হজ্জ্বঃ হাদীস ও আছারের আলোকে – ফাতাওয়া বিভাগ, মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া – ঢাকা (৬ষ্ঠ পর্ব)

৩য় দিন ১০ যিলহজ্ব

উকূফে মুযদালিফা

মাসআলা : উকূফে মুযদালিফার সময় ১০ তারিখ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত-। সুবহে সাদিকের পর সামান্য কিছু সময় অবস’ান করে মুযদালিফা ত্যাগ করলেও ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সূর্যোদয়ের কিছু পূর্ব পর্যন- অপেক্ষা করা সুন্নত। এ বিষয়ক কিছু মারফূ হাদীস ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।-মানাসিক ২১৫, ২১৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৩০; গুনইয়াতুন নাসিক ১৬৫

হযরত কাসেম রাহ. বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা.কে বলতে শুনেছি, হজ্বের একটি সুন্নত এই যে, ফজরের নামায পড়ে মুযদালিফায় অবস্থান করবে। যখন (সূর্যোদয়ের পূর্বে) আলো ছড়িয়ে পড়ে তখন রওনা হবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৫৬৫

মাসআলা : উকূফে মুযদালিফা ওয়াজিব। তাই বিশেষ ওযর ব্যতীত নির্ধারিত সময়ে উকূফ না করলে দম ওয়াজিব হবে। বিখ্যাত তাবেয়ী আতা রাহ. বলেন, যে ব্যক্তি মুযদালিফার নিকবর্তী হল অথচ তাতে অবতরণ করল না তার উপর দম আসবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস :১৫৪৬৮

ইবরাহীম রাহ. বলেন, যে ব্যক্তি মুযদালিফার পাশ দিয়ে অতিক্রম করল অথচ তার জানা নেই যে, এখানে উকূফ করতে হয় ফলে সে উকূফ না করে মিনায় চলে গেল তাকে দম দিতে হবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৪৬৬ মাসআলা : ভিড়ের কারণে সূর্যোদয়ের আগে মুযদালিফায় পৌঁছা সম্ভব না হলে দম ওয়াজিব হবে না।-মানাসিক ২১৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৩১; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫১১

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, মুযদালিফার রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্বাস রা.কে বললেন, তুমি আমাদের দুর্বল ব্যক্তি ও নারীদেরকে নিয়ে মিনার উদ্দেশে রওনা হও। সেখানে তোমরা ফজরের নামায আদায় করবে। এরপর মানুষের ভিড়ের আগেই রমী করবে।-শরহু মাআনিল আছার ১/৪৩৬

উকূফের স্থান

মাসআলা : মুযদালিফা ময়দানের যেকোনো অংশেই উকূফ করা যায়। তবে মসজিদে মাশআরে হারামের নিকট উকূফ করা উত্তম। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. নিজ পরিবারের দুর্বল ব্যক্তিদেরকে অগ্রসর করে দিতেন। তারা মুযদালিফায় এসে রাতে মাশআরে হারামের নিকটে অবস্থান করতেন এবং যতক্ষণ ইচ্ছা যিকিরে মশগুল থাকতেন।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪০৭৫; সহীহ মুসলিম ১/৪১৮ হযরত ইবরাহীম নাখঈ রাহ. বলেন, ‘সাহাবায়ে কেরাম মুযদালিফায় পাহাড়ের সমান-রালে উকূফ করতে পছন্দ করতেন।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪০৭৬

মাসআলা : মুযদালিফার বাইরে মিনার দিকে ‘ওয়াদিয়ে মুহাস্সির’ নামক স্থানে উকূফ করা যাবে না। কারণ এখানে উকূফ করা নিষিদ্ধ। এ স্থানের উকূফ ধর্তব্য নয়।-গুনইয়াতুন নাসিক ১৬৭; মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ২২০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৩০; আদ্দুররুল মুখতার ২/৫০৮ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, ‘বতনে মুহাসসির ব্যতীত পুরো মুযদালিফা উকূফ করার স্থান।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪০৭২, ১৪০৭১

মাসআলা : অতিশয় বৃদ্ধ, দুর্বল কিংবা অধিক পীড়িত ব্যক্তির জন্য মুযদালিফায় অবস্থান না করে আরাফা থেকে সোজা মিনায় চলে যাওয়ার অনুমতি আছে। এতে তাদের উপর দম বা কোনো কিছু ওয়াজিব হবে না।-মানাসিক ২১৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৩১

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, মুযদালিফার রাতে সওদা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট মিনায় চলে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি দিলেন। কেননা সওদা ছিলেন তখন ভারী ও ধীর গতিসম্পন্ন।-সহীহ বুখারী ১/২২৮

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফার রাতে তাঁর পরিবারের দুর্বল ব্যক্তিদের সঙ্গে যাদের পূর্বেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমি তাদের মধ্যে শামিল ছিলাম।’-সহীহ বুখারী ১/২২৭

