পাশ্চাত্য ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র (৬ষ্ঠ পর্ব) – শায়খ আব্দুল্লাহ আযযাম (রহঃ)

কাঙ্খিত সমাধান

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআলা বলেন-

أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ ۖ وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِن دُونِهِ ۚ وَمَن يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ [٣٩:٣٦]

وَمَن يَهْدِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِن مُّضِلٍّ ۗ أَلَيْسَ اللَّهُ بِعَزِيزٍ ذِي انتِقَامٍ [٣٩:٣٧]

وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ ۚ قُلْ أَفَرَأَيْتُم مَّا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ ۚ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ ۖ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ [٣٩:٣٨]

“আল্লাহ্ কি তার বান্দার জন্যে যথেষ্ট নয়? তারা আপনাকে তাদের কথিত উপাস্যদের ভয় দেখাচ্ছে। আল্লাহ যাকে পথ ভ্রষ্ট করেন, তাকে পথ দেখানোর কেউ নেই। আর আল্লাহ্ যাকে পথ দেখান, তাকে পথ ভ্রষ্ট করার কেউ নেই। আল্লাহ কি ক্ষমতাধর ও প্রতিশোধ গ্রহণকারী নন ? যদি আপনি তাঁদেরকে প্রশ্ন করেন যে, পৃথিবী ও আকাশ সমূহকে কে সৃষ্টি করেছে  ? তাহলে তাঁরা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। এখন তাঁদের বলুন যে, তোমরা আল্লাহকে ছাড়া যাদেরকে ডাক, তারা কি আল্লাহ্ আমার কোন ক্ষতি করতে চাইলে, সে ক্ষতি দূর করতে পারবে কিংবা যদি আল্লাহ্ আমার প্রতি কোন অনুগ্রহ করেন, তা কি তাঁরা প্রতিরোধ করতে পারবে ? আপনি বলুন, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। ভরসাকারীরা তাঁর উপরেই ভরসা করে।”[যুমারঃ৩৬-৩৮]।

কাঙ্খিত সমাধান কী?

তোমাদের পরিচয় হচ্ছে তোমরা কাঙ্খিত সমাধান কামনা করছ। সে কাঙ্খিত সমাধান কী যা মানুষ তোমাদের  মাধ্যমে পেতে চাচ্ছে? যার কথা ইসলামী আন্দোলন কর্মীরা মাঠে-ময়দানে বলে বেড়াচ্ছে? যার জন্য তোমার মন অধীর অপেক্ষা করছে? সংক্ষেপে সমাধান কি এই নয় যে, পৃথিবীতে আল্লাহর আইনের শাসন নতুন ভাবে ফিরিয়ে আনা, যার কথা শায়খ বান্না তাঁর দাওয়াতের প্রথম থেকে বলে এসেছেন? খেলাফতের পতনের চার বছর পর শায়খ বান্না সে তড়িত আন্তরিক প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন, তা খেলাফতের সে প্রাসাদ পুনঃনির্মাণের জন্য যা ধূসর বাঘ মোস্তফা কালাম আতাতুর্ক ১৯২৪ সালের ৪থা মার্চ ভেঙ্গে তছনছ করেছিল।

অতএব, আমাদের এ দলবদ্ধ হওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য সে খেলাফতের প্রাসাদের পূর্ণনির্মাণই।

শায়খ বান্না বলতেন-

‘ভাইয়েরা ! তোমরা কোন রাজনৈতিক দল নও, তোমরা কোন সেবা সংঘঠনও নও এবং কোন দল বা কোন উদ্দেশ্যের জন্য গঠিত কোন সংস্থাও নও। তোমরা এ উম্মাহর মাঝে চলাচলকারী এক নতুন আলো, যা কুরআন দ্বারা এ উম্মাহকে জীবিত করবে এবং ইসলামের আলো দ্বারা জাহিলিয়াতের অন্ধকারকে দূরীভূত করবে’। অতএব, শহীদ বান্না ১৯২৮ সালে এ নতুন আলো যাকে ইসমাঈলিয়ায়* তাঁর পবিত্র আহবানের মাধ্যমে জ্বালিয়েছিলেন, তার লক্ষ্য ছিল চার বছর পূর্বে ধবংস করা খেলাফতের প্রাসাদকে পুনঃনির্মাণ করা।

খেলাফত কী?

আমরা ব্যক্তিগত ভাবে সবাই চাই নিজেকে রক্ষা করতে, জান্নাতে প্রবেশ করতে। অতএব, আমরা যে দু’উদ্দেশ্য তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও বেহেশতে প্রবেশ করার আশায় কাজ করছি, তার মত অন্যান্য মানবগোষ্ঠীও যাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে, সে জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা।

অর্থাৎ, পৃথিবীর কোন ভূখন্ডে কিছু লোক একজন নেতার নেতৃত্বে আল্লাহর আইন প্রয়োগ করা । আর এটাই হচ্ছে খেলাফত তথা ইসলামী রাষ্ট্র।

কাঙ্খিত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কয়েকটি ধাপ

এ ইসলামী রাষ্ট্র প্রথমে এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় দাঁড়িয়ে মানুষকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, “বল, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই”। এ কথা বলে তিনি মানুষকে তাওহীদের দিকে আহবান করেছিলেন। এ তাওহীদ তিন প্রকার। এক. তাওহীদুর রুবূবীয়্যাহ ‘পৃথিবী সৃষ্টি ও পরিচালনায় আল্লাহকে একক জানা ‘। দুই. তাওহীদুল উলুহীয়্যাহ ‘ ইবাদত পাওয়ার অধিকার আল্লাহর একক বলে জানা’। তিন. তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাত ‘ বিশেষ কিছু বিশেষণ ও গুণাবলীর অধিকারী একমাত্র আল্লাহই বলে বিশ্বাস করা ‘।

