মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রায়নের সঙ্কট ও সম্ভাবনা – খান শরীফুজ্জামান

মুসলিম বিশ্ব দেখল মুসলিমদের রক্তে নীলনদ কীভাবে লালনদ হয়ে উঠল। কীভাবে নীলনদের ধারার সঙ্গে মুসলিম সন্ত্রাসীদের (ধর্মনিরপেক্ষ ও পশ্চিমা মোড়লদের মতে) রক্ত ধারা বয়ে গেল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য আরও একবার মুসলিমরা এপ্রিল ফুলের মতো গণতন্ত্রের ফুলে পরিণত হলো। তিন তিনবার নির্বাচনের পরীক্ষা দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় গিয়েও মডারেট মুসলিম ব্রাদারহুড শেষ রক্ষা পেল না—বিশ্বগণতন্ত্রের মোড়ল আমেরিকা-ইসরাইলের অনুগত মিসরীয় সেনাবাহিনীর হাত থেকে। আরব বসন্তের গর্ভে জন্ম নেয়া মুরসিকে বিতাড়িত করে সেই স্বৈরশাসক মোবারককে মুক্ত করে পুরস্কৃত করা হলো। এমন ঘটনার পর মুসলিম বিশ্বের আজকের তরুণরা যদি গণতন্ত্রের রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বাকি বিশ্বকে তা হাসি মুখেই গ্রহণ করতে হবে। যে কোনো পন্থা ও ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মানবিক অধিকার তরুণদের রয়েছে। সেনা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এই অভিযানে মারা গেছে ৫২৫ জন। অপরদিকে মুসলিম ব্রাদারহুড দাবি করেছে, দুই হাজার ৬০০ জন মারা গেছে।

আমরা নব্বইয়ের দশকে আলজেরিয়ায় দেখেছি, ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হওয়ার পরও সেনাবাহিনী সে ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং লিয়ামেন জেরুয়ালের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। লিয়ামিন জেরুয়াল তিন দশক ধরে দেশটিতে একদলীয় শাসন কায়েম করে রেখেছে। নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়ার ফল হিসেবে আলজেরিয়ার জনগণকে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের মুখে পড়তে হয়েছে। আলজেরিয়ার সেক্যুলার রাজনৈতিক দলগুলো মিসরের আজকের সেক্যুলার দলগুলোর মতোই সেনা শাসককে সমর্থন জানিয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মিসরও আলজেরিয়ার পরিণতির পথে হাঁটছে। মজার ব্যাপার, আজ পশ্চিমাবিশ্ব মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রায়নের মার্কেটিং বাদ দিয়ে সেনাশাসক জেনারেল সিসির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও কাউন্টার পাঞ্চ-এর লেখক ইসাম আল-আমিন তার সাম্প্রতিক একটি লেখায় লিখেছেন, ‘আলজেরিয়া ও ফিলিস্তিনের (হামাসকে) মানুষ যখন ১৯৯২ ও ২০০৬ সালে ইসলামপন্থীদের নির্বাচিত করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসলামপন্থীদের বিজয়কে ভিন্ন চোখে দেখেছে। মিসরেও ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। গত দুই দশকে এটা তৃতীয় বার ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের এরূপ অবস্থান ভবিষ্যতে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমাবিশ্বের ভবিষ্যত্ সম্পর্কের নির্ণায়ক হতে পারে।’

মুসলিমবিশ্বের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস
মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রায়নের সঙ্কট বিষয়ে জানতে চাইলে আমাদের মুসলিম বিশ্বেও রাজনৈতিক সঙ্কটের সূত্রপাত সম্পর্কে জানা জরুরি। মুসলিম বিশ্বের সর্বশেষ রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতীক ছিল উসমানিয়া খিলাফত। ১৯২৪ সাল নাগাদ মুসলিমদের রাজনৈতিক উদাসীনতা ও দীর্ঘমেয়াদি পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের কারণে ভেঙে পড়ে খিলাফত ব্যবস্থা। যে ষড়যন্ত্রের মূল নায়ক ছিল সামরিক বাহিনীর সদস্য কামাল আতাতুর্ক। খিলাফতকে ভেঙ্গে তুরস্ককে সেকুলারাইজ করারও মূল নায়ক। ষড়যন্ত্র সফল হওয়া ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব লর্ড কার্জন পার্লামেন্টে সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন,‘বাস্তবতা এমন যে, তুরস্ক আজ মৃত, আর কখনো সে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ, আমরা তার নৈতিক শক্তিকে ধ্বংস করে দিয়েছি, আর তার নৈতিক শক্তি ছিল খিলাফত ব্যবস্থা ও ইসলাম।’ (“The situation now is that Turkey is dead and will never rise again, because we have destroyed its moral strength, the Caliphate and Islam”.) লর্ড কার্জন সতর্ক করে বলেন, আমাদের সে সব বিষয়গুলোও ধ্বংস করতে হবে যা মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। কার্জনের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি ৬ অক্টোবর, ২০০৫ আমরা ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রসচিব চার্লস ক্লার্কের হেরিটেজ ফাউন্ডেশন (British Home Secretary Charles Clarke) বক্তব্যের মাঝেও পাই। তিনি বলেন, খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও শরিয়া আইন বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনো আলোচনা হতে পারে না ঐ পথে হাঁটার ব্যাপারে মুসলিমদের হুশিয়ারি করা হয়েছে।” অর্থাত্ উপরোক্ত বক্তব্য থেকে বোঝা যায় খিলাফতের পতন ছিল মুসলিম বিশ্বেও মানুষের জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট। মূলত এরপর থেকে শুরু হয় পশ্চিমা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর মুসলিম ভূ-খণ্ড দখল ও সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা। সশস্ত্র আগ্রাসন ও অসমযুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয় এ রাষ্ট্রগুলোর উপর। নির্বিচারে শুরু হয় আবাল-বৃদ্ধা-বণিতা-যুবকদের নিষ্পেষণ, ধর্ষণ ও গণহত্যার উত্সব। আফগানিস্তান ও উপসাগরীয় যুদ্ধ এবং সর্বশেষে ৯/১১ পর তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এ অঞ্চলের ঘটনা প্রবাহে নতুনমাত্রা সৃষ্টি করেছে। যাই হোক, খিলাফতের পতনের পর মুসলিম বিশ্বে সৃষ্টি হয় ‘ভ্যাকুম অব পলিটিক্যাল সিস্টেম অ্যান্ড পলিটিক্যাল লিডারশিপ’ (vaccume of political system and political leadership). ফলে শুরু হয় সামরিক শাসন, রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও সর্বশেষে পুতুল সরকার ব্যবস্থা। তবে, এসব ব্যবস্থার অনুকূলে পশ্চিমা পুঁজিবাদী শাসক গোষ্ঠীর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ও ইন্ধন ছিল। এখনও আছে। যারা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের সাম্য ও স্বাধীনতার এক অলীক ধারণা বিকিয়ে যাচ্ছে মুখরোচক আলোচনার টেবিলে।

মুসলিম বিশ্বে নির্বাচন আর গণতন্ত্র কখনও এক নয়
নির্বাচন হলো পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বোচ্চ সংগঠন রাষ্ট্রের নেতা জে বের করার একটি উপায়। যা একটি পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ইসলামি ব্যবস্থা তথা সব ব্যবস্থার মধ্যেই গ্রহণযোগ্য নেতা নির্বাচনের একটি উপকরণ মাত্র। ইলেকশন কোনো রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনরার আদর্শ নয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মিসর, ইরাক, ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তানের মানুষ দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক অত্যাচার ও স্বৈরাচারী শাসকদের কারণে যথার্থভাবে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ না পাওয়ায় নির্বাচনে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। গণতন্ত্র আর ইলেকশন এক নয় বলেই পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমন অপশন জনগণকে দেয়া হয়নি যে জনগণ পুঁজিবাদী গণতন্ত্র চায়, নাকি সমাজতন্ত্র চায়। যে কটি মুসলিম দেশে এখন নামকাওয়াস্তে তথাকথিত গণতন্ত্র আছে সেগুলোর কোনোটিতেই গণতন্ত্র জনগণের মতামত নিয়ে আরোপ করা হয়নি। জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তা না হলে তারা জনগণের কাছে অপশন দিত যে, জনগণ কি ‘ইসলামি শাসন ব্যবস্থা’ চায়, নাকি ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ চায়। অর্থাত্ ইলেকশন আর গণতন্ত্র এক নয়। মিসরে ইসলামপন্থী সংবিধানের (আংশিক ইসলামি আইন সংবলিত সংবিধান) জন্য নির্বাচন হয়েছিল, ইসলামপন্থীরাই জিতেছিল।

