একজন ড্রোন অপারেটরের জবানবন্দি: মৃত শিশুদের কুকুর হিসেবে রেকর্ড করতে বলা হয় – ইমরান হেলাল

নেভাদা মরুভূমির একটি গোপনীয় চেম্বার। মনিটরে চোখ রেখে বসে আছে ফার্স্ট ক্লাস এয়ারম্যান ব্রেন্ডন ব্রায়ান্ট। মনিটরে তিনটি সাদা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। ঐ তিনটি অবয়ব আসলে তিনজন আফগান, যারা আফগানিস্তানের একটি রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। ব্রেন্ডন তাদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। তাদের চলার উদ্দেশ্য, তাদের জীবনের কোন ঘটনা, এমনকি তাদের নামটি পর্যন্ত নয়। তাকে শুধু বলা হয়েছে, তারা রাইফেল বহন করছে। রহস্যময় চেইন অব কমান্ড থেকে হেডফোনে ভেসে আসা কন্ঠ তাকে বাটন চাপতে নির্দেশ দেয়। তিন… দুই… এক।

৭৫০০ মাইল দূরে, একটি Hellfire মিসাইল সক্রিয় হয়ে উঠে। শব্দের গতিতে ছুটতে থাকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে। ব্রেন্ডনের স্ক্রিন কয়েক মুহূর্তের জন্য সাদা হয়ে যায়।

তার ভাষায়, “যখন স্ক্রিন পরিষ্কার হলো, আমি দুই জন মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ চারপাশে ছড়িয়ে আছে দেখতে পেলাম। আর একজনের ডান হাটু থেকে বাকি অংশটুকু নেই। সে হাঁটু চেপে ধরে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আর ফিনকি দিয়ে রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ছিল। তারপর ধীরে ধীরে লোকটি মাটির সাথে যেন মিলিয়ে গেল।”

এটি ছিল ২০০৭ সালের ঘটনা। ব্রেন্ডনের প্রথম শিকার। ৬ বছর পর, যখন সে বিমান বাহিনী ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তাকে একটি তালিকা দেয়া হলো। সে যতগুলো মিশনে অংশগ্রহণ করেছে, তাতে নিহত হওয়া মানুষের একটি হিসাব আছে এই তালিকায়। সংখ্যাটা ছিল ১,৬২৬।

আসুন ব্রেন্ডনের মুখ থেকে আরো দু’টো ঘটনা শুনা যাক।

“ইরাকের একটি বাজারে একজন কমান্ডার তার গাড়ির ট্রাংক থেকে দু’টি মেয়েকে টেনে বের করলো। মেয়েগুলোর হাত এবং মুখ বাঁধা ছিল।

তাদের রাস্তার মাঝেই হাঁটুর গেড়ে বসিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু কেউ টুঁ শব্দটিও না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল।”

আরেকটি ঘটনা ২০০৭ সালের। আফগানিস্তানে একটি ছুটন্ত লক্ষ্যবস্তুকে তার মিসাইল আঘাত করার ঠিক আগের মুহূর্তে ব্রেন্ডনের মনে হলো ছোটখাটো গড়নের এই লক্ষ্যবস্তুটি ঠিক যেন একটি শিশু। ব্রেন্ডন এবং তার সহকর্মী তাদের গোয়েন্দা অবজারভারকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করলে জবাব ছিল,

“রিভিউ অনুসারে, ওটা তো একটা কুকুর।”

ব্রেন্ডন বলেন, “আমি নিশ্চিত যে, ওটা কোন কুকুর ছিল না।” অবসরের পর ব্রেন্ডনের সঙ্গী ছিল মদ আর হতাশা। অন্যান্য ড্রোন অপারেটরদের মত তাকেও Post traumatic stress disorder এর চিকিৎসা নিতে হয়।

ড্রোন অপারেটিং এর সময় নাকি সে জোম্বি হয়ে যেত! ভাবলেশহীন আর নির্বিকার ভঙ্গিতে শুধু মানুষ হত্যা। তাই ১,০৯০০০ ডলারের বোনাসও ব্রেন্ডনকে তার চাকুরিতে ধরে রাখতে পারেনি। সে তার এই সাক্ষাৎকার দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, ড্রোন অপারেটরদের জন্য ব্যাপারগুলো নিছকই ভিডিও গেম নয়, যেমনটা তাদের বলা হয়েছিল।

“তুমি হবে জেমস বন্ডের সহকারী, যার কাজ হলো সবসময় চোখ কান খোলা রেখে তাকে সাহায্য করা।”

দু’টি হৃদয়বিদারক ঘটনা:

২০০৯ সালের প্রথম দিন। সকালবেলা নিজেদের বাড়িতে বসে নাস্তা করছিল দুই ভাই যাহিনুল্লাহ আর আসিফ ইকবাল। হঠাৎ নতুন বছরের উপহার হিসেবেই যেন তাদের উপর আঘাত হানে একটি Hellfire মিসাইল। যাহিনুল্লাহ ঘটনাস্থলেই মারা যায় এবং আসিফ হাসপাতালে। তাদের বাবা করিম খানের ভাষায়, “যাহিনুল্লাহর মুখের একপাশে একটি বিশাল গর্ত আর তার শরীর দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। আমাকে বলা হয়, যারা এই মিসাইলগুলো চালায় তাদের ভাষায় এটি নাকি Bug-splat (একটি জনপ্রিয় গেমস যেখানে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় পিষে থেতলে দেয়া হয়)!!!”

উত্তর ওয়াজিরিস্হানে গোত্র প্রধানদের একটি সভায় শুধুমাত্র সন্দেহের বশে ড্রোন হামলা চালিয়ে ৪০ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে একজন মালিক হাজি বাবাত। তিনি একজন গোত্র প্রধান এবং পুলিশ অফিসার ছিলেন। তার ছেলে খলিল খান বলেন, “আমি যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছাই, সেখানকার অবস্হা ছিল ভয়াবহ। কাউকেই চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না, কারণ সবার দেহই টুকরো টুকরো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। আমার কাছে যে টুকরোগুলো বাবার মনে হচ্ছিল একটি ছোট কফিনে তার কয়েকটি সংগ্রহ করে আমি ফিরে আসি।”

উপরে বর্ণিত ভুক্তভোগীদের একজনও চিহ্নিত সন্ত্রাসী ছিল না। এরকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে, অসংখ্য। আপনারা নাবিলার ঘটনা জেনেছেন কিছুদিন আগেই। আপনারা চাইলে আরো পড়ে নিতে পারেন। কিন্তু কোন খবরে আসেনি, এধরনের হত্যাকান্ডের সংখ্যা আরো অনেক বেশি।

তাহলে বারাক ওবামা ড্রোন হামলার পক্ষে যে বক্তব্য দিয়েছেন তার ব্যাখ্যা কী?

This is a targeted, focused effort at people who are on a list of active terrorists, who are trying to go in and harm Americans.

ব্রেন্ডনের আরেকটি অনুভূতি দিয়ে শেষ করছি, “আপনি যখন বুঝতে পারবেন আপনার মাথার উপর একটি ড্রোন সার্বক্ষণিক ঘুরে বেড়াচ্ছে আর নজর রাখছে, আপনি কিছুতেই স্বাভাবিক থাকতে পারবেন না।”

এটাতো একজন ড্রোন অপারেটরের অনুভূতি। যাদের মাথার উপর ড্রোন ২৪ ঘন্টা শুধু ঘুরেই বেড়ায় না, বরং প্রায়ই কিছু মিসাইলও ফেলে যায়, তাদের ঘরবাড়ি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়, তাদের প্রিয়জনদের খন্ড বিখন্ড লাশ রেখে যায়, তাদের নিজেদের পঙ্গু করে দিয়ে যায়; সেই মানুষগুলোর কি আদৌ অনুভূতি বলে কিছু বেঁচে আছে?

তথ্যসূত্র এবং আরো বিস্তারিত বর্ণনাঃ

১. http://edition.cnn.com/2013/10/23/us/drone-operator-interview/index.html

২. http://www.gq.com/news-politics/big-issues/201311/drone-uav-pilot-assassination

৩. http://www.dailymail.co.uk/news/article-2220828/US-drone-attacks-CIA-chiefs-face-arrest-horrific-evidence-bloody-video-game-sorties.html

৪. http://m.aljazeera.com/story/201311193857549913

৫. http://drones.pitchinteractive.com/