বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর পরিচিতি ও প্রকারভেদ। গুরুত্বের বিচারে এটা অত্যন্ত জরুরি হলেও দুঃখের বিষয় যে, এ মাসআলার ব্যাপারে বর্তমানের অধিকাংশ মানুষ উদাসীন। সাধারণরা তো দূরে থাক; অনেক ভালো ভালো আলিমেরও এ বিষয়ে তেমন অধ্যয়ন নেই। আর এজন্য তাদের বিভিন্ন দলিলবিহীন কথার কারণে অনেক মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ছে। তাই দীর্ঘ সময় ব্যয় করে কুরআন, হাদিস ও চার মাজহাবের ফুকাহায়ে কিরামের রায় সামনে রেখে এ বিষয়ে দলিলসমৃদ্ধ একটি আর্টিকেল তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলাম, যাতে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ নিয়ে সবার ভুল ধারণা দূর হয়ে এ বিষয়ে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। আল্লাহ-ই আমাদের সাহায্যকারী এবং তিনিই আমাদের উত্তম অভিভাবক।
এ বিষয়টি নিয়ে আমরা চারটি ভাগে আলোচনা করতে পারি। প্রথমত, ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ পরিভাষা দুটির শরয়ি ভিত্তি । দ্বিতীয়ত, দারুল ইসলাম ও দারুল হারবের সংজ্ঞা ও পরিচিতি। তৃতীয়ত, দারুল হারবের প্রকারভেদ। চতুর্থত, দারুল ইসলাম ও দারুল হারবের রূপান্তর। আমরা এ চারটি বিষয়কে চারটি পার্টে ভাগ করে আলোচনা করছি ইনশাআল্লাহ।
প্রথম আলোচনা : ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ পরিভাষা দুটির শরয়ি ভিত্তি
বর্তমানে কিছু মানুষকে দেখা যায়, তারা ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ পরিভাষা দুটিকে খুবই অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে থাকে। তাদের ধারণা, এসব যেহেতু ইজাতহাদি বিষয়, তাই ‘দার’-কে দুভাগে সীমাবদ্ধ রাখা আবশ্যকীয় কিছু নয়; বরং এতে প্রকার আরও কমবেশ বা পরিবর্তন হতে পারে। অথচ এ পরিভাষা ও তার প্রকারভেদ সুদীর্ঘ বারো শতাব্দীকাল ধরে ফুকাহায়ে কিরামের মাঝে নিরবচ্ছিন্নধারায় চলে আসছে। আর তাই এটাকে একপ্রকার ইজমা দাবি করলেও অত্যুক্তি হবে না বোধহয়।
বস্তুত ‘দারুল হারব’ ও ‘দারুল ইসলাম’-এর শরয়ি উৎসমূল জানা থাকলে এসব পরিভাষা পরিবর্তন করে নতুন ইজতিহাদের দাবি করার দুঃসাহস কেউ দেখাত না। কেননা, হাদিস ও আসারের একাধিক বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, ‘দার’ সাধারণত দু’প্রকারেরই হয়ে থাকে। বিভিন্ন বর্ণনায় স্পষ্টভাবে বা ইঙ্গিতে এ প্রকারভেদের দলিল পাওয়া যায়। আমরা সেসব বর্ণনা থেকে এখানে কতিপয় বর্ণনা তুলে ধরছি।
রাসুলুল্লাহ সা. একটি সেনাভিযানকালে সেনাপতিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলতেন :
وَإِذَا لَقِيتَ عَدُوَّكَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ، فَادْعُهُمْ إِلَى ثَلَاثِ خِصَالٍ – أَوْ خِلَالٍ – فَأَيَّتُهُنَّ مَا أَجَابُوكَ فَاقْبَلْ مِنْهُمْ، وَكُفَّ عَنْهُمْ، ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى الْإِسْلَامِ، فَإِنْ أَجَابُوكَ، فَاقْبَلْ مِنْهُمْ، وَكُفَّ عَنْهُمْ، ثُمَّ ادْعُهُمْ إِلَى التَّحَوُّلِ مِنْ دَارِهِمْ إِلَى دَارِ الْمُهَاجِرِينَ
‘আর যখন তোমার শত্রু মুশরিকদের সাক্ষাৎ পাবে, তখন তাদের তিনটি বিষয়ের দিকে আহবান করবে। তারা এগুলো থেকে যেটাই গ্রহন করুক, তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নেবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকবে। (প্রথমে) তাদেরকে ইসলামের দিকে আহবান করবে। যদি তারা তোমার এ আহবানে সাড়া দেয়, তবে তুমি তাদের পক্ষ থেকে তা মেনে নেবে এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে নিবৃত্ত থাকবে। এরপর তুমি তাদেরকে তাদের ‘দার’ (এলাকা বা দেশ) থেকে মুহাজিরদের ‘দার’-এর দিকে চলে যাওয়ার আহবান জানাবে।’ (সহিহু মুসলিম : ৩/১৩৫৭, হা. নং ১৭৩১, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
এ হাদিসে ‘মুশরিকদের দার’ আর ‘মুহাজিরদের দার’ বলে স্পষ্টত ‘দার’ দুটি হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। মুশরিকদের ‘দার’-কে বলা হয় ‘দারুশ শিরক’ বা ‘দারুল হারব’। আর মুহাজিরদের ‘দার’-কে বলা হয় ‘দারুল হিজরাহ’ বা ‘দারুল ইসলাম’।
রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন :
لَا يَقْبَلُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ مُشْرِكٍ بَعْدَمَا أَسْلَمَ عَمَلًا، أَوْ يُفَارِقَ الْمُشْرِكِينَ إِلَى الْمُسْلِمِينَ
‘কোনো মুশরিক ইসলাম গ্রহণের পরও আল্লাহ তার কোনো আমল কবুল করেন না, যতক্ষণ না সে মুশরিকদের (এলাকা) ত্যাগ করে মুসলিমদের কাছে (এলাকাতে) চলে আসে।’ (সুনানুন নাসায়ি : ৫/৮২, হা. নং ২৫৬৮, প্রকাশনী : মাকতাবুল মাতবুআতিল ইসলামিয়া, হালব)
এ হাদিসেও ‘মুশরিকদের ভূমি’ আর ‘মুসলিমদের ভূমি’ বলে ‘দার’ দুটি হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন :
عَقْرُ دَارِ الْإِسْلَامِ بِالشَّامِ
‘দারুল ইসলামের মূলভূমি হলো শামে।’ (আল-মুজামুল কাবির, তাবারানি : ৭/৫৩, হা. নং ৬৩৫৯, প্রকাশনী : মাকতাবাতু ইবনি তাইমিয়া, কায়রো)
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন :
وَكَانَ مِنَ الْأَنْصَارِ مُهَاجِرُونَ لِأَنَّ الْمَدِينَةَ كَانَتْ دَارَ شِرْكٍ، فَجَاءُوا إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةَ الْعَقَبَةِ
‘আর আনসারিদের মাঝেও কতিপয় মুহাজির ছিলেন। কেননা, (হিজরতের পূর্বে) মদিনা ছিল “দারুশ শিরক”। অতঃপর তথা হতে কতিপয় সাহাবি আকাবার রাতে (হিজরত করে) রাসুলুল্লাহ সা.-এর কাছে চলে আসেন।’ (সুনানুন নাসায়ি : ৭/১৪৪, হা. নং ৪১৬৬, প্রকাশনী : মাকতাবুল মাতবুআতিল ইসলামিয়া, হালব)
খালিদ বিন অলিদ রা. খলিফাতুল মুসলিমিনের পক্ষ থেকে হিরায় পাঠানো চিঠিতে লেখেন :
وَجَعَلْتُ لَهُمْ أَيُّمَا شَيْخٍ ضَعُفَ عَنِ الْعَمَلِ أَوْ أَصَابَتْهُ آفَةٌ مِنَ الآفَاتِ أَوْ كَانَ غَنِيا فَافْتَقَرَ وَصَارَ أَهْلُ دِينِهِ يَتَصَدَّقُونَ عَلَيْهِ طَرَحْتُ جِزْيَتَهُ وَعِيلَ مِنْ بَيْتِ مَالِ الْمُسْلِمِينَ. وَعِيَالُهُ مَا أَقَامَ بِدَارِ الْهِجْرَةِ وَدَارِ الإِسْلامِ؛ فَإِنْ خَرَجُوا إِلَى غَيْرِ دَارِ الْهِجْرَةِ وَدَارِ الإِسْلامِ؛ فَلَيْسَ عَلَى الْمُسْلِمِينَ النَّفَقَةَ عَلَى عِيَالِهِمْ.