১০ম যিলহজ্বের দ্বিতীয় ওয়াজিব জামরায়ে আকাবার রমী

রমীর পদ্ধতি

মাসআলা : রমী অর্থ কংকর নিক্ষেপ করা। মসজিদে হারামের দিক থেকে সর্বশেষ কংকর নিক্ষেপের স্থানকে ‘জামরা আকাবা’ বলে। এখানে ৭টি কংকর নিক্ষেপ করতে হয়।

আবদুল্লাহ ইবনে ইয়াযীদ বলেন, ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ‘বাতনে ওয়াদী’ থেকে জামরা আকাবায় ৭টি কংকর নিক্ষেপ করলেন এবং প্রতি কংকর নিক্ষেপের সময় তাকবীর বললেন।’-সহীহ মুসলিম ১/৪১৮, ৪২০

মাসআলা : কংকর নিক্ষেপের স্থানে যে চওড়া দেয়াল আছে তাতে কংকর লাগানো জরুরি নয়; বরং বেষ্টনীর ভিতরে পড়াই যথেষ্ট। দেয়ালের কংকর লেগে তা যদি বেষ্টনীর বাইরে গিয়ে পড়ে তবে তা ধর্তব্য হবে না, ঐ কংকর পুনরায় নিক্ষেপ করতে হবে। কংকর দেয়ালের গোড়ায় মারা ভালো। দেয়ালের উপরের অংশে মারা অনুত্তম।-গুনইয়াতুন নাসিক ১৭১ রদ্দুল মুহতার ২/৫১২

মাসআলা : প্রথম দিনের সাতটি কংকর মুযদালিফা থেকে সংগ্রহ করা মুস্তাহাব। মুজাহিদ রাহ. বলেন, তিনি জামারাতে নিক্ষেপের জন্য মুযদালিফা থেকে কংকর সংগ্রহ করতেন।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৬২৩ তাবেয়ী মাকহুল বলেন, ‘মুযদালিফা থেকে কংকর সংগ্রহ করো।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৬২৬ অন্য বর্ণনায় আছে যে, মুজাহিদ রাহ.ও মুযদালিফা থেকে কংকর সংগ্রহ করতেন।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৬২৩ অবশ্য অন্য জায়গা থেকে নিলেও ক্ষতি নেই।

বিখ্যাত তাবেয়ী আতা রাহ. ও সায়ীদ ইবনে জুবাইর রাহ. থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, ‘যেখান থেকে ইচ্ছা কংকর সংগ্রহ করতে পার।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৬২৮, ১৩৬২৪

মাসআলা : জামরার নিকট থেকে কংকর নিবে না। কারণ, এই স’ানের পাথরগুলো হাদীসের ভাষ্যমতে আল্লাহ তাআলার দরবারে ধিকৃত। যাদের হজ্ব কবুল হয়নি তাদের কংকর এখানে পড়ে থাকে।

এ সংক্রান্ত- পূর্ণ হাদীসটি হল, হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন, আমরা বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, প্রতি বছর এই যে কংকরগুলো নিক্ষেপ করা হয় আমাদের মনে হয় এগুলোর পরিমাণ হ্রাস পেয়ে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে কংকরগুলো কবুল হয় তা উঠিয়ে নেওয়া হয়। (অর্থাৎ যার হজ্ব কবুল হয় তার নিক্ষিপ্ত কংকর আল্লাহর পক্ষ হতে উঠিয়ে নেওয়া হয়।) যদি এটা না হত তবে তোমরা পাহাড় পরিমাণ কংকরের স’প দেখতে পেতে।-মুসতাদরাকে হাকেম হাদীস : ১৭৯৫ আরো দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৫৭২, ১৫৫৭৩ মাসআলা : পরবর্তী দিনের কংকর মুযদালিফা থেকে নেওয়া মুস্তাহাব নয়। জামরার নিকট থেকে নেবে না, অন্য যেকোনো স’ান থেকে নিতে পারবে। -মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ২২২, গুনইয়াতুন নাসিক ১৬৮, আদ্দুররুল মুখতার ৫১৫

কংকর কেমন হবে

মাসআলা : বুট বা ছোলার দানার মতো ছোট কংকর মারা ভালো। বড়জোর খেজুরের বিচির মতো হতে পারে। বড় পাথর মারা মাকরূহ। তদ্রূপ নাপাক কংকর মারাও মাকরূহ। কংকর নাপাক হওয়ার আশঙ্কা থাকলে তা ধুয়ে নিক্ষেপের কাজে ব্যবহার করা যাবে। -মানাসিক মোল্লা আলী কারী পৃ. ২২২

