উসমানিস্তান : ভারত যেভাবে হায়দারাবাদ দখল করে

হায়দারাবাদ। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় অঞ্চলটি উসমানিস্তান নামে স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশের স্বপ্ন দেখেছিল, ভারত-পাকিস্তান ভাগ হবার পর নিজেদের স্বাধীনতাও ঘোষণা করেছিল, কিন্তু ভারতীয় ছলচাতুরী, আগ্রাসন ও নৃশংসতার শিকার হয়ে অঞ্চলটি আজ ভারতের তিনটি অঙ্গরাজ্যে বিচ্ছিন্ন ও অঙ্গিভূত।

উসমানিস্তান

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলেও বেশ কিছু রাজ্য ব্রিটিশদের আধিপত্য ও অধীনতা স্বীকারের মধ্য দিয়ে স্বায়ত্বশাসন ভোগ করত। হায়দারাবাদ ছিল এসব রাজ্যের অন্যতম। ৮২ হাজার ৬ শো ৯৮ বর্গমাইল আয়তনের এ অঞ্চলটি মুসলিম শাসক দ্বারা পরিচালিত হতো। বংশানুক্রমিকভাবে একটি পরিবার এ শাসনকার্য পরিচালনা করত। শাসককে বলা হতো নিজাম। ভারত উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় তৎকালীন নিজাম ছিলেন ওসমান আলী খান সিদ্দীকি সপ্তম আসাফ শাহ এবং তার পরিবার সেই সম্রাট আবু আল-ফাতেহ নাসির উদদীন মুহাম্মদ শাহ-এর সময় থেকে হায়দারাবাদের নিজামের দ্বায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। মোগলদের আনুগত্যে থাকলেও বাংলার নবাবের মতো সেসময়ের নিজামরাও স্বাধীন ছিলেন এবং ব্রিটিশদের কাছে দিল্লির পতনের পর তৎকালীন নিজাম স্বভাবতই ব্রিটিশদের আধিপত্য স্বীকার করে নেন।

ব্রিটিশরা যখন ভারত উপমহাদেশকে দুটি ভাগ করে এখান থেকে চলে যায় তখন হায়দারাবাদের শাসক ওসমান দুটি রাষ্ট্রের কোনোটির সঙ্গে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে ভারত ভাগের প্রস্তাব যখন ওঠে, মুসলিম জাতীয়বাদের প্রবক্তা চৌধুরী রহমত আলী পাকিস্তানের পাশাপাশি বাংলা অঞ্চলকে বাঙ্গালিস্তান নামে এবং হায়দারাবাদকে উসমানিস্তান নামে পৃথক তিনটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেন। পরে ঘটনার পরিক্রমায় স্বাধীন বাঙালিস্তান ও উসমানিস্তানের প্রস্তাব থেকে তিনি ফিরে গেলেও হায়দারাবাদের শাসক উসমান নিজের অবস্থান থেকে সরেননি। তিনি ব্রিটিশদের কাছে অনুরোধ করেন যেন হায়দারাবাদকে একটি স্বাধীন মুসলিম কমনওয়েলথ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লুইস ফ্রান্সিস অ্যালবার্ট ভিক্টর নিকোলাস মাউন্টব্যাটেন তার অনুরোধ নাকচ করে তাকে যেকোন একটি দেশের সাথে যোগ দেয়ার পরামর্শ দেন।

কিন্তু নিজাম ওসমানের এ দুটো দেশের কোনোটির সঙ্গেই যুক্ত হবার ইচ্ছে ছিল না। তাই ব্রিটিশরা হায়দারাবাদকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা না করলেও তিনি নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠন করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজের কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকেন। আর ব্রিটিশদের বিদায়ের পর যেহেতু এ অঞ্চলটি ব্রিটিশদের সঙ্গে কৃত চুক্তি থেকেও মুক্ত হয়ে গিয়েছিল, ফলে কার্যত ও আইনত স্বাধীন রাষ্ট্রেই পরিণত হয়েছিল তারা।

নিজাম উসমান স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের একটা কাঠামোও দাঁড় করে ফেলেছিলেন। নিজস্ব পতাকা, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, বিমান সংস্থা, রেলপথ, ডাকযোগাযোগ ব্যবস্থা, রেডিও স্টেশন, নিজস্ব মুদ্রা এমনকি সেনাবাহিনী পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়েছিল।

ভারত যেভাবে দখল করে

হায়দারাবাদের চতুর্দিকে ছিল ভারত। নিজাম উসমান যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন, এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে লাগলেন, ভারত কোনোভাবেই এটাকে মেনে নিলো না। আবার প্রাথমিক পর্যায়ে বহির্বিশ্বের সমালোচনার ভয়ে সরাসরি আক্রমণের ভয়ে দখলেও নিতে পারছিল না। তাই প্রথমে কৌশলের আশ্রয় নেয় তারা। হায়দারাবাদের শাসক নিজামের সাথে ‘স্ট্যান্ড স্টিল’ চুক্তি করে। এ চুক্তি মুতাবেক হায়দারাবাদ পরবর্তী এক বছরের মধ্যে কোনো ধরনের মিলিটারি অ্যাকশন নেবে না, এবং নিজেদেন সেনাবাহিনীকেও সমৃদ্ধ করবে না। পাশাপাশি পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবারও কোনো ফিকির করবে না।