‘আর আমি তাদের (জিম্মিদের) জন্য এটা নির্ধারণ করেছি যে, কোনো বৃদ্ধ যদি কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়ে যায় অথবা কোনো বিপদে আক্রান্ত হয় অথবা সে ধনী ছিল, কিন্তু পরে দরিদ্র হয়ে গেছে এবং তার ধর্মের লোকেরা তাকে দান-সদকা করতে শুরু করে, তাহলে আমি তার জিজিয়া স্থগিত করে দেবো এবং বাইতুল মাল থেকে তার ও তার পরিবারের ভরণপোষণ দেওয়া হবে; যতক্ষণ পর্যন্ত সে “দারুল হিজরাহ” ও “দারুল ইসলাম”-এ অবস্থান করবে। যদি তারা “দারুল হিজরাহ” ও “দারুল ইসলাম” থেকে বের হয়ে যায়, তাহলে মুসলমানদের ওপর তাদের পরিবারের ভরণপোষণ বহন করার কোনো দায়িত্ব নেই।’ (আল-খারাজ, আবু ইউসুফ : পৃ. নং ১৫৭-১৫৮, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুল আজহারিয়্যা লিত্তুরাস)
এসব বর্ণনা থেকে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ পরিভাষা দুটি পুরোপুরি ইজতিহাদি নয়; বরং এ ব্যাপারে আলাদাভাবে নস পাওয়া যায়। এ নসগুলোতে যেমন ‘দারুল ইসলাম’ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনই এটার পাশপাশি ‘দারুল হিজরাহ’ বা ‘দারুল মুহাজিরিন’ পরিভাষাও ব্যবহৃত হয়েছে। বস্তুত এগুলো সব একই ‘দার’-এর নাম। অনুরূপ এসব বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ‘দারুল হারব’-কে ‘দারুশ শিরক’ ও ‘দারুল মুশরিকিন’-ও বলা হয়।
মোটকথা এখানে আমরা দুটি ‘দার’-এর অস্তিত্ব পরিষ্কারভাবে দেখতে পাই। এক : এমন দার, যেখানে হিজরত করা হয়। এটাকে ‘দারুল হিজরাহ’ বা ‘দারুল ইসলাম’ বলে। দুই : এমন দার, যেখান থেকে অন্য ভূমিতে হিজরত করে চলে আসতে হয়। এটাকে ‘দারুল হারব’ বা ‘দারুশ শিরক’ বলে।
এছাড়াও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাঝে এটা সর্বজনস্বীকৃত যে, ইসলাম ও কুফরের মাঝে তৃতীয় কোনো স্তর নেই। ব্যক্তি হয়তো মুমিন হবে, নয়তো কাফির হবে। গোমরাহ মু’তাজিলারাই একমাত্র ফিরকা, যারা ইসলাম ও কুফরের মাঝে তৃতীয় একটি স্তর নির্ধারণ করে। তারা বলে, এমন কিছু মানুষও আছে, যারা মুমিনও নয় আবার কাফিরও নয়। কিন্তু এটা একটি ভ্রান্ত ধারণা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদা হলো, মুমিন যতই গুনাহগার হোক না কেন, সে ইমানের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যায় না। হ্যাঁ, যার থেকে স্পষ্ট কুফর বা শিরক প্রকাশ পাবে এবং তার মধ্যে তাকফিরের কোনো প্রতিবন্ধকতাও পাওয়া যাবে না, তাহলে সে পরিষ্কার কাফির। দারের বিষয়টিও ঠিক এরূপই। হয়তো দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত থাকবে কিংবা কুফর-শিরক প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠিত থাকে; চাই সেটা পূর্ণাঙ্গ হোক বা অপূর্ণাঙ্গ হোক, সেটাকে ‘দারুল ইসলাম’ বলা হবে। আর যদি কুফর-শিরক প্রতিষ্ঠিত থাকে, সেটাকে ‘দারুল হারব’ বলা হবে। এ মাসআলাটি যার কাছে যতটা স্পষ্ট, তার কাছে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর মাসআলাও ততটা স্পষ্ট হবে।
সুতরাং যারা মনে করে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ নতুন দুটি পরিভাষা, কুরআন-হাদিসে যার কোনো অস্তিত্ব নেই, তাদের এসব নস ভালো করে দেখা উচিত। আর যারা মনে করেন, এসব পরিভাষা পরিবর্তনশীল, তাদের কাছে মূলত ইসলাম ও কুফরের বৈপরীত্য এবং ব্যক্তি ও ভূমির ওপর এর প্রায়োগিক দিকটি স্পষ্ট নয়। নতুবা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন মুমিন ও কাফির হওয়ার বাহিরে তৃতীয় কোনো অবস্থার কথা কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনই ভূমির ব্যাপারেও ইসলামি ও কুফরি ভিন্ন অন্য কোনো গুণে গুণান্বিত করার কথা ভাবা যায় না। ব্যক্তি যেমন হয়তো মুমিন, নয়তো কাফির; ভূমিও তেমনি হয়তো ইসলামি, নয়তো কুফরি হবে।
দ্বিতীয় আলোচনা : ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর পরিচিতি
যেকোনো বিষয়ে ভালোভাবে জানতে বা বুঝতে হলে প্রথমে তার পরিচিতি ভালোভাবে জানতে হয়। তাই এ আলোচনায় আমরা ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর পরিচয় বা সংজ্ঞা তুলে ধরব। সংজ্ঞা বর্ণনার ক্ষেত্রে আমরা চার মাজহাবের ফুকাহায়ে কিরামের মতই তুলে ধরব, যাতে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। প্রথমে আমরা এর আভিধানিক অর্থ নিয়ে আলোকপাত করব, এরপর তার পারিভাষিক বা শরয়ি অর্থ নিয়ে ফুকাহায়ে কিরামের ভাষ্য তুলে ধরব ইনশাআল্লাহ।
আভিধানিক অর্থ :
এখানে আমরা এর শাব্দিক অর্থ এবং সমর্থক কিছু শব্দ উল্লেখ করব, যেন শব্দের ভিন্নতায় বা ভুল শাব্দিক অর্থের কারণে কাউকে বিভ্রান্ত হতে না হয়। ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ পরিভাষা দুটিতে তিনটি শব্দ আছে। যথা : ‘দার’, ‘ইসলাম’ ও ‘হারব’। আমরা শব্দ তিনটির আলাদা আলাদা অর্থ বর্ণনা করে পরে সমষ্টিগত অর্থও বর্ননা করব ইনশাআল্লাহ।
‘দার’ অর্থ আঙিনা, ঘর ও মহল্লা। বসবাসের স্থানকে ‘দার’ বলা হয়। সাধারণত ‘দার’ বলতে শহর বুঝানো হয়ে থাকে। ‘দার’-এর বহুবচন হলো ‘দিয়ার’। একাধিক শহর মিলে গঠিত দেশকে ‘দিয়ার’ বলা হয়।
আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা-তে বলা হয়েছে :