জামরা আকাবাতে রমীর সময়

মাসআলা : সম্ভব হলে ১০ যিলহজ্ব সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য ঢলে যাওয়া পর্যন- সময়ের ভিতর রমী করা মুস্তাহাব। হযরত জাবির রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ইয়াওমুন নাহর’ (অর্থাৎ ১০ যিলহজ্ব) চাশতের সময় রমী (কংকর নিক্ষেপ) করেছেন। আর পরবর্তী দিবসসমূহের রমী সূর্য ঢলে যাওয়ার পরে করেছেন।-সহীহ মুসলিম ১/৪২০ তবে ১০ তারিখ সুবহে সাদিক থেকে ১০ তারিখ দিবাগত রাতের সুবহে সাদিক পর্যন- রমী করা জায়েয। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ১০ যিলহজ্ব মিনায় এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, আমি সন্ধ্যার পর রমী করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘কোনো সমস্যা নেই।’-সহীহ বুখারী ১/২৩৪

উল্লেখ্য, বিনা ওজরে মুস্তাহাব সময় রমী না করে অন্য সময় রমী করা মাকরূহ। কিন’ আজকাল যেহেতু মুস্তাহাব সময়ে রমীর স্থানে প্রচণ্ড ভিড় হয় তাই মহিলা ও দুর্বলদের মতো অন্যদের জন্যও মুস্তাহাব সময়ের বাইরে রমী করার অবকাশ রয়েছে। ওজর থাকার কারণে তা মাকরূহ হবে না।-গুনইয়াতুন নাসিক ১৬৯-১৭০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ২৩৩

হযরত সাফিয়্যার কন্যা মুযদালিফায় সন্তান প্রসব করলেন। তখন মা ও কন্যা মুযদালিফায় রয়ে গেলেন। ১০ যিলহজ্ব দিবাগত রাতে তাঁরা মিনায় এসে কংকর নিক্ষেপ করলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. তাদেরকে কিছু বলেননি এবং কোনো ধরনের কাযা আদায় করারও আদেশ করেননি।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৫৫৩

সাত কংকর সাত বারে মারতে হবে

মাসআলা : কেউ যদি সাত কংকর একবারে নিক্ষেপ করে তবে এক কংকর মারা হয়েছে বলা হবে। এক্ষেত্রে আরো ছয়টি কংকর পৃথক পৃথক মারতে হবে।-আহকামে হজ্ব ৭৫ হযরত জাবির রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হজ্বের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামরাতুল কুবরার নিকট এলেন এবং সাতটি কংকর নিক্ষেপ করলেন। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় তাকবীর বলেন।’ -সহীহ মুসলিম ১/৩৯৯ মাসআলা : জামরা আকাবার রমীর পর দুআর জন্য এখানে অবস্থান না করা সুন্নত। তাই আজ কংকর মেরে দুআর জন্য বিলম্ব করবে না; বরং কংকর মেরে দ্রুত স্থান ত্যাগ করবে।-মানাসিক ২২৪

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বাতনে ওয়াদী থেকে জামরা আকাবায় কংকর নিক্ষেপ করতেন। অতঃপর জামরা আকাবার নিকট অবস্থান না করে স্থান ত্যাগ করতেন এবং বলতেন, আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এভাবে করতে দেখেছি।-সহীহ বুখারী ১/২৩৬ আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামরা আকাবায় এসে কংকর নিক্ষেপ করেছেন অতঃপর সেখানে অবস্থান করেননি।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৫৭৪

সময়মতো রমী না করলে

মাসআলা : ১০ তারিখ দিবাগত রাতের সুবহে সাদিকের আগে জামরা আকাবার রমী করতে না পারলে ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর মতে দম ওয়াজিব হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলতেন, যে ব্যক্তি হজ্বের কোনো (ওয়াজিব) আমল ভুলে যায় অথবা ছেড়ে দেয় তার জন্যে দম দেওয়া জরুরি।-মুয়াত্তা মুহাম্মাদ পৃ. ২৩৫ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যে ব্যক্তি হজ্বের কোনো (ওয়াজিব) আমল নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে আদায় করে তার জন্য দম দেওয়া জরুরি।-শরহু মাআনিল আছার ১/৪৪৭ ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর মতে দম ওয়াজিব হবে না। বেশি মাজুর ব্যক্তিগণ এই মত গ্রহণ করতে পারেন। তবে ১৩ তারিখ সূর্যাসে-র আগে রমী সমাপ্ত করতে হবে। এরপরে কংকর মারার অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে কংকর না মারার কারণে সবার মতেই ভিন্ন দম ওয়াজিব হবে।-আহকামে হজ্ব ৭৬ ইবনে আব্বাস রা. বলতেন, যে ব্যক্তি হজ্বের (ওয়াজিব) আমলের থেকে কোনো আমল ভুলে যায় অথবা ছেড়ে দেয় তার জন্য দম দেওয়া ওয়াজিব।-মুয়াত্তা মুহাম্মাদ পৃ. ২৩৫

