পাত্থর দিল! – শায়খ আতিক উল্লাহ (দা.বা)

(১): আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। একটি হল দৈনন্দিন জীবন। আরেকটি ঈমানি জীবন। আমরা খেয়াল করলে দেখতে পাব, দৈনন্দিন জীবনের মতো ঈমানি জীবনেও চড়াই-উৎরাই আছে। ছন্দ ও পতন আছে। উত্থান ও পতন আছে। আগু ও পিছু আছে।

(২): কখনো আমাদের মনে হয়, আমার কলবে ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার কলবটা অত্যন্ত নরম হয়ে গেছে। আল্লাহমুখী হয়ে গেছে। কলবটা নেকআমলের জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে। বদআমলের প্রতি প্রচ- অনীহা নাফরত (ঘৃণা) অনুভব করছে।

(৩): আবার কখনো মনে হয়, আমার ঈমান দুর্বল হয়ে পড়েছে। নেকআমলের ইচ্ছা শিথিল হয়ে গেছে। বদআমলের প্রতি কলব বেশি ঝুঁকে আছে। আল্লাহর হুকুম মানতে কলব গড়িমসি করছে। মসজিদের দিকে পা উঠতে চায়ই না। ভালো কাজের দিকে পা সরতেই চায় না। মনে হয় যেন পায়ে আশিমণি বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়েছে।

(৪): প্রতিটি মুমিনই এমন মিশ্র অনুভূতির সম্মুখীন হয়। সবাই-ই প্রাত্যহিক জীবনে এই দুই অনুভূতির সম্মুখীন হয়। প্রশ্ন হল, আমাদের কলব কতটা শক্ত হতে পারে? আমাদের ঈমান কতটা শীতল আর জমাটবদ্ধ হতে পারে? কলব শক্ত হয়ে পড়ার সর্বনিম্ন আর সর্বোচ্চ পরিমাণ কি? কলবে ঈমানি সজীবতা নির্জীব হয়ে পড়ার মাত্রা কতটুকু?

(৫): কলব শক্ত হওয়ার মাত্রা ও ধরন নিয়ে ভাবতে বসলে আমি দেখব, কলব একেক সময় ভয়াবহ রকমের শক্ত হয়ে যায়,
ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم مِّن بَعْدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً ۚ وَإِنَّ مِنَ الْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ الْأَنْهَارُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ الْمَاءُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ ۗ
এসব কিছুর পর তোমাদের অন্তর আবার শক্ত হয়ে গেল, এমনকি তা হয়ে গেল পাথরের মত’ বরং তার চেয়েও বেশি শক্ত। (কেননা) পাথরের মধ্যে কিছু তো এমনও আছে, যা থেকে নদী-নালা প্রবাহিত হয়, তার মধ্যে কিছু এমন আছে যা ফেটে যায় এবং তা থেকে পানি নির্গত হয়, আবার তার মধ্যে এমন (পাথর)-ও আছে, যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে। (বাকারা ৭৪)।

(৬): কী ভয়ংকর কথা! মানুষের কলবটা কখনো কখনো শুধু পাথরের মতো নয়, বরং পাথরের চেয়েও শক্ত হয়ে যায়। পাথরের চেয়েও বেশি শক্ত কলব হতে পারে? অত্যন্ত বেদনাদায়ক তুলনা। আল্লাহ তা‘আলা পাথরকে কিছু মানুষের কলবের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। পাথরের গুণাবলী বর্ণনা করেছেন। পাথর কখনো নরম হয়। নিজে বিদীর্ণ হয়ে পানি বেরিয়ে আসার সহজ রাস্তা করে দেয়। কোনও কোনও পাথর আল্লাহর ভয়ে উঁচু থেকে গড়িয়ে পড়ে।

