এতদাঞ্চলে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’: পরিচিতি, মহিমা ও মজলুমি (৩য় পর্ব) – মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক (দা.বা)

কিছু বই, চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

আলোচ্য পুস্তিকাটিতে প্রথমে কিছু বইয়ের নাম দেওয়া হয়েছে, যার লেখক হিন্দুস্তানের বাদায়ুনী বা রেযাখানী ঘরানার অথবা তাদের সমমনা লোকেরা। এগুলো তারা লিখেছে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে। ঐ ঘরানা দুটি ছিল ভারতবর্ষে বিদআত ও শিরকী কর্মকান্ডের বড় পৃষ্ঠপোষক। আলোচ্য পুস্তিকায় হক্কানী আলিমগণকে তাদের নিম্নলিখিত বইগুলোর উপর মুনাযারার চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়েছে।

(১) ‘তাহকীকুল ফাতাওয়া’

আবেদ শাহ সাহেব একই সঙ্গে শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. এবং আল্লামা ফযলে হক খায়রাবাদী রাহ. দু’জনের উপর মিথ্যারোপ করে লিখেছেন,

‘ইমামে আহলে ছুন্নত হজরত আল্লামা ফজলে হক খায়েরাবাদী (রঃ) হিন্দুস্থানে ওহাবীদের প্রথম ইমাম মৌলবী ইছমাইল দেহলভীর বিরুদ্ধে এই ফতোয়া দিয়াছেন যে, ইছমাইল দেহলভী কাফের, বেদ্বীন, ইসলাম ধর্ম্ম হইতে সম্পূর্ণ বহির্ভূত। যে ব্যক্তি তাহার কুফরী সম্বদ্ধে অবগত হওয়ার পর তাহাকে কাফের জানিবে না বরং তাহার কুফরী সম্বদ্ধে একটু সন্দেহ করিবে সেও কাফের। কেননা ইছমাইল দেহলভী তাহার রচিত ‘তাকবীয়াতুল ঈমান’ কিতাবে লিখিয়াছে যে, কেয়ামতের দিবসে রসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াছাল্লাম পাপী মুসলমানদের মুক্তির জন্য শাফায়াত করিবেন বলিয়া যদি কেহ বিশ্বাস করে তবে সে অভিশপ্ত আবু জেহেলের ন্যায় মুশরিক হইবে। দেখুন প্রমাণ স্বরূপ আল্লামা খায়েরাবাদী (রঃ) তাহকিকুল ফতুয়া নামক কিতাবখানা। আমার নিকট এই ফতুয়া হক এবং সহীহ।’

অথচ বাস্তবতা হলো, ইসমাঈল শহীদ রাহ.-ও রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফাআত অস্বীকার করেননি। আর ফযলে হক খায়রাবাদীও তাকে কাফের বলেননি। খায়রাবাদী রাহ.-এর কিতাব ‘তাহকীকুল ফাতওয়া’ বান্দার কাছে আছে। এবং রীতিমত রেজভী ঘরানার প্রকাশকের ছাপানো কপিই আছে। আমি তা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি। তাতে আবেদ শাহ সাহেবের উদ্ধৃত ঐ বক্তব্য নেই। এটা আবেদ শাহ সাহেবের নিজের বানানো কথা।

বিষয়টি আরো স্পষ্ট হওয়ার জন্য আমি শুধু দুইটি কথা বলতে চাই। প্রথম কথা হল, ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ তো দুষ্প্রাপ্য কোনো কিতাব নয়। আজ পর্যন্ত এর লক্ষাধিক কপি ছাপা হয়েছে। অসংখ্য মানুষ তা থেকে তাওহীদ ও সুন্নাহর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং শিরক ও বিদআত থেকে বিমুখ হয়েছেন। যে কোনো শিক্ষিত মানুষ নিজেই বইটি পড়ে দেখতে পারেন, তাতে কি হাশরের ময়দানে আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফাআতকে অস্বীকার করা হয়েছে, না তা দলীল দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে?

তাক্ববিয়াতুল ঈমানের পৃষ্ঠা ৬৬ থেকে পৃষ্ঠা ৭৩ পর্যন্ত শাফাআতের আলোচনা পুরো পড়ুন। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লে নিজেই দেখতে পাবেন, ইসমাঈল শহীদ রাহ. ঐ শাফাআতকে প্রমাণ করেছেন যা কুরআন বলেছে আর ঐ শাফাআতকে অস্বীকার করেছেন যা কুরআন অস্বীকার করে।

কুরআনে কারীমের একাধিক আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার আদেশ ছাড়া কেউ কারো জন্য সুপারিশ করতে পারবে না এবং আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছাড়া কারো কোনো সুপারিশ কার্যকরও হবে না। -দেখুন, সূরা সাবা (৩৪) : ২২-২৩; সূরা নাবা (৭৮) : ৩৮; সূরা বাকারা (২) : ২৫৪-২৫৫

আল্লাহ তাআলার আদেশে যে শাফাআত হবে তার নাম ‘শাফাআত বিল ইয্ন’ (অনুমতিক্রমে শাফাআত)। শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. ‘তাকবিয়াতুল ঈমানের’ ৭২ নম্বর পৃষ্ঠায় স্পষ্ট ভাষায় তা প্রমাণ করেছেন। তিনি খণ্ডন করেছেন ঐ শাফাআতকে যার বিশ্বাস কাফের মুশরিকেরা পোষণ করে। মুশরিকদের বিশ্বাস ছিল, তাদের উপাস্যকুল আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সুপারিশ করে নাজাতের ব্যবস্থা করতে পারে বা তাদের সুপারিশের সামনে নত হয়ে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে আল্লাহ তাআলা নাজাত দিয়ে দিবেন। এমনিভাবে অনেক ফাসেক-ফাজেরেরও এরকম শিরকী বিশ্বাস রয়েছে যে, তাদের পীররাও আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে সুপারিশ করে তাদের নাজাতের ব্যবস্থা করতে পারবে।

তাকবিয়াতুল ঈমান কিতাবে ‘শাফাআত’ বিষয়ে শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. যা কিছু লিখেছেন তার সারসংক্ষেপ এটাই। যে কেউ তাঁর কিতাব নিজেই পড়ে দেখতে পারেন। বলাবাহুল্য, এতে না কুফরী আছে, না র্শিক, আর না রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে গোসতাখী, না তাঁর শাফাআতের ইনকার; বরং তা খালেস তাওহীদ এবং কুরআনের অনুসরণ।

তো শাহ শহীদ রাহ. যখন শাফাআতের ইনকার করেননি তো এই ইনকারের ভিত্তিতে তাকে কাফের বলার প্রশ্নই অবান্তর। কেউ তা করলে তা নিতান্তই না-হক কাজ, যার কোনোই ই‘তিবার নেই।

দ্বিতীয় কথা হল, আল্লামা ফযলে হক্ব খাইরাবাদী রাহ. ছিলেন হযরত শাহ শহীদ রাহ.-এর উস্তাযভাই। কারণ তিনিও ছিলেন শাহ আব্দুল আযীয রাহ. ও শাহ আব্দুল কাদের রাহ.-এর শাগরিদ। পাশাপাশি তিনি হযরত শাহ শহীদ রাহ.-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। যদিও দু’জনের মাঝে কিছু মাসআলায় মতানৈক্য ছিল। নীচের ঘটনাদুটি লক্ষ্য করুন :

১. শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. যখন বালাকোটের ময়দানে শহীদ হলেন এবং আল্লামা ফযলে হক্ব খায়রাবাদী রাহ.-এর কাছে তাঁর শাহাদাতের সংবাদ পৌঁছল তখন তিনি মানতিক শাস্ত্রের দরস দান করছিলেন। সংবাদটি শোনামাত্র তিনি দরস বন্ধ করে দেন এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত থাকেন। এরপর বলেন,

اسماعيل کو ہم مولوی (ہی) نہیں مانتے تھے بلکہ وہ امت محمدیہ کا حکیم تھا۔ کوئی شئ  نہ تھی جس کی انیت اور لمیت اس کے ذھن میں نہ ہو۔ امام رازی اگر حاصل کیا تو دود چراغ  کھا کر (رات کر چراغ کی روشنی میں محنت کرکے) اور اسماعیل نے محض اپنی قابلیت اور استعداد خدا داد سے.