অন্যকে দিয়ে রমী করানো

মাসআলা : প্রত্যেক হাজী পুরুষ হোক বা মহিলা, নিজের রমী নিজেই করবে। ভিড়ের কারণে কিংবা অন্য কোনো শরয়ী ওযর ব্যতীত অন্যের দ্বারা রমী করানো জায়েয নয়। শরয়ী ওযর ব্যতীত অন্যকে দিয়ে রমী করালে তা আদায় হবে না। এক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে পুনরায় নিজের রমী করতে হবে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি তার বাচ্চাদেরকে হজ্ব করাতেন। তাদের মধ্যে যারা নিজেরা রমী করতে পারত তারা নিজেরাই রমী করত। আর যারা রমী করতে অক্ষম ছিল তাদের পক্ষ থেকে রমী করা হত।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪০২৯ মাসআলা : উপরোক্ত ক্ষেত্রে যদি নিজের রমী পুনরায় না করে তবে দম ওয়াজিব হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি হজ্বের কোনো ওয়াজিব আমল ভুলে যায় অথবা ছেড়ে দেয় তার জন্য দম দেওয়া জরুরি।-মুয়াত্তা মুহাম্মাদ পৃ. ২৩৫

মাসআলা : শরয়ী ওযর হল এমন অসুস’তা বা দুর্বলতা যার কারণে বসে নামায পড়া জায়েয। অথবা অসুস’তার কারণে জামরাত পর্যন- পৌঁছানো খুবই কষ্টকর হয় কিংবা রোগ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে তবে এরূপ ব্যক্তি অন্যকে দিয়ে রমী করাতে পারবে।-আহকামে হজ্ব ৭৬-৭৭ আতা রাহ. বলেন, ‘অসুস’ ব্যক্তির পক্ষ থেকে রমী করা যাবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪০২১ তাউস রাহ. কে এক অসুস’ মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘তার পক্ষ থেকে তার পরিবারের কেউ রমী করে নিবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪০২৬

মাসআলা : মাজুর ব্যক্তির পক্ষ থেকে রমী করার জন্য তার অনুমতি লাগবে। বিনা অনুমতিতে কেউ তার পক্ষ থেকে রমী করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে অচেতন, পাগল এবং ছোট বাচ্চার অনুমতি ছাড়া তাদের পক্ষ থেকে অভিভাবক রমী করতে পারবে। -আহকামে হজ্ব ৭৭ মাসআলা : যে ব্যক্তি অন্যের পক্ষ থেকে রমী করবে, তার জন্য উত্তম হল প্রথমে নিজের রমী সমাপ্ত করা তারপর বদলী রমী করা। একটি কংকর নিজের পক্ষ থেকে দ্বিতীয়টি অন্যের পক্ষ থেকে-এভাবে মারা মাকরূহ। তাই প্রথমে নিজের সাত কংকর নিক্ষেপ করবে এরপর বদলী আদায় করবে। -আহকামে হজ্ব ৭৭

মাসআলা : ঋতুমতী মহিলাগণও রমী করতে পারবে। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. বলেন, আমি যখন মক্কায় এলাম তখন ঋতুমতী ছিলাম। তাই তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ার মাঝে সায়ী থেকে বিরত থাকলাম। এরপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট সমস্যা তুলে ধরলে তিনি বললেন, হাজীরা যেসব কাজ করে তুমিও তা করতে থাক তবে পবিত্র হওয়ার আগে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করবে না।-সহীহ বুখারী ১/২২৩ ১০ম যিলহজ্বের তৃতীয় ওয়াজিব

দমে শোকর বা হজ্বের কুরবানী

মাসআলা : তামাত্তু ও কিরান হজ্ব আদায়কারীদের জন্য একটি কুরবানী করা ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা বলেন, তারপর যখন তোমরা নিরাপদে থাক তখন যে ব্যক্তি উমরাকে হজ্বের সঙ্গে একত্র করে লাভবান হয় সে (যবেহ করবে) কুরবানী, যে পশু সহজলভ্য হয় …।-সূরা বাকারা : ১৯৬ ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় এলেন তখন লোকদেরকে লক্ষ করে বললেন, তোমাদের মধ্যে যারা কুরবানীর পশু সঙ্গে এনেছ তারা যেন হজ্ব সম্পন্ন করার পূর্বে হালাল (ইহরামমুক্ত) না হয়। আর যারা কুরবানীর পশু সঙ্গে আনেনি তারা তাওয়াফ করবে এবং সাফা-মারওয়ার মাঝে সায়ী করে চুল ছেঁটে হালাল হয়ে যাবে। অতঃপর (নির্ধারিত সময়ে) হজ্বের ইহরাম গ্রহণ করবে এবং কুরবানী করবে …।-সহীহ মুসলিম ১/৪০৩এক বর্ণনায় আছে যে, ছুবাই ইবনে মা’বাদ রাহ. হজ্বে কিরান করলেন। তাকে উমর রা. ভেড়া যবাই করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪০৪৩ অনুরূপ বিষয় উমর ইবনে আবদুল আযীয, ইবরাহীম ও আতা রাহ. থেকেও বর্ণিত আছে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪০৪৭, ১৪০৪৩, ১৫৫৯৮