(৭): কাতাদাহ বিন দা‘আমাহ সাদূসী (১১৮ হি) রহ.। তিনি নিজ সময়ে তাফসীরের ইমাম ছিলেন। তিনি পাথর ও কলবের তুলনার ব্যাপারটা গভীরভাবে লক্ষ্য করেছিলেন। মন্তব্য করেছিলেন,
‘‘আল্লাহ শক্ত হলেও তার স্বপক্ষে ওযর (যুক্তি) পেশ করেছেন। কিন্তু পাত্থরদিলের স্বপক্ষে কিছু বলেননি (তাবারী ২/১৩৬)।

(৮): প্রশ্ন হতে পারে, কলব পাথর বা তার চেয়েও শক্ত হয়ে গেলে, কী ঘটে? শক্তকলবের পরিণতি কি? কারও কলব শক্ত হয়ে গেলে, তার কি কোনও বিরূপ প্রভাব দেখা যায়?
-কলব শক্ত হয়ে গেলে, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল, সেই কলব আল্লাহর সাথে ইত্তেসাল বা যোগাযোগ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সলাতে খুশু-খুযু আনতে পারে না। মুনাজাতে মনোযোগ আনতে পারে না। আল্লাহর সামনে দাঁড়ালে মনে ভয় জাগিয়ে তুলতে পারে না। মুনাজাতে চোখে পানি আনতে পারে না। কুরআন তেলাওয়াতে স্বাদ পায় না।

(৯): বান্দা যখন আল্লাহর সামনে দাঁড়ায়, তার কলব পুরোপুরি আল্লাহর প্রতিই সমর্পিত থাকে। আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে পারা, দুনিয়া আখেরাতের শ্রেষ্ঠতম সৌভাগ্য। বান্দার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর আর উজ্জ্বলতম সময় হল আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর মুহূর্তটা। সবচেয়ে বেশি ঈমানী সময়ও বলা যেতে পারে। কিন্তু এমন মহার্ঘ ক্ষণেও শক্তদিলের মানুষ কোনও মজা পায় না। মনোযাগ পায় না। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা শাস্তি। এর কারণে, আল্লাহর সাথে গভীরভাবে যুক্ত হতে পারে না। কাকুতি-মিনতি করে দু‘আ করতে পারে না। ইবাদতগুলো হয় খোলস আর ফাঁপা,
وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا إِلَىٰ أُمَمٍ مِّن قَبْلِكَ فَأَخَذْنَاهُم بِالْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ لَعَلَّهُمْ يَتَضَرَّعُونَ فَلَوْلَا إِذْ جَاءَهُم بَأْسُنَا تَضَرَّعُوا وَلَٰكِن قَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَزَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
(হে নবী!) আপনার পূর্বেও বহু জাতির নিকট আমি রাসূল পাঠিয়েছি। অতঃপর আমি (তাদের অবাধ্যতার কারণে) তাদেরকে অর্থ-সংকট ও দুঃখ-কষ্টে আক্রান্ত করেছি, যাতে তারা অনুনয়-বিনয় করে। অতঃপর যখন তাদের কাছে আমার (পক্ষ হতে) সংকট আসল, তখন তারা কেন অনুনয়-বিনয় করল না? বরং তাদের অন্তর আরও কঠিন হয়ে গেল এবং তারা যা করছিল, শয়তান তাকে তাদের কাছে শোভনীয় করে দিল (আনআম ৪৩-৪৪)।

(১০): কী ভয়ানক কথা! আল্লাহ তা‘আলা পাপের কারণ শাস্তি দিয়েছেন। যাতে তারা কাকুতি-মিনতি করে আল্লাহভিমুখী হয়। কিন্তু তারা তাদের কলব শক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে, কাকুতি-মিনতি করতে পারল না। ভেতর থেকে না এলে কিভাবে করবে? এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?