আধুনিক ও বর্তমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সবাই একমত যে, ইলেকশন অনুষ্ঠিত হলেই একটি জাতিকে গণতান্ত্রিক বলা যায় না। মূলত, প্রচলিত পুঁজিবাদী গণতন্ত্রেও উত্পত্তি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ থেকে। আর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের থেকে উত্সারিত হয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, ব্যক্তির স্বার্বভৌমত্ব তথা জনগণের স্বার্বভৌমত্ব। সর্বোপরি উদারবাদী চিন্তা-ভাবনার উন্মেষ ঘটেছে রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক জীবনেও। এসবের সম্মিলিত প্যাকেজই আজকের আধুনিক পুঁজিবাদ যা ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’, ‘বিশ্বায়নে’র মতো বিভিন্ন নতুন নতুন নামে বিশ্বব্যবস্থায় বাজারজাতকরণ করা হচ্ছে। এছাড়া ব্যক্তিস্বাধীনতার দর্শন থেকে যে হোমোসেক্সচুয়ালিটি, এডালট্রি, পর্নোগ্রাফি ও মদ্যপানের সংস্কৃতি পশ্চিমে গড়ে উঠেছে এর প্রত্যেকটি বিশ্বাসই ইসলাম ও মুসলিমদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ভিন্ন বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির ধারক মুসলিমরা তাদের আদর্শে অনড় ও শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী। ইরাক অথবা আফগানিস্তানের মানুষ কখনোই বিশ্বাস করে না পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে। ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির সংঘাত আজ মুসলিমসহ সারা বিশ্বে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।

এছাড়া মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের সফলতার কথা তুললে অনেকেই মালয়েশিয়া ও তুরস্কের কথা উল্লেখ করে। এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার উন্নতি হয়েছে মূলত মাহাথির মুহম্মদের এক ধরনের এক নায়কত্বের শাসনামলে। বাকি থাকল তুরস্ক। সেখানের সেকুলাইজেশন প্রজেক্টও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকেনি। গত প্রায় এক দশক সেখানেও ইসলামপন্থীরাই ক্ষমতায় আছে। এই এ.কে পার্টির বিরুদ্ধে সেখানের সেকুলাররা প্রায়ই দাবি তোলে, দলটি নাকি আবার উসমানীয় ঢংয়ের শাসন ব্যবস্থা আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। আর দেশ দুটির সংবিধান ও সাধারণ মানুষের মধ্যেও পশ্চিমা সেকুলার আদর্শ ও সংস্কৃতির গণতন্ত্রের কোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ পাওয়া যায় না। ইরাক-আফগানিস্তানে ও আমেরিকা গণতান্ত্রিক শাসন চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে সেখানে সুশাসন আনতে পুরোপুরি ব্যর্থ।

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ইতিহাসও ভালো কিছু নয়। তাই মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রায়নের ভবিষ্যত্ নিয়ে শঙ্কা যে কোনো ইতিহাস সচেতন মানুষেরই আছে। আমেরিকান বিশিষ্ট নীতি-নির্ধারক ও বর্তমান বিশ্বের প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এইচ পি হান্টিংটন তার ‘দ্য ক্লাস অফ সিভিলাইজেশন’ থিসিসের মধ্যে বলেছেন, ‘সভ্যতাসমূহের দ্বন্দ্ব ভবিষ্যত্ বিশ্বরাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করবে। সভ্যতাসমূহের বিভেদ রেখাই ভবিষ্যত্ সংঘাতের পথ বাতলে দেবে। আর এ সভ্যতাসমূহের বিভেদরেখাই পশ্চিমা ও ইসলামি সভ্যতার মধ্যে ১৩০০ বছরের দ্বন্দ্বের ইতিহাস গড়ে তুলেছে।’ মুসলিমদের তথা ইসলামের জীবনাদর্শ যে পশ্চিমা পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের অনুকূলে নয় এ সত্য উপলব্ধি করেই কি আমেরিকান সাবেক রাষ্ট্রপতি নিক্সন তার ‘ভিক্ট্রি উইদাউট ওয়ার’ বইয়ের মধ্যে বলেছেন, ‘সাম্যবাদী ও ইসলামি বিপ্লবী উভয়ই আমাদের আদর্শিক শত্রু। যাদের উদ্দেশ্যও অভিন্ন। তারা তাদের আদর্শের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদ্ধতি ব্যবহার করে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় যা কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এইচ পি হান্টিংটন তার ‘ক্লাস অফ সিভিলাইজেশন অ্যান্ড রিমেকিং দ্য ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ডা বইয়ের মধ্যে খোলসা করেই বলেছেন, ‘ইসলামি মৌলবাদ পাশ্চাত্যের জন্য কোনো অন্তর্নিহিত সমস্যা নয়। ‘ইসলাম’ই সমস্যার মূল কারণ। এটা এক স্বতন্ত্র সভ্যতা, যার আওতাভুক্ত মানবমণ্ডলী তাদের সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তারা ক্ষমতার দিক দিয়ে পিছিয়ে বিধায় আবেগ আক্রান্ত (পৃ-১০৯-১১০)।

মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি পশ্চিমা পুঁজিবাদীদের স্বার্থবিরোধী
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর মুসলিম বিশ্বের স্বৈরশাসকদের ক্ষমতায় নিয়ে আসা ও তাদের সব রকমের সহযোগিতা দিয়ে মসনদে টিকিয়ে রাখার বিষয়গুলো আজ বুঝতে আর কারও বাকি নেই। ওসমানিয় খিলাফতের পতনের পর মুসলিম ভূ-খণ্ডগুলো থেকে সম্পদ প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য ব্রিটিশ-ফ্রান্স-আমেরিকা কখনও স্বৈরশাসক আবার কখনও সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। মুসলিম বিশ্বের স্বৈরশাসকদের সঙ্গে আমেরিকার দহরম-মহরম সম্পর্কের কথা কারও না জানা নেই। জামাল আব্দুল নাসের, ইসলাম কারিমভ, হোসনে জাইম, করিম কাসেম, হাফিজ আল আসাদ, জেনারেল সুহার্তো, সাদ্দাম, সৌদ বংশের শাসকগণ, গাদ্দাফি, মোবারক, আইয়ুব খান, জিয়াউল হক, মোশাররফদের মতো বর্তমান ও সাবেক স্বৈরশাসকরা আমেরিকা-ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনে টিকে আছে, টিকে ছিল। তেল সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনায় ইরানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জনপ্রিয় মোসাদ্দেক সরকারকে হটিয়ে রেজা শাহ পাহলভীকে ক্ষমতায় বসায়। অনুগত স্বৈরশাসক রেজা শাহ পাহলভীর শাসনামলে সামরিক বাহিনীর উন্নয়নের নামে আমেরিকা বাত্সরিক ত্রিশ মিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রদান করত। ১৯৯৫ সালে ক্লিনটন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একজন কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসে ইন্দোনেশিয়ার স্বৈরশাসক জেনারেল সুহার্তোকে ‘আওয়ার কাইন্ড অফ গাই’ হিসেবে সম্বোধন করেন। এতে সুস্পষ্ট হয়, ইন্দোনেশিয়ায় তার আমলের গণহত্যা, জুলুম ও স্বৈরশাসনের প্রতি আমেরিকার নগ্ন সমর্থন ছিল। সাদ্দাম হোসেনের ঘটনাও ব্যতিক্রম কিছু নয়। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ইরান, সিরিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এ দেশগুলোর স্বৈরশাসকদের হাত থেকে জনগণকে মুক্ত করা আমেরিকা-ব্রিটেনের লক্ষ্য নয়।