অতএব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাওয়াত যেমন তাওহীদ দিয়ে শুরু হয়েছিল, তদ্রুপ আমাদের দাওয়াতও শুরু হতে হবে তাওহীদের মাধ্যমে। ‘ তাওহীদুর রুবূবীয়্যাহ ‘ বলতে অন্তর ও মানসে স্থান লাভ করা চিন্তাগত তাওহীদকে বুঝায়। অর্থাৎ, তোমরা এ কথা স্বীকার করা যে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআলা সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, জীবনদাতা ও মৃত্যুদাতা এবং সবকিছু তাঁরই ইচ্ছায় হয়, তিনিই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাকারী, তিনি রক্ষা করেন এবং তাঁর কাছ থেকে রক্ষা করা যায় না ইত্যাদি। এ সবই হল চিন্তাগত তাওহীদ। এ তাওহীদ পূর্বের যুগের সকল কাফির ও মুশরিকদের মাঝে পাওয়া যেত।

যেমন আল্লাহ্ বলেন-

قُلْ مَن بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ [٢٣:٨٨]

سَيَقُولُونَ لِلَّهِ ۚ قُلْ فَأَنَّىٰ تُسْحَرُونَ [٢٣:٨٩]

“ বলুন, তোমাদের জানা থাকলে বল, কার হাতে সব কিছুর কর্তৃত্ব, যিনি রক্ষা করেন এবং যার কবল থেকে কেউ রক্ষা করতে পারে না? তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহর। বলুন, তাহলে তোমাদের কোথা থেকে যাদু করা হচ্ছে। ”

অতএব, শুধু ‘ তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ’ র স্বীকৃতি দানের জন্য আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেননি এবং এ জন্য কোন সময় কোন নবী ও প্রেরণ করেননি। মানুষের অন্তরে প্রাকৃতিক ভাবে সে ‘তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ’ লালিত থাকে, তাকে বাস্তব জগত তথা কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করার নামই ‘তাওহীদুল উলূহিয়াহ’। অতএব, ‘তাওহীদুল উলূহিয়াহ’ হচ্ছে কর্মগত তাওহীদ। প্রথম প্রকার তাওহীদ দ্বারা আল্লাহকে তাঁর কর্মের ক্ষেত্রে একক বলে জানা হয়। আর দ্বিতীয় প্রকার তাওহীদ দ্বারা আমাদের কর্মগুলো একমাত্র আল্লাহর জন্য এ কথার স্বীকৃতি দেয়া হয়। অতএব, আমরা নামায ও রোযা থেকে শুরু করে যে কোন কাজই করি না কেন তা একমাত্র আল্লাহর জন্যই করব।

এ বিষয়টিকে কুরআন চিত্রিত করেছে এভাবে-

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ [٦:١٦٢]

لَا شَرِيكَ لَهُ ۖ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ [٦:١٦٣]

“বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী এবং আমার জীবিত থাকা ও মৃত্যুবরণ (অর্থাৎ,সবকিছুই) আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের জন্য নিবেদিত। কোন ক্ষেত্রে তাঁর কোন অংশীদার নেই আর তাঁর জন্য অংশীদার সাব্যস্ত করা থেকে পবিত্র থাকার জন্যেই আমি আদিষ্ট এবং আমি সর্বপ্রথম মুসলিম। ”[আনআমঃ১৬২,১৬৩]।

তাওহীদুল আসমা ওয়াসসিফাতের অর্থ হচ্ছে কুরআন ও সহীহ হাদীসে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআলার যে সব সুন্দর নাম ও মহৎ গুণাবলীর কথা উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো কোন প্রকার বিকৃতি, অস্বীকৃতি, অপব্যাখ্যা ও সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যকরণ ছাড়া মেনে নেয়া । কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর নামগুলো দ্বারাই আমরা আল্লাহকে ডাকব। এতে কোন কিছু বৃদ্ধিও করব না, কমাবও না। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআলা নিজেকে জব্বার বলে অভিহিত করেছেন। অতএব, আমরা তাঁকে জাবের বলে অভিহিত করব না। আবদুল জব্বার নাম রাখা জায়েয। কিন্তু আবদুল জাবের নাম রাখা জায়েয নেই। কারণ, জাবের নামে আল্লাহর কোন নাম নেই। অনুরূপ হাদীসে এসেছে আল্লাহ্ সাতীর অর্থাৎ আল্লাহ্ (বান্দার গুনাহ) ঢেকে রাখেন। অতএব, আমরা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে সাতীর নামে অভিহিত করব না।

অনুরূপ আমরা আল্লাহর জন্য নিজের পক্ষ থেকে নামও তৈরী করব না। যেমন ধরুন কুরআনে আছে “আল্লাহ্ আরশে উপবেশন করেছেন”। কিন্তু তাই বলে আমরা আল্লাহকে উপবেশনকারী নামে অভিহিত করতে পারি না। ইমাম ইবনে হাযম বলেছেন-

‘ সমগ্র উম্মাহ এ ব্যাপারে একমত যে, কারো জন্য কাউকে আবদুল মুস্তাবী নামে অভিহিত করা জায়েয নেই এবং এ কথা বলাও জায়েয নেই যে, হে মুস্তাবী আমাকে সাহায্য করুন’।

