খলিফা হারুনুর রশিদ ও তাঁর বাইতুল হিকমাহ : মুসলিম সভ্যতার প্রধান মানবিক জ্ঞানকেন্দ্র

ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে যেসব ন্যায়-পরায়ণ ও সফল শাসকের নাম জ্বলজ্বল করছে, তাঁদের অন্যতম আব্বাসীয় বংশের ৫ম খলিফা বাদশাহ হারুনুর রশিদ। একদিকে যেমন ন্যায়পরায়ণ শাসক ও সিংহশার্দুল সিপাহসালার ছিলেন, অপরদিকে ছিলেন খোদাভীরু ও পরহেজগার ব্যক্তিত্ব। ইসলামের জন্য তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা সমর্পিত ছিল।

আজ ২৪ মার্চ। ৮০৯ খ্রিষ্টাব্দের এ দিনে বাদশাহ হারুনুর রশিদের ইন্তেকাল হয়। ৭৬৬ সালে আব্বাসি খেলাফতের অধীনস্থ রাই নামক অঞ্চলে আব্বাসি বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ৭৮৬ সালে তিনি যখন ২০ বছরের টগবগে নওজোয়ান, আব্বাসি খেলাফতের ৫ম খলিফা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ইতিমধ্যেই তৎকালীন প্রতিভাধর জ্ঞানতাপস ইয়াহইয়া বর্মাকের কাছে ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষায় বুৎপত্তি অর্জন করে নেন।

ক্ষমতাগ্রহণের পর বাদশাহ হারুনুর রশিদ ইসলামি সাম্রাজ্যের প্রভূত কল্যাণ সাধনে মনোনিবেশ করেন। তাঁর শাসনামলে খারেজি ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে কঠোর হাতে তা দমন করেন। পাশাপাশি বহির্শত্রুর মুকাবেলায়ও অনন্য অবদান রাখেন।

বাইজানটাইনরা বাদশাহ হারুনুর রশিদের ক্ষমতাগ্রহণের আগ থেকেই উৎপাত করছিল। হারুনুর রশিদ ক্ষমতাগ্রহণের পর নানাভাবে এদের মুকাবেলা করেন। ৭৯১ সালে বাইজেনটাইন শাসক আইরিন জিযিয়া প্রদানের শর্তে তাঁর সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। আইরিনের পরবর্তী শাসক এ জিযিয়া প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন এবং পরাজিত করেন হারুনুর রশিদ। মোটকথা তাঁর শাসনামলে ইসলামি সাম্রাজ্যের শক্তিধর শত্রুরাও কখনও মাথা খাড়া করে দাঁড়াতে পারেনি।

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রেই উন্নতি সাধিত হয়েছিল বাদশাহ হারুনুর রশিদের শাসনামলে। বিশেষত বায়তুল হিকমাহ প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য অবদানের পাশাপাশি এ কারণেও তিনি আলাদাভাবে বরিত হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। প্রায় ২৩ বছর নিষ্ঠা ও দাপটের সঙ্গে শাসনকার্য পরিচালনা করে ২৪ মার্চ ৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে তুস নগরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন।

বাইতুল হিকমাহ
বাইতুল হিকমাহ একাধারে গ্রন্থাগার, অনুবাদকেন্দ্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সমকালীন বিশ্বে অভূতপূর্ব খ্যাতি অর্জন করেছিল। ইসলামি স্বর্ণযুগের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ইতিহাসে আজও জ্বলজ্বল করছে বাইতুল হিকমাহর নাম ও অবদান। বাদশাহ হারুনুর রশিদ তাঁর শাসনামলে ইরাকের বাগদাদে এটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

গণিত, জোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল, মানচিত্র অঙ্কনবিদ্যা থেকে শুরু করে সমকালের প্রতিটা বিষয়ের ওপরই চর্চা হতো বাইতুল হিকমাহয়। একই সঙ্গে ভিন ভাষায় রচিত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বইয়ের আরবি অনুবাদও করা হতো এখানে।

দেশ-বিদেশের জ্ঞানপিপাসুরা এখানে এসে হাজির হতেন জ্ঞানার্জনের জন্য। চলত নান রকমের গবেষণা, পরীক্ষা ও আবিষ্কার। গণিতবিদ্যার অভূতপূর্ব কল্যাণসাধন, আলোকবিজ্ঞানের নতুন নতুন ধারা তৈরি এখান থেকেই হয়েছে।

বাগদাদের এ গবেষণাগার থেকেই পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন প্রগামড-মেশিনের নমুনা তৈরি হয়েছিল।

চোখের রোগ নিয়ে হিকমাহর বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে গেছেন। তাঁরা অস্ত্রোপচার ও রোগসংক্রমণ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করে গেছেন।

হিকমাহর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা টলেমীয় মডেল (গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি, ১০০-১৬৮ খ্রিস্টাব্দ) পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন। পৃথিবীর প্রথম বিস্তৃত মানচিত্র তৈরি হয় হিকমায়।

বাদশাহ হারুনুর রশিদ এ গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করে গেলেও এর চূড়ান্ত উৎকর্ষ সাধিত হয় তাঁর পুত্র আল-মামুনের শাসনামলে।

প্রায় সাড়ে চারশত বছর সমকালীন দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ গবেষণাগার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বাইতুল হিকমাহ অনন্য সব গবেষণা ও আবিষ্কার উপহার দেয় পৃথিবীকে। ১২৫৮ সালে বর্বর হালাকু খান বাগদাদ অবরোধ করে আব্বাসীয় খেলাফতের পতন ঘটায় এবং সেই সঙ্গে ধ্বংস করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ নগরী বাগদাদকে। ধ্বংস করে বায়তুল হিকমাহসহ অসংখ্য গবেষণাগার ও লাইব্রেরি।

ইতিহাসবিদরা বলেন, বাগদাদের বিভিন্ন লাইব্রেরি ও বাইতুল হিকমাহয় থাকা কয়েক লাখ বই হালাকু খানের বাহিনী আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। আর বাকি সব বই ফেলে দেয় দজলা ও ফোরাতের জলে। যার কারণে বর্বর এ ধ্বংসযজ্ঞের পরে দজলা ও ফোরাতের পানি বইয়ের লেখা কালিতে ৬ মাস অবধি কৃষ্ণবর্ণ ছিল।

বাইতুল হিকমাহ কেবল গবেষণাগারই ছিল না, ছিল মুসলিম সভ্যতার প্রধান মানবিক জ্ঞানকেন্দ্র। ইতিপূর্বে পৃথিবীর কোনো সভ্যতাই এমন জ্ঞানকেন্দ্রের নজির দেখাতে পারেনি। কিন্তু হালাকু খানের হাতে নির্মমভাবে তা ধ্বংস হবার পর আজ অবধি এমন জ্ঞানকেন্দ্র মুসলিম সভ্যতা ওভাবে আর দাঁড় করাতে পারেনি। আর গত কয়েক শতাব্দী ধরে তো নেতৃত্ব হারাবার পাশাপাশি জাগতিক ও মানবিক জ্ঞানের চর্চাও পুরোদমে মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।


হামমাদ রাগিব
মূলঃ fateh24