খাব্বাব ইবনুল আরাত (রা)

নাম খাব্বাব, কুনিয়াত আবু আবদিল্লাহ, পিতার নাম আরাত। তাঁর বংশ সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন, তিনি বনু তামীম, আবার কেউ বলেছেন, বনু খুযা’য়া গোত্রের সন্তান। তবে সহীহ মতানুযায়ী তিনি বনু তামীম গোত্রের সন্তান। (সীরাত ইবন হিশাম-১/২৫৪) শৈশবে তিনি দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁর দাসত্বের কাহিনী ইতিহাসে এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ

বনু খুযা’য়া গোত্রের উম্মু আনমার নাম্মী এক মহিলা মক্কার দাস কেনা-বেচার বাজারে গেল। তার উদ্দেশ্য, সে সুস্থ ও তাজা-মোটা দেখে এমন একটি দাস কিনবে, যে তার যাবতীয় কাজ সম্পাদন করতে পারবে। বাজারে বিক্রির উদ্দেশ্যে আনীত দাসদের চেহারা সে গভীরভাবে দেখতে লাগলো। অবশেষে সে একটি কিশোর দাস নির্বাচন করলো, যে তখনও যৌবনে পদার্পণ করেনি। তবে দাসটি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। চোখে-মুখে তার বুদ্ধিমত্তার ছাপ। আর এটা দেখেই সে তাকে চয়ন করেছে। দাম মিটিয়ে কিশোর দাসটিকে সে সংগে নিয়ে চললো।

কিছুদূর যাওয়ার পর উম্মু আনমার দাসটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলোঃ

বৎস, তোমার নাম কি?

খাব্বাব।

আব্বার নাম?

আল-আরাত।

তোমার জম্মভূমি কোথায়?

নাজদ।

তাহলে তুমি আরবের অধিবাসী?

হাঁ, বনু তামীমের সন্তান।

তুমি মক্কার এ দাসের আড়তে এলে কিভাবে?

আরবের কোন এক গোত্র আমাদের গোত্রের উপর আক্রমণ করে গৃহপালিত পশু-পাখি লুট করে নিয়ে যায়, পুরুষদের হত্যা করে এবং নারী-শিশুদের বন্দী করে দাসে পরিণত করে। আমি সেই বন্দী শিশুদের একজন। তারপর হাত বদল হয়ে মক্কায় পৌঁছেছি এবং বর্তমানে আপনার হাতে।

উম্মু আনমার তার দাসটিকে তরবারি নির্মাণের কলা-কৌশল শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে মক্কার এক কর্মকারের হাতে সোপর্দ করলো। অল্প দিনের মধ্যে এ বুদ্ধিমান দাস তরবারি নির্মাণ শিল্পে দক্ষ হয়ে ওঠে। উম্মু আনমার একটি দোকান ভাড়া নিয়ে কর্মকারের সাজ-সরঞ্জাম ক্রয় করে তাকে তরবারি তৈরীর কাজে লাগিয়ে দেয়।

তাঁর সততা, নিষ্ঠা, আমানতদারি এবং তরবারি তৈরীর দক্ষতার কথা অল্প দিনের মধ্যে মক্কায় ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ তাঁর নির্মিত তরবারি খরীদের জন্য তাঁর দোকানে ভীড় জমাতে থাকে।

তরুণ হওয়া সত্বেও খাব্বাব লাভ করেছিলেন বয়স্কদের বুদ্ধিমত্তা ও বৃদ্ধদের জ্ঞান। তিনি কাজের ফাঁকে অবসর সময়ে জাহিলী সমাজ যে বিপর্যয়ের মধ্যে আপাদমস্তক নিমজ্জিত সে সম্পর্কে আপন মনে ভাবতেন। তিনি ভাবতেন, কী মারাত্মক মূর্খতা ও ভ্রান্তির মধ্যেই না গোটা আরব জাতি হাবুডুবু খাচ্ছে এবং যার এক নিকৃষ্ট বলি সে নিজেই। তিনি চিন্তা করতেন, অবচেতন মনে মাঝে মাঝে বলতেন, এই রাত্রির শেষ অবশ্যই আছে। এই শেষ দেখার জন্য মনে মনে তিনি দীর্ঘায়ূ কামনা করতেন।

দীর্ঘদিন খাব্বাবকে অপেক্ষা করতে হলো না। তিনি শুনতে পেলেন, বনু হাশিমের এক যুবক মুহাম্মাদ ইবন আবদিল্লাহর মুখ থেকে নূরের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। তিনি ছুটে গেলেন। তাঁর কথা শুনলেন এবং সেই জ্যোইত অবলোকন করলেন। সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে উচ্চারণ করলেনঃ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। এভাবে তিনি হলেন বিশ্বের ষষ্ঠ মুসলমান। এ কারণে তাঁকে ‘সাদেসুল ইসলাম’ বলা হয়। অবশ্য মুজাহিদ বলেনঃ সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ (সা) ইসলামের ঘোষণা দেন। তারপর যথাক্রমেঃ আবু বকর, খাব্বাব, সুহাইব, বিলাল, আম্মার ও আম্মারের মা সুমাইয়্যা ইসলামের ঘোষণা দেন। এই বর্ণনা মতে খাব্বাব তৃতীয় মুসলমান। (উসুদুল গাবা-২/৯৮, আল-ইসাবা-১/৪২৬) হযরত রাসূলে কারীম (সা) যখন হযরত আরকাম ইবন আবিল আরকামের গৃহে গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিতেন, খাব্বাব তখনই ইসলাম গ্রহণ করেন।

