নবুওতের আগের জীবনে মুহাম্মদ (সাঃ)

বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে যেসব গুণ-বৈশিষ্ট্য বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায়, মুহাম্মদ (সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মধ্যে এককভাবেই সেসব গুণ-বৈশিষ্ট্য ছিলো; যেমন : দূরদর্শিতা, সত্যপ্রিয়তা এবং চিন্তাশীলতার এক সুউচ্চ মিনার। চিন্তার পরিচ্ছন্নতা, পরিপক্বতা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পবিত্রতা তাঁর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিলো। দীর্ঘ সময়ের নীরবতায় তিনি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আল্লাহর সাহায্য পেতেন। পরিচ্ছন্ন মার্জিত সুন্দর বুদ্ধি, উন্নত স্বভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি মানুষের জীবন সম্পর্কে—বিশেষত জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে গভীরভাবে ধ্যান করেছিলেন। এ ধ্যানের মাধ্যমে মানুষকে যে সকল পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত দেখলেন, এতে তাঁর মন ঘৃণায় ভরে উঠলো। তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হলেন। পঙ্কিলতার আবর্তে নিমজ্জিত মানুষ থেকে তিনি নিজেকে দুরে রাখলেন। মানুষের জীবন সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেওয়ার পর মানব-কল্যাণ যতটা সম্ভব অংশগ্রহণ করতেন; বাকি সময় নিজের প্রিয় নির্জনতার ভুবনে ফিরে যেতেন। তিনি কখনো মদ স্পর্শ করেননি, আস্তানায় জবাই করা পশুর গোশত খাননি, মূর্তির জন্য আয়োজিত উৎসব মেলা ইত্যাদিতে কখনোই অংশগ্রহণ করেননি।

শুরু থেকেই তিনি মূর্তি নামের বাতিল উপাস্যদের অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। এত বেশি ঘৃণা তাঁর অন্য কিছুর প্রতি ছিলো না। লাত এবং উযযার নামে শপথও তিনি সহ্য করতেন পারতেন না।

তকদির তাঁর উপর হেফাজতের ছায়া ফেলে রেখেছিলো, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পার্থিব কোনো কিছু পাওয়ার জন্য যখন মন ব্যাকুল হয়েছে, অথর্ব অপছন্দনীয় রুসম-রেওয়াজের অনুসরণের জন্য মনে ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছে, তখন আল্লাহ পাক তাঁকে সেসব থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।

ইবনে আসিরের এক বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘জাহেলি যুগের লোকেরা যেসব কাজ করতো, দু’বারের বেশি কখনো সেসব কাজ করার ইচ্ছে আমার হয়নি। সেই দুটি কাজেও আল্লাহর পক্ষ থেকে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপর সে ধরনের কাজের ইচ্ছা কখনোই আমার মনে জাগেনি। ইতিমধ্যে আল্লাহ পাক আমাকে নবুওতের সম্পদে গৌরবান্বিত করেছেন।’

একবারের ঘটনা। নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মক্কার উপকণ্ঠে যে বালক আমার সাথে বকরি চরাতো, একদিন তাকে বললাম, তুমি আমার বকরিগুলোর দিকে যদি লক্ষ্য রাখতে তবে আমি মক্কায় গিয়ে অন্য যুবকদের মতো রাত্রিকালের গল্প-গুজবের আসরে অংশ নিতাম। রাখাল রাজি হলো। আমি মক্কার দিকে রওনা দিলাম। প্রথম ঘরের কাছে গিয়ে বাজনার আওয়াজ শুনলাম। জিজ্ঞাসা করতে একজন বললো, অমুকের সাথে অমুকের বিবাহ হচ্ছে। আমি শোনার জন্য বসে পড়লাম। আল্লাহ পাক আমার কান বন্ধ করে দিলেন, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। রোদের আঁচ গায়ে লাগার পর আমার ঘুম ভাঙলো। আমি তখন মক্কার উপকণ্ঠে সেই রাখালের কাছে ফিরে গেলাম। সে জিজ্ঞাসা করার পর সব কথা খুলে বললাম। আরও একদিন একই রকমের কথা বলে রাখালের নিকট থেকে মক্কায় পৌঁছুলাম, কিন্তু প্রথমোক্ত রাতের মতোই ঘটনা ঘটলো। এরপর কখনো ওই ধরনের ভুল ইচ্ছা আমার মনে জাগ্রত হয়নি।

বুখারি শরিফে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, কাবাঘর যখন নির্মাণ করা হয়েছিলো, তখন নবি করিম সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হযরত আব্বাস পাথর ভাঙছিলেন। হযরত আব্বাস আল্লাহর রাসূলকে বললেন, তহবন্দ খুলে কাঁধে রাখো, পাথরের ধুলোবালি থেকে রক্ষা পাবে। তহবন্দ খোলার সাথে-সাথে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তারপর আকাশের দিকে তাকালেন এবং বেহুঁশ হয়ে গেলেন; খানিক পরেই হুঁশ ফেরে এলে বললেন, আমার তহবন্দ আমার তহবন্দ। এরপর তাঁর তহবন্দ তাঁকে পরিয়ে দেওয়া হয়। এক বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, এ ঘটনার পর আর কখনো তাঁর লজ্জাস্থান দেখা যায়নি।

এমন একটি অতুলনীয় নিরুপম জীবন নবি মুহাম্মদ কাটাচ্ছিলেন তাঁর নবুওতের আগেই; মূলত এর সবই ছিলো অদৃশ্যের মহাপরিকল্পনার অংশ, যা কিছু কাল পরে মহাকালের অংশ হওয়ারই আগাম ইঙ্গিত বহন করছিলো।


নবীজি