শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম এর সংক্ষিপ্ত জীবনী – মাওলানা নাসীম আরাফাত

আসবাহ আল হারতিয়া৷ ফিলিস্তিনের জেনিন প্রদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম৷ যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের পাতায় এ গ্রামের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ৷ কারণ এ গ্রাম জন্ম দিয়েছে বহু মহামানবকে, বহু মুজাহিদ আর সমরবিদকে, বহু দার্শনিক আর চিন্তাবিদকে, বহু সাহিত্যিক আর ভাষাবিদকে৷

১৯৪১ সাল৷ আসবাহ আল হারতিয়া তখন পরাধীন। ইহুদিদের পদভারে রক্তাক্ত৷ দুরন্ত বায়ুর বুকে সন্তানহারা মায়েদের আহাজারি৷ এতিম শিশুদের আর্তচিৎকার৷ অসহায় বৃদ্ধ আর বৃদ্ধাদের চোখে চোখে অশ্রুর বান৷ কৌমার্যছিন্ন যুবতী আর তরুণীদের চোখে প্রতিশোধের লেলিহান আগুন৷ ঠিক তখন আসবাহ আল হারতিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এক নবজাত সন্তান৷ আব্দুল্লাহ ইউসুফ আযযাম৷ পারিবারিক ঐতিহ্যে লালিত হন ইসলামী আকিদাহ-বিশ্বাসে৷ মহব্বত করতে শিখেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে, আল্লাহর পথে জিহাদে রত বীর বাহাদুরদেরকে, সৎকর্মপরায়ণ ব্যক্তিদেরকে। আখিরাতের চিন্তা-ফিকির আর শাহাদাতের তামান্না শৈশব থেকেই তাঁর চরিত্রে ফুটে উঠতে থাকে।

আব্দুল্লাহ আযযাম একটু ব্যতিক্রমধর্মী – সদা গভীর, নিষ্ঠাবান, চিন্তায় ডুবে থাকা এক কিশোর৷ নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা তাঁর চরিত্রকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে৷ অল্প বয়সেই তিনি দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। ইসলামি চিন্তা-চেতনাকে মুসলমানদের মাঝে জাগ্রত করতে পেরেশান হয়ে পড়েন৷ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থাতেই তাঁর অসাধারণ গুণাবলি দেখে শিক্ষকরা হতবাক হয়ে যেতেন। তারা ভাবতে থাকেন, আমাদের এ সন্তান কালের ব্যবধানে নিশ্চয়ই বড় কিছু হবে৷ হয়তো আল্লাহ তা’লা তাঁর দ্বারা ইসলামের সংস্কারের কাজ করাবেন৷ সুনামের সাথেই তিনি লেখাপড়া করতে থাকেন৷ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের লেখাপড়া সুনামের সাথেই শেষ করেন৷ ক্লাসে সবার চেয়ে ছোট হওয়া সত্বেও তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি সুদর্শন ও মেধাবি। এরপর তিনি এগ্রিকালচারাল কাদরী কলেজে ভর্তি হন এনং সেখান থেকেই ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন।

তারপর দক্ষিণ জর্দানের আদ্দির নামক গ্রামে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন৷ কিন্তু তাঁর পিপাসার্ত মন তখনো ছিল অস্থির-উতলা। তাই দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে শরিয়াহ বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬৬ সালে শরিয়াহ(ইসলামী আইন) এর ওপর বিএ ডিগ্রি লাভ করেন৷

১৯৬৭ সাল। ইহুদিরা পশ্চিম তীর দখল করে নিল৷ রক্তে রঞ্জিত হল পশ্চিম তীর৷ চোখের সামনে দেখলেন, নির্যাতন আর নিপীড়নের ভয়াল চিত্র৷ বুক ফাটা আহাজারি, কান্না আর বিলাপের অসহনীয় বেদনায় টানটান করতে থাকে তাঁর হৃদয়। চোখেই জমাট বেঁধে যায় অশ্রু। তিনি শপথ করলেন, না, আর নয়। ইহুদীদের দখলদারিত্বের অধীনে তিনি আর থাকবেন না।

