সাঈদ ইবন যায়িদ (রাঃ)

নাম সাঈদ, কুনিয়াত আবুল আ’ওয়ার। পিতা যায়িদ, মাতা ফাতিমা বিন্‌তু বা’জা। উর্ধপুরুষ কা’ব ইবন লুই-এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর সা. নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে।

সাঈদের পিতা যায়িদ ছিলেন জাহিলী যুগের মক্কার মুষ্টিমেয় সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের একজন যাঁরা ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেই শিরক ও পৌত্তলিকতা থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখেন, সব রকম পাপাচার ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকেন। এমন কি মুশরিকদের হাতে যবেহ করা জন্তুর গোশ্‌তও পরিহার করতেন। একবার নবুওয়াত প্রকাশের পূর্বে ‘বালদাহ’ উপত্যকায় রাসূলুল্লাহর সা. সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। রাসূলুল্লাহর সা. সামনে খাবার আনা হলে তিনি খেতে অস্বীকৃতি জানান। যায়িদকে খাওয়ার অনুরোধ করা হলে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়ে তাদেরকে বলেনঃ ‘তোমাদের দেব-দেবীর নামে যবেহকৃত পশুর গোশ্‌ত আমি খাইনে।’

হযরত আসমা রা. বলেনঃ একবার আমি যায়িদকে দেখলাম, তিনি কা’বার গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে বলছেন, ওহে কুরাইশ বংশের লোকেরা আল্লাহর কসম, আমি ছাড়া দ্বীনে হানীফের ওপর তোমাদের মধ্যে আর কেউ নেই।

জাহিলী যুগে সাধারণতঃ কন্যা সন্তান জীবন্ত দাফন করা হতো। কোথাও কোন কন্যা সন্তান হত্যা বা দাফন করা হচ্ছে শুনতে পেলে যায়িদ তার অভিভাবকের কাছে চলে যেতেন এবং সন্তানটিকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে নিতেন। তারপর সে বড় হলে তার পিতার কাছে নিয়ে গিয়ে বলতেন, ইচ্ছে করলে এখন তুমি নিজ দায়িত্বে নিতে পার অথবা আমার দায়িত্বে ছেড়ে দিতে পার।

কুরাইশরা তাদের কোন একটি উৎসব পালন করছে। মানুষের ভিড় থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে যায়িদ ইবন আমর ইবন নুফায়িল তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি দেখছে পুরুষেরা তাদের মাথায় বেঁধেছে দামী রেশমী পাগড়ী, গায়ে জড়িয়েছে মূল্যবান ইয়ামনী চাদর। আর নারী ও শিশুরা পরেছে মূল্যবান সাজে সুসজ্জিত করে হাঁকিয়ে নিয়ে চলেছে তাদের দেব-দেবীর সামনে বলি দেওয়ার জন্য।

তিনি কা’বার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর বলরেনঃ

‘কুরাইশ গোত্রের লোকেরা! এই ছাগলগুলি সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তায়ালা। তিনিই আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে তাদের পান করান, যমীনে ঘাস সৃষ্টি করে তাদের আহার দান করেন। আর তোমরা অন্যের নামে সেগুলি যবেহ কর? আমি তোমাদেরকে একটি মূর্খ সম্প্রদায়রূপে দেখতে পাচ্ছি।

এ কথা শুনে তাঁর চাচা ও উমার ইবনুল খাত্তাবের পিতা আল খাত্তাব উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলল-

তোর সর্বনাশ হোক! সব সময় আমরা তোর মুখ থেকে এ ধরণের বাজে কথা শুনে সহ্য করে আসছি। এখন আমাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে। তারপর তার গো্ত্রের বোকা লেকাদের উত্তেজিত করে তুলল তাঁকে কষ্ট দিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত করে তুলতে। অবশেষে তিনি বাধ্য হলেন মক্কা ছেড়ে হিরা পর্বতে আশ্রয় নিতে। তাতেও সে ক্ষান্ত হল না। গোপনেও যাতে তিনি মক্কায় প্রবেশ করতে না পারেন, সেদিকে সর্বক্ষণ দৃষ্টি রাখার জন্য একদল কুরাইশ যুবককে সে নিয়োগ করে রাখে।

