বাবাক খুররামি : নৃশংস এক অপরাধীর উপাখ্যান

সামাররা (১), ইরাক। ২২৩ হিজরি। ৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ। খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ তাকিয়ে আছেন বন্দির দিকে। বন্দির হাত পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে। মধ্যবয়সী লোকটির চেহারায় এখনো ভয়ের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। বন্দি সুঠামদেহী, সুদর্শন। খলিফা একটু আনমনা হয়ে গেলেন। প্রায় ২০ বছর ধরে চলা লড়াইয়ের শেষ হতে চলেছে। খলিফা মামুন যা সমাপ্ত করতে পারেননি, অবশেষে এখন তা সমাপ্তির মুখ দেখবে।

‘তার হাত পা কেটে দেও’ গম্ভীর স্বরে বললেন খলিফা। জল্লাদ নুদ আদেশের অপেক্ষায় ছিল। সে এগিয়ে এসে বন্দির হাত কেটে ফেললো। বন্দি দ্রুত হাতের অক্ষত অংশ চেহারায় ডলতে লাগলো। পুরো চেহারা রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল।

‘এমন করছো কেন?’ জল্লাদ জিজ্ঞেস করলো।

‘আমি চাই না আমার চেহারা ফ্যাকাসে হোক আর তোমরা তা দেখে ফেলো’ বন্দি শান্তকন্ঠে বললো।

জল্লাদ এবার বন্দির দুই পা কেটে ফেললো। বন্দি মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। পুরো শরির থেকে রক্ত ঝরছে। কিন্তু তার মুখ থেকে সামান্য আহ শব্দও বের হল না। জল্লাদ এবার তার মাথা কেটে ফেললো।

‘তার মাথা খোরাসানে পাঠিয়ে দাও। সেখানকার লোকজনকে দেখাও। আর শরির সামাররার সেনা শিবিরের পাশে লটকে রাখো’ আদেশ দিলেন খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ।


নিহত এই ব্যক্তি সাধারণ কোনো অপরাধী ছিল না। সে ছিল ইতিহাসের ভয়ংকর এক অপরাধী। টানা ২০ বছর সে আব্বাসী খিলাফাহর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। তাবারীর বর্ননামতে, এ সময়ে তার হাতে নিহত মানুষের সংখ্যা ২ লক্ষ ৫৫ হাজার। তার সাথে লড়াই করতে গিয়ে খলিফা মামুন হারিয়েছিলেন আহমাদ বিন জুনাইদ ও মুহাম্মদ বিন হামিদ তুসির মত বিখ্যাত সেনাপতিদের।

একের পর এক পরাস্ত হয়েছিলেন আব্বাসি খিলাফাহর বিখ্যাত সেনাপতি ইয়াহইয়া বিন মুয়াজ, মুহাম্মদ বিন আবি খালেদ, ইবরাহিম বিন লাইস প্রমুখ। তবু তাকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ২২২ হিজরিতে হায়দার বিন কাউস আল আফশিনের নেতৃত্বে তাকে পরাস্ত ও গ্রেফতার করে খলিফার দরবারে নিয়ে আসা হয়। (২) ইতিহাসের কুখ্যাত এই খুনির নাম বাবাক খুররামি।


বাবাক খুররামির পিতা আবদুল্লাহ ছিল মাদায়েনের একজন তেলবিক্রেতা। পরে সে আজারবাইজান চলে আসে। এখানে এক মেয়ের সাথে তার প্রেম হয়। পরে তারা বিবাহ করে নেয়। এখানেই ১৮২ হিজরিতে বাবাক খুররামির জন্ম। বাবাকের জন্মের কিছুদিন পর তার বাবা নিহত হয়। বাবাক কিছুদিন তাবরিয ও অন্যান্য শহরে আমিরদের গৃহে কাজ করে। কিছুদিন পর সে আজারবাইজানের একটি অঞ্চলের শাসক জাভেদানের গৃহে সে কর্মচারী হয়।