গণতন্ত্র নিয়ে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে মতভেদ
কিছু বড় ইসলামি দল রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জন ও রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তাই বিশ্বে ও বহু দেশে তাদের শাখা বা সংগঠন থাকা সত্ত্বেও তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। মুসলিম বিশ্বেও সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী সবগুলোর কোনোটিই ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। যে দলগুলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তারা নির্বাচনকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণে একটি মাধ্যম বা হিকমা হিসেবে মনে করে। সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক দলের একটি সম্প্রতি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী মুসলিম ব্রাদার হুড ও আরেকটি হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবিশ্বাসী হিযবুত তাহরির। সালাফিপন্থী বা বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া-পাকিস্তানে আহলে হাদিস হিসেবে পরিচিত আছে কিছু দল। এই আহলে হাদিসপন্থী অধিকাংশ দলগুলোও গণতন্ত্রকে একটি কুফরি মতবাদ মনে করে। আল কায়দার মতো সশস্ত্র দলগুলোকে আলোচনায় আনলেও বলতে হয়—এগুলোর অধিকাংশ গণতন্ত্রকে মুসলিমদের জন্য হারাম মনে করে। এছাড়া সাধারণ ধার্মিক মুসলিমদের প্রায় ৯০ ভাগেরও বেশি মানুষ খুলাফায়ে রাশিদার শাসন ব্যবস্থাকে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসন ব্যবস্থার মডেল হিসেবে মনে করেন। হযরত মুহম্মদ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী খিলাফত ব্যবস্থা আবার ফিরে আসবে। মুসনাদে আহমদ শরিফের সহি হাদিস- ‘—- আবার খিলাফত ফিরে আসবে নবুয়্যতের আদলে।’ বিশ্বব্যবস্থায় ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাস দেখতে গেলেও তা কোনোভাবেই উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানীয় খিলাফতের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে নয়। ইসলামের প্রকৃত রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো খিলাফত আমলের রাজনীতি বা খুলাফায়ে রাশিদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রীয় মডেল (তাফসির ইবনে কাসির, ১০ম খণ্ড)। পশ্চিমা গ্রিকীয় গণতন্ত্র বা আইন প্রণয়নে মানুষের সার্বভৌমত্বের গণতন্ত্র পশ্চিমা বিশ্বে রাসুল ও তার সাহাবি, তাবেয়ি ও তাবেতাবেইনদের সময়েও বিদ্যমান ছিল। কিন্তু, ওই আদর্শ তারা কখনো রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার নীতি বা আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেননি। তবে জনগণের প্রতিনিধি নির্ধারণের জন্য নির্বাচন বা মনোনয়ন দুইই ইসলাম অনুমোদন দেয়। কিন্তু, রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের অনুমোদন ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসে পাওয়া যায় না। কারণ, সাহাবিরা ও পরবর্তী খলিফাগণ জানতেন ইসলামি ব্যবস্থাকে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। সর্বশেষ খিলাফত ব্যবস্থা উসমানীয় খিলাফতও টিকে ছিল আধুনিক গণতন্ত্রের জয়জয়কারের মধ্যে। ১৯২০ সালে এর ভাঙ্গনের প্রান্ত বেলায়ও উসমানীয় খিলাফতের খলিফা ব্রিটেন-ফ্রান্সের চাপের মুখেও গণতন্ত্র বাস্তবায়নে নারাজ ছিলেন। ১৯২০ সালে উসমানীয় খিলাফত ব্যবস্থাকে ভেঙে দেয়ায় ব্রিটেনের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদে বাংলাদেশ ও ভারতের মানুষ খিলাফত আন্দোলন করেছে। তাই প্রায় সব সুন্নিপন্থীই দল খিলাফত প্রতিষ্ঠার রাজনীতিকে ইসলামি মূল ধারার রাজনীতি মনে করে। গণতন্ত্র যেমন কোনো দলের বিষয় নয়, খিলাফত ব্যবস্থাও কোনো ব্যক্তি বা একটি ইসলামি দলের বিষয় নয়।

আরব বিশ্বে মুসলিম তরুণরা স্বৈরতন্ত্রের জিঞ্জির হতে মুক্তির জন্য যে বিপ্লবের সূচনা করেছিল সে মুক্তির স্বপ্ন ভঙ্গ হলে তারা চরমপন্থার দিকে পা বাড়াতে পারে। ব্রাদারহুড তথা মুসলিমবিশ্বের অন্যান্য ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সামনেও বড় প্রশ্ন থাকবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নির্বাচন কী তাদের ইসলামি সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী? নাকি পশ্চিমা সেকুলার পুঁজিবাদী বিশ্ব চায়, ইসলামপন্থীরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করুক কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের ইসলামি আদর্শ যেন বাস্তবায়ন না করে। হাজার বছরের ক্রুসেডের বারংবার যুদ্ধ ও পরাজয়ের ইতিহাসও হয়তো পশ্চিমারা ভুলতে পারে না। তাদের ধারণা সেকুলার পুঁজিবাদী গণতন্ত্র ধর্মভিত্তিক মুসলিম সমাজে হয়তো মানিয়ে উঠতে পারবে না। তাই মুসলিমবিশ্বের ১৪০০ বছরের ভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার নিরিক্ষে পশ্চিমারা হয়তো ইসলামপন্থী দলগুলোকে সমর্থন দিতে সংকোচবোধ করে। ঐতিহাসিক ও আদর্শিক এ দ্বন্দ্বের অভিজ্ঞতা মনে হয় ইসলাম ও পুঁজিবাদী সেকুলার গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ সম্পর্কের রূপ নির্ধারণ করবে।


লেখক ও মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতিবিষয়ক এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যেঃ আমার দেশ . ১৪আগস্ট ২০১৩