ইখলাস

بسم الله الرحمن الرحيم

মূল: আন্তরিক তওবা – ইমাম গাজ্জালি, ইমাম ইবনুল কায়্যিম, ইমাম ইবনে রজব – সংকলন থেকে

ইখলাস হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে সবরকম অপবিত্রতা থেকে নিয়্যাতকে মুক্ত করা। সকল ইবাদাতের পিছনে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি নিশ্চিত করাই এর উদ্দেশ্য। ইখলাস হচ্ছে আল্লাহর ধ্যানে এমনভাবে নিমগ্ন হওয়া যেন ব্যাক্তি সৃষ্টিকেও ভুলে যায়।

রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ মেনে করা যেকোনো ভালো কাজ আল্লাহর দরবারে গৃহীত হওয়ার শর্ত হচ্ছে ইখলাস । আল্লাহ কুরআনে বলেন, “তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে ,তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। এটাই সঠিক ধর্ম।”(৯৮:৫)

একবার আবু উমামা রাসূল(সা) এর নিকট এসে বলেন, ওই লোকের ব্যাপারে কি মত, যে শুধুমাত্র খ্যাতি ও সম্পদের জন্যে জিহাদে যোগদান করে? আল্লাহর রাসূল(সাঃ) বলেন, সে কিছুই পেলো না। লোকটি তিনবার একই প্রশ্ন করলো। প্রতিবারই রাসুল(সাঃ) একই উত্তর দিলেন। অতঃপর রাসূল(সাঃ) বলেন, “আল্লাহ শুধুমাত্র সেসব কাজই গ্রহন করেন যা সম্পূর্ণরূপে তার সন্তুষ্টির জন্যে করা হয়।”১

আবু সাইদ আল খুদরী(রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুল(সাঃ) বিদায় হজ্জের খুতবায় বলেন ,

“আল্লাহ তাকে অনুগ্রহ করবেন যে এই কথাগুলো শুনে এবং বুঝে। কারণ এমনও হতে পারে যে, একজন ব্যাক্তি কথাগুলো শুনলো কিন্তু ভালো করে বুঝলো না। তিনটি জিনিসের ব্যাপারে মুমিনের হৃদয়ে কোনো শত্রুতা এবং বিদ্বেষ থাকা উচিত নয় যেগুলো হচ্ছে, কাজকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সঁপে দেয়া, মুসলিম ইমামদের পরামর্শ নেয়া এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতি অনুগত থাকা।”২

এর অর্থ হল, এই তিনটি গুণ হৃদয়কে মজবুত করে। যে এই তিনটি গুণ আয়ত্ত করতে পারবে তার হৃদয় সকল প্রকার ভ্রষ্টতা এবং শয়তানি থেকে মুক্ত থাকবে।

একজন বান্দা নিজেকে শয়তান থেকে মুক্ত করতে পারে গভীর একনিষ্ঠতার মাধ্যমে, কারণ আল্লাহ কুরআনে আমাদের বলেন যে শয়তান তাঁকে বলে, “তবে তাদের মধ্যে যারা আপনার খাঁটি বান্দা, তাদেরকে ছাড়া।”(৩৮:৮৩)

একথা বর্ণিত আছে যে, এক নেক ব্যাক্তি বলেন যে, “হে আত্মা একনিষ্ঠ হও, এতে তুমি পবিত্র হয়ে যাবে।”

যখন কোনো পার্থিব বিষয়ে কেউ আসক্তিবোধ করে এবং হৃদয় ওই দিকে ঝুঁকে পড়ে, আমাদের ইবাদাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে, তখন এটি বিশুদ্ধতা থেকে আমাদের দূরে ঠেলে দেয় এবং আমাদের ইখলাসকে ধ্বংস করে দেয়। যে মানুষ তার সৌভাগ্যে বুদ হয়ে যায়, আর নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করা শুরু করে; সে মানুষের ইবাদাত এই ধরনের কামনা বাসনা থেকে খুব কমই মুক্ত থাকতে পারে। তাই বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি তার জীবনের একটি মুহূর্ত বিশুদ্ধ একনিষ্ঠতায় ব্যয় করে সে মুক্তি পেয়ে গেলো, কারন একনিষ্ঠতা হলো দুর্লভ ও দামী এবং হৃদয়কে এর অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করা একটি কঠিন প্রতিজ্ঞা।

আমলের একনিষ্ঠতা হচ্ছে হৃদয়কে সবরকম অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করা, হোক তা কম বা বেশি, যাতে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার নিয়্যাতে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ব্যতীত আর কোনো উদ্দেশ্য থাকে না।

এই কাজটি শুধুমাত্র এমন একজন আল্লাহপ্রেমিক মানুষই করতে পারে , যার হৃদয় আখিরাতের জন্যে এতোটাই ব্যাকুল যে এতে দুনিয়ার জন্যে কোনো জায়গা খালি নেই।এমন ব্যাক্তি পানাহার থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক কাজ সব কিছুতেই একনিষ্ঠ হবে।এমনটা না হলে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া যে কারো জন্যেই একনিষ্ঠতার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।

আল্লাহ এবং আখিরাতের প্রতি ভালোবাসা সম্পন্ন একটি মানুষের চরিত্র এই ভালোবাসা দিয়েই নির্ধারিত হয় আর প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্যিকারের নিষ্ঠাবান। আর যার হৃদয় পার্থিব মর্যাদা আর কর্তৃত্বের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ তার সালাত সিয়াম কোনো ইবাদাতই গৃহীত হবে না খুবই অল্প কিছু ব্যতিক্রম বাদে।

