মুহাম্মদ আল-ফাতেহ : রোমান সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পরাজয়ের মহানায়ক

আজ ৩০ মার্চ। ১৪৩২ খ্রিষ্টাব্দের এ দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুসলিম ইতিহাসের অন্যতম বীর সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতেহ। উসমানীয় সুলতানদের মধ্যে যিনি দ্বিতীয় মুহাম্মদ হিসেবেও পরিচিত। রোমান শাসনের সর্বশেষ শক্তি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের অজেয় দুর্গ ও রাজধানী কনস্টান্টিনোপল জয়ের কারণে তিনি ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন।

মুহাম্মদ আল-ফাতেহের বাবা সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ। মুহাম্মদের বয়েস যখন সবে ১১, দ্বিতীয় মুরাদ উসমানি সালতানাতের গুরুভার ছেলের ওপর অর্পণ করেন। এটা ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দের ঘটনা। মুহাম্মদ যদিও বিস্ময়কর মেধা, অতুলনীয় যোগ্যতা এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের অধিকারী ছিলেন একদম ছেলেবেলা থেকেই, কিন্তু উসমানি সালতানাতের মতো সমকালের অন্যতম এক পরাশক্তির পরিচালনা বয়েসের অপরিপক্কতার কারণে তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। দু বছরের মাথায় ১৪৪৪ খ্রিষ্টাব্দের পিতার হাতে জোর করে পুনরায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এবং পরবর্তী সময়ের অজেয় বীর সুলতান হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন।

১৪৫১ খ্রিষ্টাব্দে পিতা দ্বিতীয় মুরাদ ইন্তেকাল করলে পুনরায় ক্ষমতার ভার মুহাম্মদের ঘাড়ে পড়ে। অবশ্য ততদিনে একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক ও সিপাহসালার হিসেবে নিজেকে তিনি প্রস্তুত করে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বারের মতো যখন যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন, মুহাম্মদ তখন ১৯ বছরের টগবগে নওজোয়ান। ক্ষমতাগ্রহণের পরপরই তিনি কনস্টান্টিনোপল জয়ের পরিকল্পনা শুরু করেন।

কনস্টান্টিনোপল বিজয় কেবল উসমানি সালতানাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণই ছিল না, বরং এর বিজেতা সেনাপতি ও সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষভাবে দোআ করে গিয়েছেন মহানবি হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা (মুসলিমরা) অবশ্যই কন্সটান্টিনোপল বিজয় করবে। কতোই না অপূর্ব হবে সেই বিজয়ী সেনাপতি, কতোই না অপূর্ব হবে তার সেনাবাহিনী।’ (আহমাদ আল-মুসনাদ ১৪:১৩১)

একদম শিশুকালেই মুহাম্মদ আল-ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের এ ফজিলত এবং গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে গিয়েছিলেন। আর এটা করেছিলেন তাঁর শৈশবের শিক্ষাগুরু ও রাজনৈতিক জীবনের উপদেষ্টা উসমানি সালতানাতের পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্ব আকশামসউদ্দন। আকশামসউদ্দিন মুহাম্মদ আল-ফাতিহের বুদ্ধি হবার বয়েসেই তাঁর ভেতর কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দিয়েছিলেন।

মুহাম্মদ আল ফাতিহ তাঁর এ শিক্ষাগুরুর কাছ থেকেই জেনেছিলেন অজেয় এ দুর্গ বিজয়ের জন্য ইতোপূর্বে তাঁর পূর্বপুরুষের অনেকেই চেষ্টা করে গিয়েছেন। সাহাবা ও তাবেয়িদের যুগ থেকে নিয়ে তাঁর প্রপিতামহ প্রথম বায়েজিদ অবধি অনেকেই এ কনস্টান্টিনোপল জয়ের চেষ্টা করেছেন। নবিজির অন্যতম আনসারি সাহাবি হজরত আবু আইয়ুব রাদিয়াল্লাহ আনহু এ দুর্গ জয় করার জন্য এসেই পথিমধ্যে ইন্তেকাল করেছিলেন। কিন্তু কেউই চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারেননি।