(১১): রোগ-বালাই, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধবিগ্রহ, দারিদ্র্য আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। আল্লাহর চান, বান্দা যেন এসব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করে। বান্দা যেন আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। বান্দা যেন পরিপূর্ণ দাসত্বের চাদরাবৃত হয়। কিন্তু বান্দার সেই সৌভাগ্য হয় না। কারণ তার কলব শক্ত হয়ে আছে। শক্ত কলব যেন তার পায়ে বেড়ী পরিয়ে দেয়। আল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে দেয় না। আরেকবার পড়ে দেখি না,
فَلَوْلَا إِذْ جَاءَهُم بَأْسُنَا تَضَرَّعُوا وَلَٰكِن قَسَتْ قُلُوبُهُمْ
অতঃপর যখন তাদের কাছে আমার (পক্ষ হতে) সংকট আসল, তখন তারা কেন অনুনয়-বিনয় করল না? বরং তাদের অন্তর আরও কঠিন হয়ে গেল।

(১২): কলব শক্ত হয়ে গেলে, বান্দা ঈমানের স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। শক্তদিলের কারণে অপ্রাপ্তির বঞ্চনা কি শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে? জি¦ না, এরচেয়েও ভয়ংকর বিষয় আছে। বান্দার কলব যখন শক্ত হয়ে যায়, তখন সে আল্লাহর অনুগত্যে শিথিলতা করতে শুরু করে। ইবাদত-বন্দেগীতে পিঠটান দিতে শুরু করে। ঘটনা এখানেই থেমে গেলে কথা ছিল না, পরে একসময় না একসময় অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হয়ে ফিরে আসার ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বান্দা শিথিলতা করতে করতে এক পর্যায়ে, নিজের শৈথিল্য-আলস্যের স্বপক্ষে কুরআন-সুন্নাহ থেকে দলীল খুঁজতে শুরু করে দেয়। দলীল না পেলেও, বিপরীতার্থক আয়াত বা হাদীস নিয়ে হলেও, নিজের পছন্দমাফিক তাবীল-ব্যাখ্যা করতে শুরু করে। মতভেদপূর্ণ মাসয়ালায়, আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখে, নিজের সুবিধামাফিক কোনও ছোটখাট ইমাম বা মুজতাহিদের ভিন্নমত আছে কি না। পেয়ে গেলে, তাকে আর পায় কে। এতদিন তার যে আমল শৈথিল্য আর আলস্যের দোষে দুষ্ট, সেটা এখন হয়ে গেল, শরয়ী নস ও মুজতাহিদের সমর্থনপুষ্ট। কেউ তাকে কিছু বলতে গেলেই, সে আয়াত-হাদীসকে ঢাল হিশেবে ব্যবহার করে। ভিন্নমতাবলম্বী মুজতাহিদের বক্তব্য দিয়ে দলীল দেয়। এটা সুষ্পষ্ট বিকৃতি,
وَجَعَلْنَا قُلُوبَهُمْ قَاسِيَةً ۖ يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَن مَّوَاضِعِهِ ۙ
তাদের অন্তর কঠিন করে দেই। তারা (তাওরাতের) বাণীসমূহকে তার আপন স্থান থেকে সরিয়ে দেয় (মায়িদা ১৩)।

(১৩): কুরআন কারীমে দুই রকমের আয়াত আছে।
১: আয়াতে মুহকামাহ। এগুলোর অর্থ পরিস্কারভাবে বোঝা যায়। এগুলোই কুরআন কারীমের মূল।
২: আয়াতে মুতাশাবিহ। এগুলোর অর্থ পরিস্কার ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বোঝা যায় না। এসব আয়াত একাধিক অর্থের সম্ভাবনা রাখে।
هُوَ الَّذِي أَنزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُّحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابِهَاتٌ ۖ فَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ زَيْغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَاءَ تَأْوِيلِهِ ۗ وَمَا يَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلَّا اللَّهُ ۗ وَالرَّاسِخُونَ فِي الْعِلْمِ يَقُولُونَ آمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِندِ رَبِّنَا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ
(হে রাসূল!) সে আল্লাহই এমন সত্তা, যিনি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন, যার কিছু আয়াত মুহকাম, যার উপর কিতাবের মূল ভিত্তি এবং অপর কিছু আয়াত মুতাশাবিহ। যাদের অন্তরে বক্রতা আছে, তারা সেই মুতাশাবিহ আয়াতসমূহের পেছনে পড়ে থাকে, উদ্দেশ্য ফিতনা সৃষ্টি করা এবং সেসব আয়াতের তাবীল খোঁজা, অথচ সেসব আয়াতের যথার্থ মর্ম আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আর যাদের জ্ঞান পরিপক্ব তারা বলে, আমরা এর (সেই মর্মের) প্রতি বিশ্বাস রাখি (যা আল্লাহ তা‘আলার জানা)। সবকিছুই আমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে এবং উপদেশ কেবল তারাই গ্রহণ করে, যারা বুদ্ধিমান (আলে ইমরান ৭)।