অতঃপর যায়িদ ইবন আমর কুরাইশদের অগোচরে ওয়ারাকা ইবন নাওফিল, আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ, উসমান ইবনুল হারিস এবং মুহাম্মদ ইবন আবদিল্লাহর ফুফু উমাইমা বিনতু ’আবদিল মুত্তালিবের সাথে গোপনে মিলিত হলেন। আরববাসী যে চরম গুমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত সে ব্যাপারে তিনি তাদের সাথে মত বিনিময় করলেন যায়িদ তাঁদেরকে বললেনঃ

‘আল্লাহর কসম আপনার নিয়মিতভাবে জেনে রাখুন, আপনাদের এ জাতি কোন ভিত্তির ওপর নেই। তারা দ্বীনে ইবরাহীমকে বিকৃত করে ফেলেছে তার বিরুদ্ধাচরণ করে চলছে। আপনারা যদি মুক্তি চান, নিজেদের জন্য একটি দ্বীন অনুসন্ধান করুন।’

অতঃপর এ চার ব্যক্তি ইয়াহুদী, নাসারা ও অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুদের নিকট গেলেন দ্বীনে ইবরাহীম তথা দ্বীনে হানীফ সম্পর্কে জানার জন্য। ওয়ারাকা ইবন নাওফিল খৃস্ট ধর্ম অবলম্বন করলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ উসমান ইবনুল হারিস কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারলেন না। আর যায়িদ ইবন ’আমর ইবন নুফায়িলের জীবনে ঘটে গেল এক চমকপ্রদ ঘটনা। আমরা সে ঘটনা তাঁর জবানেই পেশ করছি।

‘আমি ইয়াহুদী ও খৃষ্টধর্ম সম্পর্কে অবগত হলাম; কিন্তু সে ধর্মে মানসিক শান্তি পাওয়ার মত তেমন কিছু না পেয়ে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। এক পর্যায়ে আমি শামে (সিরিয়া) এসে উপস্থিত হলাম। আমি আগেই শুনেছিলাম সেখানে একজন রাহিব’ ‘সংসারত্যাগী ব্যক্তি আছেন, যিনি আসমানী কিতাবে অভিজ্ঞ। আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে আমার কাহিনী বিবৃত করলাম। আমার কথা শুনে তিনি বললেন- ’ওহে মক্কাবাসী ভাই, আমার মনে হচ্ছে আপনি দ্বীনে ইবরাহীম অনুসন্ধান করছেন।’

বললাম ‘হ্যাঁ আমি তাই অনুসন্ধান করছি।’

তিনি বললেনঃ ‘আপনি যে দ্বীনের সন্ধান করছেন, আজকের দিনেতো তা পাওয়া যায়না। তবে সত্য তো আপনার শহরে। আপনার আপনার কওমের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তি পাঠাবেন যিনি দ্বীনে ইবরাহীম পুনরুজ্জীবিত করবেন। আপনি যদি তাকে পান তাঁর অনুসরণ করবেন।’

যায়িদ আবার মক্কার দিকে যাত্রা শুরু করলেন। প্রতিশ্রুত নবীকে খুঁজে বের করার জন্য দ্রুত পা চালালেন।

তিনি যখন মক্কা থেকে বেশ কিছু দূরে, তখনই আল্লাহ তা’য়ালা নবী মুহাম্মাদকে সা. হিদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠালেন। কিন্তু যায়িদ তাঁর সাক্ষাৎ পেলেন না। কারণ, মক্কায় পৌঁছার পূর্বেই একদল বেদুঈন ডাকাত তাঁর উপর চড়াও হয়ে তাঁকে হত্যা করে।