তাঁর পেশিতে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠে। চিরচেনা শান্ত সমাহিত সেই আযযম যেন জলন্ত অঙ্গার। তবে অত্যন্ত নীরব। দারুণ চিন্তাশীল। সময়ের ব্যবধানে হলেও তিনি সফলতার মুখ দেখতে চান। অত্যাচারীদের হাত গুটিয়ে দিতে চান চিরতরে।

১৯৭০ সাল। তিনি তখন জর্দানে। ইসরাঈলি আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদে যোগ দিলেন। শুরু হল তাঁর জীবনের আরেক অধ্যায়। চিন্তায় লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে দৃঢ়পপদে এগিয়ে চললেন। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর অনুধাবন করলেন, না, তাঁকে আরও পড়ে হবে। তাঁকে আরও শিখতে হবে। অল্পবিদ্যা নিয়ে সামনে এগোনো যে বড়ই কঠিন। অত্যন্ত দুষ্কর। তাই তিনি চলে এলেন মিশরে। ভর্তি হলেন আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার তিনি ইসলামী আইন শাত্রে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করলেন। ১৯৭১ সালে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান্ডিত্যের পুরষ্কার লাভ করেন। সে বছরই তিনি ইসলামি আইনের বিজ্ঞান ও দর্শন ( উসুলুল ফিকাহ) এর ওপর পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে মিশরে অবস্থানকালে শহীদ সাইয়্যেদ কুতুবের রহ. (১৯০৬-১৯৬৬) পরিবারের খোঁজখবর নিতেন।

শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযাম দেড় বছর ফিলিস্তিননের জিহাদে অতিবাহত করেন। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে জিহাদে কার্যক্রম চালিয়ে যান। কিন্তু এসময় তিনি মানসিকভাবে প্রশান্ত ছিলেন না। কারণ তিনি দেখতেন, যারা ফিলিস্তিন জিহাদে রত তারা ইসলাম থেকে অনেক দূরে। মাঝে মধ্যেই তিনি দুঃখ করে বলতেন, ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার জন্য এটা কোন ধরনের জিহাদ হচ্ছে, যেখানে মুজাহিদ ভাইয়েরা প্লেইং কার্ড, গান শোনা আর টেলিভিশনে অশ্লীল ছবি দেখে রাত কাটিয়ে দিচ্ছে! তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতেন, হাজারো মানুষের জনবহুল জায়গায় সালাতের জন্য আহ্বান করা হলে একেবারেই অল্প সংখ্যক লোক উপস্থিত হয় যাদের হাতের আঙ্গুলী দিয়ে গোনা সম্ভব, এদের দিয়ে কী জিহাদ হবে! তাই তিনি তাদেরকে ইসলামের পথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু তারা তাঁকে প্রতিহত করত। বাধা দিত।

একদিন তিনি এক মুজাহিদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ফিলিস্তিনের এ অভ্যুত্থানের সাথে কি দ্বীনের কোনো সম্পর্ক আছে? তখন সেই মুজাহিদ অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় বলল, এই অভ্যুত্থানের পশ্চাতে দ্বীনের কোনো সম্পর্ক নেই।

এ কথা শুনার পর তাঁর মন ভেঙে যায়। তিনি ফিলিস্তিনের রণাঙ্গন ত্যাগ করে সৌদি আরব চলে আসেন। জেদ্দায় অবস্থিত বাদশা আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মাঝে ইসলামের নির্মল চেতনা ও জিহাদি জযবা সৃষ্টির লক্ষ্যে পাঠদানে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি তখন উপলব্ধি করতে পারেন, মুসলিম উম্মাহর বিজয় ফিরিয়ে আনতে পারবে ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র বাহিনী। এ ছাড়া বিজয় সম্ভব নয়। তখন থেকে জিহাদ আর বন্দুক হয়ে যায় তাঁর প্রধান কাজ আর বিনোদনের সঙ্গী। তিনি অত্যন্ত জোরালো ভাষায় ঘোষণা করতে থাকেন, আর কোন সমঝোতা নয়, নয় কোন আলাপ আর আলোচনা। জিহাদ আর রাইফেলই হবে সমাধানের একমাত্র পথ।