পার্থিব ভালোবাসা দূরীকরণের উপায় হচ্ছে নিজের দুনিয়াবি বাসনাগুলোকে ভেঙ্গে লোভ লালসা ত্যাগ করে আখিরাতের প্রস্তুতির মাধ্যমে হৃদয়কে পবিত্র করা ,তাহলে এটাই হয়ে যাবে হৃদয়ের স্বাভাবিক অবস্থা আর একনিষ্ঠতা অর্জন হয়ে যাবে সহজতর।এমন অনেক কাজ আছে যেখানে মানুষ ভাবে যে সে এই কাজটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যেই করছে।আসলে সে এর মধ্যকার ত্রুটিগুলো ধরতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়।

বর্ণিত আছে এক ব্যাক্তি সর্বদা মাসজিদের প্রথম কাতারে সালাত আদায় করতো। একদিন দেরি করে আসায় প্রথম কাতারে জায়গা না পেয়ে সে পরের কাতারে দাঁড়ায়। যখন সে টের পায় মানুষ তাকে দ্বিতীয় কাতারে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখছে সে অস্বস্তি তে পড়ে যায়। সে বুঝতে পারে যে, এতোদিন সে প্রথম কাতারে দাঁড়াতো যেন লোকে তার প্রশংসা করে। এটি দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার মত একটি বিষয় যা থেকে খুব কম ইবাদাতই মুক্ত। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কেউই এইসব  ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাপার থেকে মুক্ত নয়। যারা এই জিনিসটি উপলব্ধি করতে পারে না, তার আখিরাতে তাদের ভালো কাজগুলোকে খারাপ কাজ রুপে দেখতে পাবে। এদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,

“যদি গোনাহগারদের কাছে পৃথিবীর সবকিছু থাকে এবং তার সাথে সমপরিমাণ আরও থাকে, তবে অবশ্যই তারা কেয়ামতের দিন সে সবকিছুই নিস্কৃতি পাওয়ার জন্যে মুক্তিপন হিসেবে দিয়ে দেবে। অথচ তারা দেখতে পাবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন শাস্তি, যা তারা কল্পনাও করত না।আর দেখবে, তাদের দুস্কর্মসমূহ এবং যে বিষয়ে তারা ঠাট্টা–বিদ্রুপ করত, তা তাদেরকে ঘিরে নেবে।” (৩৯: ৪৭–৪৮)

“বলুনঃ আমি কি তোমাদেরকে সেসব লোকের সংবাদ দেব, যারা কর্মের দিক দিয়ে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। তারাই সে লোক, যাদের প্রচেষ্টা পার্থিবজীবনে বিভ্রান্ত হয়, অথচ তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করেছে।”(১৮:১০৩–১০৪)

ইয়াকুব বলেন, “একনিষ্ঠ ব্যাক্তি হচ্ছেন তিনি যিনি তার ভালো কাজ গুলোকে এমনভাবে লুকিয়ে রাখেন যেভাবে তার খারাপ কাজগুলোকে লুকিয়ে রাখেন।”

আস সৌসি বলেন, “সত্যিকার একনিষ্ঠতা হচ্ছে নিজের একনিষ্ঠতার ব্যাপারে সচেতনতা হারিয়ে ফেলা”। কারণ যে তার একনিষ্ঠতায় একনিষ্ঠতা খুঁজে পায় তার একনিষ্ঠতার একনিষ্ঠতা প্রয়োজন আছে।”

একনিষ্ঠতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রশংসা আর প্রশ্নবিদ্ধতা থেকে যা মুক্ত তাই পবিত্র। অর্থাৎ যেকোনো কাজই আত্মপ্রশংসা মুক্ত হতে হবে।

আইয়ুব বলেন, “একটি কাজ করার চেয়ে ওই কাজের নিয়্যাতকে পরিশুদ্ধ করা অনেক কঠিন।

কেউ কেউ বলে থাকেন অল্প সময়ের জন্যে একনিষ্ঠ হতে পারা মানে চিরকালের জন্যে বেঁচে যাওয়া, কিন্ত একনিষ্ঠতা দুর্লভ।

সুহাইলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো নিজের জন্যে সবচেয়ে কঠিন কাজ কি? তিনি বলেন, যখন আত্মার মুরোদ হয় না একনিষ্ঠতা দিয়ে পরিপূর্ণ হওয়ার সৌভাগ্য লাভের।

আল ফুদাইল বলেন, “লোকদের জন্যে কাজ থামিয়ে দেয়ার অর্থ হচ্ছে লোকদের প্রশংসা কামনা করা। আর লোকদের প্রশংসার জন্যে কাজ করার অর্থ অই লোকদের সাথে আল্লাহর শরিক করা। একনিষ্ঠতা হলো যখন আল্লাহ আপনাকে উভয় অবস্থা থেকে মুক্ত করেন।”


পাদটীকাঃ

১। সাহিহ আন নিসাই, কিতাব আল জিহাদ ৬/২৫,আল হাফিজ বিন হাজার, ফাতহ আল কাদর ৬/২৮

২। সাহিহ ইবন মাজাহ, ইবন হিব্বান,মাওয়ারিদ আয যামান, পৃষ্ঠা ৪৭ যাইদ বিন সাবিত হতে