তাওহীদের এ দাওয়াতকে মক্কায় কিছু লোক গ্রহণ করেছিলেন। ফলে জাহিলিয়াত তাঁর সর্বশক্তি নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিল, তাদেরকে বিতাড়িত করেছিল, দেশান্তর করেছিল, ক্ষুধার্ত রেখেছিল, শেষ পর্যায়ে মারধর করেছিল। এসবের সামনের যারা ঝরে পড়েছে, তারা ঝরে পড়েছে ও যারা মুরতাদ হয়েছে, তারা মুরতাদ হয়েছে। শেষ পর্যায়ে আল্লাহ্ অবশিষ্ট দৃঢ়পদ ও ধৈর্য্যধারণকারীদের জন্যই পথ খোলা রেখেছিলেন এবং তাদেরকে পৃথিবীর কর্তৃত্ব দান করেছিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চারপাশে যখন দৃঢ়পদের একদল মানুষ সংগঠিত হল, তখন তিনি এমন একটি ভূখন্ড খোজা শুরু করলেন, যেখানে তিনি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করবেন এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন। এ উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গোত্রের কাছে আবেদন জানালেন যে, কে আমাকে আল্লাহর দ্বীন প্রচারের জন্য জায়গা দিবেন? আল্লাহর হুকুমে মদীনার আওস ও খাযরাজ গোত্রের কিছু সর্দার তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এলেন, যারা আকাবার রাত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এ সাহায্য তিনি লাভ করেছেন তাঁর দাওয়াতী যিন্দেগীর বার বছর পর। আল্লাহর হুকুমে তিনি মদীনায় চলে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে শুরু হল জিহাদ।

আল্লাহ এ ব্যাপারে বলেন-

أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ [٢٢:٣٩]

“যাদের সাথে যুদ্ধ বাঁধানো হচ্ছে, তাদেরকে যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হল। কারন, তারা নির্যাতিত। আর আল্লাহ্ তাঁদেরকে বিজয়ী করার ক্ষমতা রাখেন। ”[হজঃ৩৯] ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় উদ্দেশ্য সফলকরণে একটি পরিকল্পনা আটলেন। আর তা হচ্ছে মহা মূর্তি তথা কুরাইশদের মূর্তিকে ধবংস করা। যখন কুরাইশদের মূর্তি ভেঙ্গে যাবে এবং তাঁদের প্রতিরোধ শেষ হয়ে যাবে, তখন মানুষ আল্লাহর দ্বীনে দলে দলে প্রবেশ করবে। তাই তিনি তাঁর চতুষ্পার্শ্বের ইয়াহুদীদের সাথে কতিপয় চুক্তি করলেন। এরপর তিনি কুরাইশকে প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলেন। অতঃপর কুরাইশদের সাথে তাঁর যুদ্ধ শুরু হয়। কুরাইশদের সাথে যুদ্ধের এ পথে তিনি বানু কাইনুকার উপর আঘাত হানলেন, বানু নাযীরকে দেশান্তর করলেন এবং বানু কুরাইযাকে হত্য করলেন। কিন্তু যে শত্রুকে মূল টার্গেট বানিয়েছেন এবং যাকে দমন করার জন্য রাত দ্বীন পরিকল্পনা করেছেন, সে হচ্ছে কুরাইশ। অতঃপর তিনি কুরাইশদের উপর বিজয় লাভ করলেন। এ সময় ইসলামী বিধি বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হচ্ছিল এবং এগুলোকে পর্যায়ক্রমে মুসলিম সমাজে প্রয়োগ করছিলেন কুরআন অবতরণ শেষ হল এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠাকামী মানবতার জন্য আদর্শ হিসেবে পৃথিবীর একটি অঞ্চলে ইসলামী শাসন বাস্তবায়ন করে দেখানো সম্পন্ন হল। অতঃপর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআলা তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন পুনরায় প্রতিষ্ঠার যত আন্দোলন পরিচালনা করা হোক, তা ঐ পথের অনুসরণের মাধ্যমে করতে হবে, যে পথে আল্লাহ্র দ্বীন প্রথম বার কায়েম হয়েছিল।

তাওহীদের দিকে আহবান সাময়িক। তাওহীদের চতুষ্পার্শ্বে মানুষ সংগঠিত হওয়ার পর জ্বালানো হয়েছে জ্বিহাদের আগুন। অতঃপর মানুষ এ আগুনের চতুষ্পার্শ্বে ক্রমান্বয়ে জড়ো হওয়া শুরু করে। আর এ জ্বিহাদই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের প্রধান বাহন হিসেবে রয়ে যায়। আন্দোলনের এ পথে তাঁর অনেক কর্মী শহীদ হন। এর নেতৃত্বে কিছু লোক দৃঢ়পদ থাকে।মানুষ আস্তে আস্তে তাদের কাছে এসে ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। যখন তাঁরা বাতিলের উপর বিজয় লাভ করেন, তখন মানুষ আল্লহর দ্বীনে দলে দলে প্রবেশ করতে শুরু করে।

জ্বিহাদ যে ইসলামী আন্দোলনের অবকাঠামোর একটি অংশ ও স্তম্ভ সমূহের একটি স্তম্ভ না হবে, সে ইসলামী আন্দোলন ইসলামী আন্দোলন নয়; তা একটি সেবা সংস্থা, যা এতীম, বিধবা ও মিসকীনদের সাহায্য করে বা সচ্চরিত্র ও ধুমপান ত্যাগের প্রতি আহবান জানায়।

অতএব, জিহাদ ইসলামী আন্দোলনের অবকাঠামোর অন্যতম উপাদান ও স্তম্ভ হওয়া অপরিহার্য। নতুবা ইসলামী আন্দোলন অন্ধকারে থেকে যাবে এবং কোন দিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ, আল্লাহর শত্রুদের পক্ষে তো তোমাকে ক্ষমা করা সম্ভব নয়, তারা তোমার সাথে অবশ্যই লড়বে। অতএব, তুমি যদি শক্তিশালী না হও, তাহলে তোমাকে নেকড়ে খেয়ে বসবে।

আধুনিক যুগে আমরা শায়খ বান্নার ইসলামী আন্দোলনকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। দেখুন, তিনি কীভাবে ইসলামের বিধানকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে গেছেন। প্রথমে তিনি তাওহীদের উপর প্রশিক্ষন দিয়েছেন। অতঃপর জ্বিহাদের আগুন জ্বেলেছেন। অতঃপর জনসাধারণ তাঁর দাওয়াতকে সমর্থন জানাল।