এভাবে তিনি রাসূলুল্লাহর সা. দর্শন লাভের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’আ করেন-

আল্লাহুম্মা ইন কুনতা হারামতানি মিন হাজাল ‍খায়রি ফালা তাহরিম মিনহু ইবনী সাঈদান’- ‘হে আল্লাহ, যদিও এ কল্যাণ থেকে আমাকে বঞ্চিত করলেন, আমার পুত্র সাঈদকে তা থেকে আপনি মাহরুম করবেন না।’

আল্লাহ তা’আলা যায়িদের এ দু’আ কুবল করেছিলেন। রাসূল সা. লোকদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন। প্রথম ভাগেই যাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সা. ওপর ঈমান আনলেন তাঁদের মধ্যে সাঈদও একজন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ, সাঈদ প্রতিপালিত হয়েছিলেন এমন এক গৃহে, যে গৃহ ঘৃণাভরে প্রতিবাদ ও প্রত্যাখ্যান করেছিল কুরাইশদের সকল কুসংস্কার ও গুমরাহীকে। তাঁর পিতা ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি তাঁর সারাটি জীবন অতিবাহিতত করেছিলেন সত্যের সন্ধানে। সাঈদ একাই ইসলাম গ্রহণ করেননি, সাথে তাঁর সহধর্মিনী উমার ইবনুল খাত্তাবের বোন ফাতিমা বিনতুল খাত্তাবও ইসলাম গ্রহণ করেন।

ইসলাম গ্রহণের কারণে কুরাইশ বংশের এ যুবকও অন্যদের মত যুলুম অত্যাচারের শিকার হন। কুরাইশরা তাঁকে ইসলাম থেকে ফেরানো দূরে থাক, তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে বরং কুরাইশদের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ছিনিয়ে নিয়ে এলেন ইসলামের মধ্যে। তিনি হলেন তাঁর শ্যালক হযরত ’উমার ইবনুল খাত্তাব রা.। তাঁদের মাধমেই আল্লাহ তা’আলা ‘উমারকে ইসলামের মধ্যে নিয়ে আসেন।

হযরত সাঈদ তার যৌবনের সকল শক্তি ব্যয় করেন ইসলামের খিদমতে। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তাঁর বয়স বিশ বছরও অতিক্রম করেনি। একমাত্র বদর যুদ্ধ ছাড়া রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অন্য সব যুদ্ধেই তিনি অংশগ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহর সা. নির্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে সিরিয়ায় থাকার কারণে তিনি বদর যুদ্ধে যোগদান করতে পারেননি। তবে বদর যুদ্ধের গণিমতের অংশ তিনি লাভ করেছিলেন। এ হিসাবে তিনি প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে বদর বাহিনীর সদস্য ছিলেন।

পারস্যের কিসরা ও রোমের কাইসারের সিংহাসন পদানত করার ব্যাপারে তিনি মুসলিম সৈন্য বাহিনীর সাথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মুসলিমদের সাথে তাঁদের যতগুলি যুদ্ধ সংঘটিত হয় তার প্রত্যেকটিতে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ইয়ারমুক যুদ্ধেই তিনি তাঁর বীরত্বের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। তিনি নিজেই বর্ণনা করেন,

‘‘ইয়ারমুকের যুদ্ধে আমরা ছিলাম ছাব্বিশ হাজার বা তার কাছাকাছি। অন্যদিকে রোমান বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল এক লাখ বিশ হাজার। তারা অত্যন্ত দৃঢ় পদক্ষেপে পর্বতের মত অটল ভংগিতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। তাদের অগ্রভাগে বিশপ ও পাদ্রী-পুরোহিতদের বিরাট এক দল। হাতে তাদের ক্রুশ খচিত পতাকা, মুখে প্রার্থনা সংগীত। পেছন থেকে তাদের সুরে সুর মিলাচ্ছিল বিশাল সেনাবাহিনী। তাদের সেই সম্মিলিত কণ্ঠস্বর তখন মেঘের গর্জনের মত ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছিল।