মাসআলা : জামরায়ে আকাবার রমীর পর কুরবানী করবে এবং মাথা মুণ্ডাবে। আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনায় এসে জামরায়ে আকাবায় রমী করলেন। অতঃপর মিনায় নিজ অবস্থানস্থলে ফিরে গেলেন এবং কুরবানী করলেন। অতঃপর ক্ষৌরকারকে মাথা মুণ্ডাতে বললেন। প্রথমে ডান পাশের চুলের দিকে ইশারা করলেন অতঃপর বাম পাশের চুলের দিকে। অতঃপর চুল মোবারক উপসি’ত লোকদের মাঝে বিতরণ করে দিলেন।-সহীহ মুসলিম ১/৪২১

মাসআলা : ইফরাদ হজ্বকারীর উপর হজ্বের কুরবানী করা ওয়াজিব নয়। তবে করলে ভালো। সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব রাহ. বলেন, যে ব্যক্তি হজ্বের মাসে অর্থাৎ শাওয়াল, যিলকদ, যিলহজ্বে উমরা করল, অতঃপর হজ্ব সম্পন্ন করা পর্যন- সেখানে অবস্থান করল সে তামাত্তুকারী, তার কর্তব্য যা কিছু সহজলভ্য তা দিয়ে কুরবানী করা। অথবা কুরবানীর পশু না পাওয়া গেলে রোযা রাখা। আর যে ব্যক্তি হজ্বের মাসে উমরা করার পর তার পরিবারের কাছে ফিরে এল তারপর ঐ বছরই হজ্ব করল সে তামাত্তুকারী নয়।-মুয়াত্তা মুহাম্মাদ পৃ. ২১৯ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যে ব্যক্তি হজ্ব করল এবং কুরবানী করল সে একটি হজ্ব ও একটি উমরা করে নিজ পরিবারে প্রত্যাবর্তন করল।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪৪০৬

মাসআলা : ইফরাদ হজ্বকারীদের যেহেতু ওয়াজিব কুরবানী নেই তাই তারা রমীর পরই চুল কাটতে পারবে। রমীর আগে চুল কাটলে দম ওয়াজিব হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যে ব্যক্তি হজ্বের কোনো (ওয়াজিব) আমল নির্ধারিত সময় থেকে আগে বা পরে করল তার উপর দম ওয়াজিব হবে।-শরহু মাআনিল আছার ১/৪৪৭

দমে শোকর বা হজ্বের কুরবানীর সময়

মাসআলা : ১০ যিলহজ্ব সুবহে সাদিকের পর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাসে-র আগ পর্যন- সময়ের ভিতর কুরবানী করতে হবে। সুন্নত সময় শুরু হয় ১০ যিলহজ্ব সূর্যোদয়ের পর থেকে। ইকরামা রাহ. বলেন, আমি তামাত্তু হজ্ব করলাম, কিন’ কুরবানী করতে ভুলে গেলাম। ইতিমধ্যে (কুরবানীর) দিনগুলো অতিবাহিত হয়ে গেল। তখন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.কে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, (তুমি দু’টি কুরবানী করবে) তামাত্তুর জন্য একটি এবং বিলম্ব করার কারণে একটি।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৭০৯ আলী ইবনে আবী তালিব রা. বলেছেন, ‘রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে তিন দিনের অধিক কুরবানীর পশুর গোশত খেতে নিষেধ করেছেন।’-সহীহ বুখারী ২/৮৩৫ আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, কুরবানীর সময় হল কুরবানীর দিনের পর আরো দুই দিন।-আল ইসতিযকার ১৫/১৯৭; রদ্দুল মুহতার ২/৫৩২

কুরবানীর স্থান

মাসআলা : হজ্বের কুরবানী হরমের সীমার ভিতরে করা জরুরি। হরমের বাইরে জবাই করলে হজ্বের কুরবানী আদায় হবে না। হে মুমিনগণ, ইহরামে থাকা অবস্থায় তোমরা শিকার-জন্তু হত্যা করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তা হত্যা করলে (তার উপর) বিনিময় (ওয়াজিব হবে) যা সেই পশুর সমতুল্য হয় যা সে হত্যা করেছে, যার ফয়সালা করবে তোমাদের মধ্যে দুই জন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। কাবাতে প্রেরিতব্য কুরবানীরূপে-অথবা …।-সূরা মাইদা : ৯৫ জুনদুব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, (হুদায়বিয়ার বছর) যখন কুরবানীর পশু হেরেমে নিয়ে যেতে বাধা দেওয়া হল তখন আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে আরয করলাম, আল্লাহর রাসূল! কুরবানীর পশুগুলো আমার কাছে দিন, আমি তা হরমের ভিতরে নিয়ে জবাই করব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কীভাবে হেরেমের ভিতর নিয়ে যাবে? আমি বললাম, এমন উপত্যকা দিয়ে নিয়ে যাব যে, মক্কার কাফিররা আমাকে ধরতে পারবে না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পশুগুলো আমার কাছে সমর্পণ করলেন এবং আমি তা হরমে নিয়ে কুরবানী করলাম।-শরহু মাআনিল আছার ১/৪৫০