কারণ, জনগণের সমর্থন না পেলে ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে একা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কারণ, রণাঙ্গন খুব দীর্ঘের এবং ত্যাগের প্রয়োজন অত্যাধিক আর ইসলামী আন্দোলনের সন্তানরা সংখ্যায় কম। আর ভাল জিনিস কমই থাকে। অতএব, যারা জ্বিহাদের চিন্তা বাদ দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের কর্মী জনসংখ্যার শতকরা দশ ভাগ বা বিশ ভাগে পৌছার অপেক্ষা করে এবং বলে যে, শতকরা দশ কিংবা বিশ ভাগ জনগণ যখন ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হবে, তখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব, তারা সমাজের প্রকৃতি, দাওয়াতের নীতি ও পৃথিবীতে আল্লাহর রীতি ও নিয়ম উপলব্ধি করে না । ইসলামী আন্দোলনের কর্মী সংখ্যা জনসংখ্যার একশ ভাগের পাঁচ কিংবা দশ ভাগে এসে পৌঁছা কখনো সম্ভব না, এটা অবাস্তব স্বপ্ন কিছুই নয়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীদের দিকে দেখুন। মক্কার তের বছরে তাঁদের সংখ্যা ছিল শতের কাছাকাছি। জিহাদের পথে অগ্রসর হওয়ার পর বদরে গিয়ে তাঁদের সংখ্যা দাঁড়াল ৩১৩ (তিনশ তের) জনে। উহুদে গিয়ে তাঁদের সংখ্যা দাঁড়াল ৭০০ (সাতশ) এ। হুদাইবিয়ার গিয়ে তাঁদের সংখ্যা এসে উপনীত হয় ১৪০০ (চৌদ্দশ) এ । মক্কা বিজয়ের দিন তাঁদের সংখ্যা এসে উপনীত হয় ১০০০০ (দশ হাজার) এ। কেন এত বিরাট পার্থক্য । ষষ্ঠ হিজরীতে হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় সাহাবীদের সংখ্যা ছিল ১৪০০। কিন্তু মক্কা বিজয়ের দিন দশ হাজার হল। কীভাবে? এর কারণ, যুদ্ধে হেরে কুরাইশরা তাঁদের দম্ভ অহংকারকে খুইয়ে স্বীকার করে নিল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই কর্তৃত্বের অধিকারী। তাই তাঁরা তাঁর হাতে কর্তৃত্বের চাবি তুলে দিতে বাধ্য হয়। হুদাইবিয়ার সন্ধি আরব দ্বীপে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাজনৈতিক প্রভাব বহুগুণে বৃদ্ধি করল। ফলে মানুষ আল্লাহর দ্বীনে দলে দলে প্রবেশ করা শুরু করল। কারণ, মানুষের ইসলাম গ্রহণে কুরাইশদের দম্ভ ও আল্লাহর দ্বীনের সাথে তাঁদের শত্রুতা বড় বাঁধা ছিল। অতঃপর যখন হুদাইবিয়ার সন্ধির মাধ্যমে কুরাইশরা তাঁদের দম্ভ অহংকার থেকে হটে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে চুক্তি করতে বাধ্য হল, তখন জনসাধারণ  মনে করল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিজয় অনিবার্য। ফলে তাঁরা ব্যাপক ভাবে ইসলামে দীক্ষিত হতে শুরু করে। অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয় হল এবং কুরাইশরা পরাজয় স্বীকার করে নিল। মক্কা বিজয় রমযানে হয়েছিল। নবম হিজরীর জুমাদাল উখরা বা রজব মাসে তথা মক্কা বিজয়ের নয় মাস পর তাবূক অভিযান পরিচালিত হয়। মুসলমানদের সংখ্যা মক্কা বিজয়ের দিন দশ হাজার ছিল। কিন্তু তাবুক অভিযানের সময় মুসলমানদের সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ত্রিশ হাজারে। বিপুলভাবে বর্ধমান এ সংখ্যা যুদ্ধ সমূহে মুসলমানদের বিজয়েরই ফল। দশম হিজরীর শেষের দিকে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ করতে গিয়েছিলেন, তখন মুসলমানদের সংখ্যা এসে পৌঁছে এক লক্ষ চৌদ্দ হাজারে।

তুমি শক্তিশালী না হলে মানুষ তোমার পক্ষ নিবে না। দুর্বলতা ও কষ্টের সময় গণ মানুষের পক্ষে তোমার সাথে এসে দাঁড়ানো কল্পনাতীত ব্যাপার। কারণ, গণ মানুষ অবস্থা দেখেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আল্লাহ বলেছেন-

“যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এসে গেল, আর আপনি মানুষকে দেখছেন, তারা আল্লাহর দ্বীনে দলে দলে প্রবেশ করছে।”

আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের পরই মানুষ আল্লাহর দ্বীনে গণহারে দীক্ষিত হয়। দুর্বলতা ও কঠিন পরিস্থিতির সময় কেবল সেসব দুর্লভ ও অনন্য সাধারণ লোকেরা তোমার পাশে থাকবে, যারা ত্যাগ ও মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকে ।

ইখওয়ানের অর্জিত অভিজ্ঞতা সমূহ

শায়খ বান্না এ নীতি কীভাবে প্রয়োগ করেছেন দেখুন। তিনি ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উৎখাতের ষড়যন্ত্র দেখে সেখানে তিনি তাঁর পক্ষ থেকে কয়েকটি দল পাঠান। শহীদ বান্না তাঁর আন্দোলন নিয়ে প্রকাশ্যে মাঠে না আসার পূর্ব থেকে ইংরেজ ও ইয়াহুদীরা তাঁর আন্দোলন নিয়ে ভীষণ আশঙ্কায় ভুগছিল। যখন দেখা গেল তাঁর আন্দোলনের কর্মীরা অস্ত্রধারণ করে তাঁদের মুখোমুখি হচ্ছে, তখন গোটা পশ্চিমা বিশ্বে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়।

আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যার নাম এখন আমার মনে আসছে না, কিছু পত্রিকা সংরক্ষিত আছে, যেগুলোতে শহীদ বান্নার নিহত হওয়ার ছবি আছে এবং নীচের ক্যাপশনে এ কথা লেখা আছে যে, আজ বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর লোকটি নিহত হল। এ সংবাদ শুনেই সাইয়েদ কুতুব ইখওয়ানুল মুসলিমীনের আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাতে যোগদান করেন। বান্নার শাহাদাতে যখন আমেরিকাকে তিনি আনন্দ প্রকাশ করতে দেখলেন, তখন তিনি ভাবলেন, তার দাওয়াত অবশ্যই সত্যের উপর ছিল। না হলে তাঁকে নিয়ে বিশ্বের ইসলামের শত্রুদের এত মাথা ব্যথা কেন?

এ ইসলামী আন্দোলনই ফিলিস্তিনের বুকে সাড়া জাগানো একমাত্র আন্দোলন। এ আন্দোলন অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে ও উন্নত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এমনকি ডায়ান পর্যন্ত মা’রূফ হাদারীকে বন্দী বিনিময়ের দিন এ কথা বলেছিল যে আজকে আমরা আপনাকে বিনিময় হিসেবে মিশরীয়দের কাছে হস্তান্তর করছি। মারূফ হাদারী ফিলিস্তিনে গ্রেফতাঁর হওয়া ইখওয়ান নেতা ছিলেন। মা’রূফ হাদারী তাঁকে বললেন, আমি আপনার কাছে একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই যে, আপনারা সবার ক্যাম্পে হামলা চালালেও ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ক্যাম্পে কেন হামলা চালাননি ? ডায়ান বলল, আমরা তো বাঁচার জন্য এসেছি। আর ইখওয়ানুল মুসলিমীন এসেছে মরার জন্য। যারা মরতে চায় তাঁদেরকে পরাজিত করা অসম্ভব। তাই আমরা তাঁদের ক্যাম্পে হামলা করিনি।

শায়খ বান্না ফিলিস্তিনে ইয়াহুদীদের উপর বিজয় লাভ ও তাতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে মিশর থেকে দশ হাজার যুবক পাঠানোর ইচ্ছা করেছিলেন। এর ফলে আরব রাজা ও স্বৈরাচারীদের সিংহাসনগুলোর একের পর এক পতন হত। কিন্তু তিনি ভুলবশত আরব লীগের শীর্ষ বৈঠকে এ মর্মে টেলিগ্রাম পাঠান যে, আমি দশ হাজার যোদ্ধা নিয়ে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে চাই। অতএব, আমাকে অনুমতি দিন। এরপর থেকে তাঁর বিরুদ্ধে অবিরাম ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। আমেরিকার প্রতিনিধিত্বকারী রাষ্ট্রদূতরা তথা আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত একত্রিত হয়ে ১৯৪৮ এর ৬ ডিসেম্ভর ইখওয়ানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অতঃপর ইখওয়ান কর্মীদের কারাগারে নিক্ষেপ শুরু হয় । শায়খ বান্নাকে বাইরে রাখা হয়। অতঃপর এর দু’মাস শেষে তাঁকে হত্যা করা হয়।

ওই সময় আমরা পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে ফিলিস্তিনকে ইয়াহিদী মুক্ত করতে পারতাম। সে সময় ইসলামী আন্দোলন সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল। সে সময় মিশরের ইসলামী আন্দোলনের বীর সন্তানরা সানাই উপত্যকা অতিক্রম করে খান ইউনুসে পৌঁছে যেতে পারত এবং শত্রুদের পরাজিত করে গোটা ফিলিস্তিনের ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করে যেত। কিন্তু ফিলিস্তিনের ব্যাপারে শায়খ বান্নার সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক দেরী হয়ে যায়। ফলে আমরা সফলকাম হতে পারিনি। এরপরও আমরা কিছু মুজাহিদ ও কিছু শহীদদের পেশ করে আল্লাহর কাছে কৈফিয়ৎ দিয়েছি।

ফিলিস্তিন যাতে মুক্ত না হতে পারে, সে জন্য ইসলামী আন্দোলনের উপর দমন নিপীড়ন শুরু হয়ে যায়। শহীদ বান্নার নিহত হওয়ার দু’দিন পর রূডস চুক্তি সম্পন্ন হয় এবং মিশর ইয়াহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি দান করে।এর দশ দিন পর জর্ডান স্বীকৃতি দান করে। তার এক মাস পর সিরিয়াও স্বীকৃতি দেয়।

শায়খ বান্না থেকে বর্ণনা করে হয়েছে যে, তিনি প্রথমে মিশরেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। যখন ফারুক* ও তাঁর পেটুয়া বাহিনীর পক্ষ থেকে ইখওয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়, তখন তিনি ফিলিস্তিনে লোক পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধ বন্ধের জন্য নাফরাতীর চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পর ১৯৪৮-এর ডিসেম্ভরে তিনি শেষবারের মত যুবকদের ফিলিস্তিনে প্রেরণ করেন। শায়খ বান্নার সেক্রেটারী আবদুল বদী সাকার বলেন, আমরা সর্বশেষ দলকে ফিলিস্তিনে পাঠালাম। শায়খ বান্না তাঁদেরকে খুব উৎসাহের সাথে বিদায় দেন। অতঃপর তিনি আমাকে হাতে ধরে ইখওয়ানের অফিসের একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, ফিলিস্তিনতো শেষ হয়ে গেল। আমি বললাম, ফিলিস্তিনে পাঠানো এ যুবকদের রক্তের জন্য আল্লাহর কাছে আপনিই দায়ী থাকবেন। তখন তিনি বললেন, ওহে মিসকীন, আমি কোন যুবককে তাঁর ফরয দায়িত্ব পালন করতে যাওয়ায় বাঁধা দিতে পারি না। দ্বিতীয়ত আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা বলছে যে, ফিলিস্তিনে যা হবার হয়ে গেছে। তবে হতে পারে এ যুবকরা আল্লাহর ইচ্ছায় আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা বাতিলের ক্ষেত্রে একটি ভূমিকা পালন করতে পারে।