এই চুক্তির মাধ্যমে হায়দারাবাদকে সবরকমের সামরিক শক্তি জোগাড় ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা থেকে বিরত রাখে ভারত। আর এদিকে নানা পন্থা ও কৌশলে হায়দারাবাদের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তোলে। সেখানকার হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যে সম্প্রীতি ছিল যুগ যুগ ধরে, সেই সম্প্রীতিতে ফাটল ধরিয়ে পরস্পরকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করায়। বাঁধে দাঙ্গা। এই দাঙ্গাকে হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের আক্রমণ বলে প্রচার করা হয় ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোতে। ভারতের হিন্দুদের মধ্যে এতে তুমুল প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় এবং হায়দারাবাদের হিন্দুদের ‘বাঁচাতে’ সারা ভারতে জোর আওয়াজ ওঠে।

ভারত সরকার এ সুযোগটারই অপেক্ষা করছিল। হিন্দুদের ‘রক্ষা’ করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু হায়দারাবাদে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন।

এদিকে ‘স্ট্যান্ড স্টিল’ চুক্তির ফলে হায়াদারাবাদ তাদের মিলিটারিকে সেরকমভাবে উন্নত করেনি বা করতে পারেনি। ফলে সেসময় তাদের মাত্র ২৪ হাজার নিয়মিত সৈনিক ছিল, যাদের মধ্যে মাত্র ৬ হাজার ছিল সশস্ত্র এবং এই অস্ত্রের বেশ বড় একটি অংশ ছিল মাজল লোডার রাইফেল। এই ছোট্ট বাহিনীকে ভারতীয় সেনাবাহিনী মেজর জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রায় ৩৫ হাজার প্রশিক্ষিত সেনা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ট্যাংক, আর্টিলারি ও এয়ার সাপোর্টের আন্ডারে ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে আক্রমণ করে। এ আক্রমণের ফলাফল কী হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। নিজামের বাহিনী মাত্র ৫ দিনে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে হেরে যায়। ১৮ সেপ্টেম্বর নিজাম উসমান আলী খান রেডিওতে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেন। হায়দারাবাদ আর্মি চিফ মেজর জেনারেল সৈয়দ আহমেদ আল ইদ্রিস তার ২৪,০০০ সৈন্য নিয়ে জেনারেল জয়ন্ত নাথের কাছে আত্মসমর্ণ করেন। কিন্তু এই পাঁচদিনে হায়দারাবাদের মুসলমানদের ওপর কেয়ামতের বিভীষিকা নামিয়েছিল ভারতীয় বাহিনী।

হায়দারাবাদে কেয়ামতের বিভীষিকা

হায়দারাবাদের নিজাম ছিলেন একজন মুসলমান এবং অঞ্চলটি হওয়ার কথা ছিল একটি মুসলিম রাষ্ট্র। তাই স্বভাবতই সেখানকার সামরিক বাহিনীতে মুসলিমদের সংখ্যাই বেশি ছিল। কিন্তু হায়দারাবাদ হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল বলে সেনাবাহিনীতে হিন্দুদের সংখ্যাও কম ছিল না। সেনাবাহিনীতে মাত্র ৫৫ শতাংশ মুসলিম ছিল আর বাকি অংশ ছিল হিন্দু বা কিছু খ্রিষ্টান। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হওয়ার পরে সেনাবাহিনী মুসলিমদের নিরস্ত্র করলেও হিন্দু সৈনিকদের নিরস্ত্র করেনি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এই আক্রমণ করা হয়েছিল মূলত হিন্দুদের উপর অত্যাচারের কথা বলে, আর ভারতীয় সেনাবাহিনী এখানে এই বিষয়টিকেই কাজে লাগিয়ে মুসলমান নিধনে নামে। তারা এসব ঘটনা বলে সশস্ত্র হিন্দুদের এর বদলা নিতে উৎসাহিত করে। আর বদলা নেয়ার অন্যতম মাধ্যম ছিল মুসলিমদের হত্যা করে সম্পদ লুটপাট আর ধর্ষণ। এই কর্মকান্ডে ভারতীয় সৈন্যরাও সরাসরি অংশগ্রহণ করে। সৈন্যরা প্রথমে এলাকার সকল পুরুষকে একত্রে গ্রেফতার করে একজায়গায় এনে হত্যা করত তারপর তাদের বাড়িতে গিয়ে মহিলাদের গণধর্ষণ করত এবং তাদেরও হত্যা করা হতো।

পাঁচদিনের এ যুদ্ধে এভাবে কত মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল, তার সঠিক পরিসংখ্যান আজ অবধি পাওয়া যায়নি। ভারত সরকারের প্রতিবেদন অনুযায়ীই এ সংখ্যা চল্লিশ হাজার বলা হয়েছে। আর বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, এটা ২ লাখেরও উপরে।

বর্তমানে মুসলমানদের স্বপ্নের সেই উসমানিস্তানকে ভারতের তিনটি প্রদেশ—অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের সঙ্গে একীভূত করে মুসলিম শাসনের শত শত বছরের ইতিহাসকে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে।

তথ্যসূত্র :
উইকিপিডিয়া
রোর বাংলা
হায়দ্রাবাদ দখলের ইতিহাস, জিবলু রহমান


মুসান্না মেহবুব
সূত্রঃ fateh24