এখন থেকে খাব্বাবের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো। আর তা হলো সত্যের জন্য হাসিমুখে যুলুম-অত্যাচার সহ্য করা ও সত্যের প্রচারে জীবন বাজি রাখার অধ্যায়। খাব্বাব তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা কারো কাছে গোপন করলেন না। অল্প সময়ের মধ্যে এ খবর তাঁর মনিব উম্মু আনমারের কানে পৌঁছল। ক্রোধে সে উম্মত্ত হয়ে উঠলো। সে তার ভাই সিবা ইবন আবদিল উযযাসহ বনী খুযা’য়ার একদল লোক সংগে করে খাব্বাবের কাছে গেল। তিনি তখন গভীর মনোযোগের সাথে কাজে ব্যস্ত। একটু এগিয়ে গিয়ে সিবা বললোঃ

তোমার সম্পর্কে আমারা একটি কথা শুনেছি, আমরা তা বিশ্বাস করিনি।

কি কথা?

শুনেছি, তুমি নাকি ধর্মত্যাগ করে বনী হাশিমের এক যুবকের অনুসারী হয়েছো?

আমি ধর্মত্যাগী হইনি, তবে লা শরীক এক আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছি। তোমাদের মুর্তিপূজা ছেড়ে দিয়েছি এবং সাক্ষ্য দিয়েছি, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।

খাব্বাবের কথাগুলি তাদের কানে পৌঁছার সাথে সাথে তারা তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। হাত দিয়ে কিল-ঘুষি ও দিয়ে দিয়ে পিষতে শুরু করলো। তাঁর দোকানের সব হাতুড়ি, লোহার পাত ও টুকরা তাঁর ওপর ছুঁড়ে মারলো। খাব্বাব সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, দেহ তাঁর রক্তে রঞ্জিত হলো।

অন্য এক দিনের ঘটনা। কুরাইশদের কতিপয় ব্যক্তি তাদের অর্ডার দেওয়া তরবারি নেওয়ার জন্য খাব্বাবকে বাড়ীতে গেল। খাব্বাব তরবারি তৈরী করে মক্কায় বিক্রি করতেন এবং বাইরেও চালান দিতেন। ব্যস্ততার কারণে তিনি খুব কম সময়ই বাড়ী থেকে অনুপস্থিত থাকতেন। কিন্তু তারা খাব্বাবকে বাড়ীতে পেলনা। তারা তাঁর অপেক্ষায় থাকলো। কিছুক্ষণ পর খাব্বাব বাড়ীতে এলেন। তাঁর মুখমণ্ডলে একটা উজ্জ্বল প্রশ্নবোধক চিহ্ন। তিনি আগত লোকদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বসলেন। তারা জিজ্ঞেস করলোঃ খাব্বাব, তরবারিগুলি কি বানানো হয়েছে?

খাব্বাবের চোখে মুখে একটা খুশীর আভা। আপন মনে তিনি কি যেন ভাবছেন। এ সময় অবেচেতনভাবে বলে উঠলেনঃ ‘তাঁর ব্যাপারটি বড় অভিনব ধরনের।’

সাথে সাথে লোকগুলি প্রশ্ন করলোঃ তুমি কার কথা বলছো? আমরা তো জানতে চাচ্ছি, তরবারিগুলি বানানো হয়েছে কিনা।

তাদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে খাব্বাব বললেনঃ

তোমারা কি তাঁকে দেখেছো? তাঁর কোন কথা কি তোমরা শুনেছো?

তারা বিস্ময়ের সাথে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। তাদের একজন একটু রসিকতা করে জিজ্ঞেস করলোঃ তুমি কি তাকে দেখেছো?

খাব্বাব একটু হেঁয়ালীর মত প্রশ্ন করলেনঃ তুমি কার কথা বলছো?

উত্তেজিত কন্ঠে লোকটি জবাব দিলঃ তুমি যার কথা বলছো, আমি তার কথাই বলছি।

সত্য প্রকেশের এ সুযোগটুকু খাব্বাব ছাড়লেন না। তিনি বললেনঃ হাঁ, তাঁকে আমি দেখেছি এবং তাঁর কথাও শুনেছি। আমি দেখেছি, সত্য তাঁর চতুর্দিক থেকে প্রবাহিত হচ্ছে, নূর তাঁর মুখের মধ্যে দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে।

আগত লোকেরা এখন বিষয়টি বুঝতে শুরু করলো। তাদের একজন চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ

ওহে উম্মু আনমারের দাস! তুমি কার কথা বলছো? শান্তভাবে খাব্বাব জবাব দিলেনঃ

আমার আরব ভায়েরা, তিনি আর কে, তোমাদের কাওমের মধ্যে তিনি ছাড়া আর কে আছেন যার চতুর্দিক থেকে সত্য প্রবাহিত, যার মুখে নূরের আভা দীপ্তিমান?