ফিলিস্তিনে পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমরা ফিলিস্তিনে সুযোগের যথাযথ সৎ ব্যবহার করতে পারিনি। এরপর আমাদের চলার পথ সংকুচিত হয়ে যায়। অবশ্যই প্রত্যেক ক্ষেত্রে আল্লাহর কোন না কোন হিকমত কার্যকর থাকে। এর কিছুদিন পর আরেকটি পরীক্ষা আসল সেটা ছিল সুয়েজ খালকে ঘিরে। ইখওয়ানরা সেখানে জ্বিহাদ করল এবং একমাত্র ইখওয়ানই ইংরেজদের সাথে দৃঢ়পদ থেকে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু তাতেও ইখওয়ানরা সুযোগের সৎ ব্যবহার করতে পারেনি। অতঃপর আবদুন নাসেরকে সৈন্যদের বিন্যাসের দায়িত্ব দেয়া হল। সে তাতে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হল না এবং এর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। সে সৈন্যদের মাঝে অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে এবং ইখওয়ানদের সাথে কুরআন শরীফ ধরে ওয়াদা করে যে, সে ক্ষমতায় আসলে কুরআন-সুন্নাহর বিধান বাস্তবায়ন করবে। একই সময় সে মার্কিন দূতের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, সে ক্ষমতায় আসার পর ইখওয়ানকে দমন করবে, আল আযহারকে নিশ্চিহ্ন করবে ও ইসরাঈলের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিবে। অতঃপর সে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসে।

অভ্যুত্থানের জন্য ইখওয়ানুল মুসলিমীন তার দশ হাজার সশস্ত্র কর্মীকে মাঠে নামিয়েছিল এবং আবদুন নাসেরের পক্ষে রাজনৈতিক প্রচারণা চালিয়েছিল। তারা তাঁর ক্ষমতার খুঁটিকে গেড়ে দিল। কিন্তু যখন আবদুন নাসের তাঁর ক্ষমতার মসনদে ভাল ভাবে গেড়ে বসতে সক্ষম হল, তখন তাঁর সাঙ্গ-পাঙ্গকে নিয়ে ইখওয়ানকে যবাই করা শুরু করল। নেতৃত্ব যাদের হাতে থাকে, তাদের পরিশুদ্ধ ও বিশেষ গুণের অধিকারী হতে হয়। কারণ, তুমি তাঁদের হাতে মানুষের রক্ত, সম্মান ও সম্পদ তুলে দিচ্ছ। তাই এখানেও আমরা সফলকাম হলাম না। অভ্যুত্থান ইখওয়ানরাই ঘটিয়েছিল। অর্থাৎ, অভ্যুত্থানের নায়কদের পক্ষে প্রচারণা ও তাদেরকে জনপ্রিয় ইখওয়ানরাই করেছিল।

ফারুক তাঁর জীবনীতে লিখেছে যে, ইখওয়ানুল মুসলিমীনরাই তাঁর সিংহাসন উল্টিয়ে দিয়েছে। ঐ সময় বিদ্রোহের নেতারা তাঁদের হাতের পুতুল বৈ কিছু ছিল না। আমি যদি জাহাজের ক্যাপ্টেনকে নিষেধ না করতাম, তাহলে ইখওয়ানুল মুসলিমীন জাহাজকে সাগরের মাঝে নিয়ে আমাকে ফেলে দিত।

ইসলামী আন্দোলনকে দমন করা হল এবং পুরো মুসলিম বিশ্বে বরং গোটা বিশ্বে এ খবর ছড়িয়ে পড়ল। দমন, নির্যাতন ও হত্যার পর ইসলামী আন্দোলন আর উঠে দাঁড়াতে পারল না। কারণ, তার হৃদপিণ্ড ও মূল দেহ মিশরে ছিল। আর তাঁর কিছু কোণা জর্ডান ও সিরিয়া ইত্যাদিতে আন্দোলিত হচ্ছিল।কিন্তু যতক্ষণ হৃদপিণ্ড যিন্দা না থাকে ও দেহ শক্তিশালী না হয়, ততক্ষণ প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া কোন কাজ হয় না। গোটা দেহ আন্দোলিত না হলে একটি দুটি আঙ্গুলের আন্দোলনে কী হবে ?

সিরিয়াতে ইখওয়ানরা তাগুতের বিরুদ্ধে একাই লড়েছে। জনগণ তাঁদেরকে যথাযথ সমর্থন দেয়নি। সিরিয়ায় ইসলামী আন্দোলনের সন্তানদের ত্যাগ নজিরবিহীন, তাদের বীরত্ব ছিল অনন্য।