মাসাআলা : হেরেমের যে কোনো স্থানে কুরবানী করা যায়। মিনাতে করা জরুরি নয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. মক্কায় কুরবানী করতেন এবং আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. মিনায়।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৭৭৭ জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘গোটা মিনা কুরবানীর স্থান এবং মক্কার সকল গলি চলার পথ ও কুরবানীর স্থান।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৭৭৩; রদ্দুল মুহতার ২/৫৩২ হাজীদের জন্য ঈদুল আযহার কুরবানী

মাসআলা : মুসাফিরের উপর ঈদুল আজহার কুরবানী ওয়াজিব নয়। সুতরাং যারা ১০-১২ তারিখ সূর্যাস- পর্যন- মুসাফির থাকবে তাদের উপর ঈদুল আযহার কুরবানী ওয়াজিব হবে না। ইবরাহীম রাহ. বলেন, উমর রা. হজ্ব করতেন এবং ফিরে যাওয়া পর্যন- কোনো কিছু কুরবানী করতেন না।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪৩৯৪ অন্য বর্ণনায় আছে যে, উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. হজ্ব করতেন এবং তাঁর ভাতিজাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন না।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪৩৯৭

মাসআলা : যারা মিনায় রওনা হওয়ার আগে মক্কাতেই ১৫ দিনের নিয়তে অবস্থান করেছে তারা মুকীম। তাদেরকে হজ্বের কুরবানী ছাড়াও ঈদুল আযহার ভিন্ন কুরবানী দিতে হবে।-রদ্দুল মুহতার ২/৫১৫আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।’-সুনানে ইবনে মাজা পৃ. ২২৬ হজ্বের কুরবানীর গোশত

মাসআলা : হজ্বের কুরবানীর গোশত ঈদুল আযহার কুরবানীর মতো। হাজী নিজেও তা খেতে পারবে। হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর স্থানে গিয়ে নিজ হাতে ৬৩টি পশু জবাই করলেন। অতঃপর আলী রা.কে দিলেন। তিনি অবশিষ্ট পশুগুলো জবাই করলেন। তাকে কুরবানীর পশুতে শরীক করেন। এরপর প্রত্যেক পশু থেকে এক টুকরা গোশত নিয়ে রান্না করার নির্দেশ দিলেন। রান্না হওয়ার পর উভয়ে তা আহার করলেন।-সহীহ মুসলিম ১/৩৯৯ সায়ীদ ইবনে যুবাইর রাহ. বলেন, ‘নফল ও তামাত্তু কুরবানীর গোশত আহার করা যেতে পারে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৫৮৪ হজ্বের কুরবানীর সামর্থ্য না থাকলে

মাসআলা : তামাত্তু ও কিরানকারী কোনো হাজীর যদি হজ্বের কুরবানীর সামর্থ্য না থাকে তাহলে তাকে ১০টি রোযা রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, তারপর যখন তোমরা নিরাপদে থাক তখন যে ব্যক্তি উমরাকে হজ্বের সঙ্গে একত্র করে লাভবান হয় সে (যবেহ করবে) কুরবানী, যা সহজলভ্য হয় আর যে তা না পায় (সে) রোযা রাখবে তিন দিন হজ্বের সময়, আর সাত দিন যখন তোমরা হজ্ব হতে প্রত্যাবর্তন করবে। এই পূর্ণ দশ দিন।-সূরা বাকারা : ১৯৬

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ্বের কুরবানীর পশু পাবে না তার জন্য হজ্বের মাঝে তিনটি এবং নিজ পরিবারে ফিরে যাওয়ার পর সাতটি রোযা রাখা জরুরি।’-সহীহ বুখারী ১/২২৯ মাসআলা : ৩টি রোযা আরাফার দিন পর্যন- শেষ হতে হবে। আর বাকী সাতটি পরবর্তীতে সুযোগমতো রাখা যাবে। হযরত আলী রা. উপরোক্ত তিন রোযা সম্পর্কে বলেন, ‘ইয়াওমুত তারবিয়ার পূর্বের দিন, ইয়াওমুত তারবিয়া ও ইয়াউমে আরাফায় (অর্থাৎ ৭, ৮ ও ৯ যিলহজ্ব) উক্ত তিন রোযা।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৩৮০আল্লাহ তাআলার বাণী-‘হজ্বের মাঝে তিন দিন’ প্রসঙ্গে ইমাম শাবী রাহ. থেকেও উপরোক্ত তিন দিনের কথা বর্ণিত হয়েছে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৩৮৭ আতা রাহ. বলেন, যিলহজ্বের দশ দিনের প্রথম দিকেও রাখা যায়, মাঝেও রাখা যায় তবে শেষ দিন হল ইয়াওমে আরাফা।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৩৮৩