আমাদের ধারণা, তুমি মুহাম্মাদের কথাই বলছো। খাব্বাব মাথাটি একটু দুলিয়ে উৎফুল্লভাবে বললেনঃ

হাঁ, তিনি আমাদের প্রতি প্রেরিত আল্লাহর আসূল। আমাদের আন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসার জন্য আল্লাহ তাঁকে পাঠিয়েছেন।

এ কথা গুলি উচ্চারণের পর তাঁর মুখ থেকে আর কি বেরিয়েছিল, অথবা তাকে কী বলা হয়েছিল, তিনি তা জানেন না। যতটুকু মনে আছে, কয়েক ঘন্টা পর যখন তিনি জ্ঞান ফিরে পেলেন, দেখলেন সেই লোকগুলি নেই। তাঁর শরীর ব্যথা-বেদনায় অসাড় এবং সমস্ত শরীর ও পরনের কাপড়-চোপড় রক্তে একাকার। ঘটনাটি তাঁর বাড়ীর সামনেই ঘটলো। তিনি কোন মতে উঠে বাড়ীর ভেতরে গেলেন, আহত স্থানে পট্টি লাগিয়ে নতুন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। (রিজালুন হাওলার রাসূল-২৩০)

এভাবে হযরত খাব্বাব দ্বীনের খাতিরে যুলুম-অত্যাচারের শিকার মানুষদের মধ্যে এক বিশেষ স্থানের অধিকারী হলেন। দরিদ্র ও দুর্বল হওয়া সত্বেও যারা কুরাইশদের অহমিকা ও বিকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন খাব্বাব তাঁদের এক প্রধান পুরুষ।

শুকনো পাতার আগুনের মত খাব্বাবের নতুন দ্বীন গ্রহণ এবং তাঁর শাস্তি ভোগের কথা মক্কার অলি-গলিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। খাব্বাবের দুঃসাহসে মক্কাবাসীরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল। ইতোপূর্বে তারা একথা আর কক্ষণো শোনেনি যে, কেউ মুহাম্মাদের অনুসারী হয়ে এভাবে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জের সুরে মানুষের সামনে তা ঘোষণা করেছে।

খাব্বাবের ব্যাপারটি কুরাইশ নেতাদের নাড়া দিল। উম্মু আনমারের নাম-গোত্র ও সহায় সম্বলহীন এ দাস কর্মকারটি-যে এভাবে তাদের ক্ষমতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এবং তাদের উপাস্য দেব-দেবী ও পিতৃ-পুরুষের ধর্মের নিন্দে-মন্দের আস্পর্ধা ও দুঃসাহস দেখাবে, তা তাদের ধারণায় ছিল না। তারা মনে করলো, এমন পিটুনির পর সে হয়তো শান্ত হয়ে যাবে, কক্ষণো আর এমন বোকামী করবে না।

কুরাইশদের ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হলো। বরং উল্টো ফল ফললো। খাব্বাবের এই দুঃসাহসে তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সাহস বেড়ে গেল। প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা দেওয়ার জন্য তারাও উৎসাহী হয়ে পড়লো। একের পর এক তারা সত্যের কালেমা ঘোষণা করতে শুরু করলো।

আবু সুফইয়ান ইবন হারব, ওয়ালীদ ইবনুল মুগীরা, আবু জাহল প্রমুখ কুরাইশ নেতৃবৃন্দ কা’বার চত্বরে সমবেত হলো। তারা মুহাম্মাদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলো। তারা দেখলো, তাঁর বিষয়টি দিন দিন, এমনকি ঘন্টায় ঘন্টায় বৃদ্ধি ও গুরুত্ব লাভ করে চলেছে। তারা বিষয়টি আর বাড়তে না দিয়ে এখনই মূ্লোৎপাটনের দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করে সিদ্ধান্ত নিলঃ আজ থেকে প্রতিটি গোত্র, সেই গোত্রের মুহাম্মাদের অনুসারীদের ওপর যুলুম-অত্যাচার চালাতে শুরু করবে। এতে হয় তারা তাদের নতুন দ্বীন ত্যাগ করবে, না হয় মৃত্যুবরণ করবে।

সিবা ইবন আবাদিল উযযা ও তার গোত্রের ওপর খাব্বাবকে শায়েস্তা করার দায়িত্ব অর্পিত হলো। মধ্যাহ্ন সূর্যের প্রচণ্ড খরতাপে মাটি যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠতো, তারা খাব্বাবকে মক্কার উপত্যকায় টেনে আনতো। তাঁর শরীর সম্পূর্ণ উদোম করে লোহার বর্ম পরাতো। প্রচণ্ড গরমে পিপাসায় তিনি কাতর হয়ে পড়তেন, তবুও এক ফোঁটা পানি দেওয়া হতো না। দারুণ পিপাসায় তিনি যখন ছটফট করতে থাকতেন, তারা তাঁকে বলতোঃ

মুহাম্মাদ সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কি?