আফগান রণাঙ্গন

অতঃপর আফগানিস্তানের পরীক্ষা শুরু হয়। আফগানিস্তানের ইসলামী আন্দোলনের এ পরীক্ষা এখনও পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের জগতে অনন্য। এখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বই প্রথমে গুলি ছুড়েছেন, তারাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এরা রব্বানী, সাইয়াফ, হেকমতিয়ার। হেকমতিয়ারই কাবুলে ইসলামী আন্দোলনের সামরিক শাখার যিম্মাদার ছিলেন। আন্দোলনের প্রধান যিম্মাদার ছিলেন রব্বানীর সহকারী। সংগঠনের নাম ছিল আলজমইয়াতুল ইসলামিয়া। সাইয়াফ ছিলেন রব্বানীর সহকারী। অতঃপর সামরিক শাখার প্রধান হন ইঞ্জিনিয়ার হাবীবুর রহমান। তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকও। তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য সেনা কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করেন। আলহামদুলিল্লাহ সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। মিশরে আব্দুন নাসের নিয়ে ইখওয়ানের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। ইঞ্জিনিয়ার হাবীবুর রহমান সেনা কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করলেন। কিন্তু আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও হিকমতের কারণে এ ঘটনা ফাস হয়ে যায়।ফলে ইঞ্জিনিয়ার হাবীবুর রহমানকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। অতঃপর তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। আহমাদ শাহ মাসউদই ইঞ্জিনিয়ার হাবীবুর রহমানের নিকট সেনা কর্মকর্তাদের উপস্থিত করতেন। কারন, পাঞ্জশীরের অনেক লোকই সেনা কর্মকর্তা ছিল। কারাগার থেকে ইঞ্জিনিয়ার হাবীবুর রহমান তাঁর কাছে পত্র দিয়ে জানিয়েছিলেন, হেকমতিয়ারের সাথে সেনাকর্মকর্তাদের সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে। হেকমতিয়ার সেনাকর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করলেন। পরে তা ফাস হয়ে যায়। ফলে অভ্যুত্থান হতে পারেনি। পরে সরকার হেকমতিয়ারের পেছনে একজন সেনাকর্মকর্তা নিয়োগ করে। ফলে তাঁরা যখনই অভ্যুত্থান ঘটাতে চেয়েছেন তখনই ব্যর্থ হয়েছেন, কারণ, সরকার অভ্যুত্থানের জন্যে নির্ধারিত ব্রিগেডকে অভ্যুত্থানে সময়ের একদিন পূর্বেই কাবুল থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করত। এভাবে হেকমতিয়ারের তিনটি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরে হেকমতিয়ার সামরিক অপারেশন অব্যাহত রাখার উপর জোর দেন এবং আফগানিস্তানের কয়েকটি গ্রুপ পাঠান। ঐ গ্রুপে মওলবী হাবীবুর রহমান ড.মুহাম্মদ উমর ও আহমদ শাহ মাসউদ ছিলেন। ড.উমরকে পাঠানো হত বাদখশানে এবং আহমদ শাহ মাসউদকে পাঠানো হত পাঞ্জশীরে। আহমদ শাহ মাসউদই দাউদ সরকারের ট্যাংক পুড়িয়েছিলেন। ফলে ইসলামী আন্দোলনের সকল সন্তানদের ধরে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু তাঁদের এ প্রচেষ্টাগুলো আন্তরিক ও নিষ্ঠাপূর্ণ ছিল। তবে সে সময়ে এ প্রচেষ্টা পূর্ণ অভিজ্ঞতা ও পরিপক্কতার আলোকে ছিল না। এতে যারা বেঁচে যায়, তারা বেঁচে যায় আর যারা ধরা পড়ে তাঁরা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়। আন্দোলনের নেতাদের হত্যা অব্যাহত থাকে। তবে তা প্রকাশ্যে নয়; কৌশলে, লুকিয়ে। অতঃপর দাউদের অভ্যুত্থান ঘটল। দাউদের অভ্যুত্থানের পর গোলাম মুহাম্মদ নিয়াযী ও সাইয়াফকে কারারুদ্ধ করা হয়। গোলাম মুহাম্মদ আন্দোলনের আধ্যাত্মিক পিতা ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচিত হতেন। সাইয়াফ রব্বানীর সহকারী ছিলেন। হেকমতিয়ার ও রব্বানী রক্ষা পেয়ে পেশোয়ারে চলে আসেন। আন্দোলনের অর্ধেক বা অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। রব্বানী ও হেকমতিয়ার পেশোয়ারে বসে কতিপয় যুবকদের নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে লাগলেন। অতঃপর যখন তারাকীর অভ্যুত্থান ঘটল, তখন আলেমরা ফতোয়া দিলেন যে, সে কাফির তাঁর বিরুদ্ধে জ্বিহাদ ফরয। তখন লোকজন বিদ্রোহ শুরু করে। গ্রামের আলিমরা জ্বিহাদ শুরু করেন এবং সাধারণ লোকেরা তাঁদের পক্ষে অস্ত্রধারণ করে।

অতঃপর তাঁরা হয়তো হেকমতিয়ারের আলহিযবুল ইসলামীয়ে যোগ দিত নতুবা রব্বানীর আলজমইয়াতুল ইসলামিয়ায় যোগ দিত। এ দু’দলই জ্বিহাদের ময়দানে মূলস্তম্ভ বলে বিবেচিত হতে থাকে । এরপর সে দলগুলো জন্ম লাভ করেছে, তার কোন একটাই এ দু’দলের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারেনি। বছরের পর বছর জ্বিহাদ উন্নতি অর্জন করতে থাকে। তিন বছর পূর্বে ১৯৮৪-১৯৮৫ এ এক বছর কিছুটা শূণ্যতার সৃষ্টি হয় । অতঃপর জ্বিহাদ তাঁর পূণ্যময় যাত্রা অব্যাহত রাখে। এরপর যখন জিহাদ মুসলিম উম্মাহকে নাড়া দেয়া শুরু করে, পৃথিবীর প্রত্যেক মুসলমানের জন্য তা একটি জীবন্ত দৃষ্টান্তে পরিণত হয় এবং মুসলমানরা তা দ্বারা প্রভাবিত হওয়া ও তাঁর দিকে দলে দলে আগমণ করা শুরু করে, সৌদিআরব, কুয়েত ও আরব আমিরাত থেকে ব্যবসায়ীরা মুজাহিদ নেতাদের হাতে স্বহস্তে অর্থ প্রদান করতে আগমণ করে, তখন পশ্চিমারা তাঁদের হিসাব পর্যালোচনা শুরু করে।

জ্বিহাদ নিয়ে আমেরিকার রাজনীতি

এক ইয়াহুদী তাঁদের নেতাদের নিয়ে What We have Done? “আমরা কী করেছি?” শিরোনামে একটি রিপোর্ট পেশ করে। তাতে সে উল্লেখ করে যে, আমরা আমাদের শত্রুদের জাগ্রত করেছি। আমেরিকাসহ পশ্চিমারা চেয়েছিল রাশিয়া ও আফগানদের যুদ্ধের আগুনে নিক্ষেপ করতে। তারা চেয়েছিল তাঁদের প্রকৃত শত্রু আফগানিস্তান ও গতানুগতিক শত্রু রাশিয়ার ক্ষতি হোক। তারা আফগানিস্তান সমস্যার মাধ্যমে রাশিয়াকে চাপিয়ে রাখতে চায়। তাঁরা চায়, সবকিছুর সূত্র তাঁদের হাতেই থাকুক। আফগানিস্তান নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনা ছিল তিনটি। প্রথম পরিকল্পনা হচ্ছে, জিহাদ শুধু রাশিয়াকে ক্লান্ত করে রাখার উপর সীমাবদ্ধ থাকুক। দ্বিতীয় পরিকল্পনা হচ্ছে, সব কিছুর সূত্র আমেরিকার হাতেই থাকুক। তৃতীয় পরিকল্পনা হচ্ছে, মুজাহিদরা তাঁদের জিহাদের ফলাফলে না পৌঁছুক। কিন্তু সূতা তাঁদের হাত থেকে ছুটে যায়। তবে এর অনেক কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে মুসলমানদের জাগরণ, মুসলিম বিশ্ব থেকে আগত অর্থ ও জিয়াউল হকের উপস্থিতি অন্যতম। জিয়াউল হক সে মযলূম ব্যক্তি, যার মত লোক এ যুগের রাজনৈতিক অঙ্গনে আর আত্মপ্রকাশ করেনি। জিয়াউল হক আমেরিকার হাত থেকে ছুটে গেছেন। আমরা পাকিস্তানের মুসলমানদেরকে বলেছিলাম, আপনারা এ ব্যক্তির পাশে দাঁড়ান। আপনারা আর কী চান ? তিনি তো পৃথিবীর মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ও বিপদের পাশে তাঁর সব কিছু নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আফগানিস্তানে যখন ইসলামের বিজয় অর্জন হবে, তখন তা হবে আপনাদেরই বিজয় অর্জন। আর যদি আফগানিস্তানে ইসলামের পরাজয় ঘটে, তাহলে আপনারা পাকিস্তানীরাই পরবর্তী টার্গেট হবেন। আফগানিস্তানের জ্বিহাদের কারণেই কম্যুনিস্টরা পাকিস্তানে চুপ হয়ে বসে আছে। অতএব, আল্লাহ না করুন যদি মুজাহিদরা পরাজয় বরণ করে তাহলে কম্যুনিস্ট নেতারা আপনাদের লোক দিয়ে আপনাদের মাঝে নিশ্চিত বিপ্লব ঘটাবে। অতঃপর পাকিস্তানের মুসলমানরাই তাঁদের যবাইর স্বীকার হবে।

কিন্তু পাকিস্তানের মুসলমানরা জিয়াউল হকের মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেনি। আক্ষেপের বিষয় তাঁরা পাশ্চাত্যের প্রচার মাধ্যমের প্রচারণা ও জনপ্রিয়তা কামনা করে। অর্থাৎ, দূর থেকে তাঁরা এ অপবাদের ভয় করছে যে, তারা জিয়াউল হকের দালালি করছে।

জিয়াউল হক তাঁর শাহাদাতের কয়েক মাস পূর্বেই তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র টের পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর একজন কাছের বন্ধুকে বলেছিলেন যে, মার্কিনীদের পক্ষ থেকে আমাকে হত্যার সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করা হয়ে গেছে। জিয়াউল হকের মুখ থেকে সরাসরি শোনা একজন রাজনীতিকের নিকট আমি নিজেই শোনেছি যে, তিনি বলেছেন, আমাকে হত্যার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।

হয়তো এ কারণেই জিয়াউল হক তাঁর প্রতিটি সফরে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তাঁর সাথে রাখতেন, যাতে মরলে সেসহ মরেন। এ দ্বারা যেন তিনি মার্কিনীদের বলেছেন, তোমরা কি তোমাদের লোককেও বলি দিতে চাও ! আমি তো মরবই, সাথে সাথে তোমাদের একজনও আমার সাথে মরুক।

বাস্তবে আফগান জনগণ উদার ও বিশ্বাসভাজন। আমি উত্তর আফগানিস্তানে গিয়েছিলাম। দেখলাম জনসাধারণ আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। লোকজন ও শিশুরা জমিয়ত ইসলামীর প্রধান অধ্যাপক রব্বানীকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে তাঁর ছবি হাতে নিয়ে। রব্বানীর ছবির পাশে শোভা পাচ্ছে জিয়াউল হকের ছবি। বাস্তবেই আফগানরা তাঁকে আফগান জ্বিহাদের শহীদ বলে গণ্য করে। আর জিয়াউল হক নিহত হয়েছেন একমাত্র আফগান জ্বিহাদের কারণে। এখন হয়তো আমেরিকা জুনেজুর মত একজন দুর্বল রাজনীতিক অথবা শুকরের ন্যায় একজন পুতুল ও নষ্টা মহিলাকে ক্ষমতায় বসিয়ে আফগান জ্বিহাদের উপর আবারো তাঁর থাবা বিস্তার করতে সক্ষম হবে। ঐ মহিলার নাম বে নজীর । অর্থাৎ, লজ্জাহীনতায় যার কোন সদৃশ্য নেই । ‘বে’ অর্থ হচ্ছে ‘না’ ।