মুসলিম বাহিনী এ ভয়াবহ দৃশ্য ও তাদের বিপুল সংখ্যা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ভয়ে তাদের অন্তরও কিছুটা কেঁপে উঠলো, সেনাপতি আবু উবাইদা তখন উঠে দাঁড়ালেন এবং মুসলিম সৈন্যদের জিহাদে অনুপ্রাণিত করে এক ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর বান্দারা। আল্লাহকে সাহায্য কর, তিনিও তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের পা’কে দৃঢ় করবেন।

আল্লাহর বান্দারা! ধৈর্য ধারণ কর। ধৈর্য হল কুফরী থেকে মুক্তির পথ, প্রভুর রিজামন্দী হাসিলের পথ এবং অপমান ও লজ্জার প্রতিরোধ। তোমরা তীর বর্শা শানিত করে ঢাল হাতে প্রস্তুত হয়ে যাও। অন্তরে আল্লাহর যিকর ছাড়া অন্য সব চিন্তা থেকে বিরত থাক। সময় হলে আমি তোমাদের নির্দেশ দেব ইনশাআল্লাহ।’’

সাঈদ রা. বলেন,

তখন মুসলিম বাহিনীর ভেতর থেকে এক ব্যক্তি বেরিয়ে এসে আবু ’উবাইদাকে বলল,

‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ মুহূর্তে আমি আমার জীবন কুরবানী করব। রাসূলুল্লাহর সা. কাছে পৌঁছে দিতে হবে এমন কোন বাণী কি আপনার কাছে?’ আবু উবাইদা বললেন
‘হ্যাঁ, আছে। তাঁকে আমার ও মুসলিমদের সালাম পৌঁছে দিয়ে বলবেঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের রব আমাদের সাথে যে অংগীকার করেছেন, তা আমরা সত্যই পেয়েছি।’

সাঈদ রা. বলেন,

‘‘আমি তাঁর কথা শুনা মাত্রই দেখতে পেলাম সে তার তরবারি কোষমুক্ত করে আল্লাহর শত্রুদের সাথে সংঘর্ষের জন্য অগ্রসর হচ্ছে। এ অবস্থায় আমি দ্রুত মাটিতে লাফিয়ে পড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে অগ্রসর হলাম এবং আমার বর্শা হাতে প্রস্তুত হয়ে গেলাম। শত্রুপক্ষের প্রথম যে ঘোড় সওয়ার আমাদের দিকে এগিয়ে এলো আমি তাকে আঘাত করলাম। তারপর অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে শত্রু বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আল্লাহ তা’আলা আমার অন্তর থেকে সকল প্রকার ভয়ভীতি একেবারেই দূর করে দিলেন। অতঃপর মুসলিম বাহিনী রোমান বাহিনীর ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালাল এবং তাদেরকে পরাজিত করল।’’

দিমাশ্‌ক অভিযানেও সাঈদ ইবন যায়িদ অংশগ্রহণ করেন। দিমাশক জয়ের পর আবু ’উবাইদা তাঁকে সেখানকার ওয়ালী নিযুক্ত করেন। এভাবে তিনি হলেন দিমাশকের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম ওয়ালী। কিন্তু জিহাদের প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে এ পদ লাভ করে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি আবু উবাইদাকে লিখলেনঃ ‘আপনারা জিহাদ করবেন, আর আমি বঞ্চিত হবো, এমন আত্মত্যাগ ও কুরবানী আমি করতে পারিনে।’ চিঠি পৌঁছার সাথে সাথে কাউকে আমার স্থলে পাঠিয়ে দিন। আমি শিগ্‌গিরই আপনার নিকট পৌঁছে যাচ্ছি। আবু উবাইদা বাধ্য হয়ে হযরত ইয়াযিদ ইবন আবু সুফিয়ানকে দিমাশকের ওয়ালী নিযুক্ত করলেন এবং হযরত সাঈদ জিহাদের ময়দানে ফিরে গেলেন।