বলতেনঃ তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। অন্ধকার থেকে আলোয় নেওয়ার জন্য সত্য ও সঠিক দ্বীন সহকারে তিনি আমাদের নিকট এসেছেন।

তারা আবার মারপিট করতো ও কিল-ঘুষি মারতো। তারপর জিজ্ঞেস করতোঃ

লাত ও উযযা সম্পর্কে তোমার বক্তব্য কি? বলতেনঃ ক্ষতি বা কল্যাণের কোন ক্ষমতা এ দু’টি বোবা-বধির মূর্তির নেই।

তারা আবার পাথর আগুনে গরম করে সেই পাথরের ওপর তাঁকে শুইয়ে দিত। খাব্বাব বলেনঃ একদিন তারা আমাকে ধরে নিয়ে গেল। তারা আগুন জ্বালিয়ে পাথর গরম করলো এবং সেই পাথরের উপর আমাকে শুইয়ে দিয়ে একজন তার একটি পা আমার বুকের ওপর উঠিয়ে ঠেসে ধরে রাখলো। (হায়াতুস, সাহাবা-১/২৯২) এভাবে তিনি শুয়ে থাকতেন, আর তাঁর দু’ কাধের চর্বি গলে বেয়ে পড়তো। ইমাম শা’বী বলেন, তাঁর পিঠের মাংস উঠে যেত।

তাঁর মনিব উম্মু আনমার তার ভাই সিবা অপেক্ষা হিংস্রতায় কোন অংশে কম ছিল না। একদিন নবী মুহাম্মাদকে (সা) খাব্বাবের দোখানে দাঁড়িয়ে তাঁর সাথে কথা বলতে দেখে সে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত হয়ে গেল। সে একদিন পর পর খাব্বাবের দোকানে আসতো এবং খাব্বাবের হাপরে লোহার পাত গরম করে তাঁর মাথায় ঠেসে ধরতো। তীব্র যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করতে করতে চেতনা হারিয়ে ফেলতেন।

একদিন যখন লোহা গরম করে খাব্বাবের মাথায় ঠেসে ধরা হচ্ছে, ঠিক সেই সময় ঐ পথ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) কোথাও যাচ্ছিলেন। খাব্বাবের এই অবস্থা দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। হৃদয় বিগলিত হয়ে গেল। কিন্তু তাঁর কী-ই বা করার ক্ষমতা ছিল? খাব্বাবের জন্য দু’আ ও তাঁকে কিছু সান্তনা দেওয়া ছাড়া তিনি আর কিছুই করতে পারলেন না। দু’হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে অত্যন্ত আবেগের সাথে বললেনঃ ‘আল্লাহুমা উনসুর খাব্বাবানা – হে আল্লাহ। খাব্বাবকে আপনি সাহায্য করুন।’ (রিজালুন হাওলার রাসূল-৩৩১)

উম্মু আনমারের প্রতি খাব্বাবের বদ-দু’আ আল্লাহ পাক কবুল করেছিলেন। তিনি স্বচক্ষে মক্কা থেকে মদীনায় হিজারাতের পূর্বেই তার ফল দেখতে পান। উম্মু আনমারের মাথায় অকস্মাৎ এমন যন্ত্রণা শুরু হয় যে, সে সব সময় কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। তার ছেলেরা চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে গেল। সব ডাক্তারই বললোঃ এ যন্ত্রণা নিরাময়ের কোন ঔষধ নেই। তবে লোহা আগুনে গরম করে মাথায় সেক দিলে একটু উপশম হতে পারে। লোহার পাত গরম করে তার মাথায় সেক দেওয়া শুরু হলো।

খলীফা হযরত উমারের (রা) খিলাফতকালে একদিন খাব্বাব গেলেন তাঁর কাছে। খলীফা অত্যধিক সমাদরের সাথে তাঁকে একটা উচু গদির ওপর বসিয়ে বললেনঃ একমাত্র বিলাল ছাড়া এই স্থানে বসার জন্য তোমার থেকে অধিকতর উপযুক্ত ব্যক্তি আর কেউ নেই। খাব্বাব বললেনঃ তিনি আমার সামান হতে পারে কেমন করে? মুশরিকদের মধ্যেও তাঁর অনেক সাহায্যকারী ছিল; কিন্তু এক আল্লাহ ছাড়া আমার প্রতি সমবেদনা জানানোর আর কেউ ছিল না। কুরাইশদের হাতে তিনি যে নির্যাতন ভোগ করেছিলেন, খলীফা তা জানতে চাইলেন। কিন্তু খাব্বাব তা জানাতে সংকোচ বোধ করলেন। খলীফার বার বার পীড়াপীড়িতে তিনি চাদর সরিয়ে নিজের পিঠটি আলগা করে দিলেন। খলীফা তাঁর পিঠের বীভৎস রূপ দেখে আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করেন; এ কেমন করে হলো?

খাব্বাব বললেনঃ পৌত্তলিকরা আগুন জ্বালালো। যখন তা অঙ্গারে পরিণত হলো, তারা আমার শরীরের কাপড় খুলে ফেললো। তারপর তারা আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে গিয়ে তার ওপর চিৎ করে শুইয়ে দিল। আমার পিঠের হাড় থেকে মাংস খসে পড়লো। আমার পিঠের গলিত চর্বিই সেই আগুন নিভিয়ে দেয়। এ ঘটনায় তাঁর পিঠের চামড়া শ্বেতী-রোগীর মত হয়ে গিয়েছিল। (হায়াতুস সাহাবা-১/২৯২, মুসতাদরিক, সীরাতু ইবন হিশাম, টীকা-১/৩৪৩)

দৈহিক নির্যাতনের সাথে সাথে কুরাইশরা তাঁকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ও উপহাস করতো। তাঁর পাওনা অর্থও তাঁরা আত্মসাৎ করে ফেলতো। ইবন ইসহাক বলেনঃ আস ইবন ওয়ায়িল আস-সাহমী নামক মক্কার এক কাফির তাঁর নিকট থেকে কিছু তরবারি খরিদ করে এবং এ বাবদ কিছু অর্থ তার কাছে বাকী থাকে। খাব্বাব পাওনা অর্থের তাগাদায় গেলেন। সে বললোঃ ওহে খাব্বাব, তোমাদের বন্ধু মুহাম্মাদ – যার দ্বীনের অনুসারী তুমি –সে কি এমন ধারণা পোষণ করেনা যে, জান্নাতের অধিবাসীরা স্বর্ণ, রৌপ্য, বস্ত্র অথবা চাকর-বাকর যা চাইবে লাভ করবে? খাব্বাব বললেনঃ হাঁ, করেন। সে বললোঃ খাব্বাব কিয়ামত পর্যন্ত একটু সময় দাও, আমি সেখানে গিয়ে তোমার পাওনা পরিশোধ করবো। আল্লাহর কসম, তোমার বন্ধু মুহাম্মাদ ও তুমি আমার থেকে আল্লাহর বেশী প্রিয়পাত্র নও। তোমরা আমার থেকে বেশী সৌভাগ্যও লাভ করতে পারবে না। এ ঘটনার পর আল্লাহ তা’আলা নিম্মোক্ত আয়াতগুলি নাযিল করেনঃ “তুমি কি লক্ষ্য করেছ সেই ব্যক্তিকে, যে আমার আয়াতসমুহ অস্বীকার করে এবং বলে, ‘আমাকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেওয়া হবেই। সে কি অদৃশ্য সম্বন্ধে অবহিত হয়েছে অথবা দয়াময়ের নিকট হতে কোন প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে? কক্ষণোই নয়, তারা যা বলে আমি তা লিখে রাখবো এবং তাদের শাস্তি বৃদ্ধি করতে থাকবো। আর সে যে বিষয়ের কথা বলে তা থাকবে আমার অধিকারে এবং সে আমার নিকট আসবে একাকী।” (সূরা মরিয়ামঃ ৭৭-৮০)

একদিন খাব্বাব তাঁর মত আরো কতিপয় নির্যাতিত বন্ধুর সাথে রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে হাজির হয়ে নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বললেন। খাব্বাব বলেনঃ আমরা যখন আমাদের কথা রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট বললাম, তখন তিনি একটি ডোরাকাটা চাদর মাথার নীচ দিয়ে কা’বার ছায়ায় শুয়ে ছিলেন। আমরা বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য ও ক্ষমা চাইবেন না?

আমাদের কথা শুনে রাসূলুল্লাহর (সা) চেহরা মুবারক লাল হয়ে গেল। তিনি ওঠে বসলেন। তারপর বললেনঃ “তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক লোককে ধরে গর্তে খুঁড়ে তার অর্ধাংশ পোতা হয়েছে, তারপর করাত দিয়ে মাথার মাঝখান থেকে ফেঁড়ে ফেলা হয়েছে। লোহার চিরুনী দিয়ে তাদের হাড় থেকে গোশত ছড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তবুও তাদের দ্বীন থেকে তারা বিন্দুমাত্র টলেনি। আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই এই দ্বীনকে পূর্ণতা দান করবেন। এমন একদিন আসবে যখন একজন পথিক ‘সান’আ’ থেকে ‘হাদরামাউত’ পর্যন্ত ভ্রমণ করবে। এই দীর্ঘ ভ্রমণে সে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয় করবে না। তখন নেকড়ে মেষপাল পাহারা দিবে। কিন্তু তোমরা বেশী অস্থির হয়ে পড়ছো’ (রিজালুন হাওলার রাসূল-২৩১, উসুদুল গাবা-২/৯৮)

খাব্বাব ও তাঁর বন্ধুরা মনোযোগ সহকারে রাসূলুল্লহর (সা) এ বাণী শুনলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যে পরিমাণ সবর ও কুরবাণী – ধৈর্য ও ত্যাগ পছন্দ করেন, তাঁরা তা করবেন। এভাবে তাঁদের ঈমান আরো মজবুত হয়ে যায়।

