেকে এসে বললেনঃ ‘দেখুন, এসব রেখে গেছেন।’ আবু কুহাফা অন্ধ ছিলেন। তিনি আসমার কথায় বিশ্বাস করেন। আসমা বলেনঃ ‘আবু কুহাফাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমি এমনটি করেছিলাম। আসলে সেখানে কিছুই ছিল না।’

আসমা বিনতু আবু বকরের ঘটনাবহুল জীবনের অনেক কথাই ইতিহাস ধরে রাখতে পারেনি। তবে তাঁর পুত্র আবদুল্লাহর সাথে জীবনের শেষ সাক্ষাতের সময় তিনি যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা, চারিত্রিক বল ও ঈমানী দৃঢ়তার পরিচয় দেন, ইতিহাসে তা চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। উমাইয়া খলিফা ইয়াজিদ বিন ‍মু’আবিয়ার মৃত্যুর পর হিজায, মিসর, ইরাক ও খুরাসানসহ সিরিয়ার বেশীর ভাগ অঞ্চলের লোকেরা আবদুল্লাহকে খলীফা বলে মেনে নেয় এবং তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে। কিন্তু উমাইয়া রাজবংশ তা মেনে নিতে পারেননি। তারা তাঁকে দমনের জন্য হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নেতৃত্বে বিরাট এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাঠায়। দু’পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, এবং তাতে আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর চরম বীরত্ব প্রদর্শন করেন। পরিশেষে তাঁর সংগী সাথীরা বিজয়ের কোন সম্ভাবনা না দেখে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। তিনি তাঁর শেষ মুহূর্তের অনুসারীদের নিয়ে কা’বার হারাম শরীফে অবস্থান গ্রহণ করেন। এখানে উমাইয়া সেনাবাহিনীর সাথে চূড়ান্ত সংঘর্ষের কিছুক্ষণ পূর্বে তিনি তার মা আসমার সাথে শেষবারের মত সাক্ষাত করতে যান। হযরত আসমা রা. তখন বার্ধক্যের ভারে জর্জরিত ও অন্ধ। মাতা-পুত্রের জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারটি নিম্নরূপঃ

– মা, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্‌ভ

– আবদুল্লাহ, ওয়া আলাইকাস সালাম। হাজ্জাজ-বাহিনীর মিনজানিক হারাম শরীফে অবস্থানরত তোমার বাহিনীর ওপর পাথর নিক্ষেপ করছে, মক্কার বাড়ী-ঘর প্রকম্পিত করে তুলছে, এমন চরম মুহূর্তে তোমার উপস্থিতি কি উদ্দেশ্যে?

– উদ্দেশ্য আমাদের সাথে পরামর্শ।

– পরামর্শ! কি বিষয়ে?

– হাজ্জাজের ভয়ে অথবা তার প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে লোকেরা আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলে চলে গেছে, এমনকি আমার সন্তান এবং আমার পরিবারের লোকেরাও আমাকে পরিত্যাগ করেছে। এখন আমার সাথে অল্প কিছু লোক আছে। তাদের ধৈর্য ও সাহসিকতা যত বেশীই হোকনা কেন, দু’ এক ঘন্টার বেশী তারা কোন মতেই টিকে থাকতে পারবে না। এদিকে উমাইয়ারা প্রস্তাব পাঠাচ্ছে, আমি যদি আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানকে খলীফা বলে স্বীকার করে নেই এবং অস্ত্র ফেলে দিয়ে তাঁর হাতে বাইয়াত হই তাহলে পার্থিব সুখ-সম্পদের যা আমি চাইবো তাই তারা দেবে- এমতাবস্থায় আপনি আমাকে কি পরামর্শ দেন। আসমা রা. একটু উচ্চস্বরে বলেনঃ

– ব্যাপারটি একান্তই তোমার নিজস্ব। আর তুমি তোমার নিজের সম্পর্কে বেশী জান। যদি তোমার দৃঢ় প্রত্যয় থাকে যে, তুমি হকের ওপর আছ এবং মানুষকে হকের দিকেই আহ্‌বান করছো, তাহলে তোমার পতাকাতলে যারা অটল থেকে শাহাদাত বরণ করেছে, তাদের মত তুমিও অটল থাকো। আর যদি তুমি দুনিয়ার সুখ-সম্পদের প্রত্যাশী হয়ে থাক, তাহলে তুমি একজন নিকৃষ্টতম মানুষ। তুমি নিজেকে এবং তোমার লোকদেরকে ধ্বংস করেছো।

– তাহলে আজ  আমি নিশ্চিতভাবে নিহত হবো।

– স্বেচ্ছায় হাজ্জাজের কাছে আত্মসমর্পণ করবে এবং বনী উমাইয়াদের ছোকরারা তোমার মুণ্ডু নিয়ে খেলা করবে, তা থেকে যুদ্ধ করে নিহত হওয়াই উত্তম।

– আমি নিহত হতে ভয় পাচ্ছি না। আমার ভয় হচ্ছে, তারা আমার হাত-পা কেটে আমাকে বিকৃত করে ফেলবে।

– নিহত হওয়ার পর মানুষের ভয়ের কিছু নেই। কারণ, জবেহ করা ছাগলের চামড়া তোলার সময় সে কষ্ট পায় না?

একথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইরের মুখমণ্ডলের দীপ্তি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন, ‘আমার কল্যাণময়ী মা, আপনার সুমহান মর্যাদা আরো কল্যাণময় হোক। এ সংকটময় মুহূর্তে আপনার মুখ থেকে কেবলমাত্র এ কথাগুলি শোনার জন্য আমি আপনার খেদমতে হাজির হয়েছিলাম। আল্লাহ জানেন, আমি ভীত হননি, আমি দুর্বল হইনি। তিনিই সাক্ষী, আমি যে জন্য সংগ্রাম করছি, তা কোন জাগতিক সুখ সম্পদ ও মর্যাদার প্রতি লোভ-লালসা ও ভালোবাসার কারণে নয়। বরং এ সংগ্রাম হারামকে হালাল ঘোষনা করার প্রতি আমার ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারণেই। আপনি যা পছন্দ করেছেন, আমি এখন সে কাজেই যাচ্ছি। আমি শহীদ হলে আমার জন্য কোন দুঃখ করবেন না এবং আপনার সবকিছুই আল্লাহর হাতে সোপর্দ করবেন।’

– যদি তুমি অসত্য ও অন্যায়ের ওপর নিহত হও তাহলে আমি ব্যথিত হবো।

– আম্মা, আপনি বিশ্বাস রাখুন, আপনার এ সন্তান কখনও অন্যায় অশ্লীল কাজ করেনি, আল্লাহর আইন লংঘন করেনি, কারো বিশ্বাস ভঙ্গ করেনি, কোন মুসলমান বা জিম্মীর ওপর যুলুম করেনি এবং আল্লাহর রিজামন্দী অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর কোন কিছু এ দুনিয়ায় তার কাছে নেই। এ কথা দ্বারা নিজেকে পবিত্র ও নিষ্পাপ বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কারণ, আমার সম্পর্কে আল্লাহই বেশী ভালো জানেন। আপনার অন্তরে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সৃষ্টি হোক- কথাগুলি শুধু এ জন্যই বলছি। জবাবে আসমা রা. বললেনঃ

– আলহামদুলিল্লাহিল্লাজী জা’আলাকা আলা মা ইউহিব্বু ওয়া উহিব্বু- সেই আল্লাহর প্রশংসা, যিনি তাঁর ও আমার পছন্দনীয় কাজের ওপর তোমাকে অটল রেখেছেন। বৎস! তুমি আমার কাছে একটু এগিয়ে এসো, আমি শেষবারের মত একটু তোমার শরীরের গন্ধ শুকি এবং তোমাকে একটু স্পর্শ করি। কারণ, এটাই আমার ও তোমার ইহজীবনের শেষ সাক্ষাৎ।

আবদুল্লাহ উপুড় হয়ে তাঁর মার হাত-পা চুমুতে চুমুতে ভরে দিতে লাগলেন, আর মা তার ছেলের মাথা, মুখ ও কাঁধে নিজের নাক ও মুখ ঠেকিয়ে শুকতে ও চুমু দিতে লাগলেন এবং তাঁর শরীরে নিজের দু’টি হাতের পরশ বুলিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি একথা বলতে বলতে তাঁকে ছেড়ে দিলেনঃ

– আবদুল্লাহ তুমি এ কী পরেছো?

– আম্মা, এ তো আমার বর্ম।

– বেটা, যারা শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষী এটা তাদের পোশাক নয়।

– আপনাকে খুশী করা ও আপনার হৃদয়ে প্রশান্তি দানের উদ্দেশ্যে আমি এ পোশাক পরেছি।

– তুমি এটা খুলে ফেল। তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার সাহসিকতা ও আক্রমণের পক্ষে উচিত কাজ হবে এমনটিই। তাছাড়া এটা হবে তোমার কর্মতৎপরতা, গতি ও চলাফেরার পক্ষেও সহজতর। এ পরিবর্তে তুমি লম্বা পাজামা পর। তাহলে তোমাকে মাটিতে ফেলে দেওয়া হলেও তোমার সতর অপ্রকাশিত থাকবে।

মায়ের কথামত আবদুল্লাহ তাঁর বর্ম খুলে পাজামা পরলেন এবং এ কথা বলতে বলতে হারাম শরীফের দিকে যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন- ‘আম্মা, আমার জন্য দু’আ করতে ভুলবেন না।’