(১৪): আল্লাহ তা‘আলা বিশেষ হেকমতবশত, কুরআন কারীমের দুই প্রকার আয়াত স্থান দিয়েছেন। শয়তান আয়াতে মুতাশাবিহ দিয়ে মানুষকে গোমরাহ করার প্রয়াস পায়। সে মানুষকে ক্রমাগত প্ররোচনা দিতে থাকে, বান্দা যেন আয়াতে মুতাশাবিহ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়। সেগুলোর তাবীল-তাফসীর নিয়ে সময় ব্যয় করে। শয়তান নানা ভঙ্গিতে আয়াতে মুতাশাবিহকে বান্দার সামনে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলে। মানুষ দেখে, সে সহজেই মুফাসসির হয়ে যাচ্ছে, সহজেই কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারছে, কিছু মানুষ তার অনুসারীও হচ্ছে, ব্যস আর কি চাই।

(১৫): যাদের কলব ঈমানে পরিপূর্ণ, তারা শয়তানের পাতা ফাঁদে পা দেয় না। তারা সব সময় মুহকাম আয়াতের গণ্ডীতেই থাকে। দ্ব্যর্থবোধক আয়াতগুলোর পেছনে সময় ব্যয় করে না। কিন্তু শক্তদিলের অধিকারী যারা, তাদের অবস্থা ভিন্ন। তারা ঘুরেফিরে আয়াতে মুতাশাবিহের কাছেই আসে। তারা নিজের শৈথিল্য আর আলস্যের স্বপক্ষে আয়াতের মুতাশাবিহের মনগড়া তাবীল-তাফসীরকে দাঁড় করায়,
لِّيَجْعَلَ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ فِتْنَةً لِّلَّذِينَ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ وَالْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُمْ ۗ
তা এজন্য যে, শয়তান যে প্রতিবন্ধ ফেলে, আল্লাহ তাকে যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে এবং যাদের অন্তর শক্ত, তাদের জন্য ফিতনায় পরিণত করেন (হাজ্জ ৫৩)।

(১৬): শয়তান মানুষের মনে নানা চিন্তা প্রবিষ্ট করায়। এটা শুধু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, নবীগনের মনেও শয়তান প্রতিবন্ধ ফেলার চেষ্টা করত। আগের আয়াতেই ব্যাপারটা বলা আছে। এই প্রতিবন্ধের কারনেই মানুষ ফিতনায় পড়ে যায়। হক চিনতে ব্যর্থ হয়। আয়াতটা পড়ে দেখতে পারি,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ وَلَا نَبِيٍّ إِلَّا إِذَا تَمَنَّىٰ أَلْقَى الشَّيْطَانُ فِي أُمْنِيَّتِهِ فَيَنسَخُ اللَّهُ مَا يُلْقِي الشَّيْطَانُ ثُمَّ يُحْكِمُ اللَّهُ آيَاتِهِ ۗ
(হে নবী!) আপনার পূর্বে যখনই আমি কোনও রাসূল বা নবী পাঠিয়েছি, তার ক্ষেত্রেও এ রকমই ঘটেছে যে, তাদের কেউ যখন কোনও আকাঙ্খা করেছে, তখন শয়তান তার আকাঙ্খায় বিপত্তি সৃষ্টি করত, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা শয়তানের সৃষ্ট বিপত্তি অপসারণ করে নিজ আয়াতসমূহকে আরও দৃঢ় করতেন।