বিজয় অর্জনের প্রধানতম বাধা ছিল কনস্টান্টিনোপল শহরের ভৌগোলিক অবস্থান। প্রায় ত্রিভুজাকৃতির এ শহরের উত্তরে বসফরাস প্রণালীর অংশ গোল্ডেন হর্ন, পূর্বে বসফরাস প্রণালীর মূল অংশ আর দক্ষিণে মারমারা সাগরের অথৈ জল। এ ছাড়াও রয়েছে শহরকে ঘিরে রাখা অসংখ্য নগর-প্রতিরক্ষা দেয়াল। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই সুরক্ষিত ছিল শহরটি।

কম্পিউটার গ্রাফিক্সে তৈরি করা এক সময়ের কনস্টান্টিনোপল

তাছাড়া শহরটির ঐতিহ্যও ছিল সুপ্রাচীন। খ্রিষ্টানদের চেতনা ও বিশ্বাসের সঙ্গে যার সম্পৃক্তি ছিল অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন বসফরাস প্রণালীর উপকূলে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। নাম দেন ‘নোভারোমা’ বা নতুন রোম। তবে কালের পরিক্রমায় তা হয়ে দাঁড়ায় কনস্টান্টিনোপলে। ৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট থিউডোসিয়াস তার দুই পুত্রের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে দেন। ফলে পশ্চিম রোম এবং পূর্ব রোম সাম্রাজ্য নামে দুইটি সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের নাম হয় বাইজান্টাইন। কনস্টান্টিনোপল হয় তার রাজধানী। গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের প্রধান কেন্দ্র হিসেবেও নগরীটি পরিচিতি লাভ করে।

মুহাম্মদের আমলে কনস্টান্টিনোপলের সিংহাসনে ছিলেন কনস্ট্যান্টইন। প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত শহরটিকে অজেয় করার জন্য খ্রিষ্টীয় বাহিনী তাদের নৌযানগুলোকে এমনভাবে বিন্যস্ত করে যাতে কেবল একদিক থেকে আক্রমণ হানা যায়। অন্যদিকে একটি সৈন্য মোতায়েন না করেও শহরটি রক্ষা করা যায়। এই কৌশল তাদেরকে দীর্ঘদিন অজেয় করে রেখেছিল।

সুলতানের রাজ্যের সাথে সংযুক্ত দিকটিও কম সুরক্ষিত ছিল না। সেখানে ১৪ মাইল দীর্ঘ ৪০ থেকে ৭০ ফুট উঁচু তিন স্তর বিশিষ্ট দেওয়াল। বাইরের মসৃণ দেয়ালের সাথেই ছিল ৭০ ফুট চওড়া ও ৪০ ফুট গভীর পরিখা। বহিরাক্রমণের সময় পানি দিয়ে এটিকে ভরে ফেলা হতো। অন্যদিকে দেওয়ালে ওপরে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হতো। ফলে যেকোনো আক্রমণই ৭০ ফুট দূরে থমকে যেতো। নগরীর দেয়ালেও অনেক সময় আঁচড় লাগতো না।

সুলতান মুহাম্মদ জানতেন, কনস্টান্টিনোপল জয়ের এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। তবে যুদ্ধের আগে তিনি নিজের অবস্থান আরো মজবুত করে নেন। কনস্টান্টিনোপল থেকে ৫ মাইল দূরে রুমেলিয়ায় এক দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলেন। আদ্রিয়ানোপলে সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করেন। সাইবেরিয়া ও ওয়ালেসের সাথে চুক্তি নবায়ন করে নেন। ১৪৫৩ সালের মার্চে অভিযান শুরু হয়। তবে অবরোধ চলে ৬ এপ্রিল থেকে। ২৯ মে বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।

মুহাম্মদ তাঁর অভিযানে তখনকার প্রচলিত সব উন্নতমানের প্রযুক্তির ব্যবহার করেন। তাঁর বাহিনী প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। তাতেই তিনি সন্তুষ্ট না থেকে ইউরোপ থেকেও বিশেষজ্ঞদের যোগাড় করেছিলেন অভিযানের বিভিন্ন বিষয় আঞ্জাম দেয়ার জন্য। এছাড়াও তিনি এমন কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করেন, যা ছিল সকলের কাছে অকল্পনীয়। এগুলোর মধ্যে ছিল চাকার সাহায্যে টেনে নেয়া যায় এমন যুদ্ধ জাহাজ এবং তিনতলা বিশিষ্ট চলন্ত মিনার।