১৯৮০ সাল। হজ্জে এসেছেন এক আফগান মুজাহিদ। সহসা তার সাথে দেখা হয়ে যায় ড. আব্দুল্লাহ আযযাম রহ. এর। কথার তালে তালে সখ্যতা বৃদ্ধি পেল। একের পর এক শুনলেন আফগান জিহাদের অবিশ্বাস্য কাহিনীমালা। মুজাহিদদের ত্যাগ, কুরবানী আর আল্লাহর সাহায্যের কাহিনীমালা শুনতে শুনতে ড. আব্দুল্লাহ আযযাম অভিভূত হয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন, এতোদিন ধরে তিনি এ পথটিই খুঁজে ফিরছেন। এরই তালাশে আছেন। এরপর তাঁন মন অস্থির হয়ে উঠে। অশান্ত হয়ে উঠে। তিনি বাদশাহ আব্দুল আজীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশা ত্যাগ করে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে চলে আসেন।

শুরুতে তিনি ইসলামাবাদের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ইতোমধ্যে বেশ কিছু আফগান মুজাহিদ নেতার সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে। তখন আফগান জিহাদ সম্পর্কে তিনি বাস্তব তথ্য সংগ্রহ করেন। নানা বিষয়ে খোঁজ খবর নেন। চলমান জিহাদের রূপরেখা অনুধাবন করেন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পুরোপুরিভাবে আফগান জিহাদে আত্মনিয়োগ করেন। হৃদয়-মন, মেধা-যোগ্যতা, অর্থ-সম্পদ সবকিছু অকাতরে উজাড় করে দান করেন। আত্মতৃপ্ত শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের কন্ঠ চিরে বার বার রাসূলের ﷺ এই বাণীটি মুজাহিদদের মাঝে ছাড়িয়ে পড়ত,

“আল্লাহর পথে জিহাদের ময়দানে এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকা ষাট বৎসর ইবাদতে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।” তারপর তা তাদের হৃদয়ে ছুঁয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করত। শাহাদাতের আশায় তাদের অস্থির করে ছাড়ত। ব্যাকুল করে দিত।

আব্দুল্লাহ আযযাম ও তাঁর প্রিয় শিষ্য উসামা বিন লাদেন পেশোয়ারে অবস্থানকালে মুজাহিদদের সেবা সংস্থা বায়তুল আনসারে যোগ দেন। এ সংস্থা আফগান মুজাহিদদের সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করত। নতুন মুজাহিদদের পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ দিয়ে আফগানিস্তানে সম্মুখ যুদ্ধে প্রেরণ করত। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর পরিবারকেও নিয়ে আসেন।

এরপর আব্দুল্লাহ আযযাম আরো সামনে অগ্রসর হলেন। জিহাদের প্রথম কাতারে গিয়ে শামিল হলেন। হাতে তুলে নিলেন অস্ত্র। ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সম্মুখ লড়াইয়ে। অসম সাহসিকতায় বীরের মত যুদ্ধ করতে লাগলেন। আল্লাহর রাহে জীবন দেওয়ার জন্য তিনি উতলা হয়ে উঠলেন। ছুটে চললেন এক ফ্রন্ট থেকে আরেক ফ্রন্টে। এক রণক্ষেত্র থেকে আরেক রণক্ষেত্রে। আহ! এ যেন আরেক জীবন। এ জীবনের কোন মৃত্যু নেই। এর স্বাদ, রঙ আর প্রকৃতি একেবারে আলাদা। অনন্য।

তিনি আফগানিস্তানের অধিকাংশ প্রদেশে ছুটে গেলেন। লোগার, কান্দাহার, হিন্দুকুশ পর্বতমালা, পাঞ্জশির উপত্যকা, কাবুল আর জালালাবাদে ছুটে চললেন বিরামহীন গতিতে। ফলে আফগান রণাঙ্গনের সাধারণ যোদ্ধা ও মুজাহিদদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। সখ্যতা হয়। বন্ধুত্ব হয়। সবাই তাঁকে তাঁর হৃদয়ের উদারতা, জিহাদী জযবা, আল্লাহর রাহে জীবন দেয়ার আকুতি, মুসলিম উম্মাহর দরদী ব্যক্তিত্বের কারণে মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতে থাকে। মহব্বত করতে থাকে।

