ভয়ঙ্কর বয়কটের মুখে নবীজি, বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব

হযরত উমর, হামযা প্রমুখ বীর সাহাবিদের ইসলামগ্রহণ, ইসলাম প্রচারে নবীজির (সাঃ) গতিশীল উদ্যম এবং বনু হাশেম ও মুত্তালিবের নির্বিশেষ সহযোগিতা মুহাম্মদের (সাঃ) বিরুদ্ধে লেলিয়ে-দেওয়া মুশরিকদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিচ্ছিলো। দিনদিন মুশরিকদের হতবুদ্ধিতা বেড়ে চলছিলো।

এর সবকিছুর বিরুদ্ধে সম্মিলিত একটি ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে কথা স্থির হলো; এবং সে সিদ্ধান্ত মোতাবেক মুশরিকরা ‘মুহাসসাব’ নামক উপত্যকায় খাইফে বনি কিনানার ভিতরে একত্রিত হয়ে সর্বসম্মতভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলো যে, বনু হাশেম এবং বনু মুত্তালিবের সাথে ক্রয়-বিক্রয়, সামাজিক কার্যকলাপ, অর্থনৈতিক আদান-প্রদান, কুশল বিনিময় ইত্যাদি সবকিছুই বন্ধ রাখা হবে। কেউ তাদের কন্যা গ্রহণ করতে কিংবা তাদের কন্যা দান করতে পারবে না। তাদের সঙ্গেস ওঠা-বসা, কথোপকথন, মেলামেশা, বাড়িতে যাতায়াত ইত্যাদি কোনো কিছুই করা চলবে না। হত্যার জন্য মুহাম্মদকে (সাঃ) যত দিন তাদের হাতে সমর্পণ না করা হবে, তত দিন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।

মুশরিকরা এ বর্জন বা বয়কটের দলিলস্বরূপ একটি অঙ্গীকারনামা সম্পাদন করে, যাতে অঙ্গীকার করা হয়েছিলো যে, তারা কখনো বনু হাশেমের পক্ষ হতে কোনো সন্ধিচুক্তির প্রস্তাব গ্রহণ করবে না এবং তাদের প্রতি কোনো প্রকার ভদ্রতা বা শিষ্টাচার প্রদর্শন করবে না, যে পর্যন্ত তারা মুহাম্মদকে (সাঃ) হত্যার জন্য মুশরিকদের হাতে সমর্পণ না করবে, সে পর্যন্ত এ অঙ্গীকারনামা বলবৎ থাকবে।

এ অঙ্গীকার স্থিরীকৃত হলো এবং অঙ্গীকারনামাটি কাবার দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো; যার ফলে আবু লাহাব ব্যতীত বনু হাশেম এবং বনু মুত্তালিবের কী কাফের, কী মুসলিম, সকলেই আতঙ্কিত হয়ে ‘শেয়াবে আবু তালিব’—গিরিসংকটে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো নবুওতের সপ্তম বর্ষের মুহাররম মাসে।

এ বয়কটের ফলে বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিবের লোকজনদের অবস্থা অত্যন্ত কঠিন ও সঙ্গীন হয়ে পড়লো। খাদ্য-শস্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব-সামগ্রী আমদানি ও পানীয় সরবরাহ বন্ধ হয়ে ছিলো। কারণ, খাদ্য-শস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী, যা মক্কায় আসতো, মুশরিকরা তা তাড়াহুড়া করে ক্রয় করে নিতো। এ কারণে গিরিসংকটে অবরুদ্ধদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ হয়ে পড়লো। খাদ্যাভাবে তাঁরা গাছের পাতা, চামড়া ইত্যাদি খেতে বাধ্য হলো। কোনো কোনো সময় তাঁদের উপবাসেও থাকতে হতো। গিরিসংকটে তাঁদের নিকট জিনিসপত্র পৌঁছানোও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো, যা পৌঁছুতো, তাও অতি সঙ্গোপনে। হারাম মাসগুলো ছাড়া অন্য কোনো সময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁরা বাহিরে যেতে পারতেন না। অবশ্য যে সকল কাফেলা মক্কার বাহির থেকে আগমন করতো, তাদের নিকট থেকে তাঁরা জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারতেন। কিন্তু মক্কার ব্যবসায়ীগণ এবং লোকজনেরা সেসব জিনিসের দাম এতই বৃদ্ধি করে দিতো যে, গিরিসংকটবাসীগণের ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই তা থেকে যেতো।

খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার ভ্রাতুষ্পুত্র হাকিম বিন হিযাম কখনো কখনো তাঁর ফুফুর জন্য গম পাঠিয়ে দিতেন। এক দিবস আবু জাহলের সঙ্গে সাক্ষাত হয়ে গেলে সে বাধা দিতে উদ্যত হলো, কিন্তু আবুল বুখতারি এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলো এবং তাঁর ফুফুর নিকট খাদ্য প্রেরণে সাহায্য করলো।

এদিকে আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম্পকে নিয়ে সর্বক্ষণ চিন্তিত থাকতেন। তাঁর নিরাপত্তাবিধানের কারণে লোকেরা যখন নিজ নিজ শয্যায় শয়ন করতো, তখন তিনি নবীজিকে নিজ শয্যায় শয়ন করার জন্য পরামর্শ দিতেন। উদ্দেশ্য এই ছিলো যে, কেউ যদি তাঁকে হত্যা করতে ইচ্ছুক থাকে, তাহলে সে দেখে নিক যে, তিনি কোথায় শয়ন করেন; তারপর যখন লোকজনেরা ঘুমিয়ে পড়তো, তিনি তাঁর শয্যাস্থল পরিবর্তন করে দিতেন। নিজ পুত্র, ভাই কিংবা ভ্রাতুষ্পুত্রদের মধ্যথেকে একজনকে নবীজির শয্যায় শয়ন করার জন্য পরামর্শ দিতেন এবং তার পরিত্যাজ্য শয্যায় রাসূলের শয়নের ব্যবস্থা করতেন।