মাসআলা : আরাফার দিন সহ তিনটি রোযা রাখা না হলে তার জন্য কুরবানী দেওয়াই জরুরি হয়ে যাবে। প্রখ্যাত তাবেয়ী মুজাহিদ রাহ. বলেন, যে ব্যক্তি ইয়াওমুত তারবিয়ার পূর্বের দিন, ইয়াওমুত তারবিয়া ও ইয়াওমে আরাফা মিলে উক্ত তিন রোযা রাখল না তার এই রোযা ছুটে গেছে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৩৮৯ আতা ও সায়ীদ ইবনে যুবায়ের রাহ. বলেন, যে তামাত্তু হজ্ব করেছে, কিন’ কুরবানী করেনি এবং রোযাও রাখেনি তার উপর দম ওয়াজিব।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫৭১১

মাসআলা : যে ব্যক্তি আরাফার দিন পর্যন- তিনটি রোযা পূর্ণ করতে সক্ষম হল না সে তাৎক্ষণিক কুরবানীর ব্যবস্থা করতে না পারলে চুল কাটবে এবং পরবর্তীতে দুটি পশু যবেহ করবে। একটি হজ্বের কুরবানী হিসাবে। অপরটি কুরবানী না করে চুল কাটার কারণে। সায়ীদ ইবনে যুবায়ের রাহ. বলেন, যে ব্যক্তি হজ্বের কোনো আমল নির্ধারিত সময়ের পূর্বে করল অথবা কুরবানীর পূর্বে চুল মুণ্ডন করল তার উপর দম ওয়াজিব।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৫১৮৯ মাসআলা : হজ্বের কুরবানীতে ঈদুল আযহার কুরবানীর ন্যায় গরু, মহিষ, উটের সাত ভাগের একভাগ দেওয়া যাবে। এ ছাড়া ছাগল, ভেড়া, দুম্বাও কুরবানী করা যাবে।আবু জামরা রাহ. বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.কে তামাত্তু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি আমাকে তা করার আদেশ দিলেন। এরপর হজ্বের কুরবানীর পশু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘হজ্বের কুরবানীতে উট, গরু, ছাগল কিংবা এক পশুতে শরীক হয়ে কুরবানী করতে পারবে।’-সহীহ বুখারী ১/২২৮

১০ যিলহজ্বের চতুর্থ ওয়াজিব মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করা

মাথা মুণ্ডানোর সময়

মাসআলা : ১০ যিলহজ্ব কুরবানীর পর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাসে-র পূর্ব পর্যন্ত- মাথা মুণ্ডানোর সুযোগ আছে। এর চেয়ে বিলম্ব করলে দম ওয়াজিব হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যে ব্যক্তি হজ্বের কোনো ওয়াজিব আমল তার নির্দিষ্ট সময় থেকে আগে বা পরে করল তার জন্য দম দেওয়া জরুরি।-শরহু মাআনিল আছার ১/৪৪৭

মাসআলা : অবশ্য ১০ যিলহজ্ব মাথা না মুণ্ডালে ইহরাম থেকে মুক্ত হতে পারবে না। ১২ তারিখ রমী করে মাথা মুণ্ডাবে। ১১ ও ১২ তারিখ ইহরাম অবস্থায় রমী করতে হবে। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, যখন তোমাদের রমী, কুরবানী ও চুল মুণ্ডন সমাপ্ত হল তখন স্ত্রী ছাড়া সবকিছু তোমাদের জন্য হালাল।-আলক্বিরা লিমাক্বাসিদি উম্মিল কুরা পৃ. ৪৭১; হিদায়া ১/২৭৬; গুনইয়াতুন নাসিক ১৭৫; রদ্দুল মুহতার ২/৫৫৪; বাদায়েউস সানায়ে ২/৩৩০; মাবসূতে সারাখসী ৪/৭০

চুল কাটার পরিমাণ

মাসআলা : মাথার চুল না মুণ্ডিয়ে যদি খাটো করে তবে আঙুলের এক কর (প্রায় এক ইঞ্চি) পরিমাণ ছোট করা ওয়াজিব। মহিলাগণ অন-ত এতটুকু ছোট করবে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, ‘মহিলাগণ ইহরাম অবস্থায় চুল একত্র করে তা থেকে আঙুলের এক কর পরিমাণ ছোট করবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩০৬৫