উম্মু আনমার খাব্বাবকে আযাদ করার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলতে থাকে। ইমাম শা’বী বলেন, ‘শত নির্যাতনের মুখেও খাব্বাব ধৈর্য ধারণ করেন। কাফিরদের অত্যাচারে তাঁর শিরদাঁড়া একটুও দুর্বল হয়ে পড়েনি।’ মক্কায় অবস্থানকালে তিনি তাঁর সবটুকু সময় ইবাদাত ও তাবলীগে দ্বীনের কাজে ব্যয় করতেন। মক্কায় তখনও যারা ভয়ে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করেনি, তিনি গোপনে তাদের বাড়ীতে যেয়ে যেয়ে কুরআন শিক্ষা দিতেন। হযরত উমারের (রা) বোন-ভগ্নিপতি ফাতিমা ও সা’ঈদকে তিনি গোপনে কুরআন শিক্ষা দিতেন। যেদিন হযরত রাসূলে কারীমকে হত্যার উদ্দেশ্যে উমার (রা) বের হলেন এবং পথে নু’য়াইম ইবন আবদিল্লাহর নিকট তাঁর বোন-ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের খবর শুনে তাদের বাড়ীতে উপস্থিত হলেন, সেদিন সেই সময় খাব্বাব (রা) তাদের কুরআন শিক্ষা দিচ্ছলেন। উমারের (রা) উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি ফাতিমার বাড়ীর এক কোণে আত্মগোপন করেন। অতঃপর উমারের (রা) মধ্যে কুরআন পাঠের পর ভাবান্তর সৃষ্টি হলে তিনি যখন বললেন, তোমরা আমাকে মুহাম্মাদের কাছে নিয়ে চল, তখন খাব্বাব গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি উমারকে (রা) বলেন, ওহে উমার, আমি আশা করি তোমার ব্যাপারে আল্লাহর নবীর দু’আ কবুল হয়েছে। গতকাল আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) দু’আ করতে শুনেছিঃ ‘হে আল্লাহ, তুমি আবুল হাকাম অথবা উমার ইবনুল খাত্তাব – এ দু’ ব্যক্তির কোন একজনের দ্বারা ইসলামকে সাহায্য কর।’ উমার বললেনঃ খাব্বাব মুহাম্মাদ এখন কোথায় আমাকে একটু বল। আমি তাঁর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে চাই। খাব্বাব বললেনঃ তিনি এখন সাফা পাহাড়ের নিকটে একটি বাড়ীতে তাঁর কিছু সংগীর সাথে অবস্থান করছেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩৪৩, ৩৪৫, হায়াতুস সাহাবা-১/২৯৭)

একদিন কুরাইশদের দুই নেতা আকরা ইবন হাবিস ও উ’য়াইনা ইবন আল-ফাযারী রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে দেখলো, তিনি আম্মার, সুহাইব, বিলাল, খাব্বাব প্রমুখ দাস ও দুর্বল মু’মিনদের সাথে বসে আছেন। নেতৃদ্বয় উপস্থিত সকলকে উপেক্ষা করে হযরত রাসূলে কারীমকে (সা) একটু দূরে ডেকে নিয়ে যেয়ে বললোঃ আরবের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি আপনার কাছে আসে। এই দাসদের সাথে আমরা এক সংগে বসি, তাদের একটু দূরে সরিয়ে দেবেন। রাসূল (সা) তাদের কথায় সায় দিলেন। তারা বললো, বিষয়টি তাহলে এখনই লেখাপড়া হয়ে যাক। রাসূল (সা) আলীকে ডেকে কাগজ-কলম আনালেন। খাব্বাব বলেনঃ আমরা তখন একটু দূরে বসে আছি। এমন সময় জিবরীল (আ) এ আয়াতগুলি নিয়ে হাজির হলেনঃ “যারা তাদের প্রতিপালককে সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ডাকে তাদের তুমি দূরে সরিয়ে দিওনা। তাদের কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তোমার নয় যে, তুমি তাদের বিতাড়িত করবে। আর তা করলে তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (সূরা আল আনআমঃ ৫২-৫৩)

খাব্বাব বলেন, উপরোক্ত আয়াত নাযিলের সাথে সাথে হযরত রাসূলে কারীম (সা) কাগজ-কলম ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমাদেরকে কাছে ডাকলেন। আমরা কাছে গেলে তিনি আমাদের সালাম জানালেন। আমরা রাসূলুল্লাহর (সা) হাঁটুর সাথে হাঁটু মিলিয়ে বসলাম। আর তক্ষুণি আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেনঃ

“তুমি নিজেকে ধৈর্যশীল রাখবে তাদের সাথে যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে আহবান করে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এবং তুমি পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করে তাদের দিক হতে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিওয়া।” (সূরা কাহাফ-২৮)

খাব্বাব বলেন, এর পর থেকে আমরা যখনই রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে বসতাম, আমরা না ওঠা পযর্ন্ত তিনি উঠতেন না। (হায়াতুস সাহাবা-২/৪৭৫)

খাব্বাব দীর্ঘকাল মক্কার কুরাইশদের সীমাহীন নির্যাতন ধৈর্যের সাথে সহ্য করে মক্কার মাটি আঁকড়ে থাকেন। অবশেষে আল্লাহ পাক হিজরাতের অনুমতি দান করেন এবং তিনি মদীনায় হিজরাত করেন। অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য নয়; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রিজামন্দী-লাভের উদ্দেশ্যেই তিনি হিজরাত করেছেন। তিনি বলতেন, আমি কেবল আল্লাহর জন্যই রসূলুল্লাহর সাথে হিজরাত করেছি। মদীনায় আসার পর হযরত রাসূলে কারীম (সা) হযরত খিরাশ ইবন সাম্মার সাথে মতান্তরে জিবর ইবন উতাইকের সাথে তাঁর মুওয়াখাত বা দ্বীনী-ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন। (উসুদুল গাবা-২/৯৯)

মদীনায় আসার পর হযরত খাব্বাবের জীবনে একটু শাস্তি ও নিরাপত্তা দেখা দেয়। যে শাস্তি ও নিরাপত্তা থেকে তিনি আজম্ম বঞ্চিত ছিলেন। এখানে তিনি রাসূলে কারীমের একান্ত সান্নিধ্যে লাভের সুযোগ পান। বদর ও উহুদসহ সকল যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে যোগ দেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি উম্মু আনমারের ভাই সিবা’র পরিণতি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। এদিন সে হযরত হামযার (রা) হাতে নিহত হয়।

হযরত খাব্বাবের (রা) সারাটি জীবন দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েছে। ইসলাম-পূর্ব ও ইসলাম-পরবর্তী কিছুকাল তরবারি নির্মাণ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। জীবনের শেষ ভাগে তাঁর যথেষ্ট সচ্ছলতা আসে। খলীফা হযরত উমার ও হযরত উসমানের খিলাফতকালে যখন সকল সাহাবীর নিজ নিজ মর্যাদা অনুসারে ভাতা নির্ধারিত হয়, হযরত খাব্বাব তখন থেকে মোটা অংকের ভাতা লাভ করেন। তখন প্রচুর অর্থ তাঁর হাতে জমা হয়ে যায়। তবে সেই অর্থের সাথে তাঁর আচরণ ছিল ব্যতুক্রমধর্মী। তিনি তাঁর দিরহাম ও দীনারসমুহ একটি উম্মুক্ত স্থানে রেখে দেন। অভাবগ্রস্ত ও ফকীর মিসকীনরা সেখান থেকে ইচ্ছামত নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে নিয়ে যেত। এজন্য কোন অনুমতির প্রয়োজন হতো না। এতকিছু সত্বেও এ চিন্তা করে তিনি সব সময় ভীত ছিলেন যে, হয়তো আল্লাহ তাঁর এ সম্পদের হিসাব চাইবেন এবং এ জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে।

তাঁর সংগী-সাথীদের একটি দল বলেনঃ “ আমরা খাব্বাবের অন্তিম রোগ শয্যায় তাঁকে দেখতে গেলাম। তিনি তাঁর জরাজীর্ণ ঘরের একদিকে ঈঙ্গিত করে আমাদের বললেনঃ এই স্থানে আশি হাজার দিরহাম আছে। আল্লাহর কসম, কক্ষণো স্থানটির মুখ বন্ধ করিনি এবং কোন সায়েলকেও তা থেকে গ্রহণ করতে নিষেধ করিনি। একথা বলে তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বন্ধুরা তাঁকে বললেনঃ আপনি কাঁদছেন কেন? বললেনঃ আমার সঙ্গীরা দুনিয়াতে তাদের কাজের কোন প্রতিদান না নিয়ে চলে গেছে। আমি বেঁচে আছি এবং এত সম্পদের মালিক হয়েছি। আমার ভয় হয়, এই সম্পদ আমার সৎকাজের প্রতিদান কিনা। আর এজন্য আমি অস্থির হয়ে কাঁদি। তারপর তাঁর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো, যখন তিনি নিজের জন্য ক্রয় করা দামী কাফনের দিকে ইঙ্গিত করে একথাগুলি বললেনঃ তোমরা দেখ, এই আমর কাফনের কাপড়। কিন্তু রাসূলুল্লাহর (সা) চাচা হযরত হামযা উহুদে শাহাদাত বরণ করলে তাঁর কাফনের জন্য একটি চাদর ছাড়া আর কোন কাপড় পাওয়া গেল না। সেই চাদর দিয়ে তার মাথা ঢাকলে পা এবং পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে পড়ছিল।”

হিজরী ৩৭ সনে তিনি কূফায় রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। চিকিৎসা সত্বেও রোগ দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। দীর্ঘদিন রোগ যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকেন। এ অবস্থায় তিনি মাঝে মাঝে বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) যদি মৃত্যু কামনা করতে নিষেধ না করতেন তাহলে আমি মৃত্যুর জন্য দু’আ করতাম। (আল-ইসাবা-১/৪১৬, উসদুল গাবা-২/৯৯) তাঁর মৃত্যুর সন, স্থান ও মৃত্যুকালে বয়স সম্পর্কে সীরাত লেখকদের মধ্যে মতভেদ আছে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী হিজরী ৩৯ সনে সিফফীন যুদ্ধের পর ৭২ বছর বয়সে কূফায় ইনতিকাল করেন। অসুস্থতার কারণে সিফফীন যুদ্ধে যোগদান করতে পারেননি। হযরত আলী (রা) সিফফীন যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পান এবং তিনিই নামাযে জানাযার ইমামতি করেন। কূফাবাসীরা সাধারণতঃ শহরের ভেতরেই মৃতদের দাফন করতো। মৃত্যুর পূর্বে হযরত খাব্বাব অসিয়াত করে যান, তাঁকে যেন শহরের বাইরে দাফন করা হয়। তাঁর অসিয়াত মুতাবিক তাঁকে কূফা শহরের বাইরে দাফন করা হয়। কূফা শহরের বাইরে দাফনকৃত প্রথম সাহাবী তিনি। (উসুদুল গাবা-২/১০০)