সাথে সাথে তাঁর মা হযরত আসমা রা. দু’টি হাত আকাশের দিকে তুলে দু’আ করলেনঃ হে আল্লাহ, রাতের অন্ধকারে মানুষ যখন গভীর ঘুমে অচেতন থাকে তখন তার জেগে জেগে দীর্ঘ ইবাদত ও উচ্চকণ্ঠে কান্নার জন্য আপনি তার ওপর রহম করুন। হে আল্লাহ, রোযা অবস্থায় মক্কা ও মদীনাতে মধ্যাহ্নকালীন ক্ষুধা ও পিপাসার জন্য তার ওপর রহম করুন। হে আল্লাহ, পিতামাতার প্রতি সদাচরণের জন্য তার প্রতি আপনি করুণা বর্ষন করুন। হে আল্লাহ, আমি তাকে আপনারই কাছে সোপর্দ করেছি, তার জন্য আপনি যে ফায়সালা করবেন তাতেই আমি রাজী, এর বিনিময়ে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের প্রতিদান দান করুন।’

সেদিন সূর্য অস্ত যাবার আগেই হযরত আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর তাঁর মহাপ্রভুর সাতে মিলিত হন। তাঁর শাহাদাতের কিছুদিনের মধ্যেই হিজরী ৭৩ সনে হযরত আসমাও রা. ইহলোক ত্যাগ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল এক শ’ বছর। মহিলা সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষে মৃত্যুবরণ করেন। (সিয়ারু আলাম আন-নুবালা- ২/২৮৮)

হযরত আবদুল্লাহকে রা. হত্যার পর হাজ্জাজ তাঁর লাশকে শূলিতে লটকিয়ে রেখেছিল। তাঁর মা আসমা এলেন ছেলের লাশ দেখতে । লটকানো লাশের কাছে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত শান্তভাবে বললেন, ‘এ সওয়ারীর এখনো ঘোড়া থেকে নামার সময় হলো না?’ জনতার ভিড় কমানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে নেওয়ার জন্য হাজ্জাজ লোক পাঠায়। তিনি যেতে অস্বীকৃতি জানান। সে আবারো লোক মারফত বলে পাঠায়, এবার না এলে, তাঁর চুলের গোছা ধরে টেনে আনা হবে। হযরত আসমা হাজ্জাজের ভয়ে ভীত হলেন না। তিনি গেলেন না। এবার হাজ্জাজ নিজেই এলো। তাদের দু’জনের মধ্যে নিম্নরূপ কথাবার্তা হলো। হাজ্জাজ বললোঃ

– ‘বলুন তো আমি আল্লাহর দুশমন ইবন যুবায়েরের সাথে কেমন ব্যবহার করেছি?’ আসমা বললেন, ‘তুমি তার দুনিয়া নষ্ট করেছো। আর সে তোমার পরকাল নষ্ট করেছে। আমি শুনেছি, তুমি নাকি তাকে ‘যাতুন নিতাকাইন’ তনয় বলে ঠাট্টা করেছো। আল্লাহর কসম, আমিই ‘যাতুন নিতাকাইন’। আমি একটি নিতাক দিয়ে রাসূলুল্লাহর সা. ও আবু বকরের রা. খাবার বেঁধেছি। আরেকটি নিতাক আমার কোমরেই আছে। মনে রেখ, নবী করীমের সা. কাছ থেকে আমি শুনেছি, সাকীফ বংশে একজন মিথ্যাবাদী ভণ্ড এবং একজন যালিম পয়দা হবে। মিথ্যাবাদীকে তো আগেই দেখেছি। (আল-মুখতার) আর যালিম তুমিই।’ হাজ্জাজ এ হাদীস শুনে নীরব হয়ে যায়। (সহীহ মুসলিমঃ ২য় খণ্ড)

হযরত আসমা থেকে ৫৬টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তেরোটি মুত্তাফাক আলাইহি এবং বুখারী পাঁচটি ও মুসলিম চারটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন। বহু বিশিষ্ট সাহাবী তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হলোঃ তাঁর দুই ছেলে- আবদুল্লাহ ও ’উরওয়া, পৌত্র আবদুল্লাহ ইবনে ’উরওয়া, প্রপৌত্র ’উব্বাদ ইবন আবদিল্লাহ, ইবন আব্বাস, আবু ওয়াকিদ আল-লাইসী, সাফিয়্যা বিনতু শায়বা, মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির, ওয়াহাব ইবন কায়সান, আবূ নাওফিল মুয়াবিলা ইবন আবী আকবার, আল-মুত্তালিব ইবন আবদুল্লাহ ইবন হানতাব, ফাতিমা বিনতুল মুনজির ইবনুয যুবাইর, ইবন আবী মুলাইকা, ’উব্বাদ ইবন হামযা ইবন আবদুল্লাহ এবং আরও অনেকে। (সিয়ারু আলাম আন-নুবালা ২/২৮৮)