জাভেদান ছিল খুররামিয়্যাহ (৩) ফিরকার একজন গুরু। তারা বিশ্বাস করতো পৃথিবীতে দুজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। একজন ভালো বিষয়ের দেখভাল করেন। অন্যজন মন্দের। এরা সকল নারীকে নিজের জন্য বৈধ মনে করতো। জাভেদান বাবাককে তার একান্ত শিষ্য হিসেবে গড়ে তোলে। বাবাক অগ্নিপূজকদের ধর্মে দীক্ষিত হয়। গুজব আছে, জাভেদানের স্ত্রীর সাথে বাবাকের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং দুজন মিলে জাভেদানকে বিষপানে হত্যা করে। বাস্তবতা যাই হোক, জাভেদানের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে বাবাকের নিয়ন্ত্রনে বিশাল এলাকা ও জনবল চলে আসে। জাভেদানের স্ত্রীকে সে বিয়ে করে।

২০১ হিজরিতে সে আজারবাইজানের বাদিন পাহাড়ে নিজের ঘাটি মজবুত করে। এরপর সে আশপাশের বিভিন্ন দুর্গ দখল করতে থাকে। একই সময়ে মুসলমানদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাতে থাকে। সে আব্বাসি খিলাফাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ২০৪ হিজরিতে খলিফা মামুনুর রশিদ আরমেনিয়া ও আজারবাইজানের শাসক ঈসা বিন মুহাম্মদকে পাঠান বাবাককে দমন করতে। ঈসার উপর আদেশ ছিল বাবাককে হত্যা করে তার কর্তিত মস্তক বাগদাদে পাঠাতে হবে। ঈসা এই অভিযানে পরাজিত হন। বাধ্য হয়ে ২০৯ হিজরিতে খলিফা মামুন তার বিশ্বস্ত সেনাপতি যারিককে আজারবাইজান প্রেরণ করেন।

যারিক তার সঙ্গী আহমাদ বিন জুনাইদকে নিয়ে বাবাকের বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। এক যুদ্ধে আহমাদ বিন জুনাইদ বন্দি হন। বাবাক তাকে হত্যা করে। এই সংবাদে খলিফা মামুন ক্রোধান্বিত হন। তিনি যারিককে অপসারণ করে ইবরাহিম বিন লাইসকে পাঠান। কিছুদিন পর তিনি পাঠান মুহাম্মদ বিন হামিদ তুসিকে। ২১২ হিজরিতে মুহাম্মদ বিন হামিদ তুসির তীব্র আক্রমনে বাবাক পিছু হটতে বাধ্য হয়। সে পাহাড়ের আরো ভেতরের দিকে চলে যায়। মুহাম্মদ বিন হামিদ তুসি তাকে ধাওয়া করে পর্বতমালার ভেতরের দিকে চলে যান। ইতিমধ্যে পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা বাবাকের সেনারা তীব্র আক্রমন চালায়। মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মুহাম্মদ বিন হামিদ তুসি নিহত হন।

এই সংবাদে খলিফা মামুন ব্যথিত হন। তিনি বাবাকের উপর চুড়ান্ত আক্রমনের পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে রাজত্বের নানা ঝামেলায় ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় তিনি অভিযান মুলতবি রাখতে বাধ্য হন। পরবর্তী ৬ বছর মামুন আর কোনো অভিযান প্রেরণ করতে পারেননি। এই সুযোগে বাবাক নিজের রাজত্ব আরো বড় করে নেয়। ধর্মবিশ্বাসে যদিও সে অগ্নিপূজক ছিল কিন্তু বাহ্যিকভাবে সে নিজেকে মুসলমানও সাজাতো।
ইমাম আবদুল কাহের বাগদাদি লিখেছেন, বাবাক ও তার অনুসারীরা পাহাড়ে মসজিদ নির্মাণ করেছিল। সেখানে আযান দেয়া হত। তবে তারা সালাত ও সিয়াম পালন করত না। ঈদের রাতে তারা নারী পুরুষ একত্রিত হয়ে মদপান করত। তারপর সবাই উন্মুক্ত ব্যাভিচারে লিপ্ত হত। বাবাক ও তার অনুসারীরা নিজেদের ধর্মকে জাহেলি যুগের এক ব্যক্তি শারউইনের দিকে সম্পর্কযুক্ত করতো। তাদের বিশ্বাস ছিল এই ব্যক্তি সকল নবীদের চেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী। (৪)

২১৮ হিজরিতে খলিফা মামুনের মৃত্যুর পর খলিফা হন মুতাসিম বিল্লাহ। তিনি আবার নতুন করে বাবাকের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। তিনি নিজের বিশ্বস্ত সেনাপতি হায়দার বিন কাউস আল আফশিনকে বাবাকের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রেরণ করেন। আফশিন টানা চার বছর বাবাকের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। বাবাকের সুবিধা ছিল সে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ঘাটি করেছিল। বাগদাদ থেকে আসা সেনাদলের জন্য এই অপরিচিত এলাকায় লড়াই করা বেশ কষ্টকর ছিল। তবুও তারা লড়াই অব্যাহত রাখে। ২২২ হিজরির শুরুর দিকে বাবাকের শক্তি হ্রাস পায়। এমনকি মুসলিম বাহিনী তার কেল্লা দখল করে ফেলে। সে অল্পকিছু সহচর সহ আরেমেনিয়ার দিকে পালিয়ে যায়।

কিছুদিন সে আত্মগোপন করে থাকে। কিন্তু আফশিনের গোয়েন্দারা তাকে খুঁজে বের করে। তাকে বন্দি করে আফশিনের কাছে নিয়ে আসা হয়। আফশিন খলিফাকে পত্র লিখে বিস্তারিত জানান। খলিফা আফশিনের পত্র পড়ে খুশিতে দাঁড়িয়ে যান। তিনি আফশিনকে বলেন বাবাককে সামাররা শহরে নিয়ে আসতে। আফশিন বাবাককে নিয়ে আজারবাইজান থেকে রওনা হন। বাবাকের শেষ ইচ্ছা ছিল তাকে নিজের জন্মস্থানে একটু ঘুরিয়ে নিতে হবে। আফশিন এই শর্ত মেনে তাকে নিয়ে তার গ্রামে যান। সেখানে একদিন অবস্থান করেন। এরপর সামাররার পথ ধরেন।

তিনি শহরের কাছাকাছি আসতেই খলিফার ছেলে ওয়াসিক বিল্লাহ আমিরদের সাথে নিয়ে শহর থেকে বের হন। আফশিনকে অভিনন্দন জানান। ততদিনে ২২৩ হিজরি শুরু হয়েছে। আফশিন বাবাককে নিয়ে খলিফার দরবারে উপস্থিত হন। খলিফা আফশিনকে ২০ লাখ দিরহাম উপহার দেন। খলিফার আদেশে বাবাককে হাতির পিঠে চড়িয়ে শহরে ঘুরানো হয়। শহরবাসী বাবাকের উপর ক্ষিপ্ত ছিল। কেউ কেউ তার চেহারায় থুথু নিক্ষেপ করে। বাবাক শান্তস্বরে বলে, অচিরেই তোমরা আমার সাহস ও দৃঢ়তা প্রত্যক্ষ করবে।
বাবাক নিজের কথায় অটল ছিল। মৃত্যু পর্যন্ত সে একবারও ভেঙ্গে পড়েনি। ক্ষমাও চায়নি। সে ছিল সত্যিকারের এক দুর্ধর্ষ অপরাধী। (৫)

সূত্র
———————
১। এটি বাগদাদ থেকে ১২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি শহর। ২২১ হিজরিতে খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ এই শহর নির্মাণ করেন। তখন এর নাম ছিল সুররা মান রআ। মুতাসিম বিল্লাহ বাগদাদ থেকে রাজধানী সরিয়ে এখানে নিয়ে আসেন।

২। তাবারি, আবু জাফর মুহাম্মদ বিন জারির (মৃত্যু ৩১০ হিজরী), তারিখুর রুসুল ওয়াল মুলুক, ৯/৫৪ (দারুল মাআরিফ, কায়রো)

৩। অগ্নিপূজক জরথ্রুস্টিয় ধর্মের একটি শাখা। ইসলামের পূর্বযুগ থেকেই ইরানে এই ফিরকার লোকেরা বসবাস করতো।

৪। বাগদাদি, আবু মানসুর আবদুল কাহের তাহের বিন মুহাম্মদ (মৃত্যু ৪৬৯ হিজরি), আল ফারকু বাইনাল ফিরাক, পৃ-২৩৭,২৩৮ (মাকতাবাতু ইবনি সিনা, কায়রো)

৫। তাবারি, আবু জাফর মুহাম্মদ বিন জারির (মৃত্যু ৩১০ হিজরী), তারিখুর রুসুল ওয়াল মুলুক, ৯/২০-৫৪ (দারুল মাআরিফ, কায়রো)


ইমরান রাইহান 
সূত্রঃ fateh24