হযরত খাব্বাবকে দাফন করার পর আমীরুল মুমিনীন আলী (রা) তাঁর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেছিলেনঃ “আল্লাহ খাব্বাবের ওপর রহম করুন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন ব্যাকুলভাবে, হিজরাত করেন অনুগত হয়ে এবং জীবন অতিবাহিত করেন মুজাহিদ রূপে। যারা সৎকাজ করে আল্লাহ তাদের ব্যর্থ করেন না।”

হযরত খাব্বাবের মধ্যে রাসূলুল্লাহর (সা) কথা ও কাজ জানার প্রবল ঔৎসুক্য ছিল। কখনও কখনও রাসূলুল্লাহর (সা) অজ্ঞাতসারে রাত জেগে জেগে তাঁর ইবাদাতের কায়দা-কানুন দেখতেন এবং সকাল বেলা সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। একবার রাসূল (সা) সারারাত নামায পড়লেন, আর তিনি চুপিসারে তা দেখলেন। সকালে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার মাতা-পিতা আপনার প্রতি কুরবান হোক। গত রাতে আপনি এমন নামায পড়েছেন যা এর আগে আর কখনও পড়েননি। তিনি বলেলনঃ হাঁ, এটা ছিল আশা ও ভীতির নামায, আমি আল্লাহর কাছে তিনটি জিনিস চেয়েছিলাম, দু’টি দান করেছেন; কিন্তু একটি দেননি। একটি ছিল, আল্লাহ যেন আমার উম্মাতের দুর্ভিক্ষের দ্বারা ধ্বংস না করেন। এটা কবুল করেছেন। আরেকটি ছিল, বিজাতীয় কোন শত্রুকে যেন আমার উম্মাতের উপর বিজয়ী না করেন। এটাও আল্লাহ কবুল করেছেন। তৃতীয়টি ছিল, আমার উম্মাতের একদলের হাতে অন্যদল যেন নিষ্ঠুরতার শিকার না হয়। এটা কবুল হয়নি। (উসুদুল গাবা-২/৯৯)

তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) তেত্রিশটি (৩৩) হাদীস বর্ণনা করেছেন। তম্মধ্যে তিনটি মুত্তাফাক আলাইহি, দু’টি বুখারী ও একটি মুসলিম এককভেবে বর্ণনা করেছেন। সাহাবা ও তাবেঈদের মধ্যে যে সকল উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্য তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁরা হলেনঃ তাঁর পুত্র আবদুল্লাহ, আবু উমামা বাহিলী, আবু মা’মার, আবদুল্লাহ ইবন শুখাইর, কায়েস ইবন আবী হাযেম, মাসরূক ইবন আজাদা, আলকামা ইবন কায়েস প্রমুখ।

হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাতের কন্যা বর্ণনা করেছেন। আমার আব্বা একবার জিহাদে চলে গেলেন। বিদায় বেলা আমাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য একটি মাত্র ছাগী রেখে বলে গেলেনঃ ছাগীটির দুধ দোহনের প্রয়োজন হলে আহলুস সুফফার কাছে নিয়ে যাবে। আমরা ছাগীটি তাদের কাছে নিয়ে গেলাম। আমরা সেখানে রাসূলকে (সা) বসা দেখলাম। তিনি ছাগীটি বেঁধে দুইলেন। তিনি বললেনঃ তোমাদের ঘরের সবচেয়ে বড় পাত্রটি আমার কাছে নিয়ে এস। আমি আটা মাখার পাত্রটি নিয়ে এলাম। তিনি তাতে দুধ দুইলেন এবং তা ভরে গেল। তিনি দুধ ভরা পাত্রটি আমাদের হাতে দিয়ে বললেনঃ নিয়ে যাও, নিজেরা পান করবে, পাড়া-প্রতিবেশীদেরও দেবে। আর যখনই প্রয়োজন হয় ছাগীটি আমার কাছে এনে দুইয়ে নিয়ে যাবে। আমরা প্রায়ই ছাগীটি রাসূলুল্লাহর (সা) হাত দ্বারা দুইয়ে নিয়ে আসতাম। আমার আব্বা জিহাদ থেকে ফিরে এলেন। তিনি যখনই ছাগীটি দুইতে গেলেন, দুধ বন্ধ হয়ে গেল। আমার আম্মা বললেনঃ তুমি ছাগীটি নষ্ট করে দিলে আগে আমরা এই পাত্র ভরে দুধ পেতাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ কে দুইতো? আম্মা বললেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা)। তিনি বললেনঃ তুমি কি আমাকে তাঁর সমকক্ষ মনে করলে? তাঁর চেয়ে বেশী বরকত বিশিষ্ট হাত আর কার আছে? (হায়াতুস সাহাবা-৩/৬৩৭)