উমাইয়া যুগে হযরত সাঈদ ইবন যায়িদকে কেন্দ্র করে এক আশ্চর্যময় ঘটনা ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে মদীনাবাসীদের মুখে ঘটনাটি শোনা যেত।

ঘটনাটি হল, আরওয়া বিন্‌তু উওয়াইস নাম্নী এক মহিলা দুর্নাম রটাতে থাকে যে সাঈদ ইবন যায়িদ তার জমির একাংশ জরবদখল করে নিজ জমির সাথে মিলিয়ে নিয়েছেন। যেখানে সেখানে সে একথা বলে বেড়াতে লাগল। এক পর্যায়ে সে মদীনার ওয়ালী মারওয়ান ইবনুল হিকামের নিকট বিষয়টি উত্থাপন করল। বিষয়টি যাচাই করে দেখার জন্য মারওয়ান কয়েকজন লোককে সাঈদের নিকট পাঠালেন। রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী হযরত সাঈদের জন্য বিষয়টি ছিল বেশ কষ্টদায়ক। তিনি বললেনঃ

‘‘তারা মনে করে আমি তার ওপর যুল্‌ম করছি। কিভাবে আমি যুল্‌ম করতে পারি? আমি তো রাসূলুল্লাহকে সা. বলতে শুনেছিঃ ‘যে ব্যক্তি এক বিঘত পরিমাণ জমি যুল্‌ম করে নেবে, কিয়ামতের দিন সাত তবকা যমীন তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে।’ ইয়া আল্লাহ! সে ধারণা করেছে অমি তার ওপর যুল্‌ম করেছি। যদি সে মিথ্যুক হয়, তার চোখ অন্ধ করে দাও, যে কূপ নিয়ে সে আমার সাথে ঝগড়া করেছে, তার মধ্যেই তাকে নিক্ষেপ কর এবং আমার পক্ষে এমন আলোক প্রকাশ করে দাও যাতে মুসলিমদের মাঝে স্পষ্ট হংয়ে যায় যে আমি তার ওপর কোন যুল্‌ম করিনি।’’

এ ঘটনার পর কিছু দিন যেতে না যেতেই আকীক উপত্যকা এমনভাবে প্লাবিত হল যে অতীতে আর কখনো তেমন হয়নি। ফলে দু’যমীনের মাঝখানে বিতর্কিত অদৃশ্য চিহ্নটি এমনভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ল যে, মুসলিমরা তা দেখে বুঝতে পারল সাঈদ সত্যবাদী। তারপর একমাস না যেতেই মহিলাটি অন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় একদিন সে তার যমীনে পায়চারী করতে করতে বিতর্কিত কূপটির মধ্যে পড়ে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে।

আবদুল্লাহ ইবন ’উমার রা. বলেন,

‘আমরা শুনতাম লোকেরা কাউকে অভিশাপ দিতে গেলে বলতঃ আল্লাহ তোমাকে অন্ধ করুন যেমন অন্ধ করেছেন আরওয়াকে। এ ঘটনায় অবাক হওয়ার তেমন কিছু নেই, কারণ রাসূল সা. তো বলেছেনঃ

‘তোমরা মাযলুমের দু’আ থেকে দূরে থাক। কারণ, সেই দু’আ আর আল্লাহর মাঝে কোন প্রতিবন্ধক থাকে না।’ এই যদি হয় সব মাযলুমের অবস্থা, তাহলে ‘আশারায়ে মুবাশ্‌শারাহ’ জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশ জনের একজন সাঈদ ইবন যায়িদের মত মাযলুমের দু’আ কবুল হওয়া তেমন আর আশ্চর্য কি?