الدَّارُ لُغَةً اسْمٌ جَامِعٌ لِلْعَرْصَةِ وَالْبِنَاءِ وَالْمَحَلَّةِ. وَفِي كُلِّيَّاتِ أَبِي الْبَقَاءِ: الدَّارُ اسْمٌ لِمَا يَشْتَمِل عَلَى بُيُوتٍ وَمَنَازِل وَصَحْنٍ غَيْرِ مَسْقُوفٍ. وَهِيَ مِنْ دَارَ يَدُورُ، وَسُمِّيَتْ بِذَلِكَ لِكَثْرَةِ حَرَكَاتِ النَّاسِ فِيهَا وَاعْتِبَارًا بِدَوَرَانِهَا الَّذِي لَهَا بِالْحَائِطِ، وَجَمْعُهَا أَدْوُرٌ، وَدُورٌ، وَالْكَثِيرُ دِيَارٌ، وَهِيَ الْمَنَازِل الْمَسْكُونَةُ وَالْمَحَال. وَكُل مَوْضِعٍ حَل بِهِ قَوْمٌ فَهُوَ دَارُهُمْ، وَمِنْ هُنَا سُمِّيَتِ الْبَلْدَةُ دَارًا، وَالصَّقْعُ دَارًا. وَقَدْ تُطْلَقُ الدَّارُ عَلَى الْقَبَائِل مَجَازًا.
‘আরবিতে ‘দার’-এর আভিধানিক অর্থ আঙিনা, ঘর ও মহল্লা। ‘দার’ বলতে সাধারণত কয়েকটি ঘর, বাড়ি ও ছাদবিহীন আঙিনা মিলে গঠিত এরিয়াকে বুঝানো হয়ে থাকে; যেমনটি আবুল বাকা রহ.-এর কুল্লিয়াতে বলা হয়েছে। শব্দটি دَارَ يَدُوْرُ دَوْرًا ক্রিয়ামূল থেকে নির্গত হয়েছে, যার অর্থ আবর্তিত হওয়া, চক্কর দেওয়া। ঘরকে ‘দার’ এজন্যই বলা হয় যে, মানুষ ঘরে বারবার নড়াচড়া (আসা-যাওয়া) করে এবং ঘর দেয়ালের চতুর্দিক থেকে বৃত্তাকারে আবর্তিত হয়ে থাকে। এর বহুবচন হলো : أَدْوُرٌ، وَدُوْرٌ وَدِيَارٌ। যে স্থান বা ভূখণ্ডে কোনো জাতি বসবাস করে, সেটাকে তাদের ‘দার’ বলা হয়। এজন্যই শহর ও ভূখণ্ডকে ‘দার’ বলা হয়। রূপক অর্থে ‘দার’ শব্দটি কখনো গোত্রের জন্যও ব্যবহার হয়ে থাকে।’ (আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা : ২০/১৯৮, প্রকাশনী : অজারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ুনিল ইসলামিয়্যা, কুয়েত)
‘ইসলাম’ অর্থ আনুগত্য করা, আত্মসমর্পণ করা। এটা سلم থেকে নির্গত হয়েছে। সিন, লাম ও মিমযোগে গঠিত শব্দ অধিকাংশ সময় সুস্থতা ও নিরাপত্তার অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইসলাম ধর্ম যেহেতু অস্বীকৃতি ও অবাধ্যতা থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ণভাবে আনুগত্য করে চলার নাম, তাই অর্থের মূল ধারণ করায় ‘ইসলাম’ নামটি আভিধানিকভাবে যথার্থ।
ইমাম ইবনে ফারিস রাজি রহ. বলেন :
(سَلِمَ) السِّينُ وَاللَّامُ وَالْمِيمُ مُعْظَمُ بَابِهِ مِنَ الصِّحَّةِ وَالْعَافِيَةِ ; وَيَكُونُ فِيهِ مَا يَشِذُّ، وَالشَّاذُّ عَنْهُ قَلِيلٌ، فَالسَّلَامَةُ: أَنْ يَسْلَمَ الْإِنْسَانُ مِنَ الْعَاهَةِ وَالْأَذَى. قَالَ أَهْلُ الْعِلْمِ: اللَّهُ جَلَّ ثَنَاؤُهُ هُوَ السَّلَامُ ; لِسَلَامَتِهِ مِمَّا يَلْحَقُ الْمَخْلُوقِينَ مِنَ الْعَيْبِ وَالنَّقْصِ وَالْفَنَاءِ. قَالَ اللَّهُ جَلَّ جَلَالُهُ: {وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى دَارِ السَّلَامِ} [يونس: ২৫]، فَالسَّلَامُ اللَّهُ جَلَّ ثَنَاؤُهُ، وَدَارُهُ الْجَنَّةُ. وَمِنَ الْبَابِ أَيْضًا الْإِسْلَامُ، وَهُوَ الِانْقِيَادُ ; لِأَنَّهُ يَسْلَمُ مِنَ الْإِبَاءِ وَالِامْتِنَاعِ
‘(সালিমা)। সিন, লাম ও মিমযোগে গঠিত অধিকাংশ শব্দে সুস্থতা ও মুক্তির অর্থ রয়েছে। কখনো ব্যতিক্রমও হয়; যদিও এর সংখ্যা নিতান্তই কম। অতএব, سلامة (সালামাহ) অর্থ বিপদ ও কষ্ট থেকে মানুষের নিরাপদ থাকা। উলামায়ে কিরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা হলেন سلام (সালাম)। যেহেতু তিনি দোষ, ত্রুটি ও বিনাশ হওয়া থেকে মুক্ত, যা মাখলুকের গুণাগুণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর আল্লাহ আহবান করেন শান্তি-নিরাপত্তার আবাসের দিকে”। [সুরা ইউনুস : ২৫] আল্লাহ হলেন শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা এবং জান্নাত হলো তাঁর আবাস। এ শব্দ থেকেই এসেছে, الإسلام (আল-ইসলাম)। এর অর্থ মান্য করা, আনুগত্য প্রদর্শন করা। (সুস্থতা ও নিরাপত্তার অর্থের সাথে ইসলামের অর্থের পুরাই মিল রয়েছে।) কেননা, এটা অস্বীকৃতি ও অবাধ্যতা থেকে (মুসলিমকে) নিরাপদ করে।’ (মাকায়িসুল লুগাহ : ৩/৯০, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)
শরয়ি পরিভাষায় শেষ নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আনিত দ্বীন ও জীবনব্যবস্থাকে ‘ইসলাম’ বলে। রাসুলুল্লাহ সা. হাদিসে জিবরিলে এ ‘ইসলাম’-এর দিকে ইঙ্গিত করে বলেন :
الْإِسْلَامُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَتُقِيمَ الصَّلَاةَ، وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ، وَتَصُومَ رَمَضَانَ، وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إِنِ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلًا
‘ইসলামের সারমর্ম হলো, তুমি এ সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসুল, নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, জাকাত আদায় করবে, রমজান মাসের রোজা রাখবে এবং সামর্থ্য থাকলে বাইতুল্লাহর হজ করবে।’ (সহিহু মুসলিম : ১/৩৬, হা. নং ৮, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
