হিত্তিন যুদ্ধ : সালাহউদ্দিন আইয়ুবির আল -আকসা জয়

৪ জুলাই। ১১৮৭ সালের এ দিনে ইতিহাসখ্যাত মুসলিম সেনানায়ক সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি হাত্তিন যুদ্ধে খ্রিষ্টান বাহিনীকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল-আকসা পুনরুদ্ধারের পথ তৈরি করেছিলেন। আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত বিপুল সংখ্যক খ্রিষ্টান সৈন্যের মুকাবেলা করে তাঁকে জয় ছিনিয়ে আনতে হয়েছিল এ যুদ্ধে।

আল-আকসার শহর জেরুসালেম তথা ফিলিস্তিন অঞ্চল প্রথমবার মুসলমানদের হস্তগত হয়েছিল খলিফা হজরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাসনামলে, ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে। তারপর টানা পৌনে পাঁচ শো বছর এ ভূমি শাসন করেছে মুসলমানেরা। ১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম শাসকশ্রেণির আভ্যন্তরীণ কোন্দল ও স্বার্থবাদিতার সুযোগে খ্রিষ্টান ক্রুসেডারেরা আবারও দখল করে নেয় পবিত্র এ ভূমি।

জেরুসালেমের তখনকার শাসক ইফতেখারুদ্দৌলা নিজের সর্বস্ব বিলিয়েও শেষ রক্ষাটুকুন করতে পারেননি। আশপাশের মুসলিম শাসকদের কেউই এগিয়ে আসেনি তাঁর সাহায্যে। খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা যেদিন জেরুসালেম তথা আল-কুদস শহরে প্রবেশ করে, পুরো শহর জুড়ে নেমে আসে কেয়ামতের ভয়াবহতা। খ্রিষ্টান সৈন্যরা স্থানীয় মুসলিম পুরুষদের ঘর থেকে বের করে এনে জবাই করতে থাকে এক এক করে। নারীদের ওপর চালায় পাশবিক নির্যাতন। বাদ পড়েনি নিষ্পাপ শিশুরাও। শিশুদের মাথা শরীর থেকে আলগ করে তা দিয়ে ফুটবল খেলায় মেতে ওঠে অনেক সৈন্য।

নিরস্ত্র অসহায় মুসলমানরা মসজিদুল আকসায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। আকসা তো মুসলমানদের কাছে যেমন পবিত্র, খ্রিস্টানদের কাছেও তেমন সম্মানিত স্থান। এখানে রক্তারক্তি করা দুধর্মেই পাপ। মুসলমানরা মনে করেছিল, মসজিদে আকসায় আশ্রয় নিলে হয়তো রেহাই পাওয়া যাবে। খ্রিষ্টানরা অন্তত প্রাণে মারবে না সেখানে। কিন্তু উন্মত্ত সৈন্যরা সেখানে গিয়েও মুসলমানদের নৃশংসভাবে জবাই করতে থাকে। মুসলমানদের তাজা খুন মসজিদ গড়িয়ে পাশের রাস্তায় এসে পড়ে। রাস্তায় চলমান খ্রিষ্টানদের ঘোড়ার পা পর্যন্ত ডুবে গিয়েছিল বহমান এ রক্তে।

অল্পদিনের ভেতর খ্রিষ্টানরা আলআকসা মসজিদকে গির্জায় রূপান্তরিত করে। ইসলাম ও মুসলমানদের নাম-নিশানা মুছে ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা করে পবিত্র এ শহর থেকে। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি ছিলেন এই শতাব্দীর লোক। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল পবিত্র ভূমি আল আকসা উদ্ধারের।

১১৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দামেশকের সিংহাসনে বসেন। বছর খানেকের ব্যবধানে আলেপ্পো এবং ১১৮৩ সালে মসুলেও তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিকে মিশরেও ছিল আইয়ুবির শাসন। ফলে খ্রিষ্টান শাসিত জেরুসালেম আইয়ুবির চতুর্মুখী শাসনে অনেকটাই কোনঠাসা হয়ে পড়ে।

ইহুদিদের অবৈধ রাষ্ট্র বর্তমান ইসরায়েলের টাইবেরিয়াস নামক স্থানের নিকটবর্তী একটি শহরের নাম হিত্তিন। ১১৮৭ সালের জুলাইয়ের ৪ তারিখে জেরুসালেমের খ্রিষ্টান শাসক তাঁর মিত্র অন্যান্য শাসকদের নিয়ে এ শহরের পাশেই একটি ময়দানে মুখোমুখি হয়েছিল সালাহউদ্দিন আইয়ুবির বাহিনীর। সালাহউদ্দিন আইয়ুবির সৈন্যসংখ্যা তিরিশ হাজার এবং খ্রিষ্টানদের সৈন্যসংখ্যা বিশ হাজার থাকলেও খ্রিষ্টানদের মধ্যে দুর্ধর্ষ নাইট বাহিনীর ১২ শো সৈনিক ছিল। এবং পরে ভাড়াটে আরও বহু সংখ্যক সৈন্য তারা জোগাড় করতে পেরেছিল, কিন্তু যেটা পারেনি, সেটা হলো বীর সালাহউদ্দীনের সঙ্গে মুকাবেলা। মুকাবেলা করতে এসে খ্রিষ্টান সৈন্যরা বেঘোরে মারা পড়ে। বন্দী হতে হয় জেরুসালেমের শাসকসহ উচ্চপদস্থ অফিসারবর্গকে।

৪ জুলাই হিত্তিনের এ জয়ে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি থেমে থাকেননি। তাঁর জানবাজ বাহিনী নিয়ে ক্রমশ এগোতে থাকেন পবিত্র ভূমি আল-আকসার শহর জেরুসালেমের দিকে।

২০ সেপ্টেম্বর মুতাবেক ৫৮৩ হিজরির ১৫ রজব রবিবার নিজ নেতৃত্বে মুসলিম মুজাহিদদের বিশাল এক কাফেলা নিয়ে তিনি অবরোধ করেন জেরুসালেম শহর।

জেরুসালেম খ্রিষ্টানদেরও পবিত্র ভূমি। জীবন দিয়ে হলেও এ ভূমি তারা নিজেদের করায়ত্বে রাখতে চায়। শুরু হলো রক্তক্ষয়ী লড়াই। মরণপণ লড়াই করছে উভয়পক্ষই। কিন্তু সালাহউদ্দিন আইয়ুবির জানবাজ মুজাহিদদের মুকাবেলায় খুব বেশি দিন ঠিকল না ক্রুসেডারদের এ বীরত্ব।

অবরোধের ১২তম দিন ২ অক্টোবর মুতাবেক ২৭ রজব শহরের সব প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙে পড়ল। মুসলিম মুজাহিদরা মহানন্দে প্রবেশ করলেন পূণ্যভূমি আল কুদসে। প্রবেশ করলেন দীর্ঘ প্রায় নব্বই বছর পর। এ নব্বই বছর এখানে একটা বারের জন্যও আল্লাহু আকবারের ধ্বনি উচ্চারিত হতে দেয়নি খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা। মুসলমানরা ছিল এখানে চরম নিষ্পেষণের শিকার। যারাই ইসলামের নাম মুখে এনেছে, তারাই নিক্ষিপ্ত হয়েছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে, শিকার হয়েছে সীমাহীন নির্যাতনের।

কিন্তু আজ, এই বিজয়ের দিন, আলকুদসের সর্বময় ক্ষমতা পেয়ে মুসলমানরা কী করলেন? ৯০ বছর আগে যেভাবে খ্রিষ্টানরা গণহত্যা চালিয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি করলেন? প্রতিশোধ নিলেন? খ্রিষ্টানদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে তাদের জবাই করলেন? শিশুদের মাথার খুলি দিয়ে ফুটবল খেললেন? না, এর কোনোটিই করেননি। কেবল যারা যুদ্ধাপরাধী, তাদের বিচার করলেন। যুদ্ধাপরাধের সাথে যারা জড়িত ছিল না, যারা নীরিহ খ্রিষ্টান, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় কর আদায়ের শর্তে নিরুপদ্রবে বেঁচে থাকার অধিকার দিলেন। তাদের গায়ে ফুলের আঁচড়টিও লাগতে দিলেন না।

এটাই মানবতা। এই মানবতাই শিক্ষা দেয় ইসলাম। এই মানবতারই প্রচার করে গেছেন ইসলামের নবি সরওয়ারে কায়েনাত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম।

সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবির ঐতিহাসিক এ বিজয়ের পর ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ অবধি একাধারে এখানে শাসন করেছে মুসলমানরা। ১৯১৭ সালের পর থেকেই এ অঞ্চলের মুসলমানদের ওপর আপতিত বর্তমান জিল্লতি আর জুলুমের সূচনা হয়।


হামমাদ রাগিব
সূত্রঃ fateh24