এরপর তিনি আবার ফিরে আসেন পেশোয়ারে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় এবার তিনি একেবারে টইটম্বুর। গোটা আফগান রণাঙ্গনের সমস্যা-সমাধান তাঁর মস্তিষ্কের কোষে কোষে। জিহাদের এই কাফেলাকে সঠিক পথে পরিচালনার ও চূড়ান্ত বিজয়ের পথে নিয়ে যাওয়ার তামান্নায় তিনি অধীর অস্থির। তাই মুজাহিদদের মাঝে সংস্কারমূলক বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। মুজাহিদদের পরিশুদ্ধ করতে লাগলেন। জিহাদের পথে নানা বিভ্রান্তির আলোচনা করতে লাগলেন। বিভক্ত মুজাহিদদের গ্রুপগুলোকে একই কাতারে শামিল হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে লাগলেন। শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের সেই বক্তৃতা সংকলনই পরবর্তীতে ‘ফি জিলালি সুরাতিত তাওবাহ’ নামক গ্রন্থে প্রকাশ করা হয়।

আফগান মুজাহিদ নেতাদের মাঝে তাঁর প্রভাব ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাই সবাই তাঁকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসতেন। তাঁর প্রস্তাব, পরিকল্পনাকে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারতো না।

এরপর তিনি মুসলিম উম্মাহকে জিহাদের ব্যাপারে জাগ্রত করার দিকে মনোনিবেশ করেন। আফগান জিহাদের পবিত্র আহ্বানকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে ছুটে যান বিশ্বের বহু দেশে। সাক্ষাৎ করেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও সমাজসেবক ব্যক্তিত্বদের সাথে। সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিতে থাকেন। চারদিকে ছুটতে থাকে অনল প্রবাহ। তিনি দ্বীনের হিফাজতের জন্য, শত্রুদের হাত থেকে মুসলমানদের লুন্ঠিত ভুমিকে উদ্ধারের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন।

অবসরে তার কলমও ছুটতে থাকে। তিনি জিহাদ বিষয়ে বেশ কয়েকটি পুস্তকও রচনা করেন। যা এখনো পাঠককে আন্দোলিত করে। আলোড়িত করে। জিহাদের পথে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। পুস্তকগুলোর শীর্ষে রয়েছে- এসো কাফেলাবদ্ধ হই, আফগান জিহাদে আর-রহমানের নিদর্শনসমূহ, মুসলিম ভূমিসমূহের প্রতিরক্ষা ইত্যাদি।

শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযামের অবিরাম প্রচেষ্টা, মেহনত-মুজাহাদা সফলতার আলো দেখতে পায়। তিনি বিশ্বের মুসলমানদেরকে আফগান জিহাদের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। ফলে আফগান জিহাদ শুধু আফগান জনতার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং তা আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানরা আফগান জিহাদে অংশগ্রহণ করতে ছুটে আসতে থাকে। তারা ইহুদি-খ্রিস্টানদের হাতে নিপীড়িত-নির্যাতিত মুসলিম মা-বোনদের উদ্ধারে শপথ গ্রহণ করতে থাকে এবং প্রত্যেক লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে থাকে।

তিনি তাঁর মানসপটে একটা চিত্রই এঁকেছিলেন। তা হল, জিহাদের মাধ্যমে খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বারবার বলতেন, পৃথিবীর বুকে খিলাফত প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে। তাই তিনি বহুবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রস্তাবকে অকুষ্ঠ চিত্তে প্রত্যাখান করেছেন। আর দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা করেছেন, তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যাবেন যতক্ষণ পর্যন্ত হয় তিনি বিজয়ী হবেন, নতুবা তাঁকে হত্যা করা হবে।

আফগান রণাঙ্গন ছিল তাঁর স্বপ্নের চারণভূমি। তাই তিনি বলতেন, আমি কখনও জিহাদের ভুমি পরিত্যাগ করব না, তিনটি অবস্থা ছাড়া। হয় আমি আফগানিস্তানে নিহত হব, নতুবা পেশোয়ারে নিহত হব, নতুবা হাত বাঁধা অবস্থায় আমাকে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হবে।