ইসমাঈলকে আমরা (শুধু) মৌলভী মনে করতাম না; বরং তিনি ছিলেন উম্মতে মুহাম্মাদীর ‘হাকীম’ (গভীর তত্ত্বজ্ঞানী) এমন কিছু ছিল না, যার ‘ইন্নিয়্যত’ ও ‘লিম্মিয়্যত’ তার অজানা ছিল। ইমাম রাযী যদি তা অর্জন করে থাকেন, তবে তা চেরাগের সলতে পুড়িয়ে আর ইসমাঈল তার স্বভাব-যোগ্যতা ও খোদা-প্রদত্ত মেধার ফলে।’ -আলহায়াত পৃ. ১১০; শাহ ইসমাঈল শহীদ, ড. খালেদ মাহমুদ রাহ. পৃ. ৩২; আকমালুল বায়ান পৃ. ৮০৯; শাহ ইসমাঈল শহীদ আওর উনকে নাকিদ, মাও. আখলাক হুসাইন কাসেমী, পৃ. ১৬ মুকাদ্দিমাহ

২. আল্লামা ফযলে হক্ব খায়রাবাদী রাহ. একথাও বলেছেন যে,

مجھ سے سخت غلطی ہوئی کہ میں نے مولوی اسماعیل صاحب کی مخالفت کی، وہ بے شک حق پر تھے اور میں غلطی پر تھا، مجھ پر جو مصیبت پڑی وہ مرے انہی اعمال کی سزا ہے، میری مولوی اسماعیل کے ساتھ دوستی تھی، میں بھی ان کے ساتھ شہید ہوتا، مگر کیا کیا جاۓ، بدایوں والوں نے ابھار کر ان سے بھڑا دیا۔

আমার বড় ভুল হয়েছে, আমি মৌলভী ইসমাঈল ছাহেবের বিরোধিতা করেছি। তিনি নিঃসন্দেহে হক্বের উপর ছিলেন আর আমি ভুলের উপর। আমি যে বিপদে আক্রান্ত হয়েছি তা আমার ঐ সব কাজের শাস্তি। মৌলভী ইসমাঈল ছাহেবের সাথে তো আমার বন্ধুত্ব ছিল। আমিও তার সাথে শহীদ হতাম! কিন্তু কী করা যাবে বাদায়ুনীরা উস্কানী দিয়ে আমাকে তাদের সাথে ভিড়িয়ে নিল।’ -আমীরুর রিওয়ায়াত পৃ. ১৬, মুফতী ইনায়াতুল্লাহ রাহ.-এর বরাতে আমীর শাহ খানের বর্ণনা; শাহ ইসমাঈল শহীদ, ড. খালেদ মাহমুদ পৃ. ৩২

উপরের ঘটনা ও বক্তব্যের দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আল্লামা খায়রাবাদী রাহ. সম্পর্কে ঐ দাবি যে, তিনি শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.-কে ‘কাফের’ বলতেন- ভুল ও অবাস্তব।  (এ বিষয়ে আরো কিছু আলোচনা সামনের অধ্যায়ে পড়–ন।)

(২) সাইফুল জাব্বার

আলোচ্য পুস্তিকায় উল্লেখিত দ্বিতীয় বইটি হচ্ছে মৌলভী ফযলে রাসূল বাদায়ুনীর ‘সাইফুল জাব্বার’। এই বই সম্পর্কে আলোচ্য পুস্তিকার বক্তব্য হচ্ছে, মৌলভী ফযলে রসূল বাদায়ুনী এই বইয়ে প্রমাণ করেছেন যে, শাহ শহীদ রাহ. তার কিতাবে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর কিতাবুত তাওহীদের চেয়ে বেশি কুফরিয়াত লিখেছেন। তেমনি ইংরেজের সাথে শাহ শহীদ রাহ.-এর গোপন সম্পর্ক ছিল এবং বাস্তবে তিনি ছিলেন ইংরেজের দালাল। এ প্রসঙ্গে পাঠক শুধু দুটি কথা মনে রাখুন।

এক. প্রথমে মৌলভী ফযলে রাসূল বাদায়ুনীকে চিনে নিন, কে এই লোক? তার দ্বীনদারি ও আমানতদারির অবস্থা তো তার নিম্নোক্ত ফতোয়া থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। ইংরেজ শাসনামলে সে ফতোয়া দিয়েছিল-

ببینید ساختن بت کفر نیست، و در جواز  بیع آن تفصیل علی الاختلاف، ومزدوری ساختن بتخانہ وبرا فروختن نارمعبود مجوس جائز۔

অর্থাৎ : লক্ষ্য কর, মূর্তি বানানো কুফর নয় এবং এর বেচাকেনা জায়েয হওয়ার বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে। আর মন্দির নির্মাণে মজদুরি করা ও অগ্নিপূজকের অগ্নি প্রজ্জ্বালনে মজদুরি করাও জায়েয।’ -ফাতাওয়া মৌলভী ফযলে রাসূল বাদায়ুনী পৃ. ১৪, মুদ্রণ : আল খালাইক প্রেস, ১২২৮ হিজরী, শাহ জাহান আবাদ; শাহ ইসমাঈল শহীদ, ড. খালেদ মাহমুদ পৃ. ১৭৭

যে লোক মন্দির নির্মাণে ও অগ্নিপূজার জন্য আগুন প্রজ্জ্বালনের সেবাদানকে জায়েয বলে এবং মূর্তি নির্মাণে উৎসাহিত করা হয় এমন সব কথা ফতোয়া আকারে সমাজে প্রচার করে, তার কাউকে কাফির বলা বা মুসলমান বলায় কী আসে যায়?

মৌলভী ফযলে রাসূল বাদায়ুনীর জীবনের আরেকটি দিকও বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, যা ঐ খানদানের এক মুরীদ মুহাম্মাদ ইয়াকুব কাদেরী ‘আকমালুত তারীখে’র দ্বিতীয় অংশে লিপিবদ্ধ করেন। এ বইয়ের ৩৮, ৫১ ও ৩৭২ থেকে ৩৮০ পর্যন্ত পাঠ করলে পাওয়া যাবে যে, মৌলভী ফযলে রাসূল বাদায়ুনী ছিলেন ইংরেজের বেতনভোগী কর্মচারী। তিনি ইংরেজের সমর্থনে কী কী কাজ করেছেন তা জানার জন্য পড়–ন ‘মুতালাআয়ে বেরেলবিয়্যাত’, ড. আল্লামা খালেদ মাহমুদ, খ- ২, পৃ. ১৮৭-১৮৯