(১৭): সাধারণত মনে করা হয়, গুনাহের কারণে কলব শক্ত হয়ে যায়। পাশাপাশি এটাও মনে রাখা চাই, আল্লাহ তা‘আলা শাস্তি হিশেবেও অনেক সময় বান্দার কলবকে শক্ত করে দেন,
فَبِمَا نَقْضِهِم مِّيثَاقَهُمْ لَعَنَّاهُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوبَهُمْ قَاسِيَةً ۖ
অতঃপর তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণেই তো আমি তাদেরকে আমার রহমত থেকে বিতাড়িত করি ও তাদের অন্তর কঠিন করে দেই (মায়িদা ১৩)।

(১৮): অনবরত গুনাহ করতে থাকলে, আল্লাহ তা‘আলা শাস্তিস্বরূপ তাকে আরও বেশি সেই গুনাহে লিপ্ত করে দেন। গুনাহের বদলে গুনাহ। পাপের শাস্তি পাপ। এমনটা বলা হয়েছে কুরআন কারীমে,
إِنَّ الَّذِينَ تَوَلَّوْا مِنكُمْ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ إِنَّمَا اسْتَزَلَّهُمُ الشَّيْطَانُ بِبَعْضِ مَا كَسَبُوا ۖ وَلَقَدْ عَفَا اللَّهُ عَنْهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ حَلِيمٌ
উভয় বাহিনীর পারস্পরিক সংঘর্ষের দিন তোমাদের মধ্য হতে যারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিল, প্রকৃতপক্ষে শয়তান তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের কারণে পদস্খলনে লিপ্ত করেছিল। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরে ক্ষমা করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম সহিষ্ণু (আলে ইমরান ১৫৫)।

(১৯): বান্দা বক্রতার পথে হাঁটলে আল্লাহ তা‘আলা তার বক্রতা বাড়িয়েই দেবেন,
فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ ۚ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
অতঃপর তারা যখন বক্রতা অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ তাদের অন্তরকে বক্র করে দিলেন। আল্লাহ অবাধ্য সম্প্রদায়কে হেদায়াতপ্রাপ্ত করেন না (সাফ্ফ ৫)।

(২০): আমার কলব রোগগ্রস্ত। আমি কলবের রোগকে সারিয়ে তোলার কোনও চেষ্টাই করছি না। আল্লাহ রোগ আরও বাড়িয়ে দেবেন,
فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا ۖ
তাদের অন্তরে আছে রোগ। আল্লাহ তাদের রোগ আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছেন (বাকারা ১০)।

(২১): আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা বক্রতার বদলে বক্রতা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কলমের মরযের শাস্তিস্বরূপ মরয (ব্যাধি) আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পাপের শাস্তি আরও দ্বিগুণ পাপে লিপ্ত করার মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। তাও সাধারণ পরিস্থিতিতে নয়, যখন তারা বিপদগ্রস্ত ছিল, তখনও শাস্তি পেয়েছে। কলব শক্ত হয়ে যাওয়ার পরও যখন বান্দা সতর্ক হয়নি, কলবকে সংশোধন করে নিতে সচেষ্ট হয়নি, তার কলবকে আরও বেশি শক্ত করে দেয়া হয়েছে।

(২২): দুই ব্যক্তির কলব শক্ত হয়ে গেল। দু’জনের কলব শক্ত হওয়ার ধরনই এক? কলবটা কিভাবে শক্ত হয়? কিভাবে একটা কলব ঈমানে পরিপূর্ণ থাকার পরও শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়? সজীব একটা বস্তু ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে যায়, কেমন গা-শিউরানো ব্যাপার। কলকলে টলটলে দিঘি শুকিয়ে গেলে বিস্ময় জাগে না? কলবের শুকিয়ো যাওয়া তো আরও বেশি বিস্ময়কর।

(২৩): উপুর্যপরি পাপের কারণে কলব শক্ত হয়ে আসে। এ-ছাড়া আর কোনও কারণ কি হতে পারে? জি¦, কলব শক্ত হয়ে যাওয়ার আরও বড় একটি কারণও আছে। আল্লাহর যিকির থেকে দূরে সরে যাওয়া। হাঁ, আল্লাহকে ভুলে গেলে, আল্লাহও আমাকে ভুলে যান। আল্লাহর যিকির না করতে করতে একসময় কলব শক্ত হয়ে যায়। আল্লাহর যিকিরই কলবকে আলোকিত রাখে। সজীব রাখে। সতেজ রাখে। আল্লাহর যিকির থেকে দূরে থাকলে যে কলব শক্ত হয়ে যায়, ব্যাপারটি একটি আয়াতে উঠে এসেছে,
أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَن تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ ۖ وَكَثِيرٌ مِّنْهُمْ فَاسِقُونَ
যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য কি এখনও সেই সময় আসেনি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তাদের অন্তর বিগলিত হবে? এবং তারা তাদের মত হবে না, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল অতঃপর যখন তাদের উপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর শক্ত হয়ে গেল এবং (আজ) তাদের অধিকাংশই অবাধ্য (হাদীদ ১৬)।

(২৪): দীর্ঘসময় ধরে আল্লাহর যিকির ও আল্লাহর কিতাব থেকে দূরে সরে থাকার কারণে, তাদের কলব শক্ত হয়ে গিয়েছে। কুরআন কারীম পূর্বেকার কওমের এই ঘটনা কি নিছক গল্প বলার জন্য উল্লেখ করেছে? জি¦ না, আমাদের শিক্ষা গ্রহণের জন্যে ঘটনাটি বলা হয়েছে। আল্লাহর যিকির থেকে দূরে থাকলে যে কলব শক্ত হয়ে যায়, আরও একটি আয়াতে আছে,
فَوَيْلٌ لِّلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُم مِّن ذِكْرِ اللَّهِ ۚ
সুতরাং ধ্বংস সেই কঠোরপ্রাণদের জন্য, যারা আল্লাহর যিকির থেকে বিমুখ (যুমার ২২)।

(২৫): আয়াতগুলোকে ধারাবাহিকভাবে সাজালে এমন হয়,
১: কিছু করব পাথরের চেয়েও শক্ত (বাকারা ৭৪)।
২: কলব শক্ত হয়, পাপীদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নেমে আসা শাস্তির কারণে (মায়িদা ১৩)।
৩: কলব শক্ত হয়ে গেলে, বান্দা আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করে দু‘আ করতে পারে না (আন‘আম ৪৩)।
৪: কলব শক্ত হয়ে গেলে, সহজেই শয়তানের ফিতনায় পতিত হয়ে যায় (হাজ্জ ৫৩)।
৫: আল্লাহর যিকির থেকে দূর সরে থাকলে, কলব শক্ত হয়ে যায় (যুমার ২২)।

(২৬): গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে, আমরা বুঝতে পারি, কলব শক্ত হয়ে যাওয়া যা তা ব্যাপার নয়। কুরআন কারীম সাধারণ তুচ্ছ নগন্য কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা করে না। কুরআন আমাদেরকে কলব শক্ত হওয়ার ধরন কারণ সম্পর্কে সুষ্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে রেখেছে। যাদের কলব শক্ত হয়ে গেছে, তাদের ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কেও সতর্ক করেছে। আমরা কিভাবে কলব শক্ত হওয়ার বিষয়টাকে হেলাফেলা করতে পারি? গুরুত্বহীন বিষয়ের মতো ভুলে থাকতে পারি?