একদিন মিম্বারে খুতবাহ দানকালে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বললেন, “আমি মনে করি, আমার প্রকৃত বয়স হচ্ছে নয় বৎসর। সাড়ে সাত বৎসর কেটেছে আফগান জিহাদে আর দেড় বৎসর কেটেছে ফিলিস্তিন জিহাদে। এছাড়া আমার জীবনের বাকী সময়গুলোর কোনো মূল্য আমার কাছে নেই।” তিনি আরও বললেন, জিহাদ পরিত্যাগ করা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না এক আল্লাহর ইবাদাত করা হবে। জিহাদ চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না সব নির্যাতিত মানুষকে মুক্ত করা হবে। জিহাদ চলতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের সম্মান ও লুন্ঠি্ত ভুমিগুলো ফিরিয়ে আনা হবে। জিহাদ হল চিরস্থায়ী মর্যাদার পথ।

শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম মুসলিম উম্মাহকে লক্ষ্য করে জুমআর খুতবায় বলতেন, মুসলিম জাতি কখনও অন্য জাতি দ্বারা পরাজিত হয়নি। বরং আমরা আমাদের নিজেদের লোকদের কাছেই পরাজিত হয়েছি।

শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম একজন উত্তম চরিত্রের অধিকারি ব্যক্তি ছিলেন। ধর্মানুরাগ, আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা, সংযমশীলতা ছিল তাঁর চারিত্রিক অলংকার। তিনি কখনও কারো সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেন না। তরুণদের তিনি ভিন্ন চোখে দেখতেন। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সব ধরনের ভয়-ভীতি মাড়িয়ে হৃদয়ের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি নিয়মিত সিয়াম পালন করতেন। বিশেষ করে নবী দাউদের (আলাইহিস সালাম) সুন্নাহ অনুযায়ী একদিন সিয়াম পালন করতেন, আরেকদিন বিরত থাকতেন। এভাবে তিনি সারা বৎসর সিয়াম পালন করতেন। সোমবার ও বৃহস্পতিবার তিনি সিয়াম পালন করতেন এবং অন্যদেরও এ দু’দিন সিয়াম পালন করতে উৎসাহিত করতেন।

একবার এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটল। পেশোয়ারে কিছু উগ্র স্বভাবের লোক ঘোষণা দিল, শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম কাফের হয়ে গেছে। কারণ তিনি মুসলমানদের সম্পদ অপচয় করছেন।

শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম এ সংবাদ শুনে বিস্মিত হলেন না। ক্ষিপ্তও হলেন না। তাদের সাথে কোন রুঢ় আচরণও করলেন না। বরং তাদের জন্য কিছু উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে দিলেন। এরপরও কিছু লোক বিরত হল না। তারা তাঁর বিরুদ্ধে কটু কথা বলতে লাগল। অপবাদ ছড়াতে লাগল। শাইখ আযযাম কিন্তু একেবারেই নীরব। নির্বিকার। তিনি তাদের সম্পর্কে কিছুই বললেন না। বরং নিয়মিত তাদের নিকট উপহার সামগ্রী পাঠাতে লাগলেন। তারপর একসময় তাদের ভুল ভাঙ্গলো। তখন তারা বলতে লাগল, আল্লাহর কসম, আমরা কখনোই শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের মতো মানুষ দেখিনি। তিনি আমাদের নিয়মিত অর্থ ও উপহার সামগ্রী দিয়ে যেতেন। অথচ আমরা তার বিরুদ্ধে কটুবাক্য বলতাম।

শাইখ আব্দুল্লাহ আযযামের চেষ্টা ও মুজাহাদার ফলে আফগানিস্তানের বেশ কয়েকটি মুজাহিদ গ্রুপ একত্রিত হল। তারা একই আমিরের নির্দেশে চলতে লাগলো, ফলে শত্রুদের মাঝে ভীতি ছড়িয়ে পড়লো। মুজাহিদরা প্রত্যেক ফ্রন্টে বিজয়মালা ছিনিয়ে আনতে লাগলো। এ অবস্থায় শত্রুরা তাঁকে সহ্য করতে পারছিল না। তারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করল। তাঁকে হত্যার কৌশল খুঁজতে লাগল।

পেশোয়ারে তিনি এক মসজিদে নিয়মিত জুমআর নামায পড়াতেন। নামাযের আগে অগ্নিঝরা বক্তৃতা দিতেন। দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ তাঁর বক্তৃতা শুনতে ছুটে আসতো। ১৯৮৯ সালে শত্রুরা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে তার মিম্বারের নিচে একটি প্রচন্ড শক্তিশালী টিএনটি বিস্ফোরক রেখে দিল। এটা এতোই ভয়াবহ ছিল যে তা বিস্ফোরিত হলে পুরো মসজিদটি ধ্বসে পড়তো। মসজিদের হয়তো কেউই বাঁচতো না। কিন্তু আল্লাহর ফায়সালা ছিল ভিন্ন। তাই তা বিস্ফোরিত হয়নি!