দুই. ফযলে রাসূল বাদায়ুনী যেমন লোকই হোক তার বই ‘সাইফুল জাব্বারে’ এই মিথ্যা কথাটি নেই যে, ইংরেজের সাথে শাহ শহীদ রাহ.-এর আঁতাত ছিল বা তিনি তাদের সহযোগিতা করতেন বা তিনি তাদের দালাল ছিলেন (নাউযুবিল্লাহ)। এটি আবেদ শাহ সাহেবের নিজের সৃষ্টি, যা তিনি ফযলে রাসূল বাদায়ুনী ও তার বই ‘সাইফুল জাব্বারের’ নামে চালিয়ে দিয়েছেন। আমার কাছে ‘সাইফুল জাব্বার’-এর কপি আছে। যদি কোনো রেজভী বন্ধু তা পাঠ করতে চান, আমার কাছে এসে তা পাঠ করতে পারেন এবং আবেদ শাহ সাহেবের মিথ্যাচারের একটি দৃষ্টান্ত সচক্ষে দেখতে পারেন।

‘সাইফুল জাব্বারে’ এ কথাও নেই যে, তাকবিয়াতুল ঈমানে কিতাবুত তাওহীদ থেকে বেশি কুফরিয়াত রয়েছে। এটাও আবেদ শাহের বানানো কথা। তবে হাঁ, এই বাদায়ুনী মৌলভী সাহেব যেহেতু বিদআত ও শিরকী কর্মকাণ্ডের সমর্থক তাই তার তাওহীদের আকীদা বড় ঢিলাঢালা। এ কারণে সে ‘সাইফুল জাব্বার’-এ ‘তাকবিয়াতুল ঈমানের’ আলোচনার উপর কিছু অসার ও ভিত্তিহীন আপত্তি তুলেছে এবং এই অবাস্তব কথাও বারবার লিখেছে যে, তাকবিয়াতুল ঈমানের সব কিছু মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর কিতাবুত তাওহীদ থেকে গৃহীত । অথচ ইতিপূর্বে দালীলিক আলোচনার দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, কিতাবুত তাওহীদের সাথে তাকবিয়াতুল ঈমানের এবং শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর সাথে ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর কোনো প্রকারের সম্পর্ক নেই। আলোচনাটি আবার একবার দেখে নেয়া যায়।

আবেদ শাহ সাহেবের অনুযোগ ‘সাইফুল জাব্বারের’ কোনো জওয়াব কেন লেখা হয় না! তাকে কে বোঝাবে যে, সব কথার জওয়াব হয় না। ‘সাইফুল জাব্বারে’ জবাব দেয়ার মতো কোনো ‘শোবহা’ যদি থেকেও থাকে তবে তার জবাব মাওলানা আযীযুদ্দীন মুরাদাবাদী লিখিত أكمل البيان في تأييد تقوية الإيمان  -এ পাওয়া যাবে। প্রায় হাজার পৃষ্ঠার কিতাব। এই একটি কিতাব পাঠ করলেও সকল বিভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

হাঁ, শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. যিনি কাফেরদের সাথে অবিরাম জিহাদ করেছেন এবং অবশেষে শহীদ হয়ে গেছেন, তাঁর জিহাদের সূচনা যদিও সময়ের দ্বীনী প্রয়োজন ও ভবিষ্যত দ্বীনী স্বার্থের বিবেচনায় শিখদের সাথে হয়েছিল কিন্তু তার মূল লক্ষ্য ছিল ইংরেজ। খোদ ইংরেজ ঐতিহাসিকেরাও তা স্বীকার করেছেন। তাঁকে ইংরেজের দালাল বলা এমনই নির্জলা মিথ্যা, যা কোনোরূপ পর্যালোচনার অপেক্ষা রাখে না।

শাহ শহীদ রাহ. ও তাঁর শায়েখ সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর ঈমান উদ্দীপক ঈমানী ও জিহাদী ঘটনাবলী জানার জন্য পড়–ন :

১. ‘সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ’ মাও: গোলাম রাসূল মেহের। (চার খণ্ডে)

২. সীরাতে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ, মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (দুই খণ্ডে) বিশেষত : প্রথম খ- পৃ. ৩৯৯-৪৪৭

৩. মাকাতীবে সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ

৪. শাহ ইসমাঈল শহীদ, ড. আল্লামা খালেদ মাহমুদ (বিশেষত : পৃ. ৪০-৬১)

৫ ‘তাহকীক ও ইনসাফ কি আদালত মে এক মজলুম মুসলিহ কা মুকাদ্দামা’ মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী

৬. সেহমাহী আহওয়াল ওয়া আসার, বিশেষ সংখ্যা: ২০-২১ (অক্টোবর ২০০৮-মার্চ ২০০৯), সম্পাদক মাওলানা নূরুল হাসান রাশেদ কান্ধলভী, প্রকাশক : হযরত মুফতী এলাহী বখশ একাডেমী, মুযাফফারনগর, ইউপি, ভারত

(৩) দেওবন্দী মাযহাব

আবেদ শাহ সাহেব ‘দেওবন্দী মাযহাব’ নামে একটি বইয়ের উল্লেখ করেছেন। এবং গোলাম মেহের মাহমুদপুরীকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, তিনি ঐ বইয়ে আকাবিরে দেওবন্দকে ইংরেজের দালাল বলেছেন।

এ কথা লিখে আবেদ শাহ সাহেব নিজেকেও লাঞ্ছিত করেছেন এবং গোলাম মেহের মাহমুদপুরীকেও। কারণ সর্বজনবিদিত সত্যের বিপরীত কিছু বলা নিজেকে প্রকাশ্য লাঞ্ছিত করা ছাড়া আর কী হতে পারে।

আকাবিরে দেওবন্দ, যাদের ইংরেজ-বিদ্বেষ সর্বজনবিদিত এবং ১৮৫৭-এর সিপাহী বিপ্লবসহ এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইংরেজের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল আন্দোলন-সংগ্রামে যাঁরা ছিলেন সর্বপ্রথম সারিতে এবং এ অপরাধে কালাপানির নির্বাসনসহ সব ধরনের দ- ও নির্যাতন যারা ভোগ করেছেন, তাদেরকে ইংরেজের দালাল বলা কত বড় দুঃসাহসিকতা! উপরন্তু তা যদি হয় এমন সব লোকের মুখে যাদের ইংরেজ সাম্র্রাজ্যবাদী বা অন্য কোনো অমুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে এক ফোঁটা রক্ত ঝরানোর সৌভাগ্য তো দূরের কথা, আল্লাহর পথে এক বিন্দু ঘামও হয়তো ঝরাবার তাওফীক হয়নি!! রেশমী রুমাল আন্দোলন কি দারুল উলূম দেওবন্দের সদরুল মুদাররিসীন হযরত শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রাহ.-এর ছিল, না আপনাদের জনাব আহমদ রেযা খানের?! আল্লাহ তাআলা মিথ্যুকদের ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে মুসলমানদের হেফাযত করুন।

আকাবিরে দেওবন্দের ইংরেজ বিদ্বেষ ও জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর প্রোজ্জ্বল ইতিহাস জানার জন্য পড়ুন :

১. উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী, মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ মিয়াঁ

২. আসীরানে মাল্টা, মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ মিয়াঁ

৩. তাহরীকে শায়খুল হিন্দ (রেশমী রুমাল আন্দোলন) মাওলানা সাইয়েদ মুহাম্মাদ মিয়াঁ

৪. নকশে হায়াত শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়েদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহ.