(২৭): আমার মধ্যে কলব শক্ত হওয়ার আলামতগুলো থাকে, আমার কি উচিত আজই এখনই সতর্ক হয়ে যাওয়া? আমি আজ, এই মুহূর্তে মারা গেলে, আমার কী পরিণতি হবে? আল্লাহর হুমকিটা আরেকবার দেখি না,
فَوَيْلٌ لِّلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُم مِّن ذِكْرِ اللَّهِ ۚ
সুতরাং ধ্বংস সেই কঠোরপ্রাণদের জন্য, যারা আল্লাহর যিকির থেকে বিমুখ।

(২৮): আমার অবশ্য কর্তব্য, এখনই শক্ত কলবের চিকিৎসা করানো। আমি কিভাবে এই আযাব আর গযব থেকে মুক্তি পাবো? রাব্বে কারীম সেই সমাধান দিয়ে দিয়েছেন। খুবই সহজ সমাধান। কুরআন তিলাওয়াতই সেই অব্যর্থ সমাধান,
اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُّتَشَابِهًا مَّثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ ۚ
আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম বাণী- এমন এক কিতাব যার বিষয়বস্তুসমূহ পরস্পর সুসামঞ্জস্য, (যার বক্তব্যসমূহ) পুনরাবৃত্তিকৃত, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে এর দ্বারা তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়। তারপর তাদের দেহ-মন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে (যুমার ২৩)।

(২৯): কান্না কখন আসে? কলব যখন নরম হয়। কলব কখন নরম হয়? আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করলে। নবীগন কিভাবে আল্লাহর কালাম শুনে কাঁদতেন, তার একটা চিত্র কুরআন কারীমে আঁকা আছে,
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ مِن ذُرِّيَّةِ آدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِن ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا ۚ إِذَا تُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَٰنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا ۩
আদমের বংশধরদের মধ্যে এরাই সেই সকল নবী, যাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ করেছেন। এদের কতিপয় সেই সব লোকের বংশধর, যাদেরকে আমি নূহের সাথে (নৌকায়) আরোহণ করিয়েছিলাম এবং কতিপয় ইবরাহীম ও ইসরাঈল (ইয়া‘কূব)-এর বংশধর। আমি যাদেরকে হিদায়াত দিয়েছিলাম ও (আমার দীনের জন্য) মনোনীত করেছিলাম, এরা তাদের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সামনে যখন দয়াময় আল্লাহর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হত, তখন তারা কাঁদতে কাঁদতে সিজদায় লুটিয়ে পড়ত (মারয়াম ৫৮)।

এটা সাজদার আয়াত। 

(৩০): কলবকে নরম করতে, আসলেই আল্লাহর কালামের কোনও বিকল্প নেই। শুধু নবীগণই নন, আগের যুগের নেককারগণও আল্লাহর কালাম শুনে কাঁদতেন,
وَإِذَا سَمِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَى الرَّسُولِ تَرَىٰ أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوا مِنَ الْحَقِّ ۖ
এবং রাসূলের প্রতি যে কালাম নাযিল হয়েছে তারা যখন তা শোনে, তখন দেখবেন তাদের চোখসমূহকে, তা থেকে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে, যেহেতু তারা সত্য চিনে ফেলেছে (মায়িদা ৮৩)।

(৩১): কলব শক্ত হয়ে যাওয়া যত কঠিন শাস্তি, তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তা ততটাই সহজ। কুরআন কারীম আমাদের সবার হাতের নাগালে। হাত বাড়িয়ে নিলেই হল। নবীগণ আল্লাহর কালামের প্রভাবে কেঁদেছেন। আগের যুগের নেককারগণ কেঁদেছেন। আমি কেন কাঁদব না? আল্লাহর কালামের প্রভাবে আমার শক্ত কলবও নরম হয়ে যাবে। আমার দু’চোখ বেয়ে নামবে শুকরিয়ার অশ্রুধারা। আনুগত্যের ফল্গুধারা। ইনশাআল্লাহ।