সুতরাং যেকোনো আনুগত্যের নামই ইসলাম নয়; বরং আনুগত্য হতে হবে একমাত্র আল্লাহর দেওয়া বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে। আবার শুধু বিধিনিষেধের ক্ষেত্রে আনুগত্য করাই যথেষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তা শেষ নবি মুহাম্মাদ সা.-এর আনিত শরিয়তের অনুকূলে হবে। অতএব, প্রকৃত ইসলাম রাসুলুল্লাহ সা. কর্তৃক আনিত আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার নাম। এতে যে কমবেশ করবে সে প্রকৃত ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে।
‘হারব’ শব্দের সাধারণ অর্থ যুদ্ধ। তবে এর আরও একাধিক অর্থ আছে। যেমন একটি অর্থ হলো বিদ্বেষ ও দূরত্ব। ‘দারুল হারব’ কথাটিতে এ দ্বিতীয় অর্থই উদ্দেশ্য, প্রথম অর্থ নয়। কেননা, ‘দারুল হারব’ হওয়ার জন্য যুদ্ধ-কবলিত দেশ হওয়া জরুরি নয়; বরং তথায় কুফরি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলেই তা ‘দারুল হারব’ বলে গণ্য হয়। তাই সাধারণভাবে ‘দারুল হারব’ বলতে যুদ্ধ-কবলিত রাষ্ট্র হওয়ার যে ধারণা প্রচলিত আছে, তা পুরোপুরি সঠিক নয়।
ইমাম আবুল ফজল শামসুদ্দিন বা’লি রহ. বলেন :
قوله: “الحَرْبِيُّ” مَنْسُوْبٌ إِلَى الْحَرْبِ، وَهُوَ القِتَالُ، وَدَارُ الْحَرْبِ، أَيْ: دَارُ التَّبَاعُدِ وَالْبَغْضَاءِ، فَالْحَرْبِيُّ بِالْاِعْتِبَارِ الثَّانِيْ.
‘“হারবি” কথাটি “হারব”-এর দিকে সম্বন্ধিত। “হারব” অর্থ যুদ্ধ, আর “দারুল হারব” অর্থ পরস্পরে দূরত্ব ও বিদ্বেষের দেশ। সুতরাং “হারবি” বলা হয় দ্বিতীয় অর্থের দিকে লক্ষ করে।’ (আল-মুতলি’ আলা আলফাজিল মুকনি’ : পৃ. নং ২৬৯, প্রকাশনী : মাকতাবাতুস সাওয়াদি)
বুঝা গেল, ‘দারুল হারব’ হওয়ার জন্য তথায় যুদ্ধ চলমান থাকা জরুরি নয়। ‘হারব’-এর প্রসিদ্ধ অর্থ ‘যুদ্ধ’ হলেও এখানে তার প্রসিদ্ধ অর্থ উদ্দেশ্য নেওয়া হয়নি; বরং এখানে ‘দূরত’ ও ‘বিদ্বেষ’ অর্থ উদ্দিষ্ট। কাফির-শাসিত রাষ্ট্রের সাথে যেহেতু মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক ও হৃদ্যতা নেই; বরং তাদের সাথে রয়েছে বিদ্বেষ ও শত্রুতার সম্পর্ক, তাই তাদের রাষ্ট্রকে ইসলামি পরিভাষায় ‘দারুল হারব’ বলা হয়।
অবশ্য ‘হারব’-এর প্রসিদ্ধ অর্থ ধরেও এর একটি ব্যাখ্যা করা যায়। সেটি হলো, ‘দারুল হারব’ অর্থ আমরা যুদ্ধের দেশ বা যুদ্ধ-কবলিত দেশও বলতে পারি। কেননা, এখানে বর্তমানে যুদ্ধ না থাকলেও এর উপযুক্ত হওয়াই তার এ নাম হওয়ার জন্য যথেষ্ট। কাফির-শাসিত রাষ্ট্র পদানত করে তথায় আল্লাহর কালিমা প্রতিষ্ঠা করা যেহেতু ইসলামের নির্দেশ, বিধায় সেটাকে রূপক অর্থে যুদ্ধের দেশ বলতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। অর্থাৎ বর্তমানে যুদ্ধ না থাকলেও সেটা যুদ্ধের উপযুক্ত একটি রাষ্ট্র। যেমন আমরা বলে থাকি, ‘ভাত রান্না হচ্ছে’। মূলত রান্না করা হয় চাল, কিন্তু সেটা যেহেতু শীঘ্রই ভাতে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে, বিধায় অগ্রীম তাকে ‘ভাত’ নামেও ডাকা হয়। কাফিরদের রাষ্ট্রের বিষয়টিও ঠিক এমনই। তথায় যুদ্ধ না থাকলেও ইসলামের দাবি অনুসারে শীঘ্রই তাদের সাথে যুদ্ধে জড়াতে হবে, সে হিসেবে অগ্রীম সে দেশকে ‘দারুল হারব’ বা যুদ্ধের রাষ্ট্র বলা পুরোপুরিই যৌক্তিক।
উল্লেখ্য যে, ‘দারুল হারব’-কে ফুকাহায়ে কিরাম ‘দারুশ শিরক বা ‘দারুল কুফর’ অভিধায়ও অভিহিত করে থাকেন। এ থেকেও প্রমাণ হয় যে, ‘দারুল হারব’ বলতে বাস্তবিক যুদ্ধ-কবলিত দেশ হওয়া জরুরি নয়। কেননা, পারিভাষিকভাবে ‘দারুশ শিরক’ বা ‘দারুল কুফর’ হলো তার সমর্থক শব্দ। আর এ দুটি শব্দের মধ্যে যুদ্ধের অর্থ নেই। অতএব, শুধু ‘দারুল হারব’ শব্দ দেখেই এ ধারণা করা ভুল হবে যে, দারুল হারব হওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে প্রকৃতই যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হবে। এছাড়াও এ দুটি অতিরিক্ত শব্দ থেকে এর পারিভাষিক অর্থের ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। কেননা, যেরকমভাবে ‘দারুল ইসলাম’ পরিভাষাটিতে ‘দার’ শব্দটিকে ইসলামের দিকে ইজাফত করা হয়েছে বিধায় তার সংজ্ঞায় বলা হয়, যে রাষ্ট্রে ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকবে, সেটাই ‘দারুল ইসলাম’। অনুরূপ ‘দারুল কুফর বা ‘দারুশ শিরক’ পরিভাষাদ্বয়েও ‘দার’ শব্দটিকে কুফর বা শিরকের দিকে ইজাফত করা হয়েছে বিধায় তার সংজ্ঞায় বলা হবে যে, যে রাষ্ট্রে কুফরি বা শিরকি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকবে, সেটাই ‘দারুল কুফর’ বা ‘দারুশ শিরক’। বস্তুত ‘দারুল কুফর’, ‘দারুশ শিরক ও ‘দারুল হারব’―এ তিনটির মাঝে শাব্দিক ব্যবধান ছাড়া পরিভাষাগত কোনো পার্থক্য নেই।
পারিভাষিক অর্থ :
কোনো সন্দেহ নেই যে, ‘দার’-এর পরিচয়ের ক্ষেত্রে মূল দেখার বিষয় হলো, কর্তৃত্ব, শক্তি ও রাজত্ব কার। যার রাজত্ব ও শাসনব্যবস্থা জারি থাকবে, তার ভিত্তিইে ‘দার’-কে দারুল ইসলাম বা দারুল হারব বলা হবে। এখানে অন্য কোনো বিষয়, যেমন : নিজ ধর্মের জনসংখ্যা বেশি হওয়া, ধর্মের কিছু বিধান পালন করার সুযোগ থাকা ইত্যাদি বিবেচ্য হবে না। এগুলোর কারণে ‘দার’-এর বিধানে কোনোরূপ পরিবর্তন আসবে না। বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য আমরা এখানে ‘দার’-এর সংজ্ঞা নিয়ে ফুকাহায়ে কিরামের উক্তিগুলো তুলে ধরছি।
১. ইমাম মালিক রহ. মক্কা বিজয়ের পূর্বের মক্কার ব্যাপারে বলেন :
وَكَانَتْ الدَّارُ يَوْمئِذٍ دَارَ الْحَرْبِ لِأَنَّ أَحْكَامَ الْجَاهِلِيَّةِ كَانَتْ ظَاهِرَةً يَوْمئِذٍ.