৫. আসীরে মাল্টা, ঐ

৬. তারীখে দারুল উলূম দেওবন্দ, সংকলন : সাইয়্যেদ মাহবুব রেজভী, উভয় খ-, বিশেষত প্রথম খণ্ডের ৫০৬-৫১৫

৭. তাহরীকে আযাদী আওর মুসলমান, মাওলানা আসীর আদরাভী

৮. বীছ বড়ে মুসলমান, মাওলানা আব্দুর রশীদ আরশাদ

৯. চালীছ বড়ে মুসলমান, সংকলন ও বিন্যাস, সাইয়্যেদ হাফেয আকবর শাহ বুখারী

১০ তাহরীকে পাকিস্তান কে আযীম মুজাহিদীন, ঐ

১১. হিন্দুস্তানী মুসলমান, মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী

১২. আররশীদ, লাহোর, দারুল উলূম দেওবন্দ সংখ্যা খ. ৪ সংখ্যা ২ ও ৩

১৩. জামিয়াতু দেওবন্দ আল ইসলামিয়্যাহ ফী যাওইল মাক্বালাতিল বানূরিয়্যাহ, মাওলানা সাইয়্যেদ ইউসুফ বানূরী

(৪) ‘আলকাওকাবাতুশ শিহাবিয়্যাহ ফী কুফরিয়াতি আবিল ওয়াহাবিয়্যা’

চতুর্থত যে বইটির উল্লেখ আবেদ শাহ সাহেব করেছেন তা হল, আহমদ রেযা খান সাহেবের ‘আলকাওকাবাতুশ শিহাবিয়্যাহ ফী কুফরিয়াতি আবিল ওয়াহাবিয়্যা’। আবেদ শাহ সাহেবের দাবি, এতে শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর সত্তরটি নির্বাচিত কুফরী কথা (নাউযুবিল্লাহ) উল্লেখ করা হয়েছে। আর তিনি নিজেও তা বাস্তব মনে করেন এবং শাহ শহীদ রাহ.-কে কাফের মনে করেন। অথচ আবেদ শাহ সাহেবের ভালো করেই জানা ছিল যে, শাহ শহীদ রাহ.-এর জীবনে সত্তর তো দূরের কথা একটি কুফরী কথাও নেই।

আবেদ শাহ সাহেব তো আহমদ রেযা খানের ঐ বইয়ের ভিত্তিতে শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.-কে কাফের মনে করছেন। কিন্তু ভালো হত তিনি যদি স্বয়ং আহমদ রেযা খান সাহেবকেই জিজ্ঞাসা করে নিতেন যে, তিনিও শাহ শহীদ রা.-কে ‘মাআযাল্লাহ’ কাফের মনে করেন কি না?

আহমদ রেযা খান তার ‘তামহীদে ঈমান’ কিতাবে শাহ শহীদ রাহ.-কে কাফির বলতে সরাসরি অস্বীকার করেছেন এবং পরিষ্কার লিখেছেন যে,

علماۓ محتاطین اسے کافر نہ کہیں

সাবধানতা অবলম্বনকারী আলেমগণ তাঁকে যেন কাফের না বলেন।

তিনি আরো বলেন,

یہی صواب ہے، وھوالجواب، وبہ یفتی، وعلیہ الفتوی، وھو المذھب وعلیہ الاعتماد، وفیہ السلامۃ، وفیہ السداد۔ یعنی یہی جواب ہے، اور اسی پر فتوی ہو اور  ایسی فتوی ہے، اور یہی ہمارا مذھب ہے اور اسی پر اعتماد اور اسی میں سلامت اور اسی میں استقامت.

অর্থাৎ ‘এটাই ঠিক কথা এবং এটাই উত্তর। এই অনুযায়ীই ফতোয়া। এটাই ফতোয়া এবং এটাই নির্ভরযোগ্য। এতেই নিরাপত্তা এবং এতেই অবিচলতা’। -পৃ. ৪২

চিন্তা করুন। আবেদ শাহ সাহেব এই সত্যপথের শহীদকে কাফের বানানোর জন্য যার উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি কত শক্তভাবে ও তাকিদের সাথে বলেছেন যে, তাকে যেন কোনোভাবেই কাফির বলা না হয়। এখন আবেদ শাহের অনুসারীরাই সিদ্ধান্ত নিন যে, কোনটা ঠিক- জনাব আহমদ রেযা খানের ফতোয়া, না আপনাদের আবেদ শাহের কথা?

(৫) হুসামুল হারামাইন

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপের হীন উদ্দেশ্যে লেখা যে বইয়ের উল্লেখ আবেদ শাহ সাহেব খুব জোরেশোরে বিস্তারিতভাবে করেছেন তা হচ্ছে, জনাব আহমদ রেযা খানের ‘হুসামুল হারামাইন’। তার বক্তব্য, এই কিতাবে আহমদ রেযা খান মাওলানা কাসেম নানুতবী, মাওলানা রশীদ আহমাদ গঙ্গুহী, মাওলানা খলীল আহমাদ সাহারানপুরী ও মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (আল্লাহ তাদের উপর রহম করুন)-কে কাফের বলেছে এবং মক্কা মুকাররমা ও মদীনা মুনাওয়ারার ৩৩ জন মুফতী তাতে স্বাক্ষর করেছেন। এরপর হিন্দুস্তানের ২৬৮ জন মুফতী তাতে দস্তখত করেছেন, যা আলাদাভাবে ‘আসসওয়ারিমুল হিন্দিয়া’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। আবেদ শাহ সাহেবের বক্তব্য, হুসামুল হারামাইন ছাপা হয়েছে ১৩২৪ হিজরীতে আর ‘আসসাওয়ারিমুল হিন্দিয়া’ ছাপা হয়েছে ১৩৪৫ হিজরীতে। প্রথম কিতাব প্রকাশিত হওয়ার পর ৯৫ বছর এবং দ্বিতীয় কিতাব প্রকাশিত হওয়ার পর প্রায় পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু কোনো ওহাবী দেওবন্দী এ দুই কিতাবের কোনোটিরই জবাব লেখেনি।’

‘হুসামুল হারামাইন’ নামক বইটি আলোচনায় এনে আবেদ শাহ সাহেব আসলে রেজভী বন্ধুদের এক পুঁতিগন্ধময় ইতিহাসের ঢাকনা খুললেন! একই সাথে এই নির্জলা মিথ্যাও উচ্চারণ করলেন যে, হুসামুল হারামাইন ও আসসাওয়ারিমুল হিন্দিয়া’র কোনো জবাব এ পর্যন্ত লেখা হয়নি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বাতিল ফের্কাগুলোর মধ্যে রাফেযী শিয়া ফের্কা ছিল মিথ্যাকথনে প্রবাদতুল্য। এখন দেখা যাচ্ছে রেজভী ফের্কা ওদেরকেও মাত করে দিচ্ছে!

হুসামুল হারামাইনের হাক্বীকত

উম্মাহর অবনতিশীল অবস্থার ইসলাহ ও সংশোধনের দায়িত্বপালনের ধারা যখন আকাবিরে দেওবন্দ পর্যন্ত পৌঁছল আর তাঁরা তাওহীদ ও সুন্নাহর প্রচার-প্রসারে এবং শিরক-বিদআত ও রসম-রেওয়াজের খ-ন ও মূলোৎপাটনে নিজেদের জীবন ওয়াক্ফ করে দিলেন তখন তা বিদআতের পক্ষের শক্তির সহ্য হল না। ঐ সময় বিদআতের পক্ষে ও পৃষ্ঠপোষকতায় যে লোকটি ময়দানে ছিলেন তিনি হলেন জনাব আহমদ রেযা খান। শিরক-বিদআতের বিরুদ্ধে ঐ আকাবিরীনের সংগ্রামের প্রভাব দুর্বল করার জন্য আহলে ঈমান এবং আহলে তাওহীদ ও সুন্নাহ্কে কাফের আখ্যা দেয়ার তার পুরানো অস্ত্রটি এঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করার সংকল্প করেন এবং ঐ আকাবিরীনের মধ্যে যাদের খেদমত ঐ সময় ব্যাপক ও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল তাদেরকেই টার্গেট করেন। তাদের কিছু কিছু কিতাব থেকে উম্মাহর সংশোধনমূলক কিছু কথাকে কাটছাঁট করে এবং তাতে শব্দগত ও অর্থগত বিকৃতি ঘটিয়ে সেগুলোকে কুফরী বাক্যের রূপ দান করেন। এরপর এগুলো তাদের সাথে যুক্ত করে তাদেরকে কাফের আখ্যা দেন। এ বিষয়ে ১৩২০ হিজরীতে তার একটি আরবী কিতাব المعتمد المستند নামে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে তার খামোখা কাফের আখ্যা দেয়ার বিষয়টি গণমানুষের মাঝে ব্যাপক সমালোচিত ও ধিকৃত হয়েছে। তাই তার এই বইয়ের কোনো প্রভাব মানুষের মধ্যে পড়েনি এমনকি যাদেরকে এই বইয়ে কাফের আখ্যা দেওয়া হয়েছে তারাও একে ভ্রুক্ষেপযোগ্য মনে করেননি।

আহমদ রেযা খান তার ফতোয়ার এই দুর্দশা দেখে এক নতুন ফন্দি আঁটেন। ১৩২৩ হিজরীতে তিনি এই ফতোয়ার উপর মক্কা মুয়াজ্জামা ও মদীনা মুনাওয়ারার ব্যক্তিত্বদের দস্তখত নেয়ার জন্য হিজায চলে যান এবং ওখানকার উলামা ও মুফতীদের কাছে চূড়ান্ত শঠতার সাথে এই ফরিয়াদ করেন যে, হিন্দুস্তানে ইসলাম অতি নাযুক অবস্থার মুখোমুখি। মুসলমানদের মধ্যে এই এই কুফরী আকীদা পোষণকারী কতক লোকের উদ্ভব ঘটেছে এবং আম মুসলমানের উপর এদের প্রভাব বেড়েই চলেছে। আমরা অসহায় কিছু মানুষ এই ফিৎনা প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি; কিন্তু এ কাজে আপনাদের সাহায্য অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। আপনারাও এই বদ-আকীদার লোকদের কুফরীর ফতোয়ায় দস্তখত করে দিন। যেহেতু আপনারা আল্লাহ তাআলার পবিত্র ভূমির এবং রাসূলুল্লাহর পাক শহরের অধিবাসী তাই দ্বীনী নির্দেশনার ব্যাপারে হিন্দুস্তানী মুসলমানেরা আপনাদের উপরই পুরোপুরি আস্থাশীল। তাই এই ফতোয়ার উপর আপনাদের দস্তখতই হিন্দুস্তানের সাধারণ মুসলমানদেরকে কুফ্র ও বদদ্বীনীর এই সয়লাব থেকে রক্ষা করতে পারে। সাহায্য। সাহায্য! হে খোদার শার্দূলেরা! সাহায্য! সাহায্য! হে মুহাম্মদী লশকরের ঘোড়সওয়ারেরা! (দেখুন, হুসামুল হারামাইন-এর ভূমিকা)

মোটকথা, হারামাইনের আলিমগণ মূল ঘটনা সম্পর্কে একেবারেই বেখবর ছিলেন এবং উর্দূ ভাষা জানা না থাকায় ঐ আকাবির আলেমগণের ঐ সকল বইপত্র পড়ারও সুযোগ তাদের ছিল না, যাদের ব্যাপারে খান বেরেলভী সাহেব এইসব কুফরী কথা-বার্তা রচনা ও সম্বন্ধ করেছে। মক্কা মুআজ্জমা ও মদীনা তাইয়েবার পাকদিল আলেমগণ খান বেরেলভীর এই শঠতাপূর্ণ রোদনে প্রভাবিত হয়ে তার সব কথাকেই বাস্তব মনে করেন এবং তার এই কাফের আখ্যাদান সম্বলিত ফতোয়ায় দস্তখত করে দেন। ফতোয়ায় প্রশ্ন যেমন ছিল উত্তরও সে অনুযায়ী ছিল। এখন প্রশ্নই যদি বানানো ও অবাস্তব হয় তাহলে মুফতীর কী করার আছে! কিন্তু এরপরও কিছু প্রখর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি তাঁদের ঈমানী অন্তর্দৃষ্টির কারণে এবং অন্য আরো কিছু আলেম আলাদা সূত্রে প্রাপ্ত কিছু সংবাদের কারণে সতর্ক হয়ে যান এবং এই ফাঁদে জড়িয়ে যাওয়া থেকে বেঁচে যান।’[1]

যাইহোক, খান বেরেলভী হারামাইনের আলেমদের যাদের কাছ থেকে সম্ভব হয়েছে দস্তখত নিয়ে হিন্দুস্তানে ফিরে আসেন এবং এগুলোকে ‘হুসামুল হারামাইন’ নামে, উর্দূ তরজমার সাথে প্রকাশ করেন, যার কারণে হিন্দুস্তানী মুসলমানদের মধ্যে এক তুফানসম ফিৎনার সৃষ্টি হয়। অনেক লোক যারা ইতিপূর্বে আহমদ রেযা খানের প্রোপাগান্ডায় একেবারেই প্রভাবিত ছিল না তাদেরও অনেকে মক্কা-মদীনার আলিমগণের নাম শুনে বিভ্রান্ত হন এবং এই ফিৎনার শিকার হয়ে পড়েন। এই সময়ে আকাবিরে দেওবন্দের পূর্ণ মনোযোগ ছিল ভারতবর্ষে ইসলামের মৌলিক গঠনমূলক কাজে। তারা দ্বীনী তালীম, ইসলাহ ও সংশোধনের কাজে আত্মনিমগ্ন ছিলেন। মৌলভী বেরেলভী সাহেবের এই কাফের বানানোর কাজটিকে তাঁরা ইতিপূর্বে ভ্রুক্ষেপযোগ্যও মনে করেননি; বরং এমন লোকদের পেছনে সময় ব্যয় করা এবং তাদের মিথ্যাচারসমূহের জওয়াব দেওয়াও ছিল তাদের নীতি ও রুচির পরিপন্থী। কিন্তু যখন দেখা গেল, আল্লাহর বান্দাদেরকে হারামাইনের আলেমদের নাম দিয়ে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে এবং সহজ-সরল আম মুসলমান এই ধোঁকাবাজির শিকার হয়ে ফিৎনায় পড়ছে তখন তারাও প্রয়োজন অনুপাতে এই ধোঁকাবাজির পর্দা উন্মোচন করা ও বাস্তব বিষয়টি প্রকাশ করে দেওয়া জরুরি মনে করলেন। এরই ফলশ্রুতিতে যে চারজন শীর্ষস্থানীয় বুযুর্গ আলেমের উপর আহমদ রেযা খান কুফরীর অপবাদ আরোপ করেছিল তাদের মধ্যে দুইজন, হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. ও মাখদূমুল মিল্লাত হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রাহ., যাঁরা তখনও জীবিত ছিলেন- এইসব মিথ্যাচারের ব্যাপারে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন, যাতে তারা এইসব কুফরী আকীদা থেকে মুক্ত থাকার কথা ঘোষণা করেন এবং পরিষ্কার লেখেন যে, ‘মৌলভী আহমদ রেযা খান আমাদের সম্পর্কে যেসব আকীদা প্রচার করে তা সে আমাদের উপর আরোপ করেছে। এ ধরনের আক্বীদা পোষণকারীকে আমরা নিজেরাও কাফের মনে করি।’

আর যে দুই বুযুর্গ হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী এবং হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী ইতিমধ্যে ইন্তেকাল করেছিলেন তাঁদের কিতাবাদি থেকে তাঁদের ওই সব বক্তব্য তুলে ধরা হয়, যা আহমদ রেযা খানের কথাবার্তার সম্পূর্ণ বিরোধী। এভাবে প্রমাণ করে দেওয়া হয় যে, বাস্তবে তাদের আকীদা কী, আর আহমদ রেযা খান তাদের নামে কী প্রচার করেছে। এ প্রসঙ্গে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের পক্ষ থেকে যেসব কিতাব প্রকাশিত হয় তার মধ্যে কয়েকটি কিতাবের নাম নীচে দেওয়া হল :

১. ইনসাফুল বারী মিনাল কাযযাবিল মুফতারী, মাওলানা সাইয়্যেদ মুরতাজা হাসান চাঁদপুরী

২. ইসকাতুল মু‘তাদী, ঐ

৩. আসসাহাবুল মিদরার ফী তাওজীহি আকওয়ালিল আখয়ার, ঐ

৪. তাযকিয়াতুল খাওয়াতির আম্মা- উলকিয়া ফী উমনিয়্যাতিল আকাবির, ঐ

৫. ক্বতউল ওয়াতীন আম্মান তাকাওয়ালা আলাস সালেহীন, ঐ

৬. তাওজীহুল বয়ান ফী হিফযিল ঈমান, ঐ

এই কিতবাগুলো হুসামুল হারামাইন প্রকাশিত হওয়ার পরপরই লেখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সর্বশেষ কিতাবটি হচ্ছে, তাওযীহুল বয়ান, যা ১১ রবিউল আওয়াল ১৩৩১ হিজরী লিপিবদ্ধ হয় এবং ঐ সময় প্রকাশিত হয়।

৭. বাসতুল বানান লিকাফ্ফিল লিসান মিন কাতিবি হিফযিল ঈমান, হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী

৮. আশশিহাবুস সাকিব আলাল মুসতারিক্বিল কাযিব, শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী

এই কিতাবটি ১৩২৮ হিজরী মোতাবেক ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে রচিত এবং ঐসময় প্রকাশিত।

এই সব কিতাব এবং এছাড়া আরো বহু কিতাব ‘হুসামুল হারামাইন’ প্রকাশিত হওয়াতর পর এর মিথ্যা ও জালিয়াতি ছিন্নভিন্ন করার জন্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। এছাড়া আরো যেসব কিতাব ও মুনাযারা- বৃত্তান্ত আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তার কথা তো বাদই থাকল। অথচ আবেদ শাহ সাহেব বলছেন, হুসামুল হারামাইন প্রকাশিত হওয়ার পর আজ পর্যন্ত কেউ এর জওয়াব লেখেনি! এহেন বক্তব্যকে মিথ্যাচার বলা হবে, না অন্য কিছু- এ ফয়সালার ভার পাঠকের উপরই ছেড়ে দিচ্ছি।

হারামাইনের আলেমগণ কর্তৃক ‘হুসামুল হারামাইন’ ও তার সংকলককে প্রত্যাখ্যান

আরো আশ্চর্যের বিষয়, আবেদ শাহ সাহেব যেন একেবারেই জানেন না যে, মক্কা-মদীনার শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ বাস্তব অবস্থা অবহিত হওয়ার পর ‘হুসামুল হারামাইন’ ও তার সংকলকের ব্যাপারে প্রতিবাদ লিখেছেন এবং তাদের পূর্বের বক্তব্য পরিহার করেছেন। এই ইতিহাসটাও শুনে নিন। জনাব আহমদ রেযা খান তার না-হক ও সাজানো ফতোয়ার উপর হারামাইনের আলেমদের দস্তখত নিয়ে নেওয়ার পর হারামাইনে বিশেষ করে মদীনা শরীফে এ আলোচনা হতে থাকে যে, এই ভারতীয় মৌলভী যাদের ব্যাপারে কুফরীর ফতোয়ায় দস্তখত নিয়ে গেছে ফতোয়ার প্রশ্নপত্রে সে তাদের বাস্তব আকীদা পেশ করেনি। সে তাদের ব্যাপারে কিছু মনগড়া কথা সাজিয়ে এই কাজ করে গেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, তারা সমকালীন ভারতবর্ষে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। ফলে ওখানকার কিছু আলেম সরাসরি উলামায়ে দেওবন্দের কাছ থেকে বিষয়টি জেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। হুসামুল হারামাইনে তাদের সম্পর্কে যা কিছু উদ্ধৃত করা হয়েছে তার আলোকে ২৬টি প্রশ্ন তৈরি করে উলামায়ে দেওবন্দের কাছে জওয়াব চাওয়া হয়। এই প্রশ্নগুলি ওলামায়ে দেওবন্দের আকাইদ ও তাদের মত ও পথের ব্যাপারেই ছিল। হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী এর বিস্তারিত ও দালীলিক জবাব লেখেন। এই রচনার সমাপ্তির তারিখ ১৮ শাওয়াল ১৩২৫ হিজরী।

এতে ঐ সময়ের প্রায় সকল শীর্ষস্থানীয় ও প্রসিদ্ধ উলামায়ে দেওবন্দ দস্তখত করেন এবং তা মক্কা-মদীনা ছাড়াও মিসর, শাম প্রভৃতি মুসলিম দেশসমূহের উলামা ও মুফতীদের কাছে পাঠানো হয়। তারা সবাই এর উত্তরসমূহকে সত্যায়ন করেন এবং এর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। তারা লেখেন যে, এ সবই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা এবং এর কোনোটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদার পরিপন্থী নয়।

এই সকল প্রশ্ন ও উত্তর হিন্দুস্তান, মক্কা-মদীনা ও অন্যান্য ইসলামী দেশের আলিমগণের সত্যায়ন ও সমর্থন সে সময়ই উর্দূ অনুবাদের সাথে ‘আলমুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ’

(المهند على المفند، معروف به التصديقات لدفع التلبسات، مع ترجمہ اردو مسمی : ماضي الشفرتين على خادع أهل الحرمين)

নামে প্রকাশিত হয়। এরপর এর বহু এডিশন প্রকাশিত হয়েছে। বাস্তবতা এই যে, এই একটি গ্রন্থই জনাব আহমদ রেযা খানের জালিয়াতি ও প্রতারণা বোঝার জন্য যথেষ্ট, যদি খোদাভীতি ও সত্যান্বেষণ থাকে।

অতি আফসোসের ব্যাপার, আবেদ শাহ সাহেব এই সকল বাস্তবতা সম্পূর্ণ চেপে গেছেন এবং অজ্ঞতার ভান করে বলেছেন, এত বছর হয়ে গেল, আজ পর্যন্ত কেউ হুসামুল হারামাইনের জবাব লিখল না! فلعنة الله على الكاذبين অথচ লেখা উচিত ছিল, একশ বছরের এই দীর্ঘ সময়েও রেজভীদের কেউ المهند على المفند -এর জবাব লিখতে পারেনি, আর না এর যুক্তিযুক্ত কোনো জবাব লেখা সম্ভব। এরপরও খান বেরেলভীর মিথ্যাচার-ভিত্তিক  কাফের বলার অপবাদ এরা বহন করে চলেছেন আর নিজেদের আমলনামার পাশাপাশি খান বেরেলভীর আমলনামাকেও বুহতান ও মিথ্যা অপবাদের এবং খাঁটি মুমিনদের কাফের আখ্যা দেওয়ার গুনাহের মাধ্যমে কণ্টকিত করে চলেছেন। আল্লাহ এদের হেদায়েত দান করুন।

‘আসসাওয়ারিমুল হিন্দিয়াহ’র হাকীকত

আবেদ শাহ সাহেব আরো লিখেছেন যে, ‘হুসামুল হারামাইনে ভারতবর্ষের ২৬৮ জন মুফতী দস্তখত করেছেন, যা ১৩৪৫ হিজরীতে ‘আসসাওয়ারিমুল হিন্দিয়াহ’ নামে প্রকাশিত হয়। এরও কেউ জওয়াব লেখেনি।’

শাহ সাহেব চিন্তাও করেননি, মূল ‘হুসামুল হারামাইন’ বইটিরই যখন বহু জবাব লেখা হয়েছে, তো এরপর শুধু দস্তখতসমূহের কি জওয়াব দরকার আছে? এরপরও যারা আবেদ শাহের এই পুস্তিকা দ্বিতীয়বার ছেপে বিলি করছেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, ‘আস সাওয়ারিমুল হিন্দিয়াহ’-তে যাদের দস্তখত সংকলিত হয়েছে তাদের সবাইকেই তো শাহ সাহেব মুফতী উপাধিতে ভূষিত করেছেন অথচ এদের অধিকাংশই হচ্ছে, অজ্ঞাত ও অতি সাধারণ মৌলভী কিসিমের লোক, যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে শুধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্য।

বাস্তবেই যাকে মুফতী বলা যায় এমন কারো দস্তখত ওখানে থাকলে তা শুধু এই জন্য যে, তারা প্রশ্নপত্রের সাজানো কথাগুলোকে সঠিক মনে করেছেন। কিন্তু যখন প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রশ্নে উল্লেখিত কথাগুলোই সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা তখন কী মূল্য থাকে সেই প্রশ্নের জবাবের কিংবা এই জবাবের উপর কৃত দস্তখতের?

দস্তখতকারীদের যাদের আখেরাতের ভয় ছিল তারাও বাস্তব অবস্থা জানার পর সাথে সাথে দস্তখত প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। এর একটি মাত্র উদাহরণ দেখুন-

জনাব আহমদ রেযা খানের একজন পুরনো সঙ্গী ও পীরভাই ছিলেন মুফতী খলীল আহমদ বাদায়ুনী বারাকাতী ক্বাদেরী। তিনিও কুফরের ফতোয়ায় খান সাহেবের সাথে একমত ছিলেন। রেজভী আলেমদের মধ্যে তাঁর বড় মর্যাদা ছিল। কিন্তু তিনি রেযাখানী পথ পরিহার করে ‘ইনকিশাফে হক’ নামে একটি পুস্তক রচনা করেন। তাতে লেখেন, ‘অধিকাংশ লোকই উত্তমরূপে অবগত আছেন, কাফের আখ্যা দেওয়ার ব্যাপারে ফকিরের (তার নিজের) মতও তাই ছিল যা ফাযেলে বেরেলভী মরহুম ও তার অনুসারীদের ফতোয়ায় উল্লেখিত হয়েছে। তার লেখার প্রতি আস্থাশীল থাকায় এবং কাফের আখ্যা দেওয়ার ব্যাপারে তার ফতোয়াসমূহ সঠিক মনে করতাম বলে নিজে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি যাচাই করার সুযোগ হয়নি। এখন কিছুদিন যাবৎ আল্লাহ তাআলা ফকীরকে কিছু হালত ও মওকা দিয়েছেন, যার কারণে ঐ লেখা ও ফতোয়াগুলো মনোযোগের সাথে পড়েছি। ফতোয়াগুলো ত্রুটি ও দুর্বলতামুক্ত না হওয়ায় ফকীর ওইসব ফতোয়ার তাকফীরী সিদ্ধান্ত থেকে অর্থাৎ কাফের বলা থেকে জিহ্বাকে সংযত করে নিয়েছি। কারণ মুসলমানকে কাফের বলার রাস্তা অতি ভয়াবহ।’ কিছুদূর গিয়ে লেখেন,

‘গভীর চিন্তা ও গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, এই রাশি রাশি তাকফীরী ফতোয়া শুধু এ কারণে যে, বক্তব্যের শব্দ-বাক্যের অর্থ ও মর্ম সঠিকভাবে বোঝা হয়নি। ফাযেলে বেরেলভী এসব বক্তব্যের ঐ অর্থ বুঝেছেন আর সমকালীন আলিমগণ ও খোদ লেখক ঐ মর্ম পরিষ্কার ভাষায় অস্বীকার করে দিয়েছেন। এবং তার ঐ মর্ম বর্ণনা করেছেন, যা শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মুসলমানেরা! ইনসাফ কর, এখন আর মতভেদ কীসে?’ -ইনকেশাফে হক্ব, মুফতী খলীল আহমদ বাদায়ুনী পৃ. ৮; শাহ ইসমাঈল শহীদ আওর উনকে নাক্বেদ, মাওলানা আখলাক হুসাইন ক্বাসেমী পৃ. ১৬৭; মুতালাআয়ে বেরেলাবিয়্যাত, ড. আল্লামা খালেদ মাহমুদ খ. ৪, পৃ. ৩৫৬

তো মুফতী খলীল আহমদ বাদায়ুনীর মত কেউ যদি খান বেরেলভীর উপর আস্থাশীল হয়ে তার উপস্থাপিত তথ্যকে বাস্তব মনে করেন এবং তার ভিত্তিতে ফতোয়া দেন তাহলে তার ফতোয়ার আলাদা কী মূল্য থাকতে পারে?

আবেদ শাহ সাহেব তো যোগ্য-অযোগ্য নির্বিশেষে সকলকে মুফতী বানিয়ে ঘোষণা করে দিলেন যে, হুসামুল হারামাইন এর সমর্থনে ২৬৮ জন ‘মুফতী’ দস্তখত করেছে অথচ আগেও বলা হয়েছে, দস্তখতকারীদের অধিকাংশই অজ্ঞাত কিসিমের লোক। এ উপমহাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা বুযুর্গানে তরীকতের খানকায় অবস্থানকারী মাশায়েখ, মাদরাসা ও দারুল ইফতাগুলোতে অবস্থানকারী বিজ্ঞ আলেম ও মুফতীগণ, প্রসিদ্ধ ও নিরপেক্ষ ইলমী ব্যক্তিত্ব এবং জাতীয় পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের কেউ আহমদ রেযা খানের এই কাফের বানানোর মিশন সমর্থন করেননি; বরং তারা এক্ষেত্রে তাদের ঘৃণাই প্রকাশ করেছেন। ঐ সময়ের আকাবির ও মাশায়েখ, বিজ্ঞ উলামা, নির্ভরযোগ্য মুফতীয়ান এবং জাতীয় নেতৃবৃন্দের বাণী ও বক্তব্য জানতে হলে, যাতে খান বেরেলভীর এই গর্হিত কর্মের প্রতি ঘৃণা ও বিরোধিতা প্রকাশিত হয়েছে এবং যা ন্যায় ও ইনসাফের দাবিকেই পূরণ করেছে- অবশ্যই পড়–ন ড. আল্লামা খালেদ মাহমুদের গ্রন্থ ‘মুতালাআয়ে বেরেলবিয়্যাত’ খ. ১, পৃ. ১১৬-১৮২, খ. ৪, পৃ. ৬১-১৪০।

‘আস সাওয়ারিমুল হিন্দিয়া’-এর জওয়াবী কিতাব

আবেদ শাহ সাহেবের অভিযোগ, ‘আস সাওয়ারিমুল হিন্দিয়াহ’ ১৩৪৫ হিজরীতে প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউ এর জওয়াব লেখেনি। শাহ সাহেব সম্ভবত জানেন না যে, ১৩৫৩ হিজরী মোতাবেক ১৯৩৪ সালে ‘বারাআতুল আবরার আন মাকাইদিল আশরার’ নামে প্রকাশিত গ্রন্থটি ‘হুসামুল হারামাইন’ ও ‘আস সাওয়ারিমুল হিন্দিয়াহ’ দুই বইয়েরই বাস্তব জবাব ও দাঁতভাঙ্গা জবাব।

১৯৩০ হিজরীতে মৌলভী হাশমত আলী খান বেরেলভী (জনাব আহমদ রেযা খানের বিশিষ্ট অনুসারী) রেঙ্গুন গিয়ে উলামায়ে দেওবন্দের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার আরম্ভ করে, তাদের উপর কুফুরের অপবাদ লাগায় এবং হঠকারিতা করে মুনাযারার চ্যালেঞ্জও দেয়। তখন স্থানীয় মাওলানা আব্দুর রউফ খান জগনপুরী ফয়েজআবাদী হযরত মাওলানা আব্দুশ শাকুর লাখনোভী ও হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নোমানীকে রেঙ্গুন নিয়ে আসেন এবং মুনাযারার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে লিফলেট বিতরণ করেন। মৌলভী হাশমত আলী উপরোক্ত দুই বুযুর্গের নাম শুনে ওখান থেকে পালিয়ে দেশে চলে আসে। ঐ সময় মাওলানা আব্দুর রউফ খান ঐ সকল মিথ্যা অপবাদ, যা জনাব আহমদ রেযা খান ও মৌলভী হাশমত আলী উলামায়ে দেওবন্দের উপর আরোপ করেছিল, তা উলামায়ে দেওবন্দের মূল বক্তব্যসহ লিখিত আকারে উপমহাদেশের সকল কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা (ফতোয়া-কেন্দ্র) এবং প্রসিদ্ধ ও নেতৃস্থানীয় উলামা-মাশায়েখের কাছে প্রেরণ করেন। জবাব আসার পর তিনি তা ‘বারাআতুল আবরার আন মাকাইদিল আশরার’ নামে ১৯৩৪ সালে প্রকাশ করেন। এই ঐতিহাসিক দলীলটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫১৬। এতে চারশোর কাছাকাছি উত্তর রয়েছে এবং তার চেয়েও বেশি সংখ্যক ব্যক্তির দস্তখত আছে। উত্তরদাতা ও দস্তখতকারীদের অধিকাংশই তৎকালীন উপমহাদেশের (বর্তমানের ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) প্রসিদ্ধ মুফতিয়ান, মাশায়েখে তরীকত ও কেন্দ্রীয় ইলমী ব্যক্তিত্ব।

ঐ সকল জওয়াবে উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় উলামা-মাশায়েখ একমত হয়ে আহমদ রেযা খান ও হাশমত আলী সাহেবকে আকাবিরে দেওবন্দের ব্যাপারে মিথ্যা অপবাদ আরোপের অপরাধে অভিযুক্ত করেন। যার কাছে ‘বারাআতুল আবরার’ কিতাবটি নেই তিনি ড. আল্লামা খালেদ মাহমুদ ছাহেবকৃত ‘মুতালাআয়ে বেরেলবিয়্যাত’ গ্রন্থটির খ. ৪, পৃ. ৫৯-১৩১ পাঠ করতে পারেন। ঐ কিতাবের উত্তম সারসংক্ষেপ এখানে পেশ করেছেন।

মোটকথা, আসাম, বার্মা, বারোদা, বোম্বাই, ভাওয়ালপুর, বাঙ্গাল, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, পেশোয়ার, রামপুর, লাখনৌ, মাদ্রাজ, সিন্ধ, কর্ণাটক, আলীগড় প্রভৃতি অঞ্চলের উলামায়ে কেরাম, যাদের ফতোয়াই ঐ সময় আস্থার সাথে অনুসরণ করা হত তারা সকলে একমত ছিলেন যে, মৌলভী আহমদ রেযা খান শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. ও আকাবিরে উলামায়ে দেওবন্দের ব্যাপারে যে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন তা সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং মিথ্যা অপবাদ-নির্ভর। এখানে আমি শুধু মাওলানা মুঈনুদ্দীন আজমীরী রাহ.-এর বক্তব্য তুলে ধরছি, যাকে রেজভীরা নিজেদের আলেম বলে মনে করেন এবং ‘শামসুল উলামা’ উপাধিতে স্মরণ করেন (দেখুন, আল মীযান, আহমদ রেযা নম্বর) তিনি বারাআতুল আবরারে’ তার দস্তখতে লিখেছেন, এরা (দেওবন্দী উলামা মাশায়েখ) মুসলমান এবং মুসলমানদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ।’ (বারাআতুল আবরার, পৃষ্ঠা: ২০৯)

মাওলানা মুঈনুদ্দীন আজমীরী তাঁর কিতাব ‘তাজাল্লিয়াতে আনওয়ারুল মুঈন’-এ লেখেন,

‘দুনিয়াতে সম্ভবত কেউ এত সংখ্যক কাফেরকেও মুসলমান বানায়নি যত মুসলমানকে আলা হযরত (আহমদ রেযা খান) কাফের বানিয়েছেন (কুফুরের অপবাদ দিয়েছেন)। এটাই ঐ ফযীলত যা আলা হযরত ছাড়া আর কারো ভাগ্যে জোটেনি।’ -মুতালাআয়ে বেরেলবিয়্যাত খ. ৪, পৃ. ১২৯

আলা হযরত খান বেরেলভীর সম্পর্কে এই মূল্যায়ন কোনো দেওবন্দীর নয়; মাওলানা আজমীরীর, যাকে রেজভীরা নিজেদের লোক মনে করে। কিন্তু তিনি বড় বুযুর্গ ছিলেন, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর খাতিরে হক্ব কথা বলা থেকে বিরত থাকেননি। যা সত্য ও বাস্তব তা-ই নির্দ্বিধায় বলে গিয়েছেন। আহ, যদি আমাদের দেশের রেজভী ভাইয়েরাও হক্ব কথা বলা শুরু করতেন এবং খালেস মুমিনদেরকে কাফের আখ্যা দিয়ে নিজেদের আখেরাত বরবাদ না করতেন!

 

[1] ১ খান বেরেলভী হারামাইনের কিছু আলেমের কাছ থেকে কীভাবে ধোঁকাবাজির মাধ্যমে দস্তখত সংগ্রহ করেন এবং এর প্রেক্ষাপট কী ছিল, ওখানের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের কারা কারা দস্তখত করতে অস্বীকার করেন আর কারা দস্তখত করার পর তা ফেরৎ নিতে চান এবং বাস্তব অবস্থা প্রকাশিত হওয়ার পর দস্তখতকারীরা কত অনুতপ্ত হয়েছেন- সে ইতিহাস জানার জন্য পড়ুন,

(১) শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.-এর কিতাব ‘আশশিহাবুস সাকিব আলাল মুসতারিক্বিল কাযিব’। হযরত মাদানী রাহ. ঐ সময় মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করছিলেন। তাই তিনি ছিলেন খান বেরেলভীর তখনকার অপতৎপরতার প্রত্যক্ষদর্শী। এ বিষয়ে তাঁর আরেক কিতাব ‘নকশে হায়াত’ও (খ. ১, পৃ. ১৩৮-১৬৩) পাঠ করা যায়।

(২) ‘আকাইদে উলামায়ে দেওবন্দ আওর হুসামুল হারামাইন’ মুকাদ্দিমা, হযরত মাওলানা মনযুর নোমানী ও মাওলানা হুসাইন আহমাদ নাজীব।

(৩) ‘মুতালাআয়ে বেরেলবিয়্যাত’ ড. খালেদ মাহমুদ খ. ১, পৃ. ৯৮-২১৪

 

সফর ১৪৩৮ . নভেম্বর ২০১৬

মাসিক আলকাউসার