আবু নুয়াঈম, বিরাহ ইবনুল হারিস থেকে বর্ণনা করেছেনঃ মুগীরা ইবন শু’বা একটি বড় মসজিদে বসে ছিলেন। তখন তাঁর ডানে বাঁয়ে বসা ছিল কুফার কিছু লোক। এমন সময় সাঈদ ইবন যায়িদ নামক এক ব্যক্তি এলেন। মুগীরা তাকে সালাম করে খাটের ওপর পায়ের দিকে বসালেন। অতঃপর কুফাবাসী এক ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে মুগীরার দিকে মুখ করে গালি বর্ষণ করতে লাগল। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ মুগীরা, এ লোকটি কার প্রতি গালি বর্ষণ করছে? বললেনঃ আলী ইবন আবী তালিবের প্রতি। তিনি বললেনঃ ওহে মুগীরা! এভাবে তিনবার ডাকলেন। তারপর বললেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবীদের আপনারা সামনে গালি দেওয়া হবে, আর আপনি তার প্রতিবাদ করবেন না, এ আমি দেখতে চাইনা। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, রাসূল সা. বলেছেনঃ আবু বকর জান্নাতী, ’উমার জান্নাতী, ’উসমান জান্নাতী, ’আলী জান্নাতী, তালহা জান্নাতী, যুবাইর জান্নাতী, আবদুর রহমান জান্নাতী, সা’দ ইবন মালিক জান্নাতী। এবং নবম এক ব্যক্তিও জান্নাতী, তোমরা চাইলে আমি তার নামটিও বলতে পারি। রাবী বলেনঃ লোকেরা সমস্বরে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলঃ হে রাসূলুল্লাহর সা. সাহাবী, নবম ব্যক্তিটি কে? বললেনঃ নবম ব্যক্তিটি আমি। তারপর তিনি কসম করে বললেনঃ যে ব্যক্তি একটি মাত্র যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর সা. সাথে অংশগ্রহণ করেছে, রাসূলুল্লাহর সাথে তার মুখমণ্ডল ধূলি ধূসরিত হয়েছে, তার এই একটি কাজ যে কোন ব্যক্তির জীবনের সকল সৎকর্ম অপেক্ষা উত্তম- যদিও সে নূহের সমান বয়সই লাভ করুক না কেন। (হায়াতুস সাহাবা/ ২য়- ৪৭০ পৃঃ)

তিনি ছিলেন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবীদের অন্যতম। সাঈদ ইবন হাবীব বলেনঃ রাসূলুল্লাহর সা. নিকট আবু বকর, ’উমার, উসমান, আলী, সা’দ, সাঈদ, তালহা, যুবাইর ও আবদুর রহমান ইবনে আওফের স্থান ও ভূমিকা ছিল একই। যুদ্ধের ময়দানে তাঁরা থাকতেন রাসূলুল্লাহর সা. আগে এবং নামাযের জামায়াতে থাকতেন তাঁর পেছনে।

সাঈদ ইবন যায়িদের নিকট থেকে সাহাবীদের মধ্যে ইবন ’উমার, ’আমর ইবন হুরাইস, আবু আত্‌তুফাইল এবং আবু উসমান আন-নাহদী, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, কায়েস ইবন আবী হাযেম প্রমুখ প্রখ্যাত তাবেয়ীগণও হাদীস বর্ণনা করেছেন।

ওয়াকিদী বলেনঃ তিনি আকীক উপত্যকায় ইনতিকাল করেন এবং মদীনায় সমাহিত হন। মৃত্যুসন হিজরী ৫০। মতান্তরে হিজরী ৫১ অথবা ৫২। সত্তর বছরের ওপর তিনি জীবন লাভ করেন। হযরত সা’দ ইবন আবী ওয়াক্‌কাস তাঁকে গোসল দিয়ে কাফন পরান এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবন ’উমার নামাযে জানাযার ইমামতি করেন। তবে হাইসাম ইবন ’আদীর মতে তিনি কুফায় ইনতিকাল করেন এবং প্রখ্যাত সাহাবী হযরত মুগীরা ইবন ‍শু’বা তাঁর জানাযার ইমামতি করেন।