ইবরাহীম রাহ. বলেন, ‘মহিলাগণ আঙুলের এক কর পরিমাণ চুল ছোট করবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩০৭৩ মাসআলা : এ পরিমাণ চুল মাথার এক চতুর্থাংশ থেকে কাটা হলেই হালাল হয়ে যাবে। হযরত হাসান বসরী রাহ. বলেন, মুহরিম মহিলা তার ললাটের কেশগুচ্ছ থেকে চুল কাটবে। হযরত হাফসা বিনতে সীরীন রাহ. বলেন, আমার কাছে এটাই ভালো মনে হয় যে, যুবতী নারী চুল বেশি পরিমাণে কাটবে না। আর বৃদ্ধা নারী অধিক কাটতে পারবে। তবে সেও এক চতুর্থাংশের বেশি চুল কাটবে না।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩০৬৮ মাসআলা : মাথার এক অংশ মুড়িয়ে অন্য অংশে চুল রাখা বা ছোট বড় করে রাখা মাকরূহ তাহরীমী। তাই এমন করবে না। -রদ্দুল মুহতার ২/৫১৫; মানাসিক পৃ. ২২৯

মাসআলা : মাথা মুণ্ডানো বা চুল কাটার আগে নখ বা শরীরের অতিরিক্ত পশম কাটা যাবে না। যদি কাটে তবে জরিমানা দিতে হবে।-গুনইয়াতুন নাসিক পৃ. ১৭৪; রদ্দুল মুহতার ২/৫১৫

মাসআলা : জামরা আকাবার কংকর নিক্ষেপের পর হজ্ব আদায়কারী নিজের চুল কাটার আগে অন্যের চুল কাটতে পারবে। ইবনে জুরাইজ রাহ. বলেন, আমি আতা রাহ.কে জিজ্ঞাসা করলাম, এক ব্যক্তি জামরা আকাবার রমী (কংকর নিক্ষেপ) করেছে কিন’ এখনো চুল মুণ্ডন করেনি। সে কি অন্যের চুল কামিয়ে দিতে পারবে? তিনি বললেন, হাঁ, পারবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৬১৩৯ মাসআলা : কিন’ নিজের চুল কাটার সময় হওয়ার পূর্বে অন্যের চুল কেটে দিলে যে কাটছে তার উপর এক ফিতরা পরিমাণ সাদকা করা জরুরি হবে।-আহকামে হজ্ব ৯৯, আহসানুল ফাতাওয়া ৪/৫১২

খুছায়েফ রাহ. বলেন, আমি ইহরাম অবস্থায় মুহাম্মাদ ইবনে মারওয়ান রাহ.-এর মোচ কেটে দিই। পরে এ সম্পর্কে সায়ীদ ইবনে যুবায়ের রাহ.কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি এক দিরহাম সদকা করার নির্দেশ দিলেন।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৪৭৪ অনুরূপ সিদ্ধান- মুজাহিদ রাহ. ও হাসান রাহ. থেকেও বর্ণিত আছে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৪৭৫ মাসআলা : কারো মাথা পূর্ব থেকে মুণ্ডানো থাকলে কিংবা পুরো মাথা টাক থাকলে হালাল হওয়ার জন্য মাথায় ক্ষুর বুলিয়ে নেওয়াই যথেষ্ট।-বাদায়েউস সানায়ে ২/২১২, রদ্দুল মুহতার ২/৫১৬, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৩১

তাবেয়ী মাছরূক রাহ.কে জিজ্ঞাসা করা হল, যে ব্যক্তি উমরা করে চুল মুণ্ডন করেছে এরপর হজ্ব করেছে সে কী করবে? তিনি বলেন, ‘সে তার মাথায় ক্ষুর বুলিয়ে নিবে।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৭৯৯ নাফে রাহ. বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর পুরো মাথা ছিল কেশবিহীন। তাই তিনি হজ্ব-উমরার সময় মাথার ক্ষুর বুলিয়ে নিতেন।’-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৩৮০৩

মাথা মুণ্ডানোর স্থান

মাসআলা : হাজীদের ইহরাম থেকে হালাল হওয়ার জন্য মিনাতে মাথা মুণ্ডানো বা চুল কাটা সুন্নত। আনাস ইবনে মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিনায় এসে জামরা আকাবায় কংকর নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর মিনায় নিজ অবস্থান স্থলে গেলেন এবং কুরবানী করলেন। এরপর চুল মুণ্ডনকারীকে চুল মুণ্ডানোর আদেশ করলেন। প্রথমে ডান পাশের চুলের দিকে ইশারা করলেন। অতঃপর বাম পাশের চুলের দিকে। অতঃপর কেশ মোবারক লোকদের মাঝে বিতরণ করে দিলেন।-সহীহ মুসলিম ১/৪২১

মাসআলা : হেরেমের সীমার ভিতর অন্য কোথাও চুল মুণ্ডালেও ওয়াজিব আদায় হবে। ইবরাহীম রাহ. বলেন, চুল কেবল মক্কাতেই মুণ্ডানো যাবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ১৪০৭৮ মাসআলা : হরমের বাইরে মাথা কামালে দম ওয়াজিব হবে। -আহকামে হজ্ব ৭৯; মানাসিক পৃ. ২৩০