১৪৫৩ সালের ৬ই এপ্রিল তিনি অভিযান শুরু করেন। ৫৩ দিনের অক্লান্ত যুদ্ধের পর ২৯শে মে শুক্রবার অভিযান সম্পন্ন করেন। সুলতান তার অভিযানে ১২ হাজার ‘জাননেসারি’, ২০ হাজার অশ্বারোহী, একলাখ পদাতিক, সৈন্য ব্যবহার করেন।

জাননেসারি সৈন্য ছিল অপ্রতিরোধ্য। বিশেষ অভিযানের জন্যই তুর্কিরা এই বাহিনী গঠন করেছিল। জাননেসারি শব্দের অর্থ ‘আত্মনিবেদিত’ বা ‘জানবাজ’। সেনাবাহিনী থেকে বাছাই করা সৈন্যদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত। বিদ্যুৎগতিতে আক্রমণ হানতে সক্ষম জাননেসারি বাহিনীর উপস্থিতিতেই প্রতিপক্ষ সৈন্য ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো।

প্রথম দিকের প্রচণ্ড আক্রমণ সত্ত্বেও যখন কনস্টন্টিনোপলের প্রতিরক্ষা দেয়ালকে ধ্বংস করা গেল না, তখন সুলতান তাঁর চাকায় টানা যুদ্ধজাহাজ ব্যবহারের পরিকল্পনা করেন। ৮০টি যুদ্ধজাহাজ তৈরি করে সেগুলোকে চাকার সাহয্যে কয়েক মাইল দূরের সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে নগরীটি একদিকের বদলে তিন দিকে থেকেই আক্রান্ত হয়। সুলতান এতো গোপনীয়তার সাথে তার পরিকল্পনা কার্যকর করেন যে, সাধারণ লোক তো দূরের কথা, তার উজিরে আজম পর্যন্ত তা জানতে পারেননি।

জাহাজ নির্মাণের সময় একদিন উজিরে আজম এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুলতান শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, আমার একটা দাঁড়িও সেকথা জানলে, তা উপড়ে আগুনে ফেলে দেবো।

৭০ ফুট দীর্ঘ পানিরাশিকে পাড়ি দেয়ার জন্য তিনি ৩ তলা বিশিষ্ট একটি মিনার ব্যবহার করেন। উপরে দুটি তলা থেকে গোলা বর্ষণের ফাঁকে নিচের তলার সৈন্যরা যাতে খন্দাটি পাড়ি দিতে পারে সেজন্য তিনি মিনারটি উদ্ভাবন করেন।

খ্রিষ্টানবাহিনীও তাদের দৃঢ়তা নিয়ে মুসলিম বাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়। শেষ পর্যন্ত ১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে মে চূড়ান্ত আক্রমণ হানার নির্দেশ দেওয়া হয়। সবদিক থেকে পরিচালিত আক্রমণের ফলে হাজার বছরের সুরক্ষিত ও অজেয় নগরী কনস্টান্টিনোপলের পতন ঘটে। আর এর মধ্যদিয়েই রোমান সাম্রাজ্যের কফিনে ঠোকা হয় পরাজয়ের শেষ পেরেক। মুসলমানদের হাতে আসে সমকালীন ইউরোপের শ্রেষ্ঠতম নগরী।

সুলতান মুহাম্মদ এতদিন কেবল মুহাম্মদ নামেই পরিচিত ছিলেন, অজেয় এই দুর্গজয়ের পর তাঁর নামের সঙ্গে নতুন উপাধী যুক্ত হয়—আল-ফাতেহ—বিজেতা। আর এর সঙ্গে তিনি নিজেকে নবিজির সেই ভবিষ্যতবাণীর উদ্দিষ্ট সেনাপতি হিসেবেও প্রমাণিত করেন—যাঁর জন্য আছে ক্ষমা ও সৌভাগ্যের অপূর্ব ঘোষণা।


রাগিব রব্বানি
মূলঃ fateh24