‘আর সেসময় মক্কা ছিল দারুল হারব। কেননা, তখন (মক্কায়) জাহিলি যুগের (কুফরি) আইন ও সংবিধান প্রতিষ্ঠিত ছিল। (আল-মুদাওওয়ানাতুল কুবরা : ১/৫১১, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
ইমাম জাসসাস রহ. বলেন :
حُكْمُ الدَّارِ إِنَّمَا يَتَعَلَّقُ بِالظُّهُوْرِ وَالْغَلَبَةِ، وَإِجْرَاءِ حُكْمِ الدِّيْنِ بِهَا، وَالدَّلِيْلُ عَلَى صِحَّةِ ذَلِكَ: أَنَّا مَتَى غَلَبْنَا عَلَى دَارِ الْحَرْبِ، وَأَجْرَيْنَا أَحْكَامَنَا فِيْهَا: صَارَتْ دَارَ الْإِسْلَامِ، سَوَاءٌ كَانَتْ مُتَاخِمَةً لِدَارِ الْإِسْلَامِ أَوْ لَمْ تَكُنْ، فَكَذَلِكَ الْبَلَدُ مِنْ دَارْ الْإِسْلَامْ، إِذَا غَلَبَ عَلَيْهِ أَهْلُ الْكُفْرِ، وَجَرَى فِيْهِ حُكْمُهُمْ: وَوَجَبَ أَنْ يَكُوْنَ مِنْ دَارِ الْحَرْبِ. وَلَا مَعْنَى لِاِعْتِبَارِ بَقَاءِ ذِمِّيٍّ أَوْ مُسْلِمٍ آَمِنًا عَلَى نَفْسِهِ؛ لِأَنَّ الْمُسْلِمَ قَدْ يَأْمَنُ فِيْ دَارِ الْحَرْبِ، وَلَا يَسْلِبُهُ ذَلِكَ حُكْمَ دَارِ الْحَرْبِ، وَلَا يُوْجِبُ أَنْ يَكُوْنَ مِنْ دَارِ الْإِسْلَامِ.
‘“দার”-এর হুকুম বিজয়, কর্তৃত্ব ও কোনো ধর্মের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার সাথে সম্পর্কিত। এ দাবির পক্ষে দলিল হলো, আমরা যখন “দারুল হারব” এর ওপর বিজয়ী হই এবং তথায় আমাদের শাসনব্যবস্থা চালু করি, তখন সেটা “দারুল ইসলাম” হয়ে যায়; চাই সে রাষ্ট্রটি কোনো “দারুল ইসলাম” এর সংলগ্ন হোক বা না হোক। তাহলে অনুরূপ “দারুল ইসলাম”-এর কোনো শহরের ওপর যখন কাফিররা বিজয়ী হবে এবং তথায় তাদের কুফরি শাসনব্যবস্থা চালু হবে, তাহলে সেটা অবশ্যই “দারুল হারব”-এ পরিণত হয়ে যাবে। মুসলিম ও জিম্মিদের পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তিতে তাদের নিরাপদ থাকাকে বিবেচনা করার কোনোই যৌক্তিকতা নেই। কেননা, মুসলমানও তো কখনও কখনও “দারুল হারব”-এ নিরাপদ থাকে; অথচ এর কারণে এটা রাষ্ট্রকে “দারুল হারব” হওয়া থেকে বের করে দেয় না এবং “দারুল ইসলাম”-এ রূপান্তরিত হয়ে যাওয়াকে আবশ্যক করে না।’ (শারহু মুখতাসারিত তাহাবি : ৭/২১৬-২১৭, প্রকাশনী : দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়্যা, বৈরুত)
৩. ইমাম সারাখসি রহ. স্বীয় ‘মাবসুত’-এ সাহিবাইনের-এর পক্ষ থেকে দলিল দিয়ে বলেন :
الْبُقْعَة إنَّمَا تُنْسَبُ إلَيْنَا أَوْ إلَيْهِمْ بِاعْتِبَارِ الْقُوَّةِ وَالْغَلَبَةِ، فَكُلُّ مَوْضِعٍ ظَهَرَ فِيهِ حُكْمُ الشِّرْكِ فَالْقُوَّةُ فِي ذَلِكَ الْمَوْضِعِ لِلْمُشْرِكِينَ فَكَانَتْ دَارَ حَرْبٍ، وَكُلُّ مَوْضِعٍ كَانَ الظَّاهِرُ فِيهِ حُكْمُ الْإِسْلَامِ فَالْقُوَّةُ فِيهِ لِلْمُسْلِمِينَ.
‘স্থান আমাদের (মুসলমানদের) সাথে বা তাদের (কাফিরদের) সাথে সম্পৃক্ত হয় শক্তি ও বিজয়ের ভিত্তিতে। অতএব, যে জায়গায় শিরকের সংবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকবে, বুঝতে হবে সেখানে মুশরিকদের শক্তি বিজয়ী; বিধায় সেটা হবে “দারুল হারব”। আর যে জায়গায় ইসলামের সংবিধান বিজয়ী থাকবে, বুঝতে হবে সেখানে মুসলমানদের শক্তি বিজয়ী।’ (আল-মাবসুত, সারাখসি : ১০/১১৪, প্রকাশনী : দারুল মারিফা, বৈরুত)
তিনি শারহুস সিয়ারে আরও বলেন :
الْمَوْضِع الَّذِي لَا يَأْمَنُ فِيهِ الْمُسْلِمُونَ مِنْ جُمْلَةِ دَارِ الْحَرْبِ، فَإِنَّ دَارَ الْإِسْلَامِ اسْمٌ لِلْمَوْضِعِ الَّذِي يَكُونُ تَحْتَ يَدِ الْمُسْلِمِينَ، وَعَلَامَةُ ذَلِكَ أَنْ يَأْمَنَ فِيهِ الْمُسْلِمُونَ.
‘যে স্থানে মুসলমানরা নিরাপদ নয়, সেটাও “দারুল হারব”-এর অন্তর্গত। কেননা, “দারুল ইসলাম” বলা হয় ওই জায়গাকে, যা মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আছে। আর এর নিদর্শন হলো, তথায় মুসলমানরা নিরাপদে থাকবে।’ (শারহুস সিয়ারিল কাবির : পৃ. নং ১২৫৩, প্রকাশনী : আশ-শিরকাতুশ শারকিয়্যা)
তিনি আরও বলেন :
الْمُعْتَبَرَ فِي حُكْمِ الدَّارِ هُوَ السُّلْطَانُ فِي ظُهُورِ الْحُكْمِ
‘“দার” নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় হলো শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে (ইসলাম বা কুফরের) কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা।’ (শারহুস সিয়ারিল কাবির : পৃ. নং ১৭০৩, প্রকাশনী : আশ-শিরকাতুশ শারকিয়্যা)
৪. ইমাম ইবনে হাজাম রহ. বলেন :
الدَّارَ إنَّمَا تُنْسَبُ لِلْغَالِبِ عَلَيْهَا، وَالْحَاكِمُ فِيهَا، وَالْمَالِكُ لَهَا.
‘দেশকে (ইসলাম বা কুফরের দিকে) সম্বন্ধিত করা হয় দেশটির বিজয়ী শক্তি, শাসক ও অধিকারীর ভিত্তিতে।’ (আল-মুহাল্লা : ১২/১২৬, প্রকাশনী : দারুল ফিকর, বৈরুত)
৫. ইমাম কাসানি রহ. সাহিবাইনের পক্ষে দলিল পেশ করতে গিয়ে বলেন :
أَنَّ قَوْلَنَا دَارُ الْإِسْلَامِ وَدَارُ الْكُفْرِ إضَافَةُ دَارٍ إلَى الْإِسْلَامِ وَإِلَى الْكُفْرِ، وَإِنَّمَا تُضَافُ الدَّارُ إلَى الْإِسْلَامِ أَوْ إلَى الْكُفْرِ لِظُهُورِ الْإِسْلَامِ أَوْ الْكُفْرِ فِيهَا، كَمَا تُسَمَّى الْجَنَّةُ دَارَ السَّلَامِ، وَالنَّارُ دَارَ الْبَوَارِ؛ لِوُجُودِ السَّلَامَةِ فِي الْجَنَّةِ، وَالْبَوَارِ فِي النَّارِ وَظُهُورُ الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِهِمَا، فَإِذَا ظَهَرَ أَحْكَامُ الْكُفْرِ فِي دَارٍ فَقَدْ صَارَتْ دَارَ كُفْرٍ فَصَحَّتْ الْإِضَافَةُ، وَلِهَذَا صَارَتْ الدَّارُ دَارَ الْإِسْلَامِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْإِسْلَامِ فِيهَا مِنْ غَيْرِ شَرِيطَةٍ أُخْرَى، فَكَذَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْكُفْرِ فِيهَا.
‘আমাদের “দারুল ইসলাম” ও “দারুল কুফর” কথা দুটিতে “দার”-কে ইসলাম ও কুফরের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে। আর “দার”-কে ইসলাম ও কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয় তাতে ইসলাম কিংবা কুফর প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে। যেমন : জান্নাতকে “দারুস সালাম” এবং জাহান্নামকে “দারুল বাওয়ার” নামে ডাকা হয়; যেহেতু জান্নাতে সালাম বা শান্তি রয়েছে আর জাহান্নামে বাওয়ার বা ধ্বংস রয়েছে। আর ইসলাম ও কুফর প্রতিষ্ঠিত হয় তার আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারা। অতএব, যখন কোনো ভূখণ্ডে কুফরি আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন তা “দারুল কুফর” হয়ে যাবে। তাই “দার”-কে এভাবে ইসলাম কিংবা কুফরের সাথে সম্পৃক্ত করাটা সঠিক। এজন্য ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা লাভের দ্বারাই কোনো ভূখণ্ড “দারুল ইসলাম” হিসেবে গণ্য হয়। এই একটি মাত্র শর্ত ছাড়া এখানে আর কোনো শর্ত নেই। অনুরূপ “দারুল ইসলাম”-এ কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই সেটা “দারুল কুফর”-এ রূপান্তরিত হয়।’ (বাদায়িউস সানায়ি : ৭/১৩০-১৩১, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
৬. কাজি আবু ইয়ালা হাম্বলি রহ. বলেন :
كُلُّ دَارٍ كَانَـتِ الْغَلَبَةُ فِيْهَا لِأَحْكَامِ الْإِسْلَامِ دُوْنَ الْكُفْرِ فَهِىَ دَارُ الْإِسْلَامِ. وَكُلُّ دَارٍ كَانَـتِ الْغَلَبَةُ فِيْهَا لِأَحْكَامِ الْكُفْرِ دُوْنَ أَحْكَامِ الْإِسْلَامِ فَهِىَ دَارُ الْكُفْرِ.
‘প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলামি বিধিবিধান বিজয়ী, কুফরি সংবিধান নয়, তা “দারুল ইসলাম”। আর প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে কুফরি বিধিবিধান বিজয়ী, ইসলামি সংবিধান নয়, তা “দারুল কুফর”।’ (আল-মুতামাদ ফি উসুলিদ্দিন : পৃ. নং ২৭৬, প্রকাশনী : দারুল মাশরিক, বৈরুত)
৭. ইমাম ইবনে মুফলিহ মাকদিসি রহ. বলেন :
فَكُلّ دَار غَلَبَ عَلَيْهَا أَحْكَام الْمُسْلِمِينَ فَدَارُ الْإِسْلَام وَإِنْ غَلَبَ عَلَيْهَا أَحْكَام الْكُفَّار فَدَارُ الْكُفْر وَلَا دَارَ لِغَيْرِهِمَا
‘প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত, তা “দারুল ইসলাম”। আর যদি কোনো ভূখণ্ডে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে তা “দারুল কুফর”। এ দু’প্রকারের বাইরে আর কোনো “দার” নেই।’ (আল-আদাবুশ শারইয়্যা ওয়াল মিনহুল মারইয়্যা : ১/১৯০, প্রকাশনী : আলামুল কুতুব, বৈরুত)
৮. ইমাম ইবনে কাইয়িম জাওজিয়া রহ. অধিকাংশ ফকিহের মতামত উল্লেখ করত বলেন :
قَالَ الْجُمْهُورُ: دَارُ الْإِسْلَامِ هِيَ الَّتِي نَزَلَهَا الْمُسْلِمُونَ، وَجَرَتْ عَلَيْهَا أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ، وَمَا لَمْ تَجْرِ عَلَيْهِ أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ لَمْ يَكُنْ دَارَ إِسْلَامٍ، وَإِنْ لَاصَقَهَا، فَهَذِهِ الطَّائِفُ قَرِيبَةٌ إِلَى مَكَّةَ جِدًّا وَلَمْ تَصِرْ دَارَ إِسْلَامٍ بِفَتْحِ مَكَّةَ.
‘জমহুরে ফুকাহা বলেন, “দারুল ইসলাম” ওই ভূখণ্ডকে বলে, যেখানে মুসলমানরা বসবাস করে এবং তথায় ইসলামি বিধিবিধান চালু থাকে। আর যেখানে ইসলামি বিধিবিধান চালু থাকবে না, সেটা “দারুল ইসলাম” হবে না; যদিও তা দারুল ইসলামের সাথে লাগোয়া অঞ্চল হোক। দেখো এই যে মক্কার অদূরেই অবস্থিত তায়িফ, মক্কা বিজয় সত্ত্বেও সেটা “দারুল ইসলাম” হয়ে যায়নি।’ (আহকামু আহলিজ জিম্মাহ : ২/৭২৮, প্রকাশনী : রামাদি, দাম্মাম)
৯. আল্লামা মানসুর বিন ইউনুস হাম্বলি রহ. বলেন :
وَتَجِبُ الْهِجْرَةُ عَلَى مَنْ يَعْجِزُ عَنْ إظْهَارِ دِينِهِ بِدَارِ الْحَرْبِ، وَهِيَ مَا يَغْلِبُ فِيهَا حُكْمُ الْكُفْرِ
‘“দারুল হারব”-এ অবস্থান করে যে ব্যক্তি দ্বীন প্রকাশ্যে পালন করতে অক্ষম হবে, তার জন্য হিজরত করা আবশ্যক। আর “দারুল হারব” হলো এমন ভূখণ্ড, যেখানে কুফরের সংবিধান বিজয়ী।’ (কাশশাফুল কিনা’ আনিল ইকনা’ : ৩/৪৩, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)
১০. ইমাম আবুল হাসান আলাউদ্দিন মুরাদাবি রহ. বলেন :
وَدَارُ الْحَرْبِ: مَا يَغْلِبُ فِيهَا حُكْمُ الْكُفْرِ.
‘আর “দারুল হারব” ওই ভূখণ্ডকে বলে, যেখানে কুফরি সংবিধান বিজয়ী থাকে।’ (আল-ইনসাফ ফি মারিফাতির রাজিহি মিনাল খিলাফ : ৪/১২১, প্রকাশনী : দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)
১১. ইমাম ইবনে কুদামা রহ. বলেন :
وَمَتَى ارْتَدَّ أَهْلُ بَلَدٍ، وَجَرَتْ فِيهِ أَحْكَامُهُمْ، صَارُوا دَارَ حَرْبٍ فِي اغْتِنَامِ أَمْوَالِهِمْ، وَسَبْيِ ذَرَارِيِّهِمْ الْحَادِثِينَ بَعْدَ الرِّدَّةِ، وَعَلَى الْإِمَامِ قِتَالُهُمْ،
‘যখন কোনো শহরবাসী মুরতাদ হয়ে যাবে এবং তাদের মাঝে তাদের (কুফরি) সংবিধান চালু করবে তখন তাদের সম্পদ গনিমত হওয়া এবং মুরতাদ হওয়ার পর জন্মগ্রহণ করা সন্তান-সন্তুতিকে দাস-দাসী বানানোর ক্ষেত্রে তারা সবাই “দারুল হারব”-এর অধিবাসী বলে বিবেচিত হবে। আর মুসলিম খলিফার ওপর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আবশ্যক হয়ে যাবে।’ (আল-মুগনি : ৯/১৭, প্রকাশনী : মাকতাবাতুল কাহিরা, মিশর)
১২. আল্লামা শাওকানি রহ. বলেন :
اَلْاِعْتِبَارُ بِظُهُوْرِ اْلكَلِمَةِ فَإِنْ كَانَتِ الْأَوَامِرُ وَالنَّوَاهِيْ فِي الدَّارِ لِأَهْلِ الْإِسْلِامِ بِحَيْثُ لَا يَسْتَطِيْعُ مَنْ فِيْهَا مِنَ الْكُفَّارِ أَنْ يَتَظَاهَرَ بِكُفْرِهِ إِلاَّ لِكَوْنِهِ مَأْذُوْنًا لَهُ بِذَلِكَ مِنْ أَهْلِ الْإِسْلَامِ فَهَذِهِ دَارُ إِسْلَامٍ وَلَا يَضُرُّ ظُهُوْرُ الْخِصَالِ الْكُفْرِيَّةِ فِيْهَا لِأَنَّهَا لَمْ تَظْهَرْ بِقُوَّةِ الْكُفَّارِ وَلَا بِصَوْلَتِهِمْ كَمَا هُوَ مُشَاهَدٌ فِيْ أَهْلِ الذِّمَّةِ مِنَ الْيَهُوْدِ وَالنَّصَارَى وَالْمُعَاهِدِيْنَ السَّاكِنِيْنَ فِي الْمَدَائِنِ الْإِسْلَامِيَّةِ وَإِذَا كَانَ الْأَمْرُ الْعَكْسَ فَالدَّارُ بِالْعَكْسِ.
‘ধর্মের বিজয়ের ভিত্তিতে “দার” বিবেচ্য হবে। অতএব, যদি কোনো ভূখণ্ডে আদেশ-নিষেধ জাতীয় সকল আইন-কানুন মুসলিমদের হয়, তথায় অবস্থানকারী কাফিররা মুসলিমদের পক্ষ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হওয়া ছাড়া কুফরি কোনো কাজ করার ক্ষমতা রাখে না, তাহলে এটা হলো “দারুল ইসলাম”। এ ভূখণ্ডে কিছু কুফরি কাজকর্মের অস্তিত্ব থাকায় “দারুল ইসলাম” হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। কেননা, এসব কুফরি কাজ কাফিরদের শক্তি ও দাপটের ভিত্তিতে প্রকাশ হয়নি; যেমনটি ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসরত ইহুদি, খ্রিষ্টান ও চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম জিম্মিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর বিষয়টি যদি এর (তথা দারুল ইসলামের সংজ্ঞার) উল্টো হয়, তাহলে “দার”ও উল্টোটা (তথা “দারুল হারব”) হবে।’ (আস-সাইলুল জাররার : পৃ. নং ৯৭৬, প্রকাশনী : দারু ইবনি হাজাম)
১৩. সাইয়িদ কুতুব শহিদ রহ. বলেন :
يَنْقَسِمُ الَعَالَمُ فِيْ نَظَرَ الْإِسْلَامِ وَفِيْ اعْتِبَارِ الْمُسْلِمِ إِلَى قِسْمَيْنِ اثْنَيْنِ لَا ثَالِثَ لَهُمَا. اَلْأَوَّلُ : دَارَ الْإِسْلَامِ. وَتشْمِلُ كُلَّ بَلَدٍ تُطَبَّقُ فِيْهِ أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ، وَتَحْكُمُهُ شَرِيْعَةُ الْإِسْلَامِ… فَالْمَدَارُ كُلُّهُ فِي اعْتِبَارِ بَلَدٍ مَّا دَارَ إِسْلَامٍ هُوَ تَطْبِيْقُهُ لِأَحْكَامِ الْإِسْلَامِ وَحُكْمُهُ بِشَرِيْعَةِ الْإِسْلَامِ. اَلثَّانِيْ : دَارُ الْحَرْبِ. وَتَشْمِلُ كُلَّ بَلَدٍ لَا تُطَبَّقُ فَيْهِ أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ، وَلَا يُحْكَمُ بَشَرِيْعَةِ الْإٍسْلَامِ… فَالْمَدَارُ كُلُّهُ فِي اعْتِبَارِ بَلَدٍ مَّا دَارَ حَرْبٍ هُوَ عَدَمُ تَطْبِيْقِهِ لِأَحْكَامِ الْإِسْلَامِ وَعَدَمُ حُكْمِهِ بِشَرِيْعَةِ الْإِسْلَامِ.
‘ইসলাম ও মুসলিমদের বিবেচনায় পুরো বিশ্ব দু’ভাগে বিভক্ত, যার তৃতীয় কোনো প্রকার নেই। প্রথম হলো “দারুল ইসলাম”। এটা প্রত্যেক এমন ভূখণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করা হয় এবং ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা হয়। …সুতরাং কোনো দেশ “দারুল ইসলাম” হওয়ার মূলভিত্তি হলো ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করা এবং শরিয়া অনুসারে বিচার-ফয়সালা করা। দ্বিতীয় হলো “দারুল হারব”। এটা প্রত্যেক এমন ভূখণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করা হয় না এবং ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা হয় না। …সুতরাং কোনো দেশ “দারুল হারব” হওয়ার মূলভিত্তি হলো ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন না করা এবং শরিয়া অনুসারে বিচার-ফয়সালা না করা।’ (ফি জিলালিল কুরআন : ২/৩৪৮, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুশ শামিলা)
১৪. শাইখ মুহাম্মাদ সাদকি বিন আহমাদ গাজ্জি বলেন :
دَارُ الْحَرْبِ هِيَ الدَّارُ الَّتِيْ لَا يَأْمَنُ فِيْهَا الْمُسْلِمُوْنَ، وَلَا يُحْكَمُ فِيْهَا بِشَرْعِ اللهِ، فَكُلُّ مَكَانٍ لَا يَأْمَنُ فَيْهِ الْمُسْلِمُوْنَ، وَلَا يُحْكَمُ فَيْهِ بِشَرْعِ اللهِ فَهُوَ مِنْ جُمْلَةِ دَارِ الْحَرْبِ.
‘“দারুল হারব” হলো ওই ভূখণ্ড, যেখানে মুসলমানরা নিরাপদ নয় এবং যেখানে আল্লাহর শরিয়ত অনুসারে বিচার-ফয়সালা করা হয় না। অতএব, যে জায়গায় মুসলিমরা নিরাপদ নয় এবং যেথায় আল্লাহর শরিয়ত অনুযায়ী বিচার করা হয় না, তা “দারুল হারব”-এর অন্তর্ভক্ত।’ (মাওসুআতুল কাওয়ায়িদিল ফিকহিয়্যা : ৯/১৭৬, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
তিনি আরও বলেন :
فَالْمَكَانُ وَالْمَوْضِعُ وَالْبِلَادُ الَّتِيْ لَا يَأْمَنُ فِيْهَا الْمُسْلِمُوْنَ عَلَى إِقَامَةِ شَعَائِرِ دِيْنِهِمْ وَعَلَى أَنْفُسِهِمْ وَأَعْرَاضِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ، وَلَا يُقَامُ فِيْهَا شَرْعُ اللهِ هُوَ دَارُ الْحَرْبِ، وَالْمَكَانُ الَذِيْ يَكُوْنُ تَحْتَ يَدِ الْمُسْلِمِيْنَ، وَفِيْهِ يَأْمَنُوْنَ، وَيُحْكَمُ فَيْهِ بِشَرْعِ اللهِ هُوَ دَارُ الْإِسْلَامِ.
‘অতএব যে স্থান, জায়গা ও দেশে মুসলমানরা নিজেদের দ্বীন পালন, জান, ইজ্জত সম্মানের ক্ষেত্রে নিরাপদ নয় এবং যেখানে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন করা হয় না, সেটাই হলো “দারুল হারব”। আর যে স্থান মুসলমানদের হাতে থাকবে, মুসলিমরা তথায় নিরাপদ থাকবে এবং সেখানে আল্লাহর আইন অনুসারে বিচার-ফয়সালা করা হবে, সেটা হলো “দারুল ইসলাম”।’ (মাওসুআতুল কাওয়ায়িদিল ফিকহিয়্যা : ১১/১১৪৪, প্রকাশনী : মুআসসাসাতুর রিসালা, বৈরুত)
এসব ফকিহ ও উসুলবিদদের ভাষ্য থেকে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর অর্থ স্পষ্ট হয়ে যায় যে, জনগণের আধিক্য বা কিছু ধর্মীয় বিধিবিধান পালনের সুযোগ থাকার কারণেই কোনো দেশকে ‘দারুল ইসলাম’ বা ‘দারুল হারব’ বলা হবে না; বরং মূলে দেখতে হবে যে, সে দেশের সংবিধান ও শাসনক্ষমতা কাদের হাতে। যদি শাসনক্ষমতা মুসলিমদের হাতে থাকে এবং দেশের সংবিধান ও বিচারব্যবস্থা শরিয়ামতে চলে তাহলে সে দেশকে ‘দারুল ইসলাম’ বলা হবে। এক্ষেত্রে এটা বিবেচ্য নয় যে, দেশের অধিকাংশ জনগণের ধর্ম কী। চাই সবাই জিম্মি কাফির হোক বা সবাই মুসলিম হোক কিংবা কমবেশ করে উভয় শ্রেণির জনগণ থাকুক। এসবের কারণে ‘দারুল ইসলাম’ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। এর বিপরীতে যদি দেশের শাসনক্ষমতা কাফিরদের হাতে থাকে কিংবা নামধারী মুসলমানের হাতে থাকলেও কুফরি ও মানবরচিত আইনে দেশ পরিচালনা করা হয় এবং শরিয়ার পরিবর্তে এসব মানবরচিত আইনেই বিচার-ফয়সালা করা হয়, তাহলে এটাকে ‘দারুল হারব’ বলা হবে। যদিও দেশের সিংহভাগ নাগরিক মুসলমান হোক এবং দেশে ব্যক্তিগত বিভিন্ন ইবাদত পালনের সুযোগ দেওয়া হোক।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. বলেন :
الدَّار إِذا ظهر فِيهَا القَوْل بِخلق الْقُرْآن وَالْقدر وَمَا يجْرِي مجْرى ذَلِك فَهِيَ دَار كفر
‘কোনো ভূখণ্ডে যখন কুরআন মাখলুক হওয়ার মতবাদ, তাকদির অস্বীকার করার মতাদর্শ এবং এ জাতীয় অন্য কোনো কুফরি, শিরকি আকিদা বিজয়ী হবে, তখন সেটাকে “দারুল কুফর” বলা হবে।’ (আল-আকিদা, আবু বকর আল-খাল্লাল : পৃ. নং ১২৪, প্রকাশনী : দারু কুতাইবা, দামেশক)