এইদিকে শত্রুরা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে লাগল। ১৯৮৯ সালের ২৪শে নভেম্বর। শুক্রবার। শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম যে পথ দিয়ে জুমআর নামায আদায় করতে যেতেন সে পথে শত্রুরা তিনটি বোমা পুঁতে রাখল। রাস্তাটি ছিল সরু। একটির বেশি গাড়ি তা দিয়ে অতিক্রম করতে পারত না। দুপুর ১২.৩০ মিনিটে শাইখের গাড়িটি ঠিক বোমা যেখানে পুঁতে রাখা হয়েছিল সেখানে এসে থামল। সে গাড়িতে ছিলেন শাইখ ও তাঁর দুই ছেলে ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ। তাঁর আরেক পুত্র তামীম আদনানী আরেকটি গাড়িতে করে পিছনে পিছনে আসছিল।

শাইখ গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলেন। আর তখনই বিকট শব্দ করে শত্রুদের পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরিত হল। বিস্ফোরণের ভয়াবহ আওয়াজে কেঁপে উঠল পুরো শহর। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। তারপরই মসজিদ ও আশপাশের মানুষেরা দৌঁড়ে এল।

কিন্তু ইতোমধ্যে যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। ঘটনাস্থলে তাঁর গাড়ির বিক্ষিপ্ত টুকরো ছাড়া আর কিছুই পেল না। বিস্ফোরণের ফলে শাইখের দুই ছেলের দেহ ১০০ মিটার উপরে উঠে গিয়েছিল। তাদের দেহ বিভিন্ন গাছের ডালে, বৈদ্যুতিক তারের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা শহীদ ড. আব্দুল্লাহ আযযামের দেহকে রক্ষা করলেন। দেহটি সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় একটি দেয়ালের সাথে হেলান দেয়া অবস্থায় পাওয়া গেল।তখন তাঁর মুখ দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।

তাঁর শাহাদাতের সংবাদে চারদিকে শোকের ছায়া নেমে এলো। কান্নার রোল পড়ে গেল। মুজাহিদদের শিবিরে শিবিরে সেই কান্না ছড়িয়ে পড়লো। স্তব্ধ হয়ে গেল তাঁর বন্ধু-বান্ধব আর নিকটতম ব্যক্তিরা।

“ওরা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূরের পূর্ণ বিকাশ ছাড়া আর কিছুই চান না, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।”

১৯৯৯ সাল। আল-জাজিরা টিভি চ্যানেল শাইখ উসামা বিন লাদেনের এক সাক্ষাৎকার নিল। তিনি তাতে বললেন, “শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম একক কোন ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি একাই ছিলেন একটি উম্মাহ। একটি জাতি। তাঁর শাহাদাতের পর মুসলিম মায়েরা তাঁর মতো দ্বিতীয়জন জন্ম দিতে পারে নাই।”

টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে, “বিংশ শতাব্দীতে জিহাদকে পুনর্জাগরণে তিনিই দায়ী।”

চেচনিয়া জিহাদের ফিল্ড কমান্ডার ইবনুল খাত্তাব রহ. বলতেন, “১৯৮০- এর দশকে শহীদ শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম ছিলেন এমন একটি মুদ্রিত নাম যাঁর কথা চেচনিয়ার জিহাদের ময়দানগুলোতে আজও বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে চলছে।

আর শাইখ আব্দুল্লাহ আযযাম বলতেন, “কেউ জিহাদের ময়দানে ইন্তেকাল করলে সে যেন ‘শহীদী কাফিলার সাথে’ গিয়ে শরীক হল।”

আল্লাহ শাইখকে কবুল করুন।


লেখকঃ নাসীম আরাফাত
মুহাদ্দিস, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা