দারুল হারব ও দারুল ইসলাম : পরিচিতি ও প্রকারভেদ – মুফতি তারেকুজ্জামান (২য় পর্ব)

তৃতীয় আলোচনা : দারুল হারবের প্রকারভেদ
সব ‘দারুল হারব’ এক ক্যাটাগরির নয়। শ্রেণিগতভাবে ‘দারুল হারব’-এর নানা ভাগ রয়েছে। প্রথমত ‘দারুল হারব’-এ কুফরি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দিক থেকে ‘দারুল হারব’-কে দুভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
এক. দারুল হারবিল আসলি। দুই. দারুল হারবিত তারি।

‘দারুল হারবিল আসলি’ বলা হয় এমন কুফরি রাষ্ট্রকে, যেখানে পূর্ব থেকেই কুফরি শাসনব্যবস্থা চলে আসছে। আগে বা পরে কখনো তথায় ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেমন : আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান ইত্যাদি।

আর ‘দারুল হারবিত তারি’ বলা হয় এমন কুফরি রাষ্ট্রকে, যেখানে কখনো ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে মুসলমানদের গাফলতি বা অন্য কোনো কারণে ইসলামি শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে কুফরি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন : স্পেন, ফ্রান্স, ইটালি, চীন, উত্তর আফ্রিকা ও হিন্দুস্তান ইত্যাদি।
এরপর ‘দারুল হারব’-এ কাফির বা মুরতাদদের অনৈসলামিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি আবার দু’প্রকারের হতে পারে। যথা : এক. ইসতি’লায়ে কামিল। দুই. ইসতি’লায়ে নাকিস

‘ইসতি’লায়ে কামিল’ বলা হয় এমন কর্তত্বকে, যা নিজেদের কুফরি আইন ও শাসনব্যবস্থার বিপরীতে ভিন্ন কোনো আইন বা বিধানের স্বীকৃতি দেয় না। বরং ভিন্ন কোনো আইন ও নিয়মকানুন অনুসরণ করলে তাকে হত্যা, বা বন্দী করা হয় এবং তাকে চরম নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন : চীন, উত্তর কোরিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রগুলোতে করা হয়ে থাকে।

আর ইসতিলায়ে নাকিস বলা হয় এমন কর্তত্বকে, যা নিজেদের কুফরি আইন-কানুন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ভিন্নধর্মীদের জন্য সীমিত পরিসরে ধর্ম পালন করার সুযোগও দিয়ে থাকে। তবে শর্ত হলো, সেটা তাদের কুফরি আইন-কানুন ও দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। যেমন : তাতারিদের যুগে শাম ও পাশ্ববর্তী কিছু অঞ্চলের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গিয়েছিল এবং যেরকমভাবে বর্তমানে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক কুফরি রাষ্টসমূহে দেখা যায়। মোটকথা, এসব অঞ্চলে যদিওবা ইসলামি কিছু বিধিবিধান পালনের সুযোগ থাকে, কিন্তু সেটা মুসলমানদের কর্তত্বের বলে নয়; বরং কাফির ও তাগুত শাসকেরা এর অনুমোদন দেওয়াতেই সেটা সম্ভব হয়। তাই এমন কিছু ইবাদত পালনের সুযোগ পাওয়াতে সে দেশকে ‘দারুল ইসলাম’ বলা যাবে না।

আল্লামা সিদ্দিক হাসান খান রহ. বলেন :
فمتى علمنا يقينًا ضروريًا بالمشاهدة أو السّماع المتواتر أنّ الكفّارَ استولوا على بلدٍ مِن بلاد الإسلام التي تليهم، وغلبوا عليها وقهروا أهلَها، بحيث لا يتمُّ لهم إبرازُ كلمة الإسلام إلا بجوارٍ مِن الكفّار: صارت دارَ حرب وإن أقيمت فيها الصّلاة.
‘অতএব, যখন আমরা সরাসরি পর্যবেক্ষণ বা পারম্পরিক ধারায় শ্রবণের মাধ্যমে সুনিশ্চিতভাবে জানতে পারব যে, কাফিররা তাদের পাশ্ববর্তী কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের ওপর কতৃত্ব অর্জন করে বিজয় অর্জন করেছে এবং এর নাগরিকদের এমনভাবে পরাজিত করেছে যে, কাফিরদের নিরাপত্তাপ্রাপ্তি ছাড়া তাদের প্রকাশ্যে ইসলামের কালিমা বলারও সুযোগ নেই, তখন সেটা দারুল হারব বলেই বিবেচিত হবে; যদিও তথায় নামাজ প্রতিষ্ঠা করা হোক।’ (আল-ইবরাতু মিম্মা জাআ বিল-গাজবি ওয়াশ-শাহাদাতি ওয়াল-হিজরাহ : পৃ. নং ২৩৬-২৩৭, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

উল্লেখ্য যে, দারুল হারব চাই আসলি হোক বা তারি, অনুরূপ তাতে ইসতিলায়ে কামিল থাকুক বা নাকিস―সর্বাবস্থায়ই এ দেশগুলোর সাথে ‘দারুল হারব’-এর মতোই আচরণই করা হবে। যদিও এসব দেশে বসবাস করা বা হিজরতের আবশ্যকীয়তার মাঝে এ প্রকারগুলো বিধানগত কিছুটা পার্থক্য সৃষ্টি করবে। অতএব, যারা কোনো দেশে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নাগরিক কিংবা দেশে কিছু ইসলামি বিধিবিধান পালনের সুযোগ থাকায় দেশকে দারুল ইসলাম বলে মনে করে, তাদের এ মাসআলায় বড় ধরনের ভ্রম ঘটেছে।

নিরাপত্তার দিক থেকে আবার ‘দারুল হারব’ দুপ্রকারের। যথা : দারুল খাওফ ও দারুল আমান। ‘দারুল খাওফ’ এমন কুফরি রাষ্ট্রকে বলা হয়, যাদের সাথে ইসলামি রাষ্ট্রের কোনো নিরাপত্তাচুক্তি নেই। এমন রাষ্ট্রে যেহেতু মুসলমানদের কোনো নিরাপত্তা থাকে না, তাই এটাকে দারুল খাওফ বা ভীতির রাষ্ট্র বলা হয়। আর ‘দারুল আমান’ এমন কুফরি রাষ্ট্রকে বলা হয়, যাদের সাথে ইসলামি রাষ্ট্রের কোনো নিরাপত্তাচুক্তি আছে। এর কারণে তথায় মুসলমানেরা নিরাপদে চলাফেরা ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে।

উল্লেখ্য যে, ফিকহের কিতাবগুলোতে ‘দারুল আমান’ বলতে ‘দারুল হারব’-এর একটি প্রকার বুঝানো হলেও বর্তমানে কিছু মানুষ এটাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ‘দার’ হিসেবে দাবি করে থাকে। অথচ এটা সম্পূর্ণ ভুল একটি দাবি, যা ফিকহের এসব অধ্যায়ের সাথে সামান্য সম্পর্ক রাখে, এমন যেকোনো তালিবুল ইলমের জানা থাকার কথা। বিষয়টি যেহেতু বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, তাই এখানে সংক্ষেপে এটা নিয়ে সামান্য আলোচনা তুলে ধরছি।

দারুল আমান ও তার হাকিকত :

অধুনা সময়ের কিছু কিছু আলিমের মুখে শুনতে পাওয়া যায়, ‘দার’ তিন প্রকারের। এক. দারুল ইসলাম, দুই. দারুল হারব, তিন. দারুল আমান। এ প্রসঙ্গে আমরা দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলব। প্রথমত, ফুকাহায়ে কিরামের পরিভাষায় ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’―এ দুটির বাইরে ‘দারুল আমান’ বলে তৃতীয় কোনো ‘দার’-এর অস্তিত্ব আছে কিনা, সেটা দেখানো। দ্বিতীয়ত, ‘দারুল আমান’ বলতে কী বুঝায় এবং এটার প্রকৃত অর্থ কী।

প্রথম কথা হলো, শরিয়তের পরিভাষায় ‘দার’-এর প্রকারভেদ দুটিই। যথা : দারুল ইসলাম ও দারুল হারব। এখানে এ দুটির বিপরীতে ‘দারুল আমান’ বলে তৃতীয় কোনো ‘দার’ নেই। মানুষ যেমন হয় মুমিন, নয় কাফির হবে, এখানে তৃতীয় কোনো প্রকার নেই; অনুরূপ রাষ্ট্র হয় ‘দারুল ইসলাম’ হবে নয় ‘দারুল হারব’ হবে, এর তৃতীয় কোনো প্রকার নেই। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকিদামতে ইসলাম ও কুফরের মাঝে যেমন তৃতীয় কোনো স্তর নেই, ঠিক তেমনই ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ এর মাঝেও তৃতীয় কোনো স্তর নেই, যা ‘দারুল ইসলাম’ও হবে না, আবার ‘দারুল হারব’ও হবে না। এ ব্যাপারে আমরা ফুকাহায়ে কিরামের উক্তিসমূহ তুলে ধরছি।

কাজি আবু ইয়ালা হাম্বলি রহ. বলেন :
وَدَلِيْلُنَا مَا تَقَدَّمَ فِيْ مَسَائِلِ الْإِيْمَانٍ وًأًنًّ سًائِرَ الْمُكَلَّفِيْنَ لَا يَخْلُوْ مِنْ أَنْ يَكُوْنُوْا كُفَّارًا أَوْ مُؤْمِنِيْنَ كَامِلِي الْإِيْمَانِ أَوْ نَاقِصِي الْإِيْمَانِ أَوْ بَعْضُهُمْ كُفَّارًا وَبَعْضُهُمْ مُؤْمِنِيْنَ. وَلَا يَجُوْزُ كَوْنُ مُكَلَّفٍ لَيْسَ بِمُؤْمِنٍ وَلَا كَافِرٍ كَذَلِكَ الدَّارُ أَيْضًا لَا يَخْلُوْ مِنْ أَنْ تَكُوْنَ دَارَ كُفْرٍ أَوْ دَارَ إِسْلَامٍ.
‘আর আমাদের দলিল হলো যা ইমানের মাসায়িলের আলোচনায় বিগত হয়েছে। আরেকটি দলিল হলো, সকল মুকাল্লাফ (শরিয়তের বিধান মানতে আদিষ্ট ব্যক্তি) দুই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারবে না। হয় সবাই কাফির হবে, নয়তো সবাই মুমিন হবে; চাই পরিপূর্ণ ইমানের অধিকারী হোক বা অপরিপূর্ণ ইমানের অধিকারী হোক। অথবা আংশিক কাফির আর আংশিক মুমিন হবে। কিন্তু এমনটা হওয়ার কোনোই অবকাশ নেই যে, কোনো মুকাল্লাফ মুমিনও হবে না আবার কাফিরও হবে না। ঠিক অনুরূপ “দার”ও দুই অবস্থা থেকে মুক্ত নয়। হয় তা “দারুল কুফর” হবে নয়তো “দারুল ইসলাম” হবে।’ (আল-মুতামাদ ফি উসুলিদ্দিন : পৃ. নং ২৭৬, প্রকাশনী : দারুল মাশরিক, বৈরুত)

ইমাম ইবনে মুফলিহ মাকদিসি রহ. বলেন :
فَكُلّ دَار غَلَبَ عَلَيْهَا أَحْكَام الْمُسْلِمِينَ فَدَارُ الْإِسْلَام وَإِنْ غَلَبَ عَلَيْهَا أَحْكَام الْكُفَّار فَدَارُ الْكُفْر وَلَا دَارَ لِغَيْرِهِمَا
‘প্রত্যেক এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত, তা “দারুল ইসলাম”। আর যদি কোনো ভূখণ্ডে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত থাকে, তাহলে তা “দারুল কুফর”। এ দু’প্রকারের বাইরে আর কোনো “দার” নেই।’ (আল-আদাবুশ শারইয়্যা ওয়াল মিনহুল মারইয়্যা : ১/১৯০, প্রকাশনী : আলামুল কুতুব, বৈরুত)

সাইয়িদ কুতুব শহিদ রহ. বলেন :
يَنْقَسِمُ الَعَالَمُ فِيْ نَظَرَ الْإِسْلَامِ وَفِيْ اعْتِبَارِ الْمُسْلِمِ إِلَى قِسْمَيْنِ اثْنَيْنِ لَا ثَالِثَ لَهُمَا. اَلْأَوَّلُ : دَارَ الْإِسْلَامِ. وَتشْمِلُ كُلَّ بَلَدٍ تُطَبَّقُ فِيْهِ أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ، وَتَحْكُمُهُ شَرِيْعَةُ الْإِسْلَامِ… اَلثَّانِيْ : دَارُ الْحَرْبِ. وَتَشْمِلُ كُلَّ بَلَدٍ لَا تُطَبَّقُ فَيْهِ أَحْكَامُ الْإِسْلَامِ، وَلَا يُحْكَمُ بَشَرِيْعَةِ الْإٍسْلَامِ.
‘ইসলাম ও মুসলিমদের বিবেচনায় পুরো বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত, যার তৃতীয় কোনো প্রকার নেই। প্রথম হলো “দারুল ইসলাম”। এটা প্রত্যেক এমন ভূখণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করা হয় এবং ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা হয়। …দ্বিতীয় হলো “দারুল হারব”। এটা প্রত্যেক এমন ভূখণ্ডকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেখানে ইসলামি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করা হয় না এবং ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা হয় না।’ (ফি জিলালিল কুরআন : ২/৩৪৮, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুশ শামিলা)

তবে হ্যাঁ, শরিয়তে ‘দারুল আমান’ বা ‘দারুল আহদ’ নামে একটি পরিভাষা আছে, কিন্তু সেটা ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর বিপরীতে তৃতীয় কোনো প্রকার নয়; বরং তা ‘দারুল হারব’-এরই একটি প্রকার মাত্র। কেননা, ফুকাহায়ে কিরাম ‘দারুল হারব’-কে দুভাগে ভাগ করেছেন। একটি হলো, ওই ‘দারুল হারব’, যাদের সাথে মুসলমানদের কোনো চুক্তি নেই এবং সেখানে মুসলমানরা নিরাপদ নয়। এটাকে বলা হয় ‘দারুল খাওফ’ বা ভীতির দেশ। দ্বিতীয় প্রকার হলো, ওই দারুল হারব, যেখানে মুসলমানদের নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়ে চুক্তি আছে। এটাকে ‘দারুল আমান’ বা ‘দারুল আহদ’ বা ‘দারুল মুওয়াদাআ’ তথা নিরাপত্তার দেশ বলা হয়।

এ ব্যাপারে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিকহি বোর্ড ‘মাজমাউল ফিকহিল ইসলামি’ তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এভাবে তুলে ধরেছে :
وَلَا فَرْقَ بَيْنَ دَارِ الْعَهْدِ وَدَارِ الْحَرْبِ إِلَّا مِنْ حَيْثُ إِنَّ الْأُوْلَى بَيْنَهَا وَبَيْنَ الْمُسْلِمِيْنَ مُعَاهَدَةُ سَلَامٍ، عَلَى حِيْنٍ لَا يُوْجَدُ هَذَا بِالنِّسْبَةِ لِلثَّانِيَةِ فَكَانَتْ دَارَ الْحَرْبِ يَتَوَقَّعُ مِنْهَا الْاِعْتِدَاءُ فِيْ أَيِّ وَقْتٍ، وَهُمَا عَدَا هَذَا دَارٌ وَاحِدَةٌ تُقَابِلُ دَارَ الْإِسْلَامِ، فَهُمَا لَا يَعْتَرِفَانِ بِهَذَا الدِّيْنِ، وَلَا عِبْرَةَ بِمَا يَكُوْنُ مِنْ تَفَاوُتٍ فِي الْعَقَائِدِ بَيْنَ أَهْلِ دَارِ الْعَهْدِ وَدَارِ الْحَرْبِ، فَهَذَا لَا يُؤَثِّرُ فِيْ أَنَّهُمَا دَارٌ وَاحِدَةٌ غَيْرُ إِسْلَامِيَّةٍ.
‘বস্তুত “দারুল আমান” ও “দারুল হারব” এর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। শুধু এতটুকু যে, “দারুল আমান”-এর ক্ষেত্রে তাদের ও মুসলমানদের মাঝে শান্তিচুক্তি থাকে। কিন্তু “দারুল হারব”-এর ক্ষেত্রে এমন কোনো চুক্তি থাকে না। এর কারণে তাদের পক্ষ থেকে যেকোনো ধরনের সীমালঙ্ঘনের আশঙ্কার ভিত্তিতে সেটাকে (“দারুল আমান” না বলে) “দারুল হারব” বলা হয়। এ পার্থক্য ছাড়া মূলত এ দুটি (“দারুল হারব” ও “দারুল আমান”) একই, যা “দারুল ইসলাম”-এর বিপরীতে আসে। এ উভয় প্রকার রাষ্ট্রই দ্বীন ইসলামকে স্বীকার করে না। আর “দারুল আমান” ও “দারুল হারব”-এর মাঝে আকিদা ও বিশ্বাসগত যে ব্যবধান আছে, তা তেমন বিবেচ্য নয়। উভয় প্রকারই অনৈসলামিক রাষ্ট্র হওয়ার ব্যাপারে এটা কোনো প্রভাব ফেলবে না।’ (মাজাল্লাতু মাজমাইল ফিকহিল ইসলামি : ৭/১৭১১, প্রকাশনী : আল-মাকতাবাতুশ শামিলা)

ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেন :
وَلَوْ أَنَّ الْمُوَادَعِينَ لَمْ يَخْرُجُوا إلَيْنَا حَتَّى أَغَارَ عَلَيْهِمْ أَهْلُ دَارِ حَرْبٍ أُخْرَى فِي دَارِهِمْ فَأَسَرُوا مَعَهُمْ أَسِيرًا ثُمَّ ظَهَرَ الْمُسْلِمُونَ عَلَيْهِمْ فَاسْتَنْقَذُوهُمْ مِنْ أَيْدِيهِمْ، كَانُوا عَبِيدًا لِلْمُسْلِمِينَ؛ لِأَنَّهُمْ مَا كَانُوا أَصَابُوهُمْ مِنْ دَارِ الْإِسْلَامِ، فَإِنَّ دَارَ الْمُوَادَعِينَ دَارُ الْحَرْبِ، لَا يَجْرِي فِيهَا حُكْمُ الْمُسْلِمِينَ.
‘যদি চুক্তিবদ্ধ কাফিররা আমাদের নিকট না এসে থাকে (বরং তাদের দেশেই অবস্থান করে); ইতিমধ্যে অন্য কোনো “দারুল হারব”-এর কাফিররা তাদের দেশে আকস্মিক আক্রমন করে তাদের লোকদেরকে বন্দী করে নিয়ে যায়, অতঃপর মুসলিমরা ওই আক্রমণকারী কাফিরদের (সাথে যুদ্ধ করে তাদের) ওপর বিজয় অর্জন করে এবং ওই সব বন্দীদের মুক্ত করে আনে, তাহলে এসব বন্দী মুসলমানদের দাস হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা, মুসলমানেরা তো “দারুল ইসলাম” থেকে তাদের বন্দী করে আনেনি। যেহেতু চুক্তিবদ্ধ কাফিরদের দেশ তো (প্রকৃত অর্থে) “দারুল হারব”, যেখানে মুসলমানদের শাসন কার্যকর নয়।’ (আস-সিয়ারুল কাবির মাআ শারহিস সারাখসি :৫/১৮৯৩, প্রকাশনী : আশ-শিরকাতুশ শারকিয়্যা)

এ বর্ণনা থেকে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে প্রমাণ হয় যে, ‘দারুল আমান’ বা চুক্তিবদ্ধ কাফির রাষ্ট্র আলাদা কোনো প্রকার নয়; বরং সেটাও ‘দারুল হারব’-এরই অন্তর্ভুক্ত। আমরা পূর্বে বলে এসেছি যে, ‘দারুল হারব’ মূলত দু’প্রকার। এক. ‘দারুল খাওফ’ বা ভীতির দেশ। অর্থাৎ কাফির-শাসিত যে রাষ্ট্রের সাথে মুসলমানদের নিরাপত্তাচুক্তি নেই, সেটা হলো ‘দারুল হারব’-এর প্রথম প্রকার ‘দারুল খাওফ’। দুই. ‘দারুল আমান’ বা নিরাপত্তার দেশ। অর্থাৎ কাফির-শাসিত যে রাষ্ট্রের সাথে মুসলমানদের নিরাপত্তাচুক্তি আছে, সেটা হলো ‘দারুল হারব’-এর দ্বিতীয় প্রকার ‘দারুল আমান’। অতএব, যারা ‘দারুল আমান’-কে ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’-এর বিপরীতে তৃতীয় একটি প্রকার বলে প্রচার করে, তারা অজ্ঞতাবশত বা ভুল বুঝে এমনটা বলে থাকে, যার সাথে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই।

চতুর্থ আলোচনা : দারুল ইসলাম ও দারুল হারবের রূপান্তর
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ‘দারুল হারব’ কখন ‘দারুল ইসলাম’-এ পরিণত হয় এবং ‘দারুল ইসলাম’ কখন ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হয়, তা জানা। এ দুটির মধ্যে একটি মাসআলা মুত্তাফাক আলাইহি বা ঐকমত্যপূর্ণ। আরেকটি মাসআলা হলো কিছুটা মুখতালাফ ফিহ বা মতানৈক্যপূর্ণ। ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলাটি হলো, কোনো ‘দারুল হারব’ মুসলমানদের হাতে আসার পর তাতে ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করলেই তা ‘দারুল ইসলাম’ হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে কারও তেমন কোনো মতানৈক্য নেই। কিন্তু ‘দারুল ইসলাম’ কখন ‘দারুল হারব’ হবে, সে ব্যাপারে কিছুটা মতভেদ আছে।

‘দারুল ইসলাম’ কখন ‘দারুল হারব’ হবে, সে ব্যাপারে তিনটি মত পাওয়া যায়। এক : ইমাম মালিক রহ., ইমাম আহমাদ রহ., ইমাম আবু ইউসুফ রহ., ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-সহ অধিকাংশ ফকিহের নিকট ‘দারুল ইসলাম’-এ কুফরি শাসনব্যবস্থা ও সংবিধান চালু হলেই তা ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হয়ে যায়। দুই : ইমাম শাফিয়ি রহ.-এর মতে কোনো রাষ্ট্র ভূখণ্ড একবার ‘দারুল ইসলাম’ হয়ে গেলে তা আর কখনো ‘দারুল হারব’ হবে না; যদিও তথায় কুফরি আইন-কানুন প্রতিষ্ঠিত হয়। তিন : ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর নিকটে ‘দারুল ইসলাম’ ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে। এক. সে দেশে কুফরি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। দুই. সেটা অন্য আরেকটি ‘দারুল হারব’-এর সাথে লাগোয়া থাকতে হবে। তিন. ‘দারুল ইসলাম’ থাকাবস্থায় প্রজাদের যে নিরাপত্তাব্যবস্থা ও চুক্তি ছিল তা কার্যকর থাকবে না; বরং জনগণের নিরাপত্তার জন্য নতুন করে চুক্তি ও শর্ত ঠিক করে নেওয়ার প্রয়োজন হবে। এই তিনটি শর্ত যদি একসাথে পাওয়া যায়, তাহলেই কেবল কোনো ‘দারুল ইসলাম’ ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হবে। (আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা : ২০/২০২, প্রকাশনী : অজারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুয়ুনিল ইসলামিয়্যা, কুয়েত)

এ ব্যাপারে ইমাম শাফিয়ি রহ.-এর মতটি নিতান্তই দুর্বল, যার কারণে অনেক সময় দেখা যায়, এ ইখতিলাফের আলোচনায় তাঁর মতটি উল্লেখ না করে শুধু প্রথম আর তৃতীয় মতটিই উল্লেখ করা হয়। তাই আমরাও এখানে ইমাম শাফিয়ি রহ.-এর মত নিয়ে আলোচনা না করে শুধু জমহুর ও ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মত নিয়ে আলোচনা করব। নিম্নে আমরা এ দু’মতের ব্যাপারে ফুকাহায়ে কিরামের ভাষ্য ও উভয় পক্ষের দলিলাদি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করছি।

ইমাম কাসানি রহ. বলেন :
لَا خِلَافَ بَيْنَ أَصْحَابِنَا فِي أَنَّ دَارَ الْكُفْرِ تَصِيرُ دَارَ إسْلَامٍ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْإِسْلَامِ فِيهَا وَاخْتَلَفُوا فِي دَارِ الْإِسْلَامِ، إنَّهَا بِمَاذَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ؟ قَالَ أَبُو حَنِيفَةَ: إنَّهَا لَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ إلَّا بِثَلَاثِ شَرَائِطَ، أَحَدُهَا: ظُهُورُ أَحْكَامِ الْكُفْرِ فِيهَا وَالثَّانِي: أَنْ تَكُونَ مُتَاخِمَةً لِدَارِ الْكُفْرِ وَالثَّالِثُ: أَنْ لَا يَبْقَى فِيهَا مُسْلِمٌ وَلَا ذِمِّيٌّ آمِنًا بِالْأَمَانِ الْأَوَّلِ، وَهُوَ أَمَانُ الْمُسْلِمِينَ. وَقَالَ أَبُو يُوسُفَ وَمُحَمَّدٌ – رَحِمَهُمَا اللَّهُ: إنَّهَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْكُفْرِ فِيهَا.
‘আমাদের ফকিহদের মাঝে এ ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই যে, “দারুল হারব”-এ ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই তা “দারুল ইসলাম”-এ পরিণত হয়ে যায়। তবে তাঁরা “দারুল ইসলাম”-এর ব্যাপারে মতানৈক্য করেছেন যে, তা কখন “দারুল হারব”-এ পরিণত হবে। ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, তিনটি শর্ত পাওয়া গেলে তবেই “দারুল ইসলাম” “দারুল হারব”-এ পরিণত হবে। এক. তথায় কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়া। দুই. (পার্শ্ববর্তী অন্য) কোনো “দারুল হারব”-এর সাথে সংযুক্ত থাকা। তিন. মুসলমানদের (খলিফার) পক্ষ থেকে প্রদত্ত পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি অনুসারে কোনো মুসলমান বা জিম্মি থাকতে না পারা। আর ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. বলেছেন, “দারুল ইসলাম”-এ কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই তা “দারুল হারব”-এ পরিণত হয়ে যাবে।’ (বাদায়িউস সানায়ি : ৭/১৩০, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

ইমাম কাসানি রহ. সাহিবাইনের পক্ষ থেকে দলিল দিয়ে বলেন :
وَجْهُ قَوْلِهِمَا أَنَّ قَوْلَنَا دَارُ الْإِسْلَامِ وَدَارُ الْكُفْرِ إضَافَةُ دَارٍ إلَى الْإِسْلَامِ وَإِلَى الْكُفْرِ، وَإِنَّمَا تُضَافُ الدَّارُ إلَى الْإِسْلَامِ أَوْ إلَى الْكُفْرِ لِظُهُورِ الْإِسْلَامِ أَوْ الْكُفْرِ فِيهَا، كَمَا تُسَمَّى الْجَنَّةُ دَارَ السَّلَامِ، وَالنَّارُ دَارَ الْبَوَارِ؛ لِوُجُودِ السَّلَامَةِ فِي الْجَنَّةِ، وَالْبَوَارِ فِي النَّارِ وَظُهُورُ الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِهِمَا، فَإِذَا ظَهَرَ أَحْكَامُ الْكُفْرِ فِي دَارٍ فَقَدْ صَارَتْ دَارَ كُفْرٍ فَصَحَّتْ الْإِضَافَةُ، وَلِهَذَا صَارَتْ الدَّارُ دَارَ الْإِسْلَامِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْإِسْلَامِ فِيهَا مِنْ غَيْرِ شَرِيطَةٍ أُخْرَى، فَكَذَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ بِظُهُورِ أَحْكَامِ الْكُفْرِ فِيهَا.
‘ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর মতের পক্ষে দলিল হলো, আমাদের “দারুল ইসলাম” এবং “দারুল কুফর” কথা দুটিতে “দার”-কে ইসলাম ও কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে। আর “দার”-কে ইসলাম ও কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয় তাতে ইসলাম কিংবা কুফর প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে। যেমন : জান্নাতকে “দারুস সালাম” এবং জাহান্নামকে “দারুল বাওয়ার” বলা হয়ে থাকে; যেহেতু জান্নাতে “সালাম” বা শান্তি রয়েছে আর জাহান্নামে “বাওয়ার” বা ধ্বংস রয়েছে। আর ইসলাম ও কুফর প্রতিষ্ঠিত হয় তার আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারা। অতএব, যখন কোনো ভূখণ্ডে কুফরি আইনকানুন ও বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন তা “দারুল কুফর” হয়ে যাবে। তাই “দার”-কে এভাবে ইসলাম কিংবা কুফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করাটা সঠিক। এজন্য ইসলামের বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা লাভের দ্বারাই কোনো ভূখণ্ড “দারুল ইসলাম” হিসেবে গণ্য হয়। এই একটি মাত্র শর্ত ছাড়া এখানে আর কোনো শর্ত নেই। অনুরূপ কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দ্বারাই “দারুল ইসলাম” “দারুল কুফর”-এ রূপান্তরিত হয়।’ (বাদায়িউস সানায়ি : ৭/১৩০-১৩১, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

ইমাম কাসানি রহ. ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর পক্ষ থেকে দলিল দিয়ে বলেন :
وَجْهُ قَوْلِ أَبِي حَنِيفَةَ – رَحِمَهُ اللَّهُ – أَنَّ الْمَقْصُودَ مِنْ إضَافَةِ الدَّارِ إلَى الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ لَيْسَ هُوَ عَيْنَ الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ، وَإِنَّمَا الْمَقْصُودُ هُوَ الْأَمْنُ وَالْخَوْفُ. وَمَعْنَاهُ أَنَّ الْأَمَانَ إنْ كَانَ لِلْمُسْلِمِينَ فِيهَا عَلَى الْإِطْلَاقِ، وَالْخَوْفُ لِلْكَفَرَةِ عَلَى الْإِطْلَاقِ، فَهِيَ دَارُ الْإِسْلَامِ، وَإِنْ كَانَ الْأَمَانُ فِيهَا لِلْكَفَرَةِ عَلَى الْإِطْلَاقِ، وَالْخَوْفُ لِلْمُسْلِمِينَ عَلَى الْإِطْلَاقِ، فَهِيَ دَارُ الْكُفْرِ وَالْأَحْكَامُ مَبْنِيَّةٌ عَلَى الْأَمَانِ وَالْخَوْفِ لَا عَلَى الْإِسْلَامِ وَالْكُفْرِ، فَكَانَ اعْتِبَارُ الْأَمَانِ وَالْخَوْفِ أَوْلَى، فَمَا لَمْ تَقَعْ الْحَاجَةُ لِلْمُسْلِمِينَ إلَى الِاسْتِئْمَانِ بَقِيَ الْأَمْنُ الثَّابِتُ فِيهَا عَلَى الْإِطْلَاقِ، فَلَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ، وَكَذَا الْأَمْنُ الثَّابِتُ عَلَى الْإِطْلَاقِ لَا يَزُولُ إلَّا بِالْمُتَاخَمَةِ لِدَارِ الْحَرْبِ، فَتَوَقَّفَ صَيْرُورَتُهَا دَارَ الْحَرْبِ عَلَى وُجُودِهِمَا مَعَ أَنَّ إضَافَةَ الدَّارِ إلَى الْإِسْلَامِ احْتَمَلَ أَنْ يَكُونَ لِمَا قُلْتُمْ، وَاحْتَمَلَ أَنْ يَكُونَ لِمَا قُلْنَا، وَهُوَ ثُبُوتُ الْأَمْنِ فِيهَا عَلَى الْإِطْلَاقِ لِلْمُسْلِمِينَ وَإِنَّمَا يَثْبُتُ لِلْكَفَرَةِ بِعَارِضِ الذِّمَّةِ وَالِاسْتِئْمَانِ، فَإِنْ كَانَتْ الْإِضَافَةُ لِمَا قُلْتُمْ تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ بِمَا قُلْتُمْ. وَإِنْ كَانَتْ الْإِضَافَةُ لِمَا قُلْنَا لَا تَصِيرُ دَارَ الْكُفْرِ إلَّا بِمَا قُلْنَا، فَلَا تَصِيرُ مَا بِهِ دَارُ الْإِسْلَامِ بِيَقِينٍ دَارَ الْكُفْرِ بِالشَّكِّ وَالِاحْتِمَالِ عَلَى الْأَصْلِ الْمَعْهُودِ أَنَّ الثَّابِتَ بِيَقِينٍ لَا يَزُولُ بِالشَّكِّ وَالِاحْتِمَالِ، بِخِلَافِ دَارِ الْكُفْرِ حَيْثُ تَصِيرُ دَارَ الْإِسْلَامِ؛ لِظُهُورِ أَحْكَامِ الْإِسْلَامِ فِيهَا؛ لِأَنَّ هُنَاكَ التَّرْجِيحَ لِجَانِبِ الْإِسْلَامِ؛ لِقَوْلِهِ – عَلَيْهِ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ -الْإِسْلَامُ يَعْلُو وَلَا يُعْلَى فَزَالَ الشَّكُّ عَلَى أَنَّ الْإِضَافَةَ إنْ كَانَتْ بِاعْتِبَارِ ظُهُورِ الْأَحْكَامِ، لَكِنْ لَا تَظْهَرُ أَحْكَامُ الْكُفْرِ إلَّا عِنْدَ وُجُودِ هَذَيْنِ الشَّرْطَيْنِ – أَعْنِي الْمُتَاخَمَةَ وَزَوَالَ الْأَمَانِ الْأَوَّلِ – لِأَنَّهَا لَا تَظْهَرُ إلَّا بِالْمَنَعَةِ، وَلَا مَنَعَةَ إلَّا بِهِمَا وَاَللَّهُ – سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى – أَعْلَمُ
‘ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর বক্তব্যের কারণ হলো, “দার”-কে ইসলাম ও কুফরের সঙ্গে সম্পর্কিত করার দ্বারা আসলে তো ইসলাম কিংবা কুফরের হাকিকত উদ্দেশ্য নয়। (কেননা, “দার” বা ভূখণ্ড তো আর মুসলমান বা কাফির হয় না)। উদ্দেশ্য হলো আমান (নিরাপত্তা) ও খাওফ (ভীতি)। এর অর্থ হলো, যদি সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য আমান (নিরাপত্তা) থাকে, আর কাফিরদের জন্য স্বাভাবিকভাবে খাওফ (ভীতি) থাকে (পূর্ণ নিরাপত্তা পেতে হলে তাদের আলাদা চুক্তি করার প্রয়োজন হয়), তাহলে তা “দারুল ইসলাম”। আর যদি সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য খাওফ (ভীতি) থাকে আর কাফিরদের জন্য স্বাভাবিকভাবে থাকে আমান (নিরাপত্তা), তাহলে তা হবে “দারুল কুফর”। হুকুমের ভিত্তি হলো আমান ও খাওফের ওপর; বাস্তবিক ইসলাম ও কুফরের ওপর নয়। তাই আমান ও খাওফকেই বিবেচনায় নেওয়া উত্তম। তো যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানদেরকে নিরাপত্তা প্রার্থনা করতে হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সাধারণভাবে আমান বহাল রয়েছে ধরা হবে। তাই তা “দারুল কুফর”-এ পরিণত হবে না। তেমনিভাবে সাধারণ নিরাপত্তা তখনই বিনষ্ট হওয়া সম্ভব, যখন সে অঞ্চলটা “দারুল হারব” সংলগ্ন হবে। তাহলে “দারুল ইসলাম” “দারুল হারব”-এ পরিণত হওয়ার জন্য দুটো বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। এক. আমান (নিরাপত্তা) নষ্ট হওয়া। দুই. “দারুল হারব” সংলগ্ন অঞ্চল হওয়া। “দার”-কে ইসলামের দিকে নিসবত করার হেতু সেটাও হতে পারে, যা সাহিবাইন বলেছেন, আবার তা-ও হতে পারে, যা ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর পক্ষে আমরা বলছি। অর্থাৎ সাধারণভাবে মুসলমানদের জন্য নিরাপত্তা সাব্যস্ত থাকা। কাফিরদের জন্য নিরাপত্তা সাব্যস্ত হওয়ার জন্য আলাদা জিম্মাচুক্তি কিংবা ইসতিমান বা ভিসাচুক্তি প্রয়োজন। “দার”-কে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত করার হেতু যদি তা হয়, যা সাহিবাইন বলেছেন, তাহলে কোনো অঞ্চল “দারুল কুফর” হিসেবে গণ্য হবে সে কারণেই, যা তারা উল্লেখ করেছেন। আর যদি এই সম্পর্কিতকরণের হেতু তা হয়, যা আমরা বলেছি, তাহলে দেশ তখনই “দারুল হারব” হিসেবে গণ্য হবে, যখন আমাদের বর্ণিত শর্তগুলো পাওয়া যাবে। সুতরাং নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত “দারুল ইসলাম” শুধু সন্দেহ-সম্ভাবনার কারণে “দারুল কুফর”-এ পরিণত হবে না। কারণ, এ মূলনীতি স্বীকৃত যে, “যা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত, তা সন্দেহ-সম্ভাবনার কারণে বিদূরীত হয় না।” কিন্তু “দারুল হারব”-এর বিষয়টি ভিন্ন। যেহেতু (আমরা জানি,) “দারুল হারব”-এ ইসলামি আইন ও শাসনব্যবস্থা চালু হলেই তা “দারুল ইসলাম”-এ পরিণত হয়ে যায়। এর কারণ হলো, এখানে ইসলামের দিকটিকে প্রাধান্য দেওয়ার বিষয় রয়েছে। কেননা রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “ইসলাম (সর্বদা) বিজয়ী থাকবে, পরাজিত নয়।” অতএব, সকল সংশয় নিরসন হয়ে গেল। এছাড়াও (ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর পক্ষ থেকে) বলা যায় যে, (ইসলাম বা কুফরের সাথে) “দার”-এর সম্পৃক্তি যদি শুধু আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিবেচনায়ও হয়, তবুও উপরিউক্ত দু’শর্ত―দারুল হারবের সংলগ্ন হওয়া ও পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়া―না থাকলে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা হওয়া সাব্যস্ত হয় না। কেননা, সামরিক বাহিনী ছাড়া (তাদের কুফরি আইন ও শাসনব্যবস্থা) প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা কল্পনা করা যায় না। আর সামরিক বাহিনী পূর্বের দু’শর্তের উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব নয়।’ (বাদায়িউস সানায়ি : ৭/১৩০-১৩১, প্রকাশনী : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত)

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ‘দারুল হারব’-এ ইসলামি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা ও চালু হয়ে গেলেই তা ‘দারুল ইসলাম’-এ পরিণত হয়ে যায়। তবে ‘দারুল ইসলাম’-এ কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা পাওয়ার দ্বারা সেটা ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হওয়ার মাসআলায় কিছুটা মতানৈক্য পাওয়া যায়। এ মাসআলায় ইমাম আবু হানিফা রহ. একদিকে, আর এর বিপরীতে তাঁর দুই প্রধান শাগরিদ ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এবং পাশাপাশি ইমাম মালিক রহ. ও ইমাম আহমাদ রহ.-সহ অধিকাংশ ফুকাহায়ে কিরাম আরেকদিকে। অন্যান্য ইমাম এতে শুধু কুফুরি আইন ও শাসন চালু হওয়াকেই যথেষ্ট মনে করেন। আর ইমাম আবু হানিফা রহ. মনে করেন, শুধু এতটুকু হওয়ায়ই যথেষ্ট নয়; বরং এখানে মূল দেখার বিষয় হলো, এখানে কারা নিরাপত্তায় থাকতে পারছে আর কাদের ভয় ও আতঙ্কে থাকতে হচ্ছে। সুতরাং কোনো ‘দারুল ইসলাম-এর শাসক মুরতাদ হয়ে গেলে বা অন্য কোনো কাফির শাসক মুসলমানদের উদাসীনতায় ‘দারুল ইসলাম’-এর কোনো ভূখণ্ড দখল করে তথায় কুফরি আইন ও শাসনব্যবস্থা চালু করলেও তা ‘দারুল হারব’ হবে না, যতক্ষণ না এ প্রতিষ্ঠা শক্তিশালী ও সুদৃঢ় বলে প্রমাণিত হয়। আর এর জন্য দুটি বিষয় লাগবে। এক. এ রাষ্ট্রটির সীমান্ত অন্য কোনো ‘দারুল হারব’-এর সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে। কেননা, রাষ্ট্রটির চারপাশে যদি ‘দারুল ইসলাম’-ই থাকে, তাহলে এ মধ্যবর্তী রাষ্ট্রে কাফিরদের প্রভাব ও অবস্থান শক্তিশালী হবে না। চারপাশ থেকে কাফিরদের সর্বদা এ আতঙ্কে থাকতে হবে যে, না জানি কখন ‘দারুল ইসলাম’ থেকে মুসলিম বাহিনী এসে আমাদের দেশ আক্রমণ করে বসে। দুই. ‘দারুল ইসলাম’ থাকাবস্থায় মুসলিম শাসক কর্তৃক জনগণকে যে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল করে দিতে হবে। কেননা, কাফির শাসক যদি ‘দারুল ইসলাম’-এর দেওয়া নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করতে না পারে, তাহলে বুঝা যাবে, তার শক্তি ও সাহস দুর্বল। আর এমন দুর্বল অবস্থানের ভিত্তিতে কোনো ‘দারুল ইসলাম’-কে ‘দারুল হারব’ ঘোষণা দেওয়া ইসলামকে ছোট করার নামান্তর। তাই এ দু’শর্ত বা দু’শর্তের কোনোটি পাওয়া না গেলে সেখানে কাফিরদের অবস্থান শক্তিশালী ও প্রভাবপূর্ণ বলে প্রমাণিত না হওয়ায় সেটা ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হবে না।
বাকি থেকে যায় এ সংশয় যে, যদি ‘দারুল ইসলাম’ ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হওয়ার জন্য তিনটি শর্তের দরকার হয়, তাহলে তো ‘দারুল হারব’ ‘দারুল ইসলাম’-এ পরিণত হওয়ার জন্যও তিনটি শর্ত দরকার। এর উত্তরে ইমাম কাসানি রহ. বলেন, ‘দারুল হারব’-এর বিষয়টি ভিন্ন। কারণ, এখানে আরেকটি মূলনীতি কাজ করেছে। সেটা হলো, কোথাও ইসলাম ও কুফরের মাঝে প্রাধান্যের ব্যাপার আসলে সেখানে ইসলামের দিকটিকে প্রাধান্য দেওয়া নিয়ম। কেননা, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ইসলাম (সর্বদা) বিজয়ী থাকবে, পরাজিত নয়। অতএব, এতে এ সংশয় নিরসন হয়ে যায়। তিনি আরেকটি জবাব দিয়েছেন এ বলে যে, ইসলাম বা কুফরের সাথে ‘দার’-এর সম্পৃক্তি যদি শুধু আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিবেচনায়ও হয়, অর্থাৎ কুফরি শাসনব্যবস্থা থাকলে ‘দারুল হারব’ আর ইসলামি শানব্যবস্থা থাকলে ‘দারুল ইসলাম’ বলে মেনেও নেওয়া হয়, তবুও উপরিউক্ত দু’শর্ত (তথা ‘দারুল হারব’-এর সংলগ্ন হওয়া ও পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল হয়ে যাওয়া) না থাকলে কুফরি বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা হওয়া সাব্যস্ত হয় না। কেননা, কাফিরদের সামরিক বাহিনী ছাড়া তাদের কুফরি আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা কল্পনা করা যায় না। আর সামরিক বাহিনীর অস্তিত্ব পূর্বের দু’শর্তের উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব নয়।

ইমাম সারাখসি রহ. তাঁর মাবসুতে ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর দলিলের মূলের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন যে, মূলত কোনো দেশে শক্তি ও প্রভাবের ভিত্তিতেই ‘দারুল ইসলাম’ ও ‘দারুল হারব’ নির্ণীত হয়। এক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফা রহ. মনে করেন, তিনটি শর্তের উপস্থিতি ছাড়া কাফিরদের শক্তি ও প্রভাব পূর্ণতা পায় না, এজন্যই তিনটি শর্ত করা হয়েছে। আর অন্য ইমামগণ মনে করেন, কোনো দেশে কুফরি শাসনব্যবস্থা ও আইন প্রতিষ্ঠা হওয়ায়-ই প্রমাণ করে যে, সেখানে কুফর প্রতিষ্ঠিত; অতএব সেটা ‘দারুল হারব’ হবে।

ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতভিন্নতা ও তাঁর দলিলের উৎসের ব্যাপারে ইমাম সারাখসি রহ. বলেন :
وَلَكِنْ أَبُو حَنِيفَةَ – رَحِمَهُ اللَّهُ تَعَالَى – يَعْتَبِرُ تَمَامَ الْقَهْرِ وَالْقُوَّةِ؛ لِأَنَّ هَذِهِ الْبَلْدَةَ كَانَتْ مِنْ دَارِ الْإِسْلَامِ مُحْرَزَةً لِلْمُسْلِمِينَ فَلَا يَبْطُلُ ذَلِكَ الْإِحْرَازُ إلَّا بِتَمَامِ الْقَهْرِ مِنْ الْمُشْرِكِينَ، وَذَلِكَ بِاسْتِجْمَاعِ الشَّرَائِطِ الثَّلَاثِ؛ لِأَنَّهَا إذَا لَمْ تَكُنْ مُتَّصِلَةً بِالشِّرْكِ فَأَهْلُهَا مَقْهُورُونَ بِإِحَاطَةِ الْمُسْلِمِينَ بِهِمْ مِنْ كُلِّ جَانِبٍ، فَكَذَلِكَ إنْ بَقِيَ فِيهَا مُسْلِمٌ أَوْ ذِمِّيٌّ آمِنٌ فَذَلِكَ دَلِيلُ عَدَمِ تَمَامِ الْقَهْرِ مِنْهُمْ، وَهُوَ نَظِيرُ مَا لَوْ أَخَذُوا مَالَ الْمُسْلِمِ فِي دَارِ الْإِسْلَامِ لَا يَمْلِكُونَهُ قَبْلَ الْإِحْرَازِ بِدَارِهِمْ لِعَدَمِ تَمَامِ الْقَهْرِ، ثُمَّ مَا بَقِيَ شَيْءٌ مِنْ آثَارِ الْأَصْلِ فَالْحُكْمُ لَهُ دُونَ الْعَارِضِ كَالْمَحَلَّةِ إذَا بَقِيَ فِيهَا وَاحِدٌ مِنْ أَصْحَابِ الْخِطَّةِ فَالْحُكْمُ لَهُ دُونَ السُّكَّانِ وَالْمُشْتَرِينَ. وَهَذِهِ الدَّارُ كَانَتْ دَارَ إسْلَامٍ فِي الْأَصْلِ فَإِذَا بَقِيَ فِيهَا مُسْلِمٌ أَوْ ذِمِّيٌّ فَقَدْ بَقِيَ أَثَرٌ مِنْ آثَارِ الْأَصْلِ فَيَبْقَى ذَلِكَ الْحُكْمُ، وَهَذَا أَصْلٌ لِأَبِي حَنِيفَةَ – رَحِمَهُ اللَّهُ تَعَالَى -…وَكَذَلِكَ حُكْمُ كُلِّ مَوْضِعٍ مُعْتَبَرٌ بِمَا حَوْلَهُ فَإِذَا كَانَ مَا حَوْلَ هَذِهِ الْبَلْدَةِ كُلُّهُ دَارَ إسْلَامٍ لَا يُعْطَى لَهَا حُكْمُ دَارِ الْحَرْبِ كَمَا لَوْ لَمْ يَظْهَرْ حُكْمُ الشِّرْكِ فِيهَا، وَإِنَّمَا اسْتَوْلَى الْمُرْتَدُّونَ عَلَيْهَا سَاعَةً مِنْ نَهَارٍ.
‘কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহ. বিবেচনায় নিয়েছেন বল ও শক্তির পূর্ণতা। কেননা এই শহর ইতিপূর্বে মুসলমানদের রক্ষণকারী হিসেবে ‘দারুল ইসলাম’-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অতএব, সেই ইহরাজ (রক্ষণশক্তি) মুশরিকদের পূর্ণ প্রতাপ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমেই বিদূরিত হতে পারে। আর তা এই তিন শর্ত সম্মিলিতভাবে পাওয়া গেলেই কেবল সম্ভব। কেননা, যখন তা ‘দারুল হারব’ সংলগ্ন না হবে, তখন চারিদিক থেকে মুসলমানদের বেষ্টনীর মধ্যে থেকে তার অধিবাসীরা পরাভূত থাকবে। তেমনই সেখানে মুসলমান এবং জিম্মি যদি (পূর্বের নিরাপত্তার অধীনেই) নিরাপদ থাকে, তবে তা মুশরিকদের পূর্ণ প্রতাপ না থাকার প্রমাণ। এর দৃষ্টান্ত হলো এ মাসআলা যে, হারবিরা যদি ‘দারুল ইসলাম’-এ অবস্থানরত কোনো মুসলমানের সম্পদ আত্মসাৎ করে, তবে তাদের নিজেদের দেশে সংরক্ষণ করার পূর্ব পর্যন্ত তারা সেই সম্পদের মালিক হয় না; যেহেতু সেখানে পূর্ণ প্রতাপ নেই। যতক্ষণ মূলের নিদর্শনসমূহের একটিও বাকি থাকবে, ততক্ষণ মূলের জন্যই হুকুম প্রযোজ্য হবে, আপতিত বিষয়ের জন্য নয়। যেমন কোনো মহল্লা, যতক্ষণ তথায় একজন জমির মালিকও থাকবে ততক্ষণ তার মালিকানা ও কর্তৃত্বই বহাল থাকবে, নতুন আবাসগ্রহণকারী বা ক্রেতাদের নয়। এই ভূখণ্ড তো মূলত ‘দারুল ইসলাম’-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই যতক্ষণ তাতে কোনো মুসলিম কিংবা জিম্মি (পূর্বের নিরাপত্তার অধীনে নিরাপদ) থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মূলের নিদর্শনসমূহের মধ্য থেকে একটি নিদর্শন তো বাকি থেকেই যাচ্ছে। সুতরাং সেই (পূর্বের) হুকুম (অর্থাৎ ‘দারুল ইসলাম’ বহাল থাকা এবং সেটা ‘দারুল হারব’-এ পরিণত না হওয়া) বাকি থাকবে। এটা ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর একটি মূলনীতি। …তেমনই প্রত্যেক জায়গার হুকুমের ক্ষেত্রে তার আশপাশের জায়গার অবস্থা বিবেচ্য। সুতরাং যখন এই ভূখণ্ডের চারিদিকে ‘দারুল ইসলাম’ তখন এই ভূখণ্ডের ওপর ‘দারুল হারব’-এর বিধান আরোপিত হবে না; যেমনিভাবে সেখানে শিরকি বিধান প্রতিষ্ঠিত না হলে তা আরোপ করা হতো না। মুরতাদরা এর ওপর দিনের কিছু সময়ের জন্য দখল নিয়েছে মাত্র (যার শক্তিশালী কোনো ভিত্তি ও সুদৃঢ় কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেই)।’ (আল-মাবসুত, সারাখসি : ১০/১১৪, প্রকাশনী : দারুল মারিফা, বৈরুত)

সার্বিক আলোচনার পর আমাদের দেখার বিষয় হলো, এখানে কোন মতটি অধিক শক্তিশালী। তো সবার দলিল ও যুক্তি সামনে রাখলে স্পষ্ট হয় যে, এ মাসআলায় জমহুরের মতটিই অধিক শক্তিশালী। কেননা, কোনো ভূখণ্ড ‘দারুল ইসলাম’ বা ‘দারুল হারব’ হওয়ার বিষয়টি এসেছে মূলত আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা থাকা বা না-থাকার ওপর ভিত্তি করে। অতএব, কোনো ‘দারুল হারব’ মুসলমানদের হাতে আসার পর তথায় আল্লাহর দ্বীন ও ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা হলে সেটা যে ‘দারুল ইসলাম’ হবে, তাতে কোনো সন্দেহ বা ইখতিলাফ নেই। অনুরূপ কোনো ‘দারুল ইসলাম’ কাফিররা দখল করে নেওয়ার পর তথায় কুফরি ও অনৈসলামিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলে সেটাও ‘দারুল হারব’ হয়ে যাবে।

হানাফি মাজহাবের বিখ্যাত ফকিহ ইমাম জাসসাস রহ. শারহু মুখতাসারিত তাহাবি-তে ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর ফতোয়াকে তাঁর যুগের জন্য সাব্যস্ত করে সাহিবাইনের মতকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন :
وَالَّذِيْ أَظُنُّ أَنَّ أَبَا حَنِيْفَةَ إِنَّمَا قالَ ذَلِكَ عَلَى حَسْبِ الْحَالِ الَّتِيْ كَانَتْ فِيْ زَمَانِهِ مِنْ جِهَادِ الْمُسْلِمِيْنَ أَهْلَ الشِّرْكِ، فَامْتَنَعَ عِنْدَهُ أَنْ تَكُوْنَ دَارُ حَرْبٍ فِيْ وَسَطِ دَارِ الْمُسْلِمِيْنَ، يَرْتَدُّ أَهْلُهَا فَيَبْقُوْنَ مُمْتَنِعِيْنَ دُوْنَ إِحَاطَةِ الْجُيُوْشِ بِهِمْ مِنْ جِهَةِ السُّلْطَانِ، وَمُطَوَّعَةِ الرَّعِيَّةِ. فَأَمَّا لَوْ شَاهَدَ مَا قَدْ حَدَثَ فِيْ هَذَا الزَّمَانِ، مِنْ تَقَاعُدِ النَّاسِ عَنِ الْجِهَادِ، وَتَخَاذُلِهِمْ، وَفَسَادِ مَنْ يَتَوَلَّى أُمُوْرَهُمْ، وَعَدَاوَتِهِ لِلْإِسْلَامِ وَأَهْلِهِ، وَاسْتِهَانَتِهِ بِأَمْرِ الْجِهَادِ، وَمَا يَجِبُ فِيْهِ، لَقَالَ فِيْ مِثْلِ بَلَدِ الْقَرَمَطِيِّ بِمِثْلِ قَوْلِ أَبْيِ يُوْسُفَ وَمُحَمَّدٍ، بَلْ فِيْ كَثِيْرٍ مِنَ الْبُلْدَانِ الَّتِيْ هَذِهِ سَبِيْلُهَا.
‘আর আমি যেটা মনে করি, ইমাম আবু হানিফা রহ. এসব শর্তের কথা বলেছিলেন তাঁর সময়কার অবস্থার দিকে তাকিয়ে, যখন মুসলমানরা মুশরিকদের সাথে জিহাদ করত। এজন্য তাঁর নিকটে এটা অসম্ভব মনে হয়েছে যে, চারপাশে দারুল ইসলাম থাকা সত্ত্বেও মাঝে একটি দারুল হারব থাকবে, তার অধিবাসীরা সবাই মুরতাদ হয়ে যাবে; অথচ মুসলিম শাসকের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক মুসলিম জনগণ এসে তাদেরকে অবরুদ্ধ না করে নিবৃত্ত থাকবে! কিন্তু তিনি যদি আজকের অবস্থা অবলোকন করতেন, যখন লোকেরা জিহাদ করার ব্যাপারে বিমুখতা প্রদর্শন ও শিথিলতা দেখাচ্ছে, শাসকরা দুর্নীতি করছে, ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে শত্রুতা রাখছে, জিহাদ ও জিহাদ সংশ্লিষ্ট আবশ্যকীয় বিষয়াবলিকে অবজ্ঞা করছে, তাহলে তিনি অবশ্যই কারামতি (মুরতাদ কারামতি কর্তৃক দখলকৃত একটি দেশ) রাষ্ট্রের মতো দেশগুলোকে ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর মতোই ‘দারুল হারব’ বলতেন। শুধু তাই নয়; বরং যেসব রাষ্ট্রের এ অবস্থা, সবগুলোর ব্যাপারেই তিনি এমন ফতোয়া দিতেন।’ (শারহু মুখতাসারিত তাহাবি : ৭/২১৮, প্রকাশনী : দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়া, বৈরুত)

প্রখ্যাত হানাফি ফকিহ আল্লামা ইবনে নুজাইম মিসরি রহ. তাতারদের দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এর রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে সাহিবাইনের মতানুসারে ‘দারুল হারব’ হওয়ার ফতোয়া দিয়ে বলেন :
وَفِي زَمَانِنَا بَعْدَ فِتْنَةِ التَّتَرِ الْعَامَّةِ صَارَتْ هَذِهِ الْوِلَايَاتُ الَّتِي غَلَبُوا عَلَيْهَا وَأَجْرَوْا أَحْكَامَهُمْ فِيهَا كَخُوَارِزْمَ وَمَا وَرَاءَ النَّهْرِ وَخُرَاسَانَ وَنَحْوِهَا صَارَتْ دَارَ الْحَرْبِ فِي الظَّاهِرِ
‘আর আমাদের সময়ে তাতারিদের ব্যাপক ফিতনার পর খুওয়ারিজম, মা-ওরাউন্নাহার, খুরাসানসহ এ ধরনের যেসব অঞ্চলে তারা বিজয়ী হয়েছে এবং তথায় তাদের কুফরি বিধিবিধান চালু করেছে, জাহিরুর রিওয়ায়াত অনুসারে সব ‘দারুল হারব’-এ পরিণত হয়ে গিয়েছে।’ (আল-বাহরুর রায়িক : ৩/২৩০-২৩১, প্রকাশনী : দারুল কিতাবিল ইসলামি, বৈরুত)

বাকি থেকে যায়, এ রাষ্ট্রের চারপাশে যদি কোনো দারুল হারব না থাকে কিংবা দেশের জনগণের পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল না করা হয় তাহলে তো তাদের কর্তৃত্ব পূর্ণাঙ্গ ও শক্তিশালী হয় না। সুতরাং এটাকে ‘দারুল হারব’ কীভাবে বলা হবে? এর উত্তরে বলা যায় যে, যখন একটা রাষ্ট্রে কেউ ভিন্ন আইন ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ফেলে তখন চারপাশে যতই ‘দারুল ইসলাম’ থাকুক না কেন, বুঝাই যায় যে, তারা এদের প্রতিরোধ করতে সক্ষম নয়। যদি সক্ষমই হতো তাহলে তো এরা এ দেশ দখলই করতে পারত না কিংবা এ দেশে তাদের কুফরি আইন চালুও করতে পারত না। তাই শুধু চারপাশের ‘দারুল ইসলাম’ থাকার ভিত্তিতে সে দেশকে ‘দারুল ইসলাম’ বলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এর স্বপক্ষে আমরা কয়েকটি কারণ তুলে ধরছি :

প্রথমত, এটা খুবই স্বাভাবিক যে, কখনও আল্লাহ মুসলমানদের অন্তরে ভীতি বিস্তার করে দেন। তাদেরকে লাঞ্ছনার শাস্তি আস্বাদন করান। তখন উক্ত দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এর চারপাশেই শুধু নয়; বরং পৃথিবীর অর্ধেক জায়গাজুড়ে ‘দারুল ইসলাম’ থাকলেও দেখা যায়, সবাই মিলেও ওই মধ্যবর্তী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে না। এর বাস্তব উদাহরণ হলো বর্তমানের ইসরাইল। মুসলমানদের মূলকেন্দ্র আরব রাষ্ট্রসমূহের মাঝে অবস্থিত ছোট্ট একটি জায়গায় তারা তাদের সব ধরনের কুফরি কর্ম ও বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কিছু করার সামরিক সক্ষমতা মুসলমানদের নেই। বর্তমান সময়ের এমন একজন হক্কানি আলিমকেও পাওয়া যাবে না, যে কিনা ইসরাইলকে ‘দারুল ইসলাম’ বলবে। অথচ তার চারপাশেই কিন্তু লক্ষ্-কোটি মুসলমানদের বসবাস!

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রটি ‘দারুল হারব’ হওয়ার জন্য ‘দারুল হারব’-এর সাথে সংযুক্ত থাকা মূলত যৌক্তিক কোনো শর্ত নয়। কেননা, পার্শ্ববর্তী ‘দারুল হারব’ রাষ্ট্রটি হয়তো এমন দুর্বল হবে, যার থাকা বা না-থাকার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। আর ইমাম আবু হানিফা রহ. তো নিঃশর্ত ‘দারুল হারব’-এর শর্তারোপ করেছেন, শক্তিশালী ‘দারুল হারব’ থাকার কথা বলেননি। অতএব, কোনো কাফিরদের দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এ কুফরি আইন-শাসন চালু হওয়া এবং খলিফার পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল হওয়ার পর যদি দেখা যায়, তার পাশে সামরিকভাবে খুবই দুর্বল একটি ‘দারুল হারব’ আছে, তাহলে তাঁর শর্তানুসারে তো সেটা ‘দারুল হারব’ হয়ে যাওয়ার কথা; অথচ তাঁর এ শর্তারোপের মূলভিত্তি ছিল, পাশে ‘দারুল হারব’ থাকার কারণে এ রাষ্ট্রটির প্রভাব ও শক্তি সুদৃঢ় সাব্যস্ত করা। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহ. বা তাঁর অনুসারী কোনো ফকিহ-ই দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এর পাশে এমন শক্তিশালী ‘দারুল হারব’ থাকার কথা বলেননি। তাহলে যে ভিত্তিতে এ শর্ত করা হলো, সেটাই যখন প্রযোজ্য হচ্ছে না, তাহলে এমন শর্ত করাটা অতিরিক্ত একটি বিষয় হবে, যা ‘দারুল হারব’ হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না।

তৃতীয়ত, চারপাশে ‘দারুল ইসলাম’ থাকা সত্ত্বেও যখন কোনো ‘দারুল ইসলাম’-এ কাফিররা কুফরি আইন ও শাসন প্রতিষ্ঠা করবে, তখন প্রতীয়মান হবে যে, চারপাশের ‘দারুল ইসলাম’-এর শাসকরা হয় গাদ্দারি করে কাফিরদের সঙ্গ দিয়েছে, যদ্দরুন তারাও মুরতাদ হয়ে গিয়েছে, কিংবা দুর্বলতার দরুন তারা কাফিরদের প্রতিহত করতে পারেনি। সুতরাং এই যখন অবস্থা তাহলে চারপাশে অন্য কোনো ‘দারুল হারব’ না থাকায় কী-ই আর এমন সমস্যা হবে! তারা তো নির্দ্বিধায়ই তথায় তাদের খেয়াল-খুশি অনুসারে কুফরি আইন ও শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। হ্যাঁ, এটা হতে পারে যে, পরবর্তী সময়ে অন্য কোনো শক্তিশালী মুসলিম সেনাপতির হাতে এ ‘দারুল হারব’-এর পতন ঘটবে। কিন্তু এর কারণে তো পূর্বের কাফির-শাসিত রাষ্ট্রকে আমরা ‘দারুল ইসলাম’ বলতে পারি না। কোনো রাষ্ট্র কুফরি শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত হবে, আর শুধু চারপাশে দুর্বল ও নামকাওয়াস্তে ‘দারুল ইসলাম’ থাকায় সেটাকেও ‘দারুল ইসলাম’ বলতে হবে, এটা কোনো যুক্তিতেই সঠিক হতে পারে না।

চতুর্থত, দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এর কোনো সীমান্তে ‘দারুল হারব’ থাকলেও এটা খুবই সম্ভব যে, তারা হয়তো পার্থিব কোনো স্বার্থের কারণে এ দখলকারী কাফিরদের শত্রু হবে। হাদিসের ভাষ্যানুসারে যদিও কাফিরদের এক জাতি বলা হয়েছে, কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, তাদের মধ্যে কখনও শত্রুতা সৃষ্টি হবে না কিংবা তাদের একদল অন্য দলের বিরোধিতা করার জন্য কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। এটা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাস্তব একটি বিষয়, যা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। হাদিসের অর্থ হলো, কাফিরদের কাউকে আমরা আপন ভাবব না। কোনো কারণে তারা আমাদের সাথে থাকলেও মৌলিকভাবে তারা আমাদের শত্রু। এখানে মূলত জিনস (জাতীয়তা) বুঝানো হয়েছে, যা ব্যাপকতা বুঝালেও ইসতিগরাক (সামগ্রিকতা) বুঝায় না। তাই তো ইতিহাসে দেখা যায়, অনেক সময় কোনো কাফির রাষ্ট্র অন্য একটি কাফির রাষ্ট্রের সাথে শত্রুতা থাকায় তার ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্ব ও চুক্তি করে। যেমনটি স্পেন বিজয়ের ইতিহাসে দেখা গিয়েছিল। অতএব, দখলকৃত ‘দারুল ইসলাম’-এ এমন শত্রুভাবাপন্ন কোনো ‘দারুল হারব’ থাকলে এতে দখলকারী কাফিরদের কোনোই লাভ নেই; উল্টো শত্রুতা থাকায় বরং তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ইমাম আবু হানিফা রহ. যে ভিত্তিতে এ শর্তারোপ করেছিলেন, দেখা যাচ্ছে শর্ত পাওয়া গেলেও সে মূলভিত্তিটি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই এমন শর্ত করার দ্বারা আলাদা কোনো ফায়েদা নেই।

পঞ্চমত, আর ‘দারুল ইসলাম’ দখলে নিয়ে কাফিররা তথায় কুফরি শাসনব্যবস্থা চালু করলেও এটা হতে পারে যে, কোনো কারণবশত পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি তারা এখনও বহাল রেখেছে। কিন্তু এর অর্থ কখনো এ হওয়া জরুরি নয় যে, তারা ভীত হওয়ায় বা দুর্বল হওয়ায় পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করছে না। এমন হলে তো তারা এ দেশ দখলই করতে পারত না। আর নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করার চাইতে তথায় কুফরি শাসনব্যবস্থা চালু করা অনেকগুণে বেশি কঠিন ও সাহসের ব্যাপার। যখন তারা সে দেশে তাদের কুফরি শাসনব্যবস্থা চালু করতে পেরেছে, তখন পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করতে আর কতক্ষণের ব্যাপার! তাই এর ভিত্তিতে এ ফলাফল বের করা ভুল হবে যে, সম্ভবত তারা প্রবল ও শক্তিশালী না হওয়ায় পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করছে না। বরং এটার সম্ভাবনাই প্রবল যে, হয়তো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকায় এটা বাতিল করার চিন্তা পরে করবে বা এটা তাদের নীতি ও স্বার্থবিরোধী কিছু হচ্ছে না কিংবা এতে তারা অন্য কোনো কল্যাণ দেখছে; এমন বিভিন্ন কারণেই পূর্বের চুক্তি বাতিল না করার সম্ভাবনা আছে। তাই একটি সম্ভাবনাকে নিশ্চিত ধরে তার ভিত্তিতে কাফিরদের দুর্বল প্রমাণ করে সেটাকে ‘দারুল ইসলাম’ আখ্যায়িত করা দুর্বল যুক্তির কথা।

এছাড়াও আরও একাধিক কারণে প্রমাণ হয় যে, এ মাসআলায় ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতের চাইতে তাঁর দু’ছাত্র তথা ইমাম আবু ইউসুফ রহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. এবং ইমাম মালিক রহ., ইমাম আহমাদ রহ.-সহ জমহুরের মত অনেক বেশি শক্তিশালী। অতএব, বর্তমানে আমরা জমহুরের মতের ভিত্তিতেই ‘দারুল হারব’ চিহ্নিত করব। শুধু দেখা হবে যে, সেখানে আল্লাহর আইনের বিপরীতে মানবরচিত আইনের শাসনব্যবস্থা চালু আছে কিনা। চালু থাকলে বুঝতে হবে সেটা ‘দারুল হারব’; যদিও তার অধিকাংশ প্রজা মুসলিম হোক। অনুরূপ কোথাও আল্লাহর আইন ও শাসনব্যবস্থা চালু থাকলে বুঝতে হবে, সেটা ‘দারুল ইসলাম’; যদিও তার অধিকাংশ জনগণ কাফির হোক। তবে উল্লেখ্য যে, এই ইখতিলাফ শুধু ওই সকল ভূখণ্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেখানে একবার ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর তাতে কুফর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অন্যথায় কোনো ভূখণ্ড যদি এমন হয়, যেখানে ইসলামের আবির্ভাবের পর কখনও ইসলাম প্রতিষ্ঠিত-ই হয়নি, তাহলে সেটা ‘দারুল হারব’ হওয়ার ব্যাপারে কারও কোনো মতভেদ নেই; যদিও তথায় উপরিউক্ত তিন শর্ত না পাওয়া যাক।

এ হিসেবে আমরা তাত্ত্বিকভাবে ভূখণ্ডকে চারভাগে ভাগ করতে পারি। এক. এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কখনো কুফরি আইন বা শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দুই. এমন ভূখণ্ড, যেখানে কোনো কালেই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি; বরং সর্বদাই সেখানে কুফরি আইন ও শাসনব্যবস্থা চলে আসছে। তিন. এমন ভূখণ্ড, যেখানে ইসলামের আবির্ভাবের পর প্রথমে কুফরি আইন ও শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল, পরে তথায় ইসলামি আইন বা শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চার. এমন ভূখণ্ড, যেখানে একসময় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত ছিল, এরপর আবারও তাতে কুফরি আইন ও শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং প্রথম প্রকারটি সবার ঐকমত্যে দারুল ইসলাম। দ্বিতীয় প্রকারটি সবার ঐকমত্যে দারুল হারব। তৃতীয় প্রকারটি সবার ঐকমত্যে দারুল ইসলাম। আর চতুর্থ প্রকারটি হলো মতানৈক্যপূর্ণ। জমহুরের মতে এটাও ‘দারুল হারব’। আর এটাই বিশুদ্ধ মত। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা রহ.-এর মতে এতে আরও দুটি শর্ত (অর্থাৎ কোনো ‘দারুল হারব’-এর সীমান্তের সাথে মিলিত থাকা এবং পূর্বের নিরাপত্তাচুক্তি বাতিল করে দেওয়া) পাওয়া গেলে তবেই এটা ‘দারুল হারব’ হবে, অন্যথায় তা ‘দারুল ইসলাম’ বলে গণ্য হবে।


১ম পর্বঃ ক্লিক করুন